সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২১

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২১
জাওয়াদ জামী

” কুহু মা, টাকাগুলো রাখ। ঢাকা যেতে, ভর্তি হতে অনেক টাকা লাগবে। তোর যখন যা লাগবে আমাকে বলবি। একদমই লজ্জা পাবিনা। তুই ঢাকা থেকে ফিরলে আমি আরেকবার এসে ঘুরে যাব। ” রেহানা আক্তার কুহুর হাতে সাত হাজার টাকা দিয়ে কথাগুলো বললেন।
” ফুপু, এখন আমার টাকা লাগবেনা। যখন লাগবে, তখন তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেব। এই যে তুমি আমাদের দেখতে এসেছ এতেই আমরা অনেক খুশি। এভাবে মাঝেমধ্যে আমাদের দেখতে এস তাহলেই হবে। ”
” এটা কি বললি তুই? টাকা নিবিনা মানে? আমি কি আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কিছুই দিতে পারিনা? তুই কি আমাকে পর কর দিতে চাচ্ছিস? ”

” বাবা-মা চলে যাওয়ার পর তোমাকে আঁকড়ে ধরেই আমরা বেঁচে আছি, ফুপু। সেই তোমাকে কি আমরা পর করতে পারি? তুমি গত কয়েক বছর যাবৎ আমাদের যথেষ্ট দিয়েছ। তোমারও তো সংসার আছে , ফুপু। রিশাপুর পড়াশোনার খরচ, রিহামের পড়াশোনার খরচ, আবার ফুপার বোনের পুরো সংসারের দ্বায়িত্ব তোমাদের কাঁধে। তোমার কাছ থেকে আর কত নেব বল? ফুপার একার ইনকামে সবকিছু সামাল দিতে হয় তোমাকে। আমার খারাপ লাগে, ফুপু। ”
” দেখ মেয়ের কথা! এক্কেবারে আমার আম্মার মত করে কথা বলছিস তুই! মাগো, তোর ফুপার ইনকাম মন্দ নয়। সে একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক। এছাড়াও কয়েকজন স্টুডেন্ট পড়ায়। তার ইনকাম দিয়ে সবকিছু আমরা দিব্যি সামাল দিতে পারি। এছাড়াও তোর ফুপার গ্রামের বাড়িতে সম্পত্তি আছে। সেগুলো থেকে প্রতিবছর বেশ কিছু টাকা আসে। তাই আমাদের কোন সমস্যাই হয়না। শোন, তোকে এতকিছু ভাবতে হবেনা। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। এখন টাকাটা নে দেখি। ” রেহানা আক্তার কুহুর বারন শুনলেননা। জোর করে টাকাগুলো কুহুর হাতে গুঁজে দিয়ে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” এই যে ভাতিজা বউ, এই টাকাগুলো নে। তিন হাজার টাকা আছে এখানে। পছন্দমত কিছু কিনে নিস। আর নিহান বাড়িতে আসলে ওর সঙ্গে আমার বাসায় যাবি। নিহানের সাথে কথা হয়েছে আমার। ও এবার আসলে তোকে নিয়ে আমার বাসায় যেতে চেয়েছে। আমার বাপ যদি ভুলে যায়, তবে ওকে মনে করিয়ে দিবি। কি দিবি তো? ”
” দিনে একশোবার না না এক হাজারবার করে বলব তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা। বেচারা ভুলে যাওয়ার সময়ই পাবেনা। আজ থেকেই মনে করানোর মিশন শুরু হয়ে যাবে। ”
” পাগলি মেয়ে আমার। আমার কথা মন দিয়ে শোন, শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়াঝাটি করবিনা। সে যে ধরনের মানুষ, তার সাথে ঝগড়া করে জিততে পারবিনা। তাকে বুদ্ধিতে হারাতে হবে। আমার বিশ্বাস তাকে হারানোর মত কুবুদ্ধি তোর পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। ”
রেহানা আক্তারের কথা শুনে শিহাব হো হো করে হেসে উঠল। রেহানা আক্তার একটা চেয়ারে বসে শিহাবকে কোলে বসিয়ে নিলেন।

” ও ফুপু, তুমি ঠিকই বলেছ। দৃষ্টিপুর মাথায় কুবুদ্ধি গিজগিজ করছে। আমার চিন্তা হয় বড়মাকে নিয়ে। আমার মনে হয় কি জানো? আগামী এক বছরের মধ্যে বড়মা দৃষ্টিপুর জ্বালায় পাগল হয়ে যাবে। নিহান ভাইয়াও হবে। এখনই আপু নিহান ভাইয়াকে জ্বালিয়ে মারে। ”
” আমি তো আর ঐ নিহানের বাচ্চার দজ্জাল মাকে সরাসরি শাস্তি দিতে পারিনা, তাই নিহান ভাইয়াকেই জ্বালিয়ে শোধ নেই। তবে এটক সত্যি ফুপু, ঐ দজ্জাল মহিলাকে আমি সোজা করেই ছাড়ব। তার বাবার বাড়ির লোকজন এত ভালো, আর সে হয়েছে হাড়ে বজ্জাত। দিদুনের মত ভালো মানুষের পেট থেকে ঐ বজ্জাত মহিলার জন্ম হয়েছে এটা ভাবলেই আমার মাথা ঘুরে যায়। ঐ বাড়ির সবাই তোমার ভাইয়ের বউয়ের বিপক্ষে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফোন করে তাকে ধমকায়, থ্রেড দেয়। সবার ধমকানোর ঠ্যালায় ত্যাড়া মহিলা সোজা হয়ে চলে। ”
” ফুপু, এই মেয়েকে আমি বোঝাতেই পারিনা বড়দের সম্পর্কে এভাবে বলতে হয়না। তুমি একটু ওকে বোঝাও তো। ”

” শোন কুহু, তোর থেকে দৃষ্টির বুদ্ধি অনেক বেশি আছে এটা তোকে মানতেই হবে। দুনিয়ার সবাই তোর মত সহজসরল নয়। তাই কখনো-সখনো নিজেকে একটু কঠিন করতেই হয়। দৃষ্টির জায়গায় তুই হলে কখনোই রাখীর সংসারে টিকতে পারতিনা। দৃষ্টির জায়গায় দৃষ্টি ঠিক আছে। তবে দৃষ্টি শ্বাশুড়িকে শায়েস্তা করতে গিয়ে তার সঙ্গে বেয়াদবি করবিনা কিন্তু? মনে রাখিস তোর মা কিন্তু বেয়াদব ছিলনা। তুই আইরিনের মেয়ে এটা সব সময়ই মাথায় রাখবি। ”
” ভুলিনা, ফুপু। সব সময়ই আমার মন-মস্তিস্ক জুড়ে বাবা-মা থাকে। আমার মন-মস্তিস্ক তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ” দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
বাবা-মার কথা উঠতেই শিহাবও কেঁদে উঠল। কাঁদছে কুহুও। রেহানা আক্তার আঁচলে চোখ মুছে, শিহাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” কাঁদেনা, বাপ। বাবা-মার জন্য বেশি বেশি দোয়া করো। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। ভালো রেজাল্ট কর। যাতে সবাই বলতে পারে, কায়েস, আইরিনের অবর্তমানেও তোমরা নষ্ট হয়ে যাওনি। বুঝেছ আমার কথা? ”
শিহাব মাথা নেড়ে সায় জানাল।
রেহানা আক্তার আরও আধাঘন্টা পর ভাতিজা-ভাতিজিদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

” কোকিলা, কোকিলা রে, আছিস নাকি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিস? ” আনান বাড়ির বাহির থেকে চিৎকার করে ডাকছে।
” আপু নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর মত পাব্লিক সেটা তুমি জানো ভাইয়া। সে তোমার মত ফাঁকিবাজ নয়। আচ্ছা, তোমার না দুইদিন আগেই ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল? তুমি এখন এখানে কি করছ? ”
” যাইনি কি আর সাধে। দুইদিন ধরে জ্বরে পরেছি। আজকে রাতের গাড়িতেই যাব। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় ভাবী, তুমি এখনো তোমার শ্বশুর বাড়িতে গেলেনা যে? তোমার শ্বাশুড়িকে চেনোনা তুমি? বেশিদিন ঝগড়া করতে না পারলে তার মাথায় গ্যাস্ট্রিক হয়, পুত্রবধূ হিসেবে এটা তোমার জানা উচিত ছিল। সেই সাথে তোমার এটাও জানা উচিত ছিল, তোমার শ্বশুর আজকাল তার স্ত্রীর সাথে ঝগড়ার প্রতি অনিহা দেখায়। তোমার বিয়ের পর থেকে তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, এখন থেকে তুমিই তার হয়ে ঝগড়া করবে। কবে যাচ্ছ বাড়িতে? ”
আনানের কথায় হাসল দৃষ্টি। কৃত্রিম রাগের সাথে বলল,

” আর যদি ভাবী বলে ডেকেছ তবে তোমার কান কামড়ে ছিঁড়ে নেব আমি। ভেতরে এস। তোমার কোকিলা নামাজ আদায় করছে। ”
আনান ভেতরে ঢুকে সরাসরি চলে গেল অন্য রুমে। যেখানে ওরা নিহানের বিয়েতে শুয়েছিল। রুমে ঢুকে কিছু খুঁজতে শুরু করল।
” কি খুঁজছ, ভাইয়া? তুমি হঠাৎ এখানে আসলে যে? ”
” কোকিলা রে, একটু দেখনা রুমে কোন রিস্টওয়াচ পাস কিনা। ভাই নাকি তার রিস্টওয়াচ বেশ কিছুদিন ধরেই খুঁজে পাচ্ছেনা। তাই আমাকে বলল, একবার এই রুমটা খুঁজে দেখতে। বাধ্য হয়ে ১৫০ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আমাকে আসতে হল। ”

আনানের কথায় কুহু রুমটা খুঁজে দেখতে শুরু করল। যদিওবা দৃষ্টির বিয়ের পর রুমটা ভালোভাবে ঝাড়ামোছা করা হয়েছে। রুমের আনাচকানাচে নিজ হাতে পরিষ্কার করেছে কুহু। কিন্তু কোন রিস্টওয়াচ পায়নি।
” তোমরা যাওয়ার পর আমি রুমটা কয়েকদিন পরিষ্কার করেছি, ভাইয়া। কিছুই পাইনি। রিস্টওয়াচ তো নয়ই। ”
কুহুর কথার মাঝেই আনানের ফোন বেজে উঠল। আনান ফোন মুখের সামনে এনে কথা বলতে শুরু করল। কুহু বুঝল ভাইয়া ভিডিও কলে আছে।
” ভাই, এখানে কোন রিস্টওয়াচ কেন রিস্টওয়াচের ছিঁটেফোঁটাও নেই। আমি আর কোকিলা মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছি। ”
” অলসের কারখানা, তুই নিজে না খুঁজেছিস এটা বল। কিন্তু এর মধ্যে তোর কোকিলাকে জড়াচ্ছিস কেন? নাকি ফাঁকি দিচ্ছিস কাজে ? তুই গ্রামে না গিয়েই কি মিথ্যা বলছিস আমাকে? ”
” এই যে দেখ সেই রুম, এই যে দেখ কোকিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুই ভাইবোন মিলেই এতক্ষণ তোমার রিস্টওয়াচ খুঁজলাম। ”

হুট করেই আনান ফোনটা কুহুর সামনে ধরল। এক মুহূর্তের জন্য কুহু দেখল তাহমিদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। হকচকিয়ে গেল মেয়েটা। লজ্জায় মুখ নিচু করল। ও যদি ভালো করে তাহমিদের দিকে তাকাতো তবে বুঝতে পারত, দু’টি তৃষিত নয়ত ওকে দেখার জন্য ছটফট করছে
” দেখলে তো কোকিলাকে? এবার বিশ্বাস হয়েছে আমার কথা? ”
” আমি কখন বললাম , তোকে অবিশ্বাস করেছি? বাই দ্য ওয়ে, রিস্টওয়াচটা এইমাত্রই পেয়ে গেলাম বুঝলি? এটা ড্রেসিংটেবিলেই ছিল, কিন্তু আমি দেখিনি। এই যে দেখ। ” তাহমিদ রিস্টওয়াচ দেখাল আনানকে।
হতভম্ব আনান চোখ বড় করে দেখল তাহমিদের রিস্টওয়াচ। নিজেকে কেমন বলদ বলদ লাগছে ওর।

” রিস্টওয়াচ তোমার রুমেই ছিল, কিন্তু তুমি আমাকে বিশ কিলোমিটার পথ ছুটিয়ে নিলে! এই মুহূর্তে তোমাকে সামনে পেলে আমি কাঁচাই চিবিয়ে খেতাম। ”
” আমি লবন, মরিচ কিনে রেখে দেব। তুই ঢাকায় এসে আমাকে চিবিয়ে খাস। এখন রাখছি। তোর কোকিলাকে বলিস, তাকে কষ্ট দেয়ার জন্য সরি। ” আনানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিল তাহমিদ।
কুহু এতক্ষণ দু’জনের কথা শুনছিল। সবকিছুই ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল।

ফোন কেটে দিয়েই তাহমিদ বিছানায় ঝাঁপ দিল। গত কয়েক রাত ও ঘুমাতে পারেনি। ওর শ্যামাঙ্গিনীর মুখটা না দেখে কিছুতেই ঘুম আসছিনা। তাই বাধ্য হয়ে আনানকে মিথ্যা বলতে হয়েছে। আর বোকা আনানও না বুঝেই ওর ফাঁদে পা দিয়েছে। আজ এই বিকেলেই হঠাৎই দু-চোখের পাতা ভারি হয়ে ঘুম নামল৷ শুক্রবার হওয়ায় টিউশনিও নেই। তাই তাহমিদ সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতটা শান্তিতে ঘুমাবে।

” বড়মা, দোয়া কর। সবকিছু যেন ভালোয় ভালোয় মিটে যায়। ”
” শিহাবকে নিয়ে আসলিনা কেন? ওকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিসনা কেন? কিংবা এখানে রেখে গেলেই পারতিস। ছেলেটা একা একা বাড়িতে থাকতে পারবে? ”
” তিন-চার দিনের জন্য যাচ্ছি, তাই ওকে আর নিবনা, বড়মা। আগামীকাল থেকে ওর পরীক্ষা। তাই এখানেও রেখে যেতে পারলামনা। পাশের বাড়ির দাদি মানে রফিক চাচার মা থাকবে ওর কাছে। আমি রান্না করে রেখে এসেছি। সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২০

” নিহানের বাবা, চল আমরা আজ রাতে গ্রামে যাই। কুহুকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা রওনা দেব। ও যেদিন আসবে, সেদিন আমরা আসব। ”
বড়মার কথা শুনে দৃষ্টি, কুহু যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। ওরা একে-অপরের দিকে তাকাল।
” দৃষ্টি মা, গোছগাছ করে নে। আমরা কয়দিন তোর বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। ” নিয়াজ মাহমুদ খুশিতে তাড়া দিলেন।
দৃষ্টি দৌড়ে রুমে গেল।
কুহুকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিয়াজ মাহমুদ স্ত্রী আর ছেলের বউকে নিয়ে গ্রামে রওনা দিলেন।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২২