তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৪
অহনা আক্তার
আজ মুসকানের লাস্ট এক্সাম। আর আজই সে তার শশুর বাড়ি চলে যাবে। বড় ছেলের পুরো পরিবারকে বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করেছেন এরশাদ তালুকদার। শুধু বড় ছেলের পরিবারকেই না মেয়ে জিন্নাত ও নাতনি তানিয়ার শ্বশুর বাড়ির লোকদেরও নিমন্ত্রণ করেছেন। তারা সকলেই নিমন্ত্রণ রক্ষার্তে তালুকদার বাড়িতে হাজির আজ। ফারিশ সেদিনের পর আর তালুকদার বাড়িতে না এলেও বউয়ের সাথে ঠিকই দেখা করেছে। মুসকানের প্রতিটি এক্সামের শেষেই ফারিশ বাইক নিয়ে মুসকানের স্কুলে হাজির।
মুসকানকে অবাক করে দিয়ে সে ঘন্টার পর ঘন্টা মুসাকানের সাথে টাইম স্পেন্ড করেছে । পুরো গ্রাম বউকে বাইকে নিয়ে ঘুরেছে। এই গ্রামের মেয়ে হয়েও মুসকান কখনো বাবা, দাদার সাথে হাটে ছাড়া কোথাও যায়নি। আর সেই কিনা বরের সাথে বাইকে করে এক্সামের প্রতিটা দিন নিত্য নতুন জায়গায় গিয়েছে। পুরো গ্রাম চক্কর কেটেছে। গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরেছে । তাদের গ্রামে যে এতো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সেটা ফারিশের সাথে না ঘুরলে দেখতেই পেতো না মুসকান। এক্সামের পুরোটা মাস তার কাছে স্বপ্নের মতো কেটেছে। রাত জেগে পড়ার পাশাপাশি সারারাত বরের সাথে প্রেমালাপ করেছে। ফারিশের ধ্যানে মগ্ন হয়ে কয়েকটা এক্সাম খুবই খারাপ দিয়েছে মুসকান । কালকেও সারারাত কথা বলে ভোরের দিকে পড়তে বসেছে সে। যার জন্য আজকের এক্সামটাও তেমন ভালো দেয়নি। সে নিয়ত করে রেখেছে ফাইনালের আগে খুব ভালো করে পড়াশোনা করবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজকে পরীক্ষা শেষে ফারিশ আর মুসকানের স্কুলে গেলো না। ডিরেক্ট বাবা,মা,বোনকে নিয়ে তালুকদার বাড়ি চলে এসেছে। এতোদিন ফারিশ মুসকানকে কেবল তালুকদার বাড়ির রাস্তায়ই নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। মুসকান রিকুয়েষ্ট করেও বাড়ির ভিতরে আনতে পারতো না। কাজ আছে বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে দিত। কিন্তু আজ মুসকান খুশি। ফারিশ বাড়িতে এসেছে বলে। ইদানীং ফারিশকে খুব ভালো লাগে তার। ফারিশের আশেপাশে থাকলে শান্তি লাগে। আর লাগবেনাই বা কেন। লোকটা কতো কেয়ার করে তার।
সে যা আবদার করে তাই পূরণ করে। হুটহাট মজার মজার কথা বলে তাকে হাসায়। চু*মু দিয়ে গাল লাল করে ফেলে। লাগাম ছাড়া কথা বলে লজ্জা দেয়। তার একটু মন খারাপ হলে ভালো করার জন্য উতলা হয়ে পরে। এমন মানুষকে কি ভালো না লেগে পারে। ফারিশ যখন স্কুলের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে মুসকানের জন্য অপেক্ষা করে তখন ফারিশের নজরকাড়া হেন্ডসাম লুক দেখে হার্টবিট মিস হয়ে যায় মুসকানের। লোকটা যখন মুচকি হেসে বাইকে ওঠার জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় বুক কাঁপতে শুরু করে তার। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় পুরো শরীর।
মিন্নি, তিন্নি কে নিজের দুই হাটুর উপর বসিয়ে তাদের সাথে দুষ্টুমি করছে ফারিশ। বাচ্চা ফারিশের খুব পছন্দ। দু’মিনিটেই বাচ্চাদের সাথে মিশে যেতে পারে সে। এইতো মিন্নি, তিন্নি কে কি সুন্দর পটিয়ে ফেলেছে। রাতুলও ফারিশের সাথে দারুন মিশে গেছে। মুসকানের কাছে ফারিশকে আগে গম্ভীর লাগলেও এখন আর লাগে না। ফারিশ নিজেও অবাক নিজের আচরণে। মুসকানের সাথে বিয়ের পর কতটা পরিবর্তন এসেছে তার মাঝে। অলটাইম তার ঠোঁটে মৃদু হাসি লেগেই থাকে। অথচ বন্ধু বান্ধবের সাথে ছাড়া সে কখনো এতো হাসিখুশি থাকেনি। ফারিশের বরাবর একটি সোফায় পা ছড়িয়ে বসে চোখমুখ ফুলছে রিশাদ।
তার এখন ফারিশকে খু*ন করতে ইচ্ছে করছে। মুসকানকে ফারিশের সাথে বিয়ে দেওয়ার অপরাধে এরশাদ তালুকদার কেও দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে ইচ্ছে করছে। এখনে আসার পর থেকে মুসকানের উপর নজর দিয়ে রেখেছে রিশাদ। চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার মুসকানকে দেখছে। মুসকান কখন কি করছে কোথায় যাচ্ছে সব খেয়াল করছে। মুসকান রিশাদের নজর বুঝতে পেরেও উপেক্ষা করে যাচ্ছে। মাথায় খুব শালীন ভাবে ঘুমটা টেনে মা,চাচিদের কাজে সাহায্য করছে। অন্যসময় হলে ভুলেও রিশাদের সামনে আসতো না সে। কিন্তু এখন বাড়িতে মেহমান ভর্তি। দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে হচ্ছে।
যার জন্য না এসে উপায় নেই। এই অ’সভ্য ছেলেকে দু’চোখে দেখতে পারেনা মুসকান। রিশাদ মুসকানকে একা পেয়ে পরপর কয়েক’বার তার সাথে বা*জে আচরণ করার চেষ্টা করেছে। পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরেছে। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে । তখন মুসকান ক্লাস এইটে পরত। ভয়ে চাচাতো বোন তানিয়া ছাড়া আর কারো কাছে কিছু বলেনি। তানিয়াই মুসকানকে সামাল দিয়েছে, বুঝিয়েছে, রিশাদের ধারে কাছে না ঘেঁষতে বলেছে। এমনকি আজকেও তানিয়া মুসকানকে সারাক্ষণ নিজের সাথে সাথে রাখছে।
___খাওয়া দাওয়ার পার্ট চলছে। খাবার টেবিলে বসিয়ে খুব আপ্পায়নের সাথে তানিয়া আর জিন্নাতের শ্বশুর বাড়ির লোকদের খাওয়ানো হচ্ছে। তারা খাওয়া দাওয়া করেই চলে যাবে। প্রায় বিকেল হতে চলল। সকল মেহমানদের খাওয়ানো শেষে এখন বাড়ির মহিলারা খেতে বসেছে। শিল্পী আর রাহিলা বড় জা তাজমহলের সাথে ভালোই মিশে গেছে। তাদের দেখে বুঝাই যায় না এতোবছর তারা অপরিচিত ছিলো। আলাদা জায়গায় থাকতো। মনে হয় এই বাড়িতেই সকলে মিলেমিশে থাকতো।
মা,শ্বাশুড়ি,চাচি,ফুপিমণি সবাই একসাথে খেতে বসেছে দেখে মুসকানের খুব ভালোলাগছে। তার চোখের কোণে জল জমেছে। আর কবে সকলকে একত্রে এভাবে দেখবে কে জানে! সে তো আজকেই চলে যাবে। ফারিশতো মনে হয় ফাইনাল এক্সামের আগে আর আসতে দিবে না তাকে। মুসকানের একটু মন খারাপ হয়। সে নিজের রুমে গুছগাছের জন্য চলে আসে। অন্যমনষ্ক হয়ে বইখাতা, কাপড়চোপড় গুছাতে শুরু করে। পেছন থেকে একটা হাত এসে মুসকানের পেট জরিয়ে ধরতেই মুসকান আঁতকে উঠে। ঘুরে এক ধা’ক্কা দিতে নিলেই ফারিশকে দেখে থেমে যায়। ফারিশ মুসকানের মুখের উপর পরে থাকা চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে দিয়ে বলে,
— কি হলো মন খারাপ?
মুসকান দুই দিকে মাথা নাড়ে।
— তাহলে এমন মনমরা হয়ে আছো কেন?
— এমনি।
ফারিশ মুসকানের কোমরটা চেপে আরেকটু কাছে এনে বলে,
— এমনি কেউ এমন থাকে?
মুসকান কথা কাটায়,
— গো..গোছানো বাকি আমার।
ফারিশ মৃদু হাসে। দুষ্টু কণ্ঠে বলে,
— একদম কাছে আসতে দেওনা তুমি আমায়। বিয়ের কয় মাস চলে গেল এখনো বাসর করতে পারিনি। এমন হলে আমার যন্ত্রপাতি তো সব জং ধরে যাবে। নিজের বরকে কেউ এতো অপেক্ষা করায়।
মুসকান লজ্জা পায়। লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ফারিশ মুসকানের মুখটা পুনরায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
— লজ্জা পেলে চলবে না। আমার কথার উত্তর চাই। বলো আর কতদিন অপেক্ষা করাবে আমায়?
মুসকান নিচু স্বরে বলে,
— সরুন কফি নিয়ে আসি আপনার জন্য।
— আবার কথা ঘুরানো হচ্ছে?
বাইরে থেকে ধারাম করে শব্দ হতেই মুসকানকে ছেড়ে দিল ফারিশ। দু’জনেই অবাক হয়ে ছুটে রুমের বাইরে বের হলো। নিচে একটা ফ্লাউয়ার ভাজ ভেঙে পরে থাকতে দেখে ফারিশের কপাল কুঁচকে গেল।
— দেখেতো মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে ভেঙেছে! কিন্তু কে ভাঙবে?
মুসকানের গলা শুকিয়ে গেল। এটা রিশাদ ভাই ছাড়া কেউই হবে না । সে ফারিশের পেছন দিকে দরজার আড়ালে রিশাদের পা দেখেছে। নিশ্চয়ই রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে এতোক্ষণ তাদের দেখছিল। কিন্তু এখন কি বলবে। মুসকান আমতাআমতা করে বলল,
— বি..বিড়াল হবে হয়তো। আপনি রুমে বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি।
ফারিশের সন্দেহ হয়। আজকে সারাক্ষণ মুসকান কেমন অস্থির হয়ে আছে আবার চুপচাপও। অথচ অন্যসময় কত উৎফুল্ল থাকে। সে আর কিছু বলল না। হয়তো সবাইকে রেখে চলে যাবে বলে মন খারাপ।
মুসকান রান্না ঘরে এসে দেখে কেউ নেই। তার আম্মা আর বাকি সবাইতো খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। ফাইজা, রিতা, তানিয়া আপু সবাই মনে হয় ড্রয়িং রুমেই আড্ডা দিচ্ছে। মুসকান একা একাই ফারিশের জন্য কফি আর সকলের জন্য চা বানাতে শুরু করল। রিশাদ মুসকানকে রান্নাঘরে যেতে দেখে সুযোগ বুঝে সেও রান্নাঘরে ঢুকে পরে। পেছন থেকে মুসকানের অনেক কাছে এসে বলে, — ‘শুধু কি বরের খেয়ালই রাখবি? আমার খেয়াল ওতো একটু রাখতে পারিস। ‘
রিশাদের গলা শুনে মুসাকান জলদি পিছনে ঘুরে । রিশাদকে তার এতো কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত পিছনে চলে যায়। রিশাদ আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
— আমায় এতো ভয় পাস কেন তুই? ভয়ে আমার সামনেই আসতে চাস না। তোকে দেখার জন্য আমি কতো ছটফট করি জানিস?
রিশাদ কথা বলে মুসকানের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে অনেকটা ঝুঁকে পরেছে। মুসকানের পেছনে আর জায়গা নেই যে আরো পেছাবে। রিশাদকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধে পেছনে তাকায়। আর পেছনে তাকিয়েই সে জোরে চিল্লিয়ে ওঠে। “আ’গুন” মুসকানের ওড়নায় আ’গুন লেগে প্রায় অর্ধেক ওড়না জ্বলে গিয়েছে। আ’গুনের ভয়ে সে সাধারণ জ্ঞান বুদ্ধিও ক্ষুয়ে বসেছে। গাঁ থেকে যে ওড়না ছুড়ে ফেলা উচিৎ সে এটাও বুঝতে পারছে না। রিশাদ মুসকানের ওড়নায় হাত দিতে গেলে মুসকান চিল্লিয়ে দূরে সরে যায়। রিশাদও আ’গুন দেখে কোনো দিকবিদিক খোঁজে পাচ্ছে না। মুসকানতো তাকে গাঁ থেকে ওড়না সরাতেই দিচ্ছে না। সে এক জগ পানি নিয়ে মুসকানের উপর ছুড়ে মারে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। আ*গুন ততক্ষণে মুসকানের ওড়নার বেশ অর্ধেক পুড়ে মুসকানের জামার হাতায়ও লেগে গিয়েছে। মুসকানের চিৎকার শুনে ফারিশই সবার আগে ছুটে রান্না ঘরে আসে। আর আসতেই মুসকানকে এই অবস্থায় দেখে তার কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। “মুসকান” বলে এক ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে সে চিতাবাঘের মতো দৌড়ে মুসকানের কাছে আসে। মুসকানের গাঁ থেকে ওড়না ছুড়ে ফেলে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বুকে জাপটে ধরে। পা’গলের মতো মুসকানের জামার হাতা থেকে আগুন নিভিয়ে বলতে থাকে,
— কিচ্ছু হবে না জান! কিচ্ছুনা! আমি আছি না! আমি কিছু হতে দিবো না তোমার ! তাকাও আমার দিকে! মুসকান প্লিজ তাকাও একবার!
মুসকান ততক্ষণে নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মুসকানকে ওড়না ছাড়া ভেজা শরীরে দেখে ফারিশ নিজের শার্টে বুতাম গুলো একটান দিয়ে ছিঁড়ে সেই শার্ট মুসকানের গায়ে জড়িয়ে দিল। বাড়ির সকলে চিৎকার শুনে কখনই রান্নাঘরে চলে এসেছে । সবাই মুসকানের এই অবস্থা দেখে দিকশূন্য হয়ে কেবল ফারিশের কান্ডই দেখে যাচ্ছে। ফারিশ ডানেবামে না তাকিয়ে মুসকানকে কোলে তুলে নিল। দৌড়ে মুসকানের রুমের দিকে ছুটলো। সকলের ততক্ষণে স্তম্ভিত ফিরে এসেছে। তারা সবাই ফারিশের পিছু পিছু মুসকানের রুমে ছুটে আসে।
ফারিশ মুসকানকে খাটের উপর শুইয়ে দিয়ে তাকে অনবরত ডাকতে থাকে। রিতা ততক্ষণে আরেকটা ওড়না এনে মুসকানের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে। তানিয়া আর রাহিলা মুসকানের হাতে পায়ের তালু ঘষতে শুরু করেছে। তাজমহল মুসকানের পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া বাহুতে বরফ ঘষে দিচ্ছে। ফাইজা একটা গ্লাসে করে পানি এনে তার ভাইয়ের হাতে দিল। ফারিশ মুসকানকে ডেকে ডেকে তার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আর এসব কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেলো রিশাদ। তার সামনে মুসকান এতো বড় একটা বিপদে পড়ল অথচ সে কিছুই করতে পারলো না। উল্টো ফারিশ এসে কখন মুসকানকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেলো তার সামনে দিয়েই!
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ১৩
মুসকানের জ্ঞান ফিরতে না দেখে ফারিশের অবস্থা পা’গলপ্রায়। সে ব্যাকুল হয়ে তার মাকে বলছে,
— ওর জ্ঞান ফিরছে না কেন মা? ডক্টরকে ফোন দাও জলদি। আমি কি হসপিটালে নিয়ে যাব ওকে?
তাজমহল ছেলের পা’গলামোতে মৃদু হাসেন। ছেলের বাহুতে হাত রেখে বলেন,
— হসপিটালে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে।
ফারিশ মায়ের কথায় স্বস্তি পাচ্ছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসকানের জ্ঞান না ফিরবে তার কিছু ভালো লাগবে না।