বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৯
ইশরাত জাহান
ভোরের হাওয়া একটু ঠান্ডা।বাইরে মসজিদের মাইক থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে।ঘরের ভেতর অন্ধকার প্রায় কেটে গেছে।জানালা দিয়ে হালকা আলো ঢুকছে।শোভা একটু দ্বিধা নিয়ে বিছানা থেকে নামল।সে জানে দর্শন এখনও ঘুমিয়ে আছে।প্রথম রাতে ঠিকঠাক কথাও হয়নি তাদের আজ তো গেলো ঝগড়া দিয়ে।শোভা ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়াল দর্শনের পাশে।কিছুটা সংকোচ আর দায়িত্ববোধ একসঙ্গে কাজ করছে তার ভেতরে।নিচু গলায় বলল,”শুনছেন?নামাজের সময় হয়েছে।উঠবেন না?”
দর্শন কাঁথা মাথা পর্যন্ত টেনে মুখ ঘুরিয়ে বলল,”তুমি কি আমার ঘুমের বিরক্ত করার জন্যই এখানে এসেছো?”
শোভা একটু থমকে গেল।মুখে কিছু বলল না কিন্তু চোখেমুখে লজ্জা আর বিরক্তি মিলেমিশে রইল।দর্শন ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আবারও বলে,“ঘুমাতে দাও আমাকে।বিরক্ত করা আমার পছন্দ না।”
দর্শনের কণ্ঠে ছিল ঝাঁঝ।ঘুমচোখে বিরক্তির টান।শোভা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর চুপচাপ পাশে থাকা জগ হাতে নিয়ে দর্শনের গালে ছিটিয়ে দিল পানি।দর্শন চমকে উঠে বসল, “তুমি পাগল নাকি মেয়ে!এটা কোন ধরনের ব্যবহার?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শোভা শান্ত স্বরে বলল,“আমি শুধু দায়িত্ব মনে করে ডেকেছি আপনাকে সজ্ঞানে আনার জন্য।আপনার ইচ্ছা থাকলে উঠবেন নামাজ পড়বেন।আমি নামাজ পড়তে গেলাম।”
তারপর ধীর পায়ে চলে গেল পাশের ঘরে।পেছনে তাকায়নি।দর্শন বিছানায় বসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।চোখে ঘুম থাকলেও কপালে যেন একটু চিন্তার রেখা।মুখে আর কোনো কথা নেই শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই।গা থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে দাড়ালো।ওযু করে মসজিদে যেতে নিবে মনে পড়ে দিদারের কথা।চলে গেলো দিদারের ঘরে। দরজায় কড়া নাড়তেই দেখলো দরজা চাপানো আছে শুধু।হালকা খুলে গেলো।দর্শন এবার জোরে জোরে ডাকছে,“দিদার।”
ঘুমের ঘোরে জমের ডাক শুনে লাফিয়ে উঠলো দিদার।ভুল শুনল কি না ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখে দর্শন পাঞ্জাবি আর টাউজার পরে আছে।দিদার বলে,“কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া?”
“মসজিদে,তুইও রেডি হ।একসাথে নামাজ পড়তে যাবো।”
“কাল থেকে যাই ভাইয়া?”
দর্শন চোখ গরম দিয়ে তাকালো।দিদার লাফ দিয়ে উঠে চলে গেলো ওযু করতে।পাঞ্জাবি পরে বের হয় দর্শনের সাথে।পারুল বেগম দেখেই খুশিতে চলে যান দিজার ঘরে।দিজাকে ডাক দিয়ে অনেক আগেই নামাজের জন্য প্রস্তুত করেছে শোভা।আজ একসাথে তিনজনে নামাজ পড়বে।পারুল বেগম খুশি হয়ে জায়নামাজ বের করেন।তিনজনে একসাথে নামাজ পড়ে চলে যায় রান্নাঘরে।শোভা বলে,“দাদাজানের চায়ে কি চিনি দিবো?”
“না,দাদাজান সুগার ফ্রী ট্যাবলেট দিয়ে চা খায়।”
শোভা একেকজনের ব্যাপারে শুনে সেভাবে চা বানায়।দর্শনের প্রিয় লেমনগ্রাস দিয়ে চা বানিয়ে কাপে রাখলো।অতঃপর দিজার দিকে তাকাতেই পারুল
বেগম জানান,“ননদের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই।নিজের স্বামীর জন্য চা নিজে নিয়ে যাও।”
“উনি তো তাহলে খাবেন না মোটেও।”
“বাধ্য করবে।সংসার করতে গেলে একা ছেলেরা বাধ্য করবে কেন?মেয়েরাও বাধ্য করবে পুরুষদের।”
“যদি আবারও…
“মারবে?মার খেলে মারের পাল্টা কষ্ট বুঝিয়ে দিবি।তুই তোর জায়গা ধরে রাখবি। কাল তো শিখিয়ে দিলাম।”
“তোমার ছেলে তো আস্ত গণ্ডার।তার সামনে আবার দেখাবো অধিকার!”
পারুল বেগম শোভার মাথায় চাপড় মেরে বলেন,“পাগলি মেয়ে।যা গিয়ে ওকে পরিবর্তন করার চেষ্টা কর।”
সকালের আলো বারান্দার মেঝেতে সোনালি রেখা এঁকে রেখেছে। খবরের কাগজের পাতা উল্টাচ্ছে দর্শন।মুখে তার চাপা বিরক্তি ছাপ।এটা তার মুদ্রা দোষ।এমন সময় শোভা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় তার সামনে।হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ট্রে।দর্শনের সামনে চায়ের কাপ রেখে বলে,“চা এনেছি।”
দর্শন একবার তাকিয়ে পত্রিকায় চোখ ফেরালো।ঠান্ডা গলায় বলে,“ফিরিয়ে নিয়ে যাও।তোমার হাতের কিছু আমি গ্রহণ করবো না।”
শোভা নিঃশব্দে কাপটা নামিয়ে রেখে সোজা দর্শনের দিকে এগিয়ে তাকায়।দর্শনকে দেখে অপলক চেয়ে আছে।স্বামী রূপে সুদর্শন পুরুষ।পুরোই নায়ক সালমান শাহ।শোভার প্রিয় নায়ক।তার মতই দেখতে লাগছে দর্শনকে।শোভা হুসে ফিরে বলে,“খেতে হবে আপনাকে।”
দর্শন কণ্ঠে তীব্রতা বজায় রেখে বলে,“তুমি কী বললে?”
শোভা চোখে চোখ রেখে স্থির কণ্ঠে বলে,“বলেছি খেতেই হবে।”
“তোমার সাহস তো কম না আমাকে ধমকাচ্ছ!”
“আমি মোটেই ধমকাচ্ছি না।”
“তাহলে কি ভালোবাসা দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা?”
“এটা ভালোবাসা নয় এটা কর্তব্য।আপনি চাইলেই সব কিছু অস্বীকার করতে পারেন কিন্তু আমি পারি না। আপনি যাকে বিয়ে করেছেন সে রান্নাঘরে বসে বসে কান্না করতে শেখেনি।সে নিজের দায়িত্ব থেকে পিছু হটে না।আপনি পারেন।”
দর্শন রাগ সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো।ধমক দিয়ে বলে,“তুমি জোর করছো আমাকে?”
শোভা এক ধাপ এগিয়ে কাপটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,“হ্যাঁ, জোরই করছি।কারণ আপনি যতই তাচ্ছিল্য করুন আমি জানি কেন এই সম্পর্কের মানে আপনি ধরতে পারেননি।তাই ভুলে যান স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত।তবে ভুললেও মনে করিয়ে দেওয়া স্ত্রী হিসেবে আমার কাজ।”
দর্শন স্তব্ধ।তার হাতে কাপ।চায়ের গরম ভাপ ছুঁয়ে যায় আঙুলে কিন্তু চোখে যেন আগুন ও পানি একসাথে জ্বলছে।শোভা নরম গলায় কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে,“চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।তাড়াতাড়ি শেষ করুন।”
শোভা ধীরে পেছনে সরে যায়।দর্শন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।চোখ নামিয়ে তাকায় সেই কাপের দিকে।সে কিছু বলে না কিন্তু তার চোয়ালে হালকা কম্পন।মুখে চাপা দ্বিধা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।আচমকাই কাপটা ছুঁড়ে মারে মেঝেতে।কাচ ভাঙ্গা শব্দ শুনতে পায় শোভা।পা থেমে যায় দ্রুত।পিছন ফিরে দেখে দর্শনের রাগী দৃষ্টি।শোভা চারপাশ দেখে দর্শনের সামনে দাড়িয়ে বলে,“টাকা অনেক আয় করেন বলে এভাবে ভেঙে চুরে ব্যয় করবেন?আপনি চাইলে আমি আপনাকে একটা ভালো আশ্রমের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।ওখানে অনেক গরীব ব্যক্তির বসবাস আছে।ওদেরকে নাহয় কিছু দিবেন।তাহলে দেখবেন অতিরিক্ত টাকাটাও হাতে থাকবে না আর এই অতিরিক্ত ভাংচুর করতে হবেনা।”
দর্শন আঙুল উঁচিয়ে বলে,“রাত থেকে সহ্য করে যাচ্ছি মানে এই না যে মুখ ফোটাতেই থাকবে।”
“কেন কি করবেন আপনি?কি পারেন সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাওয়া ছাড়া?একটু হলেই তো পালিয়ে যান।”
“আমি পালিয়ে যাইনি।”
“না,আপনি পালিয়ে গিয়েছিলেন।আপনি না পালালে আমাকে চারটা বছর অপেক্ষা করতে হতো না।কোনো এক মীমাংসা আগেই হয়ে যেতো।আমার চারটা বছরের হিসাব আমি এক তুড়িতেই ছাড়বো না দর্শন ফরাজি।”
“শাট আপ!”
দর্শন ধমক দিয়ে বললেও শোভা বলে ওঠে,“যতটুকু পড়ালেখা করেছি তাতে ইংরেজি আমিও জানি।তাই আমাকে ধমক দিতে ইংলিশ এপ্লাই করতে হবেনা।”
এবার আর রাগ সামলে রাখতে পারল না দর্শন।দিলো শোভার বাম কানের কাছে এক থাপ্পড়।শোভা ঝুঁকে গেলো ডানদিকে।গালে হাত দিয়ে ঘাড় সোজা করে তাকালো দর্শনের দিকে।রাগ বাড়ছে তার।সেও এবার থেমে থাকবে না।পাশে থাকা মাটিসহ টব যেটাতে গাছ নেই,আছে শুধু মাটি।সেই টব হাতে নিয়ে দর্শনের মাথায় ঢাললো সমস্ত শুকনো মাটি।দর্শন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।শোভার এমন কান্ডের মাঝে ঘরে ঢোকে দিজা ও দিদার।ওরা এই দৃশ্য দেখে চোখ বড় বড় করে গালে হাত দিয়ে তাকালো।দর্শন চোখ মেলে মাথায় হাত দিয়ে ময়লা ঝেড়ে বলে,“ইউ ইডিয়ট।”
“আমাকে কিছু বলার আগে মাথায় রাখবেন আপনি আমার স্বামী।আমাকে ইডিয়ট বললে মনে রাখবেন আপনিও ইডিয়টের স্বামী।”
“ইউ ফুল!”
“ইংলিশ বাংলা মিক্সড করে বললেও ফুল বলার জন্য ধন্যবাশ।”
“হোয়াট ইজ ধন্যবাশ?”
“ধন্য মানে উজাড় হয়ে যাওয়া বাঁশ মানে হলো যেটা অনেকেরই নসিবে বিনাবাক্যে প্রবেশ করে পিছন দিয়ে।যেমন আপনি আমার জীবনের বাঁশ।”
“আমি তোমার জীবনের বাঁশ?”
“হ্যাঁ তাই তো।আপনি আমার জীবনের বাঁশ।এই জন্য ভাবছি জঙ্গলে বাঁশের খোঁজ করতে হবেনা।বাঁশ নিজেই আমার সাথে থাকবে।”
“ইউ গেট আউট।”
“আপনাকে বলতে হবেনা।আমি এমনিতেই রান্না করার জন্য যাবো।”
“শোনো মেয়ে একটা কথা মাথায় রাখবে,তোমার হাতের রান্না আমি খাবো না।”
“আমার হাতের রান্না পাবেন কোথায়?আমার হাতে থাকবে খুন্তি ওটা দিয়েই রান্না হবে।তাহলে খাবেন তো?”
“তোমার মত পাজি আমি একটাও দেখিনি।সবাইকে চাপকে সোজা করেছি আমি আর তুমি কি না!”
“আপনাকে সোজা করতে এসেছি।”
“কি!”
“বুঝবেন না এখন আপনি।যদি উন্নতি হয় সেদিন বুঝবেন।”
বলেই শোভা চলে আসে।দরজার কাছে এসে দিদারকে দেখে আগে নিজের গায়ে চোখ রাখে।সব জায়গা ভালোভাবে ঢেকে আছে দেখে দিজার উদ্দেশে বলে,“তোমরা এখানে?”
“ভাংচুরের শব্দ পেয়ে এসেছি কিন্তু এসে তো অন্যকিছু দেখছি।”
“এরপর থেকে এমন অন্যকিছুই দেখতে পাবে।”
দুই ভাইবোন হেসে দিলো।দিদার বলে,“আমার সাথে তো পরিচয় হয়নি তোমার তেমন।আগেরবার আমি বাড়িতে এসে শুনি তুমি চলে গেছিলে।আমি তোমার দেবর হই।”
দিজা খোচা মেরে বলে,“আপনি করে বল।ভাবী হয় তোর সম্মানে।”
“তুই তো তুমি করে বলছিস।”
“কারণ আমরা একই বয়সী তাই তুমি বলি।”
“আমি ভাবীর সিনিয়র।”
“তাও আপনি করে বলবি।ভাবী তোর সম্মানে বড়।”
“আর তোর সম্মানে কি?”
“বান্ধবী।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৮
শোভা দুজনের কথা থামিয়ে বলে,“আমাকে তুমি আর বোন বলেই ডাকতে পারেন।আমি আপত্তি করবো না।”
“নাহ,ভাবী ডাকবো।যেহেতু তুমি আমার ভাইয়ের বউ।”
ভাইয়ের বউ এমনভাবে বলল যেনো শব্দটা অসম্ভব কিছু প্রকাশ করে।শোভা মাথা না ঘামিয়ে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে।এখানে থাকা মানে আরেক যুদ্ধ করা।