নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৫

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৫
সিনথিয়া

বসন্তের রাতের এই হুটহাট বর্ষন, শহরের বুকে শীতের হিমটুকু ফিরিয়ে আনলেও পরিস্থিতি ঠান্ডা হলো না জামাই-শ্বশুরের মাঝে।
আয়ানের মাথা নোয়ানো। পুলিশ হয়েও বার দুয়েক ঢোক গিললো মেহমেদের রুদ্রমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। মেহমেদ দৃঢ় চোখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। আবার কিছুক্ষণ পরপর দৃষ্টি ফেলছেন হাতঘড়িতে।
যেন অপেক্ষায় আছেন আয়ানের উত্তরে খুঁত বের করার। খুঁত বের করতে পারলেই বিয়েতে বেঁকে বসবেন উনি।
‘ আমার দেয়া আড়াই মিনিট সময় শেষ হতে আর মাত্র এক মিনিটের মতো থাকলেও আমার মনে হয় না তোমার কাছে আমাকে দেয়ার মতো কোনো উত্তর আদৌ আছে! ওয়েল! হ্যাভ অ্য গুড নাইট দ্যান?’

বলেই উঠে দাঁড়ালেন মেহমেদ। তবে কিছু একটা মনে পড়তেই ফিরে তাকালেন আয়ানের দিকে।
‘ তাহলে কাল সকালে আরও একবারে দেখা হচ্ছে আমাদের? আর যখন তুমি বেরিয়ে যাবে এ বাড়ি থেকে, মনে করে আমার মেয়ের জীবন থেকেও একেবারে সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বের হবে আশা করছি!’
প্রৌঢ় ঠোঁটের বাঁকে তার তাচ্ছিল্যের হাসি। আয়ানকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উদ্যত হলেন রুম থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু চাইলেই কি সব হয়? দরজার ওপাশে পা বাড়ানোর আগেই তাকে ‘দাঁড়ান’ বলে আঁটকে দিলো অফিসার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আদালতের বিচারক পর্যন্ত আসামীর বয়ান না শুনে তার শাস্তির পরোয়ানা জারী করে না! আর আপনি কি-না আমার উত্তর না শুনেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন? দ্যটস রুড! জামাই না হোই! অন্তত অতিথি হিসেবে আমার সাথে কিছু মাত্র কার্টিসি মেইনটেইন করা উচিত ছিল আপনার মাই ডিয়ারেস্ট উড বি শ্বশুরমশাই!’
সহসা এই ভারী কন্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই
থমকালেন মেহমেদ। ফিরে চাইলেন বিরক্ত চোখে। আয়ান তখন মুখ তুলেছে। আত্মবিশ্বাসী হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে চোখে চোখ রেখেছে মেহমেদের।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন। রুশাকে আমার সাথে বিয়ে দেয়ার কোনো কারণই আমি আপনাকে দেখাতে পারবো না। একটা পরিবার ছাড়া বেড়ে ওঠা ছেলের হাতে আপনি কোন ভরসাতেই বা আপনার মেয়েকে তুলে দেবেন? তার উপর আমি যে পেশায় রয়েছি তাতে তো আমার নিজের জীবনেরই কোনো ভরসা নেই! বিশ্বাস করুন! আপনার জায়গায় আমি থাকলে ঠিক একই রকমভাবে ভাবতাম। হয়তো বাবা হিসেবে আমি আপনার থেকেও বেশি কঠোর হতাম মেয়ের বিয়ের সময়।
কিন্তু আমি আপনাকে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত করতে পারি! যে রুশাকে এতো বছর পর আপনি ফিরে পেয়েছেন সেই রুশাকে আমি আমার নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি! আর ওকে ভালো না বেসে বেঁচে থাকার কোনো উপায় আমার জানা নেই। যদি জানা থাকত, তাহলে এতোটা অযোগ্য মানুষ হয়েও এতো বড় আর্জি নিয়ে আপনার কাছে হাত পাততাম না আমি!’

‘আয়ান…!’
মেহমেদ হাসান ঐ পর্যন্তই থেমে গেলেন। তার পুরো কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দু’হাঁটু মেঝেতে ফেললো সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটা। হাঁটু গেড়ে বসতেই হুট করেই অবিচল কন্ঠখানা ভিজল আয়ানের। বাবা-মা থাকলে নিশ্চয়ই ওর হয়ে তারা রুশাকে চেয়ে নিতো মেহমেদ হাসানের থেকে?
আয়ান ঢোক গিলল। সেই ভেজা গলাতেই আওড়ালো,
‘ আমি যদি বিয়ে করি তাহলে রুশাকেই করবো! তাতে আপনার আমাকে যতখুশি অপছন্দ করার, আপনি নির্দ্বিধায় করতে পারেন! তবে আমি নিশ্চিত! মেয়ের জামাই হিসেবে না হই, মানুষ হিসেবে কখন আপনি আমাকে অপছন্দ করতে পারবেন না! এটুকু ভরসা নিজের উপর রয়েছে আমার!’

মেহমেদ হাসান নিশ্চুপ। তিনি সত্যিই কি বেশি বেশি করে ফেলেছিলেন? মানুষ হিসেবে আসলেই তো ছেলেটা খারাপ নয়! ছোটবেলা থেকে শেহজাদের সাথে বড় হয়েছে! মা-বাবাকে প্লেন ক্রাশে হারিয়ে পুরোপুরি এতিম একটা ছেলে! কত কেঁদেছে! কাঁদতে কাঁদতে যখন জ্বর চলে আসতো আয়ানের? তখন ওর দাদি মরিয়মের কাছে নিয়ে আসতো ছেলেটাকে।
মরিয়ম মায়ের মতো করেই বুকে আগলে নিতো ছেলেটাকে। মাথার পাশে বসে জলপট্টি লাগিয়ে দিতো। শেহজাদ আর আয়ানকে একসাথে খাইয়ে দিতো।

বোর্ডিং স্কুলে কতবার মেহমেদই তো গিয়ে গিয়ে দেখে আসতেন ছেলেটাকে! ছুটিতে বাড়ি নিয়ে আসতেন! শেহজাদ আর আয়ানকে তিনিও কি কখনো আলাদা চোখে দেখেছিলেন? দেখেননি তো! তাহলে আজ রুশার বিয়ের কথা উঠতেই এতো বেশি ভাবছিলেন কেনো তিনি? মেয়েকে আরো একবার কাছ ছাড়া হতে দেয়ার ভয়ে?
প্রলম্বিত শ্বাস ফেললেন মেহমেদ। আড়চোখে দেখলেন হাঁটু গেড়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকা আয়ানকে। যে তার মেয়ের জন্য এতোটা দূর্বল হতে পারে, তাকে কী করে সে পায়ে ঠেলবে?

মিষ্টি মেঘের ভেলায় চড়ে রোদ নেমেছে ঘাসফুলের গায়ে। গতরাতের বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে গেছে ইট-পাথরের রুক্ষতা, নির্জীবতা। নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে আরো একটি ব্যস্তদিনের।
সফেদ চাদরে আরশিকে মুড়িয়ে বুকে টেনে নিলো শেহজাদ। পারলে ঢুকিয়ে ফেলে বুকের ভিতর। বলিষ্ঠ হাতজোড়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে উন্মুক্ত পেলব পিঠ। শেহজাদের ঠোঁট চূড়ায় ওঠে। নীলাম্বরের তৃষ্ণা মিটিয়ে সে দেখতে থাকে তার প্রিয়দর্শিনীর চোখের ভেজা পাপড়ি। তারপর টুপ করে চুমু খেয়ে বসে সেখানে৷ চুমু খেয়ে গালের উপর দৃষ্টি ফেলে। ফের নিঃশব্দে হেসে চুমু খায় সেখানে। তারপর একে একে কপাল, নাক, চিবুক, ঠোঁট!
একপর্যায়ে বিরক্তিতে ভ্রুকুটি করে আরশি। ঘুমের ঘোরেই কোনোমতে আওড়ায়,

‘আপনি ভিজিয়ে ফেলছেন আমার মুখটা!’
শেহজাদ থামে। তড়িঘড়ি আলতো হাতে আবার মুছে দেয় চুমু খাওয়া জায়গাগুলো। তারপর নিরীহ স্বরে আওড়ায়,
‘মুছে দিয়েছি! আর ভিজে নেই কোথাও!’
আরশি জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি টেনে চোখ খুলল। দেখল শেহজাদের চোখমুখ উদগ্রীব। যেন বারণ না করলে হয়তো আরো শ’খানেক চুমু খাওয়ার প্রস্তুতি নেয়াই ছিল তার।
হতাশ চিত্তে দু’পাশে মাথা নাড়লো আরশি।
‘আপনার না সকালে ক্লাস আছে? তাহলে ঘুমোলেন না কেনো একটুও? এখন যদি শরীর খারাপ করে?’
‘ঘুমিয়ে গেলে তোমাকে দেখতাম কীভাবে?’
আরশি থতমত খায়। চোখ নামায়। পলক ঝাপ্টে আওড়ায়,
‘আর আপনার ক্লাসের কী হবে?’

‘রাতেই মেইল পাঠিয়ে ছুটি নিয়ে নিয়েছিলাম আজকের জন্য!’
বিস্ময়াহত হয় আরশির গোল গোল চোখগুলো। শেহজাদের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সাথে শুধালো,
‘তারমানে গতকাল রাতে যে বললেন আপনার ক্লাস আছে সকালে! সেটা বানিয়ে বলেছিলেন? আপনি প্রফেসর হয়ে মিথ্যেও বললেন সবাইকে?’
‘এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার ওয়াইফি! প্লাস, লেট মি মেইক অ্য স্মল কারেকশন। আমি পেশায় প্রফেসর! কোনো সাধুসন্ন্যাসী নই যে টুকটাক মিথ্যে বলতে পারবো না!’
কথাখানা শেষ করেই আরশিকে চোখ মারলো শেহজাদ। মিথ্যে বলায় আরশি এমনিতেই রেগে ছিল। শেহজাদকে চোখ মারতে দেখে তা যেন দ্বিগুণ হলো রমনীর। সে অন্যদিকে তাকিয়ে ভেঙিয়ে বলে উঠলো,
‘আপনি সাধুসন্ন্যাসীই হয়ে যান প্লিজ! তাহলে যদি রাতে একটু ঘুমোতে পারি আমি!’
তাতেই যেন শব্দ করে হেসে ফেললো শেহজাদ। তবে আরশি রেগে যাচ্ছে দেখে হাসি থামিয়ে দিলো সাথে সাথে। স্বর নামিয়ে কাছে ঘেষে শুধালো,

‘রাতে বেশি জ্বালিয়ে ফেলেছি তোমাকে? আচ্ছা সরি সরি! এখন একটু ঘুমিয়ে নাও জান! তারপর না হয় উঠে যেও!’
‘এতো মাখন লাগাতে হবে না! সকাল বেলা ঘুমোলে সবাই জিজ্ঞেস করবে না রাতে কী করেছি? ঘুমোইনি কেনো?’
শেহজাদ ঠোঁট কামড়ে হাসি আঁটকে রাখলেও আরশিকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না বিছানায়। সে চাদর পেচিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শেহজাদ টেনে ধরলো ওর হাত৷ চওড়া হেসে বলল,
‘সকালে উঠতে দেরি হয়েছে যখন, সবাই এমনিতেই বুঝবে রাতে কী করেছি! এতো ব্যস্ত হতে হবে না!’
আইঢাই করে উঠলো আরশি। রক্তিম মুখটা কোনোরকমে ফেরালো অন্যদিকে।
‘মনে তো হচ্ছে শর্টসার্কিট আমার ব্রেইনে নয়, এই জাম্বুবানের ব্রেইনে হয়েছে! নইলে সকাল হতে না হতেই কেউ এভাবে পঁচা কথা শুরু করে দেয়?’
শেহজাদ মাথা নিচু করলো। নিঃশব্দে চোখ খিঁচে হাসলো আরশিকে বিড়বিড় করতে দেখে। তারপর চোখ তুলে শুধালো,

‘তুমি শাওয়ার নিতে যাচ্ছ এখন?’
‘আপনার কী মনে হচ্ছে?’
‘চলো একসাথে যাই!’
তড়িৎ শেহজাদের হাসি হাসি মুখখানার দিকে তাকালো আরশি। চোখ ছোট ছোট করে দেখলো মানুষটাকে! নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আঁটছেন মনে মনে উনি! পরপর সপ্রশ্ন কন্ঠে শুধালো,
‘আপনি কেনো যাবেন আমার সাথে! আমি বলেছি?’
‘আমি কেনো তোমার বলার অপেক্ষায় থাকবো?’
‘আপনি…! আপনি আমার হাত ছাড়ুন!’
শেহজাদ সেসব শুনলো না। সে মনে মনে শুধু ভাবলো,
‘ বিয়ের পর হতে যতগুলো মূহুর্ত তোমার নষ্ট করেছি, সেই সবটা ঠিক করার দায়িত্ব এখন আমার! ইউ ডিজার্ভ দ্য ওয়ার্ল্ড, আই আই উইল গ্ল্যাডলি গিভ ইউ মাইন!’
আরশি অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো ফের,
‘ আপনার জন্য এবার সত্যি সত্যি অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে! আমার হাতটা ছাড়বেন নাকি স্নোবলকে ডাকবো? ডেকে বলবো, আপনাকে ভয় দেখাতে!’

স্নোবলের নাম শুনেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ল শেহজাদের। খরগোশ মশাই তো আবার মায়ের সব কথা শোনে কি-না! তবুও আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো,
‘তোমার মনে হয়? আমি স্নোবলকে ভয় পাই এখনও? ’
ভ্রু উঁচালো আরশি। ঝুঁকে এলো শেহজাদের মুখের কাছাকাছি। শুধালো,
‘ তাই নাকি? তাহলে ওর কামড় খাওয়ার আগেই কে যেন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সেদিন রাতে?’
অসহায় হাসলো শেহজাদ। তবুও হাত ছাড়লো না আরশির। নরম গলায় আবদার মিশিয়ে বললো,
‘তাহলে আমাকে শুধু একটু শেইভ করে দিও নিজের হাতে! তাতে তো সমস্যা নেই? তুমি আয়নায় দেখে এসো তোমার গালগুলো। কেমন লাল হয়ে হয়ে আছে দাঁড়ির খোঁচা লেগে!’
অমনি গালে হাত রাখলো আরশি! আসলেই কি ওর গাল গুলো লাল হয়ে আছে?
শেহজাদ ছদ্ম বিষন্ন গলায় বলে চলল,
‘তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম! নইলে আমার এভাবে থাকতে কোনো সমস্যা নেই! প্রতিদিন তোমার গালের উপর দিয়ে এমন ঝড়-তুফান চলুক! আমার কি? তোমার তো আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে না? তুমি বরং যাও! ফ্রেশ হয়ে আসো! আমি দেখি সেলুনে গিয়ে…!

কথার মাঝেই আরশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে শুধালো,
‘কেনো? আপনি নিজে করতে পারবেন না?’
শেহজাদ মাথা নাড়লো দু’পাশে। কোলের উপর দৃষ্টি ফেলে উদাস কন্ঠে আওড়ালো,
‘ ট্রিম করলে অসুবিধে হতো না। তবে শেইভ করতে গেলেই গাল কেঁটে যাবে! অভ্যেস নেই তো! তাই আর কি…!’
‘আচ্ছা বেশ আসুন! করে দিচ্ছি আমি!’
অমনি বড় বড় চোখ তুলে আরশির দিক তাকালো শেহজাদ! কন্ঠে বিস্ময় ঢেলে শুধালো,
‘সত্যি করে দেবে?’
আরশি দাঁড়ালো না আর! হাতটা কোনো মতে ছাড়িয়ে নিলো। যেতে যেতে গলা উঁচু করে বললো,
‘এরপরও দেরি করলে কিন্তু এই সার্ভিস আর পাবেন না! অফার থাকতে থাকতে লুফে নিন!’
শেহজাদ ঘাড় নোয়ালো নিম্নাষ্ঠ কামড়ে। মাথা পেছনের চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে ঝটপট নেমে পড়লো বিছানা ছেড়ে। ঠোঁটে তার বিজয়ীর হাসি! ভাগ্যিস আরশি ওর অভিনয় ধরতে পারেনি! নইলে যে সত্যি সত্যি অফারটা মিস হয়ে যেতো ওর!

বাথটাবে আধশোয়া হয়ে বসলো শেহজাদ। দিগন্তের মতো নীল চোখ নিরন্তর পরখ করে চললো তার ছোট্ট বউটার আনাড়ি হাতখানা। আরশি টাওয়াল পেচিয়ে, হাতে শেভিং ফোম আর রেজার নিয়ে বসলো শেহজাদের সামনে। ভর রাখলো হাঁটুর ওপর।
‘গাল তো ঠিক আছে! কিন্তু গলায় রেজার ধরার সময় একদম নড়াচড়া করবেন না! নড়লেই ডিরেক্ট উপরে!’
ফের একবার চূড়ায় উঠলো শেহজাদের ওষ্ঠপুট। বাঁকা হেসে শুধালো,
‘সাবধান করছো না ভয় দেখাচ্ছো?’
বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করলো আরশি। এই লোকটা ওর সব কথায় এতো হাসে কেনো? ওনার কী আসলেই ভয় লাগে না কোনো কিছুতে?

আর বেশি ভাবলো না মেয়েটা। কুসুম গরম পানিতে রুমাল ভিজিয়ে প্রথমে গাল-গলা মুছিয়ে দিলো শেহজাদের।
পরপর শেভিং ফোম লাগালো পুরো গালে। তারপর গলায়। কাঁপা কাঁপা একহাতে রেজার ধরে অন্যহাত রাখলো শেহজাদের ঘাড়ের একপাশে। বড় করে দম নিয়ে শুধালো,
‘এমনিতে আমি ইউটিউব দেখে গাড়িও বানিয়ে ফেলতে পারি! কিন্তু এখন তো আর শেভিং কীভাবে করতে হয়, সেটা দেখার সময় পেলাম না! তাই বলছিলাম যদি…’
‘যদি কেঁটে যায়?’
আরশি ভীত চোখে মাথা দোলায় ওপর-নিচ।

‘কেঁটে গেলেও সমস্যা নেই! তুমি আছো না? তুমি সামনে থাকলে আমার হাজার কাঁটলেও ব্যথা লাগবে না!’
এতক্ষণে যেন একটু সাহস পেলো আরশি। ঢোক গিলে ধীরে ধীরে চালাতে শুরু করলো হাতের রেজারটা। পুরো শেভিং যখন শেষ? তখনই দম ফেললো মেয়েটা। দু’পাশে মাথা নেড়ে বললো,
‘আমি না থাকলে যে আপনার কি হতো!’
শেহজাদ তখনও হাসলো ঠোঁট টিপে। তারপর নিজেও আরশিকে নকল করে দু’পাশে মাথা নেড়ে বললো,
‘আসলেই! তুমি না থাকলে যে কি হতো আমার!’
অমনি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আরশি। অমনি দেখে ফেললো, শেহজাদ মাথা নুইয়ে হাসছে। কপালে ভাজ পড়লো ওর। কন্ঠে সন্দেহ নিয়ে শুধালো,

‘আপনি এবারও মিথ্যে বলেছেন আমায় তাই না? আপনি আসলে নিজে নিজেই শেভ করতে পারেন! ইচ্ছে করে আমাকে টেনশনে রাখলেন এতক্ষণ?
আরশির সম্পূর্ণ মনযোগ যখন ঝগড়ার দিকে তখনই ওর গালে নিজের গাল ছুঁইয়ে দিলো শেহজাদ। শেভিং ফোমে মাখামাখি হলো দু’জনে। আরশি বিস্ময় প্রকাশ করার সময়টুকু পেলো না৷ তারআগেই কোমরে হাত পেঁচিয়ে পেলব শরীরটা নিজের বুকের ওপর এনে ফেললো শেহজাদ।
কানের পাশে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘দেরি যখন হয়েছেই, তখন আরেকটু দেরি সহ্য করে নাও স্নোফ্ল্যাক! তোমাকে সারাদিনে আর বিরক্ত করবো না! একবারও করবো না!’
একটু থেমে আরশির মতো করেই ফের আওড়ালো,
‘পাক্কা প্রমিজ!’

হাসান ভিলার ডাইনিং টেবিলে আজ যেন চাঁদের হাট। সকালের নাস্তার জন্য সবাই একটু দেরি করেই বসলেও হাসি আর আড্ডার কমতি নেই কোনো। গৃহসহায়িকা ক্যারোলিন আর মরিয়ম বেগম হাতে হাতে খাবার দিয়ে টেবিল সাজালেন। হরেক পদের খাবারে ভরতি করে ফেললেন ভিলার খাবার টেবিল।
জারা তো ওর পছন্দের নারকেল সেমাই দেখেই খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠলো। স্ফূর্ত কন্ঠে মরিয়মকে শুধালো,
‘মা! তুমি কী করে জানলে যে আমার নারকেল দিয়ে এমন ঝুরোঝুরো সেমাই পছন্দ?’
মরিয়ম মিষ্টি করে হেসে হাত বুলিয়ে দিলেন মেয়ের মাথায়! তারপর আঞ্জুমান রোজীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘তোর মনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সকালে। উনিই বললেন যে তোর এই সেমাইটা পছন্দ! ব্যস! বানিয়ে ফেললাম!’
আঞ্জুমান স্মিত হাসলেন। মুগ্ধ চোখে দেখলেন জারার উৎফুল্ল মুখখানা। কেমন কোমর জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালো মরিয়মকে। ঠিক যেমনটা তাকে জড়িয়ে ধরে জানাতো ছোটবেলায়? অমনি বুকটা ভার হয়ে এলো তার। মনে মনে ভাবলেন,

‘জারা যতোই তোকে ভালোবাসুক! জন্মদাত্রী মায়ের সাথে কী তুলনা করলে চলে আঞ্জুমান?
ওদিকে মেহমেদ এখনো আসেননি খাবার টেবিলে। চিন্তায় আয়ানের গলা থেকে খাবার নামলো না। এসে কী বলবেন তা তো এখনো স্পষ্ট নয়! তারউপর গতকাল রাতে তো কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন উনি রুম থেকে! তবে কি তার পছন্দ হয়নি আয়ানের বলা কথাগুলো?
আয়ান যখন এই সাত-পাঁচ ভেবে অস্থির ঠিক সেই সময় দোতলা থেকে নিচে নামলো আরশি আর শেহজাদ। এমিলিয়া খাবার টেবিল থেকে চোখ তুলে দেখলো ওদের দু’জনকে। আরশির পরনে হালকা গোলাপি ফুলস্লিভ কটন গাউন। গাউনের নিচ থেকে উঠেছে সাকুরা ফুলের প্রিন্ট। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কোমর পর্যন্ত। গলার কাছটায় শিফনের সাদা ওড়না।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৪

ওদিকে পুরোদস্তুর ফরমাল পরেছে শেহজাদ। তবে শার্টের রঙটা কি আরশির গাউনের সাথে হুবহু মিল রেখে পরলো?
দু’জনই কোনো একটা বিষয় নিয়ে হাসছে! আরশি হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে শেহজাদের সাথে!
কাকে নিয়ে এতো কথা বলছে ওরা? হাসছে ওভাবে? এমিলিয়াকে নিয়ে? এমিলিয়া চোখ ফিরিয়ে নিলো। বুকের ভিতরটা ভেঙেচুরে আসছে ওর! আজ শেহজাদের পাশে এমি না থাকলেও ভবিষ্যতে ঐ জায়গাটা ওর হবে! হবেই! আর এটা নিশ্চিত করবে এমিলিয়া নিজে!

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৫৬