প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২১
সাইয়্যারা খান
আকাশ আজ খানিক মেঘলা। এলেমেলো মেঘগুলো উড়ো উড়ি করছে। মাঝেমাঝে কাশফুল কোথা থেকে উড়ে আসছে। এলাকা ছেড়ে বিশ্বরোডের দিকেই ঘন কাশ ফুলের সমারোহ। ঘুমে ঢুলুঢুলু পায়ে উঠে এসে পৌষ পর্দা খুললো, তখনই বোধহয় মেঘ একটু সরে গেলো। সামান্য আলোকছটা ছুটে এলো ঘরটায়। বিছানাটা খালি পরে আছে। তৌসিফ কোথায় গিয়েছে কে জানে। পৌষ বাথরুমে ঢুকেই বিরক্ত হলো। এই ট্যাপ ব্যবহার করতে তার ঝামেলা হয়। আগেপাছে যাই করুক পানি বের হয় না।
রাগে গজগজ করতে করতে কাল এক থাপ্পড় মারতেই পানি পরেছিলো। পৌষ দাঁড়িয়ে ভাবলো আজও কি এক থাপ্পড় মারবে? দাঁত ব্রাশ করতে করতেও মুখটা তেঁতো হয়ে গেলো। টুথপেষ্টের ফ্লেভার ভালো না। একে তো দেখতে কালো, দুই আবার কচকচ করে। মনে হয় ছাই দিয়ে দাঁত মাজছে। কলটায় থাপ্পড় দিলো পৌষ। ওমা! আজ কাজ হলো না। এদিক ওদিক হেলাতে গিয়েও লাভ হলো না৷ কি মুশকিল হলো। শাওয়ার চালু করে কিছুটা দূরে সরে পৌষ হাতে পানি নিয়ে কুলি করে মুখ ধুয়ে ফেললো। কি সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার। এখন শাওয়ার চালু না হলে বাথরুমে আর কি ছিলো? ঐ হ্যান্ড শাওয়ার। ভাবতেই পৌষ ওয়াক ওয়াক করে উঠলো। কোনমতে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। বিছানা টানটান করে মেঝে ছাড়ু খুঁজতে বাইরে এলো পৌষ। রান্নাঘরে বুয়া কাজ করছে। পৌষ পেছন থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“খালা ছাড়ু কোথায়?”
বুয়ারা বোধহয় বুঝলো না তাই উত্তর আসলো না। ‘বুয়া’ বাদে অন্য নামে তাদের সম্বোধন করা হয় না। পৌষ সোফায় মিনুকে বসা দেখে এগিয়ে এসে বললো,
“ঝাড়ু কোথায় থাকে?”
মিনু ফট করে বললো,
“ঝাড়ু দিয়ে কি করবেন ছোট মামী?”
পৌষ কপাল কুঁচকালো। ঝাড়ু দিয়ে মানুষ কি করে? কপাল কুঁচকে রেখেই পৌষ উত্তর দিলো,
“ঝাড়ু দিব। কোথায় রাখা?”
“রান্নাঘরের পাশের ঘরে।”
পৌষ এগিয়ে গিয়ে ঝাড়ু নিতেই মিনু পিছু পিছু এলো। পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“ছোট মামী বুয়া ঝাড়ু দিবে তো।”
“সেটা পরে দিবে। আমি এখন দিব।”
“এটা তো আপনার কাজ না।”
পৌষর হাত চলছে। ছোট থেকে তাকে এভাবেই গড়া হয়েছে। মুখের চাইতে বেশি হাত চলে কাজে। ঝাড়ু দিতে দিতেই পৌষ বললো,
“তাহলে আমার কাজ কি?”
মিনু মুখটা লাজুক করে বিজ্ঞদের মতো বলে উঠলো,
“ক্যান, মামারে সোহাগ করবেন। ভালোবাসবেন৷ প্রেম করবেন। নতুন বউরা তো এইটাই করে।”
এতটুকু মেয়ের মুখে এহেন কথায় পৌষ কটমট দৃষ্টি ফেলে চাইলো। বললো,
“যাও এখান থেকে।”
“ও ছোট মামী, আপনি মামার সাথে পেরেম করেন নাই? করেছেনই তো। আমি বলাতে লজ্জা পাইতেছেন?”
ময়লা তুলে পৌষর মন চাইলো মিনুর গায়ে ঢেলে দিতে। তা না করে ধমক দিলো একটা,
“যাও এখান থেকে। বের হও। বেয়াদব কোথাকার।”
মিনু বের হলো না। তার মামার ঘর থেকে দুই দিনের নতুন বউ তাকে বের হতে বলছে। রাগে হঠাৎ ফুঁসতে লাগলো ও। পৌষ ময়লা তুলে নিজের বেরিয়ে গেলো। মিনু ঠাই দাঁড়িয়ে সেখানে। মামাকে আজ বিচার দিবে ও। নতুন বউ তাকে বকেছে, মামার তো জানা উচিত কিন্তু তার আগে আপাকে জানাতে হবে। দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে বাটন ফোন হাতে তুলে ‘আপা’ লিখা নামে ডায়াল করে মিনু। ওপাশ থেকে ফোন ধরতেই ফুঁপিয়ে কাঁদে মিনু। বিচার দেয় তার আপার কাছে,
“ছোট মামী আমারে বকসে আপা। ইট্টুও ভালো না।”
ওপাশ থেকে নরম স্বরে তাকে বোঝানো হলো। মিনু তাও কাঁদছে ফুঁপিয়ে।
রান্না ঘরে ঢুকেই পৌষ বুয়াকে বললো,
“খালা কি করছেন?”
বুয়া বোধহয় চমকালেন। পৌষ হেসে বললো,
“গাজর কাটছেন, ভাজি করবেন?”
“মামাকে সটে করে দিব। সকালে উনি এটা খান।”
পৌষ মুখ কুঁচকালো। নিজে বুয়ার হাত থেকে ছুরি নিয়ে গাজর কাটতে কাটতে বললো,
“সকালে ভাজি, পরটা, চা খাওয়া স্বাস্থ্যকর। বুঝলেন খালা। সটেমটেপটে করে খেতে নেই। কাঁচা সবজি আর সটেপটে একই কথা। আপনি আটা বের করে দিন। পরটা বানাই। আপনাকেও দেখাব। কাল আপনি বানালেন না, খাস্তা হয় নি। বুয়া কথা অমান্য করলো না। আটা বের করে দিতেই পৌষ কাটা সবজি ধুয়ে চুলায় বসালো। লাল আটা দেখে অবশ্য মনঃক্ষুণ্ন হলো সামান্য। লাল আটা স্বাদ লাগে না। পৌষের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বুয়া বললেন,
” আমি খামির বানিয়ে দেই?”
“একদম না। আমাকে দিন।”
পৌষ ঝটপট হাতে আটা মথে নিলো। বেলন চালিয়ে বেলে রুটির পরত করলো চার, পাঁচটা। দুই হাতের তালুতে পরটা থাপ্রে গুড়ি সরিয়ে তাওয়ায় রুটি দিলো। পৌষ বুয়ার সাথে একমনে বকবক করছে,
“বাসায় থাকলে ঘি দিয়ে ভেজে দিতাম। ঘ্রাণেই মন ভরে যায়। জানেন খালা, জৈষ্ঠ্যর একটু বেশিই পছন্দ ঘি দিয়ে পরটা। কথা একদম কম বলে ও। মুখ দেখলেই বুঝি আমি ওর যে ভীষণ ভালো লাগে। ঘি থাকলে আপনাকে..”
পাশ থেকে ঘি এর বোয়াম এগিয়ে দিতেই পৌষ খুশিই হলো। এক চামচ ঘি দিয়ে পরটা ভাজতে ভাজতে যেই না কিছু বলতে ঘুরে তাকালো ওমনেই এক পা পিছিয়ে গেলো। ওর পাশেই একটু পেছনে তৌসিফ দাঁড়িয়ে। বুয়া নেই। পৌষ বুকে থুতু দিয়ে বললো,
“ক..কি?”
তৌসিফ একটু ঘর্মাক্ত। মাত্র দৌড়ে এলো। টাউজারের পকেট থেকে হাত বের করে পৌষের কপাল থেকে আটা মুছে বললো,
“এই সকাল সকাল এমন দৃশ্য দেখানোর সৌভাগ্য যে আমার হবে তা কখনো কল্পনাই করি নি। আমার অকল্পনীয় কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ পৌষরাত।”
পৌষ চোখ নামিয়ে বললো,
“আপনার সটেপটে বাদ দিয়ে আজ পরটা, ভাজি খাবেন? রান্না করছি।”
“প্রেমিক হলে বলতাম, বিষ দিলে তাও পান করে যাব কিন্তু তুমি তো বউ আমার তাই আজ নাহয় তোমার পছন্দেই খেলাম।”
পৌষ আড়ালে মুখ বাকালো৷ তৌসিফ যেতে নিলেই পৌষ বলে উঠলো,
“শুনুন।”
চলা থামিয়ে একই ভঙ্গিতে তৌসিফ উত্তর করলো,
“বলুন।”
“আপনার বাথরুমে কল নষ্ট। শাওয়ার চালু করে মুখ ধুতে হলো। নরমাল প্যাচ ট্যাপ লাগাতেই তো হয়।”
তৌসিফের কপালে ভাজ পরলো। চিন্তিত হয়ে বললো,
“সকালেও তো ঠিক দেখলাম।”
পৌষ কথা না বাড়িয়ে পরটা উল্টে দিতেই তৌসিফ সাবধান করলো,
“হাতে যাতে ছিটা না আসে।”
তৌসিফ যেতেই বুয়া আসলো। পৌষ ঠোঁট উল্টে বললো,
“আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলেন খালা?”
বুয়া একটু হাসলেন। বললেন,
“মামা ইশারায় যেতে বললো।”
পৌষ মনে মনে ভেঙচি কাটলো, ‘ব্যাটার রঙ উথলে উথলে পরছে একদম’।
টেবিলে খাবার রাখতেই তৌসিফ হাজির হলো। গোসল করে এসেছে সে মাত্র। পৌষ নিজেই টেবিলে সব রাখছে। বুয়া পানি আনতেই তৌসিফ তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মিনু কোথায় বুয়া? উঠে নি?”
“উঠেছিলো না আবার ঘরে গিয়ে বসে আছে।”
“ওকে খেতে বলো।”
বুয়া যেতেই তৌসিফ বললো,
“খেতে বসো পৌষরাত।”
পৌষ বসলো। তৌসিফের খাওয়া দেখে ওর নিজের খেতে মন চাইলো না যেন। বেশ গুছিয়ে খায় তৌসিফ। তিন আঙুল দিয়ে পরাটা ছিড়ে ভাজি আর ডিম দিয়ে খাচ্ছে সে। একটা খেয়ে আরেকটা নিতেই পৌষ বললো,
“আরেকটা এনে দিব?”
“উঁহু, ইটস ঠু মাচ ফর মি পৌষরাত। আমার অনেক বছরের অভ্যাস বদলে দিতে এক সকালে। এত ভারী খাবার সকালে কখনোই খাই না।”
তৌসিফ সাথে আরো বলতে চাইলো, ‘খাওয়ার মানুষ নেই’ কিন্তু বলা হলো না। আম্মু থাকাকালীন এভাবে পরোটা খাওয়া হতো। আম্মু নেই সেই আদর, শাসন, যত্নটাও নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। পৌষের খাওয়া দেখেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তৌসিফ বলে উঠলো,
“কিছু বলতে চাও হানি?”
পৌষ ভাবলো মধু বলে যখন ডাকলো মানে ব্যাটার মনটন ভালো। সুযোগ বুঝে বললো,
“আমি তো ভার্সিটিতে পড়ছি। তৃতীয় বর্ষ চলছে। আদির ভার্সিটিতেই। সামনে পরীক্ষা। বলছিলাম..।”
পৌষ শেষ করার আগেই তৌসিফ বললো,
“আমি জানি সবটা।”
“তাহলে ভোন্দার মতো শুনলেন কেন এতক্ষণ?”
বিরবির করে পৌষ মুখে পরটা দিলো। তৌসিফ আবছা শুনেছে অবশ্য। পৌষকে মনে করাতে বললো,
“বিকেল নাগাদ আপা পৌঁছে যাবে। আমি চলে আসব। বুয়া রান্না করে রাখবে। কাল দুপুরে খাও নি পৌষরাত। আজ যাতে এই ভুল না হয়। একই ভুল বারবার করতে নেই।”
পৌষ চুপ রইলো। কিছুক্ষণ পর নিজেই বললো,
“আমি রান্না করি দুপুরে? খালি বসেই থাকি।”
তৌসিফ টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
” সর্বোচ্চ এক পদ পৌষরাত। বেশি না৷”
“আচ্ছা।”
তৌসিফ খুশি হলো। আপাকে চমকে যাবে নিশ্চিত। পৌষর খাবারের স্বাদ ওর ওর মায়ের কাছাকাছি কিছুটা। কবে থেকে রাঁধে এই মেয়ে?
বাড়ীর নিচ থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ আসছে। সেই সাথে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে তৌসিফের দরজায়। পৌষ উঠে তৌসিফের পেছনে যেতেই দেখলো দরজা খোলা মাত্র পলক এসে তৌসিফের বাহুতে হামলে পড়লো। পৌষ পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো একটু। এলোমেলো বেহাল দশায় পলক হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“মেঝ ভাইয়া…মেঝ ভাইয়া, ও বাসায় আসে নি রাতে। তোমার এখান থেকে গিয়েই বেরিয়ে গিয়েছে। পুকুরে কার লা’শ ভাসছে মেঝ ভাইয়া? ওই লা’শের গায়ে সাদা শার্ট কেন? তুহিন সাদা শার্ট পরে নি কাল। সাদা শার্টই নেই ওর। ওটা কে তাহলে? পেছনের পুকুরে? ত..তুহিনের কিন্তু সাদা শার্ট নেই। ও কোথায় মেঝ ভাইয়া? তুমি ফোন দাও। ফোন দিও না। ঘাটে ওর ফোন কেন মেঝ ভাইয়া? তুমি আসো আমার সাথে। তুহিনকে এনে দাও। ও কোথায় গেলো? ওর তো সাদা শার্ট নেই।”
পলক বারবার একই কথা বলছে। তুহিনের সাদা শার্ট নেই। প্রিয় পুরুষটা কাল সাদা শার্ট পরে ছিলো। রাতে ফিরে নি। পলক জানে ও নেশা করতেই গিয়েছিলো। ঐ মাগুর মাছের পুকুরে কিভাবে গেলো তুহিন?
তৌসিফ নিজের হাতটা রাখলো পলকের মাথায়। পলক ধপ করে বসে তৌসিফের পা জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কেঁদে বলে উঠলো,
“আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও মেঝ ভাইয়া। আমার দোষ নেই। তুহিনকে এনে দাও। আমি মরে যাব।”
পৌষ তারাতাড়ি এসে পলককে ধরলো। বুকে জড়িয়ে ধরে থামাতে থামাতে বললো,
“কি হয়েছে আপু? আপনি ভেতরে আসুন।”
পলক আঁকড়ে ধরে ওকে। পৌষ তৌসিফে’র দিকে তাকাতেই দেখলো মৃদু লাল হওয়া চোখে তাকিয়ে আছে তৌসিফ। পলক পৌষকে ছেড়ে তৌসিফের হাত ধরে টানলো। পাগলের বিলাপ করতে করতে বললো,
“চলো। তুমি এসো আমার সাথে।”
“ভাসুরের হাত ধরে কিসের টানাটানি? কাপড়চোপড় ঠিক করো আগে। লাজলজ্জা নেই।”
মীরা এসে কথাটা বলা মাত্রই পৌষ তার মুখের উপর চটাং করে বলে ফেললো,
“সে মুখে ভাই ডাকছে শুনতে পান নি আপনি? আপনার মাথায় কাপড় আছে?”
মীরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পৌষ এবার তৌসিফের অপর হাত ধরে টেনে বলে,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২০
“চলছেন না কেন?”
তৌসিফ চললো। পলক এলোমেলো হাঁটছে। বাড়ীর পেছন দিক হওয়ায় এলাকায় খবর ছড়ায় নি কিন্তু যেইভাবে পলক কাঁদছে খবর ছড়াতেও সময় লাগবে না।