প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৯
ফিজা সিদ্দিকী
দরজাতে চাবি ঘুরিয়ে লক করে বিছানার উপর গিয়ে বসলো নাঈম। ইশারায় তনুজাকে কাছে ডেকে বলল,
“যেভাবে নিয়ে এসেছেন সেভাবে খাইয়ে দিন। নাহয় ওভাবেই ফিরিয়ে নিয়ে যান।”
“দরজা খুলে দিন, আমি চলে যাচ্ছি।”
“উহু। আজ রাতে দরজা খোলা হবে না। এটা আপনার শাস্তি। সবাইকে জানিয়ে দেব আপনি সারারাত আমার সাথে একঘরে ছিলেন। এরপর সবাই মিলে আপনাকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। ব্যাপারটা সুন্দর হবে না?”
তনুজার চোখ উল্টে আসার উপক্রম নাঈমের প্ল্যানিং শুনে। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বললো,
“এসব বুদ্ধি কে দেয় আপনাকে?”
“আপনি”
“আমি?”
“ইয়েস। স্বপ্নে এসে এভাবেই কুবুদ্ধি দিয়ে যান আপনি। আরও কত কি বলেন।”
তনুজা ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আর কী বলি?”
নাঈম বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিয়ে গো ধরে বলে,
“ক্ষিদে পেয়েছে আমার। খাবার মুখে না গেলে কথা পেট দিয়ে বের হবে না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ক্যান আই ট্রাস্ট ইউ?”
তনুজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুর্জয়। চেহারায় মলিনতা, শরীর জুড়ে ক্লান্তির ছাপ। তুর্জয়ের মতো মানুষ দেয়ালে পিঠ না ঠেকে যাওয়া অব্দি যে তার দুয়ারে আসবে না, এ কথা বেশ জানা তনুজার। কোর্টের পাশে অবস্থিত একটা রেস্টুরেন্টের দিকে ইশারা করে সে বলে,
“খেতে খেতে কথা বলা যাক? ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে আমার।”
না করতে গিয়েও করতে পারলো না তুর্জয়। নিজের জন্য তনুজাকে অভুক্ত তো রাখতে পারে না সে। অগত্যা তনুজার সাথে এগিয়ে গেল সেদিকে।
দুটো লেমনেডের একটা তুর্জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে তনুজা বললো,
“খেয়ে নিন। গলা শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে আরাম পাবেন।”
তুর্জয় একঢোকে শেষ করলো গ্লাসটা। এরপর তনুজার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গেলে সাথে সাথে একজন ওয়েটার এসে দাঁড়ালো তাদের টেবিলে। দুটো বোলে করে রামেন নিয়ে এসে রাখলো টেবিলের উপর। তনুজা খাবারের দিকে ইশারা করলো। বললো,
“খেয়ে নিয়ে কথা বলি?”
তুর্জয় বিরক্ত হলো বেশ। হাতি পাকে পড়লে চামচিকাও যে লাথি মারে, এ প্রবাদবাক্য বেশ পুরোনো। তবে তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে সে নিজের চোখের সামনে। তনুজা ইচ্ছেকৃত তাকে এসবের মাঝে আটকে রাখছে বুঝতে পেরে ধূসর রঙের শার্টের হাতা ফোল্ড করে ঝট করে কাছে টেনে নেয় সে বোলটা। অতঃপর ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে খেতে শুরু করে খাবারটা।
তনুজা আড়চোখে তাকায় তুর্জয়ের দিকে। ঠোঁটের কোণে তার ক্ষীণ হাসি। নিজের খাবারে মনোনিবেশ করে মনে মনে ভাবে,
“আপনাকে এভাবে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না স্যার। মাফ করবেন আমাকে।”
“মিস তনুজা, এখন কি আপনি আমার কথা শুনবেন?”
তনুজা চোখ তুলে তাকালো। তুর্জয়ের বোলটা ফাঁকা একেবারে। মনে মনে হাসলো সে। মুখে বলল,
“জি স্যার, বলুন।”
“আপনার একটা হেল্প লাগবে আমার।”
তনুজা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই জাওয়াদ শিকদারকে নিয়ে তার সন্দেহের সব ঘটনা একে একে তুলে ধরলো তুর্জয়। যতটুকু সে খোঁজ চালিয়েছে, যতটুকু সে আন্দাজ করেছে, সবটুকু জানালো। সবটা শোনার পর তনুজার মুখভঙ্গি বদলে গেল কেমন যেন। সন্ধিহান কণ্ঠে বললো,
“আপনার মনে হয় নন্দিতা বেঁচে আছে?”
“শুধু মনে হয়না। আমি শিওর।”
“এতটা শিওর কিভাবে?”
“খেয়াল করে দেখুন, ওই ইনসিডেন্টের পর থেকে জাওয়াদ শিকদার একেবারে গা ঢাকা দেওয়ার মতো করে উধাও। ফিরলেন যেদিন, সেদিন তার ফ্যাক্টরিতে রেড পড়েছে। সবকিছু কেমন যেন পাজেলের মতো লাগছে না আপনার?”
তনুজা নিজেও ভাবলো বিষয়টা নিয়ে। খটকা তারও লাগছে। যেন লোকটা এতদিন ইচ্ছেকৃত গা ঢাকা দিয়েছিল, আর এখন ফিরে এসেছে তাও নিজের স্বার্থে। জাওয়াদ শিকদারের মতো মানুষ গা ঢাকা দেওয়ার লোক নয়। তবে কি সত্যিই নন্দিতাকে সরিয়ে রেখেছে সে কোথাও?
“নন্দিতাকে যদি সত্যিই লুকিয়ে রাখে সে, তাহলে কোনো না কোনো সময় সেখানে যাবেই। আমাদের শুধু অপেক্ষা করতে হবে সে সময়ের।”
“আমাদের হাতে এতো সময় নেই মিস তনুজা। নন্দিতার লাপাতা হওয়ার গুণে গুণে সাত মাস চলছে এখন। এর বেশি অপেক্ষা করলে আমার সন্তান বেঁচে গেলেও আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারবো না।”
আচমকা তনুজার খেয়াল হলো নন্দিতা অন্তঃসত্ত্বা ছিল। চমকে তুর্জয়ের দিকে তাকালো সে। সাথে সাথে দেখতে পেলো একজন অসহায় স্বামী, লাচার বাবার করুণ প্রতিচ্ছবি। এই মানুষটা সেই অহংকারী, ঔদ্ধত্যে ভরপুর এডভোকেট তুর্জয় আহসান না। যার সাদা ধবধবে শার্টের চেয়ে কিরন ছড়াতো তার ব্যক্তিত্ব। যার বড় বড় পা ফেলে হেঁটে যাওয়া দেখেই ক্রাশ খেয়ে বসে থাকতো ল কলেজের সব স্টুডেন্ট। যার রাগী চোখে তাকালো দেখে ঘায়েল হতো অর্ধেক ক্লাসরুম। সেই ব্যক্তিত্ববান পুরুষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন নরম হৃদয়ের বাবা, স্ত্রী বিয়োগের শোকে কাতর একজন দায়িত্ববান স্বামী চরিত্রকে স্বচক্ষে দেখলো আজ তনুজা। আফসোস হলো তার। এই মানুষটাকে নিজের করে না পাওয়ার আফসোস সাথে মুদ্ধতার পশরা বাড়লো তার আরও খানিকটা। বিড়বিড় করে বললো,
“আপনাকে সব রূপেই এতো কেন মানায়? আপনি বিধ্বংসী যেমন ধ্বংস, বিধ্বস্ত তেমন স্নিগ্ধ।”
নারী নেশা জাওয়াদ শিকদারের পুরোনো এক অভ্যাস। শহরে বাইরে থাকলে এই নারী স্পর্শগুলো বড্ডো মিস করে সে। শহরের বেশ কিছু পার্লার আছে, যেখানে বডি ম্যাসাজের নামে অভ্যন্তরে চলে রঙ্গলীলা। সেখানের রেগুলার একজন ক্লায়েন্ট জাওয়াদ শিকদার। নারি শরীরের প্রতি তার কেমন যেন এক পাশবিক টান কাজ করে। নাহ! স্বাভাবিক কোনো নারী পুরুষের টান না। এটা যন্ত্রণার টান। নারীদেহকে যন্ত্রণা দিয়ে পাওয়া সুখের টান।
জাওয়াদ শিকদারের এই পশুসুলভ আচরণের জন্যই একটা সময় স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য শুরু হয় তার। আঘাতে আঘাতে মানসিক ও শারীরিকভাবে দূর্বল হয়ে স্বামীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে রোজ রাতে ধূসরকে বুকে টেনে নিয়ে ঘুমাতেন তিনি। যাতে ছেলের বাহানায় হলেও যেন লোকটা তার উপর অত্যাচার চালাতে না পারে। কিন্তু এর পরিণতি হলো ভয়ংকর। জাওয়াদ শিকদারকে শারীরিক শান্তি দিতে এগিয়ে এলেন তারই আপন ভাইয়ের বউ কামিনী। বস্তি এলাকা থেকে উঠে আসা এক লোভাতুর মহিলা কামিনী। এ সংসারের একমাত্র কর্তাধর্তা জাওয়াদ শিকদারকে হাতের বশে করতে হয়ে পড়লেন তার রক্ষিতা। লাবিব শিকদার অবশ্য এসবের কিছুই জানতেন না তখন। স্ত্রীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। স্ত্রীর কথায় অন্ধবিশ্বাসে গলা পর্যন্ত ডুবন্ত সে।
পার্লারে ঢুকতেই রিসেপশনের মেয়েটা আলতো হাসে জাওয়াদ শিকদারকে দেখে। আজ যে তাদের একটা মোটা অংকের লাভ হবে বুঝতে পেরেই গদগদ হয়ে আমন্ত্রণ জানায় তাকে।
ভিআইপি কক্ষের বিছানায় বস্ত্রবিহীন, শুধুমাত্র একটা চাদর গায়ে শুয়ে আছে জাওয়াদ শিকদার। আলো আঁধারি পরিবেশে জ্বলছে কয়েকটা সুগন্ধী মোম। পাশে দুজন অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে মালিশের নানান জিনিসপত্র রেডি করছে। অল্প সময়ের মধ্যেই রুমের পরিবেশ কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠলো। চোখ জ্বালা করে উঠলো। লাল হয়ে উঠলো চোখ। নেশা লেগে যাওয়ার মত ঘোর লেগে গেল যেন সকলের। সাথে সাথেই রিসেপশনের মেয়েটা সাথে করে নিয়ে আসে একজনকে। পুরো মুখ ঢাকা, চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না যার। সেখানে থাকা দুজন মেয়েকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বেশিক্ষণ সময় নেবেন না ম্যাম। খুব বিপদে পড়ে যাব আমি তাহলে। যা করার তাড়াতাড়ি শেষ করুন।”
তনুজা একটা চকচকে নোটের বান্ডিল মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে ধীরে কণ্ঠে বললো,
“বাইরের দিকটা সামলাও। আর এই খবরটা লিক হলে কি হবে মনে আছে তো?”
“আমার ছেলেটা অনেক ছোট ম্যাম। ওর কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ। আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো।”
তনুজা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। যেটা দেখতে পেল না সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা। শুধু বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা বুঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা জাওয়াদ শিকদারের কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া চাদরটা আরও খানিকটা উপরে টেনে দিতে দিতে তনুজা বললো,
“নন্দিতা কোথায়?”
জাওয়াদ শিকদার নেশাতুর ভঙ্গিতে পিটপিট করে তাকাচ্ছেন। যে কোনো মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারে। তনুজা সাথে সাথে ক্যান্ডেলগুলো নিভিয়ে দিলো। এর বেশি নেশা চড়ে গেল জ্ঞ্যান হারাবে সে। তার পেট থেকে আসল তথ্য বের করা সম্ভব হবে না তখন।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে তনুজা বারবার উচ্চারণ করতে শুরু করলো নন্দিতার নাম। জানতে চাইলো তার আস্তানা। একসময় অবচেতন মনে জাওয়াদ শিকদার বলল,
“ওই শালীকে কোথায় রেখেছি কেউ খুঁজে পাবে না কখনও। জাওয়াদ শিকদার এতো কাঁচা কাজ করে না। হাইওয়ের পাশের জঙ্গল পেরিয়ে যে আমার একটা ডেরা আছে কেউ জানেনা।”
কথাটা বলেই জোরে জোরে হাসতে থাকে সে। সাথে সাথে আবারো বলে ওঠে,
“শালীর যা তেজ। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়েছে গরুর মতো। পেট বাঁধিয়ে না রাখলে ওই শরীরের তেজ মিটিয়ে দিলাম শালীর।”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৫৮
তনুজা আর অপেক্ষা করলো না। যেটুকু জানার ছিলো সে জেনে গিয়েছে। মোমবাতির সাথে মেশানো ড্রাগ খুব বেশি পরিমাণে প্রবেশ করেনি জাওয়াদ শিকদারের শরীরে। তাই শরীর তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। জাওয়াদ শিকদারের হাতে ধরা পড়ার আগেই সেই জায়গা ছাড়লো সে।