ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৮
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় চলে যাওয়ার কিছু মুহূর্ত পরেই তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো পরিণীতা। প্রিয়তাকে নোংরা মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিল। প্রিয়তা আশ্রয়স্থল পেয়ে ঝাঁপটে ধরল, গড়িয়ে পড়ল পরীর বুকে—বড় বোন নাকি মায়ের সমতুল্য হয়, তাই হলো। পরিণীতাকে ঝাঁপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো প্রিয়তা।
পরিণীতা মাথায়, গালে, গলায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“শশ… কাঁদিস না বোন আমার, সান্ত্ব হো, ধৈর্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কিন্তু প্রিয়তার কান্নার বেগ যেন বেড়েই চলল।
পরিণীতা প্রিয়তার চোখ-মুখ মুছে দিয়ে তাকে ঘর থেকে বের করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। বিছানায় বসিয়ে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি প্রিয়তার হাতে ধরিয়ে দিলো। চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“কাঁদিস না বোন, পানি টা খা।”
কান্নার তোড়ে প্রিয়তার ফর্সা মুখখানি রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। পরিণীতা তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো প্রিয়তার ক্ষতচিহ্নগুলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গভীর রজনীতে বুনো শিয়ালের ভয়ংকর গর্জন ভেসে আসছে একটু দূরের জঙ্গল হইতে। পরিবেশে গা ছমছমে ভৌতিকতা, যেন কারো মৃত্যুর দামামা বেজে গেলো নিঃশব্দে।
জঙ্গলের কিছুটা সামনে খাড়া পাহাড়ের প্রান্তে হাত-পা-মুখ বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। ভয়ে আতঙ্কে তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে ঠান্ডার স্রোত। কপালের লবণাক্ত বিন্দু-বিন্দু ঘামের ফোঁটা টপ টপ করে ঘাড় বেয়ে নেমে আসছে।
শক্ত কাপড় দ্বারা মুখ বাঁধার ধরুন চিৎকার দিতে অক্ষম সে। আর না পারছে হাত-পা নাড়াতে। পা ফসকে গেলে বা একটু এদিক-ওদিক হলেই সক্ষাৎ জমের দুয়ারে সোজা গিয়ে পড়বে ৫০০ ফুট নিচে।
চাঁদের আলোয় খাড়া পাহাড়ের গভীরতা দেখে মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো মেয়েটার।
এভাবে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর দূরে কোথাও হইতে গাড়ির ইঞ্জিনে ব্রেক কষার শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠলো মেয়েটা; উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আলো-অন্ধকার মাখানো রাস্তার পানে।
দূরের সেই নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো পাঞ্জাবি-পরিহিত এক পুরুষ অবয়ব। সে পুরুষকে চিনতে এক মুহূর্ত সময় লাগলো মেয়েটার। তবে চিনে ফেলতেই আতঙ্কে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। ব্যক্তিটা যত কাছে আসতে লাগলো, মেয়েটা ততই এক পা-দু’পা করে খাড়া খাদের দিকে পিছাতে লাগলো—তার সামনে যেন সক্ষাৎ মৃত্যু দণ্ডায়মান।
তুহিনার দৃষ্টিতে কাকুতি, প্রণয়ের দৃষ্টিতে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা; সঙ্গে প্রতিশোধের দাবানলে কলিজায় জ্বলছে আগুন। প্রণয় এক পা, দু পা করে এগিয়ে এসে তুহিনার থেকে ঠিক ৭ পা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো।
পেছনে থাকা গার্ডদের দিকে ইশারা করতেই একজন গার্ড এসে তুহিনার মুখের বাঁধন খুলে দিলো। সঙ্গেসঙ্গেই অস্থির কণ্ঠে চিৎকার করে মাফ চাইতে লাগলো তুহিনা,
“আমাকে মাফ করে দিন ভাইয়া, আমি… আমি বুঝতে পারিনি। না বুঝে করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দিন, আমাকে মারবেন না…”
বলে তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়লো তুহিনা।
তবে এসব ফ্যাচফ্যাচে কান্নায় সামনের ব্যক্তিদের উপর কতটা প্রভাব পড়লো, সঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু আপনারা তো জানেন—আজরাইল ফেরেশতার জানে দয়া-মায়া থাকলেও আবরার শিকদার প্রণয়ের জানে কোনো দয়ামায়া নেই। হিউম্যান হান্টার সে। হান্ট করা তার নেশা, আর যদি সাথে থাকে প্রতিশোধ!
তুহিনা আবার মিনতি করে বললো,
“আমি হিংসায় পাগল হয়ে গেছিলাম ভাইয়া, আমাকে মাফ করে দিন। আমি অনেক দূরে চলে যাবো। আমি প্রিয়তাকে ইচ্ছা করে মারতে চাইনি। আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো আমার।”
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড এসব শুনলো, তবে কোনো প্রতুত্তর না করেই রিভলভার তুলে ঠাস ঠাস করে পরপর দুটো বুলেট তুহিনার কপাল বরাবর ঠুকে দিলো।
এক মুহূর্তের নীরবতা। অতঃপর চোখের পলকে তুহিনার রক্তাক্ত নিথর শরীরটা গড়িয়ে পড়লো খাড়া পাহাড়ের নিচে।
প্রণয় একদম শান্ত, নির্লিপ্ত—যেন মানুষ নয়, একটা মশা মেরেছে। সে হাতের কালো রিভলভারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ঘাড় বাকিয়ে হিংস্র কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আবরার শিকদার প্রণয় তার শত্রুদেরকে মারে না, আঘাত করতে দেয়। কিন্তু যারা তার দুর্বলতা পয়েন্ট আউট করে আঘাত করতে যায়, তাদের…”
গার্ডস বলে হুংকার দিয়ে উঠল প্রণয়।
গার্ড দুটো দৌড়ে এল, মাথা নিচু করে বলল,
“ইয়েস বস।”
প্রণয় বললো,
“এই ব্লাডি বিচটাকে তুলে আমার রিও-র জন্য ডিনার হিসেবে হিউম্যান থাই সুপ রেডি করে। অবশ্যই যেন টেস্টি হয়, নাহলে…” রিও(ব্ল্যাক প্যান্থার)
বলে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো গার্ড দুটোর পানে।
গার্ড দুটো কাপতে কাপতে বললো,
“ইয়েস বস।”
প্রণয় বাঁকা হেসে পুনরায় ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো খাদের দিকে। চেহারার সৌন্দর্য-মাধুর্য উড়ে গিয়ে হিংস্র পশুর ন্যায় দেখাচ্ছে তাকে—যার ডিকশনারিতে ‘মায়া’ বলে কোনো শব্দ এক্সিস্টই করে না।
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আলো-অন্ধকার মিশ্রিত আকাশের পানে তাকিয়ে আছে দেবী; রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে, পূর্ব আকাশে দেখা মিলছে এক টুকরো রক্তিম সূর্যের। চোখ-মুখের অবস্থা বেগতিক মেয়েটার—হয়তো সারারাত ঘুমায়নি। এখনো অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে গাল বেয়ে; অতিরিক্ত কান্নার জন্য মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
এমন সময় খট করে দরজার পাল্লায় শব্দ হলো—স্থির হলো দেবী; আকাশ হইতে মনোযোগ সরিয়ে যেন কাঠের দরজার পানে তাকালো।
কি রকম এলোমেলো ভঙ্গিতে, বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করলো আবির্ভাব—চুলগুলো উশকো-খুশকো, চোখ দুটো লাল, বুকের দিকে পাঞ্জাবির বোতাম ছেঁড়া। সে বিছানা থেকে বালিশ তুলে সোফার পানে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে শক্ত কণ্ঠে ডেকে উঠলো দেবী,
“দাঁড়াও।”
পা থামালো আবির্ভাব; সারারাত না ঘুমানোর জন্য তার মাথা ঝিমঝিম করছে।
“পুরো রাত কার সাথে ফুর্তি করে এসেছো, ডাক্তারবাবু? ঘরের সুন্দরী বউ কি চোখে লাগে না?”
কোনরকম রাগ-রাগি ছাড়াই শান্ত মস্তিষ্কে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো দেবী।
আবির্ভাব তীব্র বিস্ময়ে—কিঙ্কর্তব্যবিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলো দেবীর পানে। কি শুনলো, এটা সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
দেবী পায়ে-পায়ে এগিয়ে এলো আবির্ভাবের নিকট—আবির্ভাবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে-খুটিয়ে নিরীক্ষণ করে চোখে চোখ রেখে বললো,
“বলো, কার কাছে রাত ফুরিয়ে এলে?”
প্রথমে অবাক হলেও এখন ওর গা-ঝাঁলানো কথার ধরণে চরম রেগে গেলো আবির্ভাব; কোন নারীর উপর রাগ প্রকাশ করা তার ধাঁচে নেই যদিও, তবে এই মুহূর্তে মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না আবির্ভাব—চেঁচিয়ে বললো,
“আমি ফুর্তি করতে গেছিলাম, তুমার আমাকে এমন মনে হয়?”
প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন হলো না দেবীর।
“তুমাকে তো আমার একদম অন্যরকম মানুষ মনে হতো, আবির্ভাব! কিন্তু তুমি তো আসলে…
“আমি আসলে কী?”
“কাপুরুষ?”
“দেবী”
” গলার জোরে নিজেকে বীরপুরুষ প্রমাণ করার চেষ্টা করো না, আবির্ভাব! তুমি দেহ-লোভী। তোমার যদি এতো শরীরের চাহিদা ছিল, তাহলে তোমার বিবাহিত স্ত্রী আমি কী ছিলাম না? বিয়ের পরে ও ঐ মেয়েটার শরীর পছন্দ হলো, যে রাত কাটিয়ে জামাকাপড় ছিড়ে ফিরলে। আর ঐ মেয়েটা তো শুনেছিলাম ভদ্র পরিবারের মেয়ে—তাহলে একটা বিবাহিত পুরুষের সাথে কিভাবে অবৈধ সম্পর্ক রাখতে পা..?”
কথা সমাপ্ত করতে পারলো না দেবী; পূর্বেই তার নরম গালে পুরুষালি হাতের শক্ত এক চপেটাঘাত পড়লো। মাথা ঘুরে উঠলো দেবীর।
আবির্ভাবের রাগে শরীর কাঁপছে; দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আজ প্রথম ভুল ভেবে মাফ করে দিলাম, কিন্তু আজ যা বলেছো—তার আর একবারও যদি কখনো পুনরাবৃত্তি করেছো, তাহলে আমার থেকে বেশি খারাপ আর কেউ হবে না, দেবী।”
দেবী গালে হাত চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
“এই তো বীরপুরুষ! সারা রাত অন্য নারীর সাথে ফুর্তি করে ভোর রাতে এসে ঘরে বউ পেটানো! এটাই তাহলে তোমার আসল রূপ?”
আবির্ভাব ক্রোধে মাথা চেপে ধরে বলল,
“আমার মাথা খারাপ করো না, দেবী। তুমি তোমার মতো থাকো, আর আমায় আমার মতো থাকতে দাও।”
এবার চরম রেগে গেলো দেবী। আবির্ভাবের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বললো,
“আমি আমার মতো থাকবো বলে তো বিয়ে করিনি!”
আবির্ভাব ঠেলে সরিয়ে দিলো তাকে। পাঞ্জাবির কলার ঝাড়তে ঝাড়তে রেগে বলল,
“১০০ দিন বলেছি, ছুঁবে না আমায়।”
“কেনো ছুঁবো না? আমি তোমার স্ত্রী! আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমার উপর!” দেবী কঠিন কণ্ঠে বললো।
আবির্ভাব স্পষ্ট উত্তরে জানিয়ে দিলো, “তোমার কোনো অধিকার নেই আমার উপর।”
“আচ্ছা, আমার অধিকার না থাকলে কার অধিকার আছে? ঐ মেয়েটার?” দেবীর কথা বার্তায় আবির্ভাব বুঝলো—দেবী সব জেনে গেছে।
“তুমি যদি এতো সুপুরুষ হয়ে থাকো, তাহলে বন্ধুর বোনের সাথে এতো মাখামাখি কিসের তোমার? নাকি ওর শরীরের-মোহ—বিয়ের পরও ছাড়তে পারছো না?”
পুনরায় দেবীর গালে শক্ত হাতে চড় বসিয়ে দিলো আবির্ভাব। এবার টাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো দেবী। তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা। আবির্ভাবের অন্তরে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো; সে মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না অথচ।
দেবী বসা থেকে উঠে নিরীহ কণ্ঠে বললো,
“আমার জীবনটা কেনো নষ্ট করে দিলে, আবির্ভাব? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। কেনো বিয়ে করলে আমায়? আমি ও—তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি আবির্ভাব।”
“তুমি যেহেতু সব জেনে গেছো, তোমার কাছে এখন আর কিছুই গোপন করার নেই দেবী, আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসিনি; বিয়ে ও করতে চাইনি—এটাই মূল কথা। আর তোমার বাকি যা প্রশ্ন আছে, আমার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও, উনি ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।”
“এমন করে বলো না, আবির্ভাব ! আমি কি তোমার মনে একটু ও জায়গা করতে পারিনি?”
“না, তুমি আমার কেবল দায়িত্ব। বিয়ের আগে আমার মা বলেছিলেন—তোমার দায়িত্বে যেন একটুকুও হেরফের না করি। আমি করিনি। অক্ষরে অক্ষরে তোমার সকল দায়িত্ব পালন করছি, করবো। কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি না। আর আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি—দায়িত্বের বাইরে তুমি আমার কাছে কিছু আশা রেখো না। আমার মন, প্রাণ জুড়ে কেবল একজনই আছে, আর আজীবন সেই থাকবে। মৃত্যু অবধি আমার ভালোবাসার সর্বাংশের অংশীদার কেবল সে; আর তা অপরিবর্তনীয়।
আমি তাকে ভুলতে চেষ্টা করিনি—ব্যাপারটা এমন নয়। আমি খুব চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখনই চেষ্টা করতে গেছি, তখনই মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে যেতে হয়েছে আমায়। তাই আমি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি —তাকে ভালোবাসা ব্যতীত আমি নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না; সে প্রবাহিত হচ্ছে আমার মনে, শরীরের রক্তে সর্বাঙ্গে।
তুমি চাইলে এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে পারো—কোনো বাধা নেই। আমার দিক থেকে সবসময় সাপোর্ট পাবে। তুমি যতটা ক্ষতিপূরণ দাবি করবে, আমি তোমায় সব দেব। শুধু এই মনটা তোমায় দিতে পারবো না।”
বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না আবির্ভাব—ঘরের সব লাইট নিভিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ল চুপচাপ। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দেবী। এই সম্পর্ক ভাঙার কথা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। আবির্ভাব যেমন মৃত্যু পর্যন্ত ঐ মেয়েটাকে ভুলতে পারবে না, দেবীও তেমন পারবে না আবির্ভাবকে ভুলতে। কিন্তু এখন কী করণীয় তার?
আবেগ চেপে রেখে কিছুক্ষণ ভাবলো দেবী। উপায়ান্তর না পেয়ে ফোন করলো শাশুড়ির নাম্বারে…
বিয়ের দ্বিতীয় দিন গায়ে হলুদ উৎসবের আবেশে হলুদের সাজে সেজে উঠেছে প্রণয় কুঞ্জ। সকাল প্রায় ৯টার কাছাকাছি হবে। তন্ময় আর অরণ্য ওঠার আগে আগেই নাস্তার কাম সবার করে দিয়েছে অন্যরা।
বিধায় ওরা দুজন মুখ চুন করে বসে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়। ক্ষিদেতে তাদের পেটে প্রায় কয়েক লক্ষ হাতি-ঘোড়া দৌড়াদৌড়ি করছে। কিন্তু হাঁড়ি পাতিল সব ফাঁকা।
এই ব্যাপারে তারা যখন বাড়ির মহিলা সমিতির চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন জানাতে গিয়েছিল, তখন অনুশ্রী বেগম উল্টো তাদের ঝাড়ি মেরে বলেছিলেন,
“নবাব পুত্তুররা বেলা ১০টা অব্দি নাক ঢেকে ঘুমাবে আর আমি হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো? যা তো বাপ, সর সামনে থেকে, ভেজাল করিস না!”
এর পর থেকেই তারা দু’জন মুখ ঝুলিয়ে বসে আছে সোফায়।
ভাইদের এই দুর্দশা দেখে বেশ মায়া লাগলো থিরার। সে রান্নাঘর থেকে একটা বিস্কুটের কৌটো এনে অরণ্যের হাতে দিয়ে বললো,
“এই দিয়েই কাজ চালাও ছোট ভাইয়া, আপাতত আর কিছুই পাবে না।”
বেশ, সেই তখন থেকেই তারা দুই ভাই হাঙ্গরের মতো খ্যাবলা খ্যাবলি করছে সেই বিস্কুটের কৌটো নিয়ে।
অরণ্য একবার টানছে তো তন্ময় একবার টানছে। তবে তাদের এসব কর্মকাণ্ড কেউই পাত্তা দিচ্ছে না।
একপর্যায়ে বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে চলেই গেল তন্ময়। তাই অরণ্য আর বসে থেকে কি আঙ্গুল চুষবে? সে ও পেটে গামছা বেঁধে নিজের ঘরে চলে গেল।
মিনিট ২০ পর বাইরে থেকে নক এর আওয়াজ ভেসে এলো।
“আসো।” ভেতর থেকে জবাব দিল অরণ্য।
দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলো তৃধা, হাতে খাবারের ট্রে। অরণ্য স্টাডি টেবিলের চেয়ারে বসে মনোযোগের সহিত অফিসে ইমেল সেন্ড করছিল। সে লক্ষ্য করলো না তৃধার উপস্থিতি।
অরণ্যকে গভীর মনোযোগের সহিত ল্যাপটপের কিবোর্ডে হাত চালাতে দেখে এগিয়ে এলো তৃধা। ট্রেটা স্টাডি টেবিলের উপর রেখে কফির মগটা অরণ্যের চোখের সামনে ধরে বললো,
“আপনার কফি।”
রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠের সাথে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো একজোড়া মোলায়েম ফর্সা হাত। অরণ্য ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে উপরে তাকাতেই আবারো ধাক্কা খেলো, গত দিনের ন্যায় আজও হারিয়ে গেলো সবুজ সরাবোরে।
তৃধার পরণে সাদা সালওয়ার কামিজ, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে পাতলা লিপস্টিক আর কোমর ছাড়ানো হালকা ঢেউ খেলানো খুলা চুল।
তবে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় সবুজ চোখের চিকন কালো কাজল রেখা। অরণ্য ধ্যান জ্ঞান খুইয়ে মোহগ্রস্তের ন্যায় তৃধার পানে হাত বাড়িয়ে দিতেই আচমকা বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
উক্ত কাণ্ডে হতবম্ব হয়ে গেল তৃধা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো অরণ্যের পানে। অরণ্য চিংড়ি মাছের মতো লাফ দিচ্ছে। নারীর মোহে পড়ে সে সর্বনাশ করেছে, তখন সে কফি নিতে গিয়ে পাশে থাকা গরম দুধের গ্লাসে ধাক্কা দিয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে পুরো এক গ্লাস উতলানো গরম দুধ উল্টে পড়েছে তার গুপ্তধনে — এখন কোথায় পড়েছে, আপনারাই বুঝুন।
অরণ্যকে এভাবে ছটফট করতে দেখে ঘাবড়ে গেল তৃধা। হাতে থাকা কফির মগটা পাশে রেখে দ্রুত শিফনের ওড়নাটা দিয়ে চেপে ধরলো অরণ্যের গুপ্তধন। সাথে সাথেই তিরিং বিরিং করা থামিয়ে দিলো অরণ্য।
দু’জনেই হতবম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো একে অপরের মুখের দিকে। অতঃপর লাফিয়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিলো অরণ্য। কয়েক সেকেন্ডে কী থেকে কী ঘটে গেল, সব কিছু মাথার উপর দিয়ে গেল তৃধার।
তৃধা গালে হাত দিয়ে বসে পড়লো অরণ্যের চেয়ারে।
“এই বেটার সাথে দেখা হলেই কি সব উদ্ভট কাণ্ড ঘটতে থাকে ওই ব্যাটার থেকে বেশি বেটার ওটার সাথে দেখা! ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা!”
সে গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় পুরো গ্লাস দুধ উপরে পড়েছে। তৃধা দুধের উষ্ণতা চেক করতে গ্লাসে হাত দিয়ে দেখলো — গ্লাসটা এখনও প্রচণ্ড গরম। আসলে এগুলো থিরাই দিয়ে পাঠিয়েছিল ওকে।
তৃধা অরণ্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মনে মনে বললো,
“আহারে, বেচারা কতই না জ্বালা করছে হয়তো। যাই বরফ নিয়ে আসি,”
বলে নিচে নেমে গেল সে।
কিছুক্ষণ পর কোমরে শুধু একটা টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো অরণ্য। বংশীয় প্রদীপে ফোস্কা পড়েছে, বিরাট কয়েকটা।
ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করলো তৃধা, হাতে বরফের বাটি।
“এই যে, আপনার বরফ…”
বলতেই থমকে গেল তৃধা।
অরণ্যের এই টাওয়াল অবতার পুনরায় দর্শন করে তার চোখ বড় হয়ে এলো আপনা-আপনি।
“লোকটা আবারো টাওয়েল পড়ে আছে! জামা কাপড় কী নেই নাকি?”
জিম করা সুঘটিত পেশী, বহুল শরীর দৃশ্যমান। লজ্জা পেল তৃধা, মনে মনে বললো,
“কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা!”
যদিও অরণ্যের এসব লজ্জা-শরমের বালাই নেই, সে তৃধার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আহত স্বরে বললো,
“প্রথমে দেখে নিলে, আর এখন জ্বালিয়ে দিলে! কি শত্রুতা বলতো তোমার আমার সাথে? আর আমায়… যাই হোক, আবার কি জ্বালাতে এসেছো?”
অরণ্যের খোঁচা দেওয়া কথায় চট করে জ্বলে উঠলো তৃধা। সে অরণ্যের দিকে এগিয়ে এসে মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,
“আপনার ওই ফ্লপ সিনেমা দেখার কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না আমার। আর আমি আপনার অ্যান্টেনা জ্বালাইনি, আপনি নিজেই জালিয়েছেন।”
“What antenna?”
অবাক হয়ে বললো অরণ্য।
তৃধা ঢোঁক গিললো, কিছু না বলে বরফের বাটিটা তুলে ধরলো অরণ্যের মুখের সামনে। অরণ্য ভুরু কুঁচকে বাটির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা দিয়ে কি করবো?”
“সঠিক জিনিসের সঠিক ব্যবহার করতে না জানলে আর কি করবেন, মুড়ি খাবেন?”
বলে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল তৃধা।
অরণ্য বোকার মতো বাটি হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝলো এটা কোন কাজে লাগবে। বাঁকা হাসলো অরণ্য, সাথে ঝাঁলে চিৎকার দিয়ে উঠলো, পুনরায় বরফের বাটি নিয়ে ছুটলো ওয়াশরুমে।
> এই ভর দুপুর, বেলা কাঁঠ ফাটা রোদ্দুরে তোমাদের পদ্মবিল দেখার ইচ্ছা জাগলো কেন শুনি?
ওড়নার আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে ক্লান্ত কন্ঠে বললো স্বেতা, সূর্য তখন মধ্যগগনে দন্ডায়মান , তাপে মনে হচ্ছে শরীরের চামড়া ঝলসে যাবে।
এই খাঁ খাঁ রোদে ধানক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটছে ইরফান, স্বেতা, তৃধা, থিরা, লাবিবা। তারা মূলত রায়পুরের বিখ্যাত শাপলা বিল দেখতে বায়না ধরেছিল, বিশেষ করে লাবিবা।
তৃধা জিভ বের করে বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি মোটেও আসতে চাইনি আপু। এই চামচিকার মতো দেখতে মেয়েটার জন্য কবে না জানি আমার জীবনটাই বেরিয়ে যায়!”
লাবিবা গাল ফুলিয়ে বললো,
“তুই আমায় চামচিকা বললি জানু?!”
“তুই কি অন্য কিছু শুনলি?”
ওদের আবার ঝগড়া লেগে গেল।
প্রগাঢ় দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলো স্বেতা। অতিরিক্ত রোদের তাপে তার ফর্সা চামড়া লাল, টকটকে আপেলের মতো লোভনীয় লাগছে, গাল দুটো মাত্রাতিরিক্ত গোলাপি আভা নিঃসরণ করছে।
ইরফান সেই দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিললো, আনমনে বললো,
“রাসবেরি …”
তৎক্ষণাত ইরফানের দিকে দৃষ্টি পাত করলো স্বেতা।
বেশি গরম লাগার দরুন এক প্রকার দৌড় দিল থিরা, তৃধা, লাবিবা। এই বিশাল ধান জমিন পেরোতে পারলেই ছায়া বন, তখন আর রোদ লাগবে না—সেই ভেবেই তাড়া হুড়ো করে দৌড় দিল, ওরা ৩ জন, একলা ফেলে গেল ইরফান ও স্বেতাকে।
স্বেতা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কোথায় র্যাসবেরি?”
মধুর কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো ইরফানের, সে ফিচেল হেসে বললো,
“তুমি দেখতে পাচ্ছো না?”
দুই পাশে না-বোধক মাথা ঝাকালো স্বেতা।
ইরফান ঠোঁট কামড়ে ধরলো, পকেট থেকে ফোন বের করে হাই ব্রাইটনেস দিয়ে স্বেতার সম্মুখে ধরলো।
স্বেতা দেখলো গরমে তার অবস্থা বেগতিক।
ইরফান পুনরায় বললো,
“আমি বুঝি না তুমি নারী নাকি অন্য কিছু, কখনও ব্লুবেরি তো কখনও র্যাসবেরি।”
“দুটোই জঘন্য খেতে,”
বলে উঠলো স্বেতা।
ওরা দুজন পাশা পাশি হাঁটছে, সরু আইল বিধায় দুজনের গায়ের ঠুকাঠুকি লাগছে অনবরত।
ইরফান একটু ভেবে বললো,
“তাহলে পাকা আম?”
“আমি আম, জাম, কাঁঠাল লিচু কোনোটা নই।”
“সেটা তো খেলেই বুঝতে পারবো,”
বিরবির করে বললো ইরফান।
“কিছু বললেন ইরফান সাহেব?”
“উঁহু, বলছিলাম তুমি তো শুনলাম কানাডা থাকো, তাহলে এই গ্রাম এত ভালোভাবে চেনো কীভাবে?”
স্বেতা ঝরঝরে হেসে বললো,
“এই গ্রামেই আমার জন্ম হয়েছে, এমনকি আমি ছোটবেলায় অনেকটা সময় এই গ্রামেই থেকেছি, এই গ্রামের অলিগলি সব আমার মুখস্থ।”
“তাহলে তো ভালোই, হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই ।”
“আপনি কি বাচ্চা ছেলে হারিয়ে যাবেন?”
ওরা কিছুটা দূর এগোতেই স্বেতাকে জুতো খুলে হাতে নিতে দেখে অবাক হলো ইরফান।
“জুতো খুঁচছো কেন? পায়ে কাদা লেগে যাবে যে!”
“লাগুক, আপনি ও, ঝটপট জুতো খুলে হাতে নিন।”
“কেন?”
“সামনে অনেক কাদা, এই চিপচিপে এঁটেল মাটিতে জুতো একবার ঢুকে গেলে আর সহজে তুলতে পারবেন না।”
বলে তাড়া দিল স্বেতা।
ইরফানও তাই করলো, জুতো খুলে নিল, কয়েক পা এগোতেই দেখলো সত্যি সত্যি অনেক কাদা, তার উপর অনেক পায়ের চাপ, মানে মানুষ এই কাদার ওপর দিয়েই হাঁটা চলা করে।
ইরফান চোখ কপালে তুলে বললো,
“ওপারে যাবো কীভাবে?”
“হেঁটে হেঁটে।”
“এ্যাঁ…”
” এ নয়, হ্যাঁ চলুন।”
বলে স্বেতা গোড়ালির কাছের পা জামাটা গোরালি থেকে খানিকটা উপরে টেনে তুললো, সাথে সাথেই সোনালি রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠলো মাখনের মতো মুলায়াম ফর্সা পা।
পা দেখেই কেমন নেশা ধরে গেল ইরফানের, স্বেতা কাদা পানিতে পা দিতে নিলেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো ইরফান।
স্বেতা পেছনে ফিরে প্রশ্নচোখে তাকালো।
ইরফানের কী যেন হলো, ঘোর লাগা কন্ঠে আবদার করে বসলো,
“এত সুন্দর পদযুগ ওই নোংরা কাদায় চুবিয়ো না, র্যাসবেরি ও ডিজার্ভ করে না এত সৌন্দর্য।”
এমন অদ্ভুত কথায় স্বেতা ভ্রু কুঁচকালো, উত্তপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“পা না দিলে পার হবো কিভাবে ইরফান সাহেব? রোদের তো ঝলসে গেলাম!”
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো ইরফান, এরপর আচমকাই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলো, সাথে সাথেই চমকে উঠে ইরফানের পিঠ খামচে ধরলো স্বেতা।
স্বেতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে পাঁজাকোলে তুলে কাদায় নেমে যায় ইরফান। সে এক হাতে স্বেতার পিঠ জড়িয়ে রেখেছে তো অন্য হাতে তাদের দুজনের জুতা।
স্বেতা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে ইরফানের পানে, স্বেতার মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই ঈদের দিনের কথা।
“দেখুন, পাগলের ডাক্তার আমি, এই হাঁটু পানি পেরিয়ে কিছুতেই ওপারে যাবো না, প্রয়োজনে আমি যাবই না, তবুও এই পানিতে পা দেবো না। তার উপর এই পানির মধ্যে যে পরিমাণ জুক আছে, আমাকে গিলে খেতে তাদের লবণ লাগবে না,”
মুখ ভার করে বললো স্বেতা।
আবির্ভাব শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বললো,
“ছে! ছে! কী নষ্ট চরিত্রের জোক রে বাবা, এখনো আমি খেতে পারলাম না, আর ওরা নাকি গিলে খাওয়ার পায়তাড়া কষচে, ওদের তো রিমান্ডে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো উচিত, মাই লাভ!”
অভিমান করলো স্বেতা, আবির্ভাবের বুকে কিল, ঘুষি মারতে মারতে বললো,
“একদম নাটক করবেন না পাগলের ডাক্তার, সত্যি আমি জোক ভীষণ ভয় পাই!”
“তাহলে এই অধম আপনার জন্য কী সেবায় নিয়োজিত হতে পারে বলুন!”
গাল ফুলালো স্বেতা, লোকটা সব বুঝে ও না-বোঝার ভান ধরছে।
লজ্জাবতীর অভিমান দেখে, ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবির্ভাব, কানের লতিতে ওষ্ট ঠেকিয়ে গভীর হাস্কি কণ্ঠে বললো,
“কোলে চড়তে চাও, সেটা মুখে বললেই তো হয়! এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কেন বোঝাতে হচ্ছে মাই লাভ আমি তো তোমারি,আদেশ করবে আমায়!”
লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেললো স্বেতা, তখনই আবির্ভাব তাকে এক হাতে পাঁজাকোলে তুলে নিলো, অন্য হাতে শ্বেতার জুতো হাতে নিয়ে বললো,
“সাপ, জোক, সব আমাকে খাক, মাই লাভ, তুমি আমার বুকে থাকো!”
ওপারের প্রান্তে এসে স্বেতাকে নামিয়ে দিলো ইরফান, সে জানে স্বেতা এখন তাকে কড়া কিছু কথা শুনবে, কিন্তু তার বা কী দোষ, সে যে এই অবিচার দেখতে পারতো না। তবে ইরফানের ভাবনা অনুযায়ী কিছু হলো না, বরং চোখ মুচতে মুচতে তার দিকে না তাকেই অন্যদিকে দৌড় দিল শ্বেতা।
তাজ্জব বনে গেল ইরফান – এটা কেমন রিয়্যাকশন!
সন্ধ্যা ঘনিয়েছে অনেকক্ষণ।
গায়ে হলুদের সাজে স্টেজে বসানো হয়েছে প্রিয়তা ও প্রেরণাকে। লাল-হলুদ কম্বিনেশনের শাড়ির সাথে মানানসই কাঁচা ফুলের গহনায় ভীষণ মানিয়েছে দুজনকে।
তার পাশে বসানো হয়েছে শুদ্ধ ও সাদাফকে। হলুদ পাঞ্জাবিতে তাদেরও মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন দেখাচ্ছে।
জমকালো গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে শিকদার বাড়ির গার্ডেন এরিয়াতে। হরেকরকম ফুলের সাজ আর ফেয়ারি লাইটের সৌন্দর্যে মনোমুগ্ধকর লাগছে বাড়ির লন এরিয়া।
সাউন্ড বক্সে ফুল দমে গান চালিয়ে উরাধুরা নাচ দিচ্ছে তন্ময়, সমুদ্র, রাজ, রাদিফ, সাদিফ, অভ্র, শুভ্র ও তাদের বন্ধুরা।
তাদের ভাষ্যমতে—
“লুঙ্গি তুলে ডান্স দিতে না পারলে বিয়ে-বিয়ে ফিল আসে না!”
সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে বাজছে-
“ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়…
বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া, রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায় ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়।
যদিও এই নাচন কোদায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না অরণ্য বেচারার দুঃখের শেষ নেই।
সকলে নিজ নিজ মতো এসে এসে বর–বউয়ের সাথে ছবি তুলছে আর হলুদ মাখাচ্ছে।
“চলো দাদা, সবাই ওদের হলুদ মাখাচ্ছে, তাহলে তুমি কেনো মাখাবে না, এটা তো হতে পারে না—এমন কপাল কয়জনের হয়!”
বলে প্রণয়কে টেনে নিয়ে এলো পরিণীতা।
প্রিয়তাকে ডেকে বললো,
“আমার ভাই তোকে হলুদ না ছুঁয়ালে, তোর বিয়ে সম্পন্ন হতে-ই পারে না প্রিয়। যতই হোক—তোর জীবনে আমার ভাইয়ের যতটা অবদান, ততটাতো সেজ চাচ্চুরও নেই।”
চুপচাপ নত মস্তকে বসে ছিল প্রিয়তা।
পরিণীতার ধারালো বাক্যে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকালো সে।
সাথে সাথেই বক্ষ–পিঞ্জর কেঁপে উঠলো প্রিয়তার। তীরের ফলার ন্যায় হৃদয় আঘাত আনলো এক জোড়া গভীর বাদামি চোখ।
আজো ওই চোখ দুটো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে প্রিয়তাকে—
কিন্তু যার ভাষা বুঝতে আজো অক্ষম সে।
পরিণীতা হলুদ দেওয়ার আগে হঠাৎ প্রিয়তার হাতের তালু মেলে ধরলো, কিঞ্চিত বিস্ময় প্রকাশ করে বললো—
“তোর হাতের রঙ এত গাঢ় হলো কীভাবে প্রিয়?”
“এতো সুন্দর রঙ তো আমাদের কারো হয়নি।”
পরিণীতার কথায় প্রিয়তাকে চেপে ধরলো থিরা, তৃধা, শুভ্র, দীপ্তি রা।
ওর হাত টেনে ধরে দীপ্তি বললো—
“ওয়াও, সত্যি তো আপু! তোমার হাতের রঙ এত সুন্দর কীভাবে? আমরা সবাই তো সেম মেহেদি পরেছি।”
থিরা ওকে ধাক্কা দিয়ে বললো—
“এতকিছু বুঝো আর এটা বোঝো না! এটা মেহেদির রঙ নারে পাগলা, এটা ভালোবাসার রঙ, সবার হাতে ফোটে না।
তাই, তোকে কে এত ভালোবেসে, বোন?”
প্রিয়তা জবাব দিতে পারলো না, তার দৃষ্টি সরছে না সেই পুরুষের মাদকীয় নেত্রদ্বয় হইতে।
পরিণীতা পুনরায় প্রণয়কে ঠেলে বললো—
“ওদের হলুদ ছোঁয়াও দাদান।”
প্রণয় বিনা বাক্যে তাই করলো।
হাতে অল্প একটু হলুদ নিয়ে আলতো করে ছুঁইয়ে দিল প্রিয়তার গালে।
সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো প্রিয়তা।
বন্ধ চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে আসলো নিঃশব্দ অশ্রু–কণা।
পরপর প্রেরণা, শুদ্ধ, সাদাফ—সবাইকে দিলো।
স্টেজে উঠে এলো রাজ আর অরণ্য।
ওরা দু’জন শুদ্ধের দুই কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো—
“এখন থেকে, যখুনি দেখা হবে—তখনই বড় সমন্ধিদের ইয়া লম্বা একটা সালাম দেবে। এটা ভদ্রতা। বুঝতে পেরেছো, ছোট জামাই? মনে রাখবে, তুমি সব জামাইয়ের ছোট।”
বুক ফুলিয়ে বললো রাজ।
শুদ্ধ ভ্রূ বাঁকিয়ে তাকালো ওদের দু’জনের পানে, তার মনে হচ্ছে ওরা বেশ আট ঘাট বেঁধেই এসেছে।
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বললো—
“সমন্ধি সাহেবরা—তাহলে আপনাদের এই সম্মান প্রদর্শন কখন কখন করতে হবে একটু জানিয়ে দেবেন?”
“কখন কখন মানে সর্বক্ষণ করতে হবে।”
“তাহলে সমন্ধিদের পশ্চাদ দেশে যদি সম্মান প্রদর্শনীতে একটা একটা লাত্তি মারি, এতে সমস্যা হবে?”
“তুমি কিন্তু বড় সমন্ধিদের মানহানি করছো, ছোট জামাই। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বউ পাবে না।”
“ও আচ্ছা! আমার বউ আমি তুলে নিয়ে যাবো।”
“হা হা! বিয়ের খুশিতে লাফাচ্ছো—লাফাও। কিন্তু আছোলা বাঁশ যখন খাবে, তখন কেঁদে কূল পাবে না।”
মুখে বাঁকিয়ে বললো রাজ।
“বাস খাবো কেনো?”
“বউ মানেই আঁচোলা বাস। একবার বিয়ে করো, প্র্যাকটিক্যালি সব বুঝে যাবে থিওরির প্রয়োজন পড়বে না। কবে যে সিংহ থেকে মিনি বিড়াল হয়ে যাবে, টেরটাও পাবে না। আমি এক নাগিন বিয়ে করে ফেসে গেছি, আর আমার বোন কেমন সেটাও আমি খুব ভালো মত জানি।”
“বিড়াল হবো বলেই তো বেঁচে আছি, সমন্ধি সাহেব! আমি আপনার মতো নাকি? আমার বউ যদি বলে সারাদিন বসে থাকতে, আমি সারাদিন বসে থাকবো।”
“হাহা, এসব প্রথম প্রথম মনে হয়।”
সকলে মিলে ঘিরে ধরলো প্রণয়কে গান গাওয়ার জন্য।
প্রণয় জোর দিয়ে মানা করতে পারলো না।
প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে ম্লান কণ্ঠে সুর তুলল।
Heheee…aaaaa Hohohooo
Ahaha….hahaa Hohohooo
taaron ka chamakta gehna ho
phoolon ki mehakti waadi ho
us ghar main khushhaali aaye
jis ghar main tumhari shadi ho
ye phool tumhare zever hain
ye chaand tumhara aaina
tum jab aise sharmati ho
doolhe ka dhrakta hai seena
har aaina tum ko dekhe
tum to aisi shehzadi ho
us ghar main khushhaali aaye
jis ghar main tumhari shadi ho
ye dunya hai dil walon ki
taaron ka chamakta gehna ho
phoolon ki mehakti waadi ho
us ghar main khushhaali aaye
jis ghar main tumhari shadi ho
khushyon ke mehlon main betho
koi gam na tumhare paas aaye
na umr ka pehra ho tum pe
mere dil ki dua ye rang laaye
rab hansta huwa rakhe tum ko
tum to hansne ki aadi ho
us ghar main khushhaali aaye
jis ghar main tumhari shadi ho
হাতের মুঠোয় বড় একটা ফল কাটার ছুরি চেপে ধরে ছাদের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে এক মানবি। নিস্তব্ধ পরিবেশে প্রবাহমান ধমকা হওয়ার সহিত তিমিরাআচ্ছন্ন আকাশের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ এক নিগূঢ় সান্নাটা ঢেলেদেয় প্রকৃতিতে।
নিস্তব্ধত রজনীতে পরনের হলুদ শাড়েটা বার বার বাতাসের ঝাপটায় উড়ে যাচ্ছে। নীলাভ চোখ দুটো রক্তিম, মায়াবি কোমল বদনে নিগূঢ় বিষাদের ছাপ।
এতটুকু জীবনে শত শত ব্যর্থতার ভাড়ে নুইয়ে পড়েছে তার সকল মনবল হার মানে নিয়েছে সে জীবনের নিকট?
নিজের জন্মদাত্রী মাই যেখানে বুঝলো না সেখানে অন্যরা বুঝবে সেটা কল্পনা করা নিছক মুর্খামি ব্যতীত অন্য কিছু নয় , নিজের গর্ভধারিণী মা যেখানে “নষ্টা” বলে আখ্যায়িত করল সেখানে অন্যদের “কলঙ্কিনী” বলাটা বিশেষ দোষের কিছু নয়।
পৃথিবীতে কারো কাছেই তার খুব একটা মূল্য নেই মূল্য নেই তার অনুভূতির।
না চাইতে ও সকলে কেন জানি তার ভালো করতে উঠে পড়ে লেগেছে কিন্তু সে আসলে কিসে ভালো থাকবে তা নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই।
পৃথিবীর একমাত্র বান্দা যে কিনা তার ভালো চায়নি ভালোরেখেছিলো, সেও এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে “ভালো চাইতে শুরু করেছে।”
অবশেষে শেষ চেষ্টাটাও ব্যর্থ হলো।
প্রিয়তার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
না চাইতেও উগরে আসা কান্নাতে দম বন্ধ হয়ে আসছ মেয়েটার।
বাড়ি ভর্তি মানুষ তাই শব্দ প্রতিহত করে, ডান হাতে মুখ চেপে ধরলো।
তীব্র দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার ব্যর্থতার মিশেলে এখন নতুন এক অনুভূতি কাজ করছে — অপরাধবোধ।
কিন্তু সে তো নিজের স্বার্থে শুদ্ধ ভাইয়াকে ব্যবহার করতে চায়নি — একদম চায়নি ব্যবহার করতে।
শুধু শুনতে চেয়েছিল সেই শব্দগুচ্ছ গুলো যেগুলো শোনার জন্য তার প্রাণ ছটফটি মরছে বহু বছর — সে শুধু দেখতে চেয়েছিল তার প্রিয় পুরুষের উন্মাদনা, ভালোবাসার গভীরতা।
কিন্তু জীবনের এই অন্তিম পরীক্ষাতেও সে ব্যর্থ।
এখন আর বেঁচে থাকার কোনো পর্যাপ্ত কারণই বেঁচে নেই তার হাতে।
পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলা মানে এখন অযথা অক্সিজেন দূষিত করা।
বেঁচে থাকলে কাল তাকে অন্য পুরুষের ঘরে, অন্য পুরুষের বিছানায় যেতে হবে।
অন্য পুরুষের গভীর ছোঁয়া মারতে হবে গায় — না না, এ অসম্ভব।
প্রিয়তা এসব ভাবনাতে আরো বেশি প্যানিক করতে লাগলো।
ফুলো ফুলো রক্তাভ দুই চোখ বেয়ে অনর্গল গড়িয়ে পড়তে লাগলো উষ্ণ জলের নদী।
সত্যটা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে সকলের কাছে সে অপরাধী —
কিছু না করেই অপরাধী।
কেবল ভালোবাসার অপরাধে অপরাধী।
“নষ্টা”, “চরিত্রহীন”, “কলঙ্কিনী”।
কত শত অপবাদ ছুটে আসে তার দিকে প্রতিনিয়ত!
আর সেগুলো সে নিজেও অস্বীকার করে না।
সত্যিই তো সে — “নষ্টা, কলঙ্কিনী” — এতে কোন সন্দেহ নেই!
কৈশোরের শুরুতে নিজের অজান্তেই যে মানুষটাকে মন গহীনে জায়গা দিয়েছিলো, অপ্রতিরোধ্য ভাবে ভালোবেসেছিল —
সে মানুষটাই যখন বোনের স্বামী রূপে চোখের সামনে হাজির হলো, তখন প্রিয়তা নিজের বারন্ত অনুভূতির পায়ের শিকল পড়াতে পারেনি।
দূরে সরে যেতে পারেনি।
কিশোরী কালের অবুঝ প্রেম রূপ নিয়েছিল নিষিদ্ধ আসক্তিতে।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভালোবাসার রং গাড় হয়েছে, আগের চেয়ে ও তীব্র হয়েছে।
বোনের সংসার ভাঙতে চাইতেও — দ্বিধা করেনি।
কারণ আবরার শিকদার প্রণয় কে সে কোনদিনো “দুলাভাই” হিসেবে দেখেইনি — সব সবময় সে তার নিকট সেই “প্রণয় ভাই” হয়েই থেকে গিয়েছিল যাকে সে ভালোবাসে।
তাই এসব মেয়ে মানুষকে লোক আর কিবা বলবে!
যা সত্যি তাই বলে।
কিন্তু এখন আর আঁকড়ে ধরার কিছু নেই।
যে মানুষটার জন্য সে এত কলঙ্কিত হয়েছে, এত এত অপবাদ গায়ে মেখেছে — দিন শেষে সেই মানুষটাও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সে তার কেউ নয়।
আপন বলতে তার কেউ নেই।
নিজের মায়ের পেটের ভাইও যা নয় তাই শুনিয়েছিল।
তাও সব কটু বাক্য মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছিল প্রিয়তা, ধৈর্য ধরেছিল নিরবে।
তখন তাকে এটুকু ও সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ ছিলনা —
যে একসময় সবকিছু থেকে আড়াল করত একটু ঘাবড়ে গেলেই মাথায় হাত রেখে বলতো,
“চিন্তা করিস না, আমি তো আছি। আমি সব ঠিক করে দেবো।”
এই নিশ্চয়তা ছাড়া সে বেঁচেছে চারটা বছর।
এখন প্রিয়তার নিজের প্রতিই মন উঠে গেছে।
প্রিয়তা নাক টেনে কান্না থামালো।
ফল কাটার ছুরিটা সাহস নিয়ে চেপে ধরলো।
বাঁ হাতের শিরায়।
ভয়ে শরীর কাঁপছে থর থর করে।
ভয় দমাতে ঢোঁক গিলে চোখ টিপে বন্ধ করে নিলো প্রিয়তা।
ধারালো ছুরিটা হাতের শিরায় চালাতে নিতেই কল্পনায় ভেসে উঠলো আকাঙ্ক্ষিত সেই পুরুষালী মুখাবয়ব।
ঝট করে চোখ খুলে ফেললো প্রিয়োতা।
ছুরির দিকে চেয়ে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বললো,
“মরেই যখন যাবো, তখন আফসোস কেন সাথে নেবো প্রণয় ভাই?
আপনার শেষ দর্শন না পেলে রুহু আমার দেহ ত্যাগ করতে চাইবে না, অকাতর পিপাসায় কাতরাতে থাকবে জনমভর,”
বলে ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো প্রিয়তা।
এলোমেলো শাড়ির কুচি ধরে দৌড়ে নেমে গেল ছাদ থেকে।
মধ্যরাতে এক পিঠ খুলা, চুলে এলোমেলো, শাড়িতে—
পিছন থেকে যে দেখবে সেই ভয় পেয়ে যাবে।
পূর্ব আকাশের জমাট বাঁধা কালো মেঘের ঘুরুম ঘুরুম শব্দে কেঁপে উঠছে প্রকৃতি, তীব্র সাদা আলোর প্রতিফলনে এক মুহূর্তে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ —
এ যেন প্রকৃতির কোন অসনি সংকেত।
ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে তিন তলার ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে পড়েছে প্রণয়, ওহ্ অবির্ভাব।
পরপর চারটা হুইস্কির বোতল খালি করে পঞ্চম টা হাতে নিয়েছে অবির্ভাব, নেশার ঘুরে উল্টাপাল্টা বকছে সে — তবে এসবে কিছুই বলছে না প্রণয়, নেশা ও করছে না, কেবল এক ধ্যানে চেয়ে আছে শূন্যে।
তার ডার্ক রেড ওষ্ট কোনে লেপ্টে আছে এক টুকরো প্রশান্তিময় হাসি।
অবির্ভাব বিদেশি মদের নেশায় বোধ হয়ে আছে তবু ও তার দৃষ্টি এড়ালো না এই মহা আশ্চর্যজনক দৃশ্য — সে নিবু চোখে চেয়ে দেখলো প্রণয় হাসছে।
অবির্ভাবের নেশা নেশা মুডটা কেমন ঘেঁটে গেল।
সে প্রণয়ের কলার টেনে ঝাঁকিয়ে শুধালো,
“এই! তুই কাঁদছিস না কেন? বল কেঁদে হালকা হচ্ছিস না কেন? স্টোক করবি তো?”
অবির্ভাবের বিস্ময় অবলোকন করে পুনরায় হাসলো প্রণয়,
শার্টের কালার হইতে আবির্ভাবের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“সুখের দিনে কাঁদবো কেন খামোকা?”
“সুখের দিন?” — অবির্ভাবের কণ্ঠে চমক।
প্রণয় আবির্ভাবের হাতের হুইস্কির বোতলে এক ঢুক দিয়ে হেসে বলল, “হ্যাঁ, আজ আমার সুখের দিন। আজ আমি খুশি, খুব খুশি। কাল আরো বেশি খুশি হবো, নিশ্চিন্ত হব,। অবশেষে আমি একজন সঠিক মানুষের হাওলা করে দিতে পারছি আমার বাচ্চাকে,যে আমার উপস্থিতিতে তাকে কখনোই ভালোবাসার অভাব বোধ করতে দেবে না।”
“একজন সঠিক মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছিস এটা দেখলি, অথচ সেই মানুষটা তোর থেকে চিরতরে আলাদা করে দেবে সেটা দেখলি না?”
“দেখেছি।”
“দেখেছিস?”
“হ্যাঁ,
“তারপরও এতটা নিশ্চিত।”
“হ্যাঁ?
“কারণ?”
“কারণ আমি সেটাই চাই।, আমি সত্যি চাই, সে আমাদের দুজনের মধ্যে দেয়াল তুলে দিতে সফল হোক— না কেবল শারীরিক, মানসিকভাবেও একটা শক্তপক্ত দেয়াল তুলে দিক।”
“একটা এমন প্রাচীর, যেটা টপকে আমার জান আর কোনোদিন আমার কাছে আসতে চাইবে না, আমার সান্নিধ্যের লোভে কাঁদবে না, আমাকে মনে করবে না।””আমি যেন তার ছোটখাটো ভুলগুলোর মধ্যে একটা হয়ে থেকে যাই আজীবন।”
ভবিষ্যতে আমাকে যখন মনে পড়বে তখন যেন চোখ না ভিজে হাসি আসে।
প্রণয়ের নিলিপ্ততায় বলা কথাগুলোতে অবির্ভাবের চোখে অশ্রু চলে এলো। সে প্রণয়ের বুকের বা পাশে আস্তে একটা পাঞ্চ মেরে বললো,
“এতো ধৈর্য কীভাবে ধরে আছিস ভাই? এখানের ব্যথা কিভাবে সহ্য করছিস? পুড়ে যাচ্ছে না এই পাশটা?””তুই মরে যা ভাই, তবু ওহ্ আমার সামনে এভাবে হাসিস না। তোর এই হাসি আমার সহ্য হচ্ছে না।”
প্রণয় কেবল হাসলো, অবির্ভাবের কাঁধ চাপড়ে বললো,
“শুধু আবেগ বেচে কী দুনিয়া চলবে অবির্ভাব? বিবেকের দায়ে কখনো কখনো আবেগকে পুড়িয়ে মারতে হয়, যেমন মারছিস তুই।”
চুপ করে গেল আবির্ভাব।
“যে ছোট পুত বড়ো করে, সেই বুঝে তার মর্ম। আর কে বললো আমার এখানটায় ব্যথা হচ্ছে না? নিজের কলিজাটা অন্য কাউকে ছিড়ে দিলে বুঝি ব্যথা হয় না? খুব ব্যথা হচ্ছে। এমন ব্যথা যা আগে কোনো দিনও অনুভব করিনি। কিন্তু এতকিছুর পরেও কোথাও একটা শান্তি লাগছে, নিশ্চিন্ত লাগছে।”
অবির্ভাব শুধু হতবাক নেত্রে চেয়ে চেয়ে দেখলো, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কেউ এভাবে কিভাবে হেসে হেসে নিজের কষ্টের স্বীকারোক্তি করতে পারে — জানা নেই অবির্ভাবের।
“এতো ভালোবাসিস — এই কথাটা একবার বার মুখ ফুটে কেন বললি না মেয়েটাকে? কেন বললি না তার কল্পনা তোর ভালোবাসার গভীরতা মাপতে অক্ষম — কেন বললি না? সব মিথ্যে, সব সাজানো — কেন বললি না? তুই শুধু তাকে ভালোবেসেছিস — তার ছিলি আর তারই আছিস?”
“সে জানে তুই অন্য কারো স্বামী, কিন্তু এটা তো সত্যি নয়! বরং ধ্রুব সত্য তো এটা — যে তোর জীবনে সে ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো নারীর অস্তিত্ব কোন কালেই ছিল না — কেন বললি না? তুই অবিবাহিত, অন্য কারো স্বামী নস — কেন বললি না? তার সব ধারণা ভুল। এতো এতো না বলা কথা বুকে জমিয়ে মরে গেলে — তুই শান্তি পাবি তো ভাই?”
“সব কথা সবার জানার প্রয়োজন নেই, অবির্ভাব। কিছু কথা অজানা থাকাই মঙ্গল, এতে বিপদ কমে। আমি আমার রক্তজবা কে সব সময় সবার থেকে আলাদা রেখেছি। কারো বদ নজর পড়তে দিইনি, কারো কোন ষড়যন্ত্রের শিকার হতে দিইনি। সব কিছুতে সবার আগে নিজের বুক পেতে দিয়েছি।”
“মাসুম আমার জান — সব কিছু থেকে অজ্ঞ, আর এটাই ওর জন্য সঠিক। আমি অভিশপ্ত, অবির্ভাব, আমি চাই না আমার অভিশাপের— এক চুল পরিমাণও ওর গায়ে লাগুক। আমি সব যাতনা সহ্য করে নেব কিন্তু এটা সহ্য করতে পারবো না। আমার আশেপাশে বন্ধুরূপি শত্রুদের কোন অভাব নেই। তুই বুঝবি না।”
“তুই পচে যাসনি ভাই।”
ব্যাঙ্গাত্মক হাসলো প্রণয়, তাচ্ছিল্য করে বললো, “আমার থেকে জঙ্গলের জানোয়ারগুলো অধিক মমতাপূর্ণ।”
“সেটা বড়ো কথা নয়, প্রণয়, কারণ তুই ও জানিস — বাঘ সবকিছু শিকার করলেও, ও নিজের বাচ্চাকে কখনো খায় না।”
“খায় না, কিন্তু যে বাঘ একবার শিকারীর জালে জড়িয়ে যায় — তাকে আর কখনো তার বাচ্চার কাছে ফিরতে দেওয়া হয় না। আমি আর বেশি সময়…”
হঠাৎ প্রণয়ের হাত চেপে ধরলো অবির্ভাব। কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে গেলো প্রণয়। চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো — “কি?”
অবির্ভাবের চেহারা হুট করে থমথমে হয়ে এলো, সে ইশারায় পিছনে দেখতে বললো।
প্রণয় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে পিছন ঘুরে চাইলো। সাথে সাথেই হয়তো কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়লো, কিন্তু প্রণয়ের বোধ হলো — সেটা হয়তো তার মাথাতেই পড়েছে।
বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো প্রণয়।
একটু দূরে টলমলে চোখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। তার নীলাভ রক্তিম চোখদুটো অবিশ্বাসের জোয়ার। প্রণয়ের ওর চোখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো, সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই, সে ধরা পড়ে গেছে। বিষয়টা ধামাচাপা দিতে মিচে রাগ দেখানোর চেষ্টা করল প্রণয়। বক্ষের কম্পন রোধ করতে চোখমুখে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তুলতে চাইল। প্রিয়তার নিকট এগিয়ে এসে রাগান্বিত কন্ঠে ধমকে উঠে বলল—
“এতো রাতে এখানে কী চাই তর? জানিস না তুই আমি এখানে একা থাকি? তাহলে আমার ঘরের সামনে কী করছিস তুই?”
এসব ধমকানি-চমকানি কানে নিলো না প্রিয়তা। এসব যেন সে শুনতেই পেলো না। অবিশ্বাসী চোখে একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের বাদামী চোখের গভীরে।
প্রণয়ের হার্ট রেট দ্রুত হচ্ছে, সে অন্যত্র দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। অস্থির কণ্ঠে চেচিয়ে বললো—
“এক্ষুনি চলে যা আমার সামনে থেকে! দূর হয়ে যা আমি তকে দেখতে….!”
পরবর্তী শব্দগুচ্ছ, আর কণ্ঠনালী বেধ করে উঠে আসতে পারল না প্রণয়ের। তার পূর্বেই ছোট্ট দুটো হাতের কোমল বন্ধনে আবদ্ধ হলো তার সামর্থ্যবান পুরুষালি কায়া। গুমোট পরিবেশে আচমকা ফুপিয়ে উঠার শব্দ শোনা গেল।
নোনতা পানির ধারায় ভেসে যেতে লাগলো প্রণয়ের বুক।
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন, প্রণয় ভাই! সত্যি ভালোবাসেন! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। হায় আল্লাহ, আমি মরে যাবো খুশিতে! আপনি সত্যি আমার! আপনি বড় আপুর নন! আপনি আমার! আপনার এই বুকটা শুধু আমার!”
“আমার খুব কান্না পাচ্ছে, প্রণয় ভাই!” — বলে ঝর ঝর করে কেঁদে দিলো প্রিয়তা, আরো শক্ত করে খামচে ধরলো প্রণয়ের পিঠ।
“আপনি খুব পচা জানেন? আপনি জেনে শুনে আমাকে কত কষ্ট দিলেন! এতো কষ্ট কেন দিলেন প্রণয় ভাই? বলেন, কেন দিলেন? আর একটু হলেই তো আমি মরে যেতাম!”
এই স্বপ্নের মানুষটা একান্তই তার। কিছু মুহূর্তে ব্যবধানে প্রিয়তার আবারো নিজেকে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখী মেয়েটা মনে হচ্ছে। এতো সুখ সে কোথায় রাখবে!
এসব শুনে একচুলও নাড়ার সামর্থ পেলো না প্রণয়। বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। কী হলো এটা? এতো দিনের ধৈর্য সব এক লহমায় নষ্ট হয়ে গেলো? কী করবে এখন সে? এই অবুঝ মেয়েটাকে এখন কি বলে ফিরিয়ে দেবে?
প্রণয় চোখ বুজলো।
“আর কতো পরীক্ষা নেবে, মাবুদ!”
সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেলো প্রিয়তা। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে প্রণয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো, মাথার চুল খামচে ধরে বললো—
“নিচু হন।”
চুপচাপ ঘাড় নিচু করলো প্রণয়। এইখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত নয় ভেবে, বসা থেকে উঠে চলে গেলো আবির্ভাব।
প্রিয়তা আর কালবিলম্ব করলো না। ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রণয়ের অস্তিত্বে, উত্তাল ভালোবাসার তোড়ে ভিজিয়ে দিতে লাগলো প্রণয়ের সর্বকায়া। বুকের জমানো অনুভূতির সাগরে শুরু হলো তুফান।
প্রণয়ের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। অপ্রতিরোধ্য অনুভূতির জোয়ারে তলিয়ে যাচ্ছে হৃদয়। এক চুলও রাগ করতে পারছে না সে। উল্টো অনুভব করতে পারছে—এই নারীর কোমল ওষ্ঠের তপ্ত স্পর্শে তার সকল সংযম গুড়িয়ে যাচ্ছে। টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছে সেই মানুষটাকে, যাকে সে নিজের মধ্যে দমিয়ে রেখেছে বহু বছর।
প্রিয়তা দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে উন্মুক্ত ঝর্ণার ন্যায় আচড়ে পড়লো প্রণয়ের শক্ত, সমর্থ পুরুষালী বুকে। তার মাথায় এখন কোনো প্রশ্নই আসছে না।
তবে হঠাৎ করে কিছু মাথায় আসতেই প্রণয়কে ছেড়ে দাঁড়ালো প্রিয়তা। ঝটপট প্রণয়ের পুরুষালী হাত আঁকড়ে ধরে ব্যস্ত কন্ঠে বললো—
“আমি তো ভুলেই গেছিলাম! চলুন, চলুন!”
—বলে প্রণয়ের হাত ধরে সামনে কদম বাড়ানোর চেষ্টা করলো প্রিয়তা। কিন্তু একচুলও নাড়লো না প্রণয়। পরাজিত কণ্ঠে সুধালো—
“কোথায় যাবো?”
প্রিয়তা ফিরলো প্রণয়ের অন্য হাতে চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো—
“আব্বুর আর ভাইয়ার কাছে!”
“কেন?”
“কেন মানে? তাদেরকে বলতে হবে না? আমি শুদ্ধ ভাইয়াকে নয়, আপনাকে চাই! আমি আপনার কাছে থাকতে চাই! আমি আপনার হতে চাই। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। চলুন, তাড়াতাড়ি!”
—বলে আবার প্রণয়ের হাত ধরে টান দিলো প্রিয়তা।
কিন্তু এবারও এক চুলও নাড়াতে পারলো না তাকে। বরং নিষ্ঠুরতম কিছু বাক্য পেছন হতে ভেসে আসতে শুনা গেলো
“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না, রক্তজবা।”
এই একটি মাত্র বাক্যে মুহূর্তের মধ্যেই চোখে পানি চলে এলো প্রিয়তার। এতক্ষণের সকল আনন্দ ম্লান হয়ে গেলো নিমিষেই। সে পুনরায় অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের পানে।
প্রণয় অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে তুলনামূলক মোলায়েম কণ্ঠে বুঝালো—
“আমার তাকদিরে নেই তোমাকে বিয়ে করা। তোমার সাথে সুখের ঘর বাধা। আমার নসিবে অন্য কিছু আছে, রক্তজবা। চলে যাও তুমি। আর কোনো প্রশ্ন করো না আমায়।”
চোখের পানি ছেড়ে দিলো প্রিয়তা। প্রণয়ের বলিষ্ঠ বাহু আঁকড়ে ধরে বললো—
“এমন বলছেন কেন, প্রণয়? আপনি তো নিজের মুখেই বললেন আপনি আমায় ভালোবাসেন! বড় আপুর স্বামী নন আপনি! তাহলে সমস্যা কোথায়? কেনো নিজের সাথে সাথে আমাকে ও এতো যন্ত্রণা দিচ্ছেন প্রণয়? সত্যি বলছি, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!”
—বলে ডুকরে উঠলো প্রিয়তা।
প্রণয়ের কলিজায় ধক আগুন ধরে গেলো। নিজের অস্তিত্বই মিটিয়ে দিতে ইচ্ছা করলো দুনিয়া থেকে। সে কিছুতেই আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। প্রিয়তা দুই গালে হাত রেখে অসহায় কন্ঠে অনুরোধ করলো—
“আমাকে আর একটু ও জ্বালাস না সোনা, প্লিজ। চলে যা এখান থেকে। যা শুনেছিস সব ভুলে যা!”
—বলে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো প্রণয়।
প্রিয়তা আছোড়বান্দা একটুও নড়লো না। বরং শক্ত করে প্রণয়ের পেট জড়িয়ে ধরে পিঠে মাথা রাখলো। সাদা পাঞ্জাবিতে নাকের পানি, চোখের পানি মুছতে মুছতে জেদি কণ্ঠে বললো—
“আমি আজ আর কিছুতেই খালি হাতে ফিরবো না প্রণয় ভাই, আপনি আমার হবেন—এটাই শেষ কথা!”
প্রণয় বুঝলো, নিজেকে এখন দুর্বল দেখানোর মানে মেয়েটাকে আস্কারা দেওয়া। এভাবে চললে মেয়েটা কিছুতেই দূরে যেতে চাইবে না, কথার আবদ্ধ হতে শুরু করবে।
তাই বাধ্য হয়ে প্রিয়তার হাত টেনে ধরে ঝটকা মেরে সামনে এনে দাঁড় করালো প্রণয়। চোখে চোখ রেখে কঠোর কণ্ঠে বললো—
“তুই বুঝতে পারছিস না? আমি তোকে বিয়ে করবো না! আমার আশয় থাকলে, তোকে আজীবন কুমারী হয়ে থাকতে হবে! তবু ও, তুই আমায় পাবি না, কোনদিনও পাবি না, কখনো না! আমার থেকে যত দূরত্ব বজায় রাখবি, ততই তোর জন্য মঙ্গল!”
প্রিয়তা পুনরায় জড়িয়ে ধরলো প্রণয়কে। বুকে মাথা রেখে বিশ্বাসী কণ্ঠে বললো—
“আপনি শুধু আমার হয়ে থাকুন। আর কোনো অমঙ্গলকে পরোয়া করে না। আপনার রক্তজবা আমার কাছে সবার আগে আপনি! আমি আপনার বউ হতে চাই, প্রণয় ভাই!”
প্রণয় আবারো প্রিয়তাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।
“তবু ও আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না। চুপচাপ ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়!”
প্রিয়তা শান্ত হয়ে গেলো। প্রণয়ের চোখে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে সুধালো—
“চলে যাবো?”
“হ্যাঁ।”
“সত্যি চলে যাবো?”
“হ্যাঁ।”
“কাল আমার বিয়ে।”
“তো?”
“তো আপনার কষ্ট হবে না? আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে অন্য কেউ বিয়ে করবে! আপনি যাকে…”
—বলে থামলো প্রিয়তা।
একদম চুপ হয়ে গেলো প্রণয়।
প্রিয়তা আরো দু’কদম এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো। আলগোছে হাত রাখলো প্রণয়ের হৃৎপিণ্ডের উপর। হৃদয়যন্ত্রটা কেমন অস্বাভাবিকভাবে বিট করছে। প্রিয়তা হাসলো। বাঁকা পথ অবলম্বন করল আরো কাছে এসে বললো
“শুনবেন এর পর কি কি হবে?”
প্রণয়ের বাদামি চোখে শীতলতা দেখতে পেলো প্রিয়তা। পুনরায় শুধালো—
“এর পর কী হবে জানেন?”
“কি?”
ঠোঁটে বক্র হাসি ফুটিয়ে তুললো প্রিয়তা। নিজেদের মধ্যেকার সেন্টিমিটার সম দূরত্বটুকুও ঘুচিয়ে দিয়ে স্লো ভয়েসে বললো—
“এর পর ফুলশয্যার বিছানায় প্রেম বিনিময় হবে। আদরে আদরে অতৃপ্ত সত্তার তৃপ্তি মিলবে। জানতে চান কিভাবে?”
প্রণয় জবাব দিলো না। প্রিয়তার নীলাভ দৃষ্টির পানে নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে রইলো কেবল।
প্রিয়তা আচানক প্রণয়ের হাত তুলে নিজের গালে চেপে ধরলো। চোখ বুজে বললো—
“প্রথমে এখানে অলতো হাতে ছুয়ে দেবে…”
এর পর কপালে ছুঁয়ে বললো—
“এর পর এখানে তপ্ত ঠোঁটের পরশ একে দেবে…””বিমোহিত কণ্ঠে বলবে, ‘তুমি শুধু আমার।’”
এর পর প্রণয়ের প্রিয় রক্তিম ওষ্ঠে স্পর্শ করিয়ে বললো—
“এরপর এই ঠোঁটের স্বাধ নিয়ে বলবে—‘তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী।’”
“এর পর এখানে… এর পর গলায়… এর পর ঘাড়ে…”
প্রিয়তা লক্ষ্য করলো, ক্রমে ক্রমে প্রণয়ের চোখ মুখের শীতলতা উবে গিয়ে অগ্নিশিখার ন্যায় ঝলসে উঠছে হিংস্র লাগছে অনেকটা।
প্রিয়তা বাঁকা হাসলো। প্রণয়ের হাত ছাড়িয়ে এবার নিজেই টাচ করে করে দেখাতে শুরু করলো। পেটের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে মেদহীন ফর্সা উদর দেখিয়ে বললো—
“তার পর এখানে, হা…”
কথা সমাপ্ত করতে পারল না প্রিয়তা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে হেঁচকা টানে ছাদে রেলিঙে ঠেসে ধরলো প্রণয়। আবহাওয়া আরো খারাপ হয়েছে ততক্ষণে, ঝিরঝির বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।
প্রণয়ের ভয়াবহ লালচে চোখ দুটো দেখে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল প্রিয়তা—যেন পলক ঝাপটালেই টুপ করে গরম রক্ত গড়িয়ে পড়বে। সামনের রমণীকে খুন করার জন্য হাত নিশফিশ করতে শুরু করলো প্রণয়ের। সে প্রথমবারের মতো এই নারীর ক্ষেত্রে রাগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হল। ক্রোধ সংবরণে শক্ত করে চেপে ধরলো তার লম্বা চুলের মুঠি।
চুলের গোড়ায় বীভৎস টান লাগাতেই—
“আহ…” —বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো প্রিয়তা, কিন্তু তা যেন গায়ে মাখলো না প্রণয়।
প্রিয়তার নিকট মুখ এগিয়ে এনে ফ্যাসফ্যাসে গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললো—
“এসব কথা যদি আর একবারও ভুল করেও আমায় বলিস—সত্যি বলছি, খোদার কসম, একদম জানে মেরে ফেলবো! তোর এই নরম দেহটার এতো গুলো টুকরো করবো, যে তুই নিজেই নিজেকে চিনতে পারবি না!”
প্রণয়ের কণ্ঠে উপচে পড়ছে প্রতিহিংসার মিশ্রণের তীব্র অধিকারবোধ।
মনে মনে ভয়ে ঢুক গিলল প্রিয়তা। তবু ও আরো রাগিয়ে দিতে বলল—
“কেন? ভুল কী বললাম?”
“কোটি কোটি টাকা খরচা করে বিয়ে কী মানুষ শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য করে?” —নির্ভয়ে বলে উঠলো প্রিয়তা।
তার চোখে মুখে ভয় এর বিন্দুমাত্র ছাপ দেখতে পেলো না প্রণয়। এতে আরো ভীষণ রাগ ধরে গেলো মেয়েটার প্রতি।
প্রিয়তা পুনরায় বললো—
“আপনি তো পুরোটা না শুনেই চিৎকার দিচ্ছেন! আগে পুরোটা শুনুন!”
প্রণয়ের ভ্রু কুঁচকালো। প্রিয়তা ওর কানে কাছে ওষ্ঠ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—
“এর পর সেসব করবে, যেসব আপনি কোনদিনও করেননি। এমন ভাবে ভালোবাসবেন, যেভাবে আপনি কোনদিনও বাসেননি। এমন ভাবে ছুঁয়ে দেবেন, যেভাবে আপনি কোনদিনও দেননি। অসম্পূর্ণ আমাকে…?”
আবারো কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই প্রিয়তার চোয়াল চেপে ধরলো প্রণয়। মাথায় যেন খুন চেপে গেলো ছেলেটার। দাঁতের সাথে ত্বক লেগে গালের মাংস কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো প্রিয়তার। তবুও, মুখে “টু” শব্দ করলো না।
“আমার বুকটা পুড়িয়ে কী শান্তি পাচ্ছিস তুই? কেন আমাকে দু’মিনিটও শান্তিতে বাঁচতে দিচ্ছিস না? শত্রুতা থাকলে মেরে ফেল! তবু ও অন্যের বিছানায় কিভাবে শুবি, তার কাহিনী শুনাস না! সহ্য করতে পারবো না! নিজের অজান্তেই মেরে ফেলবো তোকে। তাই বাঁচতে চাইলে এভাবে তিলে তিলে না মেরে সোজা মেরে ফেল আয়ায়! বুকের গভীরে ছুরি চালিয়ে দে! আঘাত কর আমায়, শেষ করে দে!”
প্রিয়তার বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো। এতো ভালোবাসে মানুষটা, কই—কোনদিন তো বলেনি! প্রিয়তা অজান্তেই প্রণয়ের গাল ছুয়ে দিলো।
কান্না ভেজা অভিমানী কণ্ঠে বললো—
“ভুল কি বললাম? আপনি তো আমার কাছে কোনদিনও স্বীকার করিনি আপনি আমাকে ভালবাসেন! আর এখন বিয়ে ও করতে চান না! তাহলে আমি অন্য কার সাথে কি করলাম, তাতে আপনার কী?”
প্রণয় ক্রোধে জ্বলে উঠলো। প্রিয়তার চুলের মুষ্টিতে অমানবিক বল প্রয়োগ করে বললো—
“কেনো তুই বুঝিস না, তুই আমার জন্য কী?”
ব্যথায় প্রিয়তার চোখে পানি চলে এলো। তবু ও অসবের তোয়াক্কা না করে বললো—
“তাহলে একবার নিজের মুখে বলুন, আপনি আমায় ভালোবাসেন!”
সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো প্রণয়। চিৎকার দিয়ে বলল-
“হ্যাঁ! হ্যাঁ! ভালোবাসি! ভালোবাসি! ভালোবাসি! সীমাহীন ভালোবাসি তোকে! এই পৃথিবীকে যতোখানি ভালোবাসা ঘিরে রেখেছে, তার থেকে শতকোটি গুন বেশি ভালোবাসি তোকে! আমার ভালোবাসার আরম্ভ আছে, কিন্তু অন্ত নেই!”
“ভালোবাসার মতো তুচ্ছ একটা বাক্য দিয়ে আমি তোকে কোনদিনও বোঝাতে পারবো না আমি তোকে কতটা ভালোবাসি! আমার কলিজায় আঘাত দিয়ে কথা বলিস না, ময়না পাখি! তুই অন্তত আমার দুর্বল জায়গায় আঘাত করিস না!”
“এত ভালোবাসেন, তবুও বিয়ে করবেন না, তাই তো?”
কিছুক্ষণ চুপ থাকলো প্রণয়। অতপর প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো—
“meri zindagi ki raas mein ek raaz tum bhi ho
Mere khwahishon ki aas mein ek aas tum bhi ho
Tum kya ho mere liye? Kuchh ho ya kuchh bhi nahin
Magar meri zindagi ke kash mein ek kash tum bhi ho.”
“মানে”
“মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি বেসে যাবো। কিন্তু আমাদের মিলন সম্ভব নয়। ”
“প্রিয়তা বা হাতের তালুতে চোখ মুছে তাচ্ছিল্য হাসলো, ‘ঠিক আছে, আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে না। যে পুরুষ ভালবাসার স্বীকৃতি দিতে ভয় পায়, সে আর যাই হোক, পুরুষ হতে পারে না!'”
“প্রণয় নিশ্চুপ রইলো।”
“‘আপনার কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হোক, মিস্টার আবরার শিকদার প্রণয়! আমি তনয়া শিকদার প্রিয়তা আজ প্রতিজ্ঞা করছি—আর কক্ষনো আপনার কাছে ভালোবাসার দাবি করবো না! বলবো না, আমাকে ভালোবাসুন! আর কখনো আপনার কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবো না। বরং আমি তো মূর্খ—দেখতে পাইনি শুদ্ধ ভাইয়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। দেখুন তাকে,ওই মানুষটা আমাকে গোপনে ভোগ করতে চায় না—বিয়ে করে স্বীকৃতি দিতে চায়!'”
“প্রিয়তার শেষ বাক্যে তাজ্জব বনে গেলো প্রণয়। বিস্মিত কণ্ঠে সুধালো, ‘আমি তোকে গোপনে ভোগ করতে চেয়েছি?'”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৭
“এই প্রশ্নের পরিবর্তে প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বললো, ‘পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট, নিষ্ঠুরতম মানুষ আপনি। আপনার থেকে বেশি নিষ্ঠুরতম পুরুষ এই গোটা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই, মিস্টার আবরার শিকদার প্রণয়! আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম, আপনি কোনদিনও ভালো থাকবেন না!’—বলে প্রণয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে গেলো প্রিয়তা।”
“প্রণয় নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার যাবার পানে।”
“‘আমি এতোটা নিকৃষ্ট জান! ভাগ্যিস, তুই বললি—তুই না বললে হয়তো জানতেই পারতাম না। তোর দেওয়া সকল অভিশাপ কবুল জান। দোয়া করি, এই নিকৃষ্ট মানুষটার ছায়া তোর উপর থেকে খুব দ্রুত সরে যাক, আর কখনও না পড়ুক।'”