সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৯
জাওয়াদ জামী
রাতের নিশ্চুপ আকাশে তারার ম্লান আলো মিটমিট করে জ্বলছে। পুরো আকাশটাই যেন অভিমানে ভরা কোন প্রিয়ার মুখ। তাহমিদ সিগারেট ধরালো। ধোঁয়ার সাথে বুকের ভারটা হালকা করতে চাইছে। ওর চোখে শূন্যতা। বুকে তার শ্যামাঙ্গিনীকে না দেখতে পাওয়ার হাহাকার।
” শ্যামাঙ্গিনী, তোমার দুরত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে , তুমি আমার কতটা জুড়ে রয়েছ। আমি বুঝতে পারছি, তোমাকে ছাড়া এক-একটা দিন আমার এক-একটা যুগের ন্যায় কাটবে। এই বিরহ আমি সইব কেমন করে?
” তুই আজকেও রান্না করছিস, দৃষ্টি! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসব কি শুরু করেছিস তুই? ” দৃষ্টিকে রান্নাঘরে দেখে ধমকে উঠল রাখী আক্তার।
” আপু ছয়টার দিকে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। তুমি সকালে উঠতে পারোনা। আনান ভাইয়া আটটার মধ্যে নাস্তা করে। সেজন্য ভাবলাম তোমাদের নাস্তা রেডি করে তারপর যাই। ”
” কি রান্না করছিস? ”
” আলুর পরোটা, রুটি, টমেটোর চাটনি, ডিম ভাজা, পটল ভাজা। তুমি উঠেছ, তাহলে আমরা এখনই বের হব। আপু, শিহাব রেডি হয়েই আছে। ”
গতকাল সন্ধ্যার দিকেই কুহু গ্রামে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়াজ মাহমুদ ওদের যেতে দিতে রাজি হননি। বাধ্য হয়ে কুহুকে এখানে থাকতে হয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তোরা না খেয়েই বের হবি? বাড়িতে গিয়ে রান্না করতে কত সময় লাগবে জানিস? সবাইকে ডাক। একসাথে খেয়ে নিবি। তারপর বাড়িতে যাবি। ”
” আমি সবার জন্য রান্না করিনি, বড়মা। আমি শুধু তোমাদের তিনজনের জন্য রান্না করেছি। জানোইতো, আপু সকালে খেতে পারেনা। শিহাবও ঘুম থেকে ওঠার পর কিছুই খায়না। ”
” কুহুতো রাতেও কিছুই খায়নি। এখনও না খেয়েই যাবে? এটা কেমন কথা? আর ওরা খায়না বলে, তুইও কিছুই রান্না করবিনা? দেখি সর। আমিই কিছু বানাই। ”
” তোমাকে কিছুই করতে হবেনা, বড়মা। আপু রাতটুকু এখানে ছিল শুধু বড় চাচার কথায়। আপু চায়না ওদের জন্য তুমি ঝামেলায় পর। ”
” বেশি কথা বলিসনা, দৃষ্টি। যা ওদের ডেকে নিয়ে আয়। ততক্ষণে আমি তোর চাচার জন্য রুটি বানিয়ে ফেলি। এই সাত-সকালে বাসি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে চায়! তোর চাচা শুনলে রাগ করবে এটা জানিসনা? ”
রাখি আক্তারের নরম গলা শুনে বিস্মিত দৃষ্টি কুহুকে ডাকতে গেল।
” হেই তাহমিদ, গতকাল তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম। কতবার তোমাকে ফোন দিলাম। কিন্তু তুমি রিসিভ করলেনা। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? ” মেডিকেলে ঢুকতেই একটা মেয়ে দৌড়ে এসে কথাগুলো বলল।
” তোমার সঙ্গে কি আমার কোন অ্যাপয়েনমেন্ট ছিল? তেমন কিছু মনে পরছেনা তো। আর প্রয়োজন ছাড়া আমি কাউকে ফোনও করিনা, কারও ফোন আমি রিসিভ করিনা। বিরক্ত লাগে। ”
তাহমিদের কথা শুনে মেয়েটার মুখ চুপসে গেল। মিনমিন করে বলল,
” আমি ভেবেছিলাম, তোমার সঙ্গে বসে এক কাপ কোল্ড কফি খাব। ধানমন্ডিতে নতুন একটা কফিশপ হয়েছে। ওরা কোল্ড কফি খুব ভালো বানায়। চলনা আজকে যাই? তোমার সঙ্গে কফি ডেটে যাব বলে আমি আমার কাজিনের বার্থডে পার্টি বাদ দিয়েছি। ”
” শাট-আপ, জায়রা। তুমি আজ পর্যন্ত কোন মেয়ের সঙ্গে আমাকে কফি খেতে দেখেছ? আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে যে দু’জন মেয়ে আছে, তারা আমার দুই ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড বলেই আমাদের সার্কেলে তাদের জায়গা হয়েছে এটা নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার? নওশিন আর মিলা ছাড়া অন্য মেয়েদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলিনা আমি, সেটাও নিশ্চয়ই তুমি জানো? সবকিছু জানার পরও কেন তুমি আমার সঙ্গেই কফি ডেটে যেতে চাও? তোমার এর আগের কফি ডেটে যাওয়ার প্রস্তাবও আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। তারপরও কেন তুমি নাছোড়বান্দার মতো আমা৷ পিছে পরে আছ? আমার এসব ভালো লাগেনা। ”
রেগে গেছে তাহমিদ।
” আ ইউ কমিটিড ঠু সামওয়ান এলস? ” থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল জায়রা।
” ইয়াহ্, আ’ম ডিপলি ইন লাভ উইথ সামওয়ান। ”
হাসিমুখে জবাব দিল তাহমিদ।
” সৌ, হু ইজ দ্যাট গার্ল? ” চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল জায়রা।
” শি ইজ দ্য এনচ্যানট্রেস অব মাই হার্ট। দ্য রিজন আই লিভ। শি ইজ মাই হার্টবিট। ” আবেগী গলায় বলল তাহমিদ।
” সে ও কি মেডিকেল স্টুডেন্ট? আমার লেবেলের সে? তার বাবা-মা ও কি আমার বাবা-মার মত ডক্টর? ”
” ভালোবাসা কি কারও অবস্থান দেখে কিংবা যোগ্যতা দেখে হয়? হ্যাঁ, যদিও সে তোমার মত মেডিকেল স্টুডেন্ট নয়। তার বাবা-মাও তোমার বাবা-মার মত ডক্টর নয়। ইনফ্যাক্ট তার বাবা-মা বেঁচে নেই। তবে সে বুয়েটে ভর্তি হবে খুব তাড়াতাড়ি। আর হ্যাঁ, সে তোমার লেবেলের নয়। বরং উল্টো। তুমি তার লেবেলের নও। এবং হতেও পারবেনা কোনদিন। আর একটা কথা, এই যে অহংকার কর নিজের লেবেল নিয়ে, রূপ নিয়ে, ফ্যামিলি নিয়ে। তাহলে শুনে রাখ, ভালো ডক্টর তুমি কোনদিনও হতে পারবেনা। কোন ডক্টরের মধ্যে কখনো যদি অহংকার জন্মায়, তাহলে সে সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর ডক্টরের কাজ বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়, বরং সাধারণ মানুষদের কাছাকাছি গিয়ে তাদের আপনজন হওয়াই ডক্টরের মুখ্য উদ্দেশ্য। ”
” হোল্ড ইট। আ’ম নট হেয়ার ঠু হেয়ার আ সারমন অন ইওর পারফেক্ট গার্লফ্রেন্ড। বাবা-মা বেঁচে নেই মানে সে অরফ্যান। আর একজন অরফ্যান হবে আমার লেবেলের! হাসালে। নিশ্চয়ই সে অন্যের কাছে হাত পেতে নিজের পেট চালায়? তোমার পছন্দ দেখে আমি অবাক হচ্ছি। দ্য গ্রেট তাহমিদ রাশেদীনের রুচি এত নীচ হতে পারে সেটা আমার জানা ছিলনা। ”
” বি কেয়ারফুল হাউ ইউ স্পিক। পাবলিক প্লেসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো তুমি যদি না বলতে, তবে এই মুহূর্তে থাপড়ে তোমার গাল আমি লাল করে দিতাম। আজকে প্রথম এবং শেষবারের মত বলছি, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা তো দূর, আমার সামনেও আসবেনা। আজকের পর থেকে তোমার প্রতি ঘৃণা ছাড়া আমার কিছুই থাকবেনা। কারন তোমার মত মেয়েকে ভালোবাসা যায়না। ”
লজ্জায় অপমানে জায়রা অন্য দিকে চলে গেল। কারন ওর ফ্রেণ্ডরা এতক্ষণ দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।
” আপু , ঐ বাসায় থাকতে কোন অসুবিধা হয়নি তো? ”
” ঐ বাড়ির প্রত্যেকেই খুবই ভালো। চার মামীই কেউ কারো থেকে কম ভালো নন। ”
কুহুরা গ্রামে এসেছে। বাড়িঘর ঝাড়ামোছা করে ওরা রান্নাঘরে কাজ করছে আর গল্প করছে।
” তোমার জন্য ভিষণ চিন্তা হচ্ছিল। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে কাউকে বলতে পারোনা, ক্ষুধা লাগলেও বলোনা। সেজন্য তুমি কোথাও একা গেলে আমার চিন্তা হয়। ”
দৃষ্টির কথায় ওর দিকে তাকায় কুহু। মূহুর্তেই মনে হল, ওর সেদিনের সেই ছোট্ট বোনটা বড় হয়ে গেছে।
” প্রয়োজনিয় সবকিছুই সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর প্রতিঘন্টায় নিয়ম করে মামীরা খাবার নিয়ে সেঁধেছেন। তাই কোনরূপ অসুবিধা আমার হয়নি। ভালো কথা, নিহান ভাইয়া এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে? আমি ঢাকায় ছিলাম, কিন্তু ভাইয়া দেখাও করতে গেলোনা। কেন বলতো? ”
” বলল, কিসের নাকি ব্যস্ততা তার। তবে তুমি পরেরবার গেলে নাকি যাবে। তোমার ভর্তি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই থাকবে। তুমি আবার ঢাকা যাবে কবে? এবারেও কি আনান ভাইয়া তোমাকে নিতে আসবে? বলেছে কিছু? ”
” ভাইভার দুই-এক দিন আগে যাব। আনান ভাইয়া বোধহয় আসতে পারবেনা। শিহাবকে নিয়ে আমাকে যেতে বলেছে। ভাইয়া বাসস্ট্যান্ডে থাকবে। ভাইয়ার নাকি পরীক্ষা। তাই আমিও তাকে আসতে নিষেধ করেছি। এই দৃষ্টি, বড় চাচীর মুড সকালে ভালো মনে হল। দেখে ভালোই লাগল। কোন কারন আছে নাকি? ”
” তার মুড কখন কখন সুয়িং হয় সেটা সে নিজেও জানেনা৷ আমি তো কোন ছাড়। গতকাল দিদুন ফোন দিয়েছিলেন। দিদুনের সাথে কথা বলার পর থেকেই বজ্জাত মহিলার মুখ থেকে মধু ঝরছে। ”
” এসব কি ভাষা তোর, দৃষ্টি ? বড়মা তোর গুরুজন সেটা ভুলে গেছিস? বড় চাচা যদি শোনে, বড়মাকে নিয়ে তোর চিন্তাভবনা এমন, তবে তিনি কি ভাববেন বলতে পারিস? বাবা-মার অবর্তমানে তারাই আমাদের অভিভাবক সেটা মনে নেই তোর? আর কখনোই যেন তোর মুখে এমন কথা না শুনি। ”
” আমি কিছুই ভুলিনি, আপু। আমি তো অনেক কম বলেছি। বড়মা আমাদের সম্পর্কে যা কিছু বলে তার তুলনায় আমার কথাটা কমই হয়ে গেছে। সে গুরুজন হতে পারে, কিন্তু সম্মান পাবার যোগ্য সে নয়। নিজে সম্মান পেতে হলে অন্যকেও ভালোবাসতে হয়, সম্মান করতে হয়। ”
” দৃষ্টি! তুই এভাবে বলছিস? বাবা-মা আমাদের এমন শিক্ষা তো দেয়নি। বাবা-মার শিক্ষার ওপর কেউ আঙুল তুললে তোর শুনতে ভালো লাগবে? যারা এই দুনিয়ায় নেই, তাদের নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে শুনতে ভালো লাগবে তোর? ”
” বাবা-মা শিক্ষা দেয়নি কারন তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। আমাদের ঢাকায় বাড়ি ছিল, গাড়ি ছিল। বাবার জমজমাট ব্যবসা ছিল। আমরা নামীদামী স্কুলে পড়তাম। তখন সবাই আমাদের মাথায় তুলে রাখত। আর আমার বোকা মা এসব দেখে ভেবেছিল, সারাজীবন সবাই আমাদেরকে এভাবেই ভালোবাসবে। মা যদি জানত, তাদের অবর্তমানে আমরা অনেকের কাঁধের বোঝা হয়ে যাব, তখন নিশ্চয়ই বাস্তবিক কিছু জ্ঞান শেখাতো। শেখাতো, কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়, কিভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে হয়, কিভাবে শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে জিততে হয়, কিভাবে উপকারীর উপকার ভুলে যেতে হয়, কিভাবে, আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। আরও অনেককিছুই শেখাতো মা। আসলে আমার বাবা-মা বোকার হদ্দ ছিল। তাই মুখোশধারী আত্নীয়দের চিনতে পারেনি, তাদের জন্য অকারনেই খেটেছে তারা। সেসব বেইমানদের পেছনে টাকাপয়সা খরচ না করে যদি ব্যাংকে জমাতো, তবে আজ আমাদের এমন দুর্দশা হতোনা। ” রাগে-অভিমানে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল দৃষ্টি।
দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে কুহু চমকায়। ও উঠে এসে আদরের বোনটিকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
” আমি তোমার মত হতে পারবনা, আপু। হতে চাইওনা। তোমার মত দরদী হতে গিয়ে কারও কাছে অপদস্ত হতে পারবনা, কারও কটুকথা শুনতে পারবনা। সইতে পারিনা এসব আমি। প্রতিবাদ আমি করবই। আমি দৃষ্টি, আমি আমার মতই হতে চাই। তোমার মত নয়। কারন কুহুদের মত নরম-সরম মেয়েরাই এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। তাদেরকে আঘাত দিয়ে কতিপয় মানুষ নামক প্রানী নগ্ন উল্লাসে মাতে। যেটাকে আমি ঘৃণা করি। ” বোনের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল দৃষ্টি।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ১৮
কুহু বুঝল এই মেয়েটা অগ্নি স্ফূলিঙ্গ। একে ঘাঁটানো মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু ওর বাবা-মাতো এমন ছিলনা। তারা ছিল শান্ত নদীর মত। এই মেয়েটা কেন ব্যাতিক্রম হলো? নিজেকেই প্রশ্ন করল কুহু। পরক্ষণে জবাবও মিলল। পরিস্থিতিই দৃষ্টিকে এমন কঠিন বানিয়েছে। অল্প বয়সেই কাছের মানুষদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখেছে, দেখেছে তাদের অভিনয়। শুনেছে অনেকেরই নানান কথা। এমনও দিন গেছে শুধু পানি খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারন করেছে। তখনও কিছু আত্নীয় নামধারী মানুষজন এসে দু মুঠো ভাত দেয়নি। নিজেদের খাবার নিজেদেরকেই জোগাড় করতে হয়েছে। দৃষ্টির কঠোর হওয়ার পেছনের কারন এগুলোই। এতকিছুর মাঝেও কুহু নিজেকে বদলায়নি। কিন্তু সবাই কুহু নয়।