সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪১
জাওয়াদ জামী
” আমার বউ পড়াশোনা বাদ দিয়ে এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছে শুনি? নাকি আমাকে বলা যাবে না? ”
তাহমিদের গলা শুনে চমকে উঠল কুহু। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হেসে উঠল। মেয়েটা সত্যিই চমকে গেছে।
” কেন বলা যাবে না? আমি কি নিষিদ্ধ কোনকিছু চিন্তা করছিলাম যে আপনাকে বলতে পারব না। আপনাকে সবকিছুই বলব, তবে তার আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি খাবার নিয়ে আসব, খেয়েদেয়ে রিল্যাক্স মুডে আমার কথাগুলো শুনবেন। ” কুহু স্নিগ্ধ হেসে বলল।
” ওয়াশরুমে যাবার আগে আমারও যে কিছু কাজ আছে । সেগুলো না করলে আমার কোন কাজ করতেই ভালো লাগবেন না। ” তাহমিদ কুহুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল।
” এখন আবার কি কাজ করবেন? এখন কোন কাজ নয়। সোজা ওয়াশরুমে ঢুকবেন। ” কুহু জোরালো গলায় বলল।
তাহমিদ হঠাৎই কুহুর গালে , চোখেমুখে টপাটপ চুমু দিতে শুরু করল। আচমকা তাহমিদের এহেন আক্রমণে কুহু চমকালেও পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করল। তাহমিদ কুহুকে চোখ বন্ধ করতে দেখে মিষ্টি হেসে কুহুর ঠোঁটে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিল। এভাবে কতক্ষণ ছিল কেউ বলতে পারবে না। ওদের দু’জনেরই হুঁশ ফিরল রাস্তা থেকে ভেসে আসা গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেয়ে। তাহমিদ কুহুকে ছেড়ে দিতেই কুহু হেসে মুখ লুকালো তাহমিদের বুকে।
” আমার কাজ আপাতত শেষ। এবার ওয়াশরুমে যেতে কোনোও বাঁধা নেই। ” নেশালো গলায় বলল তাহমিদ।
তাহমিদের কথার মর্মার্থ বুঝতে একটু সময় লাগলো কুহুর। মানুষটা কথার অর্থ বুঝতে পেরে আরেক দফা লজ্জা পেল মেয়েটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আপনি চান না মা শেষ জীবনটা শান্তিতে কাটাক? ” কুহুর এমন প্রশ্ন তাহমিদকে চিন্তায় ফেলে দিল।
” আমি যতটুকু জানি, সংসার জীবনে মা কখনোই অশান্তির মুখোমুখি হয়নি। এই বাড়ির সকলেই মাকে ভালোবাসে, সম্মান করে। কিন্তু তুমি হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে কেন? ” তাহমিদ অবাক হয়ে জানতে চাইল।
” মা তার বড় বোনের কথা ভেবে কাঁদেন। তমা আপুর জন্য কাঁদেন। ছেলে হিসেবে কি মায়ের কান্না ঘোচানোর দ্বায়িত্ব আপনার নেই? আপনি জেনেশুনে কেন মাকে কাঁদতে দিচ্ছেন? মায়ের চোখে পানি কি এতই সস্তা? ”
কুহুর প্রশ্নবানে জর্জরিত তাহমিদ করুন চোখে তাকালো কুহুর দিকে। বিষন্ন গলায় বলল,
” আমার মায়ের চোখের পানি পৃথিবীর যে-কোন কিছুর থেকেও মূল্যবান আমার কাছে। আমি চাই মা আবার আগের মত হয়ে যাক। খালামণির সঙ্গে আগের মত সুসম্পর্ক হোক মার। সেই চেষ্টাও আমি করেছিলাম। কিন্তু পারিনি সবকিছু আগের মত করে দিতে। খালুজান আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। খালামণির সামনে যাওয়ার সুযোগ আমাকে দেয়া হয়নি। তমা আপুর সঙ্গেও দেখা করতে পারিনি। বেশ কয়েকবারই আমি খালামণির বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি আমি। তাই আর কাউকেই জানাইনি কখনোই। ”
তাহমিদের কথায় অবাক কুহু আশায় বুক বেঁধে জিজ্ঞেস করল,
” আরেকটাবার কি আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারিনা? খালামণি, খালুজান যে আঘাত পেয়েছেন, তাতে তাদের রাগ হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কিন্তু তাই বলে বছরের পর বছর ধরে এটা চলতে থাকবে এমনটা হতে দেয়া যায়না। তাদেরকে মিলিয়ে দিতেই হবে। বাবা-মা হারা দুই বোনকে এক করতে হবে আমাদের। যেকোন মূল্যেই হোক কাজটা আমাদের করতেই হবে। এতদিন আপনি চেষ্টা করেছেন, এবার আমাকে চেষ্টা করতে দিন। কি দেবেন তো? ”
কুহুর কথা শুনে তাহমিদ পুলকিত নয়নে তাকায় তার নারীর দিকে। এই মেয়েটাকে দেখলে সে প্রতিবারই আশায় বুক বাঁধে। মেয়েটার নির্মল হাসি ওর সাহস জোগায়, ওর স্বচ্ছ সরোবরের ন্যায় চোখদুটো নতুন স্বপ্ন দেখায় তাহমিদকে। এই মেয়েটার মাঝেই নিজেকে খুঁজে পায় সে। তাই মেয়েটার কথা উপেক্ষা করার সাধ্য নেই তাহমিদের।
” তুমি কি করতে চাও বলো? আমার মাকে সুখী দেখতে সবকিছু করতে পারব আমি। ”
কুহু হাসল তাহমিদের কথায়। রিনরিনে গলায় বলল,
” তবে খালামণির বাসায় আমাকে নিয়ে চলুন। ”
” আনান, তুই কি পড়াশোনা বাদ দিয়ে সন্যাসী হতে চাচ্ছিস? গত কয়েকদিন ধরে তুই ঢাকায় নেই , বাসায় যাস না পনেরদিনের বেশি, তোকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তুই কি করতে চাচ্ছিস বল তো? তোর চিন্তায় বাসার সকলে অসুস্থ হয়ে গেছে। ” শ্রীমঙ্গলের একটা রিসোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আনানকে প্রশ্ন করল তাহমিদ ।
” নিজেকে সময় দিচ্ছি , ভাই। আমি কিন্তু ভাবতেই পারিনি, আমার খোঁজে তুমি এখানে আসবে! ভেবেছিলাম কয়েকদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যাব। কিন্তু তোমার জ্বালায় সেটাও করার উপায় নেই। আমি যেখানেই যাই না কেন, তুমি ঠিক সেখানেই হাজির হয়ে যাও। ” আনান অপ্রস্তুত হেসে জবাব দিল তাহমিদের কথার।
” ঢাকায় থেকেও নিজেকে সময় দেয়া যায়, আনান। তুই যেটা করছিস, ঠিক করছিস না। এভাবে আমাদের টেনশনে রাখার অধিকার তোর নেই। আমাদের না জানিয়ে এসেছিস ঠিক আছে। কিন্তু সিক্ত, ও কি দোষ করেছে? ওর সঙ্গে কেন লুকোচুরি খেলছিস? কেন কষ্ট দিচ্ছিস আমার বোনকে? ” কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” আমার এই ছন্নছাড়া জীবনের সাথে ওকে জড়িয়ে, তোমাদের পরিবারের লোকজনদের কষ্ট দিতে চাইনা , ভাই। আমার পরিবারে গেলে সিক্তা সুখী হতে পারবে না। ওকে আমার আম্মু সুখী হতে দেবে না। আমি জেনেশুনে কিভাবে সিক্তাকে কষ্ট দেব বলো? আম্মু দৃষ্টি, কোকিলার সঙ্গে কিভাবে ট্রিট করেছে সেটা তো তোমার অজানা নয়। আম্মু সেই একইরকম আচরণ যদি সিক্তার সঙ্গে করে, তোমরা কি মেনে নেবে? মাঝখান থেকে দুই পরিবারের সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে। যেটা আমি চাই না। আমি আমার মায়ের মত বড় মামীকে কষ্ট দিতে পারব না, ভাই। আমার দিদুনকে কাঁদাতে চাই না , ভাই। আর সেকারণেই সবকিছু থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছি। ” আবেগে রুদ্ধ হয়ে গেল আনানের গলা। সেই আবেগের নাম ‘ কান্না ‘।
” দূরে সরে গিয়ে সবকিছুর সমাধান যদি করন যেত, তাহলে সংসারের প্রতিটা মানুষই সবকিছু থেকে দূরে থাকত। সকলের চোখের আড়ালে থেকে সকল দ্বায়িত্ব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখত । আসলে কি জানিস, তোদের মত মানুষদের সমাজে ভীতু বলে অভিহিত করা হয়। কাপুরুষ বললেও ভুল হবে না। আর ভীতু, কাপুরুষরাই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে নেশাখোরদের সঙ্গে মেশে, সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আমি এতবছরেও বুঝতে পারিনি তুই একটা কাপুরুষ । সমস্যার সমাধান করার বদলে তুই নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছিস, সকলকে কষ্ট দেয়ার পায়তারা করছিস। কি পাবি এসব করে? তারচেয়ে বরং ফুপুর মুখোমুখি হ। তাকে তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে। সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার যেমন তোরও আছে , তেমনি সিক্তার তার ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার অধিকার আছে। আনান রে, জীবনটা এত সহজ নয়। লুকিয়ে থেকে নয় সমস্যার মুখোমুখি হয়ে তার সমাধান করতে হয়। ”
” ভাই , তুমি কি একাই এসেছ? কোকিলা কোথায়? আর আমি যে শ্রীমঙ্গল আছি সেটা কিভাবে জানলে? ” তাহমিদের কথাগুলো শুনে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আনান পাল্টা প্রশ্ন করল।
” তোর আদরের কোকিলা এখন মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে। তাই সে আমার সঙ্গে আসতে পারেনি। আর তোর খোঁজ পাওয়া কঠিন কিছু নয় আমার কাছে। তোর এক ফ্রেণ্ডের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, তোর ব্যাগে একটা বাসের টিকেট দেখেছিল। সে অনুযায়ী সেই বাস কাউন্টারে গিয়ে তুই কোথায় এসেছিস সেটা জেনে নেই। অবশ্য এজন্য বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। শ্রীমঙ্গল এসে প্রতিটা রিসোর্ট, হোটেলে খোঁজ নিতে হয়েছে। গত সাতটা দিন আমার এসব করেই কেটেছে। ”
” সরি ভাই , তোমাকে এভাবে কষ্ট দেয়ার জন্য। আর কখনোই এমন বোকামি করব না। তুমি যে বললে কোকিলা নিজেকে মানব সেবায় নিয়োজিত করেছে , এটা কিভাবে? তুমি না তোমার বউকে ছাড়া থাকতে পারতে না? তোমার সেই বউ এখন তোমাকে রেখে অন্যের সেবা করছে এটা কিভাবে মেনে নিচ্ছ? আমি কি ভুল কিছু শুনলাম? ”
” সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। এবার রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে। বাসায় যেতে হবে । সবাই তোর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। ”
” দশ মিনিট সময় দাও আমাকে। ”
” আনান, তুই এতদিন কোথায় ছিলি ? ফোনও বন্ধ করে রেখেছিস। আমাদেরকে চিন্তায় রেখে কি শান্তি পাস তুই? ” রাখী আক্তার ছেলেকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
আনান শ্রীমঙ্গল থেকে সরাসরি নিজের বাড়িতে এসেছে। তাহমিদ ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ঢাকা ফিরে গেছে। তবে ও আনানদের বাসায় যায়নি। আনান ওকে সাধেওনি। ওরা দু’জনই জানে ওদেরকে কি করতে হবে।
” আমার জন্য সত্যিই তুমি চিন্তা কর, আম্মু! চিন্তা করতে জানো তুমি? ” আনান ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল।
” এভাবে বলছিস কেন? তুই আমার সন্তান। তোর জন্য আমি চিন্তা করব না তো কে করবে? ”
” ভাইয়াও তো তোমারই সন্তান। তবে ভাইয়ার প্রতি কেন অবিচার করছ? ” আনান কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল ওর মাকে।
” আমি অবিচার করছি নিহানের প্রতি! তুই বলতে পারলি এই কথা ? আমি মা হয়ে ছেলের প্রতি অবিচার করব? এটাও কি হতে পারে? ” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল রাখী আক্তার।
” হ্যাঁ, অবিচার করেছ। দৃষ্টিকে তুমি যা নয় তাই বলে অপমান করেছ। ওকে নির্যাতন করেছ তুমি। তোমার বোঝা উচিত ছিল, ভাইয়া দৃষ্টিকে ভালোবাসে। দৃষ্টিকে কষ্ট দিলে ভাইয়াও কষ্ট পাবে। তুমি দৃষ্টিকে ভাইয়ার জীবন থেকে সরাতে চেয়েছিলে। এটা কি ভাইয়ার প্রতি অবিচার নয়? দৃষ্টিকে অপমান করা মানে পরোক্ষভাবে ভাইয়াকেও অপমান করা। আর দৃষ্টিকে অপমান করে ভাইয়ার প্রতি অবিচার করোনি তুমি বলতে চাচ্ছ? শুধুমাত্র তোমার জন্য সারাজীবন আত্নীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি সকলের চোখেই ছোট হয়ে থেকেছি আমরা। কেউই তোমাকে সুনজরে দেখেনি। একটা সন্তান হিসেবে এটা যে কতটা লজ্জার সেটা বোধহয় তোমার জানা নেই।
যখন চাচার অর্থ-সম্পদ ছিল, তখন চাচার পরিবার তোমার কাছে ভালো ছিল। এখন তাদের কিছুই নেই, তাই চাচার ছেলেমেয়েরা তোমার কাছে ভিষণ খারাপ। তুমি এমন কেন, আম্মু। দাদু ভাই, দাদীমাকেও শেষ সময়ে অবহেলা করেছ তুমি। যেটা তাদের প্রাপ্য ছিলনা। তবুও তোমার প্রতি তাদের কোন অভিযোগ ছিল না। আমরা ছোটবেলা থেকেই আমার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি তোমার বিরূপ মনোভাব দেখে বড় হয়েছি। ধীরে ধীরে তোমার প্রতিও আমাদের মনে বিরূপ ধারণা জন্মেছে।
সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪০
তার জন্য দায়ী একমাত্র তুমি। এতকিছুর পরও তোমার মনে তিল পরিমান অনুশোচনা নেই। কিন্তু আমার অনুশোচনা হয়, আম্মু। তোমার সন্তান হয়ে জন্ম নেয়ায় অনুশোচনা হয়, তোমার করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারায় অনুশোচনা হয়। কুহুদের প্রতি করা অবিচারের জন্য অনুশোচনা হয়। মাঝেমধ্যে মরে যেতে ইচ্ছে করে। শুধুমাত্র তোমার কারণে আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। ” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে গেল আনান। ও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেটা কি রাগে নাকি হাঁপিয়ে যাওয়ার কারনে সেটা অজানাই রয়ে গেল।