বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১০

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১০
ইশরাত জাহান

সেই যে সকালবেলা রাগ করে বাসা থেকে বের হলো মাত্র বাড়িতে ফিরল দর্শন।এখন দুপুরের সময়।দর্শন গোসল করেই যায়।এখন যোহরের আযান দিয়েছে।শোভা গোসল করে একেবারে ওযু সেরে মাথায় কাপড় দিয়ে বাইরে আসে।বাইরে বের হয়ে দরজায় ছিটকিনি দিতেই শব্দে দর্শনের চোখ যায় সেদিকে।শোভা দর্শনকে দেখতে না পেয়ে গামছার দিকে যায়।শুধু মাথায় ওড়না থাকার কারণে শোভার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো দর্শন।বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে।শোভার মুখটা দেখে চোখ সরাতে ব্যর্থ দর্শন।পানি দিয়ে ধুয়ে আসা মুখটা দুধে আলতা দেখতে।ওযু করার কারণে স্নিগ্ধ পবিত্র এক নারী দেখা দিলো দর্শনের দৃষ্টিতে।

গামছা দিয়ে মুখ মুছতে থাকে শোভা আর দর্শন দেখছে শোভার চোখ নাক ঠোঁট।শোভার চোখদুটো টানা।চোখের ভ্রু মোটা ও কালো বোঝা যাচ্ছে প্লাগ করেনি কিন্তু চোখের আকৃতি সুন্দরকরে ফুটিয়ে তুলেছে।চোখের পাপড়িগুলো বড় আছে।চোখে কাজল না দিয়েও সুন্দর এক আকৃতি প্রকাশ পায়।ঠোঁট দুটো যেন ফর্সা মুখের মাঝে গোলাপের পাপড়ি।ফর্সা মুখশ্রী হবার কারণে ঠোঁট তার গোলাপী।মুখে কোনকিছু মাখেনি শোভা।তাতেই তার সৌন্দর্য নজরকাড়া।চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে দর্শন।শোভা মুখ মুছে মাথায় হিজাব দিয়ে নিকাব বেঁধে পিছনে ঘুরতেই একটু কেঁপে ওঠে।দর্শন এখনও চেয়ে আছে।শোভা এগিয়ে এসে বলে,“বাইরে থেকে ঘোরাঘোরি শেষ?এখন নামায পড়তে যান।বাসায় এসে ভাত খাবেন।আর হ্যাঁ আমার হাত রান্না করেনি তাই আপনি নির্দ্বিধায় খেতে পারেন।”

দর্শন হুশে ফিরলে রাগ দেখিয়ে বলে,“তুমি একটা বাচাল।”
“বেশি কথা বললে তার সম্মানী হিসেবে বাচাল নামটা শুনতেই হয়।আমি যেহেতু বেশি কথা বলি তাহলে আমি নিজেকে বাচাল হিসেবে মেনেই নিলাম।”
শোভার এই ঘাড়ত্যাড়া কথা শুনে দর্শন আবারও হাত উঠাতে নেয় কিন্তু শোভার গালে যায়না হাতটা।হাত মুঠ করে নামিয়ে নেয়।শোভা বলে,“নামাজ পড়ে আসুন।দেখবেন মনটা প্রফুল্ল আছে।রাগ তেমন মাথায় চেপে থাকবে না।”
“তুমি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বাস্তব কথা বললাম।দেখে নিন আপনি নিজের রাগ নিজের আয়ত্তে রাখতে নামায পড়া জরুরি।এতে মনে আলাদা শান্তি কাজ করে।নিজের মাঝে ক্ষোভ বা কোনো হাহাকার থাকলে দুর হয়ে যাবে।”
দর্শন চুপ করে চলে গেলো।শোভা জায়নামাজ নিয়ে গেলো দিজার ঘরে।দিজা জানিয়েছে সে আপাতত শোভার কাছে থেকে সঠিক নিয়মে নামায পড়া শিখবে আর কুরআন তিলাওয়াত সঠিকভাবে উচ্চারণ করা শিখবে।তাই শোভা ওই ঘরে গেলো।দর্শন বাইরে এসে ধূসর রংয়ের পাঞ্জাবি পরে হাতে ঘড়ি পরে পকেটে মোবাইল নিয়ে বাইরে বের হয়।দিদারকে দেখে বলে,“চল।”

দিদার আগেই প্রস্তুত ছিল।তাই দুই ভাই একসাথে বের হয়।দাদাজান এখন একটু সুস্থ।তাও তিনি বাসায় নামাজ পড়লেন।দর্শনকে জানিয়েছে কাল থেকে মসজিদে যাবে।
নামাজ শেষে বাইরে এসে দিদার ও দর্শন পাশাপাশি হাঁটছে।একসাথে দুজনে কারবালার পাশ দিয়ে হাঁটছে।দর্শন কারবালার দিকে চোখ রেখে দাদীর কথা স্মরণ করে।এখানে দাদীর কবর আছে।দিদার বলে,“জিয়ারত করতে যাবে ভাইয়া?”
দর্শন মাথা নাড়িয়ে বলে,“বিকালবেলা।”
“আচ্ছা।”
দর্শন একটু থেমে বলে,“আমি শাসন করি বলে তোর খুব কষ্ট হয়?”
“না ভাইয়া।”

দিদার একটু তুতলিয়ে বলে।দর্শন মৃদু হেসে কারবালার পাশের পুকুরের কাছে গিয়ে বসে।দিদার পাশে বসলো।দর্শন প্রকৃতি দেখতে থাকে।সাদা আকাশটা বিশ্রীভাবে রোদের তেজে আলো ছড়িয়েছে। আকাশ এর দিকে চোখ রাখা যায়না।জ্বলে ওঠে সাথে সাথে।পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে বলে,“আমি নারীদের বিশ্বাস করতে পারিনা।আমার নিজের মা যখন আমাদের বাবাকে ধোঁকা দেয় তখন আমার কাছে ব্যাপারটা ঐভাবে ফুটে ওঠেনি।ঠিক যেদিন বুঝলাম ওই মহিলা বাবাকে কেন পছন্দ করেনা সেদিন থেকেই আমার ক্ষোভ বাড়লো।বুঝলাম নারী আসলে পুরুষের টাকা পয়সা না পুরুষের সৌন্দর্যটাও চায়।

নারীরা এক জায়গায় মনস্থির রাখতে জানেনা।ওদেরকে যত দিবে ওদের চাহিদা তত বাড়বে।লোভী হয় নারীরা।ওদের লোভ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পায়।শুধু ওই মহিলা না আমি আরো দেখেছি।আমার আশেপাশে অনেককে পস্তাতে দেখেছি নারীদের জন্য।সেই থেকেই আমার জীবনের লক্ষ্য একটাই।নিজে সফল হবো নিজের মত জীবন কাটাবো।এই নারী নিয়ে জীবনটাকে ভেজালে কাটাবো না।আমি তোকে নারী থেকে দূরে সরার কথা বলব না কিন্তু আমি বলব জীবনে সফল হতে হবে তোকে।পুরুষের সফলতা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে।ঠিক আমাদের বাবার জীবনের মত করে।সময়কে নিজের মত যেতে দেখে উড়িয়ে দিলে চলবে না।সময়ের মূল্য বুঝে কাজে লাগাতে হবে।আজ তুই নিজে নাম করে কিছু করবি তো কাল তোর কাছে লোকেরা বাহবা দিয়ে ঘিরে ধরবে।তুই কিছুই অর্জন করতে পারবি না তো তোর আশেপাশের মানুষদেরকেও হারাতে থাকবি।এটা বাস্তব সত্য কোনো গল্প বা কাল্পনিক চিন্তা না।”

দিদার মন দিয়ে শুনলো।বাবার জীবন সম্পর্কে জানে সেই সাথে জানে দর্শনের কষ্টটা।বাবার এক্সিডেন্ট হলে দর্শনের সেই এক্সিডেন্ট দেখে মাথায় চাপ সৃষ্টি করে। এতে আরো রাগী হয় সে।জেদকে ধরে রেখে তাই বিশ্বাস করে।এটাকে সম্মান করে দিদার কিন্তু সে দর্শনের মত পরিস্থিতির স্বীকার না বলেই এগুলো নিজের জীবনে মেলাতে পারেনা।আমরা কেউই কারও জীবনের ঘটনার সাথে নিজেদের মেলাতে পারিনা।নিজেদের জীবনকে নিজেদের মত সাজাতে পারি কিন্তু অন্যকে দেখে এগোনো সহজ নয়।দিদারের ইচ্ছা করলো ভাইকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু যেই জড়িয়ে ধরতে যাবে তার আগেই দর্শনের কল আসে।দর্শন কল ধরে অন্যদিকে গেলো।নারকেল গাছের কাছে এসে বলে,“কেমন আছিস তুহিন?”

ওপাশ থেকে তুহিন বলে,“আমি আলহামদুলিল্লাহ,তুই কেমন আছিস?”
“এই তো ভালো।”
“দেশে এসেছিস শুনলাম।একবার জানাবি না?”
“তোকে না বলেছিলাম দেশে কোম্পানি অর্গানাইজ করবো।তার কাজ হয়েছে কিন্তু আসাটা দ্রুত হলো দাদাজানের জন্য।”
মৃদু হাসলো তুহিন।বলে,“ঢাকায় আসবি কবে?”
“দুদিন পর।”
“ভাবীকে নিয়ে আসবি?’’
“ইচ্ছা তো নেই কিন্তু দাদাজানের একমাসের চুক্তির কারণে হয়তো আনতে হবে।”
“ফ্ল্যাট নিয়েছিস?”

“নাহ রে।আমার ওই ফ্ল্যাট ভালো লাগেনা।আমি একটা পুরোনো দোতালা বাড়ি কিনে নিয়েছি।নিচতলায় কোনো ঘর নেই আছে শুধু একটা রান্নাঘর গোসলখানা আর কোণায় গ্যারেজ আর জিমের ব্যাবস্থা।দোতালায় তিনটে ঘর আছে উপর দিয়ে সিঁড়ি।আমি ওটা দেখে সাথে সাথে কিনে নিয়েছি।”
“বাড়ি বানাবি?”
“উহু,বাড়ির পরিবেশ আমার পছন্দ।গ্রাম্য ধাঁচ আছে।”
তুহিন একটু ভেবে বলে,“তুই কি পুরান ঢাকায় আসছিস?”
“হ্যাঁ,ওখান থেকেই তো আমার কোম্পানি কাছে।আর দিজার কলেজও।”
“দিজা ঢাকায় পড়াশোনা করবে?”

“হ্যাঁ,ওর স্বপ্ন পূরণ করবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা তো ওর স্বপ্ন।”
“আরে বাহ্!তাহলে তো দেখা হবে তোর বোন আর ভাবীর সাথে।”
“তুই আমার বাড়িতে এলেই পারিস।যদিও আমার বোনের দিকে তোকে নজর দিতে দিবো না।কারণ তুই জানিস আমি কতটা স্ট্রিক।”
তুহিন মৃদু হাসলো।ওর মনে একটা মেয়ের বসবাস। এতে আর কোনো নারীর স্থান নেই।কিছু ভেবে অতঃপর জিজ্ঞাসা করে,“ভাবীকে কেমন লাগে তোর?”
“কেমন লাগে বলতে?”
“যতটুকু দেখলি সব মিলিয়ে?”

দর্শন চিন্তা করে শোভার ব্যাপারে।শোভার যেই মুখ মোছা দৃশ্য কল্পনা করে বলে,“মেয়েটার মাঝে অহংকার নেই।প্রথম দেখায় মনে হয় শান্ত কিন্তু আসলে চঞ্চল।পরিস্থিতি পরখ করে দেখে তারপর নিজের জবান চালাতে শুরু করে।দেখতে সুন্দরী আছে।ব্যবহার অন্যদের সাথে ভালো আমার সাথে ঝগড়াটে।”
দর্শন আরও বলতে নিবে তার আগে তুহিন থামিয়ে বলে,“তুই কি ভাবীর প্রেমে পড়েছিস?”
চোখ কুঁচকে দর্শন বলে, “প্রশ্নই আসেনা।আমি দর্শন ফরাজি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না কাউকে নিজের জীবনে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবো না।”
“দেখিস একদিন এর বিপরীত বাক্য না তোর মুখ থেকে বের হয়।মেয়েতে এলার্জি থাকা দর্শন ফরাজি একদিন বউকে ভালবাসবে।”

“হবে না।”
“সময় বদলাতে সময় নেয়না বন্ধু।শুধু সময় ফুরিয়ে নতুন সময়ের দেখা দেয়।”
“শিক্ষক মানুষ কি আজকাল সংসার বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করছে?”
“সময় তো হয়েছে বিয়ের কিন্তু পছন্দের নারীর জন্য অপেক্ষায় আছি।”
“কে সে?”
“সে এমন এক নারী যার জন্য আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়না কখনোই।খুব বেশি ভালোবাসি তাকে।হঠাৎ দেখা কিন্তু আবারও চোখের পলকে হারিয়ে যাওয়া।খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আমার কলেজেই তার পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে।সুযোগ হাতছাড়া করবো না।মেয়েটার পরিবারের খোজ নিয়েই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।’’
“শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবি?”

“এখনও তো শিক্ষক হইনি।আর আমি স্টুডেন্টদের রেসপেক্ট করি কিন্তু এই মেয়েটিকে আমি অন্য নজরে দেখতে পারবো না।সে একান্তই আমার মনে এসে জায়গা করে নিয়েছে।”
“খুব বেশি ভালোবাসিস?”
“হুমমম,অনেক।তাই তো এত অপেক্ষা।মেয়েটা এত বাচ্চা আর সুন্দরী যে আমি বর্ণনায় শেষ করতে পারবো না।”
“তোর প্রেমের আলাপ শুনলে আমার মাথা ঘুরে ওঠে।এসব শোনা আমার কর্ম না।ক্ষুধা লেগেছে রাখি।বাসায় যেতে হবে।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৯

“তুই কোথায় এখন?”
“মসজিদে এসেছিলাম।বাইরে বসতেই তুই কল করেছিস।”
“আচ্ছা তাহলে উন্নতি ঘটছে।রাখি দোস্ত যা বাসায় আর ভাবীর হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা কর।”
দর্শন বাকি কথা শুনতে না চেয়ে কল কেটে দেয়।দিদারের কাছে এসে বলে,“চল।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here