সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৭

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৭
জাওয়াদ জামী

” থ্যাংকস। ”
কুহু অবাক হয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। ও বুঝলনা তাহমিদ কেন ওকে ধন্যবাদ দিল।
কুহুকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
” মায়ের কষ্টের সময় তার পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছি। সামান্য মাথাব্যথার কারণে মা কাঁদবে এটা আমি বিশ্বাস করিনা। মা তার বড় ছেলের জন্য কাঁদছিল। মিথ্যা বলে তোমার কোন লাভই হলোনা। তাই ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে মিথ্যা বলতে যেওনা। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু দাঁত দিয়ে জিভ কেটে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

” থাক, আর লজ্জা পেতে হবেনা। আমি প্রথমেই সব বুঝতে পেরেছি। ”
” ভাই, তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে পুরো বাড়িতে খুঁজে বেড়াচ্ছি। বাগানে চল। মামা গাছ এনেছে সেই কবে। এতদিনও গাছগুলো ওভাবেই আছে। গাছগুলো লাগিয়ে দিতে হবে। কোকিলা, বইন আমার আমাকে এক গ্লাস লেবু পানি করে দিবি পিলিজ। আমার মামীরা ছাড়া এই বাড়ির প্রত্যেক প্রানীই অপদার্থ। এরা কাজের ক ও জানেনা। লেবু পানি খেয়েই আমি বাগানে যাব। ” আনান এসে কুহু তাহমিদ দু’জনকেই কাজে তাগাদা দিল।
” এই বাড়ির প্রানীদের অপদার্থ বলে গালি দিয়ে, সেই প্রানীদের একজনকেই আবার কাজে ডাকছিস! বিষয়টা পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেলোনা? নাকি তোর বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? ” তাহমিদ আনানের দিকে তাকিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহমিদের রাগী চেহারা দেখে ভয়ে ঢোক গিলল আনান। ও কথা বলার সময় ভুলে গেছিল কার সামনে কি বলছে। নিজের ভুল শোধরাতে কপাল চাপড়াল।
” আরে ভাই, তুমি বাদ। তুমি কোন প্রানীদের মধ্যে পরোনা। তুমি হলো গিয়ে, কি যেন বলে? মনে পরেছে, খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ‘ ষাঁড় ‘। তুমি উৎকৃষ্ট মানের দেশি ষাঁড়। অবশ্য এটা আমার কথা নয়। এটা তোমার ছোট চাচার পিচ্চি ছেলের কথা। তুমি নাকি কোনদিন ষাঁড়ের মত গুঁতো দিয়ে দিদুনের রুমে ড্রেসিংটেবিলের গ্লাস ভেঙে ফেলেছিলে? সেই থেকেই ওরা গোপনে তোমাকে ‘ ষাঁড় ‘ ভাইয়া বলে ডাকে। নামটা কিন্তু জোস। ‘ ষাঁড় ‘ ভাইয়া। ”
আনান আপনমনে তাহমদিকে খোঁচা মেরেই চলেছে। ও যদি তাহমিদের মুখের দিকে তাকাতো, তবে দেখত তাহমিদের রাগে লাল হওয়া চেহারা।
কুহু এই মুহূর্তে তাহমিদকে দেখে ভয় পাচ্ছে। আনানের কপালে যে দুঃখ আছে সেটা ও বুঝতে পারছে। যে করেই হোক ভাইকে বাঁচাতে হবে।

” ভাইয়া, তুমি আমার সঙ্গে এস। তুমি গিয়ে বড় মামীর কাছে বস। আমি তোমার জন্য লেবু পানি করে আনছি। ” কুহু আনানকে ঠেলে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল।
” নিজের ভাইকে বাঁচাতে চাচ্ছ তুমি, শ্যামাঙ্গিনী? পারবেনা। ওকে তো আমি দেখেই নেব। তোমার সামনে আমার ইজ্জতের পাংচার করে দিয়েছে ঐ হতভাগা, আহাম্মকটা। ওকে আমি ছাড়ছিনা। ” নিজে নিজেই প্রতিজ্ঞা করল তাহমিদ।

” দৃষ্টি সোনা, তুমি এসেছ? এসো আমার কাছে এসে বস। তোমার মুখটা প্রানভরে দেখি। ” দিদুন দৃষ্টিকে দেখে হাসিমুখে ওকে কাছে ডাকলেন।
” আমি ভালো আছি, দিদুন। তুমি কেমন আছো? আরেব্বাস! দিদুন, তুমি দেখছি আগের থেকেও সুন্দরী হয়ে গেছ! তোমার রূপের কাছে দুনিয়ার সব নারীর রূপই হার মানবে। তোমার রূপের গোপন রহস্য জানতে পারি কি? ”
” পাজি মেয়ে, দুষ্টুমি করছ? নিহান আসুক সে-ই বলবে কে বেশি সুন্দর। নিহান যদি বলে, আমি তোমার থেকেও বেশি সুন্দর, তবে তোমার কথা আমি মেনে নেব। তবে আমার মনে হয়না, নিহান আমাকে সুন্দরী বলবে। তোমার সঙ্গে কমপিটিশন হলে আমাকে জয়ী হতে দেবেনা সে। ”
দিদুনের কথায় লজ্জা পেল দৃষ্টি। ও নতমুখী হয়ে হাসল।

” তাহমিদ , তোর ফুপাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যেতে হবে। তুই যেখানে বলবি, আমি সেখানেই তোর ফুপাকে নিয়ে যাব। ”
” আগামী বুধবার ফুপাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাব। আমি আগেই স্যারের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। ”
” রাখী, তোর আরও আগেই নিয়াজকে নিয়ে ঢাকা আসার দরকার ছিল। নিয়াজকে দেখে আমার ভালো লাগছেনা। কেমন শুকিয়ে গেছে। তাহমিদ, বুধবারের কথা বলছ কেন? তুমি আগামীকাল নিয়াজকে ডক্টরের কাছে নিতে পারবেনা? আজ কেবল রবিবার। ” সাদিক আহমেদ রাশেদীন তাহমিদকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
” এই যে সিনিয়র ভদ্রলোক, আমার স্যার বর্তমানে সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। আজকের ফ্লাইটে তিনি দেশ ছেড়েছেন। মঙ্গলবার তিনি দেশে ফিরবেন। এখন যদি তুমি বলো, তাহলে আমি ফুপাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যেতে পারি। সেখানেই না-হয় স্যার ফুপার চেক-আপ করবেন। ”

” বেয়াদব ছেলেকে একটা কথা বলেও শান্তি নেই। বাঁকা কথা তার ঠোঁটের আগায় সব সময় এসেই থাকে। এরকম বেয়াদব ছেলে আমার বংশে জন্মাবে এটা আমার ধারনায়ও ছিলনা। এর সঙ্গে কেন যে কথা বলতে যাই।
” সবই তোমার জন্য, সিনিয়র। এসব তোমারই দান। আর তুমি যে আমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারোনা, এটা আমি ভালো করেই জানি। ”
” তাহমিদ, আর একটা কথাও বলবিনা। বড় ভাই ভুল কিছু বলেছেন? তুই সহজভাবে উত্তর না দিয়ে এভাবে পেঁচিয়ে কথা বলছিস কেন? ” তাহমিনা আক্তার ছেলের ওপর রেগে গেলেন।
মায়ের ধমক খেয়ে তাহমিদ মুচকি হেসে ফোনে মন দিল।

” মেজো মামী, তোমার এই ছেলে কিন্তু বড্ড ত্যাড়া। তাকে পরিবর্তন হতে বল। নয়তো সে কিন্তু বিয়ে করার জন্য মেয়ে পাবেনা। মেয়েরা সব সময়ই সহজ-সরল টাইপের ছেলে চায়। যেমন ধর আমার মত। এদিকে ভাই কিন্তু মোটেও সহজ-সরল নয়। তাকে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় এক গ্লাস করে নিমপাতার রস খাওয়াও। এতে ভাইয়ের ত্যাড়ামি কমবে। আর জিলাপি বর্জন করতে বল ভাইকে। যত জিলাপি খাবে, ভাইয়ের মনে ততই জিলাপির মত প্যাঁচ হবে। ” আনান পরামর্শ দেয়ার ভঙ্গিতে বলল।
আনানের কথা শুনে সকলে মুখ টিপে হাসলেও তাহমিদ হাসলনা। ও বাম ভ্রু উচিয়ে আনানের দিকে তাকিয়ে থাকল। খানিক পরই কিছু একটা ভেবে তাহমিদের ঠোঁটে হাসি ফুটল।
” আনান, বাহিরে যাবি নাকি? সামনে একটা কফিশপ হয়েছে। ওরা দারুন কোল্ড কফি বানায়। এমনকি ওদের ডোনাট, পিজ্জা আর পাস্তাও বেশ। যাবি? বিল আমিই দেব। ”

” সত্যি ভাই , তুমি আমাকে কফি খাওয়াবে? আমার ধারনাকে ভুল প্রমান করে দিলে তুমি। তোমাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা খারাপ তুমি নও। কিছুটা ভালোও আছো তুমি। কখন যাবে বল? ”
” ভাইয়া, আমার একটু ফ্ল্যাটে যাওয়ার দরকার ছিল। জরুরী একটা কাগজ রেখে এসেছি। কালকের ক্লাসে কাগজটা লাগবে। ”

তাহমিদের কথার ভঙ্গি কুহুর ভালো লাগেনি। ও বুঝতে পেরেছে, তাহমিদ আনানকে কফিশপে নেয়ার কথা বললেও ওকে কফিশপে নেবেনা। তাহমিদ ভাইয়া আনান ভাইয়ার কাছে এমন কথা শোনার পরও তাকে হাসিমুখে কফিশপে নিয়ে যাবেনা সে। নিশ্চয়ই অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। তাই তাহমিদের হাত থেকে আনানকে বাঁচাতেই মিথ্যা বলল কুহু। এই বাড়িতে আসার পর এি নিয়ে দুইবার মিথ্যা বলল কুহু। এই নিয়ে ওর আফসোসের শেষ নেই।
” আমি ঐদিকে যাব কিছুক্ষণ পর। তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পার। আনানকে নাহয় পরেই কফিশপে নিয়ে যাব। কি রে আনান, অন্য কোন সময় যেতে পারবি তো? ” তাহমিদ বুঝতে পারছে কুহু আনানকে বাঁচাতেই ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা বলেছে। তাই ও পাল্টা চাল চালল।
তাহমিদের কথা শুনে কুহু বিপদে পরে গেল। এবার কি বলবে সে? আনান ভাইয়াকে বাঁচাতে গিয়ে ও নিজে ফাঁদে পরে গেছে।

” কুহু মা, তুই তাহমিদের সঙ্গেই যা। আনান, তুই আগামী কয়েকদিন বাহিরের খাবার খেতে পারবিনা। তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ হোসনি। ”
আফরোজা নাজনীনের কথায় আনানের মুখ চুপসে গেল। সেই সাথে তাহমিদেরও। এদিকে কুহু পরেছে বিপদে। ও কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে সেটা চিন্তা করছে।

” পাঁচ মিনিটের মধ্যে যা যা প্রয়োজন নিয়ে এস। আমি গাড়িতে বসে আছি। ” কুহুর বিল্ডিংয়ের বাহিরে গাড়ি থামিয়ে বলল তাহমিদ।
কুহু বসে উসখুস করছে। মিথ্যা বলে বিপদে পরে গেছে এটা বুঝতে পারছে কুহু। মিনমিন করে বলল,
” আপনিও ভেতরে আসুন। ”
” কি খাওয়াবে? চা না কফি? ”
” আমি চা কফি কিছুই খাইনা। তাই ওসব বাসায় নেই। ”
” অতিথিকে বাসায় নিয়ে গিয়ে না খাইয়ে রাখবে? ”
” এমা তা কেন! অন্য কিছু করে দেব। ”
” এখানে নয়, একবারে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই খাব। শ্বশুর বাড়িতে খাওয়ার মজাই নাকি আলাদা হয়। আমি সেই মজাই নিতে চাই। ”
কুহু ভ্যবলার মত তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। ওর ফ্ল্যাটে যাওয়ার সাথে শ্বশুর বাড়ির সম্পর্ক কি সেটা ভেবে পাচ্ছেনা ও।

” তো ইঞ্জিনিয়ার ম্যাম, যাবেননা আপনার সো কল্ড জরুরী কাগজ আনতে? নাকি বাসায় কোন কাগজ নেই? আমি কি কয়েকটা কাগজ এনে দেব? না মানে, বাসায় গিয়ে তো দেখাতে হবে তুমি সত্যিই জরুরী পেপারস আনতে এখানে এসেছিলে। ” কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ জিজ্ঞেস করল।
তাহমিদের কথা শুনে আবারও কুহু কপাল চাপড়ায়। এই নিয়ে দুইবার তাহমিদের কাছে ধরা পরে গেল কুহু। ছেলেটা নিশ্চয়ই ওকে মিথ্যাবাদী ভাবছে। ছিহ্ কি লজ্জা।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৬

” চা-কফি নয় চাইলে তুমি ফুচকা কিংবা চটপটি খেতে পার। যাবে নাকি? ” কুহুকে লজ্জা পেতে দেখে আরেকবার কথা বলল তাহমিদ। ওর লজ্জা ভাঙ্গানোই তাহমিদের উদ্দেশ্য।
” ওসব খাইনা আমি। ”
” বাদাম? নাকি সেটাও খাওনা? ” চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
কুহু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল খায়।
তাহমিদ আর কথা বাড়ালোনা। গাড়ি চালু করল। ওর গন্তব্য সামনের পার্ক।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ২৮