তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩২

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩২
অহনা আক্তার

মায়ের সাথে ফোন কলে কথা বলে অঝোরে কাঁদছে মুসকান। তার আব্বার কথা আজকে বড্ড মনে পরছে। আজ তার আব্বা থাকলে মেয়ের এতো ভালো রেজাল্ট শুনে যে কি খুশি হতো সেটা বলে বলে মা, মেয়ে আফসোস করছে। তার আব্বার হায়াত টা আল্লাহ আর একটু দীর্ঘ করলে কি এমন হতো। রাহিলা ফোনে মেয়েকে অভিনন্দন জানিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, বুঝিয়ে শুনিয়ে কল রেখে দিলেন। মায়ের কল রেখে দেওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদল মুসকান। ফারিশ, জহির তালুকদার কেউ ই বাড়ি নেই। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করেই নিজস্ব কাজে চলে গিয়েছে। ফিরবে রাতে। তাজমহলের ডাকে চৈতন্যে ফিরে মুসকান। চোখের পানি মুছে হাসি মুখে শাশুড়ীর ডাকে সারা দেয়। তাজমহল মুসকানের সামনে এসে রাশভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— খাবার সময় কি এখনো হয়নি? আর কতোক্ষণ ওই গর্দভটার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে?
— আমি ফাইজা কে আরেকবার ডাক দিয়ে দেখছি বড়চাচি দরজা খোলে কিনা। ওকে ছাড়া একা একা খেতে ভালো লাগবে না !
— ওহ খেলে খাবে না খেলে নেই। তুমি আসো। সকাল থেকে কিছু খাওনি। তোমার খাওয়া জরুরী। আমার ছেলে বারবার বলে গিয়েছে তুমি যেন ক্ষুধার্ত না থাকো।
— আমি খাব বড়চাচি। ফাইজাকে সাথে নিয়েই খাব। আপনি চিন্তা করবেন না। অনেকক্ষণ তো হয়েছে ফাইজা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। এখন নিশ্চয়ই খুলবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ঠিক আছে দেখো পারো কিনা। ওর পছন্দের কাচ্চি অর্ডার করে গেছে ফারিশ। ডেলিভারি ম্যান এলো বলে। বোনের জন্যতো পারেনা পুরো দোকানটা তুলে নিয়ে আসে । এমন একটা রেজাল্ট করেছে তবু্ও কিছু বলেনি এইছেলে। উল্টো বোনের পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে গেছে। এতো আদর দিয়েই এটাকে এমন মাথায় উঠিয়েছে। দুটো কথা বলেছি কিনা কেঁদে ভাসিয়ে এখন দরজা বন্ধ করে রেখেছে। যত্তসব ঢং..
মুসকান কিছু বলল না। চুপচাপ নিরব দর্শকের মতো শুনে গেলো শাশুড়ীর কথাগুলো। তাজমহল মুসকান কে এসব বলে নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

খাবার হাতে নিয়ে কখন থেকে ফাইজার ঘরের দরজায় নক করে যাচ্ছে মুসকান। খাটের উপর হাঁটু ভাজ করে বসে ফ্যাচ’ফ্যাচ করে কাঁদছিল ফাইজা। মুসকানের গলা শুনে উচ্চস্বরে বলল,
— আমি এখন খাব না ভাবি। তুমি চলে যাও।
— খাও বা না খাও দরজা খুলো রুমের।
ফাইজা চেচিয়ে বলল,
— খুলবো না আমি দরজা।
— আমি আর কতোক্ষণ রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো?
— তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে?
— ফাইজা আমিও কিন্তু তোমার জন্য এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি। তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাব না। আর আমি না খেলে তোমার ভাতিজা ভাতিজীও না খেয়ে থাকবে। তুমি কি চাও ওরা তোমার জন্য ক্ষুধার্ত থাকুক?
ফাইজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফট করে দরজা খোলে দিল,

— আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল কেন করছো ভাবি? আমার খিদে নেই…
মুসকান খাবার নিয়ে অতি সাবধানে ফাইজার রুমে ঢুকলো। হাতের ট্রে টা আস্তে করে ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে ফাইজার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো,
— কি অবস্থা করেছো নিজের? চোখ মুখ ফুলিয়ে গাজী ট্যাঁক বানিয়ে ফেলেছো। তোমার বয়সী মেয়েরা এইরকম থাকে?
— আমার কিছু ভালো লাগছে না ভাবি। তুমি চলে যাও।
মুসকান ফাইজাকে টেনে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসালো। নিজেও ফাইজার পেছনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল,

— দেখো তো কেমন বনবেড়ালের মতো দেখতে লাগছে তোমাকে। চুল মনে হচ্ছে কাকের বাসা। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মাত্র হাডুডু খেলে ফিরেছো। কাঁদলে একদমই সুন্দর লাগে না তোমাকে ফাইজা..
ফাইজা গম্ভীর হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। তার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু কান্না পাচ্ছে। কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সাথের বান্ধবীরা সাবাই এ প্লাস পেয়েছে শুধু সে ছাড়া। এটা ভাবতেই শরীর মন সব বিষিয়ে উঠছে। এমন তিক্ত অনুভূতির সম্মুখীন এই প্রথমবার হয়েছে সে। রাগে জিদ্দে মাথার সমস্ত চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
মুসকান ফাইজার চোখ মুখ নিজের ওড়না দিয়ে ভালোভাবে মুছে দিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি নিয়ে ফাইজার মাথা আঁচড়ে দিতে দিতে বলল,

— আমার যখন জেএসসি রেজাল্ট খুব খারাপ হয় তখন আমিও তোমার মতো দরজা বন্ধ করে নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে সারারাত কেঁদেছিলাম। আব্বা ওইদিন বাড়ি ছিলো না। পরদিন সকালে এসে আম্মার কাছ থেকে আমার কথা শুনা মাত্রই ছুটে আসেন আমার ঘরে। আমাকে বুঝান। বলেন, ” একটা রেজাল্ট কখনোই কারো জীবন নির্ধারন করে না। অনেক বিখ্যাত মানুষ আছেন যারা খারাপ রেজাল্ট করেও জীবনে ভালো কিছু করেছেন। আমাদের তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হতে হবে। জীবনে ভালো কিছু করতে হলে আগে তার পিছনে পরিশ্রম করতে হবে। প্রত্যাশা রাখতে হবে। আজ তোমার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে এই বলে ভেঙে পরা চলবে না। এটা থেকে শিক্ষা পেয়ে ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে হবে। তাহলেই জীবনে সফলতা আসবে। সবাই যদি ভালোই করে তাহলে খারাপ করবে কে? খারাপ না থাকলে আমরা বুঝবো কি করে ভালোর কদর কতটা? আজ আমি খারাপ রেজাল্ট করেছি কাল আমি ভালো করে দেখিয়ে দিবো। মনের ভিতর এই আগ্রহটা নিয়েই পরবর্তী পথ অনুসরণ করতে হবে। তাহলে সফলতা অবশ্যই আসবে। জীবনে কোনো পরিস্থিতিতেই ভেঙে পরা চলবে না। ”

আব্বার কথাগুলো শুনে আমি আর কাঁদিনি। যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে। পরবর্তীতে ভালো করতে হবে এটা ভেবে সামনে আগাচ্ছি। ওইদিনের রেজাল্ট টা খারাপ হওয়ায়ই আমি পড়ালেখায় তীব্র ভাবে মনযোগ দিতে পেরেছি । তুমিও তাই করো ফাইজা। এভাবে ভেঙে পড়ো না। লিখা পড়ায় আরো মনযোগী হও।পরের বার এইচএসসি তে এর থেকেও ভালো করে দেখিয়ে দেও। লেখক— খাংগাল হুয়েরিট বলেছেন, পরীক্ষা হলো দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু যখন তুমি এর জন্য পরিশ্রম করবে তার ফলাফলটা তোমার সামনে রূপকথার মতোই মনে হবে।
তাই এভাবে কান্নাকাটি বাদ দিয়ে স্ট্রং হও। এর পরের ফলাফলটা তুমি রূপকথার মতো করে সবাইকে দেখিয়ে দাও।
কথাগুলো শেষ করে বড় একটা শ্বাস ছেড়ে ফাইজার চুল থেকে হাত সরিয়ে ফেলল মুসকান। মাথা বাঁধা শেষ। ফাইজা এতোক্ষণ বেশ মনযোগ দিয়ে শুনলো মুসকানের কথাগুলো। মুগ্ধ হয়ে বলল,

— তুমি কতটা সুন্দর করে বুঝালে আমায় ভাবি। আমার এখন সত্যিই আরো ভালো করে পড়াশোনায় মনযোগ দিতে ইচ্ছে করছে। সবাইকে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। তুমি খুব বুঝদার ভাবি। সবকিছু কতো সুন্দর করে বুঝে যাও । সব সমস্যার সমাধান করে ফেলো। আমার মধ্যে এখনো যে বুঝ জ্ঞানটা আসেনি সেটা তোমার মধ্যে কতো জলদি চলে এসেছে। অথচ আমি আর তুমি কিন্তু একই বয়সের। কিভাবে পারো ভাবি সবকিছু এতো সুন্দর করে হ্যান্ডেল করতে?
মুসকান মুচকি হাসে,

— সবকিছুই হয়েছে অবস্থান আর দায়িত্বের কারণে । আমার অবস্থানের মতো যদি তোমার অবস্থান হতো তাহলে হয়তো তুমিও খুব দ্রুত সব বুঝে যেতে। অবুঝ ছিলাম আমিও। আব্বার আদরের দুলালি ছিলাম। কিন্তু দিন শেষে দেখো আমাকেও এই বয়সে সংসার সামলাতে হচ্ছে। বাচ্চা জন্ম দিতে হচ্ছে। প্রথমে সবার উপর আমার রাগ থাকলেও এখন আর তেমনটা নেই। কারণ আমি তোমার ভাইয়ের মতো একজন হাসবেন্ড পেয়েছি। দাদু আমাকে বেস্ট গিফট দিয়েছে স্বামী হিসেবে তোমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে। সবার সামনে আমি যতোই আন্ডাস্ট্যান্ডিং হইনা কেন তোমার ভাইয়ের সামনে সেটা হতে পারিনা। কেমন যেন বাচ্চা হয়ে যাই। ঘুরেফিরে আমার ছেলেমানুষী, চঞ্চলতা, নির্বুদ্ধিতা তোমার ভাইয়ের সামনে প্রকাশ পাবেই।
— ভাইয়াকে খুব ভালোবাসো তাই না ভাবি?
মুসকান আনমনে বলে উঠে,

— খুবববব।
পরক্ষনে স্তম্ভিত ফিরে খুব লজ্জা পায়। ফাইজা স্মিত হাসে। সে ওতো রিশাদের সাথে খুব বাচ্চাসুলভ আচরণ করে। রিশাদের কথা মনে পরতেই ফাইজার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। মা তো ফোন নিয়ে গেছে। এবার কি ভাবে কথা বলবে। সকাল থেকে এক টুকরোও কথা বলতে পারেনি ছেলেটার সাথে। নিশ্চয়ই ফোন দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে।

— খাবার কি আজকে আর খাবে না? ফেরত নিয়ে যাব? তোমার ফেবারিট রেস্টুরেন্ট থেকে কিন্তু অর্ডার করেছে তোমার ভাইয়া।
মুসকানের কথায় ধ্যান ভাঙে ফাইজার। আবারো রিশাদের খেয়ালে মজে গিয়েছিল সে। মুসকান উষ্ণ নিশ্বাস ছেড়ে হাত ধুয়ে এক লোকমা খাবার ফাইজার মুখের সামনে ধরে। ফাইজা এক চিলতে হেসে মুসকানের হাত থেকে খাবারটা মুখে তুলে নেয়। ফাইজাকে খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে মুসকান বলে,
— বুঝে গেছি আজ আর নিজের হাতে খাবে না। আমাকেই খাইয়ে দিতে হবে।
ফাইজা হাসে,
— বাবা-মা আর ভাইয়া ছাড়া এই প্রথম কারো হাতে খাবার খাচ্ছি আমি।
মুসকানও হাসে। ফাইজাকে খাওয়াতে পেরে শান্তি লাগছে।

মাঝরাতে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফারিশের। মুসকান তখন বেঘোরে ফারিশের বাহুতে ঘুমাচ্ছে। এতো রাতে কে কল করেছে ভেবে শুয়া থেকে উঠার চেষ্টা করল ফারিশ। মুসকানের মাথাটা অতি সাবধানে নিজের বাহু থেকে নামিয়ে বালিশে রাখল। উঠে বসে বিছানা হাতরিয়ে ফোন খোঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। মুসকানের ফোন! এতো রাতে মুসকানের নাম্বারে কে কল করবে! তাও আবার নাম্বার টা সেভ করা নেই। মনেতো হচ্ছে অপরিচিত। হতচকিত হয়ে ফারিশ নিজেই কলটা রিসিভ করল,
— হ্যালো?

পুরুষালি গলা শুনে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি কল কেটে দিল। কি হলো কিছুই বুঝলো না ফারিশ। কেউ ভুলে করে দিয়েছে হয়তো! এটা ভেবে ফোন রেখে মুসকানের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। পাঁচ মিনিট পর আবারো মুসকানের ফোন বেজে উঠল। এবারও একই নাম্বার থেকে। ফারিশ ভ্রু কুঁচকে কল রিসিভ করল। বার দুয়েক হ্যালো বলল। কে, কাকে চাই জিজ্ঞেস করল। কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। ফারিশ বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিল। এর ঠিক আধা ঘণ্টা পর ঘুমে যখন ফারিশের চোখ প্রায় লেগে এসেছে ঠিক তখনই ফোনের তীব্র আওয়াজে আবারো তার ঘুম ছোটে গেল। এবার মুসকানও কিছুটা নড়েচড়ে উঠেছে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে পুনরায় কল রিসিভ করল ফারিশ।রাগান্বিত স্বরে বলল,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩১

— কে ভাই ? মেয়ে না ছেলে নাকি তৃতীয় লিঙ্গ কে?? এতো রাতে কি চাই? ঘুমাতে কেন দিচ্ছিস না? তোর আরেকটা ফোন কলে যদি আমার বউয়ের ঘুম ভেঙেছে…… টুট…টুট…..
ফারিশ বাকিটুকু শেষ করার আগেই অপর পাশের ব্যক্তি কল কেটে দিল। আশ্চর্য! ফারিশও এবার ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল হলে এর তদন্ত শুরু করা যাবে…

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩৩