তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩৯
অহনা আক্তার
হসপিটালের কেবিনে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মুসকান। হাতে ক্যানোলা লাগানো। ভয়ে তার মুখটা এই টুকুন হয়ে আছে। একটু পরেই তার সিজার করানো হবে। সেটা মনে করলেই মুসকানের সমস্ত শরীর শিরশির করছে, হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, বুক ঢিপঢিপ করছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কেবিনে বেশি মানুষ এলাও করা হয়নি বলে সকলেই কেবিনের বাইরে বসে আছে। নাতনির সিজার বলে রাতুলকে নিয়ে সকাল সকালই এরশাদ তালুকদার ঢাকায় চলে এসেছেন। তিনি কিছুক্ষণ মুসকানের মাথায় হাত বুলিয়ে মোলায়েম স্বরে কথা বলে এখন কেবিনের বাইরের চেয়ার গুলোতে বসে আছেন।
সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে জহিরও তার আব্বাজানের পাশে বসে আছেন। প্রথমবার দাদা হওয়ার আনন্দটা অন্যরকম। জামিল আর শিল্পী এইমাত্র হসপিটালে আসলেন। এসেই আগে মুসকানের সাথে দেখা করলেন। জিন্নাত আসেনি। কেন আসেনি সেটা জানতেও কারো বাকি নেই। ফারিশের ছোট মামা রাসেলও এসেছে আজ। তার বউ কেয়া ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। তাই অল্প কিছুক্ষণ থেকেই আবার চলে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দৌড়াদৌড়ি করে হসপিটালের সব ফর্মালিটিজ পূরণ করছে ফারিশ। একদিকে টেনশন অন্যদিকে তাকেই সব সামলাতে হচ্ছে। তাজমহল আর রাহিলা প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে সবকিছুই গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। রাহিলা বারবার মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিচ্ছে। শিল্পী বুঝাচ্ছে। তাজমহলও সাহস দিচ্ছে কিন্তু কারো কথা কানে তুলছে না মুসকান। সে কেঁদে কেঁদে বলছে বাড়ি চলে যাবে। সে সি’জার করাবে না। পে’ট কা*টতে দিবে না।
ওটিতে নিয়ে যাওয়ার আগে ফারিশের হাত চেপে ঢুকরে কেঁদে দিল মুসকান। ফারিশের চোখও লাল। কাল থেকে ফারিশের সাথে যতই কথা না বলুক, রাগ দেখাক,খিটমিট করুক। এখন আর সেটা করতে পারল না মুসকান। লোকটার ক্লান্ত,উদ্বিগ্ন চেহারা দেখে সে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারল না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ভেজা কণ্ঠে বলল,
— আমার স..সত্যিই খুব ভয় করছে।
মা, চাচি সকলের সামনেই মুসকানের কপালে চুমু দিল ফারিশ। ক্যানোলা লাগানো হাতটা মুঠোতে নিয়ে বলল,
— ভয়ের কিছু নেই। ভাবো যে তুমি তোমার বেবিদের আনতে যাচ্ছ। আর কিছুক্ষণ পরই তাদের তুমি ছুঁতে পারবে, চু’মু খেতে পারবে, কোলে নিতে পারবে। ওরা একসময় তোমাকে মাম্মা বলে ডাকবে। নরমাল ডেলিভারিতে তোমার লাইফ রিস্ক হবে মুসকান। সাথে বেবিদেরও ক্ষ’তি হবে। তুমি কি চাও তোমার বেবিদের ক্ষ’তি হোক?
মুসকানের দু’চোখ বেয়ে অবিশ্রান্ত পানি পড়ছে। সে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না বলল। ফারিশ মুচকি হেসে মুসকানের চোখের পানি মুছে দিল। কোমল স্বরে বলল,
— তাহলে? আর কাঁদবে না। ভালোয় ভালোয় আমার বেবিদের নিয়ে আসো। কথা দিচ্ছি আর কোনদিন বাচ্চা-কাচ্চার নামও নিব না।
ফারিশের শেষের কথাটায় হেসে দিল মুসকান। সিক্ত কণ্ঠে বলল,
— দোয়া করবেন।
ফারিশ পুনরায় মুসকানের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালো। তার চোখের কার্নিশ লাল। ঘন শ্বাস ফেলে বলল,” অবশ্যই ”
মুসকান কে ওটিতে ঢুকানোর সাথে সাথে ফারিশের অস্থিরতা শুরু হলো। সমানে পায়চারী করতে করতে বারবার ওটির দরজার দিকে তাকাচ্ছে সে। মুসকানের কিছু হবে না তো! এই টেনশন একমিনিটও তার মাথা থেকে যাচ্ছে না। মুসকান কে সাহস যুগিয়ে সে নিজেই এখন ভয় পাচ্ছে। ঘামে ভিজে ফারিশের শার্ট একাকার। বারবার উদ্বেগ হয়ে কপালের ঘাম মুছছে। নাতির এমন অস্থিরতা দেখে এরশাদ তালুকদার নিজেই ফারিশের দিকে এগিয়ে গেলেন। নাতির কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন,
— স্থির হও। তোমার বউয়ের কিছু হবে না। বসো এখানে। আমার পাশে। (এরশাদ তালুকদার ফারিশকে টেনে জোর করে উনার পাশে বসালেন) তাজমহল কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— ওকে একটু পানি খেতে দাও তো। পুরো আমার মতো হয়েছে। বউ ছাড়া একদমই চলে না।
এরশাদ তালুকদারের কথায় সবাই হেসে দিল।
পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট পর দু’টো নার্স তোয়ালে মোড়ানো সাদা ফকফকে দু’টো বাচ্চা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। নার্সদের কোলে থেকেই বাচ্চা দুটো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। ফাইজা এক কোনায় চুপচাপ বসে ছিল। বাচ্চাদের কান্না শোনে সবার আগে সেই দৌড়ে আসল। খুশিতে বাকবাকম হয়ে বলল,
— মা’আআআআ আমি ফুপিমণি হয়ে গেছি !!
দু’চোখে পানি চিকচিক করছে তাজমহলের। সেও দৌড়ে এসে সবার আগে একটা বাচ্চাকে কোলে নিল। যে নার্সটি থেকে নিয়েছে সেই নার্সটি বলল,
‘এটা বয়’ অপর নার্সটির কোলের বাচ্চাটি দেখিয়ে বলল, ‘ওটা গার্ল’
আত্মহারা হয়ে নাতির মুখে চু’মু খাচ্ছে তাজমহল। শিল্পী অন্য নার্সটি থেকে বাচ্চাটা কে কোলে নিয়ে রাহিলার কাছে নিয়ে আসলো। একটা চেয়ারে বসে মেয়ের জন্য কাঁদছিল রাহিলা। নাতনির মুখ দেখে এবার জোরেই কেঁদে দিল। একে একে জহির, এরশাদ তালুকদার, জামিল, রাতুল, ফাইজা সবাই বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাই যখন বাচ্চাদের নিয়ে হাসছে, খেলছে, মজা করছে, তখন রাতুল চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ফারিশকে খোঁজলো। না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,
— আচ্ছা ফারিশ ভাইয়া কোথায়?
রাতুলের কথায় বাকি সবাইও চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ফারিশকে খোঁজতে লাগল। বাচ্চাগুলোর কান্না ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। তাজমহল বলল,
— তাই তো! এতোক্ষণ তো এখানেই ছিল।
— আমি এখানে মা।
মাথা থেকে টুপিটা নামাতে নামাতে কথাটি বলল ফারিশ। সে এতোক্ষণ হসপিটালের নামাজ ঘরে ছিল। নামাজ পড়তে গিয়েছিল। ছেলেকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলল তাজমহল,
–‘দেখো ফারিশ তোমার ছেলে। আমাদের দাদুভাই, দিদিভাই দুটোই হয়েছে। একদম তোমার মতো দেখতে।’
তখনই তাজমহলের কোলে থাকা বাচ্চাটি কেঁদে উঠল। একটা কাঁদতে এক মিনিটও দেরি করল না সাথে সাথে অপর বাচ্চাটিও কেঁদে উঠল। বাচ্চাদের কান্না শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল ফারিশের। ঘোলা চোখে তাকালো তাদের দিকে। প্রাণ ভরে দেখল,, তার বাচ্চা, তার কলিজারা। তাদের কান্না শুনতেও তৃপ্তি লাগছে।
নার্সদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের ব্যকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিশ,
— আমার ওয়াইফের কি অবস্থা? ওহ কেমন আছে?
ফারিশের কথায় বাড়ির সবার টনক নড়ে। তাই তো! বাচ্চাদের পেয়ে তো তারা মুসকানের কথা ভুলেই গিয়েছিল!
একটি নার্স বলল,
— আপনার ওয়াইফের অবস্থা খুব খা’রাপ হয়ে গিয়েছিল। অল্প বয়সে বেবি নেয়ার জন্য আর অতিরিক্ত র*ক্তক্ষরনের জন্য উনার খি*চুনি এসে পড়েছে।
পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করে উঠল ফারিশের। দৃষ্টি ছলছল। বিদ্যুৎ গতিতে বলল,
— এ..এখন, এখন কেমন আছে ওহ?
— ব্লা*ড দেওয়া হচ্ছে। খি*চুনিও কমেছে। এখন আশঙ্কা মুক্ত। একটু পরেই কেবিনে দেয়া হবে।
বুক থেকে বড় মাপের একটা পাথর নেমে গেল ফারিশের। সকলেই শান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
মুসকান কে কেবিনে দেয়ার পর একে একে সবাই তার সাথে দেখা করল। ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে শুয়ে আছে মুসকান। তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে। গলা শুকিয়ে চৈত্রের খরায় পরিণত হয়েছে। বারবার পানি পানি করছে কিন্তু তাকে কোনো নার্সই পানি দিচ্ছে না। কাঁদতে কাঁদতে মুসকান তার আম্মাকে রিকুয়েষ্ট করল,
— আম্মা আমাকে একটু পানি দিতে বলো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এক ফোঁটা, শুধু এক ফোঁটা পানি জিহ্বার আগায় ছুঁয়াবো।
রাহিলা কিছু বলার আগেই একজন নার্সের কড়া সুর শোনা গেল ,
— একদম না। মা’য়া করে কেউ পানি দিবেন না। উনাকে এখন পানি খাওয়ানো নিষেধ।
মুসকানের চোখের কার্নিশ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়ছে। মা হওয়া এতো ক’ষ্টের কেন!
____সারাটা দিন না খেয়ে, ছটফট করে, নীরবে কান্না করে কাটালো মুসকান। মাঝ রাতে ফারিশ মুসকানের সাথে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ পেল। মুসকান তখন চোখ বুঝে শুয়ে ছিল। ফারিশ মুসকানের উপর ঝুঁকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ খুলে ফারিশকে নিজের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে ক্ষীণ হাসল মুসকান। মৃদুস্বরে বলল,
— এমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে কেন?
ফারিশ কিছু না বলে মুসকানের একটি হাত তার হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরল। একনাগাড়ে হাতের উল্টো পিঠে কয়েকটি চু’মু খেয়ে ফিচেল স্বরে বলল,
— খুব ক’ষ্ট হচ্ছে তাই না?
মুসকান আবারো হালকা হাসল,
— কই না তো! আমার তো সুখ সুখ লাগছে বেবিদের দেখে! আপনি ওদের কোলে নিয়েছেন?
ফারিশ দু’দিকে মাথা নাড়ালো,
— ভয় লাগে। ওরা যেই ছোট যদি পরে যায়!
ফারিশের কথায় একটু জোরে হাসতে গিয়ে পে’টে টান অনুভব করল মুসকান। ব্যথায় চোখ খিচে বন্ধ করে আবার খোলল। ফারিশ ব্যথিত নয়নে তাকালো মুসকানের দিকে । লহু স্বরে বলল,
— তোমার সব ব্যাথা আমার হোক। জলদি সুস্থ হয়ে যাও বাবুদের আম্মা।
পরদিন সকালে ফারিশের সকল বন্ধু-বান্ধবিরা বেবিদের দেখতে আসলো। হাতে নিয়ে আসলো নানান ধরনের ফলমূল, গিফট। বেবিদের জন্য এতো এতো গিফট নিয়ে এসেছে যে পুরো বেড ভরে গিয়েছে। বেবিদের নিয়ে ফারিশের বন্ধু-বান্ধবিদের মাতামাতি,আনন্দ দেখে মুসকানেরও খুব ভালো লাগলো। সব থেকে বেশি অবাক হলো মুসকান তাদের সাথে হিয়া কেও আসতে দেখে। মেয়ে বেবিটাকে কোলে নিয়ে হিয়া বারবার ফারিশের দিকে তাকাচ্ছে। দৃশ্য টুকু চোখ এড়ালো না মুসকানের। মেয়েটি যত ভদ্র হয়েই থাকুক না কেন। তাকে এখানে দেখে মুসকানের ভালো লাগছে না। কেমন যেন গা জ্বলছে। হিয়া যেন সবই বুঝলো। তাই তো যখন সবাই আড্ডা দিতে, কথা বলায় ব্যস্ত তখন সে মুসকানের পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলল,
— হেই লাকি গার্ল মুসকান। আমাকে এখানে দেখে তোমার খুব রাগ হচ্ছে তাই না?
মুসকান চুপ হয়ে রইল। হিয়া অস্পষ্ট হেসে বলল,
— আমি বুঝতে পারছি তোমার রাগ হচ্ছে। আমারও হচ্ছে? ভিষণ জ্বলছে বুকের ভিতর টা। এই যে দেখো কত ক’ষ্ট করে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি। কেউ আমাকে এখানে আনতে চায়নি জানো? আমি খুব জোর করে এসেছি। তুমি যেই জন্য আমার প্রতি রেগে আছো সেটা কিন্তু অনর্থক। এখানে আসার পর ফারিশ কিন্তু একবারের জন্যও আমার দিকে তাকায়নি। বরং আড়চোখে বারবার তোমার দিকে তাকাচ্ছে। তুমি এতো লাকি কেন মুসকান? (হিয়ার চোখে পানি) মুসকান অবাক হয়ে তাকাতেই পানি টুকু মুছে নিয়ে ভাঙা কণ্ঠে বলল , — এতো সহজে ফারিশকে কি করে পেয়ে গেলে মুসকান? তাকে পেয়েছো! তার সন্তানের মা হয়েছো! তার ভালোবাসা পাচ্ছ,যত্ন পাচ্ছ,স্পর্শ পাচ্ছ। হাউ লাকি ইউ আর! আমার তোমাকে খুব হিংসে হয় খুবব। ফারিশ যদি ❝তোমার মুগ্ধতায়❞ না আটকাতো না…. আমি যে কোনো মূল্যে ওকে আমার করে ছাড়তাম। কিন্তু আফসোস সে তোমাতে আসক্ত। অনেক চেষ্টা করেছি জানো? ওকে আমার করতে! আমার দিকে ফেরাতে। কিন্তু পারিনি। সে তুমি ছাড়া কিছু বুঝে না। কে জানে কি পেয়েছে তোমার মাঝে!
মুসকান বিরক্ত স্বরে বলল,
— আপনি এগুলো আমায় কেন বলছেন?
হিয়া হাসে। চোখের কোণায় জমে থাকা পানি টুকু মুছে বলে,
— বলছি কারণ না চাইতেও যেই মহামূল্যবান জিনিসটা পেয়েছো সেটা যত্নে রেখ। আমি পরশু অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি। আর কখনো এই দেশে ফেরা হবে কিনা জানি না। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমাকে,ফারিশকে আর তোমাদের মিষ্টি বেবিদেরকে দেখে গেলাম। আমার জন্য দোয়া করো?
মুসকান অবাক হয়ে বলল,
— আপনি চলে যাচ্ছেন?
— হ্যা। তোমরা ভালো থেকো।
টয়া জোর গলায় হিয়াকে ডাকল,
— কিরে হিয়া। যাবি না নাকি? আমরাতো চলে যাচ্ছি।
হিয়া উঠে দাঁড়াল। মুসকানের হাতে একটা গিফটের বক্স দিয়ে বলল,
— চলে যাচ্ছি। এটা তোমার বেবিদের দিও।
সকলেই মুসকান আর ফারিশের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
প্রায় চারদিন পর মুসকান কে বাসায় নিয়ে আসা হলো। বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে আসা মাত্রই হৈ-হুল্লোড় পরে গেল । জহির, তাজমহল, ফাইজা সবাই সবকিছু ফেলে বাচ্চাদের নিয়েই পরে থাকে। মুসকানের যত্ন যেন আগের তুলনায় আরো তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ফারিশ। নিজের হাতে তাকে খেতেও হয় না এখন। মাঝে মধ্যে মুসকানের মনে হয় হিয়া মেয়েটা এক বিন্দুও ভুল বলেনি তাকে। সত্যিই সে ভাগ্যবতী। ফারিশের মতো এমন একজন স্বামীকে পেয়ে তার জীবন পরিপূর্ণ।
বাচ্চাদের সবকিছু এখন তাজমহল আর রাহিলা সামলান । সে শুধু খাওয়ার সময় আর রাতে ঘুমানোর সময় বাচ্চাদের কাছে রাখে। রাহিলা প্রায় এক মাসের মতো মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে নাতি-নাতনীদের সামলানোর জন্য থেকে ছিল। যেদিন চলে গেল এর ঠিক পরের দিনই আবার নাতি-নাতনীদের টানে ফিরে আসলো। মুসকান কে কিছুদিনের জন্য গ্রামে নিয়ে যেতে চাইলে এবার জহির আর তাজমহল বাঁধ সাধলেন । তারা তাদের নাতি-নাতনীদের ছাড়া থাকতে পারবেন না। অগত্যা রাহিলা আরো দু’দিন থেকে নাতি নাতনী কে চু’মু, আদর, ভালোবাসা, চোখের পানিতে মুড়িয়ে রেখে চলে গেলেন। মা চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকদিন মুসকানের খুব ক’ষ্ট হলো। বাচ্চা গুলোও যেন তাদের নানুকে মিস করতে লাগল। চল্লিশ দিনের দিন খাসি এনে বড় আয়োজন করে বাচ্চাদের আকিকা দেয়া হয়। জিন্নাতও এসেছিল সেদিন। কিন্তু কারো সাথে দু’একটার বেশি কথা বলেনি। কেবল বাচ্চা দুটোকে কোলে নিয়ে আদর দিয়ে চলে গেছে। ফারিশ তার ফুপিমণির সাথে কথা বলতে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জিন্নাত বলে নি। এমন কি নিজের ভাইজান কেও ইগনোর করে চলে যায়।
ছয় মাস পরের কথা। ফাইজা এখন সবসময়ই চুপচাপ থাকে। দিনের বেশির ভাগ সময় হয় পড়ালেখা, কোচিং, কলেজ আর নয়তো ভাতিজা, ভাতিজিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেদিনের পর রিশাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ করেনি ফাইজা। আর না রিশাদ করেছে। রিশাদের কি অবস্থা এটাও জানে না ফাইজা। ফোন থেকে সব স্মৃতি মুছে ফেলেছে। আজ তার কলেজে এক্সাম। সাথে মুসকানেরও। বেবিদের সামলানোর জন্য রেগুলার ক্লাস করতে না পারলেও এক্সাম দেয় মুসকান। সকাল সকালই বাচ্চাদের খাইয়ে, গোসল করিয়ে, ঘুম পারিয়ে সে তৈরি হয়ে নিয়েছে কলেজে যাওয়ার জন্য। ছেলেটা চুপচাপ থাকলেও মেয়েটা ইদানীং খুব বিরক্ত করে তাকে। একমিনিটও শান্তিতে থাকতে দেয় না। যতটুকু শান্তি পায় কেবল একটু ঘুমালে আর নয়তো তাদের পাপা বাড়িতে থাকলে। তাজমহল, ফাইজা আর জহিরের কোলে ছেলে ‘অরুণ’ বেশি থাকে। মেয়েটা কেবল তার কোলে আর ফারিশের কোলে চুপচাপ থাকে। অন্য কারো কোলে কয়েকমিনিট থেকেই ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে শুরু করে। এই মেয়ের জ্বালায় কিছুই করতে পারে না মুসকান।
এইতো কাল রাতের কথা,,,
”এক্সাম বলে ছেলেকে শাশুড়ীর কাছে দিয়ে মেয়েকে হাঁটুতে শুইয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছিল মুসকান। একদিকে পা দোলাচ্ছিল অন্যদিকে বই নিয়ে পড়ছিল। প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো এই মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু দু’ষ্টু মেয়ে না ঘুমিয়ে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। ঘুম পারাতে ব্যর্থ হওয়ায় রাগী ভাব নিয়ে চোখ বড় করে মেয়েকে ধমক দিল মুসকান,
— ব*দমাশ মেয়ে ঘুমাচ্ছিস না কেন? একটা দিয়ে নাক ফা’টিয়ে দিব। জলদি ঘুমা।
মায়ের ধমকে যেন আরো মজা পেল বাচ্চাটা। আগের থেকে এবার আরো বেশি খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। মুসকান কাঁদো কাঁদো মুখ করে হাতের বইটা দিয়ে নিজের কপালে নিজে বারি মা’রল। সেটা দেখে হাসতে হাসতে এবার মায়ের পা থেকেই পরে গেল বাচ্চাটা। বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে সে। মেয়ের এমন স্নিগ্ধ, সুন্দর হাসি দেখে এবার নিজেই হেসে দিল মুসকান। মেয়েকে কোলে নিয়ে জাপটে ধরে কয়েকটা চু’মু খেয়ে পেটে, গলায়, মুখে, নাক দিয়ে সুরসুরি দিতে লাগল।
মা, মেয়ে যখন হাসতে ব্যস্ত তখনই রুমে ঢুকল ফারিশ। হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে আহ্লাদী স্বরে মেয়েকে ডাকল,
— কোথায় আমার ‘আয়রা’ আম্মু? মাম্মার সাথে খেলা করছে বুঝি?
পাপার গলা শুনে মায়ের কোলে থেকেই হাত পা ছুড়াছুঁড়ি করতে লাগল আয়রা। ফারিশ উজ্জ্বল হেসে বলল,
— এখন না আম্মু। পাপা আগে ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর।
পাপাকে কোলে না নিয়ে ওয়াশরুম দিকে চলে যেতে দেখে মায়ের কোলে থেকেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো আয়রা। মেয়ের কান্না শুনে ফ্রেশ না হয়েই ফিরে আসলো ফারিশ। কোনো মতে গায়ের শার্টটা চেঞ্জ করে মেয়েকে কোলে নিল। মুসকান হাফ ছেঁড়ে বলল,
— বাঁচালেন আমায়। বলেছিলাম দ্রুত আসতে। আসলেন না? আপনার এই মেয়ে আমাকে পা’গল বানিয়ে ফেলছে। কালকে এক্সাম এখন পর্যন্ত একটা অক্ষরও পড়িনি। দের ঘন্টা ধরে এটাকে ট্রাই করে যাচ্ছি ঘুম পারানোর জন্য। দু’মিনিটের জন্যও চোখ বুঝে নি। আপনার মেয়ে এখন আপনি সামলান।
মুসকানের নালিশ শুনে ঠোঁট এলিয়ে হাসল ফারিশ। প্রতিদিন বাড়িতে আসলে এমনটা শুনতে হয় তাকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
— তাই নাকি পাপা? মাম্মাকে এতো বিরক্ত করেছো তুমি?
আয়রা কথা না বলে চুপচাপ বাবার বুক ঘেঁষে রইল। তার থেকে ভদ্র এখন আর কেউ নেই।”
তাজমহলের দায়িত্বে বাচ্চা দু’টোকে রেখে ফাইজার সাথে এক্সাম দিতে বেরিয়ে পড়ল মুসকান। ইচ্ছে করেই ছেলে, মেয়েকে এমন টাইমে ঘুম পারানোর অভ্যাস করেছে সে। যেন এক্সাম দিতে যেতে পারে। তাজমহলও নাতি-নাতনীদের ভালোই খেয়াল রাখে।
যাওয়ার পথে ফাইজাকে চুপচাপ পাশে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল মুসকান,
— এভাবে মনমরা হয়ে আর কতদিন থাকবে ফাইজা? এবার তো একটু মন খোলে চলার চেষ্টা করো। ওইদিনের পর রিশাদ ভাইয়াকে এতো কল করলাম ফোনই তুলল না। ফুপিমণির সাথেও কথা বলার কতো চেষ্টা করেছি। উনিও কেমন যেন দূরে সরে গিয়েছেন। সবকিছু কেমন যেন হয়েগেছে ফাইজা! এই ছয় মাসে নানা ভাবে তোমার ভাইয়াকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি।
কিন্তু উনি……
কথা শেষ না করেই আক্ষেপের শ্বাস ছাড়ল মুসকান।
ফাইজা ফিচেল স্বরে বলল,
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩৮
— কেন এখনো সেই চেষ্টা করে যাচ্ছ ভাবি? লাভ কি হবে এতে? রিশাদ তো নিজেই দূরে সরে গিয়েছে। এখন আর বাবা, ভাইয়ার রাজি হওয়া না হওয়ায় কিছু হবে না। আমি প্রায় সময়ই আমাকে নিয়ে তোমার আর ভাইয়ার মাঝে কথা কাটাকাটি শুনি। আমার জন্য আর নিজের সংসারে অশান্তি করো না ভাবি । যেটা শেষ হয়ে গেছে সেটা শেষই। আমি আর এসব নিয়ে ভাবি না। তুমিও ভাইয়াকে বুঝানো ছেড়ে দাও। ভালো লাগে না এসব আর…