ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭ (২)

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭ (২)
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

ফুল সজ্জিত স্টেজের মধ্যিখানে পাশাপাশি বসানো হয়েছে প্রিয়তা ও প্রেরণাকে।
দুজনের কারো মুখেই ভারী কোনো সাজসজ্জার চাপ নেই, কেবল ঈশ্বর প্রদত্ত প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা। তবুও চাঁদের টুকরো লাগছে, যা হইতে দৃষ্টি ফেরানোর সক্ষমতা নেই উপস্থিত করো। প্রত্যেকেই, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে আছে নববধূদের পানে।

ইন্টারন্যাশনাল কার্ডিও সার্জন ড. আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধর বিয়ে কভার করতে এসেছেন দেশ-বিদেশের মিডিয়া রিপোর্টার। তবে বর্তমানে সবার চোখই চুম্বকের মতো সেটে আছে প্রিয়তার দূতিময় চেহারায়। এখানে আসার পূর্বেই তারা রিসার্চ করে জানতে পেরেছিলেন ডক্টর চৌধুরীর হবু স্ত্রী, ওরফে বিশিষ্ট শিল্পপতি সাজিদ শিকদারের একমাত্র কন্যা অত্যন্ত সুন্দরী। কিন্তু এখানে আসার পর সকলের তাক লেগে গেছে, এতটাও কেউ আশা করেনি—যেন অতি যত্নে নির্মিত জীবন্ত এক পুতুল।
হাঁটু ছড়ানো খোলা চুলের সাথে হালকা সবুজ লেহেঙ্গায় স্বর্গরাজ্য হইতে বিতারিত কোনো অপ্সরা লাগছে তাকে।
সকলকে এমন ঘোরে থাকতে দেখে স্টেজে উঠে এলো অরণ্য। মাইক হাতে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল—
“ওকে লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, আজকের মেহেদি সেরিমনির শুভ সূচনা হবে একটা দুর্ধান্ত কাপল ডান্সের মাধ্যমে। সো লাইটস অফ অ্যান্ড প্লে দ্য মিউজিক।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরণ্যের বলার সাথে সাথেই সব লাইটস অফ হয়ে গেল। বাতাসে ভেসে এলো রোমান্টিক সফট মিউজিক টোন—
Tumko paaya hai to jaise khoya hoon…
গানের সাথে সাথেই ফোকাসিং লাইট এসে পড়ল কয়েক জোড়া যুগলের ওপর। তারা হাস্যোজ্জ্বল মুখে একে অপরকে কাছে টেনে নিলো।
প্রেম ঊষার কোমর আঁকড়ে ধরে গানের তালে তালে নাচ করতে লাগল।
“হেই ব্লুবেরি, ডান্স।”
আচমকা মুখের সামনে কেউ হাত তুলে ধরাতে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল শ্বেতা। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। তার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা চওড়া পুরুষ, বেশ সুদর্শন বলা চলে। কিন্তু তাকে চিনে বলে মনে হচ্ছে না শ্বেতা।
তাই তাকেই বলছে কিনা শিওর হয়ে নিতে বলল—

“এক্সকিউজ মি?”
শ্বেতাকে চমকাতে দেখে ফিচেল হাসলো লোকটা। শ্বেতার সম্মুখে ফ্রেন্ডশিপের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল—
“হায়, আমি ইরফান শেখ, প্রিথমের বেস্ট ফ্রেন্ড।”
ভাইয়ের বন্ধু শুনে একটু ইজি হলো শ্বেতা। সৌজন্যমূলক হেসে হ্যান্ডশেক করল ইরফানের সাথে।
“তো এত সুন্দরী রমণী এমন অনাথের মতো একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেখতে ভালো লাগছে না, ব্লুবেরি।”
“এ্যাঁ, ব্লুবেরি?”—এমন সম্বোধন শুনে বোকা বনে গেলো শ্বেতা।
ইরফান ঠোট টিপে হাসলো, শ্বেতার মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করে বলল—
“হ্যাঁ, আপাদমস্তক তো ব্লুবেরিই লাগছে।”
শ্বেতা একটা ডিপ ব্লু কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে, সাথে হালকা মেকাপ। বেশ মিষ্টি লাগছে। কিন্তু এই লোকটা এমন কেনো বলছে!

ইরফানের লজিক শুনে শ্বেতা একটু কনফিউজড হলো। সত্যিই কি আমাকে ব্লুবেরি লাগছে?
শ্বেতার ভাবনার মধ্যেই পুরুষালী কণ্ঠ শোনা গেল—
“বললে না তো, একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
শ্বেতা নম্র কণ্ঠে জবাব দিল—
“সবার কেউ না কেউ আছে, মিস্টার ইরফান। কিন্তু আমার কেউ নেই।”
“ইটস ভেরি ব্যাড, ব্লুবেরি। এই তো মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ড পূর্বেই এই অধমের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালেন, আর এখুনি বলছেন আপনার কেউ নেই। ভেরি ডিসঅ্যাপয়েন্টিং।”
ইরফানের যুক্তিতে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল শ্বেতা।
“বাই দ্য ওয়ে, আপনি কিন্তু বললেন না…”
শ্বেতা হাসি থামিয়ে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো।
ইরফান সম্মোহিত কণ্ঠে বলল—

“এই যে, আপনার নাম কী?”
স্বাভাবিক হলো শ্বেতা। আস্তে করে জবাব দিলো—
“জি, আমার নাম মৃত্তিকা চৌধুরী শ্বেতা।”
“বাহ, খুব সুন্দর নাম তো আপনার।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
“একটা কথা বলব?”
“জি, বলুন।”
“এভাবে অনাথের মতো ঘুরু ঘুরু না করে, লেটস ডান্স।”
শ্বেতা কিয়তক্ষণ নীরব থেকে অস্বস্তি নিয়ে বলল—
“আই’ম নট কম্ফর্টেবল।”
“সো হোয়াট, আমি তো আছি। লেটস কাম,”—বলে পুনরায় হাত বাড়িয়ে দিলো ইরফান।
শ্বেতা দুই একবার অস্বস্তি হলেও আর ফিরিয়ে দিল না। আলগোছে ইরফানের হাতে হাত রাখল।
“ওকে পার্টনার।”—বলে কাপলদের মধ্যে তারাও মিলে গেলো।
ইরফান খুবই মার্জিত ভঙ্গিতে শ্বেতার সাথে পায়ে পা মিলাচ্ছে। ব্যাড টাচ একদমই লাগছে না। তবে দূর থেকে তাদের বেশ ঘনিষ্ঠই দেখাচ্ছে, মানিয়েছে ও দারুণ।

শ্বেতার গায়ে অন্য পুরুষের হাত পড়ছে দেখে দূরে দাঁড়ানো এক পুরুষের রক্ত গরম হয়ে গেল যেন মুহূর্তেই।
চোখ মুখ ঝলসে উঠলো তীব্র প্রতি হিংসার অগ্নিতে। মন গহীনের সবুজ অরণ্যে যেন লেগে গেল বিধ্বংসী দাবানল। পুরুষালী হাতের মুষ্টি শক্ত করে সে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল তার বাড়ন্ত উদ্ধত্য।
অঘটন থেকে নিজেকে রোধ করতে মনের আগুন মনে চেপে নিঃশব্দ পায়ে ত্যাগ করল স্থান।
কাপল ডান্স শেষ হতেই পুনরায় স্টেজে উঠে এলো অরণ্য। মাইক হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল—
“সারপ্রাইজ এভরিওয়ান!”

পুনরায় লাইটস অফ। ছাদের সবগুলো বাতি নিভে গেল একত্রে। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ। সকলে উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কী হয় দেখার অপেক্ষায়।
তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে এলো এক পুরুষালী কণ্ঠ। সাথে সাথেই ঝলসে উঠলো সবগুলো বাতি—
“রাতের সব তারা আছে দিনের গভীরে, বুকের মাঝে মন, যেখানে রাখব তোকে সেখানেই।
তুই কি আমার হবিরে মন?
বাড়িয়ে আছি দাঁড়িয়ে, তোর হৃদয়।
তুই জীবন-মরণ সবই রে, তুই কি আমার হবিরে?”

সবুজ শেরওয়ানি পরিহিত সুদর্শন বরের এমন গ্র্যান্ড এন্ট্রিতে সকলে চিৎকার দিয়ে উঠল।
শুদ্ধ গান গাইতে গাইতেই এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলো প্রিয়তার সম্মুখে। সকলের উজ্জ্বল দৃষ্টি তাদের পানে।
প্রিয়তা অশান্ত চোখে আশেপাশে খুঁজল সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে। কিন্তু সে নেই, কোথাও নেই। পুনরায় অযৌক্তিক অভিমানে চেয়ে গেল প্রিয়তার হৃদয়। সে এত কিছুর পরেও আশা ছাড়তে পারে না।
প্রিয়তা শুদ্ধকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালো না। নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো শুদ্ধর হাতে। শুদ্ধ তৃপ্ত হাসলো, প্রিয়তার হাত টেনে কাছে টেনে নিলো।

সাউন্ড বক্সে বাজতে থাকা সফট মিউজিকের তালে তালে পা মেলাতে লাগলো দুজন।
শুদ্ধ প্রিয়তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোমরে হাত রাখল, আরো কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
“ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস, সুইটহার্ট।”
প্রিয়তা কোনো জবাব দিলো না।
সে জানতেও পারলো না, দূরে অজস্র মানুষের ভিড় থেকে কেউ তাকে প্রাণ ভরে দেখলো। নিজের বুকের জ্বলন্ত আগুন সাক্ষী রেখে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলো তার দীর্ঘ সুখী জীবনের।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ৮টা বেজে গেলো।
প্রিয়তা ও প্রেরণাকে পাশে পাশে বসিয়ে মেহেদি পরানো হচ্ছে। তাদের পাশে মেহেদি পরার জন্য উৎসুক হয়ে বসে আছে তৃধা, থিরা, থোরি, ঊষা, শুভ্রতা, দীপ্তি, আরো অনেকে।
মেহেদি আর্টিস্ট প্রিয়তার হাতে মেহেদির ডিজাইন তোলা শেষ করে ফরমালি বললেন—

“ম্যাডাম, আপনার হাজবেন্ডের নাম শুদ্ধ, তাই না? সো ক্যাপিটাল এস হবে।”
“জি।”
“ঠিক আছে।”
প্রিয়তাকে এমন মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে দীপ্তি দুষ্টু হেসে বলল—
“এমন একটা হট আইটেম পটানোর পরও এমন মুখ গুমড়া করে বসে থাকার মানে কী বলতো, থিরা?”
থিরা শুভ্রতার সাথে গল্প করা ছেড়ে দীপ্তির কথায় মনোযোগী হলো।
দীপ্তি তুমুল আফসোস করে বলল—
“কাশ, আমি ও যদি এমন একটা ঝাক্কাস মাল পিটিয়ে ফেলতে পারতাম, হায়!”
“ঝাক্কাস মাল আবার কী?”—ভ্রূ কুঁচকে বলল থিরা।
দীপ্তি কপাল চাপড়ে বলল—

“আরে তুই জানিস ওই যে ওদিকে দেখ।”—বলে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো দীপ্তি।
থিরা দীপ্তির আঙুল অনুসরণ করে দেখল, শুদ্ধ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে বিদেশী কিছু মানুষের সাথে কথা বলছে।
“দেখছিস? হায় হায়, আমি যদি প্রিয় আপুর জায়গায় থাকতাম, তাহলে এখন লুঙ্গি কাঁধে উঠিয়ে ডান্স দিতাম।”
থিরা মুখ বেঁকিয়ে বলল—
“চুপ ডাইনি, নজর সরা। ওটা এক পিসই আছে।”
দীপ্তি থিরার কথায় পাত্তা না দিয়ে প্রিয়তার হাত ধরে বললো—
“আপুরে, তুমি বলো, তোমার ফিলিংস কী?”
প্রিয়তা এবারও ওদের কথার প্রতিউত্তর করল না। ওর হাতে মেহেদি দেওয়া শেষ বিধায় কাউকে কিছু না বলেই উঠে চলে গেলো।
সকলে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছিল। কিন্তু হঠাৎ প্রিয়তাকে এভাবে চলে যেতে দেখে অবাক হলো মেয়েরা—

“এটা কী হলো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে থিরা সেও উঠে চলে গেল। এবার আরো বেশি অবাক হলো দীপ্তি—
“কী অদ্ভুত!”
“এই তো থিরা, শোনো।” থিরা কে নিচে নামতে দেখে ঢেকে উঠলো দেবী।
“জি, আপু।”
“আবির্ভাবকে দেখছো কোথাও?”
“জি, আপু। ভাইয়াকে মাত্র কিছুক্ষণ আগেই নিচে নামতে দেখলাম। হয়তো ঘরে গেছেন।”
“ঠিক আছে।” বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না; দেবী ছুটে নেমে গেলো নিচে। সে অনেকক্ষণ ধরে আবির্ভাবকে পাগলের মতো খুঁজছে, কিন্তু আবির্ভাব যেন কোথাও কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেছে।
“আবির্ভাব, তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি!” আমি, বলে দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করলো দেবী; কিন্তু ঘরের ভেতর দেখে অবাক হলো, কারণ কোথায় আবির্ভাব নেই—ঘর তো পুরো ফাঁকা। দেবী বারান্দায় খুঁজে, ওয়াশরুমেও দেখলো, কিন্তু সেখানে ও নেই।

খানিকটা বিরক্ত হলো দেবী; চোখের পলকে মানুষ কিভাবে গায়েব হয়ে যায় বুঝতে পারলো না। সে এদিকে পূজারিণী রায়চৌধুরীকে অস্থির করে দিচ্ছেন আবির্ভাবের সাথে কথা বলানোর জন্য। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল দেবী; ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে ও কিছু একটা দেখে থেমে গেলো—তার নজর পড়লো ড্রেসিং টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কালো চামড়ার ওয়ালেটটার দিকে। দেবী পুনরায় দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে এগিয়ে গেল; ড্রেসিং টেবিলের কাছে ওয়ালেটটা হাতে নিয়ে বললো—
“এটাও ফেলে গেছে।”

দেবী ওয়ালেটটা ড্রয়ারে রাখতে গিয়ে থেমে গেলো; কিছু একটা ভেবে পুনরায় ড্রয়ার বন্ধ করে দিলো। সন্দিহান চোখে ওয়ালেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললো—
“এটা একটা ছোটখাটো রহস্য; আজকেই সুবর্ণ সুযোগ।”
“এতে কি এমন খাজানা আছে যার জন্য এতে আমায় হাত লাগাতে দেয় না আবির্ভাব?”
দেবী পিছনে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো আবির্ভাব আসছে কিনা, কিন্তু কাউকে আসতে না দেখে স্বস্তি পেলো। আস্তে করে ওয়ালেটের ভাঁজ খুলে দেখলো; কিছু ক্যাশ আর কিছু কার্ড পড়ে আছে। পকেটের এমন গড়ের মাঠ অবস্থা দেখে হতাশ হলো দেবী।

অন্য সাইডগুলো দেখার উদ্দেশ্যে ওয়ালেটের উপরে ট্রান্সপারেন্ট অংশ থেকে হাত সরাতেই চমকে উঠল দেবী—হঠাৎ এমন কিছু দেখলো যা সে কখনও কল্পনাতেও আনেনি। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হলো না দেবীর; সে তড়িঘড়ি করে পাসপোর্ট সাইজ ছবি টা বের করে ভালো করে চোখের সামনে মেলে ধরলো। ছবির মুখটা দেখে দুনিয়া দুলে উঠলো দেবীর; ছোট্ট একটা ছবি, যার মধ্যে হালকা গোলাপি শাড়ি পরিহিত অতি সুন্দরী এক নারী হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে। দেবীর হাত কাপল; চোখের মনি ঝাপসা হয়ে এলো; সহসাই শঙ্কিত হলো হৃদয়।
“শ্বেতা তো আবির্ভাবের বন্ধুর বোন, তাহলে ওর সাথে আমার স্বামীর কি এমন সম্পর্ক থাকবে যার জন্য এতো যত্ন করে তার ছবি ওয়ালেটে রাখতে হবে?” দেবী পাগলের মতো ওয়ালেট ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ পেলো। দেবী কাঁপা হাতে কাগজটা হাতে তুলে নিলো; অজানা আশঙ্কায় তার শরীর কাঁটা দিচ্ছে; ভয়ে জমে যাচ্ছে হৃদপিণ্ড—অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখার ভয় হচ্ছে।
দেবী সোফায় বসে আস্তে করে কাগজের ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলো। কাগজে লেখা ছিল—

“পাগলের ডাক্তাররা পাগল হয় শুনেছিলাম, কিন্তু পাষাণও যে হয় জানতাম না; তা আপনি প্রমাণ করে দিলেন, আবির্ভাব।
আপনি কি পরিমাণ নিষ্ঠুর; জানেন পুরো ৬ টা মাস হয়ে গেলো আপনাকে দেখি না। I Miss you আমার পাগলের ডাক্তার; তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসুন না।
আপনার মাই লাভ, আপনার অপেক্ষা করছে। I really love you Abirvab, I really miss you.”
“Date 10/08/2026”
লেটারটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো দেবী; চোখে পানি টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগলো; নিঃশ্বাস যেন আটকে এলো কণ্ঠনালীতে। যা ভেবেছিল তাই।
চিত্কার দিয়ে কেঁদে উঠলো দেবী; আহাজারি করে বলতে লাগলো—

“এটা হতে পারে না! আবির্ভাব অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না; আমি আবির্ভাবকে ভালোবাসি। আমি তার বউ।”
দেবী কয়েক মুহূর্ত কেঁদে হঠাৎ থেমে গেলো; পাগলের মতো চোখ মুছে বললো—
“এই জন্যই আবির্ভাব কখনো আমায় মেনে নেয়নি; কখনো আমায় ভালোবাসেনি।”
দেবী ওয়ালেট ফেলে দৌড়ে গিয়ে নিজেদের আলমারি খুললো। আবির্ভাবের গুছিয়ে রাখা জামাকাপড়গুলো ঘেঁটে নিচের ড্রয়ারের চাবি বের করলো। তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও তাদের মধ্যে প্রাইভেসি অনেক; আবির্ভাব তার সব দায়িত্ব দক্ষতার সহিত অক্ষর-অক্ষরে পালন করলেও নিজের পার্সোনাল জিনিসগুলো খুব একটা ধরতে দিতো না।
দেবী ড্রয়ারটা খুলে দেখলো বেশ কিছু পেপারস আর মেডিকেল সার্টিফিকেটস এগুল সব আবির্ভাবের। দেবী সব এলোমেলো করে দেখতে গিয়ে একটা কাগজে মোড়ানো বড় খাম পেলো। সেটা হাতে নিয়ে ফিল করলো—এর মধ্যে কাগজ নেই। দেবী পাগলের মতো খামটা ছিঁড়ে দিতেই ভিতর থেকে ১০০-এর বেশি ছবির অর্ধেকটা হাত ফসকে মেঝেতে পড়লো।

পড়ে যাওয়া ছবিগুলোকে তবৎ দেখে দেবী পাথর হয়ে গেলো; ধপ করে বসে পড়লো টাইলসের মেঝেতে; কাঁপা হাতে তুলে নিলো ছবি গুলো। প্রত্যেকটা ছবি যেন দুজন যুগলের গভীর প্রেমের নিঃশব্দ চিহ্ন; প্রতিটা ছবিতেই বেশ ঘনিষ্ট অবস্থার দৃশ্য—কোনোটাতে কপালে চুম্বনের দৃশ্য, তো কোনটাতে গালে, আবার কোথাও তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে হাত ধরে আছে, জড়িয়ে ধরে আছে—এমন অসংখ্য দৃশ্য ফুটে উঠছে ছবিগুলোতে।
দেবী এবার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু স্পষ্ট করে বুঝলো; সব রহস্য আজ তার কাছে পানির মত ক্লিয়ার। কোন কিন্তু বা কেন নেই আর; এটা ও বেশ বুঝলো—এবার তাকে কি করতে হবে।

সারাবাড়িতে এত মানুষের ভিড়ে কোথাও একটু শান্তি নেই; দু’দণ্ড নিজের মতো দাঁড়ানোর জায়গা নেই; নিজের মতো লুকিয়ে একটু কাঁদারও জায়গা নেই। প্রিয়তা বড় ছাদ থেকে নেমে এসে তিন তলার মাঝারি ছাদের এক কোণায় বসে আছে। চারিদিক ফেরি লাইটের রঙিন আলোয় ঝলমল করছে; ধমকা হাওয়ায় দুলছে ঢেউ খেলানো খোলা চুলগুলো। প্রিয়তা এক কর্নারে বসে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে; হাতে মেহেদি এখনো শুকায়নি।

“দেখতে দেখতে আজকের দিনটাও চলে গেলো, আর ৪০ ঘন্টাও বাকি নেই। প্রণয় ভাই, আপনি এখনো এলেন না—আমার কাছে একবারের জন্যও বললেন না ‘জান, তুই এই বিয়েটা করিস না; তুই শুধু আমার’।
আপনি একদিন খুব আফসোস করবেন, প্রণয় ভাই—খুব আফসোস করবেন। আর মাত্র কালকের দিন বাকি; এর পর আমি চিরতরে অন্য কারো হয়ে যাবো। তখন হয়তো আপনি আমাকে চাইবেন, কিন্তু পাবেন না। আমি ৬ টা বছর জলে পুড়ে মরেছি—অপমানের আগুনে, লাঞ্ছনার আগুনে, বঞ্চনার আগুনে ভালবাসা না পাওয়ার আগুনে, তবু ও আপনাকে চেয়েছি। কিন্তু দিন শেষে আমি ভুল—আপনি আমায় ভালোবাসেন কি না জানি না; তবে যদি না বাসেন, তাহলে ঠিক আছে; আর যদি বাসেন, তাহলে খুব বাজেভাবে মরতে চলেছেন।”
প্রিয়তা মেহেদি পরা হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো। সে জানে না কাল তার জীবনে কি হবে বা হতে চলেছে; সে শুধু জানে—হয়তো তার সীমিত জীবনের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে; তবে সমাপ্তি ঘটবার পূর্বে এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে।

“আপু, আপু! বড় ভাইয়া আপনাকে ডেকেছেন।” একটি ছোট্ট মিষ্টি কণ্ঠে ঘোর কাটলো প্রিয়তার। সে পাশে তাকিয়ে দেখলো একটা বয়স ১০–১১-এর বাচ্চা মেয়ে গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে তার পানে; হয়তো বিয়েতে এসেছে।
প্রিয়তা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—
“বড় ভাইয়া কে, আপু?”
“ওই যে—এই বাড়ির বড় ভাইয়া। অনেক বড়।”
“প্রিয়তা, মেয়েটার হাত টেনে কাছে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বললো—এই বাড়িতে তো সবাই বড়, আপু।”
“আরে, একটা ভাইয়া আছে না—অনেক বড়, অনেক লম্বা, অনেক সুন্দর। ওই সকলেই ‘দাদান, দাদান’ বলে ডাকে না; ওই ভাইয়াটা।”
মেয়েটার কথায় চমকে উঠলো প্রিয়তা; বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা পুনরায় বললো—
“ওই ভাইয়াটা তোমায় যেতে বলেছে।”
মেয়েটার কথায় হুট করে মন ভালো হয়ে গেল; প্রিয়তার খুশিতে চোখ চিক চিক করে উঠলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আশা ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো—

“সত্যি?”
বাচ্চা মেয়েটা ওপর-নিচ মাথা ঝাকালো।
প্রিয়তা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো—
“কোথায়?”
“ওই যে, ওখানে।”
“কোথায়?”
“স্টোর রুমের সামনে।”
প্রিয়তা অতিমাত্রার খুশিতে হিতাহিত জ্ঞান হারালো; সাত-পাঁচ বাজ বিচার না করে দৌড়ে চলে গেলো নিচে।
সিকদার বাড়ির পশ্চিম দিকের করিডোরে শেষ প্রান্তের বিশাল কক্ষটাই এই পুরো বাড়ির অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জমা রাখার একমাত্র ঠিকানা, যা বেশিরভাগ সময় তালাবদ্ধ থাকে এবং বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কেউ যাওয়া-আসা করে না। তাই এই সাইডটা খানিক অন্ধকার।

প্রিয়তা পাগলের মতো ছুটে এলো অন্ধকারাচ্ছন্ন স্টোর রুমের সামনে। রাত অনেক হয়েছে বিধায় সকলে রাতের খাবার খেতে চলে গেছে, তাও আবার বাড়ির বাইরের সেই মাঠে। তাই খুব একটা মানুষজনও নেই বর্তমানে।
প্রিয়তা স্টোর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে ডাকলো,
“প্রণয় ভাই!”
শব্দ করার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে প্রিয়তাকে ঢুকিয়ে দিলো স্টোর রুমের ভিতর। অসাবধানতায় তাল সামলাতে পারলো না, মুখ থুবড়ে পড়লো নোংরা, ধুলোজমা অপরিষ্কার মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের কনুইয়ের কিছু অংশ ছিড়ে গেল। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো প্রিয়তা।
চোখে পানি জমা হলো, শব্দ করার পূর্বেই কেউ শক্ত করে চেপে ধরলো উন্মুক্ত চুলের মুঠি। চেপে ধরার তীব্রতায় ব্যথায় কুঁকিড়ে উঠলো প্রিয়তা। অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না। ব্যথাতুর আর্তনাদ করে বললো,

“কে?”
কিন্তু অন্ধকারে কোনো জবাব ভেসে এলো না।
প্রিয়তা পুনরায় নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“কে আপনি? কথা বলছেন না কেন? আহ ছাড়ুন আমায়, লাগছে আমার! আমার প্রণয় ভাই কোথায়?”
এবার সেই আগন্তুক প্রিয়তার চুল ছেড়ে আচমকা গলা টিপে ধরলো। গা’ বড়ে গেল প্রিয়তা। অন্ধকারে মুহূর্তেই ধস্তাধস্তি লেগে গেল দুজনের মধ্যে।
গলা চেপে ধরাতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো প্রিয়তার। গলার রক্ত সরে গিয়ে বিবর্ণ কাশি শুরু হয়ে গেল। আগন্তুক গলা চেপে ধরে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে লাগলো প্রিয়তাকে। প্রিয়তা নিজেকে বাঁচানোর বা আঘাত প্রতিহত করার সুযোগটাই পাচ্ছে না। ছটফট করছে অবিরাম। কাশির সঙ্গে বুঝি এবার রক্ত উঠে আসবে, গলার রগটা ছিঁড়ে যাওয়ার পর্যায়।

“কে? কে ওখানে?”
হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে পুরুষালি শব্দ ভেসে আসতেই আগন্তুক প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়, আলগোছে দূরে সরে দাঁড়ায়। প্রণয় ধাড়াম করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ভিতর থেকে প্রিয়তার ফুপিয়ে কান্নার শব্দ স্পষ্টভাবে ভেসে আসছে। সেই হৃদয় নিংড়ানো কান্না কর্ণগোচর হতেই অন্তর জ্বলে উঠলো প্রণয়ের।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
“জান!” — বলে চিৎকার দিয়ে অন্ধকারে ছুটে এলো প্রণয়।
আগন্তুক নিঃশব্দে সরে গেল সেখান থেকে।
প্রণয় কণ্ঠ পেতেই এবার শব্দ করে কান্না করে দিলো,“প্রিয়তা!”
একরাশ অভিমান এসে জমা হলো মনে — “এই লোকটা আবারো বাঁচাতে এসেছে।”
নিজের জান পাখির সশব্দ কান্না শুনে কলিজা মুচড়ে উঠলো প্রণয়ের। অস্থিরতায় চেয়ে গেল হৃদপিণ্ড। প্রণয় উদ্বিগ্ন কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ডাকল,

“আমার জান, তুই কোথায়?”
প্রণয় পাগলের মতো অন্ধকারে কয়েক পা এগোতেই প্রিয়তার হাতের কব্জিতে পা ঠেকে, থমকে যায় প্রণয়। নিজের প্রাণের অস্তিত্ব পেয়ে অন্ধকারে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে মেঝেতে।
মারের ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে প্রিয়তা। কান্না মিশ্রিত ভেজা কণ্ঠে ডাকে,
“প্রণয় ভাই!”
প্রণয়ের মনে হলো কেউ তার কলিজায় বিষ মাখানো ধারালো কোন অস্ত্র ঢুকিয়ে দিল। হুট করেই সে অন্ধকারে ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তাকে নিজের বুকে। যেন প্রাণ পাখিটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে সব সমস্যার অবসান।
প্রণয়ের উষ্ণ বুকের আদরে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না প্রিয়তা। দুই হাতে প্রণয়ের বুকের পাঞ্জাবি মুঠো করে ধরলো। প্রণয় এক হাতে প্রিয়তার পিঠ জড়িয়ে, অন্য হাত মাথায় রাখলো। সান্ত্বনা দিয়ে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“তুই এখানে কী করছিস, পাখি? আর এভাবে মেঝেতে পড়ে কাঁদছিস বা কেন? বল আমায় জান, কেউ তোকে কিছু বলেছে?”

কান্নার তোড়ে প্রিয়তা জবাব দিতে পারলো না। পাঞ্জাবির মুঠো ছেড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো প্রণয়ের পুরুষালি পিঠ, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।
প্রিয়তার ঊর্ধ্ব গতিতে চলা হার্টবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রণয়। তার চতুর মস্তিষ্ক বলছে, এখানে বিশেষ কিছু হয়েছে। প্রণয় প্রিয়তাকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কিন্তু ছাড়তে চাইলো না প্রিয়তা।
**এটাই হয়তো শেষবার… এমন সুযোগ হয়তো এ জীবনে আর কখনো আসবে না।**
এই বুকে হয়তো আর কোনো দিন সে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে না, সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারবে না, ভয় পেলে মুখ গুঁজে বসে থাকতে পারবে না — এই ঘ্রাণ হয়তো আর পাওয়া হবে না।
প্রিয়তার পাগলামি অবলোকন করে কষ্ট পেল প্রণয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ছাড়, জান। দেখতে দে আমায় কী হয়েছে।”

প্রিয়তা তবুও ছাড়লো না। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে অশান্ত কণ্ঠে বললো,
“কিছু হয়নি। প্লিজ, যাবেন না প্রণয় ভাই। এভাবে থাকুন কিছুক্ষণ। আমার এতো ভালোবাসার আর কেউ নেই, প্রণয় ভাই। আপনি আমার শেষ আশ্রয় ছিলেন, তাও তো কেড়েই নিলেন। শেষবার আমাকে একটু থাকতে দিন আপনার বুকে। এই বুকটা আমার খুব আপন, প্রণয় ভাই, খুব আপন। এই বুকে যে শান্তি, সে শান্তির এক কণাও এই দুজাহানের কোথাও নেই।”
বলে প্রণয়ের বুকের গভীরে মুখ গুঁজে দিলো প্রিয়তা।
প্রণয়ের বুক কাঁপছে। চোখের কোণায় জমছে শরতের কালো মেঘ। মন ও শরীর দুটোই দুর্বল হয়ে আসছে এই নারীর পরশে।

“প্লিজ, প্রণয় ভাই, একটু ভালোমতো জড়িয়ে ধরুন আমায়। বুকে নিন। মনে করুন, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। মানুষ তো ফাঁসির আসামিরও শেষ ইচ্ছা পূরণ করে।”
ওর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কম্পিত কণ্ঠে ধমকে উঠলো প্রণয়,
“একদম চুপ। কী উল্টাপাল্টা বলছিস? মাথা ঠিক আছে?”
“ঠিক নেই তো। প্লিজ, আই উইল ফিল ইউ, প্রণয় ভাই। আপনাকে শেষবারের মতো একটু অনুভব করতে দিন আমায়। একটু ভালোবাসুন আমায়।”
প্রণয় আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। নিজের দুই বাহু দ্বারা প্রিয়তার মোমের শরীরটা প্রশস্ত বুকে শক্ত করে চেপে ধরলো। নিজের ছোট্ট প্রাণটা বুকে নিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো প্রণয়। জড়িয়ে ধরতেই যেন নরম শরীরটা মিলিয়ে গেল প্রাণয়ের অস্তিত্বে।

“আমাকে ভালোবাসেন, প্রণয় ভাই? প্লিজ বলুন। আজ আর চুপ করে থাকবেন না।”
“ও প্রণয় ভাই, প্লিজ বলুন না। আমি মরে যাবো আপনাকে ছাড়া। আমি নিতে পারবো না অন্য কারো ছোঁয়া।”
“আপনি ব্যতীত, দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আমাকে ছুঁবে, আমি সইতে পারবো না সেই যাতনা।”
“আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ কর, জান।” আর না পারতে আহত কন্ঠে ধমকে উঠলো প্রণয়।
প্রিয়তার কণ্ঠ নির্গত একেকটা বাক্যে প্রণয়ের মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজাটা শত শত টুকরোতে খন্ডিত করছে। সে পাপী, এটা সে শিকার করে, কিন্তু তার শাস্তি এতোটা ভয়াবহ যা সইতে পারছে না প্রণয়ের রুহ।
প্রিয়তা চুপ করলো না। পুনরায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, “প্লিজ বলুন না। একটাবার বলুন না আপনি আমায় ভালোবাসেন। আমি একা না। আপনিও আমায় ভালোবাসেন। দেখবেন, সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমি শুধু আপনার হয়ে থাকবো।”

প্রণয়ের গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। তবুও সে নিজেকে সামলে বহু কষ্টে বললো, “আমি তোকে ভালোবাসি না, জান। পাগলামি করিস না।”
আর কিছু বললো না প্রিয়তা। প্রণয়ের বুকে মুখ গুঁজে নীরবে পড়ে রইল। বাধনহারা চোখের পানিতে বুক, গলা, সব ভেসে যাচ্ছে। প্রণয়ের সয্যের বাঁধ ভাঙছে। এখানে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক করবে সে। তাই এখানে আর এক সেকেন্ডও নয় ভেবে প্রিয়তাকে জোর পূর্বক নিজের থেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রণয় দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো । একবারের জন্য ও আর পিছন ফিরে তাকালো না।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭

প্রিয়তা প্রণয়ের হাত ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু থামলো না প্রণয় তাকে নিঃসঙ্গভাবে একা ফেলে চলে গেল। প্রিয়তা মনের অসহ্য যন্ত্রণায় মেঝেতে শুয়ে পড়ে, গলাকাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগলো। এতকিছুর পরে ও জীবন সুন্দর।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৮