ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৭
মাহিরা ইসলাম মাহী
“ তুই আসবি? নাকি আমি আসবো?এ্যাজ ইউর উইস। উপরে আসতে আমার এনার্জি লস হবে। সেই শাস্তি মোতাবেক তোকে নিচে ফেলবো।”
মাহরিসা আঁতকে উঠে ছুটলো ফোন হাতে।
রাত তখন এগারোটা প্রায়।
ড্রয়িংরুমে তখন কারো উপস্থিতি পেল না মাহরিসা।
নীবিড়ের দরজা চাপানো।
ভাইবোন দুটো তার ভিন্ন রুমে।
মাহরিসা টিপটিপ পায়ে দরজা খুলে বের হলো।
যদি কেউ দেখে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মাহরিসা তার আদু ভাইয়ের আচরণে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। মানুষটা সেই ছোট সময়ের ন্যায় সবসময় তাকে ধমকাচ্ছে।
আশ্চর্য দেশে ফিরে প্রথম দেখাতেই লোকটা তাকে ধমকিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে।
মাহরিসার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কখন না জানি তার আদু ভাইয়ের ধমকে চুপসাতে চুপসাতে সে কাঠের ন্যায় শক্ত হয়ে যায়।
পাঁচ মিনিটের বদলে মাহরিসা সাত মিনিট লাগিয়ে নিচে নামতে সক্ষম হলো তার সকল জল্পনা কল্পনা জলাঞ্জলি দিয়ে।
নিচে নামতেই সে দেখতে পেলো সাদা শার্ট পরিহিত আদ্রিত কে নিজের গাড়ির সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।
মাহরিসা ভ্রু কোঁচকালো। আশ্চর্য! লোকটা কি সাদা শার্ট ব্যতীত কিছু পড়ে না নাকি?
মাহরিসা দাঁড়িয়ে রইলো নিচে নেমেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এগিয়ে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারলো না।
আদ্রিত তার দিকেই বোধহয় চেয়ে আছে।
রাস্তার সেডিয়াম লাইটের আলোয় সব কিছু যেন চকচকে ফকফকে।
তবুও রাতের আলো আধারির খেলাকে কি এই সামান্য লাইটগুলো ঢাকতে সক্ষম হয়।উহু।
মাহরিসার ফোন বেঁজে উঠলো।
সে একবার ফোনের দিকে চাইছে তো একবার আদ্রিতের পানে।
লোকটার এখান থেকে এখানে ফোন করার কি প্রয়োজন।
“ কি বলবে দ্রুত বলো আদু ভাইয়া।আমায় যেতে হবে।”
“কাছে আয়।”
আদ্রিতের গম্ভীর আদেশসূচক স্বর।
কথার পিষ্টে এমন উত্তর মাহরিসা মোটেও আশা করেনি।
“মানে। কি বলবেন বলুন প্লিজ। আমি উপরে যাবো।”
“ দেখবো।কাছে আয়।”
“ মানে?”
আদ্রিত দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে তোকে নিচে ডেকেছি আমি? ইডিয়েট।ওখান থেকে তোকে আমি মানে বোঝাবো?
থাপড়ে তোমার গাল ফাটিয়ে দেব বেয়াদব।
কাছে আয়।”
মাহরিসা গাল ফুলিয়ে, কাঁদো কাঁদো মুখ করে নাক টানতে টানতে এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।
আদ্রিত মাহরিসার চোখ মুখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করে সুধালো,
“ ঘাড়ের ত্যারা রগ গুলো আজ কেটে ফেলবি।কিভাবে কাটবি জানিনা। “
মাহরিসা ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো তার পানে।
“ নাক টানছিস কেন? ঠান্ডা লেগেছে? নাকি মাত্র লাগালি?”
মাহরিসা মাথা নাড়লো।
“ লাগে নি।”
“ গাল ফুলিয়েছিস কেন? নিজেকে মোটা দেখনোর চেষ্টা করছিস? তোর মোটা হওয়ার ভাব দেখতে আমি এখানে এসেছি?”
মাহরিসার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“ তবে কেন এসেছেন আদ্রিত ভাই।সেটাও তো বলছেন না।”
বলা হলো না।
শুধু মাথা নাড়লো।
“ আদু ভাইয়া তুমি…”
আদ্রিত তার কথাকে চট করে কেড়ে নিয়ে বলল,
“আমায় তুমি ডাকিস কেন? তোর সিনিয়র নই আমি? আপনি তুমির সংমিশ্রণে কেন ডাকিস?
তুই জানিস তোর এই ডাকের কারণে আমার কত সমস্যা হয়?
আদ্রিতের হঠাৎ প্রশ্নে মাহরিসা থতমত খেল।
আসলেই তো। কেন ডাকে সে। ওই যে ছোট বেলার অভ্যাস।
সে আমতা আমতা করতে লাগলো।
“ আসলে,ওই আসলে..”
“ তোর ওই, আসলে জানতে চাইনি।কারণ বল।এর পেছনের লজিক কি।”
মাহরিসা জবাব দিতে পারলো না। কি জাবাব দেবে।
উসখুস করতে করতে সে হাতের তালু কচলাচ্ছিলো।আদ্রিত তার দিকে পরের প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলো,
“ হাতে কি সমস্যা তোর ? ভাইরাস আক্রমন করেছে?”
“ না.. ওই।”
“ কাঁপছিস কেন? গরমের মাঝেও শীত লাগছে তোর?”
“ না আদু ভাইয়া ওই..”
“ আমি ডাকলেই তোর সব প্রবলেম শুরু হয়?”
মাহরিসা এবারে শব্দ করে কাঁদার প্রস্তুতি নিলো।
আদ্রিত সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাত চেপে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।
“ কাঁদছিস কেন মেরেছি তোকে?কি প্রমাণ করতে চাইছিস তুই? “
মাহরিসা নাক টানতে টানতে বলল,
“ আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন। আমার পুরো কথা শুনবেন না। তার আগেই এত প্রশ্ন করলে আমি উত্তর করবো কেমন করে।”
আদ্রিত ড্রাইভিং সিটে বসে বুকে হাত বেঁধে বলল,
“ ঠিক আছে বল কি বলবি।”
মাহরিসা চুপ করে রইলো।
“ ঠিক আছে বলতে হবে না।নাম। নেমে দশ মিনিট গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি চোখ বন্ধ করে। আমি বললে খুলবি।”
মাহরিসা বোঝার স্বার্থে চোখ পিটপিট করে চাইলো।
মানে টা কি সে কেন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে শুধু শুধু।
লোকটা তাকে ডেকে এনে লোক হাসালোর কাজ করাবে নাকি?
মাহরিসা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ পারবো না আদু ভাইয়া আমি বাসায় যাবো। “
আদ্রিত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ বাসায় তো যাবিই। বাপের খাঁচায় গিয়ে বসে থাকবি।দু মিনিট আমার খাঁচায় থাকতে এত কেন সমস্যা তোর? অবুঝ তুই।”
মাহরিসা অসহায় চোখে আদ্রিতের পানে চাইলো।
লোকটা কি করতে চায়? তাকে না বললে সে কেমন করে বুঝবে।
“আপনি স্পষ্ট করে না বললে বুঝবো কেমন করে? কেন গাড়ির সামনে দাঁড়াবো।রিজন বলুন?”
“ তর্ক করিস? আমার সঙ্গে? রিজন জানতে চাস? আগে নিজে আপনি, তুমির সংমিশ্রণ টা এক সুতোয় বাঁধতে শেখ তার পর আসিস রিজন জানতে।”
মাহরিসা ভীষন রাগ হলো আদ্রিতের উপর।
লোকটার মুখের উপর সে কিছু বলতে না পেরে এবারে গাড়ির উপর রাগ খাটালো।
গাড়ি থেকে নেমে সে শব্দ করে দরজা লাগালো।
“ রাগ দেখাস? আমার গাড়ির একটা পার্টের যদি কোনো ক্ষতি হয় সেটা তোর পয়সায় আমি সারাবো গড প্রমিস।”
“ সামান্য একটু দরজা জোরে লাগানোতে আপনার গাড়ির কিছু হবে না।গাড়িটা তো আপনার মতনই।”
“ কথা বলা নিষেধ সামনে গিয়ে দাঁড়া।”
মাহরিসা রাগে গজগজ করতে করতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চোখ বন্ধ করে ফোন কানে চেপে।
কারন তাতে আদ্রিতের কল এখনো লাইনে আছে।
দশ মিনিট পেরিয়ে পনেরো মিনিটে হলো।
গাড়ির শব্দ পেয়ে মাহরিসা অসহ্য হয়ে চোখ মেলে চাইলো।
হতভম্ব হয়ে সামনে তাকালো, তার সামনে না তো আছে গাড়ি আর না তো আছে আদ্রিতের অস্তিত্ব।
মাহরিসা সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকিয়ে দেখলো অভদ্র লোকটা তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে।
ফোনে ওপাশ থেকে তখন আদ্রিতের গম্ভীর স্বর ভেসে এলো।
“ বাসার ভেতরে যা।”
অতঃপর কেটে গেল লাইন।
মাহরিসা টিপটিপ পায়ে পুনরায় বাসায় ফিরলো।
সকলের রুমের দরজা লাগানো দেখে সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
রুমে গিয়ে মাহরিসা হাতের ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়।
নিজের উপর তার প্রচন্ড মেজাজ গরম হচ্ছে।
কেন সে আদ্রিতের সামনে গিয়ে বোকার মতো কাজ গুলো করে বসে।
কেন তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করে না।
মাহরিসা সত্যিই বুঝে পায় না।তার আদু ভাইয়ের সামনে গেলে সে কেমন এলো মেলো হয়ে যায়।
বাস্তব জীবনে সে তো এমন নয়।
কেন লোকটা তাকে বারবার অপদস্ত করে।আর সে নিজে বোকার মতো সব মাথা পেতে নেয়।
কাঠফাঁটা রৌদ্দুরে ব্যস্ত সকলে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের কর্মে।
জীবন তো একটাই কর্ম করেই চলতে হবে পুরোজীবন।
নিস্তব্ধতা ভার্সিটিতে যাবে।দেরি হয়ে গেছে আজ তার।
সজনেডাঁটার বাচ্চাটাকে সে ফোন দিয়ে যাচ্ছে অথচ ফোন তোলার নাম নিচ্ছে না হতভাগা টা।
আজ আসুক ভার্সিটিতে।ওর সব গুলো চুল সে কোদাল দিয়ে ছেঁটে দেবে। বেয়াদব।
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিস্তব্ধতা দরজার সঙ্গে পা বেঁধে পড়লো।
“ওও মা গো..”
বলেই সে জায়গায় পা ধরে বসে পড়লো।
ব্যাথায় টনটন করে উঠলো পায়ের উপরের অংশটুকু।
বোধহয় মচকে গেছে।
নিস্তব্ধতা যথাসম্ভব চেষ্টা করলো উঠে দাঁড়াতে কিন্তু পেরে উঠলো না।
নিস্তব্ধতার চিৎকার শুনে ওসমান ভিলার সকলে ছুটে এলো।
নিস্তব্ধ তাসফি দুজনের কেউ বাড়িতে নেই।তারা সকাল সকাল বেরিয়েছে হসপিটালে।
নিলায় সাহেব, অনিমা বেগম আর আদ্রিত ছুটে এলো বোনের কাছে।
আদ্রিত বোনের পায়ে হাত দিতেই নিস্তব্ধতা ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠলো।
আদ্রিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো।
“ কিভাবে পরলি? এত তাড়াহুড়োর কি আছে? অফিসের লাস্ট বাস মিস হয়ে যাচ্ছে তোমার নিস্তব্ধতা? “
নিস্তব্ধতা সাদাফের সঙ্গে যতটাই খোলামেলা, চটপটে ততটাই ভঙুর,আদুরে সে ভাইয়ের কাছে।
ভাই বিদেশে থাকতে কত কত নালিশ জমিয়েছে সে ভাইয়ের কাছে।
আদুরে হলেও তাদপর সম্পর্ক অন্যান্যদের মতো সহজ নয়।আদ্রিত ছোট থেকেই ছিলো গম্ভীর প্রকৃতির।বয়সে দুজন দুজনের সমান হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় যেন বয়সে তাদের বিস্তার ফারাক।
আদ্রিত পুনরায় পায়ে চেক করতে করতে বলল,
“ এখানে ব্যাথা? বেশি? উঠে দাঁড়াতে পারছো না?”
অনিমা বেগম বললেন,
“ পুনরায় একি জায়গায় ব্যাথা পেলো না তো আদ্রিত দেখ।”
আদ্রিত ভ্রু কুঁচকে দাদির পানে চাইলো,
“পুনরায় একই জায়গায় ব্যাথা মানে দাদিমা?
আগেও ব্যাথা পেয়েছিলো পায়ে? কই আমি তো জানিনা।”
নিলয় সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
“ ওসব পরে বলবো তোমায়। দিদিভাইকে হসপিটালে নিয়ে চলো দাদাভাই।কোনো সমস্যা হলে তবে… ”
আদ্রিত আর কথা না বাড়িয়ে নিস্তব্ধতা কে কোলে তুলে নিলো।
নিস্তব্ধতা ব্যাথায় চোখ খিঁচে বন্ধ করেছিল।
আদ্রিতের গম্ভীর স্বর তার কানে বাঁজলো,
“ কি এত খাও তুমি নিস্তব্ধতা। এত ভারী লাগছে কেন তোমায়? মনে হচ্ছে কোনো পাহাড়কে কোলে করে হাঁটছি। “
ভাইয়ের হঠাৎ আজগুবি কথায় নিস্তব্ধতা চোখ মেলে চাইলো।
সে বেশ বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের কারসাজি। তার ব্যাথাসিক্ত শরীরে তার মনটা অন্য দিকে ডায়ভার্ট করার সামান্য প্রচেষ্টা তার ভাইয়ের।কারন সে মোটেও এতটা ভারী নয়।
আদ্রিতের প্রচেষ্টায় নিস্তব্ধতা জল ঢেলে হেঁসে সুধালো,
“ পাহাড়কে তো নড়ানো না যায় না ভাইয়া।তবুও তুমি যে আমায় নড়াতে পেরেছ,সঙ্গে গটগট পায়ে হেঁটে যাচ্ছো তোমায় তো নিশ্চিত নোবেল দেওয়া উচিত। “
“ বাট পাহাড় উঁচু করা জন্য কোনো নোবেল এখন পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়নি।যদি হতো শিওর থাকো সেই নোবেল টা তোমার ভাই সর্ব প্রথম পেত নিস্তব্ধতা। “
নিস্তব্ধতা খিলখিল করে হেঁসে দিলো।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ৬
যেন সে সেই ছোট নিস্তব্ধতা, আর সে বায়না ধরেছে আদ্রিতের কাছে গল্প শুনতে।আর আদ্রিত তাকে তার বইয়ের গম্ভীর মুখো কবিতা গুলো বিরক্তকর মুখভঙ্গি করে শোনাচ্ছে । আর নিস্তব্ধতা হাসছে খিলখিল করে।
নিস্তব্ধতা খেয়াল করলো আসলেই সে খানিকক্ষণের জন্য হলেও নিজের পায়ের ব্যাথা ভুলতে বসেছে।