অন্তঃদহন পর্ব ৪৬

অন্তঃদহন পর্ব ৪৬
DRM Shohag

সৌম্য’র প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। ঘণ্টা দুই পর তার জ্ঞান ফিরেছে। আর জ্ঞান ফেরার পর শুনতে পায় সন্ধ্যার জ্ঞান ফিরেছিল। তবে সে দু’মিনিট-ও চোখ মেলে থাকতে পারেনি। অপারেশনের পর পর শরীর দুর্বল লাগায় সন্ধ্যা আবার-ও ঘুমিয়ে গিয়েছে।
ডক্টর বলেছে, সন্ধ্যা এখন আউট অফ ডেঞ্জার।
সন্ধ্যাকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। বেডের উপর শুয়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। যে কিছুক্ষণ আগেও নিজের অজান্তেই সবার নিঃশ্বাস কে’ড়ে নিতে যাচ্ছিল।
সৌম্য সন্ধ্যার বেডের পাশে অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সন্ধ্যার ঘুমন্ত মুখপানে। সৌম্য’র পাশে ইরা দাঁড়ানো। ইরা সৌম্য’র হাত ধরে মৃদু হেসে বলে,

– আমি বলেছিলাম না, আমাদের সন্ধ্যা সুস্থ হয়ে যাবে। দেখ ও সুস্থ হয়ে গিয়েছে।
সৌম্য ঢোক গিলল। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করছে। হঠাৎ-ই ইরার দিকে ফিরে ইরাকে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে নেয়। এতোক্ষণে জমানো জলকণা চোখ বেয়ে গড়িয়ে ইরার কাঁধে এসে পড়ে। ইরা বুঝতে পারল। তবে কিছু বলল না। দু’হাত আলতো করে সৌম্য’র পিঠে বুলিয়ে নিরব সান্ত্বনা দেয়। সৌম্য ভাঙা গলায় বলে,
– বোনুর কিছু হলে আমি ম’রে যেতাম ইরাবতী।
ইরার চোখের কোণে পানি জমে। সন্ধ্যার কিছু হলে এতোগুলো মানুষের কি হত, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। সৌম্য ইরাকে ছেড়ে দু’হাতে চোখ ডলে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথার কাছে বসে সৌম্য। ডান হাতে সন্ধ্যার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। এরপর মুখ নামিয়ে সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু এঁকে ভাঙা গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– তোর কিছু হলে আমি এতিম হয়ে যেতাম বোনু। তুই তো আমার ছোট মা। কখনো আমায় রেখে যাবি না। মনে থাকবে?
সৌম্য’র কথায় ইরা মৃদু হাসল। তার বাবার মুখে এই ছোট মা শব্দটা সে বহুবার শুনেছে। সৌম্য’র মাকে ডাকতো এই নামে। সৌম্য’র মুখে এই ছোট মা নাম শুনলে তার বাবার কথা মনে পড়ে যায়।
সৌম্য সন্ধ্যার পাশ থেকে উঠে এসে ইরার দিকে চেয়ে বলে,
– তুই বোনুর কাছে বোস ইরাবতী। আমি একটু পর আসছি।
ইরা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কোথায় যাবি?
সৌম্য কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
– কাজ আছে। একটু পর-ই আসছি। তুই বোস।

সৌম্য হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আশেপাশে খুঁজে খুঁজে একটি মসজিদে এসেছে। এখানে এসে ওজু করে এশার নামাজসহ দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহ’র কাছে শুকরিয়া জানায়, সন্ধ্যার সুস্থ হওয়ার জন্য।
এরপর মসজিদের দানবাক্সের কাছে এসে দাঁড়ায়। পকেট দেখে ওয়ালেট বের করে কয়েকটি একশ টাকার নোট ব্যতীত সব টাকা না গুনেই দানবাক্সে ফেলে। সন্ধ্যার অপারেশনে কখন কি লেগে যায়, এজন্য প্রায় হাজার দশ টাকা ক্যাশ রেখেছিল, যার সব-ই খুশি মনে আল্লাহর কাছে রেখে গেল।
এরপর সৌম্য বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস টেনে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– মা জানো, তুমি চলে যাওয়ার পর, বোনু অনেকগুলো বছর কথা বলেনি। কিন্তু আজ আবার-ও ও কথা বলবে। আমাকে সৌম্য ভাইয়া বলে ডাকবে। তুমি থাকলে তোমাকেও মা বলে ডাকতো।
বোনুকে ফিরে পাওয়া, বোনুর কণ্ঠ ফিরে পাওয়া, মাকে হারানো সব মিলিয়ে সুখ-দুঃখের অশ্রু জমে সৌম্য’র চোখজোড়ায়।

আকাশ হার্ট অ্যাটাক করেছে। ডক্টর চেকাপ করে জানিয়েছে আকাশকে তিনটে রিং পরালে আকাশের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আসমানী নওয়ান প্রথমে ভেঙে পড়লেও, পরবর্তীতে নিজেকে শক্ত করে নেয়। সে ভেঙে গেলে তার ছেলেমেয়েদের কি হবে?
আকাশের জ্ঞান ফিরেছে মিনিট দুই হলো। ডান হাত চোখের উপর রেখে চোখ কুঁচকে রেখেছে। ধীরে ধীরে মাথা সবকিছু ক্যাচ করলে আকাশ ধড়ফড় করে উঠে বসে। তার সন্ধ্যামালতী কেমন আছে না জানা পর্যন্ত সে শান্ত থাকবে কিভাবে!
আকাশ দ্রুত বেড থেকে নেমে দাঁড়াতে গেলে দেখল, বুকে কিসব লাগিয়ে রেখেছে। আকাশ বিরক্ত হয়ে সব টেনে ছুড়ে ফেলে। আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে বিচলিত কণ্ঠে বলে,

– আব্বা শান্ত হও। জান্নাত ঠিক আছে।
কথাটা শুনতেই আকাশের হাত থেমে যায়। মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকায়। ঢোক গিলল সে। আসমানী নওয়ান আকাশের গালে হাত দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলে,
– জান্নাত ঠিক হইয়া গেছে আব্বা। কিন্তু তুমি যে অসুস্থ হইয়া গেছ। শান্ত হইয়া বসো। তোমারে চিকিৎসা করানো লাগবো।

আকাশ স্থির দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মায়ের হাত তার গাল থেকে সরিয়ে দেয়। উল্টো ঘুরে বেড এর উপর থেকে তার ফোন নিয়ে পকেটে রাখে। আর পাঞ্জাবি নিয়ে আকাশ তার বা হাতে পেঁচায়। এরপর কোনোকিছু না বলেই উদাম গায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান পিছু ডাকলেও শুনলো না আকাশ। একটা টুঁ-শব্দ-ও করল না। কেবিন থেকে বেরোলে, আকাশকে নিয়াজের চোখে পড়লে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বলে,
– আকাশ তুমি অসুস্থ। তোমাকে রিং পরাতে হবে। বেরিয়েছো কেন? আমি সব ব্যবস্থা করেছি।
আকাশ নিয়াজের কথার-ও উত্তর করল না। নিয়াজের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে নিয়াজ আকাশকে টেনে ধরলে আকাশ রে’গে নিয়াজকে একটা ধাক্কা দেয়। নিয়াজ দু’পা পিছিয়ে যায়। আকাশ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এরপর এগিয়ে যেতে নিলে নিয়াজ আবার-ও আকাশের হাত টেনে ধরে বলে,
– আকাশ তুমি রা’গ কর, প্রবলেম নেই। কিন্তু প্লিজ তোমাকে রিং পরাতে দাও। তোমার হার্ট ব্ল’ক হ…….
আকাশ ডান হাতে নিয়াজের কলার ধরে চিৎকার করে বলে,

– ম’রে গেলেও আমার ট্রিটমেন্ট করাবো না। শুনতে পেয়েছিস? এসব দরদ আমার জন্য না দেখিয়ে, তোর দু’দিনের পাতানো বোন সন্ধ্যার জন্য গিয়ে দেখা যাহ্।
কথাটা বলে আকাশ নিয়াজকে ধাক্কা দেয় আবার-ও। আকাশের চিৎকারে আশেপাশের অনেকে তাকিয়েছে। আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে বলে,
– আকাশ একটু বইসা আমাদের কথা শোনো।
আকাশ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ স্বরে বলে,
– তোমাদের কথা শোনার মেয়াদ আজ বিকাল পর্যন্ত ছিল। মেয়াদ শেষ, তাই অযথা কথা খরচ করার কোনো দরকার নেই।
কথাটা বলে আকাশ বামদিকে ফিরলে দেখল একটি কেবিনের সামনে সৌম্য দাঁড়িয়ে আছে। বুঝল, ওই কেবিনেই সন্ধ্যা আছে।
আকাশ বড় বড় পায়ে সৌম্য’র দিকে এগিয়ে যায়। সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– নিজে এক এক্টর। বোনকে বানিয়েছ আরেক এক্টর। চালিয়ে যাও। অল দ্যা বেস্ট।
সৌম্য ঢোক গিলল। অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি আকাশ ভাইয়া।
সৌম্য’র কথাতে আকাশের গায়ে যেন আ’গু’ন ধরে গেল। ডান হাতে শ’ক্ত করে সৌম্য’র কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– স্যরি! তোর বোনের জীবনের চেয়ে বোনের কণ্ঠস্বর শোনা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে গিয়েছিল? আজ যদি তোর বোন আর চোখ না খুলত, নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতি? বল পারতি?
সৌম্য ভেজা চোখে তাকায় আকাশের দিকে। সত্যি-ই তো, আজ যদি তার বোনু আর না উঠত, তবে সে কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারত? কিন্তু সে যে তার বোনুর কান্না সহ্য করতে পারছিল না।
আকাশ সৌম্য’র কলার ছেড়ে দেয়। ঢোক গিলে বলে,

– তোদের বুক ভরা সাহস। আমার এতো সাহস ছিল না। তাই তোর বোনের কান্না হাজার ক’ষ্ট সয়েও গিলেছি। কিন্তু তোরা সবাই মিলে কি করলি? বিশ্বাসঘা’ত’কের দল কোথাকার!
এটুকু বলে আকাশ থামে। সৌম্য মাথা নিচু করে আছে। কেবিন থেকে ইরা-ও বেরিয়ে এসেছে। মলিন মুখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
আকাশের মাথা নিচু। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ হেসে বলে,
– সামনে দাউদাউ করে আ’গু’ন জ্বলছিল, ভেবেছিলাম, আমার প্রাণটা ওখানে ছটফট করে পু’ড়’ছে। গত একটা বছর জেনেছি, আমার সন্ধ্যামালতী আগুনে পু’ড়ে মা’রা গিয়েছে। যখন দেখি আমার কলিজায় ঠাই দেয়া মানুষ মৃ’ত্যু’র সাথে লড়াই করছে, মৃ’ত্যু’র কোলে ঢলে পড়েছে, তখন ঠিক কতটা ক’ষ্ট হয়, জানিস? জানবি কি করে? তুই তো জানতি, তোর ইরাবতী দিব্যি বেঁচে আছে। কিন্তু আমি জেনেছি আমার সন্ধ্যামালতী এই পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই। কোথাও নেই। আমার মাঝে আমার প্রাণ ছিল না রে।
তোরা লুকিয়ে থেকে, আমায় এতো ক’ষ্ট দিয়েও তোদের দু’ভাইবোনের শান্তি হয়নি তাইনা?
আজ আবার-ও স্বা’র্থ’প’রের মতো একইভাবে আমায় ক’ষ্ট দিতে নেমে পড়লি। আর কত ক’ষ্ট দিলে তোরা দুই-ভাইবোন থামবি?

কথাগুলো বলতে গিয়ে আকাশের গলা বেঁধে আসে। মাথা নিচু করে নেয়।
সৌম্য’র চোখের কোণে আরও খানিক জলকণা জমা হলো। সে তো জানতো না, আকাশ তার বোনুকে এতো ভালোবাসে। জানলে সে তার বোনুকে নিয়ে সামনে আসতো। আর আজ সন্ধ্যার ওতো কান্না, ইচ্ছে পূরণ করতে অনেক বড় রিস্ক নিয়েছিল। ঢোক গিলল সৌম্য।
আকাশ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি জানি তোরা থামবি না। আসলে আমি তোদের কাছে বেশি স’স্তা হয়ে গিয়েছি। স্পেশালি তোর বোনের কাছে। এবার থেকে নিজের মূল্য নিজে কুড়াবো।
সৌম্য কিছু বলতে চায়। আকাশ সৌম্য’র দিকে ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে শ’ক্ত গলায় বলে,
– Don’t talk Mr. Shoummo. Just be quiet.

কথাটা বলে সৌম্য’কে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সকলে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে আকাশকে দেখল। আকাশ আর এখানে দাঁড়ালো না। বা হাতে কেবিনের দরজা খুলে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে।
আকাশের শব্দ করে বলা কথার আওয়াজে সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে উঠে বসেছে। তখন-ই দরজার সামনে আকাশকে দেখে সন্ধ্যা ঢোক গিলল।
সন্ধ্যাকে দেখে আকাশ থমকানো দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যার চোখেমুখে ক্লান্তি উপচে পড়ছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। পরনে হসপিটালের পোষাক। গলায় কিছু পেচানো। আর দৃষ্টিতে অসীম মায়া। কতক্ষণ যে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে রইল, নিজেও জানেনা। সন্ধ্যা অপলক চেয়ে রইল আকাশের দিকে। একবারের জন্য-ও কারো পলক পড়েনা, যেন দু’জনেই বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।

সন্ধ্যার চোখজোড়া ভিজে ওঠে। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আকাশকে দেখার সেই তীব্র তৃষ্ণা এখনো মেটেনি তার। তার শুধু মনে হচ্ছিল, সে হয়ত আর আকাশকে দেখতে পাবে না। আর আকাশের বুকে ফিরতে পারবে না। আকাশকে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যার ভ’য় হয়। আগে আকাশ তাকে দেখলেই সর্বপ্রথম জড়িয়ে ধরত। এরপর সব কথা বলত। আজ কতক্ষণ পেরিয়ে গেল, অথচ আকাশ একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে এক পা-ও এগোয় না। আকাশকে না জানিয়ে অপারেশন করায় আকাশ কি অনেক বেশি রা’গ করেছে? সন্ধ্যা আকাশের ভালোবাসায় অপেক্ষায় বসে থাকে। দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব।

আকাশের দৃষ্টির নড়চড় নেই। স্থির দৃষ্টিতে সন্ধ্যার মুখপানে চেয়ে আছে সে। সুস্থ সন্ধ্যাকে দেখে তার মনে হলো, বুকের উপর থেকে যেন একটি পাহাড় সরে গিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার করা কাজ মনে পড়তেই আকাশের চোয়াল শ’ক্ত হয়। দৃষ্টিতে দৃঢ়তা আসে। আজ তার সন্ধ্যামালতী আর না-ও তাকাতে পারতো। আর এর জন্য দায়ী থাকতো, তার গোটা ফ্যামিলি। সবার আগে দায়ী থাকতো তার সন্ধ্যামালতী। আকাশ আর ভাবতে পারেনা। দু’বার ঢোক গিলে অসহায় কণ্ঠে বলে,

– তুমি এতোগুলো মাস আমার আড়ালে থেকে আমাকে তো ক’ষ্ট দিয়েছো-ই, এবার সত্যি সত্যি আমাকে নিঃস্ব করে দেবার পায়তারা করছিলে, তাইনা? আমার ক’ষ্ট-ই কি তোমার শান্তি বয়ে আনে? তবে থাকো। যাচ্ছি আমি। আর ফিরব না।
কথাগুলো বলে থামে আকাশ। সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। কোথায় যাবে আকাশ? মুহূর্তেই চোখজোড়ায় আরও খানিক অশ্রুকণা জমতে শুরু করল।
আকাশ সন্ধ্যার চোখে পানি দেখে প্রাণহীন হাসল।
ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল উঁচিয়ে বুকের বা পাশে খুঁচিয়ে ভারী স্বরে বলে,

– এখানটায় অনেক ব্য’থা পেয়েছি, বুঝলে? এতোটা ব্য’থা পেয়েছি যে চোখদু’টো মরুভূমির চেয়েও শুষ্ক হয়ে গিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ব্য’থা দেয়ার মালিক তুমি সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশের বলা প্রতিটি কথায় যতটা না ক’ষ্ট পেল, তার চেয়ে হাজারগুণ ক’ষ্ট পায় তার নাম সন্ধ্যা বলায়। এই প্রথম আকাশ তাকে সন্ধ্যামালতী না ডেকে সন্ধ্যা ডাকলো। গতকাল রাতেও আকাশ অনেকবার বলেছিল, ‘তুমি শুধু আমার সন্ধ্যামালতী।’
সন্ধ্যার চোখে জমা অশ্রুগুলো গালে গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে চাইল, আকাশ সাথে সাথে ডান হাত উঁচু করে ধমকের স্বরে বলে,

– স্টপ সন্ধ্যা!
সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। আবার-ও আকাশের মুখে সন্ধ্যা ডাক শুনে সন্ধ্যার বুক মুচড়ে ওঠে। চোখের বাঁধ নামে। অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ দেখল সন্ধ্যাকে। কিন্তু তার মন গলল না। বরং অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলে,
– আই হেইট ইউর ভয়েস।
এরপর আকাশ একবার শ্বাস নেয়। আবার-ও একই সুরে বলে,
– যেই কণ্ঠের জন্য তুমি আমার থেকে আমার সন্ধ্যামালতীকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলে, সেই কণ্ঠ আমি কখনো শুনতে চাইনা।

আজ বিকাল পর্যন্ত তোমার কণ্ঠ শোনার জন্য আমি প্রতিটি মুহূর্ত নিজের মাঝে তীব্র আকাঙ্ক্ষা পুষেছি। যে আকাঙ্ক্ষা আমি অনন্তকাল বয়ে বেড়াতাম। যেখানে মিশে থাকতো অফুরন্ত ভালোবাসা। কিন্তু তুমি আমার থেকে সেই ভালোবাসার মানুষটিকেই কেড়ে নেয়ার পথে পা বাড়িয়েছিলে। কাজটা তুমি ঠিক করনি সন্ধ্যা।
বারবার আকাশের মুখে সন্ধ্যা ডাক সন্ধ্যার কাছে বি’ষের মতো লাগছে। দৃষ্টিতে অসহায়।
সন্ধ্যার দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললে আকাশ চোখ বুজে নেয়। ঢোক গিলল বেশ কয়েকবার। এরপর চোখ মেলে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে দৃঢ় স্বরে বলে,

– এতোদিন আকাশ নওয়ানের ভালোবাসা দেখেছ। এবার তার ভালোবাসার উল্টোপিঠ দেখবে। গট ইট মিস সন্ধ্যা শেখ?
সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার মাথা ঘুরছে। আকাশ তার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? সে তো চিনতে পারছে না আকাশকে।
কথাটা বলে আকাশ উল্টো ঘুরে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়।
আকাশ চলে যাবে ভেবে সন্ধ্যা দ্রুত বেড থেকে নেমে একটুখানি এগোতেই দুর্বল শরীরটা ঘুরে ওঠে। ফলস্বরূপ সন্ধ্যা ধপ করে মেঝেতে পড়ে যায়।
এদিকে আকাশ দু’পা এগোলে ধপ করে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেয়ে সাথে সাথে উল্টো ঘুরে তাকায়। দেখল সন্ধ্যা মেঝেতে বসে পড়েছে। আকাশ দ্রুত কয়েক পা সন্ধ্যার দিকে এগোলে সন্ধ্যার কান্নামাখা মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এইবার আকাশকে চিনতে পারছে, শান্তি লাগছে।
সন্ধ্যার হাসি আকাশের দৃষ্টির আড়াল হয় না। আকাশ অর্ধেকটুকু এসে দাঁড়িয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে গলা চড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

– সৌম্য ভেতরে এসো। তোমার বোন পড়ে গিয়েছে।
আকাশের কথা শুনে সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসিটুকু মিলিয়ে যায়।
সৌম্য কেবিনের পাশেই দাঁড়ানো ছিল। আকাশের আগের বলা কথাগুলো শুনতে না পেলে-ও লাস্ট কথাটা আকাশ জোরে বলায় শুনেছে। আর তাই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। সন্ধ্যাকে মেঝেতে বসে পড়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাকে আগলে নেয়। দু’হাতে সন্ধ্যাকে কোলে করে বেডের উপর বসিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আকাশ এতোটা রূঢ় হবে, সে ভাবতে পারেনি। তার বোনুকে টাচ পর্যন্ত করছে না?
সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এই আকাশকে সে একটু-ও চেনে না। তার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
আকাশ বা হাতে পেঁচানো পাঞ্জাবি আরেকটু ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয় হাতের সাথে। এরপর সন্ধ্যার জলেভরা চোখে চোখ রেখে ভারী গলায় বলে,

– দেহের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন হৃদয়, যেখানে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা সবার থাকে না।
কথাটি বলে আকাশ আর এখানে দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
আকাশের কথা শুনে সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনের চোখেমুখে বিস্ময় ভর করে। সন্ধ্যার চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশ তাকে এতো ভারী কথা কি করে বলতে পারলো? আকাশের হৃদয়ে স্থানার পাবার যোগ্যতা তার নেই? সন্ধ্যা জানে আকাশ তাকে কতটা ভালোবাসে। সে-ও তো ভীষণ ভালোবাসে আকাশকে। তবুও আকাশ কেন এভাবে বলে গেল? সন্ধ্যার দমবন্ধকর অনুভূতি হয়।

সৌম্য ঢোক গিলল। আকাশ কত ভারী একটা কথা বলে গেল, তার-ই তো খারাপ লাগছে,, তাহলে তার বোনুর কেমন লাগছে? সৌম্য দৃষ্টি ঘুরিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল, সন্ধ্যার দৃষ্টি দরজার পানে, দু’চোখ থেকে অনবরত ঝরঝর করে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ছে। সৌম্য’র ভীষণ অসহায় লাগলো নিজেকে। আকাশ তো কারো কথা-ই শুনছে না। এক শব্দ উচ্চারণ করতে দিচ্ছে না। কিভাবে মানাবে আকাশকে?
সন্ধ্যা তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। সৌম্য-ও তাকায় তার বোনুর দিকে। দু’হাতে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– কাঁদিস না বোনু। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আকাশ সন্ধ্যার কেবিন থেকে বেরিয়ে গটগট পায়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে নিয়াজ আকাশের সামনে এসে বলে,
– আকাশ প্লিজ! রিং টা পরাতে দাও। প্রমিস, তোমাকে আজকেই ছেড়ে দিব।
আকাশ চোখমুখ শ’ক্ত করে তাকায় নিয়াজের দিকে। আসমানী নওয়ান আকাশের হাত ধরে বলে,
– আব্বা এমন কইর না। তোমার এই অসুখ হইব আমি বুঝিনাই। জেদ কইর না।
আকাশ তার হাত মায়ের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– জেদ আমি না, তোমরা করেছ। জেদ করে তোমাদের মেয়ের অপারেশন করিয়েছ, যেখানে ওর নিঃশ্বাস থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। করেছ ভালো কথা। এবার গিয়ে তোমাদের মেয়ের কণ্ঠ শোনো। আমার কাছে কি? সবাই আমার থেকে দূরে থাকবে।

কথাটা বলে আকাশ দু’জনের পাশ কাটিয়ে হসপিটালের বাইরে চলে যায়। আসমানী নওয়ান ঝাপসা চোখে ছেলের প্রস্থান দেখলেন। তার ছেলে রা’গ করে, অনেক রিয়েক্ট করে। একটুপর ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু এবার তো অদ্ভুদ বিহেভ করছে। এখন সে কি করবে?
নিয়াজ অসহায় চোখে চেয়ে রইল আকাশের প্রস্থানের পানে। নিয়াজের পাশে এক আধবয়স্ক সিনিয়র ডক্টর এসে নিয়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
– শুনেছিলাম আকাশ তোমার শ’ত্রু।
নিয়াজ তার সিনিয়র ডক্টেরর দিকে চেয়ে বলে,
– জ্বি স্যার!
ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে বলে,

– মনে হচ্ছে ডিজিটাল যুগের সাথে শ’ত্রুরাও ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। এখন শ’ত্রুরা-ই শ’ত্রুর ভালো চায়।
ভদ্রলোকটির কথায় নিয়াজ থতমত খেয়ে তাকায়। সিনিয়র ডক্টর মৃদু হেসে বলে,
– চিন্তা কর না। তোমার শ’ত্রুকে এখন রিং না পরালেও তেমন প্রবলেম হবেনা। তবে সামনে যখন-ই ঝামেলা মিটবে, পরিয়ে নিও।
ডক্টরের কথায় নিয়াজ আর আসমানী নওয়ান সহ সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে আসমানী নওয়ানের মন মানে না। মায়ের মন একটুতেই অস্থির হয়। সেখানে আকাশের তেমন ছোটোখাটো ব্যাপার নয়।

সন্ধ্যা সেই তখন থেকে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আকাশ যে বলল, আর ফিরবেনা। সন্ধ্যার মাথায় বারবার শুধু এটাই ঘুরছে। আর দু’চোখ বেয়ে অনবরত নোনাজল গড়াচ্ছে।
ডক্টর বলেছে, আজ যেন সন্ধ্যা কথা না বলে। আগামীকাল থেকে ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে পারবে। কিন্তু সন্ধ্যার ডক্টরের কথা মানলো না। সে সৌম্য’র দিকে চেয়ে অস্পষ্ট-ক্ষীণ স্বরে ডাকে,
– সৌম্য ভাইয়া?

হঠাৎ সন্ধ্যার কণ্ঠে সৌম্য তার আদরের বোনুর ডাক শুনে সৌম্য স্তব্ধ চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল। আজ কতবছর পর এই ডাক শুনলো সে! সন্ধ্যার কণ্ঠে পরিবর্তন এসেছে। তবে কণ্ঠস্বর ভীষণ চিকন। কি ভীষণ মিষ্টি শোনালো তার বোনুর কণ্ঠ। শেষ কতবছর আগে এতোটা শান্তি পেয়েছে সৌম্য’র মনে পড়ে না। চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমতে শুরু করেছে। বুক ভরে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, সে যুগ যুগ ধরে কোনো এক কারণে তৃষ্ণার্ত ছিল, যে তৃষ্ণা আজ তৃপ্তির সাথে মিটে গেল। সৌম্য দু’হাতে সন্ধ্যার গাল আগলে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– আরেকবার ডাক বোনু।
সন্ধ্যা নাক টেনে আবার-ও ক্ষীণ স্বরে ডাকে,
– সৌম্য ভাইয়া?

সৌম্য’র ডান চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা দেখল তার ভাইয়ের একফোঁটা পানি। তার চোখ থেকেও পানি গড়ায়। সৌম্য সন্ধ্যার মাথা তার বুকে চেপে সন্ধ্যার মাথায় একটা চুমু খেয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– আমি এতো খুশি কখনো হইনি। তুই আমার খুব আদরের বোনু।
সন্ধ্যা দু’হাতে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সৌম্য ভাইয়া ডাকতে সে কত প্রহর গুনেছে শুধু সেই জানে। কতরাত কেঁদেছে। আজ সেই দিন আল্লাহ তাকে এনে দিয়েছে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সে তো আকাশকে তার কণ্ঠ শোনাতে পারল না। কবে পারবে? কবে আকাশকে ডাকবে, আকাশ-ও তার ডাকে সাড়া দিবে। কবে আসবে সেই দিন? আকাশ যে চলে গেল। কথাগুলো ভেবে সন্ধ্যার ফোঁপানি বাড়ে।
সন্ধ্যা মাথা উঁচু করে কান্নামাখা মুখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আস্তে করে বলে,
– উনি কি আমার ডাক শুনবে না সৌম্য ভাইয়া?
সৌম্য সন্ধ্যার গালে গড়ানো চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– শুনবে বোনু। আকাশ ভাইয়াকে একটু টাইম দে।

আকাশ হসপিটাল থেকে সোজা শপিংমলে এসেছে। সাথে বায়ান আছে। সে বুঝতে পারছে না আকাশ কি করতে চাইছে। সে শুধু আকাশের পিছু পিছু আসছে। আকাশ যেখানে যেতে বলছে, গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে যদি জানতো, সে সন্ধ্যার অপারেশনের কথা বললে আকাশ এতো ঝামেলা করবে, তাহলে সে বলত না। বেচারা আকাশকে বলে নিজেই বেকুব বনে গিয়েছে। তার ভাবনার মাঝেই আকাশ ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বায়ানের দৃষ্টি আকাশের উপর পড়লে বায়ান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। কারণ আকাশের পরনে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট এমনকি জুতোটা-ও কালো।
আগে আকাশকে সবরকম পোষাকেই দেখা যেত। কিন্তু গত প্রায় দেড় বছরে আকাশকে সাদা ছাড়া অন্য কোনো কালারের একটা সুতা-ও পরতে দেখেনি। আর সবসময় পাঞ্জাবি পরতে দেখেছে।
আর আজ হঠাৎ পুরো কালো ড্রেসে নিজেকে মুড়িয়েছে।
বায়ানের অবাকের রেশ কাটে না। আকাশের হাতে বেশ অনেকগুলো শপিংব্যাগ। যেগুলো নিয়ে আকাশ শপিংমল থেকে বেরিয়ে যায় সাথে বায়ানকে যেতে বলে।

শপিংমল থেকে আকাশ তার বাড়িতে আসে। তার রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম লাগেজ বের করে। তার শপিং করে আনা প্রতি শার্ট, প্যান্ট সব লাগেজে ভরে নেয়। সব শার্ট-প্যান্ট কালো রঙের।
এরপর আকাশ কাভার্ড এর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গত দেড়বছরে কেনা যতগুলো সাদা পাঞ্জাবি, সাদা প্যান্ট, সাদা টি-শার্ট, সাদা শার্ট এমনকি সন্ধ্যার জন্য কেনা যতগুলো সাদা শাড়ি, সাদা জামা কিনেছিল সব একে একে বের করে। এরপর কাপড়গুলো দু-হাতে ভরে দোতলা থেকে নিচতলায় ফেলে দেয়।
নিচতলায় ডায়নিং-এ বসা বায়ান হতভম্ব চোখে তাকায়। একবার নিচে ফেলে দেয়া এতোগুলো কাপড়ের স্তূপ এর দিকে তাকায়, তো আরেকবার আকাশের দিকে।
আকাশ কাপড়গুলো ফেলে দু’হাতে রেলিঙ আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়ায়। যেমন রা’গ লাগছে তেমনি ক’ষ্ট হচ্ছে। চোখ বুজে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে কয়েকবার। এরপর বাড়ির দু’জন কাজের লোকদের উদ্দেশ্যে গমগমে স্বরে বলে,

– এই কাপড়গুলো এখান থেকে এক্ষুনি সরাও। এর মধ্যে একটা কাপড়-ও যেন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না থাকে। বুঝতে পেরেছ?
কাজের লোক দু’টো আকাশের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আকাশ তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রে’গে বলে,
– এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। বাংলা বোঝো না?
আকাশের রাগী স্বরে একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে দ্রুত তাদের কাজে লেগে পড়ে।
বায়ান ঢোক গিলছে বারবার। সে ঠিক বুঝতে পারছে না। এই কাপড়ের সাথে সন্ধ্যার কি কোনো কানেকশন আছে? এজন্য আকাশ এরকম করছে? বায়ান জানেনা। তবে আন্দাজ করল। আকাশের হঠাৎ সাদা থেকে কালোতে নেমে আসা, পাঞ্জাবি থেকে শার্টে নেমে আসা। ব্যাপারটি তো তাই বলে।
আকাশ তার ঘরে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলে,
– বায়ান গাড়ি বের কর।
বায়ান আকাশের কথা মেনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
আকাশ তার ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় সব লাগেজে ভরে নেয়। এরপর লাগেজ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর আকাশের ফোন। যাতে একটু পর পর আলো জ্বলে উঠছে। বায়ান গাড়ি চালায় আর একটু পর পর আকাশের ফোনের দিকে তাকায়। কেউ অনবরত কল দিচ্ছে, বায়ান বুঝেছে। কিন্তু সে কি করবে। আকাশ কল দেখেও ফোন রেখে দিয়েছে অর্থাৎ আকাশ ইচ্ছে করে কল ধরছে না।
বায়ান আড়চোখে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। বায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷
প্রায় ঘন্টাখানেক গাড়ি ড্রাইভ করার পর বায়ান এয়ারপোর্টে এনে গাড়ি থামায়। আকাশ ড্যাশবোর্ডের উপর থেকে ফোন নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। ফোন চেক করলে দেখল, উপরে উঠে আছে ৩০০ টি মিসড্ কল। প্রতিটি কল সন্ধ্যার নাম্বার থেকে এসেছে। আকাশের চোখেমুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে ফোন থেকে সিম খুলে, সিমটি দু’খন্ড করে রাস্তায় ফেলে দেয়। এরপর ফোন প্যান্টের পকেটে রাখে।
বায়ান গাড়ির ডিকি থেকে লাগেজ এনে আকাশের সামনে দাঁড়িয়েছে। আকাশের সিম ভেঙে ফেলা দেখে বায়ান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। কে যে এতোক্ষণ কল দিল। আর আকাশ কল রিসিভ করা তো দূর, সিমটাই ভেঙে দিল?
আকাশ বায়ানের দিকে চেয়ে বলে,

– লাগেজ দাও।
বায়ান এগিয়ে এসে আকাশের দিকে লাগেজ বাড়িয়ে দিলে আকাশ লাগেজ নেয়। এরপর বলে,
– অফিস সামলে রেখ।
বায়ান ছোট করে বলে,
– জ্বি স্যার।
এরপর প্রশ্ন করে,
– স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
বায়ানের প্রশ্নে আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো বায়ানের দিকে। কিছুই বলল না। উল্টো ঘুরে লাগেজ নিয়ে সিকিউরিটি গেইট এর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলে,
– বাসায় যাও।
বায়ান আকাশের ব্যবহারে অবাক হলো। আকাশকে অনেক বেশি অদ্ভুদ লাগছে।

মাঝরাত,
সন্ধ্যা বেডের উপর দু’হাঁটু জমা করে বসে, নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দেয়। সে আকাশকে শতশত বার কল দিল অথচ আকাশ একবার-ও তো কল রিসিভ করলোই না, উল্টে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। তার দমবন্ধ লাগছে। আকাশ এরকম করলে তার কি করে চলবে? আকাশের ভালোবাসা ছাড়া তার চলে না তো!
আসমানী নওয়ান আকাশকে কলে না পেয়ে বাসায় গিয়েছেন। সন্ধ্যা যেহেতু মোটামুটি সুস্থ, তাই এখানে শুধু সৌম্য আর ইরা আছে। বাকিরা বাড়ি চলে গিয়েছে। সন্ধ্যাকে সেই যে উপুড় হতে দেখেছে ইরা, সৌম্য। এখনো সেভাবেই আছে। দু’জনেই বুঝতে পারছে সন্ধ্যার মনোভাব। আকাশকে এতোবার কল দিয়েছে তাও দেখেছে। সৌম্য’র ভীষণ অসহায় লাগছে। সে আসলে কাকে দোষ দিবে বুঝতে পারছে না। দোষ তো আসলে কারোর-ই নয়। না আকাশের, না তার, না তো তার বোনুর। কিন্তু সবাই একে-অপরের কাছে দোষী হয়ে বসে আছে।
সৌম্য উঠে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার মাথায় হাত দিয়ে বলে,

– আকাশ ভাইয়া চলে আসবে বোনু। তুই এখন ঘুমো। নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবি।
সন্ধ্যা নাক টানলো। মাথা তুলে দু’হাতে চোখমুখ মুছে সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য দেখল, সন্ধ্যা কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সৌম্য অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সন্ধ্যার দিকে। ইরা এগিয়ে এসে বেডের উপর উঠে বসে। এরপর সন্ধ্যাকে নিয়ে জোর খাটিয়ে শুয়ে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যার ভালো লাগলো। ইরা যখন বড় বোনের মতো তাকে এভাবে আগলে নেয়, তখন তার মনে হয়, তার মা তার যত্ন করছে। সন্ধ্যা নিজেও ইরার পেটের উপর হাত দিয়ে চোখ বুজে নেয়।

সৌম্য দু’চোখ ভরে দেখল তার ইরাবতী আর বোনুকে। ইরা সৌম্য’র দিকে তাকালে সৌম্য মৃদু হাসে। ইরা-ও একটু হাসে। ঘরের অপরপাশে পাতা আরেকটি বেড দেখিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।
সৌম্য সম্মতি দেয়। এগিয়ে এসে ইরার কপালে দু’টো চুমু খায়, সাথে সন্ধ্যার কপালে দু’টো চুমু খেয়ে বলে,
– আর কিন্তু কাঁদবি না বোনু।
সন্ধ্যা চোখ বুজে রেখে নিরব সম্মতি দেয়। সৌম্য ঘরের লাইট অফ করে দিলে আবার-ও সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে কাকে বোঝাবে, আকাশকে ছাড়া তার কত ছটফট লাগে। কতটা দমবন্ধ লাগে। আকাশ একবার তাকে জড়িয়ে ধরলে বোধয় এই ছটফটানি কমত! কিন্তু আকাশ যে আর তার ডাকে আসেনা!

বিমান ছেড়েছে ঘণ্টাখানেক হলো। আকাশ বিমানের সিটে বসে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। দু’হাত আড়াআড়িভাবে গুঁজে রাখা। উপর থেকে একদম শান্ত। ভেতরটা ভীষণ ছটফটে। বন্ধ চোখের পর্দায় সন্ধ্যার স্নিগ্ধ, মায়াভরা মুখ। আকাশ হঠাৎ-ই গুনগুনিয়ে গায়,
যতদূরে যাইনা কেন,
থাকবো তোমার পাশে।
যেমন করে শিশির ফোঁটা,
জড়িয়ে থাকে ঘাসে।
ছায়ার মতো থাকবো আমি
ছায়ার মতো থাকবো আমি
শুধু তার পাশে।
যদি বলে সে আমায়
সত্যি ভালোবাসে।
Bahat payar karate Hain, Tumko sanam.

আকাশের পাশের সিটে ২৫ বছরের এক মেয়ে বসা। যে আকাশের গুনগুনিয়ে গাওয়া গানটি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। আকাশ থেমে গেলে মেয়েটি আকাশের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,
– ভাইয়া আপনার গানের গলা ভীষণ সুন্দর!
কথাটি শুনে আকাশ চোখ মেলে ডানদিকে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায়। চোখেমুখে বিরক্তি। মেয়েটি মৃদু হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছে, আকাশ তাকে একটা থ্যাংকস্ দিবে।
কিন্তু কিছু সময় পর-ও যখন আকাশকে গম্ভীর মুখ, সাথে একটু-আধটু রাগী চোখে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখল, তখন মেয়েটি ঢোক গিলল।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৫

আকাশ ঘাড় সোজা করে বা হাতে ডান হাতের শার্ট এর হাতা কনুই থেকে আরও উপরদিকে তোলে।
মেয়েটির আকাশের কান্ড দেখে শুকনো ঢোক গিলল।
শার্টের হাতা গোটাচ্ছে কেন? তাকে মা’রবে না তো! কথাটা ভেবে মেয়েটি তার সিটে একটু সিটিয়ে বসল। ভাবলো এই লোক বোধয় প্রশংসা নিতে পারে না। অতঃপর মেয়েটি আমতা আমতা করে বলে,
– স্যরি ভাইয়া! আমার বলতে মিস্টেক হয়েছে। আসলে আপনার গানের গলা ভীষণ জ’ঘ’ণ্য!

অন্তঃদহন পর্ব ৪৭