অন্তঃদহন পর্ব ৪৫

অন্তঃদহন পর্ব ৪৫
DRM Shohag

সৌম্য, সন্ধ্যা, ইরা, আসমানী নওয়ান, আকাশ সবাই ঢাকা এসেছে আজ। সকাল সকাল রওয়ানা দিয়েছিল। আসতে আসতে বিকাল হয়ে গিয়েছে। একটু রেস্ট নেয় সবাই। সন্ধ্যার পর আকাশ অফিসের কাজে বেরিয়ে গেলে সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে হসপিটাল আসে সন্ধ্যার চেকাপ করাতে।
সৌম্য মূলত সন্ধ্যার অপারেশনের জন্যই ঢাকা এসেছে। গতকাল রাতে নিয়াজের সাথে কথা বলেছে। এরপর আসমানী নওয়ানকে বললে তিনি-ও রাজি হয়। কিন্তু কেউ আকাশকে বলার সাহস-ই পায়নি। সবাই জানে আকাশ রাজি তো হবে না-ই। উল্টে শুধু রে’গে যাবে।
সৌম্য সন্ধ্যাকে নিয়ে নিয়াজের চেম্বারে বসে আছে। সৌম্য’র চোখেমুখে চিন্তা। সে এখনো দোটানায় ভুগছে। কখনো মনে হয়, সন্ধ্যার অপারেশন করাবেনা, আবার মনে পড়ে তার বোনুর কান্না। তার বোনু কতটা চায়, কথা বলতে। সে-ও তো চায়, তার বোনু কথা বলুন। সে তার বোনুর মুখে শুনতে চায় ভাইয়া ডাক। কিন্তু তার বোনুর কিছু হবে না তো? সবচেয়ে বড় কথা আকাশকে না জানিয়ে সৌম্য’র সাহসে কুলাচ্ছে না। আকাশ জানলে কতটা ক’ষ্ট পাবে, কতটা রিয়েক্ট করবে। সবমিলিয়ে সৌম্য’র মাথা ভনভন করে ঘুরছে। নিয়াজের ডাকে সৌম্য’র ধ্যান ভাঙে। মৃদুস্বরে বলে,

– জ্বি ভাইয়া!
নিয়াজ বলে,
– চিন্তা কর না। এখন আধুনিক যুগে এই সামান্য বিষয় নিয়ে কেউ এতো আপসেট হয়না। আকাশের ব্যাপার বাদ দাও। ও কিছু ব্যাপারে অবুঝ। কিন্তু তুমি তো বুঝদার।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্যদের কাছে যা সামান্য তার আর আকাশের কাছে সেটাই অনেককিছু। তার বোনু তার আর আকাশের কতটা দামি সেটা তারা অন্যদের কিভাবে বোঝাবে? মৃদুস্বরে বলে,
– আকাশ ভাইয়াকে না জানিয়ে বোনুর অপারেশন করার ব্যাপারটায় নিজেকে অপরাধী লাগছে নিয়াজ ভাইয়া। আকাশ ভাইয়া আমাদের ভুল বুঝবে সাথে অনেক ক’ষ্ট-ও পাবে।
নিয়াজ একবার সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সন্ধ্যার দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব। নিয়াজ একটু হেসে বলে,
– কিছুই হবে না তোমার। বুঝেছ সন্ধ্যা? সবসময় হাসবে। কারণ পরশুদিন থেকে তুমি আবার-ও কথা বলতে পারবে।
নিয়াজের কথায় সন্ধ্যার অদ্ভুদ অনুভূতি হলো। সত্যিই সে পরশুদিন থেকে আবার-ও কথা বলতে পারবে? কথাটা ভেবে সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটল।
নিয়াজ সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আকাশকে তুমি রাজি করাতে পারবেনা সৌম্য। কিন্তু সন্ধ্যার অপারেশনের পর আকাশ যখন দেখবে সন্ধ্যা কথা বলছে, তখন ও সব ভুলে যাবে। তাছাড়া আকাশ তার সন্ধ্যামালতীর জন্য যা পা’গ’ল। সন্ধ্যার কণ্ঠ শুনার পর, দেখ আকাশ সত্যি সত্যিই না পা’গ’ল হয়ে যায়। অন্য চিন্তা বাদ রেখে পারলে আগেভাগেই আকাশের জন্য পাবনায় একটা সিট বুক করে রাখো কিছুদিনের জন্য।
নিয়াজের কথায় সৌম্য কিছুটা শব্দ করে হেসে ফেলে। সন্ধ্যা একটু ল’জ্জা পায়। নিয়াজ মৃদু হাসল। চেয়ার থেকে উঠে সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– আমার সাথে এসো সন্ধ্যা। সৌম্য তুমি এখানেই বসো। আমি এক ঘণ্টার মাঝেই সন্ধ্যার সব চেক-আপ করিয়ে দিচ্ছি।
সৌম্য ছোট করে বলে, – আচ্ছা ভাইয়া।
সন্ধ্যা নিয়াজের পিছু পিছু যায়।

প্রায় দুইঘণ্টা পর নিয়াজ সন্ধ্যার রিপোর্ট এনে সৌম্যকে জানায় সন্ধ্যার সবকিছু ঠিক আছে। আগামীকাল সন্ধ্যার অপারেশন কনফার্ম। সৌম্য সন্ধ্যার রিপোর্টগুলো নিয়ে, সন্ধ্যাকে নিয়ে ক্যাশকাউন্টারে যায়। এরপর সন্ধ্যার অপারেশনের টাকা জমা দিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। সামনে রিহানকে দেখে সৌম্য, সন্ধ্যা দু’জনেই দাঁড়িয়ে যায়।
রিহান একবার সৌম্য’র দিকে তাকায়। আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। প্রায় কয়েকমাস পর আজ দেখা হলো। সৌম্য গ্রামে চলে গিয়েছে এটা রিহান জানতো। তবে তাদের মাঝে যোগাযোগ ছিল না। রিহান ঢোক গিলল। কতদিন পর সন্ধ্যাকে দেখল। সৌম্য সন্ধ্যার হাত ধরে এগিয়ে এসে রিহানের সামনে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,

– কেমন আছিস?
রিহানের দৃষ্টি সন্ধ্যার দিকে ছিল। সৌম্য’র কথায় দৃষ্টি সরিয়ে সৌম্য’র দিকে ফেলে। উত্তর করে,
– এইতো ভালো। তোরা? আর হসপিটালে এসেছিস যে! কারো কিছু হয়েছে?
সৌম্য উত্তর দেয়,
– বোনুর অপারেশন করাবো। তাই চেক-আপ করাতে এনেছিলাম।
রিহান অবাক হয়ে বলে,
– তুই যে বলতি সন্ধ্যা রাণীর অপারেশন করাবি না।
কথাটা বলে রিহান অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সন্ধ্যা অদ্ভুদভাবে তাকায় রিহানের দিকে। রিহানের বলা সন্ধ্যা রাণী কেমন যেন লাগলো। তবে সৌম্য অবাক হলো না। দেরিতে হলেও সে রিহানের মনের কথাটা ধরতে পেরেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

– নিয়াজ ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি। উনি ভরসা দিয়েছেন।
রিহান সন্ধ্যার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে,
– কথা বলার জন্য শুভকামনা সন্ধ্যা র…..
থেমে যায় রিহান। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তবে রিহানের কথায় সায় দিয়ে একটু হেসে মাথা নেড়ে বোঝায়, – ধন্যবাদ ভাইয়া।
রিহান সৌম্য’র দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আপডেট জানাস।
সৌম্য ছোট করে বলে,
– আচ্ছা। বিয়ে করছিস কবে?
কথাটা শুনে রিহান চুপ হয়ে গেল। দৃষ্টি ঘুরে গেল সন্ধ্যার দিকে। হঠাৎ-ই একটু হেসে বলে,
– তুমি চাও আমি বিয়ে করি?

রিহানের কথায় সন্ধ্যা অবাক হলো। তেমনি বিব্রতবোধ করল। রিহানের ব্যবহার কেমন যেন লাগছে। রিহানের ব্যবহারে অবাক না হলেও সৌম্য’র ভালো লাগলো না রিহানের কথা বলার ধরন। এগিয়ে গিয়ে একটি রিক্সা ঠিক করে সন্ধ্যাকে উঠিয়ে দিল। এরপর আবার-ও রিহানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– দেখ রিহান, আমার বোনুর স্বামী আছে। সবচেয়ে বড় কথা বোনু আর আকাশ ভাইয়া একে-অপরকে ভালোবাসে। তোর কাছে আমার রিকুয়েস্ট, বোনুকে দেখলে দৃষ্টি নিচে রাখবি। বোনুর উপর আকাশ ভাইয়ার দৃষ্টি ছাড়া অন্যদের দৃষ্টি আমার ভালো লাগেনা।
কথাগুলো বলে সৌম্য থামে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার-ও বলে,
– তুই প্লিজ বিয়ে করে নে। এই ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবি। আসছি।
কথাগুলো বলে সৌম্য আর এখানে দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় উঠে পড়লে রিক্সা চলতে শুরু করে।
রিহানের দৃষ্টি সৌম্য আর সন্ধ্যার চলন্ত রিক্সার পানে। দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা।

ঘড়ির কাটা তখন দশটার ঘরে। সৌম্য আকাশের ঘরে এসে ডিভানের উপর বসে আছে। সন্ধ্যা বিছানার এক কোণায় বসে আছে। আকাশ বিছানার একপাশে বসে একবার সৌম্য’র দিকে তাকায়, আরেকবার সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সৌম্যকে সেই তখন থেকে চুপ দেখে আকাশ গলা ঝেড়ে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– কিছু বলবে? না-কি আমার রুমে হাওয়া খেতে এসেছ?
সৌম্য বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– হাওয়া আমার রুমে-ও আছে। নিজেকে বেশি বড়লোক ভাবা বন্ধ করুন।
আকাশের চোখেমুখে বিরক্তি। সৌম্য ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সিরিয়াস হয়ে বলে,
– বোনুকে দুই দিনের জন্য ঘুরতে নিয়ে যেতে চাই।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,

– কোথায়?
সৌম্য ঢোক গিলল। মিথ্যা বলতে জিভ কাঁপছে। মৃদুস্বরে বলে,
– যেখানেই নিয়ে যাই। আপনি পারমিশন দিন।
আকাশ বলে,
– আমি সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে যাব। তুমি চিন্তা কর না। তুমি আর ইরা ঘুরে এসো।
আকাশের কথায় সৌম্য’র মুখে অসহায়ত্ব ভর করে। সন্ধ্যা, সৌম্য একে অপরের দিকে তাকালো। সৌম্য নিজেকে সামলে বলে,
– বোনু আপনার সাথে যেতে চায় না। আমার সাথে যেতে চায়।
কথাটা বলে সৌম্য ঢোক গিলল। সৌম্য’র কথা শুনে আকাশের কপাল কুঁচকে যায়। সাথে সাথে দৃষ্টি ঘুরে যায় সন্ধ্যার উপর। চোখ ছোট ছোট করে বলে,

– তুমি আমার সাথে যেতে চাও না সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। মাথা নিচু করে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, সে আকাশের সাথে যেতে চায় না। আকাশের রা’গ হয়। ধমকে বলে,
– আমার সাথেই যেতে হবে তোমাকে। একদম ভাইয়ের লেজ ধরেছ তো, খবর করব তোমার।
সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সৌম্য বিরক্ত হয়ে বলে,
– আপনি আমার বোনুকে ধমকাচ্ছেন কেন? দেখছেন না, বোনু সবসময় মন খারাপ করে থাকে। ও যা চাইছে সেটা ওকে দেয়া আপনার দায়িত্ব। উল্টে আপনি ওকে ধমকাচ্ছেন।
আকাশ একটু দমলো। আসলেই তার সন্ধ্যামালতী সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। প্রায় প্রতিদিন-ই কাঁদে। কারণটা অবশ্যই তার কাছে অপারেশনের আবদার। কিন্তু সে তো মানতে পারেনা। আকাশ হতাশ কণ্ঠে বলে,
– আমার সাথে গেলে কি প্রবলেম?
সৌম্য সাথে সাথে বলে,
– আপনাকে বোনুর পছন্দ হচ্ছে না।
আকাশ বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– কিহহহ?

আকাশের রিয়েকশন দেখে সৌম্য একটু হাসল। অতঃপর বলে,
– আমি অন্যকিছু মিন করিনি আকাশ ভাইয়া। দুই-একদিন বোনুর তার ভাইয়ের সাথে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করতেই পারে। আপনি নিষেধ করছেন। এতে বোনুর খারাপ লাগবে। সেটাই বুঝিয়েছি।
সৌম্য’র কথায় আকাশ শান্ত হলো। কি আর করার, ভাইপা’গ’ল বউ কপালে জুটলে বউয়ের খুশির জন্য এরকম একটু-আধটু সেক্রিফাইস করা-ই লাগে বুঝল। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,

– ঠিকআছে যেও। কিন্তু দুইদিনের পর আর এক সেকেন্ড-ও যেন লেট না হয়।
আকাশ রাজি হওয়ায় সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর সৌম্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা মনম’রা হয়ে বসে থাকে। ভীষণ ভ’য় লাগছে তার। আগামীকাল তার গলা অপারেশন। তার কিছু হবে না তো? সে সত্য-ই আবার-ও কথা বলতে পারবে তো? না-কি যেটুকু কথা বলার সম্ভাবনা আছে, সেটুকু-ও হারিয়ে ফেলবে? না-কি জীবনটাই হারিয়ে যাবে? আকাশের ভালোবাসা আবার-ও পাবে তো! না-কি সবই হারিয়ে ফেলবে?
কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। বুকটা ভার হয়ে আসছে।
আকাশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথা উঁচু করে সন্ধ্যাকে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়। দু’হাতে সন্ধ্যাকে আগলে নিয়ে বলে,

– কি হয়েছে সোনা বউ? আমি পারমিশন দিয়েছি তো। তুমি সৌম্য’র সাথে বেড়াতে যেও। আমি কিছু বলব না।
সন্ধ্যা ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশকে মিথ্যা বলে আরও বেশি খারাপ লাগছে। দলা পাকিয়ে কান্না আসছে। সন্ধ্যা এগিয়ে এসে দু’হাতে আকাশের গলা শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। আকাশ অবাক হলো সন্ধ্যাকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে। সে নিজে-ও দু’হাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরল। ভাবল, সন্ধ্যা আবার-ও অপারেশনের জন্য কাঁদছে। এই ব্যাপারে আকাশ কখনোই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আজ-ও দেখালো না। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে তার সন্ধ্যামালতী যখন কথা বলার জন্য এভাবে কাঁদে। চোখ বুজে আরও শ’ক্ত করে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করল,

– স্যরি!
বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দু’হাতে সন্ধ্যার কান্নাভেজা মুখ মুছে দেয়। এরপর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পরনে সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, গায়ে একটি সাদা শার্ট। আকাশ দু’হাতের শার্টের হাতা কনুইএর উপর পর্যন্ত ভাঁজ করে নিল।
এরপর এগিয়ে গিয়ে কাভার্ড থেকে তার গিটার এনে সন্ধ্যার দিকে বাড়িয়ে দিলে সন্ধ্যা আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– এটা ধর সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা আকাশের গিটারটি দু’হাতে ধরলে আকাশ এক সেকেন্ড-ও সময় ন’ষ্ট না করে সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা আর-ও অবাক হয়। আকাশ কিছু বলল না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। কেউ নেই ডায়নিং-এ। সবাই সবার রুমে। আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের বকুল গাছতলায় এসে সন্ধ্যাকে নামিয়ে দেয়। সন্ধ্যা আশেপাশে তাকায়। বাইরের সব লাইট বন্ধ থাকায় জায়গাটি অন্ধকার। তবে জ্যোৎস্নার আলোয় চারপাশ আলোকিত। আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যার দু’গাল আগলে ধরে মৃদুস্বরে বলে,

– প্লিজ সন্ধ্যামালতী আর কান্না কর না।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশের কথা মেনে ডানদিকে একটু মাথা কাত করে বোঝায়, সে আর কাঁদবে না। আকাশ মৃদু হেসে সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু আঁকে। এরপর সন্ধ্যাকে উল্টো ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে আকাশ সন্ধ্যার খোঁপা করা চুলগুলো খুলে দেয়। ফলস্বরূপ সন্ধ্যার খোলা চুলগুলো ঝরঝর করে পড়ে সন্ধ্যার হাঁটুর নিচে গিয়ে ঠেকে। আকাশ দু’পা পেছালো। চাঁদের আলোয় লম্বা চুলের সন্ধ্যাকে কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। আকাশের চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। আকাশ এগিয়ে এসে পিছন থেকে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যার কাঁধে ঠোঁট চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমার স্নিগ্ধপরী।

সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। আকাশ মৃদু হাসল। এরপর আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে কাঁচা মাটিতে বসে। আকাশ দু’পা ভাঁজ করে বসে সন্ধ্যাকে তার কোলে বসিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পিঠ আকাশের বুকে ঠেকেছে। আকাশ সন্ধ্যাকে দু’পাশ দিয়ে আগলে নিয়ে দু’হাতে সন্ধ্যার দু’হাত ধরে, গিটারটি বাজানোর স্টাইলে ধরে। এরপর সন্ধ্যার কাঁধে থিতনি ঠেকিয়ে সন্ধ্যার হাত দিয়ে গিটারে টুংটাং সুর তোলে।
সন্ধ্যা অবাক হয়। ভীষণ ভালো লাগছে। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আকাশ মৃদুস্বরে ডাকে,
– সন্ধ্যামালতী?

সন্ধ্যা সাথে সাথে ঘাড় ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকালে দু’জনের চোখাচোখি হয়। আকাশ দেখল সন্ধ্যার হাসি। আকাশের ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফোটে। সন্ধ্যার ঠোঁটে টুপ করে একটা শুকনো চুমু খায়। সন্ধ্যা সাথে সাথে সামনে ঘাড় ফেরায়। আকাশ সন্ধ্যার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে আড়চোখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে সন্ধ্যার হাত দিয়ে গিটারে সুর তুলে গাইতে শুরু করে,
– যত দেখি চোখ সরেনা তুই যে আমার চাঁদ
তোর হাসিতে হারিয়ে ফেলি চায়ের কাপের স্বাদ।
তুমি জ্যোৎস্না মাখা রাতে, আসো যদি বুকে
আমি তারা হয়ে আলো দেব তোমার দু’চোখে।

আশেপাশে বকুল ফুল ছড়িয়ে আছে। যা শুকানোর পথে। সন্ধ্যার মাথা নিচু। চোখের কোণে পানি জমেছে। আকাশ তাকে কেন এতো ভালোবাসে? আকাশের এতো ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে সে কি আকাশকে তার কণ্ঠ শুনাতে পারবে? যদি না পারে, এটুকু ভাবতেই সন্ধ্যার চোখের কোণ ঘেঁষে আবার-ও পানি গড়িয়ে পড়ে। পানির ফোঁটা আকাশের হাতের উপর পড়তেই আকাশের ধ্যান ভাঙে। গিটার বাজানো হাত থামিয়ে গিটারটি পাশে রেখে দেয়। এরপর দ্রুত সন্ধ্যাকে তার দিকে ফিরিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– কি হয়েছে সন্ধ্যামালতী? আবার কেন কাঁদছ? গান ভালো লাগেনি বউ?
সন্ধ্যা ভেজা চোখে আকাশের দিকে চেয়ে ইশারায় বোঝায়, ‘অনেক ভালো লেগেছে।’
আকাশ সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,

– তাহলে কাঁদছ কেন সোনা বউ?
সন্ধ্যা নাক টানলো। সে আকাশের মুখ বরাবর মুখ এনে দু’হাত আকাশের ঘাড়ে রাখে। আকাশ সন্ধ্যার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার কি হলো কে জানে, হঠাৎ-ই তাদের মাঝে দূরত্ব কমিয়ে আকাশের অধরে অধর মেলায়। আকাশ হতভম্ব হয়ে যায়। সন্ধ্যার করা কাজটিতে সে বড়সড় শক খেয়েছে। নিজের বিস্ময় চেপে আকাশ সন্ধ্যাকে তার দিকে টেনে নেয়।
প্রায় মিনিট পাঁচ পর সন্ধ্যা সরে আসতে চাইলেও পারলো না। আকাশ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে সন্ধ্যাকে। এক পর্যায়ে সন্ধ্যার মোচড়ামুচড়িতে আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যা ছাড় পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ল’জ্জায় দ্রুত আকাশের বুকে মুখ লুকায়।
আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যার ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফিসফিস কণ্ঠে বলে,

– সোনা বউ? ফার্স্ট টাইম, তোমার রেসপন্স বেস্ট ছিল।
আকাশের কথায় সন্ধ্যার ল’জ্জা বাড়ে। আকাশের দিকে আরেকটু চেপে যায়। আকাশ হাসল। হঠাৎ-ই সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে। সন্ধ্যাকে অবাক হলো। চুপচাপ আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
আকাশ সোজা তার ঘরে এসে সন্ধ্যাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা আটকে দেয়। এরপর বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার সামনে বিছানার উপর ডান পা তুলে বসে। দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে রেখে ডান হাতে একে একে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। সন্ধ্যা একবার আকাশের দিকে তাকায়, আরেকবার আকাশের শার্টের দিকে তাকায়। আকাশের মনোভাব বুঝতে পেরে সন্ধ্যার দৃষ্টি এলোমেলো হয়।
আকাশ তার শার্ট খুলে ছুড়ে ফেলল। যার স্থান হয় মেঝে।
এরপর সন্ধ্যা কিছু বোঝার আগেই আকাশ সন্ধ্যার কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে দেয়। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় তাকায়। দু’হাত তুলে সামনে ঢাকতে নেয়ার আগেই আকাশ তার দু’হাতে সন্ধ্যার দু’হাত আটকে দেয়। এগিয়ে এসে বামদিক থেকে সন্ধ্যার গলায় মুখ গুঁজে বলে,

– জানি আজ তোমার কোনো প্রবলেম নেই। তোমাকে এশার নামাজ পড়তে দেখেছি। তাই কিছু শুনছি না। বুঝেছ সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যার শরীর শিরশির করে ওঠে। চোখ বুজে ঢোক গিলল মেয়েটা। আকাশ ঠেলে সন্ধ্যাকে শুইয়ে দেয়। এরপর সন্ধ্যার মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত দৃষ্টি বুলিয়ে আকাশ ঢোক গিলল। আর এক সেকেন্ড-ও সময় ন’ষ্ট না করে এগিয়ে এসে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে মাতাল কণ্ঠে বলে,
– তুমিসহ তোমার সবকিছু অনেক বেশি সুন্দর সোনা বউ।
ল’জ্জায় সন্ধ্যা চোখমুখ খিঁচে নেয়। আকাশ থেমে নেই। ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দেয় তার সন্ধ্যামালতীকে। সময়ের পাল্লা যত বাড়ে, আকাশের উম্মাদনা তত বাড়ে। সন্ধ্যা কুঁকড়ে যায়। আকাশ বিড়বিড়িয়ে বলে,

– স্যরি সোনা বউ! অনেক ভালোবাসি তোমায়। আমার সব তুমি। আমার ভালোবাসা তুমি। শুধু আমার সন্ধ্যামালতী তুমি।
আকাশের এলোমেলো কণ্ঠে গোছানো আবেগী কথায় সন্ধ্যার চোখজোড়া ভিজে যায়। দু’হাতে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যার আশকারায় আকাশের ভেতরে জমানো উম্মাদনা আরও খানিক বাড়ে। সন্ধ্যা হাসফাস করে। একসময় আকাশের সাথে মিশে যায়। আকাশ নিজের সাথে সাথে তার সন্ধ্যামালতীকে অগোছালো করতে ব্যস্ত হয়। সন্ধ্যার কানের কাছে মুখ নিয়ে জড়ানো কণ্ঠে দু’লাইন গুনগুনিয়ে গায়,
আমার দেহের মাঝে মিশে যাওনা তুমি!
একি দেহ নিয়ে রবো তুমি আমি।
সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। শ’ক্ত করে আকাশকে জড়িয়ে ধরে।

পরদিন,
ঘড়িতে সময় সকাল ১০ টা। সন্ধ্যা একটি সাদা রঙের কাজ করা শাড়ি পরেছে। মাথায় হিজাব বাঁধা। শাড়িটি তাকে শিমু পরিয়ে দিয়েছে আকাশের নির্দেশে। আকাশের পছন্দে কেনা শাড়ি। সন্ধ্যা আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। গত রাতের কথা মনে পড়তেই শিউরে ওঠে সন্ধ্যা।
তখন-ই পিছন থেকে আকাশ সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। আয়নায় তাকালে দু’জনের চোখাচোখি হয়। আকাশ দু’ষ্টু হেসে বলে,
– এক রাত আদর পেয়ে-ই তোমাকে আস্ত এক পরী পরী লাগছে সোনা বউ।
আকাশের কথায় সন্ধ্যা ল’জ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। সন্ধ্যার ল’জ্জায় রাঙা মুখ দেখে আকাশ মৃদু হাসল। এরপর সন্ধ্যাকে ছেড়ে আকাশ সন্ধ্যাকে নিজের দিকে ফেরায়।
আকাশের হাতে চারটা সন্ধ্যামালতী ফুলের মালা।

সন্ধ্যাকে হারিয়ে ফেলার পর আকাশ তার বেলকনিতে তিনটে সন্ধ্যামালতী ফুলের গাছ লাগিয়েছিল। আজ আকাশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সেই গাছগুলো থেকে অনেকগুলো ফুল ছিঁড়েছিল। এরপর সেগুলো তার মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে মালা গেঁথে চেয়েছে। সে তো পারেনা।
আসমানী নওয়ান ছেলের কান্ডে কতক্ষণ যে হেসেছে। আকাশকে তখন তার এক পাঁচ বছরের বাচ্চা লেগেছে।
আকাশ পাত্তা দেয়নি। মা হাসুক। তার কাজ করে দিলেই হলো। তার সন্ধ্যামালতীর হাতে সে পরাবে। যে হাসার হেসেছে।

আকাশ সন্ধ্যামালতী ফুলের চারটে মালা সন্ধ্যার ডান হাতে পেঁচিয়ে দেয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। আকাশ সন্ধ্যার ডান হাত তার বা হাতে ধরে রেখে, সন্ধ্যার হাত সামান্য উঁচু করে, আর সে সামান্য ঝুঁকে সন্ধ্যার হাতের উল্টোপিঠে একটা চুমু আঁকে। এরপর আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। ডান হাত সন্ধ্যার গালে রেখে মৃদু হেসে বলে,
– আমার ব্যক্তিগত সন্ধ্যামালতীর হাতে প্রকৃতির একগুচ্ছ সন্ধ্যামালতী ফুলের ভালোবাসা নিবেদন করলাম। আমার ভালোবাসা গ্রহণ কর সোনা বউ।

আকাশের কাজ আর কথায় আবেগে সন্ধ্যার চোখজোড়া ভরে ওঠে। আকাশকে দেখলেই সন্ধ্যার শুধু মনে হয়, আকাশ তাকে কেন এতো ভালোবাসে? জানে এর উত্তর হয়না। অবুঝ মন তবুও এই প্রশ্ন নিয়ে পড়ে থাকে।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে আকাশের পরিয়ে দেয়া ফুলের মালায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। এরপর মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,

– আপনার অসীম ভালোবাসা গ্রহণ করলাম জনাব।
আকাশ অবাক হয়। সন্ধ্যা তার কথার উত্তর এভাবে দিবে, সে ভাবতেই পারেনি। সন্ধ্যাকে টেনে নিজের সাথে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চোখ বুজে অনুভব করে তার সন্ধ্যামালতীকে। মৃদুস্বরে বলে,
– অসীম ভালোবাসি আমার ভালোবাসাকে।
সন্ধ্যা মৃদু হাসল। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমছে।
আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দু’হাতে সন্ধ্যার কোমর ধরে সন্ধ্যাকে টেবিলের উপর বসিয়ে দেয়। এরপর আকাশ মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে। বা পায়ের হাঁটু উঁচু করে সন্ধ্যার বা পা তার হাঁটুর উপর রাখে। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি আলতা বের করে খুব মনোযোগের সহিত সন্ধ্যার পায়ে আলতা পরিয়ে দিতে থাকে।
আকাশের একটার পর একটা কাজে সন্ধ্যা বিস্মিত হয়। এবার চোখে জমা আবেগী জলকণাগুলো চোখ ছাড়িয়ে গালে নেমে আসে।

আকাশ সন্ধ্যার দু’পায়ে খুব সুন্দর করে আলতা পরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল, সন্ধ্যার চোখে পানি দেখে আকাশ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে বউ?

সন্ধ্যা মলিন মুখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তার খুব ভ’য় লাগছে। সে ওই অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে আবার ফিরবে তো? আকাশের এতো এতো ভালোবাসা আবার-ও সে পাবে তো? সে পারবেতো আকাশকে নিজের কণ্ঠ শোনাতে? কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ে। ডান হাত তুলে আকাশের গাল ছুঁয়ে দেয়। আকাশ অবাক হয়। সন্ধ্যা হঠাৎ-ই আকাশকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আকাশের বুকে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। তার দমবন্ধ লাগছে। সে কি করবে? আকাশকে না জানিয়ে অপারেশ করাবে? তার মন মানে না যে। কিন্তু এমন না করলে সে যে আকাশকে কখনো তার কণ্ঠ শোনাতে পারবে না। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার কান্নার বেগ বাড়ে।
আকাশ ঢোক গিলল। তার সন্ধ্যামালতী কাঁদে সে জানে। কিন্তু গতকাল থেকে যেন একটু বেশিই কাঁদছে। কি হয়েছে তার সন্ধ্যামালতীর? আকাশ সন্ধ্যার মাথা তার বুক থেকে তুলে দু’হাতে সন্ধ্যার মুখ আগলে নেয়। দেখল, সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আকাশ কণ্ঠে আবেগ ঢেলে ডাকে,

– সোনা?
আকাশের এমন ডাকে সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। আকাশ আবার-ও একই সুরে বলে,
– আমার সোনার কি হয়েছে? কেন কাঁদে আমার সোনা? বলো? আমি সব ঠিক করে দিব বউ।
সন্ধ্যা পলকহীন চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে রয় অনেকটা সময় নিয়ে। এরপর সন্ধ্যা ঠোঁট নাড়িয়ে বোঝায়,
– শুনুন, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
সন্ধ্যার কথা বুঝতে পেরে আকাশের বুকটা শীতলতায় ভরে যায়। মুখ নামিয়ে সন্ধ্যার সারামুখে ছোট ছোট চুমু আঁকে। সন্ধ্যা চোখ বুজল। আজ আর বিরক্ত হয়না। বরং চুপটি করে থাকে, যেন তার আকাশের ভালোবাসা আরও চাই।
আকাশ প্রায় সাতমিনিট টানা চুমু আঁকল সন্ধ্যার সারামুখে। এরপর সন্ধ্যার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে আবেগী স্বরে বলে,
– আমিও তোমায় ভীষণ ভীষণ ভীষণরকম ভালোবাসি সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে জল গড়ায়। দু’হাতে শ’ক্ত করে ধরে রাখে আকাশকে।

সৌম্য আর ইরা সন্ধ্যাকে নিয়ে যাবে বলে বেরিয়েছে। আকাশ গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে। সৌম্য রাজি হয়নি। আকাশ-ও জোর করেনি। সৌম্য কেমন সে জানেই। তাই জোর করে অযথা কথা খরচ করেনি।
সৌম্য ইরাদের সাথে আকাশ-ও বেরিয়েছে। সে মূলত গাড়ি নিয়ে একটা কাজে যাবে। গাড়ি সাইড করে রেখে আকাশ সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়ায়। দু’হাতে সন্ধ্যার হিজাব ঠিকঠাক করতে করতে বলে,
– সাবধানে যাবে। সবসময় সৌম্য’র হাত ধরে থাকবে। হুম?
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ ভাবছে সে বেড়াতে যাচ্ছে। অথচ সে যে আকাশের অবাধ্য হতে যাচ্ছে। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগে। মেয়েটার চোখের কোণে পানি। আকাশ মৃদুস্বরে বলে,

– আর কান্না কর না সোনা বউ। সৌম্য’র সাথে ঘুরে আসলে আমি তোমায় আরও অনেক জায়গা ঘোরাবো। বুঝেছ?
সন্ধ্যা মাথা নাড়ে, সে বুঝেছে। আকাশ মৃদু হাসলো। আসমানী নওয়ানসহ, শিমু, শিমুর মা, সৌম্য সবার সামনেই আকাশ সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু খায়। কেউ-ই ল’জ্জা পায় না। বরং সকলের মন ভার। আর আকাশ তো আগে থেকেই এমন। তার কাছে এটুকু স্বাভাবিক। আকাশ আর দাঁড়ালো না। রাস্তার অপর পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির দিকে যেতে যেতে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– আমার বউকে দেখে রাখবে সৌম্য।
সবাই মলিন মুখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। আকাশ গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। এরপর বা দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে দেখল তার সোজা সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে। সন্ধ্যার মন খারাপ আকাশ লক্ষ্য করল। খারাপ লাগছে তার। ভাবছে, তার সন্ধ্যামালতীর কি আজ কথা বলতে একটু বেশিই ইচ্ছে করছে? যার ফলে শুধু কাঁদছে আর মন খারাপ করে থাকছে?

আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু একটা ভেবে আকাশ হাসল। সে তার সন্ধ্যামালতীর মন ভালো করে দিতেই যাচ্ছে। এরপর আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বা হাতের দু’আঙুলের সাহায্যে সন্ধ্যার দিকে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দেয়।
আকাশের কান্ডে সন্ধ্যার মুখে একটুখানি হাসি ফোটে। সন্ধ্যাকে হাসাতে পেরে আকাশ-ও হাসলো। এরপর হাতের ইশারায় বাই বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জায়গাটি প্রস্থান করে।
আকাশ চলে যেতেই সন্ধ্যার চোখের কোণে জমা পানি গালে গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে আল্লাহকে খুব করে বলে,
সে যেন আবার-ও সুস্থ হয়ে আকাশের বুকে ফিরে আসে আকাশের অফুরন্ত ভালোবাসা পেতে। আকাশকে তার কণ্ঠ শুনিয়ে আকাশকে তৃপ্তি দিতে পারে।

দুপুরের রোদ পড়ে ধরণীর বুক শীতল হতে শুরু করেছে। নিয়াজ হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যার অপারেশন। নিয়াজের হঠাৎ চোখে পড়ে, একটি ফাঁকা জায়গায়, রাস্তার পাশে আকাশ বসে আছে। যদিও আকাশ উল্টোদিক ফিরে বসে আছে। তবে নিয়াজ এক দেখাতেই চিনতে পারলো। সে গাড়ি সাইড করে গাড়ি থেকে নেমে আকাশের পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
– এখানে কি করছ?
নিয়াজের কণ্ঠ পেলেও আকাশ তাকালো না। দৃষ্টি দূর অজানায়। মৃদুস্বরে বলে,
– দেখছোই তো বসে আছি।
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে খবর পেয়েছে, আকাশ আজ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছে। কথাটা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছে নিয়াজ। তার জানা মতে, আসমানী নওয়ান আর আকাশকে এসব নিয়ে বাঁধা দেয়না। তাহলে আকাশ কেন তার পছন্দের এই পদ ছাড়লো? নিয়াজ অবাক হয়ে বলে,

– তুমি সত্যিই সভাপতির পদ ছেড়ে দিলে আকাশ?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– হুম।
নিয়াজ বলে,
– কেন এমন করলে? তোমার খারাপ লাগছে না?
নিয়াজের কথায় আকাশ একটু হেসে বলে,
– সত্যি বলতে একটু খারাপ লাগছে। আবার ভীষণ ভালো-ও লাগছে।
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মানে?
আকাশ তার পাশে ইশারা করে বলে,
– এখানে বসো।

নিয়াজ আকাশের কথা মেনে আকাশের পাশে বসল। আকাশ আজ এক অদ্ভুদ কাজ করল। দু’হাত আড়াআড়িভাবে বুকে গুঁজে নিয়াজের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল।
আকাশের কান্ডে নিয়াজ বিস্ময়ান্বিত! এটা আকাশ? সে তো চিনতেই পারছে না। তবে কিছু বলল না। আকাশ চোখ বুজে রেখে মলিন হেসে বলে,
– আমার না সন্ধ্যামালতীর কণ্ঠ শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করে, জানো নিয়াজ?
আকাশের কণ্ঠে প্রাণ নেই। নিয়াজের ভীষণ খারাপ লাগলো। আবার ভালো-ও লাগলো এই ভেবে যে আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যার অপারেশন। তারপর আকাশের এই ইচ্ছে পূরণ হবে আকাশের অজান্তেই।
আকাশ আবার-ও বলে,

– কিন্তু আমি সন্ধ্যামালতীকে হারানোর ভীষণ ভ’য় পাই। সন্ধ্যামালতীকে মৃ’ত ভেবে অনেকগুলো দিনগুলো পার করেছি। আমি জানি সন্ধ্যামালতী ছাড়া বেঁচে থাকা কতটা ভ’য়ং’ক’র হয়! আমি চাইনা সেই দিনগুলো আবার-ও ফিরে আসুক। যদিও আমি জানি এরকম দিন আর আসবে না। কারণ সন্ধ্যামালতীবিহীন আমার বাঁচার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
কথাগুলো বলে আকাশ থামে। আকাশের কথা শুনে নিয়াজ ঢোক গিলল। হঠাৎ তার সন্ধ্যার অপারেশন নিয়ে ভ’য় লাগলো৷ সকালে সৌম্যকে বোঝালেও এখন তার নিজের কেমন যেন লাগছে আকাশকে না জানিয়ে সন্ধ্যার এতো বড় অপারেশন করাতে। আকাশের কথায় নিয়াজের ধ্যান ভাঙে।
আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

– সন্ধ্যামালতী এসব রাজনীতি সাইট পছন্দ করেনা। তাই ছেড়ে দিলাম। দু’দিন পর ছাড়তে চেয়েছিলাম, সেই ডেট টা এগিয়ে নিয়ে আসলাম। অপারেশনে রাজি হইনা বলে সন্ধ্যামালতী সবসময় ভীষণ মন খারাপ করে থাকে। সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছি জানলে ও ভীষণ খুশি হবে। সন্ধ্যামালতীর খুশির কাছে আমার ইচ্ছেগুলো বরাবর-ই তুচ্ছ।
এটুকু বলে আকাশ হাসল। নিয়াজ অবাক হয়ে শুনলো আকাশের কথা। রাজনীতি ব্যাপারটা আকাশের পছন্দের তালিকায় সর্বপ্রথম বলা যায়। অথচ আকাশের পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থান পাওয়া জিনিস আজ সন্ধ্যার জন্য ফিকে হয়ে গিয়েছে। নিয়াজের অবাকের মাত্রা বাড়ে বই কমে না। এভাবেও কাউকে ভালোবাসা যায় বুঝি? সে হয়ত আকাশকে না দেখলে কখনো জানতেই পারতো না।
নিয়াজের ফোন বেজে উঠে। নিয়াজ ফোনের দিকে তাকালে দেখল সৌম্য’র ফোন। নিয়াজ ঢোক গিলল। রিসিভ করে ছোট করে বলে,

– আসছি।
এরপর সাথে সাথেই কল কেটে দেয় নিয়াজ।
আকাশ নিয়াজের কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। নিয়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
– তুমি তোমার কাজে যাও।
নিয়াজ বলে,
– তুমি বাড়ি যাবেনা? সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
আকাশ নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
– যাব। সন্ধ্যামালতী ওর ভাইয়ের সাথে বেড়াতে গিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে ভীষণ একা একা লাগে। দুইদিন পর আসবে। এইদুইদিন কিভাবে থাকবো সেটাই ভাবছি। মনে হচ্ছে বাসায় থাকতে পারবো না।
এটুকু থেমে সোজা হয়ে বসে। দু’হাতের মাঝে মুখ রেখে হতাশ কণ্ঠে বলে,
– এটাই লাস্ট। আর কখনো ওকে কোথাও পাঠাবো না।
নিয়াজ চুপচাপ থাকলো। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে সে সন্ধ্যার অপারেশন করতে বারণ করে দিক। আবার ভাবলো, এটা কি করে হয়, সন্ধ্যারা সব প্রিপারেশন নিয়ে বসে আছে।
আবার-ও সৌম্য’র কল আসলে নিয়াজ আর বসল না। আকাশকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলে সে জায়গাটি প্রস্থান করে।

সন্ধ্যাকে স্ট্রেচারে শোয়ানো হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যার পরনের শাড়ি খুলে, হসপিটালের পোষাক পরানো হয়েছে। সন্ধ্যার চারপাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা মলিন মুখে সবার দিকে চেয়ে আছে। আসমানী নওয়ান একটু ঝুঁকে সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু খেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– জান্নাত তুই সুস্থ হইয়া আয় মা। আমারে কিন্তু মা কইয়া ডাকবি। মনে থাকবো?
সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি জমে। তবে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মাথা নেড়ে বোঝায়, তার মনে থাকবে। আসমানী নওয়ান মৃদু হাসলেন।
এরপর শিমুর মা সন্ধ্যার গালে হাত বুলিয়ে বলে,

– আম্মু সুস্থ হয়ে ফিরে এসো।
এরপর শিমু সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে নাক টেনে বলে,
– তুমি কিন্তু আমাকে বোন বলে ডাকবে ভাবী। ওসব ননদ-ফনদ পরের ব্যাপার। আগে তুমি আমার বোন।
শিমুর কথায় সন্ধ্যা মৃদু হাসল। ইরা সন্ধ্যার মাথায় বুলায়। ঢোক গিলে বলে,
– চিন্তা কর না সন্ধ্যা। তোমার কিচ্ছু হবে না। কালকে থেকে কথা বলবে তুমি। বুঝেছ?
সন্ধ্যা ইরার কথায় হাসল। আশেপাশে তাকিয়ে সৌম্যকে খুঁজলে না পেয়ে ইরার দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায়। ইরা সন্ধ্যাকে বলে একটু দূরে দাঁড়ানো সৌম্য’র পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
– সন্ধ্যাকে নিয়ে যাচ্ছে। ও তোকে খুঁজছে।
সৌম্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধরা গলায় বলে,
– আমার ভীষণ ভ’য় লাগছে ইরাবতী।
ইরা সৌম্য’র হাত ধরে সাহস দেয়,
– কিচ্ছু হবে না আমাদের সন্ধ্যার। ওর কাছে যা।
সৌম্য ঢোক গিলল। দু’হাতে চোখ ডলে ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়ায়। সৌম্য’র চোখজোড়া লাল। ভাইকে দেখে সন্ধ্যার চোখজোড়া ভরে ওঠে। সৌম্য ঢোক গিলল। হঠাৎ-ই একটু ঝুঁকে সন্ধ্যাকে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যা নিজেও ভাইকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। সৌম্য চোখ বুজে রেখেছে। সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো। এরপর সন্ধ্যাকে ছেড়ে সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু খায়। ডান হাত মাথায় রেখে ভারী গলায় বলে,

– তোর কিচ্ছু হবে না বোনু। আমি তোর মুখে আবার-ও সৌম্য ভাইয়া ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। ডাকবি না আমায়?
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। মাথা নেড়ে বোঝায়, – সে ডাকবে।
সৌম্য দু’হাতে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে আরেকটা চুমু খায়।
সন্ধ্যাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলে সৌম্য সন্ধ্যাকে ছেড়ে দাঁড়ায়। দু’জন নার্স স্ট্রেচার ধরে সন্ধ্যাকে নিয়ে যেতে থাকে।
সকলে বিষাদ মুখে একখানা নিভু নিভু হাসি ফুটিয়ে সন্ধ্যাকে বিদায় দেয়।
সন্ধ্যার আকাশের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সকালে আকাশের সন্ধ্যামালতী ফুলের মালা পড়ানো, এরপর তাকে যত্ন করে আলতা পরানো, তাকে বেহিসাব চুমু খাওয়া, সবশেষে কপালে চুমু খাওয়া আর তারপর তার দিলে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দেয়া, হাত নাড়িয়ে বাই বলা সবমিলিয়ে সন্ধ্যার ছটফট লাগলো। এক ফোঁটা পানির জন্য মানুষ যেভাবে তৃষ্ণায় ছটফট করে, সন্ধ্যা আকাশকে একনজর দেখতে সেভাবে ছটফট করল। আকাশ এই ত্রিসীমানায় নেই জেনেও চাতক পাখির ন্যায় এদিক-ওদিক তাকালো।

নার্স দু’জন সন্ধ্যাকে অপারেশন থিয়াটার রুমে ধীরে ধীরে প্রবেশ করালে সন্ধ্যার বুক ধুকধুক করে। পোষাক পরিবর্তন করার সময় সন্ধ্যার হাতে আকাশের পরানো সন্ধ্যামালতী ফুল খুলে ফেলতে চেয়েছিল। সন্ধ্যা খুলতে দেয়নি। রেখে দিয়েছে হাতে। ধীরে ধীরে অপারেশন থিয়েটার রুমের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
সন্ধ্যা সন্ধ্যামালতী ফুল পরিহিত হাতটি তার বুকে চেপে চোখজোড়া বুজে নিল। বন্ধ চোখের পর্দায় আকাশের হাস্যজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠল। দু’চোখের পাতা বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু কান বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। খুব করে আল্লাহকে বলল,
– সে যেন আবার-ও আকাশের বুকে ফিরতে পারে।

ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১০ টা। আকাশ বিকাল থেকে এখনো একই জায়গায় বসে আছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। কেন যেন কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বাসায় গেলে আরও দমবন্ধ লাগবে। সন্ধ্যার পর থেকে সৌম্যকে অনেকবার কল করেছে, কিন্তু সৌম্য একবারো কল রিসিভ করেনি। আকাশের চিন্তা হচ্ছে। তার সন্ধ্যামালতী ঠিক আছে তো?
আকাশ পকেট থেকে আবার-ও ফোন বের করে সৌম্যকে কল করতে নিলে বায়ানের ফোন আসে। আকাশ কল রিসিভ করে ফোন কানে দেয়। সে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে বায়ান বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– স্যার সন্ধ্যা ম্যাডাম এর গলা অপারেশন। আপনি কোথায় স্যার?
বায়ানের কথা শুনে আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো৷ বায়ান ঠিক কি বলল, তার মাথায় কেচ করতে সময় লাগলো। যখন বায়ানের কথাটা ধরতে পারলো, তখন আকাশের দুনিয়া ঘুরে ওঠে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– তুমি মিথ্যে বলছ বায়ান।
বায়ান আবার-ও বলে,

– না স্যার। সন্ধ্যা ম্যাডামকে অনেকক্ষণ আগে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। অপারেশন শেষের পথে। আপনার ফ্যামিলির সবাই এখানে আছে। শুধু আপনাকেই দেখছি না। এজন্য কল করলাম। নিয়াজ ভাইয়াও তো আছে এখানে।
আকাশ ঢোক গিলল। এইজন্য সৌম্য সন্ধ্যার পর থেকে তার কল রিসিভ করছে না? তার সন্ধ্যামালতী! আকাশ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে গাড়িতে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ৪০ মিনিটের রাস্তা ১৫ মিনিটে এসেছে। হসপিটালের সামনে গাড়ি থামিয়ে একপ্রকার দৌড়ে হসপিটালের ভিতর প্রবেশ করে। কয়েকজনের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। আকাশ কোনোদিকে তাকালো না। রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, লোকগুলো আকাশকে সন্ধ্যার ব্যাপারে ডিটেইলস বলে দেয়। সন্ধ্যার গলা অপারেশন চলছে সব-ই বলে দেয়। সব শুনে আকাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে ডান হাতে দেয়াল ধরে দাঁড়ায়। পুরো শরীর কাঁপছে তার। বহুক’ষ্টে নিজ শরীর টেনে আকাশ সেই ফ্লোরে আসে, যেখানে সন্ধ্যার অপারেশন চলছে। আকাশ সামনে তাকিয়ে দেখল তার বাড়ির প্রতিটি সদস্য অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে। সকলের মুখে চিন্তা।

আকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সকলের দিকে। কি নিখুঁত অভিনয় এই মানুষগুলোর! বিশেষ করে তার সন্ধ্যামালতীর আর সৌম্য’র। গতকাল থেকে তার সন্ধ্যামালতী এজন্যই বুঝি এতো কাঁদছিল? তাকে ছেড়ে যাবে বলে! তার সন্ধ্যামালতী এমনটা কি করে করতে পারল? বুকের কি অসহ্য ব্য’থা! যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। আকাশ ঢোক গিলল কয়েকবার। সামনে তাকিয়ে তার কাঁপা দু’হাত সামান্য উঁচু করে দু’টো তালি দিয়ে বিদ্রুপ স্বরে বলে,
– বাহ! আমাকে মা’রতে সবার এতো আয়োজন!
আকাশের কণ্ঠ পেয়ে সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে
তাকায় আকাশের দিকে। এখানে কেউই ভুলেও আকাশকে আশা করেনি।
আসমানী নওয়ান আর সৌম্য ভীতি ঢোক গিলল। আকাশ ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সৌম্য’র সামনে দাঁড়ায়। করুন স্বরে বলে,

– আমার বউকে ওই ঘরে কেন পাঠালে সৌম্য? তুমি যে বললে সন্ধ্যামালতী তোমার সাথে ঘুরতে যেতে চায়। তাহলে আমার সন্ধ্যামালতী হসপিটালে কি করে এলো সৌম্য?
আকাশের এমন করুণ সুরে কথাগুলো শুনে সৌম্য অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। সৌম্যকে চুপ দেখে হঠাৎ আকাশ সৌম্য’র শার্টের কলার ধরে চিৎকার করে বলে,
– আমার সন্ধ্যামালতীকে কেন ওই ঘরে পাঠালি বল? কথা বল বে’য়া’দ’ব।
কথাটা বলে আকাশ সৌম্য’কে ধাক্কা দেয়। সৌম্য দু’পা পিছিয়ে যায়। মাথা নিচু তার।
আসমানী নওয়ান আকাশকে বোঝানোর স্বরে বলেন,
– আকাশ ডক্টর কইছে, ওর ৪০% ঝুঁকি আছে। ৬০% ভালো হইব।
মায়ের কথায় আকাশ চিৎকার করে বলে,

– আমার সন্ধ্যামালতীর ১% ঝুঁকি নিয়েও আমি ওর অপারেশন করাতে চাইনি। আর তোমরা আমার সন্ধ্যামালতীর ৪০% ঝুঁকি নিয়ে কোন সাহসে ওকে ওই ঘরে পাঠিয়েছ?
ছেলের কথায় আসমানী নওয়ান নিভে যায়। আকাশের চোখ দু’টো র’ক্ত জমাট বাঁধার ন্যায় লাল টকটকে। আকাশ ঢোক গিলল। মায়ের দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– তুমি আমার সাথে এমনটা কি করে করতে পারলে মা?
আসমানী নওয়ানের বুক ভার হয়। ছেলেকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।
আকাশ আবার-ও সৌম্য’র দিকে এগিয়ে গিয়ে সৌম্য’র কলার ধরে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তুই তোর বোনকে নিয়ে কেন আমার সাথে নাটক করলি বল? তোরা কেউ কেন বুঝিস না আমি সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া বাঁচতে পারিনা। বল কেন এমন করলি? কথা বল!
আকাশের শেষের কথাগুলোয় অসহায়ত্ব ঝরে পড়ে।
সৌম্য হঠাৎ-ই আকাশকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বলে,

– স্যরি আকাশ ভাইয়া! আমায় ক্ষমা করুন প্লিজ!
আকাশ সৌম্যকে ধাক্কা দেয়। চিৎকার করে বলে,
– কসম আল্লাহর, এবার আমার সন্ধ্যামালতীর কিছু হলে আমি নিজেই আমার নিঃশ্বাস চিরতরে থামিয়ে দিব। আমার লা’শ দাফনের জন্য প্রস্তুত থেকো তোমরা।
আকাশের কথায় সকলে স্তব্ধ চোখে তাকায় আকাশের দিকে। আসমানী নওয়ানের বুকটা মুচড়ে ওঠে। শিমুর মা এগিয়ে এসে বোনকে আগলে নেয়। সৌম্য, ইরা, শিমু সকলেই বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে।
আকাশ চোখ বুজল। জীবনটা আর চলছেনা। আর কত ক’ষ্ট সইতে হবে তাকে!

তখন-ই নিয়াজ অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ যাবৎ সন্ধ্যার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। তার বড় স্যার বলল, সন্ধ্যার জ্ঞান একটু পর-ও ফিরতে পারে। আবার কয়েকদিন পর-ও ফিরতে পারে। নয়তো একেবারে কোমায় চলে যেতে পারে। আর নয়তো একেবারে উপরে…..নিয়াজ আর ভাবতে পারছে না। তার নিজের মাথা-ই ঘুরছে ভনভন করে। সৌম্যদের কি বলবে? নিজেকে সামলে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে মলিন গলায় বলে,

– সৌম্য সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরছে না। বুঝতে পারছি না কি হবে। তোমরা সবাই সন্ধ্যার জন্য দোয়া কর।
নিয়াজের কথাটায় যেন মেঘ বিনে বজ্রপাত হলো। সৌম্য সহ সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় নিয়াজের দিকে। সবার মাথায় বাজ পড়ল। সকলের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করে।
সৌম্য স্তব্ধ চোখে তাকায়। মুহূর্তেই চোখজোড়া ভরে ওঠে। দুনিয়া অন্ধকার লাগছে তার। তার বোনু!
নিয়াজের দৃষ্টি ডানদিকে গেলে আকাশকে দেখে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ঢোক গিলল ছেলেটা। সন্ধ্যায় বলা আকাশের কথাগুলো ভেবে নিয়াজের অসহায় লাগলো।
আকাশের র’ক্তের ন্যায় লালিত চোখজোড়া শুকনো মরুভূমির ন্যায় খড়খড়ে হয়ে আছে। ওই যে কথায় আছে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। কথাটা হয়ত আকাশের সাথে ফলে গিয়েছে। যে ছেলেটা একটুতেই মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখের পানি ফেলত, আজ তার চোখজোড়া সামান্য একটু-ও ভিজল না। তবে তার এতো লাল চোখ বোধয় এ জীবনে কেউ দেখেনি, এমনকি সে নিজেও না। আকাশ নিয়াজের দিকে প্রাণহীন দৃষ্টিতে চেয়ে করুণ স্বরে বেঁধে আসা গলায় বলে,

– নিয়াজ তোমাকে না আমি একটু আগে বললাম, সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া আমি বাঁচতে অক্ষম। তুমি তবুও আমার বউটাকে ওই ঘরে নিয়ে গেলে?
আকাশের কথায় নিয়াজের বুক ভারী হলো। সে বোধয় সত্যিই ভুল করল সন্ধ্যার অপারেশন করাতে চেয়ে। এবার সে কি করবে? তার নিজেরই তো কান্না পাচ্ছে।
আকাশ মাথা নিচু করে ঢোক গিলল।
যেদিন থেকে সে সন্ধ্যাকে ভালোবেসেছে। সেদিন থেকে সে বাঁচার মতো করে বাঁচতে ভুলে গিয়েছে। সন্ধ্যামালতীকে ভালোবাসার সময়সীমা বছর পেরিয়ে গেল, অথচ সে সুখের সময়সীমা হিসেবে হাতেগোনা কয়েকটা দিন পেয়েছে। আর বাকি দিনগুলো সে জীবন্ত লা’শ হয়ে বেঁচেছে। আজ আবার-ও সেই দিন ফেরার পথে।
আকাশের মাথাটা ঘুরছে। পিছন থেকে দু’পা পিছিয়ে যায়, পড়ে যেতে নিলে ডান হাতে চেয়ার আঁকড়ে ধরে। নিয়াজ, আসমানী নওয়ান এগোতে নিলে আকাশ বা হাত উঠিয়ে ধরা গলায় শ’ক্ত করে বলে,

– দূরে থাকো।
আকাশের কথায় তাদের পা থেমে যায়। আসমানী নওয়ানের চোখের কোণে পানি জমেছে।
আকাশের মাথা নিচু। শরীর কাঁপছে। আজ সকালে সন্ধ্যার সাথে কাটানো একে একে সব স্মৃতি চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। মনে পড়ল, সন্ধ্যার ঠোঁট নাড়িয়ে বলা কথাটা, – শুনুন, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
এরপর সে তার সন্ধ্যামালতীকে সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে ভালোবাসা নিবেদন করলে সন্ধ্যার ঠোঁট ফুলে ছোঁয়ানো, সাথে ঠোঁট নাড়িয়ে তার ভালোবাসা গ্রহণ করার কথা, সবশেষে সন্ধ্যাকে বিদায় দেয়ার সময় সন্ধ্যা সেই মিষ্টি হাসি।
কথাগুলো ভেবে আকাশের বুক ব্য’থা আর-ও কয়েকধাপ বাড়লো। বুকের অসহ্য ব্য’থায় মনে হচ্ছে, সব হাড় একসাথে ভাঙার উপক্রম হয়েছে। বা হাতে বুকের দু’পাশ ডলল কয়েকবার।
এরপর বিড়বিড়িয়ে বলে,

– সন্ধ্যামালতী? তুমি যেমন, তেমন তোমার সাথেই একটি সংসার বাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় তোমার সাথে একটি সুখের সংসার কেন বাঁধতে দিলে না?
কথাটা বলতে বলতে শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে আকাশ ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। নিয়াজ আকাশ বলে চেঁচিয়ে দৌড়ে আসে। আসমানী নওয়ান দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে ছেলের পাশে বসে।
শিমু মুখ চেপে ফোঁপায়৷
সৌম্য স্তব্ধ হয়ে মেঝেতে বসে আছে। পাশে ইরা সৌম্য’কে এতো করে ডাকছে, শিমুর মা কোথা থেকে পানি এনে সৌম্য’র মাথায় হাত দিয়ে পানি দিচ্ছে। সৌম্য’র কোনো সাড়া নেই। যেন সে কোনো সাজিয়ে রাখা পুতুল। ইরা সৌম্য’র অবস্থা দেখে কেঁদে দিয়েছে।
নিয়াজ আর আসমানী নওয়ান আকাশকে ধরলে আকাশ দুর্বল হাতে নিয়াজ আর তার মাকে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু তার শরীরে আর কুলালো না। চোখজোড়া বুজে আসে। অস্পষ্টস্বরে উচ্চারণ করে,

– সন্ধ্যামালতী আমায় বাঁচতে দিল না।
এটুকু বলে আকাশ পিছনদিকে হেলে ঠাস করে পড়ে যায়। আসমানী নওয়ান কেঁদে দিয়ে শব্দ করে ডেকে ওঠে,
– আকাশ আব্বা?
এরপর কান্নামাখা গলায় বলেন,
– নিয়াজ আব্বা, আমার আকাশের কি হইছে একটু দেহ না!
নিয়াজ আকাশকে ধরতে গিয়েও এতো শক্তপোক্ত শরীর ধরতে পারলো না। তার কানে বাজছে আকাশের একটু আগের বলা সেই কথাটা,

অন্তঃদহন পর্ব ৪৪

– নিয়াজ তোমাকে না আমি একটু আগে বললাম, সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া আমি বাঁচতে অক্ষম।
কথাটা ভেবে নিয়াজের চোখের কোণে জলকণা জমলো। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা আকাশকে টেনে কিছুটা উঁচু করে ধরে, চিৎকার করে বলে,
– নার্স, স্ট্রেচার আনো। ফাস্ট।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৬

1 COMMENT

Comments are closed.