সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৫
জাওয়াদ জামী
” রাত একটা বেজে গেছে অথচ তুমি এখনো জেগে আছো? শুনেছি অন্যদিন বারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পর। আজ কি হয়েছে? আমাকে ছাড়া ঘুম আসছেনা বুঝি? ” রুমে ঢুকেই কুহুকে লজ্জায় ফেলে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
কুহু তাহমিদের কথার উত্তর দেবে কি! ও লজ্জায় চোখ বন্ধ করে থাকল। এই ঠোঁটকাটা লোকটা যে ওকে বাকি জীবনটাতে পদে পদে লজ্জায় ফেলবে সেটা বুঝতে বাকি নেই কুহুর।
কুহুকে ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে হাসলো তাহমিদ। বধূ বেশে মেয়েটাকে দেখতে মন্দ লাগছেনা। ল্যাভাণ্ডার কালার শাড়িতে মেয়েটাকে চমৎকার মানিয়েছে। ওর শরীরের আনাচেকানাচে নতুন বউয়ের সকল লক্ষ্মণই ফুটে উঠেছে। নেশাভরা চোখে তাহমিদ তাকিয়ে থাকল তার শ্যামাঙ্গিনীর দিকে। এই মেয়ে ‘ একান্তই তার ‘ কথাটা ভাবতেই ওর শিরা-উপশিরায় অদ্ভুদ কাঁপন ছড়িয়ে যায়, হৃদয়ে ঢেউ খেলে। বুকের ভেতর অচেনা আবেগ উথলে ওঠে। প্রতিটি স্পন্দন চিৎকার করে তার নাম উচ্চারণ করছে। আবেগে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসলো তাহমিদের। নিজের আবেগ গোপন করতেই তাহমিদ কুহুকে জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” খেয়েছ? ”
” আপুদের আদেশ আপনার আগে যেন না খাই। ”
” শুধু আপুদের আদেশ? তোমার ইচ্ছে ছিলনা? ”
কুহু সায় জানিয়ে মাথা নাড়ায়।
” দশ মিনিট সময় দাও আমাকে। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার ব্যবস্থা করছি। ”
” খাবার ব্যবস্থা করাই আছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। ”
কুহুর কথার ধরন শুনে তাহমিদ বাম ভ্রু উঁচু করে তাকায় ওর রমনীর দিকে।
” বউ বউ ফর্মে আজই চলে এসেছ দেখছি! অথচ আমি ভেবেছিলাম, আমার বউটা বোকাসোকা হবে। কিন্তু এ তো দেখছি ছুপা রুস্তম নিকলা! আরে তাহমিদ ব্যাটা, তোর কপাল পুড়ল মনে হয়। ” তাহমিদ কৃত্রিম আফসোস নিয়ে বলল।
তাহমিদের ভঙ্গি দেখে কুহু হাসল শুধু। মানুষটা যে ওকে খোঁচাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছ কুহু।
” এখনই হতাশ হবেন না। সামনে বাকি জীবন পাবেন হতাশ হবার জন্য। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসেন, খাবার চলে আসলো বলে। ”
” তোমার আপুরাই কি খাবার নিয়ে আসবে? ”
” জ্বি। ”
” তাহলে আধাঘণ্টার আগে ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছিনা আমি। ওরা একেকটা যা বিচ্ছু। আমাকে জ্বালিয়ে মারবে। ” কথাগুলো বলেই তাহমিদ ওয়াশরুমে ঢুকল।
কিছুক্ষণ পর সুপ্তি, দ্যুতি খাবার নিয়ে রুমে আসলো। তাহমিদকে না দেখতে পেয়ে দ্যুতি জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় গেল আমাদের আদরের ছোট ভাই? ”
” ওয়াশরুমে। ” কুহু ছোট্ট করে উত্তর দিল।
” ও আমাদের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মনে হচ্ছে !
কতক্ষণ এভাবে পালিয়ে বেড়াবে তোমার জামাই? ও ভেবেছে পালিয়ে বেড়ালেই বুঝি আমাদের হাত থেকে ও রেহাই পাবে? আজ না হয় কাল আমাদের সামনে আসতেই হবে ওকে। নিজে বিয়ের ঘটকালি নিজেই করে আবার দূরে দূরে থাকছে? ”
” আহ্ দ্যুতি, আমাদের ভাই বিয়ে করেছে এতে তুই খুশি হোস নি? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে, বিয়ে করেছে। অন্যায় কিছু করেনি তো। বেচারাকে আর লজ্জায় ফেলে কাজ নেই। চল এবার যাই। ” বরবরই তাহমিদের পক্ষ নেয়া সুপ্তি এবারও তাহমিদের পক্ষই নিল।
” বিয়ে করেছে অন্যায় করেনি। কিন্তু এভাবে হুটহাট বিয়ে করবে কেন? আমাদের একটামাত্র ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ করব বলে কত প্ল্যান করে রেখেছিলাম, কিন্তু ও আমাদের সব আনন্দে জল ঢেলে দিল। এই অধিকার ওকে কে দিয়েছে? আপু, ওকে ওয়াশরুম থেকে বের হতে বল। ওর দুই গালে তবলা না বাজানো পর্যন্ত আমি শান্তি পাবোনা। ” দ্যুতি রাগে গজগজ করতে করতে বলল।
” দ্যুতি, তুই তাহমিদকে মারতে পারবি? কষ্ট হবেনা তোর? অথচ তুই কিন্তু একটা সময় বলতিস, তাহমিদকে তুই নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসিস। ওর কষ্ট তুই সহ্য করতে পারিসনা। আজ তুই এমন কথা বলছিস কেন? আজকে ওকে মারলে তোর কষ্ট হবেনা? ” এবার সুপ্তি তার মোক্ষম হাতিয়ার প্রয়োগ করল।
বড় বোনের কথাগুলো শুনে দ্যুতির রাগ পরে গেল। তবে সে রেগে থাকার অভিনয় করে বলল,
” হয়েছে আর ঐ হনুমানের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইতে হবেনা। ওকে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতে বল। তবে আজকের পর থেকে ও যেন আমার সামনে না আসে। ওকে দেখলেই আমার রাগ হবে। এই যে মেয়ে, তুমি আবার ভেবোনা, অকারনেই তোমার হাসবেন্ডকে বকাঝকা করছি। আদরের একটামাত্র ভাই তো, তাই ওর এভাবে বিয়ে করায় কষ্ট হচ্ছে। তাই বলে তোমাকে দোষ দিচ্ছিনা কিন্তু। তোমাকে আমরা মেনেই নিয়েছি। চল আপু, আমরা যাই। আমরা না যাওয়া পর্যন্ত তোমার ভাই ওয়াশরুম থেকে বের হবেনা৷ ”
দ্যুতির কথা শুনে কুহুর খারাপ লাগছে। আপুরা কত আশা করে ছিল ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ করবে। কিন্তু মানুষটা সেটা হতে দেয়নি। এই আফসোস হয়তো আপুদের আজীবন থেকে যাবে। আসলেই কিছু না পাওয়া, কিছু ব্যথা, কিছু আফসোস মানুষের আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এই বাড়ির লোকজনও হয়তো আজীবন আজকের ঘটনা মনে রাখবে। সেই সাথে দোষারোপ করবে তাদের ছেলেকে।
কুহুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুবোন বেরিয়ে গেল। ওরা যাওয়ার পরই তাহমিদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসল। ও এতক্ষণ ভেতর থেকে আপুদের সব কথাই শুনছিল।
” বাঁচলাম। ডক্টরের বউ যে কি সাংঘাতিক, সেটা যদি তুমি জানতে তবে এমন নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারতেনা। ” তাহমিদ কুহুর পাশে বসে বলল। কিন্তু তাহমিদের কথা কুহুর বোধগম্য হলোনা। ও প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে থাকল তাহমিদের দিকে। তাহমিদ সেটা বুঝতে পেরে বলল,
” আরে দ্যুতিপুর কথা বলছি। ভাইয়া ডক্টর তুমি জানোনা? ভাইয়া কিন্তু আপুকে ভিষণ ভয় পায়। এমনকি ভাইয়ার বাড়ির প্রতিটা সদস্যই আপুকে হেব্বি ভয় পায়। আমার সাধাসিধা বড়মার মেয়ে যে এমন ডেঞ্জারাস হবে সেটা কেউ কস্মিনকালেও ভাবেনি। ”
” আপুকে ভয় পাওয়ার মত কোন কারনই দেখলাম না আমি। অযথাই আপুকে সবাই ভয় পায়। তবে হ্যাঁ, আপু সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করে, এজন্যই বোধহয় আপুকে সবাই ভয় পায়। ”
” আপু সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছে। তাই চোখের সামনে কারও কোন অন্যায় দেখলে, সরাসরি বলে দেয়। এজন্যই আপুকে অনেকেই ভয় পায়। তবে আপুর শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের বিষয় আলাদা। পড়াশোনা চলাকালীন আপুর বিয়ে হয়। বিয়ের একবছর পরই আপু পড়াশোনা শেষ হয়। এরপর আপু স্কলারশিপ পায় সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু আপুর শ্বাশুড়ি তখন অসুস্থ ছিল। তাকে দেখাশোনার জন্য কেউ ছিলনা। আপু শাশুড়ীর দেখভালের জন্য ইংল্যান্ড গেলোনা। জীবনটা শ্বশুর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই কাটিয়ে দিল। আর এজন্যই শ্বশুড় বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে সকল কাজেই প্রায়োরিটি পেতে শুরু করে। এক সময় দেখা গেলো আপু ঐ বাড়ির মধ্যমনি হয়ে উঠল। সবাই আপুকে সমীহ করতে শুরু করল। আর তাতেই আমার আপু সকলের মাথায় ছড়ি ঘোরাতে শুরু করল। অবশ্য এজন্য কারও কোন অভিযোগ নেই। ”
” সত্যিই! আপু শ্বাশুড়ির জন্য নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে? কয়জন এটা করতে পারে! ” কুহু বিস্ময় নিয়ে বলল।
” এতে কখনোই আপুকে আফসোস করতে শুনিনি। ঐ বাড়ির লোকজনও আপুকে ছাড়া অচল। আপু তাদের জন্য বিয়ের দশ বছরেও এখানে এসে একটানা তিনদিন থাকেনি। আর সেজন্যই আপু চায় যে দুই-একটা দিন এখানে এসে থাকবে, সবাইকে নিয়ে আনন্দ করবে। ” কথাগুলো বলার সময় তাহমিদের চোখমুখ কোন এক অজানা কারনে ঝলমল করছিল। কুহু মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার পুরুষকে।
” এবার আপুকে সাতদিনের আগে যেতে দেবোনা। আপু এবার সত্যিই সবাইকে নিয়ে আনন্দ করবে। ” কুহু মৃদু হেসে বলল।
” সত্যিই! পারবে আপুকে সাতদিন রাখতে? ”
” পারতে আমাকে হবেই। ”
” গুড। এই না হলে আমার ‘ বউ ‘। এবার এগিয়ে এস আমার কাছে। আমি তোমাকে খাইয়ে দেই। বাসর ঘরে বরের হাতে খাও। এরপর থেকে প্রতিরাতে বরকে খাইয়ে দেবে। ” তাহমিদ প্লেটে বিরিয়ানি তুলে নিয়েছে।
তাহমিদ খাইয়ে দেবে শুনে কুহু লজ্জা পেল। ও মুখ নিচু করে বসে রইল। কুহুকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকাল। কুহুকে এক সাগর লজ্জায় ফেলে আবারও কথা বলল,
” রাত দেড়টা পেরিয়ে গেছে। আরও কতক্ষণ এভাবে আমাকে বসিয়ে রাখবে? এই তোমার কি বাসর করার ইচ্ছে নেই? খেতে খেতে দুইটার বেশি বেজে যাবে। এত সময় লাগালে বাসর করব কখন? নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা করছ? ”
তাহমিদের কথা শুনে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে কুহুর। লোকটার মুখে কোন কথাই আটকায়না। পাছে ওকে আরও লজ্জা দেয় ভেবেই কুহু এগিয়ে গেল তাহমিদের দিকে। কুহুকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে রাজ্যজয়ের হাসি ফুটল তাহমিদের ঠোঁটে।
ঘুম ভাঙতেই উঠে বসতে চাইল কুহু। কিন্তু পারলনা। দু’টো শক্তপোক্ত হাত ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। কুহুর কানে ধুকপুক আওয়াজ আসছে। প্রথমে বুঝতে পারলনা আওয়াজটা কিসের। একটু ধাতস্থ হতেই বুঝল ও তাহমিদের বুকে শুয়ে আছে। আর ওর কানে এতক্ষণ তাহমিদের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ আসছিল। আপনাআপনিই কুহুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। সেই সাথে মনে পরে গেল গত রাতের কথা। মানুষটা ওকে ক্ষনে ক্ষনে লজ্জায় ভাসিয়েছে, রাঙিয়েছে তার ভালোবাসায়। কুহুকে তার ভালোবাসায় করেছে গরবিনী।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৪
মানুষটা যে এতটা ভালোবাসে সেটা আগে বুঝতে পারেনি কুহু। গত রাতে সে কুহুকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার জীবনে কুহুর মূল্য কতটুকু। কুহু ভুলে গেল ওকে এবার বাইরে যেতে হবে। ও তাহমিদের বুকে পরম শান্তিতে শুয়ে রইল। চোখ বুজে অনুভব করতে থাকল তাহমিদের হৃৎস্পন্দনের প্রতিটি আওয়াজ। পুরো রাত জাগার ক্লান্তিতে একটা সময় আবারও ঘুমিয়ে পরল তাহমিদের বুকে। তাহমিদ তার নারীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।