তাজমহল পর্ব ৪৮
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
হাসপাতালের আলো ম্লান, সময় রাত বারোটা। তাজদারের অস্ত্রোপচার শেষ, কিন্তু চিকিৎসকরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল চোখে উদ্বেগ ও অবসাদ নিয়ে। রেজাল্ট এখনও সন্তোষজনক নয়।
মহিষের আঘাত কানে, গলায় আর বুকে এমন মারাত্মকভাবে প্রবেশ করেছে যে চিকিৎসকরাও ভড়কে গেছে। রক্তপাত থেমেছে, কিন্তু অসহায় দেহের কাঁপুনি রোগীর পরিবারের কাছে সহ্য করার মতো না।
বাইরে সবাই অপেক্ষামান। শাইনা মাথা ফেলে রেখেছে তার বড়ো বোনের কাঁধে। কিছুক্ষণ আগেই সে বমি করেছিল। এখনো পর্যন্ত কিছু খায়নি। ধরতে গেলে আজ সারাদিন সে খালি পেটে। খেয়েছে আর তারপর বমি করেছে। তাজদারের মামারা বলছিল ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ও অসুস্থ হয়ে পড়লে সমস্যা। এত দুশ্চিন্তা নেয়াটাও ঠিক না। কিন্তু শাইনা যেতে চাইছিল না। আনিসও বললো, ও থাকুক। অস্ত্রোপচার শেষে চলে যাবে।
সবাই আতঙ্কমুক্ত হতে চাইছিল, কিন্তু ডাক্তাররা সন্তোষজনক কোনো বার্তা দিতে পারল না। তাজদার সিদ্দিকীর জ্ঞান ফিরলে তখনই তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। অপেক্ষার সময় আরও দীর্ঘতর হয়ে উঠল। সময়টা চক্রের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাজদারের জ্ঞান ফেরার আশায় এতগুলো মানুষ সেখানে বসেছিল রাতভর। সবার রীতিমতো খিদে পেয়ে বসেছে। নাশতাগুলো সব ঠান্ডা হয়ে আছে। কেউ খেতে চাইছেনা।
আশরাফ, আনিস সবার জন্য ভাত এনেছে।
কিন্তু কারো খাওয়ার রুচি নেই। রায়হান ধমকে বলায় তিতলি, তৌসিফ, শাওন আর তাসনুভা একসাথে বসে খাওয়া শুরু করলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাসনুভা হাঁসের ডিম আর মাংস দেখে নাক সিটকে বলল,”আনিস ভাই আমি আসলে হাঁসের মাংস, হাঁসের ডিম কোনোটাই খাই না।”
আনিস তার কথায় শুনে সবার সামনে লজ্জায় পড়ে গেল। তৌসিফ চোখ রাঙিয়ে তাকালো তাসনুভার দিকে। তাসনুভা তার চাহনি দেখে চুপসে গেল।
আনিস একটুপর অবিচল ভঙ্গিতে বলল,
“না খেলে ফেলে দাও। এতরাতে বিরিয়ানি পাওয়া যাবে না।”
কথাটা সে একটু রেগে, স্পষ্টভাবে বলল। কাউকে সমীহ করে কিংবা মৃদু ভঙ্গিতে বলার দরকার মনে করেনি। সময়টাই এমন। শান্তভাবে কথা বলা যাচ্ছে না।
তাসনুভা কণ্ঠে ক্ষোভ চাপিয়ে বলল, “আমি কি বিরিয়ানি চেয়েছি আপনার কাছে?”
রায়হান ওপাশ থেকে গর্জে উঠল, “নুভা, কি হয়েছে?”
তাসনুভা বকুনি খেয়ে আনিসের দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে তাকালো। এই ছেলেটার কারণে তাকে বকুনি খেতে হয়েছে।
আনিস অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবুক হয়ে কি যেন ভাবছিল। তাসনুভার দিকে চোখ পড়তেই তার কপাল ভাঁজ হয়ে এল । এই মেয়ের সমস্যা কি? এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে এত রাতে বিরিয়ানি কোথায় পাবে?
তাসনুভা ডিম, মাংস দিয়েই ভাতটা খেল জোরপূর্বক। অবশ্য বেশ ভালো করেই খেয়েছে। কারণ তারও খিদে লেগেছিল।
বড়োরা বলায় আনিস আশরাফ রায়হানও খাওয়াদাওয়া সেড়ে নিল দাঁড়িয়ে বসে যে যেভাবে পারলো। শাইনার একদম খেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ঝিমলি তাকে জোরপূর্বক দুই তিন লোকমা খাইয়ে দিল। ভাতগুলো শাইনা গিলতে পারছিল না। এতটাও কঠিন পরিস্থিতি তার জীবনে কখনো আসেনি যখন তার ভাত গিলতে কষ্ট হয়েছে। আজ ভাতের দানাগুলোকেও তার আপদের মতো লাগছে।
সবার চোখমুখের বেহাল দশা। এত ছোটাছুটি, দুশ্চিন্তা, সামনে কি হবে তা নিয়ে নানান কল্পনা জল্পনা। তাজদারের জ্ঞান ফিরছেনা। ডাক্তাররা জানালো সকাল সাতটার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে……
তাজদারের মামারা তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে তাকে। এখানে বসে থেকে লাভ নেই। সবাই যা-ও একটু স্বস্তিতে ছিল। শান্ত হয়ে বসে আরাম করছিল কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে আবারও কান্নার রব উঠলো। রওশনআরাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি কেউ। তাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে সবাই চুপ হয়ে গেছে। শাইনা মুখ লুকিয়ে রেখেছে মায়ের কাঁধে।
গোটা একটা রাত সবার হাসপাতালের বারান্দায় কেটে গিয়েছে। তবে সুসংবাদ শোনা গেল।
ফজরের আজানের একটু পরপরই ডাক্তাররা জানালো রোগী রেসপন্স করেছে।
তাজদারের মামারা তারপরও সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এখানে চিকিৎসা করাবেন না তারা।
তাজদারের সাথে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল রওশনআরা। রায়হান ডাক্তারকে বলেকয়ে নিয়ে গেল। ডাক্তারকে বলল,”চোখ মেলেছে? কথা বলতে পারবে?”
ডাক্তার বলল,
“না না এইমুহূর্তে তার কথা না বলাটাই ভালো হবে। হুঁশ যেহেতু এসেছে চোখও মেলবে। কিন্তু আপনারা প্লিজ রোগীর সামনে কান্নাকাটি করবেন না। ভিড় জমাবেন না। শুধু তার ওয়াইফকে রাখুন। আর উনি কে হন?”
“মা।”
“তাহলে উনাকে একাই যেতে দিন।”
রওশনআরা একাই গেল। ছেলের হাত আর শরীরটাতে আলতোভাবে হাত বুলালো কাঁদতে কাঁদতে। রায়হান পেছন থেকে বলল,
“এখানে কাঁদা যাবে না। চলো। ও কান্নার শব্দ শুনতে পেলে সমস্যা হবে।”
রওশনআরা শুনতে চাইলো তার কণ্ঠটা। তিনি ধীরেধীরে ডাকলেন,”তাজ? মা ডাকছে। শুনতে পাচ্ছ?”
একটা নার্স আশেপাশে ছিল। সে বারবার সাবধান করছে না ডাকতে। কণ্ঠনালী মারাত্মক জখম হয়েছে। ব্যাথায় কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
নিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে বেলা এগারোটার দিকে তাজদার হালকা পাতলা চোখ মেলেছে। শ্বাসপ্রশ্বাস তখনো ভারী। উঠছে আর নামছে। চোখের পাতা ভার। উঠছেই না কোনোমতে। যতটুকু উঠেছে ততটুকুতে সবাইকে দেখছে কিনা কে জানে। তবে ঠোঁট নড়ছে। কি বলতে চাইছে কেউ বুঝতে পারছেনা। রওশনআরা তার মুখের সামনে গিয়ে বলল,”তোমার বুড়ো মাকে এত কষ্ট দিওনা। আমি তোমাদের জন্যই তো বাঁচি। আমার কোলে ফিরে এসো বাবা। তাজ? আমাকে চিনতে পারছো? তোমার মা।”
তাজদার সিদ্দিকীর ঠোঁট নড়লো। রায়হান তার মাথায় আলতো করে হাত বুলাচ্ছে। তাজউদ্দীন সিদ্দিকীও এল সেখানে। ছেলেকে দেখে তিনি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না সেখানে।
রায়হান তাজদারের মুখের কিছুটা কাছে কান পেতে শুনলো সে রওশনআরার প্রশ্নের জবাব দিতে চাইছে। রওশনআরা বললেন,
“ও রায়হান ও আমাকে চিনতে পারছে?”
“আশ্চর্য, চিনতে পারবে না কেন?”
তাজদার তখুনি কিছু একটা বলছে। রায়হান শুনলো মা মা এই ধরণের কিছু একটা শব্দ হচ্ছে। রওশনআরা একটু স্বস্তি পেল রায়হানের মুখে কথাটা শুনে। রায়হান নিয়ে গেল উনাকে।
তাজদারকে এখুনি নিয়ে যাওয়া হবে। সবাই তাড়াহুড়ো করছে বাইরে। সাথে মহিলাদের মধ্যে কে যাবে এটা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা চলছে।
শাইনার কথা উঠতেই তাজদারের মামা খালুরা সরাসরি বলে দিল, বউ নিজেই অসুস্থ। ও কিভাবে দেখাশোনা করবে?
শাইনা যেতে পারবে বলার পরও উনারা রাজী হলেন না। সুস্থ সবল মানুষ দরকার। শেষমেশ রওশনআরা, তিতলি, তাসনুভাকেই পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হলো। তাসনুভা শাইনার উদ্দেশ্যে বলল,”ইউজলেসদের কাজ নয় রোগীর সেবা করা।”
শাওন পাশ থেকে বলল,”ও তো যাবে বললো।”
আনিস বলে উঠলো,”ইউজলেস ও? ও নিজে অসুস্থ, তারউপর ওর বরের এমন অবস্থা। ও নিজেকে সামলেছে এটাই তো বেশি। ইউজলেস কাকে বলছো? কথা বলার আগে তুমি ভাবোনা?”
তাসনুভা দাঁত কটমট করে তাকালো। এদের জন্য কোনো কথাও দেখছি বলা যাবেনা।
“আমার ভাইয়ের এমন পরিস্থিতিতে আমি আমার ভাইয়ের বৌকে যা ইচ্ছে বলবো।”
শাহিদা বেগম বললেন,”আনিস এদিকে আয়।”
আনিসকে টেনে নিয়ে গেলেন উনি।
“থাক বাদ দে। ওর ভাইয়ের এই অবস্থা। তাই রাগের বশে বলছে। বাদ দে।”
আনিস নিজের মেজাজ সামলে একবার শাইনার দিকে তাকালো। নিজের বোনটার জন্য তার মায়া হচ্ছে। সে শাইনার কাছে গিয়ে বললো,”এদিকে আয়।”
শাইনা তার পিছু পিছু গেল। আনিস তাকে তাজদারের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দিল।
তাজদার সিদ্দিকীর চোখদুটো আগের মতো। পুরোপুরি বন্ধ না। আবার খোলাও না। বুক ধীরেধীরে উঠানামা করছে। শাইনা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আনিস বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শাইনা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে তাজদারের আঙুলটা আবারও ধরলো মুখের একটু ঝুঁকে। তাজদারের চোখের পাতাটা একটু নড়ে উঠলো। ঠোঁটও। শাইনা আলতো করে তার মুখের পাশের ব্যান্ডেজে কাঁপা হাতটা ছুঁয়ে বলল,”আমার কথা শুনছেন?”
তাজদার সিদ্দিকী চোখের পলক ফেললো আস্তে করে। শাইনা তা দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,”আপনার কি বেশি কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আমি যাই আপনার সাথে? ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না। আমি যেতে চাইছি কিন্তু ওরা কথা শুনছে না।”
বলতে বলতে শাইনা করুণ সুরে কেঁদে উঠে নিজেকে আবারো সামলে নিল। তাজদার কিছু বলতে চাচ্ছে। বাইরে সবাই কথা বলছে। শাইনাকে বেরিয়ে আসতে বলছে। শাইনা তার কানটা তাজদারের একটু সামনে নিয়ে গেল। কি বলতে চাইছে সেটা শোনার জন্য।
“কি বলছেন শুনতে পাচ্ছি না? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন।”
তাজদার ঠোঁট নড়ছে ক্রমশ। গলার ভেতর থেকে আওয়াজটা বেরিয়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শেষে হিসহিসিয়ে একটা শব্দ বের হলো, আর শাইনার কানে সেটা যেন “সরি” হয়ে বাজলো। শাইনার বুক ভেঙে পড়ল। অজান্তেই চোখ থেকে অগণিত অশ্রু ঝরে পড়ল। সে হিসহিস করে উঠে তাজদারের বুকের উপর আলতো করে হাত রাখল।
“এভাবে কেন বলছেন? কোথায় চলে যাচ্ছেন সরি বলে? আমি সরি। আপনি কেন সরি বলছেন? আমি সরি… খুব সরি… আপনি আমার কাছে ফিরে আসুন। আমাদের সংসার হয়নি। বাচ্চা? আমাদের বাচ্চাকে দেখবেন না? ওটা আপনারই। আম্মা… আম্মারে… আম্মা!”
এলোমেলো হয়ে মাকে ডাকাডাকি শুরু করলো সে। তার দমবন্ধ হয়ে এল। নিঃশ্বাস না ফেলতে পারছে না নিতে পারছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীটা ধসে পড়ছে। সব ভেঙেচুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তার সামনে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতদিন সে কিচ্ছু হারায়নি কিন্তু আজ সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব হারিয়ে ফেলছে সে।
তার ডাক শুনে শাহিদা বেগম ঢুকে এসে তাকে ধরলো। শাইনা মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। যে কান্নাটা কাল রাত থেকে কেউ একবারও দেখেনি তা আজ সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখলো। কেউ তার কান্নার উৎস খুঁজে পেল না। আনিস, শাওন এসে তাকে বাইরে নিয়ে গেল। শাইনা তার বড়ো আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। তার গলা বসে যাচ্ছে। কণ্ঠ আটকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কণ্ঠনালীতে কোনো ধারালো অস্ত্র বসে গেছে।
“সবাই সরুন, সরে দাঁড়ান।”
মানুষের ভিড় ছিঁড়ে স্ট্রেচারে করে তাজদার সিদ্দিকীকে ধীরে ধীরে বাইরে আনা হলো। শাইনা বোনের কাঁধ থেকে মুখ তুলেই একবার তাকালো তার দিকে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাতের নাগালের বাইরে, চোখের আড়ালে। চারপাশে কান্নার রোল উঠল। শাইনা বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আবারও সে মুখ লুকিয়ে ফেললো কাঁধে। তার শরীরটা কাঁপতে লাগলো শিউরে শিউরে।
তাজমহল পর্ব ৪৭
তার মনে হচ্ছিল ওই চোখদুটো এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টি, যেটা থেকে পালানো যায় নি কোনোদিন। ওই দৃষ্টি সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না, ভুলতে পারবে না সেই শব্দটাও। সরি বলে কোথায় চলে যাচ্ছে? চারপাশের সবাই বলছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেঁদো না।
কিন্তু শাইনার কান্না থামলো না। কারণটা সে ছাড়া আর কেউ জানলো না।