ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
আরেব্বাস বান্ধবী, দেখ কত বড়ো বাড়ি! এই বাড়ির ভেতর আমাদের দশটা বাড়ি অনায়াসে ফিট হয়ে যাবে।
তৃধা দেখলো, কথাগুলো বলার সময় লাবিবার চোখ দুটো মুগ্ধতায় চকচক করছে।
তৃধা ওর এই হাল দেখে খোঁচা মেরে বলল,
“এতদিন জানতাম তুই শুধু ছেলে ধরা চোখ দিয়ে ছেলে গিলে খাস, বড় বড় বাড়িও যে গিলতে পারিস এটা তো জানতাম না।”
বান্ধবীর ত্যাড়া কথায় সরু চোখে তাকালো লাবিবা। নাক উঁচুতে তুলে বলল,
“তুই কী কোনভাবে আমাকে অপমান করলি?”
তৃধা শিখদার বাড়ির অভ্যন্তরীণ রাজকীয় নকশায় নজর বুলাতে বুলাতে পুনরায় খোঁচা দিয়ে বলল,
“সত্যি কথা সব সময় ঝাঁজালোই লাগে। তবে তুই একটা কথা ঠিকই বলেছিস—এই বাড়িটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।”
২ সেকেন্ডে লাবিবা অপমান ভুলে গেল। বান্ধবীর তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস। বাড়ির ডিজাইনটা কেমন অন্যরকম, রাজকীয় ঢঙে নির্মিত। একটা রয়্যাল রয়্যাল ব্যাপার আছে।”
“হুম।”
লাবিবা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বলে উঠল,
“আচ্ছা, এই বাড়ির আঙ্কেলরা তো তোর আব্বুর ফ্যামিলি ফ্রেন্ড প্লাস বিজনেস পার্টনার, শুনলাম। তাহলে এতো বছরে আগে কখনো তুই এই বাড়িতে আসিসনি?”
লাবিবার বলদি মার্কা প্রশ্নে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো তৃধা।
“তোকে বলদ ডাকলে বেশি খুশি হবি নাকি গাধা?”
এই কথায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো লাবিবা।
“তোর জামাই আফ্রিকান কালা গাধা, শালী! তোর জামাই নাইজেরিয়ান বলদ!” — বলে চ্যাত করে উঠলো।
তৃধা ওর গালাগালির স্কিল দেখে অবাক হয়ে গেল। তবে শান্ত থেকে বলল,
“তাহলে তো তোকে গাধা বলব না তো। আর কি আমি আগে কখনো বাংলাদেশে এসেছিলাম যে এই বাড়িতে আসব?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তাই বল। আচ্ছা, ছাড় এসব। আমি গোয়েন্দা লাগে একটা কথা জানতে পেরেছি, শুনবি?” — অত্যাধিক আগ্রহ নিয়ে কথাটি বলল লাবিবা।
তৃধা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী?”
লাবিবা এবার আরো দ্বিগুণ উৎসাহ গলায় ঢেলে বলল,
“গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি—এই বাড়ির ছেলে গুলো নাকি এক একটা কড়া মাল। একদম মাখন, মুখে দিলেই গলে যাবে।”
লাবিবার কথা শুনে তৃধার সুন্দর মুখখানি ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল।
ঝাড়ি মেরে বললো,
“তোর এই আলুর দোষ দেখে আমি শিহরিত! তোর কোন ব্যাটাকে সুন্দর লাগে না বলবি? তোর তো রাস্তায় ফুচকা ওয়ালা থেকে সিঙ্গাড়া ওয়ালা, চপওয়ালা, মুড়িওয়ালা—সবাইকে হট লাগে। সব সময় ছেলে ছেলে করিস কেন?”
ঝাড়ি খেয়ে লাবিবার মুখ চুন হয়ে গেল। সে দুঃখী দুঃখী বদনে বলল,
“এমন করে বলছিস কেন বান্ধবী? আমি কি নিজের জন্য চাইছি বল? আমি তো তোর কথা ভেবে, তোর জন্য একটা হট দেখতে দুলাভাই চাইছি।”
“আহাগো, কতো ভাবো আমার কথা! এতো হট দুলাভাই খুঁজে কি পরে আমার সাথে বিয়ে দিবা?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! আমার জামাই তোকে কেন দেবো?”
“হুহ।”
“আহা বেবি, এমন করছিস কেন? তুই কি চাস না তোর একটা হট দুলাভাই হোক, আমার একটা সেক্সি জামাই হোক?”
“আলুর দোষ ছাড়াতে না পারলে পাশের বাড়ির রহিম মিয়াও তোকে বিয়ে করবে না।”
তৃধার কথায় নাটক করে কপালে হাত দিলো লাবিবা। ঢং করে বলল,
“আহ, আমার নরম মনে এভাবে আঘাত দিলি জান! একটা হট ছেলেই তো চেয়েছিলাম। খুঁজে দে না বইন, প্রমিস করছি একদম ভালো হয়ে যাব।”
লাবিবার কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলল তৃধা। নিজের দিকে তর্জনী আঙুল তাক করে বলল,
“তোর কি আমাকে ছেলে পাচারকারী চক্রের লিডার মনে হয়?”
“যাহ দুষ্টু, তা কেন হবে? আচ্ছা যা, অন্য ছেলে খুঁজে দিতে হবে না। তোর ভাইটাকে পটিয়ে দে। প্রমিস করছি—ভন্ডামী সন্ডামী ছেড়ে একদম পীর অলি আউলিয়া হয়ে যাবো। শুধু তোর হেন্ডু ভাইটাকে পটিয়ে দে।”
লাবিবা আপন মনে বকবক করতে নিজের মতো এগিয়ে গেল। হঠাৎ কিছু মনে হতেই থেমে গিয়ে পাশে তাকালো।
বেক্কেল বনে গেল লাবিবা। চার পাশ পুরো ফাঁকা!
“আস্তাগফিরুল্লাহ! এতক্ষণ কি ভূতের সাথে কথা বলতেছিলাম?” — বলে বুকে ফু দিলো লাবিবা।
নিশ্চিত হতে ঘাড় বাকিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখল, তৃধা ওকে ফেলে গটগট করে চলে যাচ্ছে।
পেত্নী ছিলো না ভেবে সস্তি পেলো লাবিবা। কিন্তু তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে দেখে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“আমার মর্মো তুই এখন বুঝবি না। যা যা মানুষকে খুশি করতে কত কিছু লাগে! আর আমায় দেখ—আমি ছেলে দেখলেই খুশি হয়ে যাই।”
তৃধা ওর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল, পাঁচ আনাও পাত্তা দিল না তাকে।
তৃধা শেখ শিল্পপতি আরশাদ শেখের কনিষ্ঠ কন্যা। তৃধার আব্বু সাজিদ শিখদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্লাস বিজনেস পার্টনার মি. আরশাদ শেখ। উনি উনার পুরো পরিবারসহ ইউএসএ-তে থাকেন। উনার দুইমাত্র সন্তানদের মধ্যে তৃধা শেখ উনার কনিষ্ঠ কন্যা এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র ইরফান শেখ।
তাই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আমন্ত্রণ রক্ষার্থে পুরো পরিবারসহ শিখদার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন আরশাদ শেখ।
বিয়ে বাড়ির সাজে সেজে উঠেছে প্রণয় কুঞ্জ। আনাচে-কানাচে কোলাহল, বাড়ি ভরতি মেহমান, আত্মীয়স্বজন, দেশ-বিদেশের নিমন্ত্রিত নানা গণ্যমান্য ব্যক্তি বর্গ।
উৎসব হৈচৈ আর বাচ্চাদের তুখোর হইহট্টগোলে শিখদার বাড়ির আমেজে এসেছে বিয়ে-বিয়ে রব।
মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে দারুণ অ্যাস্থেটিক ভাবে।
বাড়ির অন্য সব সদস্যের অবস্থা যেমন তেমন, তবে ছেলেদের অবস্থা দেখার মতন। বেচারাদের কলুর বলদের মতো খাটতে হচ্ছে, দম ফেলার ফুসরতটুকু ও নেই। প্রত্যেকেই ছুটছে তার নিজ নিজ কর্মব্যস্ততায়। এই দৌড়ঝাঁপ হতে বাদ যাচ্ছে না তন্ময় শিখদার নিজেও।
তন্ময় জিহব্বা বের করে দিয়েছে। অরন্য তার মাথায় একটা বিশাল বিরিয়ানির হাঁড়ি তুলে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
“আজ তোর পুরুষত্বের পরীক্ষা, ছোটো মিয়া।”
হাঁড়িটা এতই বিশাল যে তন্ময় মাথা থেকে ফসকে যাচ্ছে।
তন্ময় মাথা থেকে নামিয়ে হাঁড়িটার ভিতর এক হাত ঢুকিয়ে দিলো। জিম্বাকৃতির বিশাল হাঁড়িটা কাঁধে ঝুলিয়ে অরন্যর দিকে বাঁকা নজরে তাকিয়ে বললো,
“আমার কথা না ভেবে তুমি নিজের কথা ভাবো, বড়ো মিয়া।”
অরন্য ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
“কেনো কেনো?”
তন্ময় সয়াতানি হেসে হাঁড়ির গায়ে হাত বুলিয়ে বললো,
“এই বুটকা হাঁড়িতে বসিয়ে তোমাকে আজ কষিয়ে কষিয়ে ঝাল দেবে বড়ো দাদান। জিজ্ঞেস করো কেন।”
অরন্যের ভ্রু বেকে গেলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কেনো?”
তন্ময়ের ঠোঁটে শয়তানি হাসি আরো খানিক প্রশস্ত হলো। সে হাতের অ্যাপল ওয়াচে দু’বার ট্যাপ করে অরন্যর চোখের সামনে কব্জি তুলে ধরলো।
ঘন্টার কাঁটা ১২টার কোঠায় টিকটিক দেখে বিকট চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো অরন্য। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তন্ময়ের পানে।
তন্ময় হা হু করে হেসে উঠে বললো,
“দাদান, তোমাকে আরো ১ ঘণ্টা আগে পইপই করে বলে দিয়েছিল ১০ মিনিটের মধ্যে ৪০ কেজি খাসির মাংস নিয়ে বাবুর্চিদের দিতে। কিন্তু তুমি তো বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর!”
“আজ তো খাসির বদলে তোমাকে দিয়ে বিরিয়ানি বানানো হবে বড়ো মিয়া।”
অরন্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিকে। তন্ময়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কথাগুলো বলতে বিরাট মজা পাচ্ছে। অরণ্য একটু ঘাবড়েছে ঠিকই, কিন্তু হেরে যাওয়ার বান্দা সেও নয়। সে কিয়তক্ষণ নিরব থেকে মিচকে মিচকে হাসতে শুরু করলো।
অরন্যকে ভয়ের বদলে হাসতে দেখে তন্ময়ের লাবডুব বন্ধ হয়ে গেল। সে বাঁকা চোখে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“কি ব্যাপার বড় মিয়া, ভয়ে কি ৭২ লাখ মাথায় উঠে গেছে?”
অরন্য ব্রাউন ওষ্ঠে ডেভিল স্মাইল ফুটিয়ে তুলে বললো,
“আমাকে বিরিয়ানির হাঁড়িতে ঢুকিয়ে সেদ্ধ করলে তোমাকে কি চুম্মা দেবে, মাই ডিয়ার লিটিল বেরাদার?”
তন্ময়ের কপালের ভাজ দৃঢ় হল।
অরন্য বাকা হেসে বললো,
“আমাকে মাংসের হাঁড়িতে ঢুকিয়ে সেদ্ধ করলে তোমার ও ৭২ লাখ খুলে ফ্রাই করে নেবে, ব্রো।”
“কেনো?”
অরন্য এবার হাঁড়িটার দিকে ইশারা করতেই লাফিয়ে উঠলো তন্ময়।
ভাড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে কি ৭২ লাখ নিয়ে ধড়কষাকষি করছিস তোরা কামচোর দুটো! খালি কাজে ফাকি দেওয়ার ধান্দা!” — বলে দু’জনের মাথায় দুটো গাট্টা মারলো সমুদ্র। দাঁত খিচিয়ে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিস, মেজদা ডাণ্ডা নিয়ে এলো বলে!”
অরন্য ও তন্ময় আতঙ্কে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢুক গিললো।
অতঃপর তড়িঘড়ি করে হাঁড়ি-পাথিল কাঁধে উঠিয়ে দৌড় দিলো দু’জন, পিছনের মাঠের দিকে।
শিখদার বাড়ির চতুর্থতলার বাঁ দিকের তৃতীয় কক্ষের বাইরে কনফিউজড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা। থুতনিতে হাত দিয়ে দুই পাশের ঘরগুলো দেখে বোঝার চেষ্টা করছে ওর ঘর কোনটা। কারণ অনন্যা আন্টি বলেছিলেন, চতুর্থ তলায় উঠে প্রথম ৪ নম্বর রুমটাই ওর। কিন্তু বাঁ দিকেরটা নাকি ডান দিকেরটা, তা নিয়ে বিশাল কনফিউশনে ফেঁসে আছে তৃধা। লাবিবা গেছে ওদের লাগেজগুলো নিয়ে আসতে।
“উফ চুমকি চলে গেছে একা পথে। সঙ্গী হতে দোষ কী তাতে? রাগ করো না সুন্দরী গো, রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো। চুমকি চলেছে একা পথে।”
“এই যে ছোটো ভাইয়া, শুনো!”
কোনো মেয়ের মুখে ভাইয়া ডাক শুনে সহসাই ঝরঝরে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তন্ময়ের। সে পায়ে ব্রেক কষলো, গান বলা থামিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো পেছনে।
সাথে সাথেই ইয়া বড়ো টাস্কি খেলো তন্ময় চোখের স্বাভাবিক আকৃতি বৃহৎ থেকে বৃহৎতর হল। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, “ইয়া আল্লাহ!” সামনে যেনো একটা জীবন্ত হুরপরী দাঁড়িয়ে আছে। মেদহীন ছিপছিপে গড়ন, গোলগাল ফর্সা মুখ আর কোমর ছাড়ানো হালকা কুঁকড়ানো চুল। তবে সব থেকে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণীয়—সবুজ রঙের চোখ।
তৃধা মিষ্টি হেসে তন্ময়ের পানে এগিয়ে গেলো। হাতের ইশারায় পাশের ঘরগুলো দেখিয়ে বললো,
“ভাইয়া, আমি কোন ঘরে থাকবো বুঝতে পারছি না।”
এতো সুন্দরী মেয়ের মুখে পুনরায় ভাইয়া ডাক শুনে তন্ময়ের মনের আকাশের রঙিন বেলুনগুলো ঠাস ঠাস করে ফেটে পড়লো মাটিতে।
তন্ময়ের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে পুনরায় ডাক দিলো তৃধা,
“ভাইয়া!”
এবার রেগে গেলো তন্ময়। নাক ফুলিয়ে বললো,
“আমি তোমার কোন কালের ভাই লাগি মেয়ে? আবার ঢঙ করে ভাইয়া ডাকা হচ্ছে! যাও, নিজের ঘর নিজেই খুঁজে নাও,ভাইয়া ডাকছে”
বলে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো তন্ময়।
এমন আজব ব্যবহারে ভেবাচকা খেয়ে গেলো তৃধা। মনে মনে পাগল ভেবে নিয়ে বললো,
“আহারে, এতো সুন্দর বাচ্চাটা পাগল!”
যাই হোক, কি আর করা যাবে! তৃধা দুই পাশের ৪ নম্বর রুম দুটো একবার দেখে—এটা তে না ওটা তে—ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে একটা তে দৌড় দিলো।
এক দৌড়ে ঘরের মাঝখানে এসে থামলো তৃধা। চার পাশে আতঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলো, কেউ নেই।
এতোক্ষণে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল তৃধা। মনে হলো, এই ঘরটার কথাই বলেছিলেন অনন্যা আন্টি। তবে ঘরটার স্মেল নাকে যেতেই খানিক অবাক হলো তৃধা, কারণ পুরো ঘরের এনভায়রনমেন্টে ম্যান পারফিউমের গন্ধে ম ম করছে। তবে তার থেকেও বেশি অবাক হলো ঘরটার অদ্ভুত সেটাপ দেখে।
তৃধা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো ঘরটা। ঘরটা বেশ বড় আর পুরোটা ব্ল্যাক থিমের। ঘরের পর্দা থেকে বিছানার চাদর, জানালার কাচ থেকে পায়ের পাপোশ—সবই ম্যাট ব্ল্যাক কালার। এমনকি ফার্নিচার, দেয়ালের রঙ সব আল্ট্রা ডার্কেস্ট। কেমন অদ্ভুত নেগেটিভ ভাইবস দিচ্ছে! তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় তৃধার? তার সারা শরীর গরমে কুটকুট করছে। এখনই কোল্ড শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হওয়া দরকার, নাহলে র্যাশেস বেরোবেই বেরোবে।
তৃধা তাড়াহুড়ো করে লাগেজ খুলে একটা মারুন শালওয়ার কামিজ বের করে নিল। নিজের গায়ের উড়না বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ইতিমধ্যে তার শরীর চুলকাতে শুরু করে দিয়েছে। তাই ব্যস্ত হাতে দ্রুত ওয়াশরুমের লক ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আচানক ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা খেল তৃধা। চোখ মুখ অটোমেটিক্যালি হাঁ হয়ে গেল। সামনের দৃশ্যটা ব্রেইন ভালোমতো ক্যাচ করতে পারল না বিধায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সামনে। অতপর বিকট শব্দে দিল এক চিৎকার।
অসময়ে নিজের ওয়াশরুমে অপরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল অরণ্য। তোড়ি ঘড়ি দরজার দিকে তাকিয়ে বেকুব বনে গেল সে। মেয়েটা এখনো তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে চিৎকার দিচ্ছে। অরণ্য মেয়েটার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজেদের দিকে তাকতেই আপাদমস্তক মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো অরণ্যের। আপনা আপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এল,
“ইন্নালিল্লাহ!”
সে পাশ থেকে টাওয়াল নিয়ে দ্রুত কোমর পেঁচাল। ইজ্জত বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে বা হাতে শক্ত করে চেপে ধরল তৃধার মুখ। সাথে সাথেই থমকে গেল অরণ্যের গোটা পৃথিবী। হঠাৎ আশা কালবৈশাখীর ন্যায় অরণ্যের হৃদয়ে ও প্রচন্ড বেগে ঝড় উঠে গেল। সে জাগতিক মায়া ত্যাগ করে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল তৃধার নেশা ধরানো সবুজ চোখে।
উঁহু উঁহু শব্দ করে মুচড়া মুচড়ি করতে লাগল তৃধা। অরণ্য এবার অন্য হাতে নিজের অজান্তেই চেপে ধরল তৃধার দুই হাত। সে যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোন দুনিয়ায়। তৃধা ছটফট করতে করতে অরণ্যকে চোখের ইশারায় বলছে, ছেড়ে দিতে। অরণ্য ও আনমনে ছেড়ে দিল। মেয়েটা কেমন যেন তাকে চোখ দ্বারাই হিপনোটাইজ করে নিয়েছে।
অরণ্যের হাত থেকে মুক্ত হতেই এবার আরো জোরালো শব্দে চিৎকার দিতে নিল তৃধা। সাথে সাথেই তার মুখ আবারো শক্ত করে চেপে ধরল অরণ্য। এক ঝটকায় ঘুরিয়ে ঠেসে ধরল ওয়াশরুমের দেয়ালে। তৃধার নাজুক কোমল হাতে পুরুষালি চাপ প্রয়োগ করল। কণ্ঠে ঈষৎ ক্রুদ্ধ ঢেলে নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল—
“ফ্রি-তে পার্সোনাল মুভি দেখে এখন কী পাবলিকের হাতে আমাকে গণধুলাই খাওয়াতে চান?”
“উঁহু উঁহু উঁহু!”
“কী উঁহু উঁহু, হুঁ? কারো ওয়াশরুমে ঢোকার আগে নক করে ঢুকতে হয় জানেন না মিস? এই যে আমার ২৫ বছরের সঞ্চিত ইজ্জত আপনি এক মুহূর্তে লুটে নিলেন, সবকিছু দেখে নিলেন, এখন এর দায় কে নেবে? এই মুখ আমি কাকে দেখাবো? কে বিয়ে করবে আমায়?”
তৃধা এখনো ছটফট করছে। অরণ্যের গাল থুতনি বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির ফোঁটা টপ টপ করে তৃধার চকচকে ফর্সা গলায় পড়ছে। অরণ্যের শরীর থেকে ফ্রেশ সাবান, শ্যাম্পু আর বডি ওয়াশের স্মেলও পাওয়া যাচ্ছে। অরণ্য পুনরায় মেকি রাগ দেখিয়ে বলল—
“বলুন মিস, যা আমার বউয়ের আনবক্স করার কথা তা তো আপনি আনবক্স করে নিলেন। এবার আমায় কে বিয়ে করবে?”
“উঁহু উঁহু।”
“আবার উঁহু উঁহু করছেন? বলুন, এই মুখ আমি সমাজে কীভাবে দেখবো?”
কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অরণ্যের এমন কন্টিনিউয়াসলি বকবক শুনে বিরক্ত হলো তৃধা। অরণ্য এখনো এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অচেনা সে রমনীর পানে। অরণ্য নিশ্চিত, এই নারী রূপকথার গল্পের সেই ডাইনি বুড়ি, যে মানুষকে কথার জালে চোখের মায়ায় বশ করে নিত।
তৃধা আর কোনো উপায় অন্তর না পেয়ে জুড়ে একটা পাড়া দিল অরণ্যের বা পায়ের বুড়ো আঙুলে। সাথে সাথেই “আউচ!” বলে মৃদু আর্তনাদ করে ছেড়ে দিল অরণ্য। এবার অরণ্যের কল্পনার অতিথ একটা মহা আশ্চর্যজনক কাজ করে বসল। তৃধা অরণ্যকে ধাক্কা মেরে একই দেয়ালে ঠেসে ধরল। অরণ্য অন্য মনস্ক ছিল বিধায় পেরেছে। অরণ্য আশ্চর্য হওয়ার ও সময় পেল না, তার আগেই অরণ্যের ডার্ক ব্রাউন ওষ্ট কোমল হস্ত দ্বারা চেপে ধরল তৃধা।
অরণ্য হতবম্ব দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তৃধার পানে। তৃধা নিজের ছোট হাতে অরণ্যের পুরুষালি দুই হাত একত্রে চেপে ধরতে পারছে না, তবুও চেষ্টা করল। অরণ্যও ছোটাছুটি করল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তৃধার পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার জন্য।
তৃধা এতক্ষণে জমানো ক্ষোভ ঝেড়ে বলল—
“এত ওভার ড্রামাটিক হওয়ার কোন কারণ নেই। আপনার এই ফ্লপ সিনেমা দেখার কোনো ইন্টারেস্ট ছিলনা আমার। তবুও যা দেখিয়েছেন, তা কক্ষণো ভোলার মত নয়। আল্লাহর ওয়াস্তে এরপর থেকে ওয়াশরুম ডোর লক করে আপনার সিনেমা ওপেন করবেন।”
বলে অরণ্য ছেড়ে সেই একটা ভাব নিয়ে চলে গেল তৃধা। অরণ্য কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বাকা হাসল। নিজের ওষ্টে হাত বুলিয়ে বলল—
“ফাইনালি।”
প্রিয়তা অস্বস্তিতে গুঁটি শুঁটি মেরে বসে আছে খাটের এক কোনে, তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে বসে আছে অনেক যুবতী মেয়ে ও দাদী-নানীরা। তাদের মশকরা যুক্ত একেকটা ডাবল মিনিং কথায় প্রিয়তার অস্বস্তির হার বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
প্রণয়-প্রিয়তাদের নানী গুলবাহার বানু বেশ সুন্দরী ও রসিক মহিলা, বয়স প্রায় ৮৪-এর দোরগোড়ায়। তবুও এখনো বুড়ির রসের কোনো কমতি নেই। তিনি প্রিয়তাকে পরখ করে বললেন,
“শোন নাতনি, পাকা যৌবন একটা অস্ত্র আর এটাই সঠিক সময় সেটা কাজে লাগানোর। আমি তোকে সব শিখিয়ে দেবো কিভাবে কি করতে হয়।”
উনার কথায় আহাম্মক বনে গেলো প্রিয়তা। এসব কথা সে তার বাপের জন্মেও শুনেনি। ভুল প্রণয় ভাই কখনো তাকে এসব শুনতেই দেয়নি।
“দেখ, তোর শরীরডার দিকে চাইয়া বিয়ার পানি লাগতেই কেমন রূপ খুইল্লা গেছে। কাল বাদ পরশু তোর বিয়ে, এই নানির কথামতো চললে প্রথম রাতেই বিড়াল মারতে পারবি। আর প্রথম রাইতে ঠিকমতো কাজটা করে ফেলতে পারলে তোর জামাই তোর কথায় উঠবে আর বসবে।”
নানির কথায় মেয়েরা আসন পেতে গুছিয়ে বসলো শুনার আগ্রহে। পাশ থেকে থিরা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কীভাবে নানি?”
গুলবাহার বানু পান চিবোতে চিবোতে রসিয়ে রসিয়ে বললেন,
“এসব হচ্ছে কৌশলের ব্যাপার নাতনি, তুই বুঝবি না।”
শুভ্রতা এক চোখ টিপ দিয়ে বললো,
“আরে দাদী, তুমি বলো। বুঝতে চাই বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। এসব দিন তো আমাদের জীবনেও আসবে, তখন দাদীর টোটকা কাজে লাগিয়ে প্রথম রাতে বিড়াল মেরে ফেলবো।”
দিপ্তি ও তাল মিলিয়ে বলল,
“একদম হ্যাঁ হ্যাঁ, তখন যদি তুমি বেঁচে না থাকো তাহলে তো আমাদের আর টোটকা জানাই হবে না।”
“আচ্ছা নাতনিরা, শুনে রাখো, পুরুষ মানুষ হচ্ছে হুলো বেড়ালের জাত। তারা সব সময় দুধের বাটির আশেপাশে চুক চুক করে।”
প্রিয়তা অবাক চোখে গুলবাহার বানুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দুধের বাটি?”
গুলবাহার বানু বিগ্গের ন্যায় উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, দুধের বাটি।”
“কিন্তু নানি, পুরুষ মানুষের সঙ্গে দুধের বাটির কী সম্পর্ক?”
“আরে আবুলের নাতনি, দুধের বাটি হচ্ছে বউয়ের রূপ-যৌবন। এই বাটি যতদিন ভর্তি থাকবে, স্বামীর সুহাগও উতলে পড়বে।”
“সামীর সুহাগ কী জিনিস দাদী?”
“ওরে বাবুরে, সে বড়ো সাঙ্ঘাতিক জিনিস।”
সব মেয়েরা উৎসাহ নিয়ে একসাথে বললো,
“যেমন?”
“সেমরি, সুয়ামি সুহাগ কম করলেও কাঁদবি, বেশি করলেও কাঁদবি। একবার গতরে সুয়ামির হাত পড়লে আর সুয়ামি ছাড়া ঘুমাতে পারবি না।”
থিরা অবাক হয়ে বললো,
“কেনো দাদী?”
“নেশা রে বইন, নেশা। সুহাগের পিনিক উঠলে আর একা থাকা যায় না। মুখে বলে ওই পিনিক বোঝানো যায় না।”
সায়মা টোন কেটে বললো,
“বাহ বাহ দাদী, কিয়া বাত হ্যায়! তুমি তো সেই এক্সপেরিয়েন্স। আমার বিয়ের আগে পাক্কা এক মাস তোমার কাছ থেকে ক্লাস নিবো।”
“আচ্ছা নানি, নানাও কি তোমাকে খুব সুহাগ করতেন?”
নাতনিদের কথায় লজ্জা পেলেন গুলবাহার বানু। বয়সের ভারে কুঁচকে যাওয়া গালে দেখা মিললো রক্তিম আভার। তিনি মুখ লুকিয়ে বললেন,
“যাহ নডি!”
“আরে দাদী, তুমি গুরু, আমরা শিষ্য। তোমার কী লজ্জা পাওয়া মানায়? তুমি বলো, তোমার বাসর ঘরের গল্প বলো।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ নানি, বলো না।”
সকলে মিলে পিপড়ের মতো ঝেঁকে ধরলো গুলবাহার বানুকে। সকলের ঝাঁকাঝাঁকিতে গুলবাহার বানু বাধ্য হয়ে বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা, ঝাঁকাশ না, বলছি।”
মেয়েদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে, প্রিয়তাও বেশ মনোযোগী হলো।
গুলবাহার বানু লজ্জা লজ্জা মুখে বলতে শুরু করলেন,
“বাসর রাতে আমি তো ঘুমটা দিয়ে বসেছিলুম।”
আয়রা গালে হাত দিয়ে বললো,
“তারপর?”
“তারপর খট করে দরজায় একটা আওয়াজ হলো।”
“তারপর?”
“তারপর দরজা খোলার শব্দ শুনেই আমি তো লজ্জায় মিইয়ে গেলুম।”
“তারপর?”
“তারপর তোদের দাদা আস্তে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।”
“তারপর?”
“তারপর ধীরে ধীরে আমার কাছে আসলেন, পাশে বসলেন। আমার সে কী লজ্জা।”
“তারপর?”
গুলবাহার বানু এবার লজ্জায় পুরোপুরি লাল হয়ে বললেন,
“তারপর তোদের দাদা আস্তে করে আমার ঘুমটা তুলে দিলেন।”
“উফ, হাউ রোমান্টিক! তারপর কী হলো দাদী?”
“তারপর উনার ঠোঁট আমার দিকে এগিয়ে এলো।”
“তারপর?”
“তারপর তোদের দাদা…”
শুভ্রতা থিরার হাত চেপে ধরলো, অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
“আমাদের দাদা কী?”
“তোদের দাদা…”
“আমাদের দাদা…”
গুলবাহার বানু পুনরায় কিছু বলবেন তার পূর্বেই প্রিয় অপু বলে ধড়াম করে ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো তন্ময়।
এমন চরম মুহূর্তে তন্ময়ের আগমন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঠেকলো মেয়েদের কাছে। সকলে পচা কুমড়োর মতো চেহারা দেখে চোখ সরু করে ফেললো তন্ময়।
থিরা ধমকে বললো,
“এই মেয়েদের মধ্যে তোর এখানে কী চাই? ভাগ এখান থেকে।”
তন্ময় মুখ ভেংচিয়ে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার নিকট।
“কিছু বলবি ভাই?” নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করলো প্রিয়তা।
তন্ময় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো,
“বল।”
“তোমার জন্য একটা গিফট এসেছে আপু।”
“গিফট?”
“হুম।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী?”
তন্ময় নিজের হাতে থাকা একটা ছিদ্র ছিদ্র বক্স প্রিয়তার হাতে দিয়ে চলে গেলো।
প্রিয়তা কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো বক্সটার দিকে। শুভ্রতা বললো,
“এটার মধ্যে কী আপু?”
প্রিয়তাও বুঝতে পারছে না। বক্সটা র্যাপিং পেপারে মোড়ানো, তবে বড়ো বড়ো দুটো ছিদ্র আছে।
“আরে নাতনি, খুলে দেখ। নিশ্চয়ই আমার হবু নাত জামাই দিছে।”
প্রিয়তা নানির কথায় থমকালো। তবে বেশি না ভেবে থিরাকে বললো,
“বা ধিকের ড্রয়ার থেকে ছোটো কেঁচিটা নিয়ে আয়।”
থিরাও তাই করলো।
প্রিয়তা কেঁচিটা দিয়ে আলতো হাতে র্যাপিং পেপার ছিঁড়ে গিফট বক্সটা ওপেন করতেই প্রিয়তার হৃৎপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো।
বক্সের ভেতর থাকা সাদা বেড়ালটা চোখের নিমেষে লাফিয়ে প্রিয়তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
“ওয়াও, এতো সুন্দর বিড়াল! এটা তো বেস্ট গিফট।” খুশি হয়ে বলল হিয়া।
সায়মা বক্সটা হাতে নিয়ে নামের জায়গায় দেখলো, কিছুই লেখা নেই।
থিরা একটু ভেবে বললো,
“আপু, এটা তোমার ওই বিরালটা না, যেটাকে ফেলে তুমি কানাডা চলে গিয়েছিলে?”
তবে থিরার কথা যেনো প্রিয়তার কন অব্দি পৌঁছালো না। সে টলমলে চোখে কোকোকে আদর করতে লাগলো।
এই বাড়িতে আসার পর কতো খুঁজেছে সে কোকোকে, কিন্তু কেউ বলতে পারেনি কোকো কোথায়। প্রিয়তা পরম ভালোবাসায় লোমশ বিরালটা বুকে জড়িয়ে ধরলো। কোকোও চুপটি করে পড়ে রইলো প্রিয়তার বুকে, যেনো সে আজো ভোলেনি নিজের মাকে।
কিন্তু প্রিয়তা বুঝলো না, আবারো তার কাছে কোকোকে কে ফিরিয়ে দিলো।
শিকদার বাড়ির উত্তরের মাঠে বিয়ের তিন দিন গ্রামবাসীসহ বাইরের লোকদের খাওয়ার জন্য বিশাল বড়ো করে প্যান্ডেল বাধা হয়েছে। মধ্য দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিট চলমান মাঠের এক কর্নারে এক দফা রান্না-বান্নার আয়োজন চলছে জোর কদমে। তো অন্য দিকে তৃতীয় ব্যাচে বসা গ্রামবাসীদের খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে প্রণয়, প্রীতম, প্রেম, রাজ, আবির্ভাব, অরণ্য, সমুদ্র, রাদিফ, সাদিফ, অভ্র, সুভ্র সহ আরো ভাইয়েরা। কারণ শিকদার বাড়ির মেহমানদারিতে বাইরের মানুষকে যুক্ত করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।
বালতির মাংস ফুরিয়ে যাওয়াতে প্রণয় অরণ্যকে ডেকে বললো,
“তোর হাতের বালতিটা এদিকে দিয়ে আরেক বালতি করে মাংস নিয়ে আয় যা।”
“আচ্ছা দাদান।” বলে প্রণয়ের হাতে মাংসের বালতিটা দিয়ে চলে গেলো অরণ্য।
তিন ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার মানুষের পাত পড়েছে এই অব্দি, আরো দুই হাজার বাকি। তীব্র রোদে গরমের দুপুরে ছুটাছুটির ফলে প্রণয়ের ফর্সা ত্বক লালচে বর্ণ ধারণ করছে। অস্থিরতায় গায়ের চামড়া জ্বলছে, পেট পিঠ বেয়ে ঝর্ণার ধারার মতো শিরা নামছে। পরনের সফেদ রঙা পাঞ্জাবিটা ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। প্রণয়ের যেনো নিঃশ্বাস ফেলার ফুসরত নেই।
প্রণয়ের মাংস বেড়ে দেওয়ার মধ্যেই দৌড়ে কাছে এলো তন্ময়। প্রণয় ওকে দেখে থামলো।
তন্ময় দুই হাতে হাঁটুতে ভর দিয়ে দ্রুত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“তোমার কথামতো দিয়ে এসেছি দাদান।”
“খুশি হয়েছে?”
“হুম, খুউউব।”
হালকা হাসলো প্রণয়, পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে যায়, মেহমান-আত্মীয়স্বজন সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ। শিখদার বাড়ির ছাদে লাগানো সাউন্ডবক্সে ফুল ভলিউমে বাজছে,
“Arre Kab Tak Jawaani Chhupaaogi Rani
Kanwaaron Ko Kitna Sataaogi Rani
Kabhi To Kisi Ki Dulhaniya Banogi
Mujhse Shaadi Karogi,…
Mujhse Shaadi Karogi
Mujhse Shaadi Karogi….
Mujhse Shaadi Karogi”
গানের তালে তালে তন্ময় তার বন্ধুদেরকে নিয়ে পাগলা ডান্স দিচ্ছে।
বিশাল ছাদের পূর্ব দিকে বড় করে মেহেদি স্টেজ বানানো হচ্ছে, যার পুরো ভাড় পড়েছে অরণ্য ও সমুদ্রের কাঁধে। অরণ্য স্টেজের পাশে লাইট লাগাচ্ছে, আর গানের তালে তালে দুল খাচ্ছে।
দুলা-দুলি না করে উপরে উঠ বললে লম্বা একটা মই এনে অরণ্যের সামনে রাখলো সমুদ্র।
অরণ্য মইটা দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো, “আমি উপরে উঠবো?” “হ্যাঁ, তুই ছাড়া আবার কে উঠবে? তাড়াতাড়ি ওঠ, দেরি হয়ে যাচ্ছে!”
অরণ্য ওর কথা গায়ে মাখলো না, হাই তুলে দায়সারা ভাবে বললো, “পারবো না।”
“কেনো?”
“আমার কাঁধে পা উঠিয়ে দিয়ে সকলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর আমি একা খেটে খেটে মরব—এটা তো হতে পারে না।”
“তোর কাঁধে আবার কে পা তুলে দিলো?”
“কী তুলা তুলির কথা হচ্ছে, গাইস?” মুখে দুই কেজি মেকআপ মেরে সামনে এসে দাঁড়ালো সারিকা। অরণ্য সারিকাকে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, যার পানে হা করে তাকিয়ে রইল সারিকা— ওই ছেলের বক্র হাসির প্রেমে পুনরায় উষ্টা খেয়ে পড়লো সে; তাই দিন-দুনিয়া ভুলে, সর্বসমক্ষে নির্লজ্জের মতো থাকিয়ে রইলো অরণ্যের দিকে।
মনে মনে বলল, “এই ছেলে ওভাবে হাসে কেনো? তুমি এভাবে হাসলে আমি না জানি কবে অক্কা পেয়ে বসবো!”
“সুন্দরী বেয়ান সাহেবার দর্শনে কৃতার্থ হলো এই বান্দার জীবন,” তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে রশিয়ে বলল সাদিফ।
অরণ্যের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল। সে সমুদ্রের কাঁধ চাপড়ে বললো, “আরে, এতক্ষণ তুই উপরে উঠা নিয়ে চিন্তা করছিলি? কিন্তু দেখ—তর মুশকিল আসান এসে গেছে.”
সমুদ্র বুঝতে না পেরে বললো, “এ্যাঁ?”
অরণ্য বাঁকা হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের বেয়ানসাব আছেন না?”
অরন্যের কথায় অবাক হলো সারিকা। “উপরে উঠতে হবে?”
“হুম, ওই যে উপরে, ওখানে উঠতে হবে।” বলে আঙুলের ইশারায় দেখালো অরণ্য।
অরণ্যের আঙুল অনুসরণ করে উপরে তাকিয়ে ঢুক গিললো সারিকা, ভয় পেলো—জোর করে হাসার চেষ্টা করলো।
সমুদ্র রাদিফ-সাদিফের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো, “কী বুঝলে, বাচ্চারা?”
রাদিফ ভাবুক কণ্ঠে বললো, “বুঝলাম, ঘোর কলিযুগ; এখন শেয়াল মুরগি ধরে না, বর মুরগি হাটি হাটি পা-পা করে শেয়ালের গর্তের সামনে আসে তারপর।” “তার পর কী?” পাশ থেকে শোনা গেল সাদিফের আগ্রহভরা কণ্ঠস্বর।
রাদিফ দুষ্টু হেসে বললো, “এর পর শিয়ালের হাতে পায়ে ধরে কেঁদে কুটে বলে, ‘প্লিজ বেবি, কিল মি’।”
এই কথা বলে হা-হু করে হেসে দিলো তিনজন। অরণ্য ওদের পাত্তা দিলো না; ওরা তিনজন যেন সার্কাস দেখার অপেক্ষায়।
সারিকা হাসার চেষ্টা করলো। এই ছেলেকে তার যে কোনো মূল্যেই পটাতে হবে, তাই ভয়ে ভয়ে বললো, “ঠিক আছে, আমি উঠছি, কিন্তু আপনি শক্ত করে ধরে রাখবেন, বেয়াই সাব।” “অফকোর্স।”
সারিকা আল্লাহর নাম নিয়ে মই বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। অরণ্য সমুদ্রকে ইশারা করতেই সমুদ্র ফেরি লাইটগুলো ছুঁড়ে দিল সারিকার হাতে।
নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হাত-পা ঝেড়ে ফেললো অরণ্য; নিজে ও তন্ময়দের টিমে যুগ দিয়ে বললো, “কী সব বস্তা পচা মেড়-মেড়ে গান লাগিয়েছিস পার্টনার, এসব পাল্টে একটা কারেন্ট যুক্ত ঝক্কাস গান লাগা।”
তন্ময় মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিয়ে বললো, “ওকে বস, ডিজে তন্ময় প্লে দ্যা নিউ ঝাক্কা নাক্কা মিউজিক।”
সাথে সাউন্ডবক্সে শব্দের ঝংকার তুলে বেজে উঠলো, সালমান মুক্তাদিরের উত্তেজনায় ঠাসা বিখ্যাত গান:
“অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেমে
কাছে আসো না, আরো কাছে আসো না, হুস কথা বলো না, কোন কথা বলো না—অভদ্র হয়েছি আমি তোমারি প্রেম।”
তাদের এই পাগলা এসে নাচে এসে যুগ দিলো রাদিফ, সাদিফ, অভ্র, সুভ্র, সমুদ্র, রাজসহ আরো অনেক ছেলেরা। হাসি, আনন্দ আর হৈ-হুল্লুড়ে কেটে গেলো গুট একটি বিকেল।
সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে; আলোকসজ্জায় ঝলমলিয়ে উঠেছে শিখদার বাড়ির ভেতর-বাইর। প্রত্যেকেই সুন্দর করে রেডি হয়ে ছাদে চলে গেছে, কেবল আবির্ভাব ব্যতিক্রম। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সিল্কি চুলগুলোতে হাতের সাহায্যে ব্যাক ব্রাশ করছে; সুঠাম দেহে কালো পাঞ্জাবি জড়ানোর দরুন তার পুরুষালী বাহ্যিক সৌন্দর্যে যেনো তাক লেগে যায়।
আবির্ভাব তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে হাতে ঘড়ি পড়তে নিতেই পাশে থাকা ফোনটা তুমুল শব্দে বেজে উঠলো; কালো স্ক্রীনে জ্বলে উঠলো “সমন্ধি” নাম—এই নিয়ে দশবার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করলো আবির্ভাব।
“বাপ আমার, একটু অপেক্ষা কর বাপ, তোর হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে তুই ইতিহাসে প্রথম বিয়ে করতে চলেছিস।”
আবির্ভাবের ওষ্ট নির্গত বাক্য সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই উপর প্রান্ত হইতে তীক্ষ্ণ চেঁচানোর শব্দ শোনা গেল:
“শালা, আমার বিয়েতে তুই গায়ে হাওয়া লাগাতে এসেছিস? চুপচাপ দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়।”
আবির্ভাব দাঁতের দাঁত চেপে বললো, “তুই যেন আমায় কতো গায়ে হাওয়া লাগাতে দিচ্ছিস!”
“ভাট না বকে, তাড়াতাড়ি আয়।” বলে খট করে কল কেটে দিলো শুদ্ধ।
আবির্ভাব ফোনের পানে চেয়ে দাঁত খিটমিট করে বললো, “উত্তেজিত শালা, বিয়ের আগেই মরে যাচ্ছে; বিয়ের পরে যে কী করে—ভগবান জানে।” বলে দ্রুত ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, তাড়াহুড়োতে ড্রেসিং টেবিলের উপর নিজের ওয়ালেটটা ভুলে ফেলে গেলো।
সিকদার বাড়ির বিশেষ লাইব্রেরি কক্ষে বসেছে গুরুত্বপূর্ণ, গোপন, গুরুগম্ভীর বৈঠক। মুখোমুখি বসে আছেন সিকদার বাড়ির কর্তারা এবং বাংলাদেশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ ডিপার্টমেন্টের বিশিষ্ট হেড অফিসার মিঃ আদ্রিশ এহসান। তার পাশের সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে প্রণয়; তার এক পাশে শুদ্ধ, অন্য পাশে পৃথম। মহল বেশ গম্ভীর। সদমান সিকদার কিয়ৎক্ষণের নীরবতা ভঙ্গ করে জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আমার পরিবারের বিরুদ্ধে যে গুরুতর অভিযোগগুলো আনছেন, তার সপক্ষে নিশ্চয়ই প্রমাণ আছে—আপনার নিকট তা প্রমাণ সম্পর্কে জানতে চাই, অফিসার?”
আদ্রিশ তীক্ষ্ণ, ধারালো দৃষ্টিতে পরখ করছে উপস্থিত প্রত্যেককে। তাদের কাছে থাকা ডেটা অনুসারে, তারা যাকে খুঁজছে, সে এই পরিবারের কেউ কিংবা এদের মধ্যেই কেউ—মানে সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে। তবে আপাতত তার সিনিয়রদের ওপর দৃষ্টি নয়, কারণ তাদের রেকর্ডস অনুসারে এএসআর-এর বয়স ২৫–৪০-এর আশেপাশে।
“টেল মি, অফিসার, আমার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যে ডিসরেসপেক্টফুল এলিগেশনসগুলো আনছেন, তার সপক্ষে কী কোনো প্রুভ আছে আপনার কাছে?”
আদ্রিশ বাঁকা হাসলো, রহস্যময় কণ্ঠে বললো, “নিশ্চয়ই আছে, মি. সিকদার; তবে সলিড প্রুভ যদি থাকতো, তাহলে এখানে অবশ্যই বসে থাকতাম—এতক্ষণে ওয়ারেন্ট অনুযায়ী কতগুলো গুলিতে যে ঝাঁঝরা করে দিতাম,” বলে অদ্ভুত চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
পৃথম রেগে তেড়ে যেতে নিলে, তার হাত চেপে ধরলো শুদ্ধ; চোখের ইশারায় শান্ত হতে বুঝালো। আদ্রিশের কথায়, মনে মনে ফুঁসে উঠলেন সদমান সিকদার। দু’দিনের চুকরা কিনা সাদমান সিকদারকে, তার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলবে। তাও আবার তারই সামনে বসে—মাইঙ্কা চিপায় ফেঁসে না থাকলে, এই খানকি*র পোলার কলিজা টেনে ছিঁড়ে নিতেন উনি নিজের হাতে।
সদমান সিকদারের চোখে হিংস্রতা দেখে, শুদ্ধ পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বললো, “ওকে, তার মানে আপনি কোনো রকম প্রুভ ছাড়াই চলে এসেছেন আমাদের বাড়িতে; তাও আজকের দিনে—পুলিশ ওয়ালাদের কমনসেন্স কি দিন দিন মোটা অংকের বান্ডিলের নিচে চাপা পড়ছে!”
তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে আদ্রিশ সরাসরি শুদ্ধের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। “এই ছেলেটা ডাক্তার; তবে এও সন্দেহের বাইরে নয়।”
“দেখুন, ডক্টর চৌধুরী, কার বাড়িতে কী হচ্ছে তা দেখা আমাদের কাজ নয়। গভর্নমেন্ট অর্ডারে যখন যেখানে প্রয়োজন, তখন সেখানে যেতে হয়; আর সবকিছু কিন্তু বান্ডিল দিয়ে চাপা দেওয়া যায় না।”
এবার সাজিদ সিখদার ধৈর্য হারালেন, বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, “এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে, অফিসার—আপনি কোন কারণ ছাড়াই আমাদের হ্যারাস করছেন, যখন তখন ইউনিফর্ম পরে আমাদের বাড়িতে চলে আসছেন। আমাদের ফ্যামিলির একটা রেপুটেশন আছে। এর ওপর এখন আমাদের বাড়ি ভর্তি মেহমান, কত কত গেস্ট, ফরেনারস—সব মিলিয়ে আমাদের মেয়েদের বিয়ে। এই সময় আপনি এসব বলে আমাদের মান-সম্মান নিয়ে টান দিচ্ছেন। আপনার কোনো রাইটস নেই—একজন ওয়ান্টেড ক্রিমিনালের সাথে আমাদের অযৌক্তিক লিংক করে অভিযোগ তুলার; এর পর আমরা কিন্তু মানহানির মামলা করতে বাধ্য হবো।”
আদ্রিশ ভদ্রলোকের তেজ দেখে হাসলো, পেছিয়ে বললো, “গ্রেট আঙ্কল, আপনি আপনার ফ্যামিলির রেপুটেশন দেখছেন; আর এদিকে আপনার বাড়ির একজনের জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গায়েব হয়ে যায়, খুন হয়ে যায়, গুম হোয়ে যায়; যুবসমাজ দেশের ভবিষ্যৎ মাদক আসক্তির দিকে দাবিত হচ্ছে; হাজার হাজার নারীর সম্মান নষ্ট হচ্ছে; ব্ল্যাক মার্কেটের শেয়ার বাড়ছে; কোটি কোটি ডলার জালিয়াতি হচ্ছে; কতো মায়ের বুক খালি হচ্ছে—আর এগুলো হচ্ছে মাত্র এক দিনে। এসব আপনাদের দেখার বিষয় নয়, তাই না?”
“ওয়েল, আপনারা যদি আমাদের সাথে কো-অপারেট না করেন, ইট’স ওকে। সেই দিন খুব দূরে নয়—যেদিন আমরা আমাদের লক্ষ্যের পৌঁছবো, সেদিন আপনারা কেউ ছাড় পাবেন না।”
“আপনারা হাই সোসাইটিতে অনেক পাওয়ারফুল বিলিয়নিয়ার, কিন্তু এই ক্ষেত্রে এসব ক্ষেত্রে টাকা কোনো কাজে লাসবে না; বিকজ ম্যাটার ইজ ইন্টারন্যাশনাল।”
“এসব যাচ্ছেতাই কথা বলে লাভ নেই, অফিসার।”
সেটো সময় বলবে মিঃ শিকদার, “আপনাদের বাড়ির মেয়ের এ-এস-আর-এর ভীষণ ফেভারিট, তাই আমরা ৭০% শিউর—এ-এস-আর এই বাড়িতেই আছে, আপনাদের মধ্যেই আছে; শুধু তাকে চিনে নেওয়ার অপেক্ষা।”
প্রিয়তার কথা উঠতেই রেগে গেলো শুদ্ধ; কপট রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বললো, “অনেক হয়েছে, অফিসার—এতক্ষণ আপনার অনেক আজে-বাজে কথা হজম করেছি, আর নয়। আমার বৌকে নিয়ে একটা উল্টোপাল্টা কথাও বলবেন না।”
“কাম ডাউন, ডাক্তার চৌধুরী; গলার জোরে কিছুই বদলাবে না। বাই দ্য ওয়ে, এত তাড়াহুড়ো করে আপনার বিয়ের রিজনটা বুঝলাম না—কোনো রহস্য আছে নাকি?”
“যদি কোনো কোনো রহস্য থাকেও, আপনাকে বলতে হবে,” ঠান্ডা কণ্ঠে পাশ থেকে বলে উঠল প্রণয়।
প্রণয় সোজাসুজি তাকিয়ে আছে আদ্রিশের চোখের দিকে। আদ্রিশের কাছে নাম্বার-ওয়ান সন্দেহভাজন এই লোকটাই; কারণ ইনফরমেশনের ৮০% ডাটা এই লোকটার সাথে খুব ভালোভাবে ম্যাচ করছে। আর গোপন রিসার্চে যা জানতে পেরেছে তাতে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই—শুধু প্রমাণের অপেক্ষা।
আর সেটাও কিভাবে পেতে হবে তা খুব ভালো জানা আছে আদ্রিশের। রাক্ষসের প্রাণ ভোমরা থাকে, ঝিনুকের ভেতর থাকে তেমন—এ এস আর-এর প্রাণ ভোমরার পাতা সে লাগিয়ে ফেলেছে।
বাঁকা হাসলো আদ্রিশ, “অবশ্যই বলতে হবে, আপনারা বলতে বাধ্য।”
আর শুনলাম, “আপনাদের ব্যবসায় ও নাকি ঘাপলা আছে? আপনাদের ফ্যামিলি বিজনেস এস কে গ্রুপ, আপনার পার্সোনাল বিজনেস পি এস ক্রপস—সব নাকি ভিজ্যুয়াল ইলিউশন; আই মিন চোখের ভ্রম, আসল সত্য নাকি অন্য কিছু?”
“হতে ও পারে, আপনি প্রমাণ করুন।”
“তাতো নিশ্চয়ই; কিন্তু প্রমাণ হওয়ার পর—আপনি ঠিক থাকবেন তো, মিঃ আবরার শিকদার, প্রণয়?”
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো প্রণয়, আদ্রিশের চোখে চোখ রেখে বললো, “পারলে বাল ছিড়ে দেখাইয়েন।”
সাথে সাথেই প্রণয়ের হাত চেপে ধরলো শুদ্ধ, চাপা গলায় বললো, “কন্ট্রোল ভাই, কি বলছিস এসব।”
প্রণয়ের কথায় অপমানিত বোধ করল আদ্রিশ। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, “চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড; ওকে, গাইজ—আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে।” আর কিছু না বলে চলে গেলো আদ্রিশ, অপমানের ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ লাল।
আদ্রিশ যেতেই সকলে সকলের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। তবে দেয়ালেরও কান আছে ভেবে, কেউ কোনো কথা বললো না। সকলে সকলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, শুধু রয়ে গেলেন সাদমান সিখদার ও প্রণয়।
প্রণয়ের মুখ শান্ত, তবে চোখ দুটোতে ভয়াবহ হিংস্রতা। সাদমান সিখদার ছেলের চোখ দেখে আঁতকে উঠলেন; এই চোখ আর হিংস্রতা উনার ভীষণ চেনা—ঠিক যেন উনার বাবার প্রতিচ্ছবি।
সাদমান সিখদার প্রণয়ের পাশে এসে বসলেন। আচমকাই ছেলের হাত দুটো ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন—আহত কণ্ঠে বললেন, “আমাকে মাফ করে দে, বাবা; আমি তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, মাফ করে দে আমায়। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৬
প্রণয় নিঃশব্দে হেসে উনার হাত ছেঁড়ে নিল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, “পাপ বাপকে ও ছাড়ে না, বাবা। আমায় ছাড়েনি, আপনাকেও ও ছাড়বে না। কঠিন শাস্তি পাবেন। আমার শাস্তি যেমন—তেমন, চিরতরে চোখ দুটো বন্ধ করবো, সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার শাস্তি এত সামান্য হবে না, বাবা। তৈরি থাকুন।” বলে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো প্রণয়।
সাদমান সিখদার অসহায়ের মতো চেয়ে রইলেন ছেলের যাওয়ার পানে।