সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৮
জাওয়াদ জামী
” তুই রান্নাঘরে কি করছিস, দৃষ্টি? এখানে তোর কি কাজ? সরে দাঁড়া, আমাকে কাজ করতে দে। ”
রাখী আক্তার খেঁকিয়ে উঠলেও দৃষ্টি অনড় রইল। ও একমনে রান্না করছে।
” তুমি বললেই তো এখন সরে দাঁড়াতে পারবনা, বড়মা। রান্না শেষ না হওয়া অব্দি এখানেই থাকতে হবে আমাকে। ”
” তোকে রান্না করতে কে বলেছে? রান্না করার আগে আমার অনুমতি নিয়েছিলি? আমার অনুমতি ছাড়া রান্না করতে এসেছিস কেন তুই? ”
” তুমি বাসায় ছিলেনা, তাই অনুমতি নিতে পারিনি। আপুরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবে, সেজন্য তোমার অনুমতির অপেক্ষাও করিনি। ”
” ওহ এবার বুঝেছি, কেন এত তোড়জোড়। ভাইবোন আসবে, হাভাতের মত খেতে বসবে তাই রান্না করতে এসেছিস। আমাকে বললে আমি নিষেধ করব সেটা জেনেই নিজের ইচ্ছেমত রাঁধতে শুরু করেছিস? ওদেরকে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলাবি জন্যই এত আয়োজন? আমার সংসারের কথা চিন্তা না করে ভাইবোনের কথা চিন্তা করছিস তুই? লোভীর দল কোথাকার। ”
” আমার ভাইবোনের জন্য কিছুই রান্না করিনি, বড়মা। এমনিতেও আপু এখানে খাবেনা বলেছে। আমি আনান ভাইয়ার জন্য রান্না করছি। সবগুলোই ভাইয়ার পছন্দের খাবার। আমি কখনোই ভাইবোনের কথা ভাবতে গিয়ে তোমার সংসারের ক্ষতি করবনা। আমার বাবা-মা আমাদের শেখায়নি, কিভাবে অন্যের ক্ষতি করতে হয়। আমার আপু সাতদিন না খেয়ে থাকলেও কারও কাছ থেকে চেয়ে খাবেনা। আর আমাদেরও সেটাই শিখিয়েছে। এটা তুমি ভালো করেই জানো। কারন গত কয়েক বছর আমরা খাবার বা অন্য প্রয়োজনে তোমাদের কাছে হাত পাতিনি। তাই আমাদের লোভী আখ্যা দিয়ে নিজেকে নিচে নামিওনা। ”
দৃষ্টির কথাগুলো শুনে রাখী আক্তারের মুখ কালো হয়ে গেল। দৃষ্টির কথাগুলো তার পছন্দ হয়নি এটা ওকে জানানো দরকার, বিধায় সে মুখ খুলল,
” তোদের লোভী বললে আমি নিচে নামব! হাসালি তুই আমাকে। তোরা কি এমন মহান যে, তোদের লোভী বললেই আমি নিচে নেমে যাব? কেউ যখন তোদের প্রসংশা করছেনা, তোদেরকে ভালো বলছেনা, তখনই নিজেই নিজেদের ওপরে তোলার চেষ্টা করছিস? পারিসও তোরা। ”
” আমরা মহান নাকি ভালো নাকি খারাপ সেটা তোমার বাবার বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। তোমার মা মানে দিদুন তার ভাষ্যমতে, আমার বাবা-মা নাকি অসাধারণ মানুষ ছিল। তোমার বড় ভাই মানে বড় মামা আমাকে বলেছেন, বাবাকে তিনি নিজের ছোট ভাইয়ের নজরে দেখতেন। মেজো মামা বলেছেন, বাবা সৎ মানুষ ছিলেন। তাদের সকলকেই বাবা সম্মান করত। মা-ও নাকি তাদেরকে সম্মান করত। এরকম আরও অনেক কথাই তারা বলেছেন। যেখানে তোমার বাবার বাড়ির লোকজন আমার বাবা-মার সম্পর্কে একটাও খারাপ কথা বলেনি, তাই অন্য কারো উদাহরণ টানছিনা। অন্য কারো উদাহরণ দিতে গেলে লিস্ট অনেক বড় হয়ে যাবে। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তুই আমার মুখে মুখে কথা বলছিস? এই শিক্ষা তাহলে তোর মা তোকে দিয়েছে? বড়দের মুখে মুখে কথা বলা বুঝি আদবের মধ্যে পরে? ”
” মা আমাকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। এতে বড়দের মুখে মুখে কথা বলা হলেও সেটা অন্যায়েরই প্রতিবাদ। সেক্ষেত্রে বড়দের উচিত নিজেদের শুধরে নেয়া। এতে সংসারেও শান্তি থাকবে, আবার বড়রা যথাযথ সম্মানও পাবে। ”
” মুখ সামলে কথা বল, দৃষ্টি। আমাকে চটিয়ে এই বাড়িতে থাকতে পারবি, এমন আশা বাদ দে। আমার কথার বাহিরে গেলে তোর অবস্থা খুব একটা ভালো হবে এমনটাও কিন্তু নয়। ”
” আমার ভাগ্যে যদি তোমার ছেলের সংসার না থাকে, তাহলে নেই। তাই বলে তোমার অন্যায়ের প্রতিবাদ করবনা সেটা হতে পারেনা। আজ থেকে তোমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হল আমার। এরপর থেকে আমার বাবা-মা মোটকথা আমার পরিবার সম্পর্কে কোনকিছু বলার আগে দুইবার ভাববে। আমি কুহু নই, আমি দৃষ্টি। কুহুর মত সবার অপমান, কটুকথা মুখ বুঁজে সইবনা আমি। তুমি যদি নবাব নন্দিনী হও, আমিও কিছু কম যাইনা। তুমি বড় ঘরের মেয়ে হলে, আমিও বড় ঘরেরই মেয়ে। তুমি যদি ধনী মানুষের বউ হও, আমিও সেই মানুষেরই পুত্রবধু। এই বাড়িতে তোমার থেকে আমার অধিকার কোন অংশেই কম নয়। কথাটা মনে থাকলে তোমার জন্যই মঙ্গল। ”
এরপর দৃষ্টি আর কিছুই বললনা। নীরবে কাজ শেষ করল। রাখী আক্তার দৃষ্টির হুমকি শুনে ভড়কে গেল। সে-ও দৃষ্টির কথাগুলোর উত্তর দিতে পারলনা।
” কুহু সোনা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তাইনা, বউমা? ও কি বাড়িতে পৌঁছে গেছে? ” আয়েশা সালেহা তাহমিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন।
” সত্যিই আম্মা, কয়েকটা দিন কুহু থাকায় ভালোই লেগেছিল। এই কয়দিন প্রতিদিন সকালে রান্নাঘরে ঢুঁ মারত মেয়েটা। নিষেধ স্বত্বেও আমাদেরকে কাজে সাহায্য করেছে। কত গল্প করেছি ওর সাথে। ও চলে যাওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। একটু আগেও ওকে ফোন দিয়েছিলাম, বলল এখনো পৌঁছায়নি। আরও আধাঘন্টা লাগবে যেতে। আবার আনান ছিল। ছেলেটা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। আবার কবে আসবে কে জানে। ”
” আমার নিহান, আনান ওদের বংশের মানুষদের মত হয়েছে। নিয়াজের আব্বা-আম্মাও ভালো মানুষ ছিলেন। কায়েসও ছিল মাটির মানুষ। ওরা ওদের দাদুর মত হয়েছে। জানো বউমা, এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঐ পরিবারে রাখী বড্ড বেমানান। ওর আচরনের জন্য আমার লজ্জা হয়। কায়েসের ছেলেমেয়ের সাথে ও অন্যায় করেছে। আগে যদি জানতাম, তবে এতদিনে রাখীকে শোধরাতে পারতাম। ” আফসোস করে বললেন আয়েশা সালেহা।
” রাখী ঠিকই শোধরাবে, আম্মা। এখন হয়তো সময় লাগবে। আমরা সবাই মিলে ওকে বোঝালে ও নিজের ভুল ঠিকই বুঝতে পারবে দেখবেন। ”
” বউমা, রাখীকে একটা ফোন দাওতো। গতকাল ওদের সাথে কথা হয়নি। দৃষ্টি মনির কাছে সেদিন শুনলাম নিহান গিয়েছে। ”
” দিচ্ছি, আম্মা। ” তাহমিনা আক্তার রাখী আক্তারের নম্বর ডায়াল করে শ্বাশুড়ির কাছে ফোন দিলেন।
রাখী আক্তার ড্রয়িং রুমে বসে ফুঁসছিল। মনে মনে দৃষ্টির মুন্ডুপাত করছিল। তখনই বেজে উঠল তার ফোন। স্ক্রীনে মেজো ভাবীর নাম দেখে চমকে উঠল। অজান্তেই নজর গেল রান্নাঘরের দিকে। একবার ভাবল, দৃষ্টি হয়তো ভাবীকে ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা জানিয়ে দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে ফোন রিসিভ করল রাখী আক্তার।
” কেমন আছো, ভাবী? ”
” ফোন রিসিভ করে সালাম দিতে হয় সেটা কি ভুলে গেছ তুমি? নাকি আমার ছেলের বউকে অবজ্ঞা করে সালাম দিলেনা তুমি? তোমার এই স্বভাবের কথা অন্যেরা শুনলে তারা ভাববে আমরা তোমাকে শিক্ষা দেইনি। সত্যিই কি আমরা তোমাকে শিক্ষা দেইনি? ”
আম্মার গলা শুনে আরও একবার চমকায় রাখী। সেই সাথে আঁচ করতে পারে আম্মার রাগ।
” ভুল হয়ে গেছে, আম্মা। এরপর থেকে যে ই ফোন দিক না কেন তাকেই সালাম দেব। ”
” কথাটা মনে থাকে যেন। এবার বল, কেমন আছো তোমরা? নিহান নানু ভাই বাসায় আছে? দৃষ্টি মনি কি করছে? ”
” সবাই ভালো আছি। নিহান গতকাল চলে গেছে। দৃষ্টি রান্নাঘরে। ” এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল রাখী।
” রান্নাঘরে! ও রান্নাঘরে কেন? কি কাজ করতে দিয়েছ ওকে? ”
” রান্না করছে। তবে আমি করতে দেইনি। ও নিজ থেকেই রান্না করছে। আজকে কুহুরা আসছে, তাই রান্না করছে। ”
” ওকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নিওনা। তবে ও যদি শখের বশে কাজ করতে চায় বাঁধা দিওনা। ওর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছ না তো? ”
আম্মার প্রশ্নে ভয়ে ঢোক গিলল রাখী। তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” ওর সাথে আজ পর্যন্ত খারাপ আচরণ করিনি, আম্মা। ও এখানে বেশ ভালোই আছে। ”
” মিথ্যা বলছ বলে মনে হল। শোন রাখী, তুমি আমার সন্তান। আমি তোমাকে পেটে ধরেছি, তুমি আমাকে নও। তোমার গতি-প্রকৃতি আমার থেকে ভালো কেউই জানেনা। তাই আমার সাথে মিথ্যা বলতে যেওনা। এতে তুমি আমার বিশ্বাস হারাবে। কোনদিনই তোমাকে বিশ্বাস করতে পারবনা আমি। তুমি সত্য বললেও আমার বদ্ধমূল ধারনা থাকবে, তুমি মিথ্যা বলছ। আবারও সাবধান করে দিচ্ছি, দৃষ্টি মনি কিংবা ওর ভাইবোনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করো না। দৃষ্টি এখন নিহানের স্ত্রী। ওর সম্মান, ভালোমন্দ সবকিছু দেখার দ্বায়িত্ব তোমার। তোমার দ্বারা যদি ওরা সামান্যতম কষ্টও পায়, তবে এর ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। প্রয়োজনে তোমাকে ত্যাগ করব আমি এবং আমার ছেলেরা। ”
” আপনার কথা মনে থাকবে, আম্মা। ওদেরকে নিজের সন্তানের মতই দেখব আমি। এবার বলুন আপনার শরীর কেমন আছে? বাড়ির সকলে কেমন আছে? ”
” আমরা সবাই ভালো আছি। কুহু সোনা পৌঁছালে আমাকে জানিও। নিয়াজ কোথায়? কেমন আছে সে? ”
” নিহানের বাবা বাহিরে গেছে। ওর শরীরটা দুইদিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা। আমি ভাবছি, কয়টা দিন ছুটি নিতে বলব। ওকে নিয়ে ঢাকা যাব। তাহমিদকে সাথে নিয়ে ভালো ডক্টরের কাছে যেতে হবে। ”
” আমি নিয়াজের সঙ্গে কথা বলব আজকেই। তাকে আসতে বলব। তুমি ওর যত্ন নিও। ”
” জ্বি, আম্মা। আনানরা আসলেই আমি আপনাকে ফোন করব। দৃষ্টির সঙ্গে কথা বলবেন, আম্মা? ”
” দাও। ”
রাখী আক্তার দৃষ্টিকে ডেকে ওর কাছে ফোন দিল৷ দৃষ্টি হাসিমুখে নানিমার সঙ্গে কথা বলতে থাকে।
” দৃষ্টি ভাবী, কেমন আছেন? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? শুনলাম আপনার সোয়ামী এসেছিল? ” বাসায় ঢুকেই আনান দৃষ্টির পেছনে লাগল।
” ধুর ভাইয়া, কি বলছ যা তা। ” আনানের কথায় লজ্জা পেয়েছে দৃষ্টি।
” কেমন আছিস, সোনা? তুমি ভালো আছ, বড়মা? ” কুহু দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বড়মাকে জিজ্ঞেস করল।
শিহাব দৌড়ে এসে দৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরল।
” কুহু, শিহাব, তোরা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। খেয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নিবি। আনান, তুইও যা। খাওয়ার পর ভাবীর সঙ্গে ইয়ার্কি করিস। ”
রাখী আক্তারের নরম গলা শুনে প্রত্যেকেই অবাক হয়ে গেল।
” সূর্য কি আজকে দক্ষিণ দিকে উদিত হয়েছে, মা জননী? তোমার গলা এত নিরুত্তাপ শোনাচ্ছে কেন? তবে কি তুমি সংসারধর্ম ত্যাগ করে সন্যাসধর্ম বেছে নিয়েছ? ” আনান খোঁচা মারার সুযোগ ছাড়লনা।
” যা বেয়াদব ছেলে, খালি সবার পেছনে লাগার চিন্তা করে। ”
আম্মুর ধমক খেয়ে আনান দৌড়ে রুমে গেল। সাথে নিয়ে গেল শিহাবকে৷
” আসেন, বেয়াই। আমরা দুই বেয়াই মিলে এক রুম শেয়ার করব। ”
আনান ওকে বেয়াই বলায় লজ্জা পেল শিহাব। ও কিছু না বলে আনানের সঙ্গে ওপরে গেল।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৭
বাসায় ঢুকেই বুকটা ভারী হয়ে গেল তাহমিদের। ও গতরাতেই শুনেছিল কুহু আজ চলে যাবে। ভেবেছিল, মেডিকেলে যাওয়ার আগে ওর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু সকালে ইমারজেন্সি কাজ পরে যাওয়ায় ওর শ্যামাঙ্গিনীর সঙ্গে দেখা হলোনা। তাহমিদকে আরও পনেরদিন অপেক্ষা করতে হবে ওর শ্যামাঙ্গিনীর দেখা পেতে। ওর ভাইভা আরও পনের-বিশ দিন পর হবে। সে হয়তো ভাইভার দুই-এক দিন আগে আসবে। সারাটাদিন মনমরা হয়ে কাটাল তাহমিদ। সকালে না খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুপুরেও কিছু খায়নি, আবার রাতে ক্ষুধা থাকলেও খেতে ইচ্ছে করলনা ওর। সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ছাদে গেল। সারারাত ছাদের মেঝেতে শুয়ে কাটাল।