সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩২
জাওয়াদ জামী
” আমাদের সেই ছোট্ট দৃষ্টির বিয়ে হয়ে ভাবতেই কেমন লাগছে। আমি যখনই নানুর বাড়িতে আসতাম, দৃষ্টি আমার পেছনে ঘুরঘুর করত। ওকে চকলেট কিনে না দেয়া পর্যন্ত আমাকে জ্বালিয়ে মারত। সেই দৃষ্টি আজ নিহানের বউ! নিহান , তুই কিন্তু কম যাসনা। পিচ্চি মেয়েটাকেই বিয়ে করতে হলো তোর? এই পিচ্চি সংসারের কি বুঝবে? ”
রোহানের কথা শুনে নিহান হাসল। দৃষ্টিও খিলখিল করে হেসে উঠল।
” কপালে আছে , তাইতো ও আমার ঘাড়ে এসে ভর করেছে। তবে ভাইয়া, ও শুধু তোমার পেছনেই ঘুরঘুর করতনা, ও আমার পেছনেও ঘুরঘুর করত। ওর চকলেট পাওয়া দিয়ে কথা ছিল। যেখানেই চকলেট পেত, সেখানেই ওর দর্শন পাওয়া যেত। ”
” নিহাইন্না, তুই কি থামবি? নাকি তোর ঘাড় মটকাবো আমি? আমাকে চকলেট কিনে দেয়ার জন্য বাবা ছিল। তুই আমাকে কয়দিন চকলেট কিনে দিয়েছিস? আমাকে চাচা চকলেট কিনে দিত। ” নিহানের কথা শেষ হতে না হতেই দৃষ্টি চিৎকার করে বলল।
” আরিব্বাস! দৃষ্টি, তুই তো দেখছি আগের মতই ঝগড়ুটে আছিস? নিহান জেনে-বুঝেই নিজের জীবনটা কয়লা করতেই তোকে বিয়ে করেছে। নিহান, শোন, তুই কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের কাছে দৃষ্টির নামে বদনাম করতে পারবিনা? বদনাম করতে গেলেই তুই ধরা খাবি। ”
” এই ভাইয়া, তুমি কি থামবে? তুমিও তো দেখছি কম যাওনা। দুই দিকেই সমানভাবে তাল মেলাচ্ছ তুমি। আমার নিজের দাদীর পেটের ফুপুর ছেলে যে এমন মিচকে শয়তান হবে সেটা বুঝিনি। বিদেশ থেকে দু পাতা পড়াশোনা করে এসে আমাকে ঝগড়ুটে বলছ? তোমার বউ আমার থেকেও দশগুণ বেশি ঝগড়ুটে হবে দেখো। যদিওবা আমি ঝগড়ুটে নই। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” তোর আশা পূরণ করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। আমার বউ হবে সহজ-সরল, আলাভোলা মানুষ। স্বামী অন্তপ্রাণ হবে। তোর মত খ্যাঁচখ্যাঁচ করবেনা। ”
” এমনভাবে বলছ যেন, তুমি জন্মের আগে থেকেই জানো, তোমার বউ কে হবে? ”
” জানি তো। ”
” কে? কে সেই হতভাগী? তোমার মত মিচকে যার কপালে আছে , তার কপাল বৃষ্টির পানিতেই পুড়বে। আগুনের দরকার হবেনা। আবার সেই আগুন দমকলবাহিনী নেভাতেও পারবেনা। আগুন নেভানোর জন্য অ্যান্টার্কটিকার আইসবার্গ লাগবে। ”
” তোকে কিছুই বলা যাবেনা। তুই মানুষ সুবিধার নয়। তুই যে আমার বিয়ে সহিসালামতে হতে দিবিনা এটা বুঝতে বাকি নেই। তবে এখন আমার নিহানের জন্য সত্যি সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। বেচারা মামাতো ভাই আমার। কি বউ জুটলো ওর কপালে! ”
” নিহান ভাইয়া , ফুপু তোমাকে ডাকছে। রোহান ভাইয়া , তুমিও যাও। তোমাদের দু’জনকে ফুপু কোথাও পাঠাবে। ”
দৃষ্টি রোহানের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। ও রোহানের চুল ছেঁড়ার প্রস্তুতি নিতেই কুহু এসে ওদের ডাকল।
” কুহু , এদিকে এসো। তুমি আমাকে বল, ছোটবেলা থেকেই তুমি এত শান্ত, নম্র কিন্তু তোমার এই বোনটা এমন ঝগড়ুটে কেন? ” কুহুকে দেখেই প্রশ্ন করল রোহান।
” ভাইয়া , তুমিও দৃষ্টিকে রাগাচ্ছো? সবাই শুধু ওর পেছনেই লাগে। আর ও বোকা মেয়ে, শুধু ছ্যাৎ করে ওঠে। তবে ও কিন্তু মোটেও ঝগড়ুটে নয়। ও প্রতিবাদী বুঝলে? এবার যাও। দেরি করলে ফুপু রাগ করবে। ”
” মা আবার আমাদের কোথায় পাঠাবে? চল নিহান, দেখি মা আমাদের কোথায় পাঠায়? ”
নিহান আর রোহান দু’জনেই বেরিয়ে গেল।
” তোমার আরেকটু পর আসলে কি হত? আর পাঁচ মিনিট পর আসলেই রোহান, নিহান দুই চামচিকেরই চুল ছিঁড়তে পারতাম আমি। তুমি সব সময়ই অসময়ে এন্ট্রি নাও। ” নিহানরা চলে যেতেই কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল দৃষ্টি।
” কেন তুই ওদের চুল ছিঁড়বি? রোহান ভাইয়া তোর বড় ভাইয়া নয়? বড় ভাইয়ে কেউ মারে? আর নিহান তোর হাজবেন্ড। হাজবেন্ডের চুল ছেঁড়ার কথা চিন্তা করবে পাগলে। তুই কি পাগল? ”
” ওরা আমাকে ঝগড়ুটে বলবে আরও কতকিছু বলবে, আর আমি ওদেরকে কিছুই করতে পারবনা? ”
” না, পারবিনা। তুই এখন শুধু আমার বোন কিংবা বাবা-মার মেয়ে নয়। তুই এখন অন্যের স্ত্রী, এই বাড়ির বড় বউ। হুটহাট কাজ তোকে মানায়না। বিয়ে হয়েছে , এবার দ্বায়িত্ব নিতে শেখ। এবার চাচার কাছে যা। চাচার পাশে বসে থাক। আর সেটা করতে ইচ্ছে না করলে রান্নাঘরে চল। বসে থাকতে থাকতে তোর হাত-পায়ে মরিচা ধরে গেছে। মরিচা ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করছি চল। ”
দৃষ্টি বুঝল কুহু রেগে গেছে। তাই সুড়সুড় করে চাচার কাছে গেল।
” বড়মা , রাতে কি রান্না হবে? ফুপুরা এসেছে। দুপুরের বেঁচে যাওয়া খাবার তো আর রাতে দেয়া যায়না। তাড়াতাড়ি বল কি রান্না করতে হবে। সন্ধ্যার আগেই সব রান্না করে ফেলব। ”
” রাতে মুরগির মাংস, সবজি আর একটা মাছের তরকারি কর। আর দুপুরের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো পাশের বাড়িতে দিয়ে দে। ঐ খাবারগুলোর সাথে মাংসের তরকারিও দিস। ঐ বাড়ির খালাম্মার ছেলে অসুস্থ , ছেলেকে নিয়ে খালাম্মা খুব কষ্ট করে চলে। ”
” বাব্বাহ্ , বড়মা! তুমি কি হাজী মোহাম্মদ মহসীনের ফিমেল ভার্সন হওয়ার চেষ্টা করছ ? জীবনেও দেখলামনা কারোও পাতে ভাত বাড়তে, সেই মানুষ হঠাৎ করে অন্যদের খাবার দিতে বলছ! আমার হার্টে ব্যথা করছে। তারপরও বলব, চেষ্টা চালিয়ে যাও, সফল হলেও হতে পার। ” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল দৃষ্টি।
দৃষ্টির কথা শুনে ওর দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকল রাখী আক্তার।
” দৃষ্টি , বেশি ফটরফটর করিসনা। যা করতে বলেছি কর । পাকনামি করলে থাপ্পড় খাবি বলে দিলাম। ”
” তুমি শেষ পর্যন্ত নারী নির্যাতনের বোঝা কাঁধে নিতে চাচ্ছ, বড়মা! তোমার একমাত্র সুইটি, কিউটি, মিষ্টি ছেলের বউকে নির্যাতন করবে? এত বড় অন্যায় তুমি করতে পারবে, বড়মা? তুমি তোমার ছেলের জান, প্রান, কলিজাকে কষ্ট দিতে পারবে? তুমি কি জানো, আমাকে আঘাত করলে সেই আঘাত তোমার ছেলের বুকে গিয়ে লাগবে? কষ্ট পাব আমি আর হার্ট অ্যাটাক করবে তোমার ছেলে। আর তাছাড়া তোমার বাবার বাড়ির…..। ”
” এই তুই চুপ কর। আর একটাও কথা বললে তোকে কিন্তু আমি সত্যিই থাপড়াবো। কায়েসের মেয়ে যে এত ফাজিল সেটা আমার কল্পনায়ও ছিলনা। ”
” বাবা-মা ভদ্র-সভ্য হলে মেয়ে যে ফাজিল হতে পারবেনা এটা কোন হাদিসে লিখা আছে , বড়মা? তেমন কোন হাদিস থাকলে বল , আমি পড়ে দেখব। ”
” দৃষ্টি , এবার যদি তুই চুপ না করিস তবে সত্যিই তোকে আমি থাপ্পড় দেব। ”
” ওরে কে কোথায় আছিস রে? তোরা দেখে যা, আমার শ্বাশুড়ি আমাকে নির্যাতন করছে। থাপ্পড় দিয়ে আমার সোনার বরণ রূপ কালো করে দিল। ও আমার প্রাণের স্বামীরে, তুমি কোথায় রে? তোমার নিপিড়ীত বউকে বাঁচাতে এস গো। ” দৃষ্টি ন্যাকাস্বরে কাঁদতে শুরু করল।
দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল রাখী আক্তার। ভয় পেল সে। দৃষ্টি যেভাবে কাঁদছে, তাতে সবাই মনে করবে , সে সত্যিই দৃষ্টিকে আঘাত করেছে। রাগে নিজের গালেই থাপ্পড় দিল সে।
” ভাই , তুমি! তুমি সত্যিই এসেছ? ” দরজা খুলে তাহমিদকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আনান।
” হাত বাড়িয়ে দে, আমি চিমটি কাটি। তবেই বুঝবি সত্যি এসেছি নাকি স্বপ্নে এসেছি। ” আনানকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে বলল তাহমিদ।
তাহমিদকে দেখে ছুটে আসল রাখী আক্তার। সে-ও অবাক হয়ে জানতে চাইল,
” আজ তোর সঙ্গে তিনবার কথা হয়েছে। তুই তো আমাকে একবারও বললিনা বাসায় আসবি? সরাসরি এখানেই এসেছিস নাকি অন্য কোথাও যাচ্ছিস? ”
” আমিও জানতামনা এখানে আসব। রাজশাহীতে একটা কাজ ছিল , আসব প্লেনে কিন্তু এক ফ্রেন্ডের জন্য ট্রেনে রওনা দিলাম। কিন্তু কিছুদূর আসার পর ট্রেনে বসে থাকতে বিরক্ত লাগল। তাই একটা স্টেশন দেখে নেমে পরলাম। রাজশাহীর বাসে উঠলাম। বাস যেই নাটোরে আসল , তখনই তোমাদের কথা মনে পরল। ভাবলাম ফুপাকে দেখে যাই। ”
” খুবই ভালো কাজ করেছিস , আব্বা। তোর বন্ধু কোথায়? সে কি ট্রেনেই যাচ্ছে? ”
” ওকে নামতে বলেছিলাম কিন্তু ও ট্রেনেই যাচ্ছে। প্লেন , বাসে ওর এ্যালার্জি। ফুপা কোথায়? আমি ফুপাকে দেখেই চলে যাব। ”
” তুমি বললেই তোমাকে যেতে দেব , ভাই? আজ তুমি কোথাও যাচ্ছনা। এখন এসব কথা বাদ। আগে রুমে চল, ফ্রেশ হয়ে নাও। একসঙ্গে ডিনার করব । ” নিহান এসে দাঁড়িয়েছে তাহমিদের সামনে।
” আমার ফ্রেণ্ডরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। যেতে হবে আমাকে। ”
” কে তোমাকে যেতে দিচ্ছে? এসেছ নিজের ইচ্ছায় , কিন্তু যেতে হবে আমাদের ইচ্ছাতে। ” কথাগুলো বলেই দৃষ্টি তাহমিদের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে দোতলায় চলে গেল।
” ভাই , তোমাকে যেতে দিচ্ছিনা কিছুতেই। রোহান ভাইয়াকে তো চেন? ভাইয়া এসেছে। আজ সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডা দেব। ”
” আনান, তুই দিনকে দিন ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছিস। ক্লাস বাদ দিয়ে বাসায় এসে থাকছিস। এটা কিন্তু ঠিক নয়। বাই দ্য ওয়ে, রোহান কোথায়? ”
” রোহান ভাইয়া কোকিলাকে নিয়ে বাহিরে গেছে। ফুপু কিসব কেনাকাটা করতে পাঠিয়েছে কোকিলাকে। বডিগার্ড হিসেবে পাঠিয়েছে ভাইয়াকে। ”
আনানের কথা শুনে তাহমিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সুপ্ত রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। তাহমিদ অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।
বাসায় ঢুকেই কুহুর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তাহমিদকে ড্রয়িংরুমে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেনা সে সত্যিই এসেছে। মনে হাজারো প্রশ্ন জমা হলেও নিরব থাকল সে। তাহমিদ কুহুকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকল।
” হেই তুমি তাহমিদ না? চিনেছ আমাকে? আমি রোহান। ” তাহমিদকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল রোহান।
” হেই ডুড, অনেকদিন পর দেখলাম তোমাকে। তো সবকিছু কেমন চলছে? ” তাহমিদ মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল।
” চলছে….আমার স্টাইলে। তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? কি করছ আজকাল? ”
” আমার দিনকাল বলতে পারো সিনেমার মত। প্লট টুইস্টে ভরপুর। কখন কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা দায়। তা তুমি কবে দেশে এসেছ? ”
” এইতো দশদিন আগেই। তুমি বললেনা তো কি করছ? ”
” মানুষ মেরামতের কাজ শিখেছি। সেটাই এখন থেকে হাতেকলমে করার চেষ্টা করছি। ”
” মানে? মানুষও মেরামত করে নাকি? দেশে কি এমন সাবজেক্ট চালু হয়েছে? ”
রোহানের প্রশ্ন শুনে আনান হো হো করে হেসে উঠল।
” তাহমিদ ভাই ডক্টর। সেজন্যই তোমাকে বলেছে, মানুষ মেরামতের কাজ শিখেছে। ”
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩১
এবার আনানের কথায় হেসে উঠল রোহান।
কুহু আঁড়চোখে তাকাচ্ছে তাহমিদের দিকে। তাহমিদ সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলছে। কিন্তু একবারও সে কুহুর দিকে তাকাচ্ছেনা। বিষয়টা বুঝতে পেরেই কুহুর বুক ভারী হয়ে আসল।