না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৮

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৮
মাইশা জান্নাত নূরা

মেইন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সবেদা দরজা খুলে দিতেই সামনে একজন সুদর্শন, ছিমছাম পোশাক পরিহিত পুরুষকে মার্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। পরক্ষণেই সবেদা নিজের দিকে একবার তাকালো। সবেদার পরনে টকটকে হলুদ একটা থ্রি-পিস রয়েছে।
কিন্তু স*র্ব*না*শা কাজ যা সে ঘটিয়েছে তা হলো একটু আগেই ও নিজের মুখে, গলায় কালো চারকোল মাস্ক দিয়েছে! যার ফলে সবেদাকে দেতে ঠিক যেনো ভূ*তে*র জ্যা*ন্ত প্রতিরূপ বলে মনে হবে যে কারোরই।
পুরুষটি ভ্রু কুঁচকে বি*র*ক্তি মাখা কণ্ঠে বললো….

—”ভূ*তে*র মতো দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, চাচী। সাইড হয়ে দাঁড়ান। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিন।”
পুরুষটির মুখে নিজেকে চাচী বলে সম্বোধিত হতে শুনে সবেদার জন্য ক*ষ্টে*র কলসী পুরো ১৬ কলা পূর্ণ হয়ে গেলো এবার। সবেদা দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ ও কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা নিয়ে নিঃশব্দে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। পুরুষটি ভিতরে প্রবেশ করে চারপাশে নিজের তীক্ষ্ণ নজরখানা বুলিয়ে নিতে নিতে বললো….
—”এ বাড়িতে তো আরো একজন মোটা করে ৬০ উর্ধো বয়সের মহিলা থাকেন। উনাকে দেখছি না তো।”
নিজের মায়ের পরিচিতি এভাবে শুনে সবেদার মুখ হা হয়ে গেলো।
সবেদা কিছু বলার পূর্বেই ভিতর থেকে পপেলা ‘কে এসেছে রে সাবু মা’ বলে বাহিরে বেড়িয়ে আসলেন৷ পপেলাকে দেখা মাত্রই পুরুষটি বললো….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—”আসসালামু আলাইকুম বুড়ি দাদী, আমি এসেছি।”
পপেলা নিজের দিকে একবার তাকিয়ে পরপরই পুরুষটির দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন….
—”এই ছেঁমড়া এই, কোন দিক দিয়া দেইখা তোমার আমারে বুড়ি দাদী বলে মনে হলো হ্যা! আমার বয়স মাত্র ৪৫ চলে। আর তুমি আমাকে ৬০ উর্ধো বয়সের বানিয়ে দিয়েছো মানে কি এসবের!”
তখুনি পুরুষটির পিছন থেকে সবেদা পপেলার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো….
—”মা, উনি আমাকে চাচী বলে ডেকেছে। তুমিই বলো আমাকে দেখতে কি তোমার বয়সী লাগে?”
—”ম*রি ম*রি ভাই, এ কেমন কথা! আমার ১৬ বছরের যুবতী মাইয়ারে কিনা চাচী বানাইয়া দিছে! এই ছেঁ*ম*ড়া তোমার কি মাথায় কোনো গ*ন্ড*গোল আছে নাকি?”
পুরুষটি বললো….

—”চাচী নিজেকে সুইট সিক্সটিন মনে করেন আর আপনি নিজেকে চাচীর বয়সী মনে করেন কিন্তু আপনাদের দেখে আমি যা বলে সম্বোধন করলাম তেমন বয়সীই লাগে। শুধু একদিক থেকে না সবদিক থেকেই।”
পুরুষটির কথায় পপেলা রাগ এবার তার মাথায় চড়ে বসলো। পপেলা বললেন…
—”আমার বাড়ির উঠানে দাঁড়াইয়া আমারে আর আমার মাইয়ারে অ*প*মা*ন করো আমাদের চেহারা ও বয়স নিয়ে তোমার এতো বড় সাহস!”
পুরুষটি বললো….
—”আপনি করলে লীলা খেলা আর আমি করলে ভু*ল? এটা তো আমার সাথে মহা অ*ন্যায় করা হচ্ছে বুড়িইই দাদীইই।”
পপেলা বললো..…

—”আবার বলে বুড়ি দাদী। এই বেডা এই কি সমস্যা তোমার আমাদের সাথে হ্যা? আমি কি লীলা খেলা দেখাইছি?”
—”আমার হবু বউয়ের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে যে নোং*রা নোং*রা কথাগুলো বলেছিলেন সেসব কি ভুলে গিয়েছেন এতো তাড়াতাড়ি?”
—”কে তোমার হবু বউ? আমি তো তোমারেই চিনি না। তোমার বউরে চিনবো কেমনে?”
পাশ থেকে সবেদা ওর চোখের আকৃতি অস্বাভাবিক বড় করে বললো….
—”এমপি সাহেব!”
সবেদার মুখ থেকে ‘এমপি সাহেব’ শব্দটা শোনা মাত্র পপেলার মুখটাও হা হয়ে গেলো। সবেদা তৎক্ষনাৎ দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। পপেলা বারকয়েক শুকনো ঢোক গি*ল*লে*ন এবার। পরক্ষণেই জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন…..
—”আ-আপনি এ-এমপি সাহেব!”
সারফারাজ চোয়াল শক্ত করে বললো…..
—”এখানে আসার সময় শুনলাম আপনার স্বামী অনেক আগেই রিটায়ার্ড করেছেন। পেনশনের টাকায় নাকি আপনাদের সংসার ঠিকভাবে চলছে না।”
পপেলা বললেন…..

—”হ্যা, হ্যা। পেনশনের টাকা তো চাকরি চলাকালীন বেতনের টাকার অর্ধেকের ও কম হয়। রিটায়ার্ড করার আগে বেতনের টাকা দিয়েই কোনোরকমে আমাদের সংসার খরচ সামলে নেওয়া যেতো। এখন তিনি রিটায়ার্ড করার পর থেকে আর্থিক সমস্যাটা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।”
—”নতুন পেশা হিসেবে পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যেকের বাড়িতে ঘুরে সে বাড়ির ছেলে-মেয়েদের চেহারাকৃতি-বর্ণ-চরিত্র নিয়ে যে কু*ট-কাঁ*চা*লি গুলো করেন তা থেকে কতো টাকা ইনকাম হয় আপনার দৈনিক?”
সারফারাজের এরূপ কথায় অ*প*মা*নে লজ্জায় পপেলার মুখ থমথমে রূপ ধারণ করলো। পপেলা মাথা নুইয়ে নিলেন। সারফারাজ দু’কদম সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললো….

—”আপনার নিজের ঘরেও তো একটা মেয়ে আছে। আপনি কি নিজের বুকের উপর হাত রেখে এমনটা বলতে পারবেন যে আপনার মেয়েটা একেবারে দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা?”
পপেলা কোনো প্রতিত্তুর করার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। মুখ যেনো তার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেইসময় সবেদা আবার নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে পপেলার পাশে এসে দাঁড়ালো। এইটুকু সময়ের ভিতরেই সবেদা নিজের রূপ পুরোপুরি পাল্টে ফেলেছে।
সে হলুদ থ্রি-পিসটা পরিবর্তন করে এখন টকটকে গোলাপি রঙের সর্ট টাইপ একটা গাউন পরে নিয়েছে। মুখে গাঢ় মেকআপ করেছে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় এক চোখে লেন্স আর আইলাইনার লাগালেও অন্য চোখে কিছুই দেয় নি। বিধায় চোখ দু’টো দু’রকম হওয়ায় অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবেদাকে। এছাড়াও ঠোঁটে টকটকে গোলাপি লিপস্টিক ও গালে অতিরিক্ত ব্লাশন লেপেছে। কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলোভাবে ছেড়ে রেখেছে। মুখে এমন হাসি ফুটিয়ে রেখেছে সবেদা যেনো মনে করছে ওকে হয়তো এইমূহূর্তে কোনো অপ্সরার থেকে কম কিছু লাগছে না।

সবেদাদের বাড়ির বাহিরে রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আহাদ। একটু পর পর নিজের হাতে থাকা ঘড়ির তাকাচ্ছে তো সবেদাদের বাড়ির গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। অতঃপর আহাদ বললো…..
—”বস এখনও আসছেন না কেনো? বস এতো রেগে এই বাসায় প্রবেশ করলেন কিন্তু পরিবেশ এখনও এতোটাই শান্ত হয়ে আছে মনে হচ্ছে বড় ধরণের ঝ*ড়ে*র পূর্বাভাস। না জানি ভিতরে কার অবস্থা কেমন করে ফেলেছেন বস!

সারফারাজ শুধু একবার সবেদার এমন রূপ পরিবর্তনের পরের অবস্থা দেখে পরপরই ওর উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো….
—”নিজের মেয়েকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে আপনার বাড়িতে কোনো পরপুরুষ আসলে বা বাহিরে বের হওয়ায় সময় সং সেজে বের হতে হয়! নয়তো সম্মান পাওয়া যায় না!”
সারফারাজের এরূপ কথায় মুহূর্তের মধ্যেই সবেদার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আ*মা*বস্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেলো। সারফারাজ আবারও বললো…..

—”বিয়ের আগে প্রতিটি মেয়ের উচিত নিজেদের সৌন্দর্যকে আড়াল করে রাখা। পর্দা করা। কারণ মেয়েদের সৌন্দর্য আর ভবিষ্যতের স্বামীর আমানত। যার-তার সামনে এমন সং এর মতো সেজে-গুজে গিয়ে নিজের ভবিষ্যত স্বামীর আমানত এর খিয়ানত করে পা*প কামাবেন না। বিয়ের আগে প্রতিটি মেয়েকে সঠিক ভাবে পর্দা করে চলাচল করার জন্য বলা, বুঝানো তার পরিবারের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আপনি এবং স্বামী পালন করতে ব্য*র্থ হয়েছেন। এতে পা*প কেবল আপনার মেয়ের একার হয় নি আপনার এবং আপনার স্থামী দু’জনেরই হয়েছে।”
সবেদা নিজের ঠোঁট উল্টে নিয়েছে। এবার তার কোনো রাগ থেকে নয় বরং নিজের করা এতো যাবৎ এর ভু*ল কাজের জন্য অনুশোচনা থেকে এই কান্নারা আসছে। সারফারাজ হিম শীতল কন্ঠে আবারও বললো…..

—”গুরুজন হন তার উপর মহিলা মানুষ তাই ১ম বার মাফ করলাম। এই মাফ আজই শেষ বার করা হলো। পরবর্তীতে যদি আর কোনোদিন আমার হবু বউয়ের নামে একান্তেও কেনো উল্টা-পাল্টা কথা আপনার জিহ্বার সাথে তালুর ছোঁয়ায় দুই ঠোঁটের ভাঁজ পেরিয়ে বাহিরে বের হয় তাহলে আমি আর বড়-ছোট, গুরুজন-টুরুজন মানবো না। কোনো বয়সও বিচার করবো না। যাস্ট ধরবো। জিহ্বাটা মুখ থেকে টেনে বের করে কপালের মা*ঝ বরাবর লোহার গরম পেরেক দিয়ে গেঁথে দিবো।”

ভ*য়ে পপেলা ও সবেদার হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় কয়েকগুণ জোরে বিট করছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা বুক চিঁ*ড়ে বাহিরে বেড়িয়ে আসবে। অতঃপর সারফারাজ আর দাঁড়ালো না সেখানে একমূহূর্তের জন্য। গেইট খুলে বাহিরে চলো গেলো।
সারফারাজকে বাহিরে বের হতে দেখে আহাদের কলিজা মনে হলো কিছুটা ঠান্ডা হলো। আহাদ সারফারাজের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো….
—”বস কোনো লা*শ উঠাতে হবে নাকি?”
সারফারাজ ভ্রু কুঁচকে আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো….

—”তোমার কি মনে হয় আমার এতোটাই বা*জে দিন এসে গিয়েছে যে অবলা মহিলাদের খু*ন-টু*ন করে বসবো?”
আহাদ আর কিছু বলবো না ভ্য*ব*লার মতো হাসলো কেবল। সারফারাজ আবারও বললো….
—”আরেকটু অপেক্ষা করো। শ্বশুরবাড়ির এলাকায় এসেছি অথচ তোমাদের ভাবীর সাথে সাক্ষাৎ করবো না এটা তো হয় না৷ একটু নিজের থো*ব*রা*টার দর্শন দিয়ে আসি তারে।”
এই বলে সারফারাজ সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলো।
দুপুরের ওমন ঘটনার পর থেকে আর একটা দানাও মুখে তুলে নি পিহু। সবকিছুতেই চরম বিরক্তি চলে এসেছে ওর। কমলা প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বললো….
—”আপামনি কতোক্ষণ এমনে না খাইয়া বইয়া থাকবেন কন! যা হওয়ার তা তো হইয়াই গেছে। এর জন্য নিজের শরীরটারে আর কষ্ট দিয়েন না। এই খাবারটুকু আনছি। খাইয়া লন৷”
পিহু অন্যপাশে মুখ ঘুরানো অবস্থাতেই বললো….

—”খাবো না আমি কমলা আপা। তুমি খাবারটা নিয়ে যাও। এমনিতেও না খেয়ে দিন পার করার অভ্যাসটা আমার নতুন না। তাই এ নিয়ে কষ্টের কিছু নেই।”
কমলা শব্দ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে সরে এলো। সে বুঝতে পেরেছে পিহু যখন একবার বলেছে যে সে খাবে না এখন মানে সে খাবেই না৷ জোর করে পিহুকে খাওয়ানো অন্তত কমলার পক্ষে তো সম্ভব ই না। পিহুর রুম থেকে বের হতেই কমলা দেখলো গেইট পেরিয়ে সারফারাজ ভিতরে প্রবেশ করছে। কমলা এগিয়ে গিয়ে বললো….

—”ভাইসাহেব আপনে আইছেন! আইসা অনেক ভালা কাম করছেন। আপামনি ঐ ঘটনার পর থাইকা কিচ্ছু মুখে নিচ্ছেন না। আমি অনেক কইয়াও তাকে খাওয়াতে পারি নাই। আপনে ছাড়া এই অসম্ভব কাম আর কারোর পক্ষে করা সম্ভব না।”
সারফারাজ কমলার হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বললো….
—”কোথায় তোর আপামনি?”
—”ভিতরে তার ঘরেই শুইয়া আছে।”
—”আর বাকিরা?”
—”খানিক্ষন আগেই মা-মেয়েতে মিল্লা কই জানি গেলো দেখলাম।”
—”আচ্ছা, তুই বাহিরেই থাক। আমি যাচ্ছি ভিতরে।”
—”আইচ্ছা।”
অতঃপর সারফারাজ খাবারের প্লেটটা সাথে নিয়ে পিহুর রুমে প্রবেশ করে পিহুর পাশে এসে বসলো। পিহু অন্য দিকে ফিরে চোখ বুঁজে শুয়ে ছিলো বিধায় সারফারাজ যে ওর পাশে এসে বসেছে তা ও দেখতে পারে নি। পিহু কিছুটা রাগ নিয়েই বললো…..

—”কমলা আপা, তোমাকে বললাম না আমি খাবো না! তারপরেও কেনো বারবার খাবার নিয়ে আমার আশে-পাশে ঘুরঘুর করছো? আমাকে একটু এ…!”
পিহু পুরো কথা শেষ করতে পারলো না। সারফারাজ বললো….
—”কমলার সাহস আছে নাকি একবার তোমার থেকে খাবে না শোনার পরেও আবারও খাবার নিয়ে আসার!”
সারফারাজের কন্ঠ কর্ণপাত হতেই পিহু ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। সারফারাজকে নিজের পাশে বসে থাকতে দেখে পিহুর চোখে-মুখে অবাকতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। পরপরই পিহু নিজেকে সামলে নিয়ে চাপা রাগে বললো…..

—”কেনো এসেছেন এখানে? আপনার সাথে আমার নাম জড়িয়ে এ পাড়ায় আর কতো ক*ল*ঙ্ক রটুক এমনটা চান আপনি?”
সারফারাজ পিহুর দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—”ক*ল*ঙ্ক যেনো আর কেউ রটাতে না পারে তার ব্যবস্থাই করতে এসেছি আজ।”
—”ছেড়ে দিবেন আমায়! মুক্তি দিবেন? বাঁচতে দিবেন আবারও আগের মতো করে আমায়?”
—”প্লেটে থাকা খাবার টুকু সম্পূর্ণ শেষ করো তারপর বলছি।”
—”আগে শুনতে চাই আমি।”
সারফারাজ নিজের হাতে তরকারী দিয়ে অল্প ভাত মেখে পিহুর মুখের সামনে ধরলো। পিহু মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো….

—”আপনার হাতে খাবো না।”
—”বেশ তো, তাহলে নিজের হাতেই খাও।”
—”আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। মুক্তি দিবেন আমায় আপনি?”
—”বললাম তো আগে খাবার খাওয়া শেষ করো তারপর দিবো এই প্রশ্নের উত্তর।”
পিহু বুঝতে পেরেছে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। তাই সে সারফারাজের কোলের উপর থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করলো। কিছুসময়ের মধ্যেই সবটুকু খাবার খাওয়া পিহুর শেষ হলে সারফারাজ উঠে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা এনে পিহুর দিকে বাড়িয়ে দিলো।
পিহু গ্লাসটা নিয়ে পানি পান করলো এবং প্লেটেই হাত ধোঁয়ার কাজও শেষ করলো। অতঃপর সারফারাজ আলমারী খুলে ভিতর থেকে একটা গাড় নীল রঙের নরম জর্জেটের শাড়ি ও একটা সাদা রংয়ের হিজাব বের করে বললো….
—”এই শাড়ি আর হিজাবটা পড়ে দ্রুত রেডি হয়ে নাও।”
পিহু বললো….

—”ওসব কেনো পড়তে যাবো? খাবার খাওয়ার পর আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন বলেছিলেন। খেয়েছি। এখন উত্তর দিন।”
—”রেডি হও। তারপর উত্তর পাবে।”
—”আপনার দেওয়া কোনো পোশাক আমি পড়বো না।”
—”যদি নিজ থেকে না পড়ো তাহলে বিয়ের আগেই একটা অনা*সৃষ্টি কাজ আমাকে করতে হবে। যা তোমার উপরের ক*ল*ঙ্কে*র বোঝাকে বাড়াবে বই কমাবে না।”
পিহু একবার ঢো*ক গিললো। তারপর বিছানা থেকে নেমে শাড়ি, হিজাব ও শাড়ি পড়ার জন্য বাকি যা প্রয়োজন তা নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। সারফারাজ নিঃশব্দে হেসে বললো….
—”আজ যেই সারপ্রাইজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে প্রিটিহার্ট তা দেখার পর আর কখনও আমার থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ করতে পারবে না তুমি।”

টাকার লোভে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ৪০ বছর বয়সী লোকের সাথে ষোড়শী কন্যা অনুপমার বিয়ে ঠিক করেছেন ওর বাবা অরূপ মিয়া। সেই মানসিক ভারসাম্যহীন পুরুষটি অরূপ মিয়ার গ্রামেরই চেয়ারম্যানের বড় ছেলে। চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান সাহেব একজন ঘটককে নিয়ে অরূপ মিয়ার বাড়ির আঙিনায় বসে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করে গেলেন খানিক্ষন আগেই। তারা চলে যেতেই অরূপ মিয়ার স্ত্রী জমেলা বেগম ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে এলেন আঙিনায়। স্বামী অরূপের পান্ঞ্জাবির কলার্ট চেপে ধরে রাগে-দুঃখে চেঁচিয়ে বললেন….
—“এ তুমি কি করলে? আমার ফুলের মতো সুন্দর মাইয়াডার বিয়া ঐ চেয়ারম্যানের মানসিক ভারসাম্যহীন বুড়া পোলার লগে কেন চূড়ান্ত করলা? তোমার কি ধর্মের ভয় নাই? কলিজায় কি আল্লাহর ভয় নাই? একমাত্র মাইয়ার সাথে কোন বাপে এমন অবিচার করতে পারে?”

অরূপ মিয়া জমেলাকে ধা*ক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরালেন। জমেলা আঙিনার উপর পড়ে গেলেন। অরূপ খেঁ*ক খেঁ*কে স্বরে বললো….
—“বা*ন্দি*র বাচ্চা বাপের ঘর থেকে টেকা আইনা দেওয়ার নাম নাই আর আমারে শিখাইতে আইছোস কি করোন লাগবো আর কি করোন লাগবো না?“
জমেলা ওভাবে বসে মুখ তুলে বললেন….

—“টেকা আমি আনি নাই নাকি? ৫০ হাজার নগদ টেকা আর ২বিঘা জমি আইনা দিছিলাম। সবই তো নিজের নেশা আর জু*য়া*র পিছনে শেষ করছো। এখন উইঠা পরে লাগছো আমার মাইয়াডার জীবনটা নষ্ট করার জন্য?”
—“যেমন মেলা রূপ ওয়ালা মাইয়া জন্ম দিছোস তেমন তো ফল ও ভুগতে হবো। গ্রামে কোনো একটা ছ্যমরা বাকি আছে নাকি যেয় চায় না তোর মাইয়ারে নিজের ঘরে তুলতে? নেহাতই আমি বাছাই করে চলা মানুষ তাই চেয়ারম্যনের মতো বড় ঘরের প্রস্তাব হাসিমুখে মাইনা নিছি। যেন মাইয়াডা সেখানে গিয়ে সুখেই থাকতে পারে।”
—“নিজের বাপ-দাদার দিয়া যাওয়া জমিজমাগুলো খাইয় যখন জু*য়া খেলার টাকা আর কোনোদিন দিয়া জোগার করতে পারো নি তখন যে চেয়ারম্যনের কাছে এই বসতভিটাটুকুও বন্দক রাখছো সেই খবর যে আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাইছেই তা ভুইলা যাইও না। এখন যখন চেয়ারম্যান নিজের পাওনা বুইজ্জা লইতে আইছিলো তখন তো তা ফেরত দেওয়ার মুরোদ হয় নি তোমার। তাই ঐ বুড়া, পাগলের লগে আমার মাইয়ার বিয়ার সম্বন্ধে নাচতে নাচতে রাজি হইছো তুমি। মনে মনে ভাইবা রাখছো মেয়ের বদৌলতে সেখান থেকে পরে আরো টাকা পয়সা আত্মসাৎ করতে পারবা। তোমরা কু*মতলব গুলো আমার অজানা নয় অরূপ মিয়া।”

জমেলার মুখে এতোগুলো সত্য ও উচিত কথা শুনে অরূপের মাথায় যেনো র*ক্ত চড়ে বসলো। নে*শা খো*র লোকদের মেজাজ এমনিতেই তু*ঙ্গে উঠে থাকে সবসময়। অরূপ রাগে গ*জ*গ*জিয়ে জমেলার কাছে এসে ওর চুলের মুঠি ধরে জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন….
—“মাগ* র বেশি মুখ চলে। এখন আর তোর জানের ভয় লাগে না তাই না রে? কয়টাদিন শরীরে কয়েক ঘা পরে নি তাই মেলা তেল জমছে। তা এখন মুখ দিয়া গলে গলে পড়তেছে।”

এই বলে অরূপ মিয়া জমেলাকে ইচ্ছে মতো চ*ড়-লা*থি মা*র*তে শুরু করলেন। অনুপমা ওর বান্ধবীদের সাথে স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরছিলো। বাড়ির সন্নিকটে আসতেই নিজের বাবাকে নিজের মায়ের গায়ে হাত তুলতে দেখে ছুটে বাড়ির ভিতরে এসে বাবার থেকে মা’কে বাঁচানোর চেষ্টায় লেগে পড়লো। অনুনয়-বিনয় করে বললো….
—“আব্বা আর মাইরেন না আম্মারে। আপনার পায়ে পড়ি আব্বা। আল্লাহর দোহাই লাগে আম্মারে ছাইড়া দেন। আম্মার জানটা যে বাহির হইয়া যাবো এবার। আব্বা দোহাই লাগে। আমি আপনার পা দুইটা ধরে কইতাছি মাইরেন না আম্মারে। ও আব্বা। আব্বা গো ছাড়ান দেন আম্মারে। আব্বা!”

অরূপ থামলেন না। এবার তার করা আ*ঘা*ত গুলো অনুপমার শরীরে এসেও লাগছে কারন অনু ওর মা‘কে নিজের বুকের মাঝে আগলে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। অরূপ চিল্লিয়ে বললেন…
—“তোর বিয়া আমি চেয়ারম্যানের বড় পোলার লগে চূড়ান্ত করছি। আগামী শুক্রবার তোর বিয়া হবো। তোর মা‘য়ে আমারে এ নিয়া মেলা নিতী কথা শুনাইতে আইছিলো। তার জন্য আজ ওর কমোর ভা*ই*ঙ্গাই দম ফেলমু আমি।”
—“না আব্বা, আর মাইরো না তুমি আম্মারে। আমি রাজও আছি৷ তুমি যেইখানে যেইদিন বিয়া দিবার চাও আমার আমি বিয়া করমু।”
মেয়ের সম্মতি পেয়ে থামলেন অরূপ। ঠোঁটে ফুটে উঠলো তার বাঁকা হাসির রেখা। পরপরই জমেলার শরীরের উপর থু*থু মে*রে বললেন….

—“ম*র এবার তুই শালী।”
এই বলে অরূপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। জমেলার জ্ঞান নেই৷ অনু দু‘হাতে নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদছে। এই দুনিয়ায় অনুর জন্য যদি কেউ ভাবে, ওকে কেউ ভালোবাসে তাহলে সেটা কেবল ওর মা। অনুর কথা ভাবতে গিয়ে প্রায় দিনই অরূপের হাতে মাইর খেতে হয় জমেলাকে। তবুও অনুর প্রতি জমেলার ভালোবাসা কমে না এতোটুকুও। মা জাতি বুঝি এমনই হয়।

অরূপ মিয়া গ্রামের বখাটে, ছ*ন্ন*ছাড়া পুরুষদের সাথে সারাদিন রাত জু*য়া খেলে ও নেশাজাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য পান করে কাটিয়ে দেন। যখনই নেশা করার জন্য ও জুয়ায় বাজি ধরার জন্য টাকার প্রয়োজন হয় তখুনি বাড়িতে এসে ঝামেলা সৃষ্টি করেন। অনুর মা জমেলা বেগম নিতান্তই সাধারণ ও সহজ-সরল মহিলা। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ততোটা ভালো না হলেও স্বামীর অ*ত্যা*চা*র সহ্য করতে না পারে অনেক জমি ও অর্থ এনে দিয়েছিলেন স্বামীর কাছে।

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৭

কিন্তু সেইসব কিছুই অরূপ জু*য়া খেলা ও মদ্যপানে শেষ করেছে। অরূপের বাবা-দাদার রেখে যাওয়া জমিজমা গুলোও সেসবের পিছনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছিলো যে থাকার ভিটেমাটি টুকু সেটাও চেয়ারম্যনের কাছে বন্দক রেখেছে অরূপ বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই। অনুপমার বাড়িতে কেবল সে আর ওর মা-ই থাকেন। অনুপমার আর কোনো ভাই-বোন নেই। অরূপের আপন ভাইয়েরা নিজ অংশ বুঝে নিয়ে তা বিক্রি করে বহু আগেই বউ-বাচ্চা নিয়ে শহরে চলে গিয়েছেন।

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here