সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২২
জাওয়াদ জামী
” কুহু, শিহাব কই? ওকে দেখছিনা যে? ” নিহান কুহুকে একা গাড়ি থেকে নামতে দেখে জিজ্ঞেস করল।
” ওকে নিয়ে আসিনি, ভাইয়া। ও বাড়িতে আছে। ”
” ওকে একা বাড়িতে রেখে এসেছিস? একা একা থাকতে পারবে? ভয় পাবেনা? এই কয়দিন কি খাবে। এটা কোন কাজ করেছিস তুই? ”
” সামনে ওর পরীক্ষা। গত কিছুদিন থেকে ওর পড়াশোনা কিছু হচ্ছেনা। পাশের বাড়ির দাদিকে রেখে এসেছি ওর কাছ। রান্না করে রেখে এসেছি।কোন সমস্যা হবেনা। আর তাছাড়া এডমিশনের সময় কয়েকদিন এসে ছিল, তাই আর নিয়ে আসিনি। ”
” সামনে কি ওর এমবিবিএস পরীক্ষা নাকি ভার্সিটির কোন পরীক্ষা? পরীক্ষা না দিলে কিংবা রেজাল্ট একটু এদিক-ওদিক হলে খুব বেশি ক্ষতি হত কি? পরীক্ষার অজুহাতে একটা বাচ্চা ছেলেকে তুমি বাড়িতে রেখে এসেছ! এই বয়সে বেড়াবে না তো কখন বেড়াবে? ”
কুহু তাহমিদকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ও জানতোনা নিহান ভাইয়ার সঙ্গে তাহমিদ ভাইয়াও এসেছে। এতক্ষণ কুহু লক্ষ্য করেনি তাকে। কোথায় ছিল সে?
” ভাই ভুল কিছু বলেনি কিন্তু, কুহু। দৃষ্টির সঙ্গে কথা বলেছি কতবার। সে-ও তো একবারও বললনা শিহাব আসছেনা। আমি জানলে শিহাবকে বাড়িতে একা রেখে আসতে দিতামনা। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” থাকনা, ভাইয়া। দুই-তিনদিনেরই তো ব্যাপার। ও থাকতে পারবে। ”
” নিহান, গাড়িতে ওঠ। তোর মহা শিক্ষিত বোনকেও গাড়িতে উঠতে বল। তুই একা শুধু তাকে বকবি কেন? আমার বাড়ির সবার জন্য কিছুটা বকুনি রাখ। তারা যখন দেখবে শিহাবকে তোর বোন নিয়ে আসেনি, তখন তারাও নিশ্চয়ই একে ছেড়ে দেবেনা। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ভড়কে গেল। ও বুঝতে পারছে শিহাবকে না নিয়ে আসায় নিহান ভাইয়া, তাহমিদ ভাইয়া দু’জনই রাগ করেছে। তাই তাদের কথার প্রত্যুত্তর দেয়ার সাহস করলনা। আবার তাহমিদ ভাইয়া যখন বলল, তার বাড়ির সকলেই ওকে বকা দেবে, সেটা শুনেও ভয় লাগছে ওর।
” শিহাবকে সঙ্গে না নিয়ে এসে খুব অন্যায় করেছিস তুই, কুহু মা। যতই ওর দেখাশোনার জন্য কাউকে ওর কাছে রেখে আসিস, তবুও এটা ঠিক করিসনি তুই। তোর মত করে ওকে কেউ দেখে রাখতে পারবে? নাকি ছেলেটা ওর সমস্যার কথা মন খুলে অন্য কাউকে বলতে পারবে? ”
আফরোজা নাজনীনও ছোটখাটো বকুনি দিলেন কুহুকে। এবং তার এই বাড়ির প্রত্যেকেই বকা দিল দিলেন কুহুকে। কুহু নীরবে সকলে বকুনি হজম করল। ও বেশ বুঝতে পারছে, ইনারা প্রত্যেকেই শিহাবকে ভালোবাসেন।
” কুহু , আয় তো রুমে আয়। তুই যতক্ষণ এখানে থাকবি, ততক্ষণই আমার মা চাচিরা তোকে বকা দিতেই থাকবে। এদের বকুনি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, আমার রুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা। চল যাই। ” কুহুকে বকুনির হাত থেকে বাঁচাতে সিক্তা ওকে নিয়ে রুমে গেল।
” মা, আমি আসছি। বাসায় ফিরতে রাত হবে। তোমরা খেয়ে নিও। ” তাহমিদ গাড়ির চাবি তাহমিনা আক্তারে হাতে দিয়ে বলল।
” বাহিরে যাবি যা, গাড়ির চাবি আমাকে দিচ্ছিস কেন? আর ফিরতেই বা রাত হবে কেন? ”
” সিএনজি তে করে যাব। টিউশনি শেষ হবে দশটার পরে। এরপর বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাসায় আসব। ”
” যেখানেই যাবি, গাড়ি নিয়ে যা। আমি তোকে কতবার বলেছি বাপ, টিউশনি ছেড়ে দে। তোর যখন যত টাকা লাগবে সব আমি দেব। শুধু শুধু কষ্ট করছিস তুই। তোর বাপ-চাচারা কি অভাবে পরেছে যে তোকে টিউশনি করতে হবে? চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? তোর মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে জানিস? তোকে আর টিউশনি করতে হবেনা। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাসায় চলে আসবি। ”
” বড়মা, আমার বাপ-চাচারা অভাবি নয় সেটা আমি জানি। আমি অভাবের জন্য টিউশনি করাইনা। তুমি আমাকে টিউশনি ছাড়তে বলোনা, বড়মা। ধরে নাও আমার ব্যক্তিগত তাগিদ থেকেই টিউশনিগুলো করাই আমি। ”
” ওকে কিছু বলে লাভ নেই , বড় ভাবী। আমি শুধু ওর হাত-পা ধরতে বাকি রেখেছি। আমার ছেলে টিউশনি করায়, কথাটা ভাবলেই আমার কষ্ট হয়। সারাদিন মেডিকেলে কাটিয়ে তারপর আবার টিউশনি করায়। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনা। দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ওকে কিছুতেই শোনাতে পারিনা। ” তাহমিনা আক্তার আঁচলে চোখ মুছলেন।
” মা, কেঁদোনা প্লিজ। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়। শোন, আর হয়তো এক বছর আমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। ইন্টার্নি শেষ হতে আর দুই মাস বাকি। এরপর বিসিএস দেব। তারপর কোন মেডিকেলেই জয়েন করব। ব্যাস, তারপর নিজের পেশায় কনসেনট্রেট করব। তাই এই এক বছর আমাকে টিউশনি করতেই হবে। ”
” একটু বস। তোর বড়মা তোর জন্য পায়েস রান্না করেছে। একটু খেয়ে যা। ”
” বড়মা, আমাকেও দিও, এবং পরিমানে বেশি দিও। কারন আমারও এ্যানার্জি দরকার। পড়াশোনার ভিষণ চাপ বুঝলে? ” নিপুন সোফায় ধপ করে বসে তাহমিনা আক্তারকে বলল।
” নিপুন, তুই নাকি ক্লাস টেস্টে ম্যাথে পঞ্চাশ এ পনের পেয়েছিস? এই তোর পড়াশোনা? আমার জানামতে, আমাদের পরিবারে তোর মত গোবর গনেশ একটাও নেই। রাশেদিন পরিবারের সম্মান মাটিতে লুটানোর আগে পড়াশোনায় মন দে। প্রতিদিন সকল হোমওয়ার্ক শেষ রাতে আমার কাছে একঘণ্টা করে পড়বি। এর আগেও তোকে বলেছি, সময় করে আমার কাছে পড়বি। কিন্তু তুই শুনিসনা। আজ রাতে বই-খাতা নিয়ে চলে আসবি আমার রুমে ৷ ”
” ঠিক আছে যাব। কিন্তু তার আগে আম্মুকে বল আমার মাঙ্কি ক্যাপ বের করে দিতে। তোমার একেকটা থাপ্পড়ের যে ওয়েট। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে আর গাল টনটন করে। ”
” তাহমিদ, শুনেছিস ওর কথা? আমি প্রতিদিন ওকে রিকুয়েষ্ট করি তোর কাছে পড়তে যেতে। কিন্তু তোর থাপ্পড়ের ভয়ে যেতে চায়না। এবার চারটা ক্লাস টেস্টে ম্যাথে পঞ্চাশ এ পনের, বিশ, পনের করে পেয়েছে। সাতদিন পর আরেকটা ক্লাস টেস্ট আছে। সেটাতে কি করবে আল্লাহই জানেন। এর মত ফাঁকিবাজ আমি আজ অব্দি একটাও দেখিনি। পড়তে বললেই ওর কখনো মাথা ব্যথা করে, কখনো পেট ব্যথা করে আবার কখনো ক্ষুধা পায়, আবার কখনো কখনো ঘুমে অচেতন হয়ে যায়। ” নাজমা আক্তার দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন।
” তুমি চিন্তা করোনা চাচি, এখন থেকে ওর পেছনে লাগব আমি। আজকে বুঝলাম, এতদিন থাপ্পড় কম হয়েছিল তাই পড়তে চায়নি আমার কাছে। এখন থেকে ভুল প্রতি পাঁচটা থাপ্পড় বরাদ্দ করলাম ওর জন্য। আমি যতই ব্যস্ত থাকিনা কেন, প্রতিদিন ওর পেছনে একঘন্টা সময় ব্যয় করব। ”
” তোর কথা শুনে শান্তি পেলাম। এতদিন এই উজবুকটাকে নিয়ে চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। তোদের বংশে এরমত পড়া চোর একটাও নেই। ”
” আমি তোমার বংশের মত হয়েছি, আম্মু। মেজো মামা নাকি পড়াশোনা করতে চাইতনা। আরও কয়েকজন আছে যাদের কথা নানু মাঝেমধ্যেই গল্প করে। তোমার বংশের নাম উজ্জ্বল করতে চাই আমি। এটা ভালো হবেনা, আম্মু? ”
” শুনলি এর কথা! নিজে অপদার্থ জন্য আমার বংশকেও অপদার্থ বলছে? এরমধ্যে আমার বংশকে টানছে কেন এই উজবুক? ”
” কুল চাচী, কুল। বেশি রাগ কিন্তু বয়স বাড়ার অন্যতম কারন। তোমাকে বয়স্ক নারী দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগবেনা। তুমি তোমার অপদার্থ ছেলের দ্বায়িত্ব আমার ওপর দিয়ে চিল কর। বাকিটা আমি দেখব। ”
” এজন্যই তোকে এত ভালোবাসি বুঝলি? তুই আমাকে যতটা বুঝিস, ততটা আমার ছেলেমেয়েরাও বোঝেনা। একেকটা অকর্মার ঢেঁকি হয়েছে। ”
তাহমিদ খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
” মা, বড়মা, চাচী, আমি আসছি। ”
” কুহু রে, এভাবে রুমে কতক্ষণ শুয়ে-বসে থাকা যায় বল? কিছু একটা কর। ” সিক্তা বিছানায় শুয়ে পা দিয়ে দেয়াল ঠুকে বলল।
” কি করব আমি ? চা খাবি? সাথে নুডলস? ”
” চলবে। তবে খাবার নিয়ে ছাদে যেতে হবে। চাঁদ দেখতে দেখতে চায়ে চুমুক দেব। একবার ভাব, মাথার ওপরে চাঁদ আলো বিলাচ্ছে, সেই আলোর কিয়দংশ এসে পরছে আমাদের চায়ের কাপে। চায়ের কাপে চাঁদের আলো দেখতে গিয়ে আনমনে চুমুক দিলাম চায়ে। মানে কি দাঁড়ালো? চায়ের সাথে আমরা চাঁদের আলোও গলাধঃকরন করলাম। বিষয়টা মজার নয় বল? কিছুটা আলো গায়ে মাখব কিছুটা গলাধঃকরণ করব। আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে। ” উচ্ছ্বসিত গলায় বলল সিক্তা।
” চাঁদের আলোও কি গলাধঃকরণ করা যায়! পাগল হয়েছিস তুই? চাঁদের আলো গায়ে মাখবি এটা মানা যায়। কিন্তু গলাধঃকরণ করবি এটা হয়না। ”
” ভাইয়া ভুল কিছু বলেনি, তুই আসলেই একটা আনরোমান্টিক মেয়ে। বইয়ের পাতা ছাড়া আর কোনও কিছু তুই চোখে দেখিসনা। ”
” ভাইয়া? কোন ভাইয়া? ”
” কোন ভাইয়া আবার, তাহমিদ ভাইয়া। ”
” উনি কিভাবে জানলেন আমি আনরোমান্টিক! ”
” যে মেয়ে বই ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখেনা, তাকে আনরোমান্টিকই বলে। এবার বল ছাদে যাবি কিনা? ”
” আচ্ছা। চল যাই। তবে আমি একা রান্নাঘরে যাবোনা, তোকেও যেতে হবে। তুই দাঁড়িয়ে থাকবি, আমি নুডলস করব। কিন্তু আজকেও যদি উনি ছাদে থাকেন? ”
” উনি কে? ”
” তাহমিদ ভাইয়া। ”
” ভাইয়া বাসায়ই এসেছে বারোটার দিকে। এখন বাজে রাত একটা। ভাইয়া এমনিতেই রাত করে বাসায় ফিরেছে। আমার মনে হয়না ভাইয়া আজ আর ছাদে যাবে। ”
” তবে চল রান্নাঘরে যাই। ”
” সিক্ত, তোরা আজও এত রাতে ছাদে এসেছিস? ”
তাহমিদের গলা শুনে কুহুর কাপের চা ছলকে পরল। ও কেবলই চায়ে চুমুক দিয়েছিল।
” ঘুম আসছিলনা, ভাইয়া। তুমি এসেছ খুব ভালো হয়েছে। চা খাবে? ”
” এক্সট্রা চা সাথে করে এনেছিস নাকি? ”
” উঁহু। তোমার জন্য বানিয়ে আনব। যদি তুমি খাও। ”
” নিয়ে আয়। সন্ধ্যার পর চা খাওয়া হয়নি। ”
” নুডলস চলবে? ”
” দৌড়াবে। ”
” কুহু, তুই একটু বস, আমি ভাইয়ার জন্য চা নিয়ে আসছি। ”
” আজকেও তোর ফ্রেন্ড আবার সেন্সলেস হয়ে যাবেনা তো? সে রাতে যা ভয় পেয়েছিলাম।জিজ্ঞেস করে দেখ। যদি সে সেন্সলেস হয়ে যায়, তবে তোর নিচে গিয়ে কাজ নেই। এমন ভীতু মেয়ের সাথে খোলা আকাশের নীচে থাকার সাধ মিটে গেছে আমার। ”
এতক্ষণ দুই ভাইবোনের কথা শুনছিল কুহু। তাহমিদের মুখে নিজের অজ্ঞান হওয়ার কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ও বুঝতে পারল, তাহমিদ ওকে খোঁচা দিল।
” কি রে কুহু, ভয় পাবি এখানে থাকতে? ভাইয়া তো আছেই। ভয় কিসের বল? পাঁচ মিনিটেরই তো ব্যাপার। ”
” আমি চা করে আনি? ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২১
” সিক্ত, একে নিয়ে যা। ভয়ে ওর গলা কাঁপছে। দেখা যাবে, তুই রান্নাঘরে না পৌঁছাতেই ও মাথা ঘুরে ভূপাতিত হয়েছে। তখন আমাকেই আবার ওকে কোলে করে নিচে নামাতে হবে। ”
” সিক্তা, তুই গিয়ে চা করে আন। আমি এখানেই থাকব। ” তাহমিদের খোঁচা থেকে বাঁচতে কুহু ঝটপট করে বলল।
কুহুর কথা শুনে তাহমিদ মুচকি হাসল। ওর কথাটা কুহুর জায়গামত গিয়ে লেগেছে।