সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৮
জাওয়াদ জামী
” নিহান, তুই হঠাৎ করে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা ভাবছিস কেন? তোর মামা-মামীরা প্রথম থেকেই চাইতেন তুই যেন দৃষ্টিকে নিয়ে এখানেই থাকিস। তুই কি তাদের সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করছিস? ” নিয়াজ মাহমুদ ছেলের কাছে জানতে চাইলেন। নিহানের নতুন ফ্ল্যাটে উঠার কথা শুনে তিনি বেশ চমকেছেন। তাই তিনি নিহানকে আড়ালে ডেকে কথাগুলো জিজ্ঞেস করলেন।
” আমি কাউকে অপমান কিংবা অসম্মান করার জন্য সিদ্ধান্তটা নেইনি, আব্বু। আমি জানি এই বাড়ির মানুষগুলোর মনমানসিকতা কেমন। এখানে থাকলে তারা আমাদের মাথায় তুলে রাখবে। কিন্তু আমি সর্বপ্রথমে তোমার সম্মানটাই দেখব, আব্বু। আমি দৃষ্টিকে নিয়ে এখানে দিনের পর দিন থাকতে গিয়ে তোমাকে সবার সামনে ছোট করতে চাইনা। আর সেকারণেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি। ” নিহান একদিক থেকে সত্য কথাই বলেছে। ও যদি সেদিন মামা-মামীদের সামনে এই কথাগুলো বলত, তবে তারা কষ্ট পেতেন। নিহান তাদেরকে কষ্ট দিতে চায়নি। তাই সেদিন শুধু মায়ের কারনটাই তুলে ধরেছিল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছেলের কথা শুনে হাসলেন নিয়াজ মাহমুদ। নিহানের নতুন ফ্ল্যাটে উঠার কথা শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি সবসময়ই চান নিহান আর দৃষ্টির সুখের সংসার হোক। যেটা রাখীর কাছে থাকলে সম্ভব নয়। কিন্তু তার ভেতরটা খচখচ করছিল। সেকারণেই তিনি নিহানকে কথাগুলো জিজ্ঞেস করেছিলেন।
” কবে নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করতে চাচ্ছিস? কেনাকাটাও তো করতো হবে। এক কাজ কর দৃষ্টিকে বল লিষ্ট করতে। আমি টাকা দিলেই যেন ও কেনাকাটা শুরু করে দেয়। ”
” আব্বু , কুহু যেই ফ্ল্যাটে থাকত, সেখানেই উঠতে চাচ্ছি। ঐখানে তো চলার মত ফার্নিচারসহ সবকিছুই আছে। তাই নতুনভাবে কেনাকাটা করতে হবেনা। পরে যদি কোনকিছুর প্রয়োজন হয়, তবে কিনে নেব। আগামীকাল চাকরিতে জয়েন করব। প্রথমদিন এখান থেকেই অফিস করব। কালকের পরদিন আমি অফিসে যাওয়ার পর তোমরা দৃষ্টিকে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে যেও। ”
” তোমার সিদ্ধান্তকে সব সময়ই সম্মান জানিয়ে এসেছি। আজও তার ব্যাতিক্রম হবেনা। তোমার বড় মামীর সঙ্গে কথা বলব আমি। ”
” একটা কথা বলব? ”
” বল। ”
” তুমি এই তিনদিনের মধ্যেই কেমন পাল্টে গেছ। সব সময় মুখ ভার করে থাক। আমার সঙ্গেও ঠিকমত কথা বলোনা। আগের মত হাসোনা। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছনা। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগেনা। ”
দৃষ্টি, নিহান দাঁড়িয়ে আছে বেলকনিতে। এক ফালি চাঁদের আলো এসে ছুঁইয়ে দিয়েছে দু’জনের অঙ্গ। যেন আলোর বন্যায় স্নান করছে একজোড়া কপোত-কপোতী।
দৃষ্টির কথা শুনে ওর দিকে তাকায় নিহান। চাঁদের আলো শরীরে এসে পরায় মেয়েটাকে কি অপূর্বই না লাগছে। নিহান যখন ভাবে, এই মেয়েটা ওর ‘জীবনসঙ্গীনী ‘ তখন কোন এক অজানা আবেশে ছেয়ে যায় ওর মন। এই মুহূর্তেও ঠিক সেই অনুভূতিই হচ্ছে নিহানের। সে একটু হেসে দৃষ্টিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। মলিন হেসে বলল,
” হাসার মত পরিস্থিতিতে আমাকে রেখেছে আম্মু? তুইই বল? সন্তান হয়ে নিজের মায়ের মুখে ঐ ধরনের কথা শুনে সেদিন আমার কেমন লেগেছিল ভাবতে পারিস তুই? মরে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। ”
” এমন কথা বলোনা। তোমার কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচব তুমিই বল? আর কক্ষোনো এমন অলুক্ষুনে কথা বলবেনা। দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বড়মা একদিন ঠিকই নিজেকে বদলাবে। ” নিহানের শেষের কথা শুনে দৃষ্টির ভেতরটা কেঁপে উঠল। ও কাঁপা কাঁপা গলায় নিহানকে ধমকে দিল।
” সেই একদিন কবে আসবে সেটা আমার জানা নেই। তবে কখনো যদি সেইদিন আসেও তবে অতীতে বলা আম্মুর কথাগুলো আমি কোনদিনই ভুলতে পারবনা। আর তাকে কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারবনা আমি। ” দৃঢ় শোনালো নিহানের গলা।
” তুমি কি পাগল হয়ে গেছ! নিজের মা সম্পর্কে কেউ এই ধরনের কথা বলে? যতই অন্যায় করুক, বড়মা তোমার মা। তাকে আমার সামনে ছোট করতে পারোনা তুমি। সে আমার সঙ্গে যেমন আচরণ করুক না কেন, তোমাদেরকে সে আর পাঁচটা মায়ের মতই ভালোবাসে। তোমাদেরকে সুখী দেখতে চায় সে। আর সেজন্যই সব সময় চাইত তোমাকে ভালো পরিবার দেখে বিয়ে করাবে। এতটুকু চাওয়া কি অন্যায়? ”
নিহান কপাল কুঁচকে তাকাল দৃষ্টির দিকে। এই মুহূর্তে দৃষ্টিকে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারতে পারলে ওর ভালো লাগত। দৃষ্টির কথাগুলো ওর শরীরে কাঁটার মত বিঁধছে।
” আর একটাও কথা বললে থাপড়ে তোর দাঁত খুলে ফেলব আমি। কোন পরিস্থিতিতে আমি তোর আদরের বড়মার ওপর রেগে গেছি সেই ধারনা তোর আছে? আমি এখানে তোর সঙ্গে আলোচনা করছি। তুই আমার স্ত্রী। তোর সঙ্গে ভালোমন্দ আলোচনা করতেই পারি। তাই বলে তোর সামনে তাকে আমি ছোট করলাম! তিনদিন ধরে তার কান্নাকাটি দেখে তাকে সাধু বলেই ধরে নিয়েছিস? এগুলো তার অভিনয়। তোর বড়মাকে আমার থেকে ভালো কেউই চেনেনা। দাদা-দাদীমার সঙ্গে তার করা আচরণগুলো আমি ভুলে যাইনি। মা হিসেবে সে আমাকে ভালো পরিবারে বিয়ে করাতে চেয়েছে ঠিক আছে। তুই এবার আমাকে বল , তোর পরিবার কি খারাপ? তোর, আমার পরিবার এক, বংশ এক তবে কেন তোর প্রতি তার এত ক্ষোভ? শোন দৃষ্টি, আমার আম্মু সব সময়ই টাকাওয়ালা পরিবারে বিয়ে দিতে চেয়েছে। ভালো কোন পরিবারের মেয়েকে সে পুত্রবধূ হিসেবে চায়নি। সে শুধু ধনীর দুলালী খুঁজেছে। আমার সুখ তার কাছে মূখ্য বিষয় ছিলনা। সে আমাকে ধনী পরিবারে বিয়ে করিয়ে তার সোসাইটি মেইনটেইন করতে চেয়েছিল। তাই যেটা জানিসনা সেটা নিয়ে কথা বলতে আসিস না। ”
” তবে কি তুমি কোনদিনও বড়মাকে ক্ষমা করবেনা? ” নিহানের ধমক খেয়ে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি।
” সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। এবার গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে। কালকেই ঐ ফ্ল্যাটে চলে যাস। মামীরা কে কে যাবে জানিস? ”
” যেতেই হবে ঐ ফ্ল্যাটে? না গেলে হয়না? ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি।
” তোর মন চাইলে এখানেও থাকতে পারিস, আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়েও থাকতে পারিস। আমি বাঁধা দেবোনা। তবে আমি ঐ ফ্ল্যাটেই উঠব। এবং সেখানেই থাকব। ভবিষ্যতে কোনদিনও এই বাড়িতে কিংবা তোর শ্বশুর বাড়িতে যাবোনা। স্বামী ছাড়াই তোকে সংসার করতে হবে। ” কঠোর গলায় বলল নিহান।
নিহানের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দৃষ্টি নিহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে গেল। রুমে গিয়ে জোরে জোরে বলতে শুরু করল,
” থাক বাবা অন্য কোথাও গিয়ে কাজ নেই। স্বামী ছাড়া আবার সংসার করা যায় নাকি! দৃষ্টি রে, তোর কপাল খারাপ বুঝলি? নয়তো এমন খাটাশের মত স্বামী জোটে তোর কপালে? বিয়ের আগে কত ভালোবাসা দেখিয়েছে! চিরকুটে কত ঢংয়ের কথা লিখত! চিরকুটগুলো পড়লে মনে হত, সে বুঝি ভালোবাসার গোডাউন। সেই গোডাউন থেকে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুই বেড়োবেনা। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। সে আদতেই একটা করলার গোডাউন। সেজন্যই আজ তার মুখ দিয়ে শুধু তেতো কথা ডেলিভারি হচ্ছে। এই ছিল আমার কপালে! ”
দৃষ্টির কথাগুলো শুনে নিহানের হাসি পেলো। ওর বউটার যে অভিমান হয়েছে সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। মেয়েটা ওর কাজ বাড়িয়ে দিল। এখন আবার তার অভিমান ভাঙাতে হবে, তার মনোকাশ থেকে মন খারাপের মেঘেদের ছুটি দিতে হবে, তার মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কত কাজ নিহানের। সে হাসিমুখে রুমে ঢুকল। দৃষ্টি তখনো বকবক করছে আর কাপড় গোছাচ্ছে। নিহান গিয়ে দৃষ্টিকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। দৃষ্টিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ওর কোমল রাঙা ঠোঁটে নিজের পুরুষ্টু ঠোঁট ডোবাল।
” দৃষ্টি, মন দিয়ে শোন, তোরা যে এখান থেকে চলে যাচ্ছিস, এটা নিয়ে চাচা কিছু একটা সন্দেহ করছে। তোকে যদি চাচা কিছু জিজ্ঞেস করে কক্ষণোই বড়মার কথা বলবিনা। মামী যেগুলো শিখিয়ে দিয়েছে সেগুলোই বলবি। আর নিহান ভাইয়া রেগে আছে সেজন্যই বড়মার কথা শুনতে পারছেনা। এখনই বড়মার বিষয়ে কোন কথা ভাইয়াকে বলতে যাবিনা। কিছুদিন যাক, যখন দেখবি ভাইয়ার রাগ কমেছে তখন বড়মাকে নিয়ে কথা বলবি। চেষ্টা করবি বড়মার সঙ্গে ভাইয়াকে মিলিয়ে দিতে। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি, একজন মা কখনোই খারাপ হয়না। তারা সর্বদাই সন্তানের সুখের চিন্তা করে।
তাই মাঝেমধ্যে তারা একটুআধটু ভুল করে। আর সকল ভুলই যে ক্ষমার অযোগ্য এমনটাও কিন্তু নয়। তুই কখনোই ভাইয়ার সামনে বড়মার সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বলবিনা। নিজেও বড়মাকে সম্মান করবি, আবার অন্যের সামনে তার সুনাম করবি। সুখ কিন্তু সহজপ্রাপ্য নয়। সুখ পেতে চাইলে ত্যাগ আর ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। তোকে ধৈর্য ধরতে শিখতে হবে। সব সময় মায়ের কথা মনে করবি। চিন্তা করবি, মা কেমন ছিল, কিভাবে সংসার করেছে, সকলের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে। দেখবি সুখ তুই পাবি। ” কুহুর কথাগুলো শুনে দৃষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আজ সকাল থেকেই ওর মাকে মনে পরছে। মা বেঁচে থাকলে হয়তো ওদের এতটাও অপদস্ত হতে হতোনা। এই বয়সেই সমাজের কঠিন রূপ দেখতে হতোনা।
দৃষ্টিকে কাঁদতে দেখে কুহু ওকে জড়িয়ে ধরল। দৃষ্টিকে দেয়ার মত কোন শান্তনা বানী ওর জানা নেই। তাই কুহুও কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। ওরা দু’জনের কেউই লক্ষ্য করেনি তাহমিনা আক্তার এতক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলেন। ওদেরকে কাঁদতে দেখে তাহমিনা আক্তারেরও চোখে পানি আসলো। তিনি আঁচলে চোখ মুছে ভেতরে ঢুকলেন।
” কি হচ্ছে এখানে? এত কান্নাকাটি কিসের? দু’জনের চোখের পানিতে রাশেদীন বাড়িতে বন্যা দেখা দিয়েছে সেটা কি তোরা দেখতে পাসনি? ”
তাহমিনা আক্তারের গলা পেয়ে দৃষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছল কুহু। দৃষ্টিও চোখ মুছে তাকাল মামীর দিকে। দুবোন কেউ কিছুই বললনা। ওদেরকে চুপচাপ থাকতে দেখে তাহমিনা আক্তার বললেন,
” আমি সব সময় ছেলেদের জন্য একটা সহজ-সরল বউ চেয়েছি। চেয়েছি , এই সংসার যেন তারা আগলে রাখে। সবাইকে নিয়ে থাকে। বড় ছেলে তো আমার চাওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছে। সে ভালো থাকুক। তবে আমি তাহমিদকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। ভয়ও ছিল আমার। যদি সে-ও বড় ভাইয়ের পথেই হাঁটে? কিন্তু না। আমার ছেলেটা ওর বড় ভাইয়ের মত বেইমান হয়নি। আমার চাওয়া সে পূরণ করেছে। আমি শুধু সহজ-সরল, সংসারী বউ খুঁজেছি। কিন্তু তাহমিদ আমাকে খাঁটি সোনার টুকরা উপহার দিয়েছে। আজকে আমি নিশ্চিত, এই সংসারে ভাঙ্গন আসবেনা কোনদিন। আমার ছোট ছেলের বউ কোনকিছু ভাঙতে জানেনা। সে গড়তে জানে। সে সবকিছু গড়ায় বিশ্বাসী। ” তাহমিনা আক্তার আনন্দে কেঁদে ফেললেন। তিনি চুমু দিলেন কুহুর কপালে।
” এমনিতেই কি বলি, আমার কপাল মন্দ? শ্বাশুড়ির ভালোবাসা আমার কোনদিনও পাওয়া হবেনা বোধকরি। সারাজীবন বোন আর বোনের শ্বাশুড়ির মধ্যেকার মধুর সম্পর্ক দেখেই কাটাতে হবে। ” কৃত্রিম আফসোস নিয়ে বলল দৃষ্টি।
দৃষ্টির কথা শুনে হেসে ওকেও চুমু দিলেন তাহমিনা আক্তার। হাসতে হাসতে বললেন,
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৩৭
” পাজি মেয়ে, শ্বাশুড়ি ভালোবাসেনা তো কি হয়েছে? আমরা আছি কি করতে? অবশ্য তোর শ্বাশুড়িও পথে আসতে শুরু করেছে। কয়েকটা মাস অপেক্ষা কর, দেখবি তোর শ্বাশুড়িও তোকে মাথায় তুলে রাখবে। এবার তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। আমরা তোর নতুন সংসারে তোকে পৌঁছে দেব। সবাই তৈরী হয়ে তোর অপেক্ষাই করছে। ”
” আমরাও রেডি। ”
” তবে রাখীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আয়। ”
মেজো মামীর কথা শুনে দৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে রাখী আক্তারের কাছে গেল।