সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৫
Jannatul Firdaus Mithila
কাধে কারো শীতল স্পর্শ পেতেই চমকে পিছনে তাকায় অরিন।সামনেই রুহিকে দেখে মুচকি হাসলো অরিন।
— কিরে অরি,এখানে একা একা কি করছিস?
— না রুহিপু, তেমন কিছু না। আসলে জানো আজকে না একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
— তাই নাকি।কি সেটা বলতো।
কৌতুহলের সাথে জানতে চায় রুহি
— আজকে না ফের একজন আমায় প্রপোজ করেছে।
— কিহ! সত্যি। কে সে?
— ঐ যে আমাদের কেমিস্ট্রি স্যারের ছোট ভাই সে।
— ওহ তা তুই কি বললি?
— আমি আর কি বলবো,বলেছি এসব বড়দের কাজ ছোটরা করলে আল্লাহ পাপ দিবে।বলেই হো হো করে হেসে উঠলো অরিন।
— অরিনরে তুই পারিসও বটে।বলেই রুহিও হেসে দেয় অরিনের সাথে।
বেশকিছুক্ষন রুহির সাথে গল্প করে নিচে চলে যায় অরিন।
কেটে গেলো আরও ৭ টি দিন। আজ এহসান বাড়িতে মুখরিত পরিবেশ। আজ এহসান বাড়ির বড় ছেলে ইফতেখার এহসান রৌদ্র বাড়ি ফিরছে।এই-তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এলো বলে।কবির সাহেব ড্রয়িং রুম জুড়ে কোমরের পেছনে হাত ভাজ করে পায়চারি করছে। তার পাশেই বসে আছেন সাব্বির সাহেব। তায়েফ এহসান ও তাশরিক এহসান ও আজ ছুটি নিয়ে বাসাতেই আছেন। রৌদ্র কে আনতে তারা যেতে চেয়েছিলো কিন্তু রৌদ্র এককথায় নাকচ করে দিয়েছে। তাইতো সকলে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার। এহসান বাড়ির গৃহিণীরা রান্নাঘরে হরেকরকমের খাবার তৈরীতে ব্যাস্ত। কারোই একদণ্ড জিরোবার ফুরসত নেই।জুবাইদা বেগম ছেলের পছন্দের রান্না করতে ব্যাস্ত।অন্যদিকে রাফিয়া বেগম রৌদ্রর পছন্দের গাজরের সন্দেশ, ছানার পায়েস, পিঠা এসব বানাতে ব্যাস্ত।মাইমুনা বেগম তাদের এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছেন। রাইসা বেগম কাজের মেয়ে ফুলির সাথে সবকিছু গুছিয়ে রাখছেন টেবিলে।ব্যাস্ত হাতে কাজ করতে করতে জুবাইদা বেগম সকলকে তাড়া দিয়ে বলে উঠেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— মেজো একটু মাংস টা চেখে দেখ না বোন লবন টা ঠিকঠাক আছে কি না।
রাফিয়া বেগম বুঝলেন জুবাইদা বেগমের ছেলের জন্য হওয়া চিন্তা টা।তিনি হয়তো ভাবছে ছেলে আসার খুশিতে তার রান্না ঠিকঠাক হচ্ছে না। জুবাইদা বেগমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে পাশে এসে দাড়ায় রাফিয়া বেগম। কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেন,
— ‘এত চিন্তা করিস না জবা।তোর রান্না অবশ্যই ভালো হচ্ছে। তবুও যদি তোর সন্দেহ থাকে তাহলে দাড়া আমি চেখে দেখছি।’
এই বলে কিছুটা খাবার চেখে নেয় রাফিয়া বেগম।
— হুম, সবটা একদম পারফেক্ট আছে। তুই তারাতাড়ি হাতের কাজগুলো শেষ করে গোসলে যা।রোদ এই এলো বলে।
— হ্যা,হ্যা যাচ্ছি। সেজো পোলাওয়ে বেরেস্তাটা দিয়ে দে বোন। ও ছোটো এদিকে আয় সোনা।একটু শরবত টা বানিয়ে রাখ না ছোটো। তোর হাতের শরবত তো বেশ ভালো হয়।
— হ্যা হ্যা বড়বু।ওটা তোমার বলতে হবে না। আমি এক্ষুণি বানাচ্ছি।তুমি বরং গোসলে যাও।
রাইসা বেগম চটপট করে বলে উঠলেন।
— ও বড়বু,এদিকে তো আর বেশি নেই।বাকিটুকু আমি দেখে নিতে পারবো তুমি বরং গোসলে চলে যাও।
মাইমুনা বেগম আশ্বাস দিয়ে বলেন।
— আচ্ছা তাহলে যাচ্ছি আমি।বলেই চলে গেলেন জুবাইদা বেগম।
—-ও বউমনি তোমার মিষ্টি বানানো হলো? রোদ টাও না! এখনো আসছে না। ও না আসলে তো একটা মিষ্টি ও মুখে দিতে পারবো না।ইশশ এত মজার মিষ্টি, পিঠাগুলো।
বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠেন তাশরিক সাহেব। রাফিয়া বেগম ছোট দেবরের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেন।
— আরে তাতে কি হয়েছে। তুমি নাহয় একটু আগে থেকেই চেখে রাখো।রোদ আসলে নাহয় ওর সাথে আবার খেয়ো কেমন। এই নাও।
বলেই একটা প্লেটারে কিছু মিষ্টি আর পিঠা এগিয়ে দিলেন রাফিয়া বেগম।মিষ্টি দেখে যেন আর তর সইলো না তাশরিক সাহেবের। চট করে মুখে তুলতে লাগলেন সেগুলো। হুট করে তার প্লেট থেকে দুটো মিষ্টি নিয়ে মুখে পুরে নিলেন তায়েফ এহসান। মিষ্টি মুখে নিয়েই দাত কেলিয়ে হাসি দিলো সে।
— এই, এই সেজো ভাইজান, এটা কি করলে তুমি? আমি কতো কষ্ট করে বউমনির থেকে নিলাম আর তুমি এসে একেবারে দুটো খপ করে খেয়ে নিলে।এটা কেমন হলো বলো তো?
বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করতে লাগলেন তাশরিক সাহেব। ওদিকে উনাদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে বাড়ির বাচ্চারা সহ গৃহিণীরাও হেসে কুটো কুটি খাওয়ার মতো অবস্থা। ড্রয়িং রুমে আপাতত উপস্থিত আছেন বাড়ির সকলে। ড্রয়িং রুমের এক পাশের বড় সোফায় বসে আছেন সাব্বির সাহেব, তার পাশেই এতক্ষণ পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে বসে আছেন কবির সাহেব। অন্যপাশের সোফায় বসে আছে আহিরা,মাহিরা,রুহি,পুতুল। তায়েফ এহসান ও তাশরিক এহসান এখনো ভাগাভাগি করে মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছেন। অনিক মাত্র গোসল সেরে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েছে। আজ ছুটি নিয়েছে বলে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে সে।সকালের নাস্তা ও বাকি তার।ছেলেকে দেখামাত্রই রাফিয়া বেগম বলেন,
— অনিক বাবা খাবার খাবিনা? এখন দিবো?
— না মা।এখন আর খাবো না।ভাইয়াতো চলেই আসবে এখন। ওর সাথেই খাবো।
— আচ্ছা। বলেই চলে গেলেন রাফিয়া বেগম।
এদিকে সবাই উপস্থিত থাকলেও অরিন আশেপাশে কোথাও নেই।সে আজ ঘরে খিল দিয়ে বসে আছে চুপটি করে। কেনো জানি তার ভেতরটা খুব বেশি ধুকপুক করছে।এতটা অস্থির আগে কখনো হয়নি অরিন।আচ্ছা এমন লাগছে কেনো অরিনের? রৌদ্র আসছে বলে? সামান্য তার আসার খবরেই অষ্টাদশীর এই হাল তাহলে এখন থেকে যে তারা একই বাড়িতে থাকবে তখন।এসব ভাবতে ভাবতেই হাত-পা আসাড় হয়ে আসছে তার।নাহ এই অবস্থা হলে রৌদ্র ভাইয়ের সামনে যাবে কিভাবে সে। এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে।দরজার দিকে ফিরতেই তার মায়ের গলা ভেসে আসে ওপাশ থেকে,
— অরিন,কি হয়েছে এভাবে দোর দিয়ে বসে আছিস কেনো? তারাতাড়ি নিচে আয়,রৌদ্র চলে আসবে এক্ষুনি।
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে অরিন কি করবে বুঝে উঠতেই তার মা এবার খেঁকিয়ে বলতে থাকে,
—কি হলো শুনছিস তুই আমার কথা? এখনো দরজা খুলছিস না যে।খোল বলছি।
অগত্যাই রাফিয়া বেগমের এমন চেচামেচিতে অরিন গেট খুলে দেয়। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাফিয়া বেগম বলে উঠেন,
— এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?
কথাটা বলা মাত্রই তার চোখ যায় অরিনের কোমরের নিচ সমান সিল্কি চুলগুলোর দিকে যেখান থেকে এখন টপটপ করে পানি ঝড়ছে।মেয়ের এমন বেখায়ালিপনায় ভিষণ চটে ওঠেন তিনি।মেয়ের হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে নিজে হাত বাড়িয়ে টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বলতে থাকেন,
— এখনো নিজের চুলগুলো ঠিকঠাক মুছতে পারিস না তুই? আর কবে শিখবি অরিন।মা কি সারাজীবন থাকবো তোর এই ছোট ছোট বিষয় গুলো খেয়াল রাখার বল।একটু নিজের প্রতি যত্ন নিতে শেখ মা।বলেই চুল মুছা শেষ করেন তিনি। এদিকে মায়ের এমন আদরে আরও আহ্লাদী হয়ে উঠে অরিন। মায়ের কাজ শেষ হতেই সে ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে। বুকে নিজের নাক ঘষতে ঘষতে বললে উঠে,
— কে বলেছে তুমি সারাজীবন থাকবে না।মনে রেখো আমি অরিন তোমাকে আর বাবাই কে রেখে কোত্থাও যাবো না।একদম না। হুহ।
মেয়ের এমন বাচ্চামো কথা শুনে মুচকি হাসলো রাফিয়া বেগম। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
— তা কি হয়রে মা।মেয়েরা হলো পরের আমানত।একটা সময় যে ঠিকই তাদের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়।
— না না না।আমি কোন বিয়ে করবো না।তোমাদেরকে রেখেও কোত্থাও যাবো না।
— আচ্ছা ঠিক আছে যাস না।এখন আপাতত নিচে যা।আমি গোসল টা সেড়ে আসছি।যা।
অরিন মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎকাল পরক্ষণেই দোনোমোনো করে নিচের যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে।কয়েক সিড়ি নামতেই হঠাৎ বাড়ির বাহিরে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠে।
গাড়ির আওয়াজে সকলেই বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায়।অনিক দৌড়ে চলে যায় বাড়ির গেটের সামনে।গেটের সামনে গিয়েই অনিক এক ঝটকায় রৌদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। হঠাৎ এমন আক্রমণে কিছুটা হকচকিয়ে যায় রৌদ্র। পরক্ষণেই মুখে হালকা হাসি টেনে একহাত দিয়ে অনিককে আগলে ধরে। কিছুক্ষণ পর অনিক হাসি হাসি মুখ নিয়ে রৌদ্র কে আপাদমস্তক দেখতে থাকে।হঠাৎ ওর এমন তাকিয়ে থাকার ধরনে রৌদ্র ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— কিরে কি হইছে তোর? এমন করে তাকিয়ে কি দেখছিস?
— আরে ভাইইইই।তোমাকেই দেখছি।You are looking soooo handsome. Just like a greek god.
প্রচুর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলতে থাকে অনিক।
ওর এমন প্রশংসায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয় রৌদ্র। অতঃপর চিরচেনা গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
— ভিতরে যেতে দিবি নাকি এখানেই দাড় করিয়ে রাখবি?
— ও হ্যা,হ্যা। সরি ভাইয়া আসলে এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা তুমি ভেতরে ঢুকো আমি তোমার লাগেজ নিচ্ছি। চলো।
— হুম আয়।তুই একা পারবি না আমিও নিচ্ছি।
এসবের মাঝেই সেখানে তাশরিক সাহেব উপস্থিত হন।রৌদ্র কে দেখেই বুকে জড়িয়ে নেন তিনি।রৌদ্র ও তার সাথে কুশলাদি বিনিময়ের মধ্যে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রৌদ্র বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে তার বাবাকে সালাম দেয়।কবির সাহেব তো ছেলেকে সাথে সাথে বুকে জড়িয়ে নেন। ছেলেকে আপাদমস্তক দেখতে থাকেন তিনি।সেই ছোটো কিশোর রৌদ্র আজ বলিষ্ঠ যুবক। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং এখন যেনো অনেকটাই ফর্সা হয়েছে। ৬’২” উচ্চতার জিম করা পেটানো শরীর। অবশ্য এর পেছনেও আছে এক বিশেষ কারন।রৌদ্রর ভাষ্যমতে চিকিৎসক নিজে যদি ফিট নাহয় তাহলে নাকি তিনি ঠিকমতো চিকিৎসা করতে পারবে না।অবশ্য কথাটা ঠিকই।উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় টি হচ্ছে তার চোখ যা Cat eyerish বাংলায় যেটাকে বিড়াল চোখ বলে আর তার ঠোঁটের অনেকটা নিচে একটা মাঝারি ছোট সাইজের কালো তিল।রৌদ্রর এমন সৌন্দর্যে বাড়ির সকলেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। একে একে সকলেই তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে কিন্তু জুবাইদা বেগম এখনো ছেলের সামনে আসেননি।রৌদ্র বেশ বুঝতে পারছে হয়তো অভিমান করে আছে তার মা। রৌদ্র দূর থেকে রান্না ঘরে উকি দিয়ে দেখে তার মা সেদিকেই আছে তাই চুপচাপ পা টিপে টিপে রান্না ঘরে যায় সে। রান্না ঘরে গিয়েই মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রৌদ্র। রৌদ্রর স্পর্শ পাওয়া মাত্রই জুবাইদা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন।তড়িঘড়ি করে ছেলের দিকে ফিরে পুরো মুখ জুড়ে স্নেহের পরশ একে দেন।ছেলেকে বুকে নিয়েই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি।
— আমার আব্বা।আমার রোদ। কেনো রে বাবা এত দেরি করলি? দুটো বছর আগেই তো তোর ফেরার কথা ছিলো কিন্তু তুই ফিরলি না।আর, আর কোত্থাও যেতে দিবো না তোকে। কোত্থাও না।
বলেই আবারও সারা মুখে অজস্র চুম্বন একে দিতে লাগলেন তিনি।
রৌদ্র এবার মায়ের মায়া ভরা মুখটি দু’হাতের আজলায় নিয়ে সযত্নে চোখের পানি মুছে দেয় এবং কপালে একটি গাঢ় চুম্বন একে দেয়।জুবাইদা বেগম একদৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন।মায়ের এমন চাহনি দেখে রৌদ্র মুখ খুলে,
— কথা দিচ্ছি মা, আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে। এবার অন্তত শান্ত হও।চলো ড্রয়িং রুমে যাওয়া যাক।এতক্ষণ উপস্থিত বাড়ির সকলে মা-ছেলের এমন দৃশ্যে আবিভূত। রৌদ্র ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হতেই অদূরে রুহিকে ওড়নায় মুখ গুজে কাঁদতে দেখে মাকে ছেড়ে এবার বোনের নিকট যায়।রুহি ভাইকে সামনে পেয়েই ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে।রৌদ্র বোনের মাথায় আদুরে হাত বোলাতে থাকে।বেশকিছুক্ষন পর রুহিকে বুক থেকে উঠিয়ে তার রুমাল দিয়ে চোখ মুছে দেয়।
— হুশশ! আর কাদে না বুড়ি।এইতো তোর দাভাই।এখন থেকে আর কান্না নয় ওকে।
রুহি ভাইয়ের কথামতো কান্না থামায়।একে একে আহি,মাহি ও পুতুল সকলকেই আদর করে রৌদ্র।উপস্থিত সকলের মাঝে অরিন কোথাও নেই। রৌদ্র সকলের সাথে কথা বলে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাবে তখনি সিড়ি দিয়ে নামে অরিন।অরিন কে দেখে একমুহূর্ত থমকায় রৌদ্র। অরিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রর পানে।লোকটার চোখে সানগ্লাস তাই দেখে বোঝার জো নেই যে সেও কি তাকে দেখছে না কি না।এদিকে রৌদ্র কে দেখে অরিনের হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে ত দেয় রৌদ্র কে।হালচাল জিজ্ঞেস করে তার।
— হু, ওয়ালাইকুমুসসালাম।আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুই?
ছোট করে বলে রৌদ্র।
— আমিও বেশ ভালো আছি। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে উওর দেয় অরিন।
রৌদ্র আর কিছু না বলে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে আসে।রুমে ঢুকতেই সবটা ঠিক আগের মতো পায় সে।বেশ বুঝতে পারছে তার মা যে রোজ নিয়ম করে এগুলো গোছায়।রৌদ্র নিজের লাগেজ ফ্লোরে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরুমে।
একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে রৌদ্র। পড়নে শুধু একটি ব্ল্যাক ট্রাউজার। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সে চলে যায় বারান্দায়। বারান্দায় গিয়েই বড় করে নিশ্বাস নেয় রৌদ্র। এই মিষ্টি সুবাস টা যে তার ভিষণ রকমের পছন্দ। বারান্দার রেলিংয়ে হাত দিয়ে ঘাড় বাকিয়ে তাকায় পাশের বারান্দাটায়।আচ্ছা এটা কার রুম? বারান্দা টা তো বেশ সাজানো গোছানো। কি সুন্দর একটা দোলনা লাগানো,পাশেই ছোট ছোট ফুলের টব।রৌদ্রর এসব ভাবনার মাঝেই রুমে প্রবেশ করে আহি,মাহি,রুহি,পুতুল আর অরিন দাড়িয়ে আছে একটু দূরে দরজা ঘেঁষে। রৌদ্র তাদের দেখেই রুমে প্রবেশ করে একটি টিশার্ট গায়ে দেয়।অতঃপর জিজ্ঞেস করে,
— কিরে তোরা সবাই এখানে? কিছু বলবি?
— হ্যা,চলো নিচে যাবে খেতে। রুহি বলে উঠে।
— আমি কি নিজে যেতে পারতাম না,তোরা আসলি যে?
— তো কি হয়েছে? আমরা কি আসতে পারি না? আহি,মাহি একত্রে বলে উঠে। এই দুজন আবার কোন কথা বললে একবারে বলে উঠে।
— তাই।আচ্ছা দাড়া।
বলেই রৌদ্র ঘরে রাখা দুটো লাগেজ ওপেন করে। সেখান থেকে একে একে ওদের জন্য চকলেট, গিফটস দেয়।অরিনকে আর রুহিকে দুটো ম্যাকবুক দেয় রৌদ্র ।রুহি উচ্ছ্বাস এর সাথে ধন্যবাদ জানায় ভাইকে।অরিনও খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না।এরই মাঝে ছোট্ট পুতুল একটি চকলেট খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে,
— ভাইয়া তুমি কি আমাকে মিস করেছিলে?
— হ্যা অবশ্যই।আমার পুতুল সোনাকে খুব মিস করেছি।এই বলে বেশ কিছু রিমোট কন্ট্রোল খেলনা তুলে দেয় পুতুলের হাতে।
— আর আমাদের মিস করোনি?
আবারও একসঙ্গে প্রশ্ন করে আহিরা,মাহিরা।
— হ্যা তোদের ও মিস করেছি।
দু’হাতে তাদের মাথায় হালকা চাটি দিয়ে বলে উঠে রৌদ্র।
— আর আমাকে? আমাকে বুঝি মিস করোনি?
অভিমানি কন্ঠে বলে উঠে রুহি।
— আমার বুড়িকে মিস না করে কি থাকা সম্ভব হুম?
রৌদ্র বোনের নাকটি হালকা টিপে দিয়ে বলতে থাকে।
—আচ্ছা এবার তোদের কথা শেষ হলে চল নিচে। অনেক হয়েছে। রৌদ্র তাদের তাড়া দিয়ে বলতে থাকে।আহি,মাহি,রুহি,পুতুল একে একে রুম থেকে বের হয়ে যায়। অরিনও বের হতে নিবে এমন সময় রৌদ্র তাকে পিছন থেকে ডেকে উঠে,
— অরি দাড়া।
অরিনও বাধ্য মেয়ের মতো দাড়িয়ে পরে।রৌদ্র নিজের লাগেজ থেকে বড় বড় দু বক্স চকলেট নিয়ে অরিনের হাতে দেয়।
— এগুলো তোর।
— না, মানে এতগুলো আমার?
— হুম। ছোটো করে উত্তর দেয় রৌদ্র।
অরিন চকলেট গুলো হাতে নিয়ে চলে যাবে এমন সময় কি যেনো একটা মনে করে আবারও পিছনে তাকায়। হুট করে বলে উঠে,
— আচ্ছা রোদ ভাই একটা প্রশ্ন করি?
— আবার কি? আচ্ছা যা বলার তারাতাড়ি বল।
— আপনি তো সবাই কে মিস করেছেন না মানে,আমাকেও কি আপনি মিস করেছিলেন?
— খুব কি করার কথা ছিলো?
রৌদ্রর এমন খাপছাড়া উত্তরে মুখে আধার নেমে আসে অরিনের। সে তো চেয়েছিলো তার রোদ ভাই যেমন টা সবাই কে বলেছে তাকে বলুক যে,” অরি তোকেও খুব মিস করেছি ” কিন্তু না সে তো বললো অন্য কথা।পরক্ষণেই ভাবলো ও হয়তো রৌদ্রর জন্য ওতোটাও ইম্পর্ট্যান্ট না যতটা ও আশা করেছিলো।এসব ভাবনার মাঝেই রৌদ্রর গম্ভীর কণ্ঠ কানে আসলো তার,
— কিরে এখানে স্ট্যাচুর মতো দাড়িয়ে আছিস কেন? যা নিচে যা। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।
বলেই রৌদ্র লাগেজ থেকে কিছু একটা খুজতে লেগে গেলো।অরিনও আর কিছু না বলে চলে আসে সেখান থেকে। রৌদ্র অরিনের যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে,ফোস করে একটা শ্বাস ফেলে উঠে চলে যায় বারান্দায়। দূর আকাশ পানে চেয়ে থেকে একটি শ্লেষাত্মক হাসি দেয় রৌদ্র। অতপর বলতে থাকে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ৪
— তোকে আমি সত্যি বেশি মিস করিনিতো সানশাইন।শুধু ঠিক যে কয়বার আমার এই হৃদয়টা স্পন্দন করেছে ঠিক সে কয়বার তোকে মনে পড়েছে। এ আর এমন কি বল।কই আমিতো সত্যি তেমন মিস করতে পারিনি।পারিনি রে, সত্যিই পারিনি।বলেই নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরে।
আচ্ছা কেউ কি শুনতে পেলো এই অপ্রকাশিত অনুরক্তি? রৌদ্রর এমন সরল স্বীকারোক্তি টি কি তার সানশাইন শুনতে পেলো? নাহ পেলো না তো।কেউই পেলো না।রৌদ্রর এমন অনুরক্তি যে এই চার দেয়ালের মাঝেই আটকে রইলো।এই দেয়ালগুলো যে বড্ড বিশ্বস্ত। কি সুন্দর একটি মানুষের সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতিগুলো নিজেদের মাঝেই আবদ্ধ রেখেছে।