সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৫ (২)
Jannatul Firdaus Mithila
রাত ১১ টা🌼🌼
রৌদ্র নিজের রুমে বসে মেডিক্যালের কিছু ফাইল ঘাঁটছে। আগামীকাল তার দু’দুটো সার্জারী। এজ এ প্রফেশনাল ডক্টর তার দায়িত্ব বরাবরই বেশি। আগামীকাল যাদের সার্জারী তাদেরই ফাইলগুলো চেক করছে রৌদ্র। এমন সময় রৌদ্রের ঘরের দরজায় নক করার শব্দ আসে।রৌদ্র তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় ভ্রুকুটি করে তাকায় দরজার পানে।দেখতে পায় অনিক দাড়িয়ে। রৌদ্র কুচকানো ভ্রু শিথিল করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— এতো রাতে! কোন বিশেষ দরকার?
অনিক কিছু না বলে মাথা নাড়ে।ধীরগতিতে এগিয়ে আসে রৌদ্রের কাছে। রৌদ্রের দৃষ্টি এখনো তার হাতে থাকা ফাইলগুলোতে।বেশকিছু সময় পার হবার পরও অনিককে নিজের সামনে এমন সটান হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রৌদ্র আবারও গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,
— কি ব্যাপার! এখানে কি শুধু দাড়িয়ে থাকতে এসেছিস? কিছু বলার থাকলে বল।
রৌদ্রের কথা শেষ হবার সাথে সাথে অনিক শান্ত অথচ নিরেট কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
— তুমি বনুকে ভালোবাসো?
কথাটি কর্ণধার অবধি পৌছানো মাত্রই থমকে যায় রৌদ্রের হাতদুটো। হাতের ফাইলগুলো ইতোমধ্যেই অসাবধানতায় ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে। রৌদ্রের হাতদুটো যেন বরফের ন্যায় জমে উঠেছে। গলা দিয়ে কোন শব্দই বের হচ্ছে না তার!
অনিক রৌদ্রের নিস্তব্দতা দেখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তার সামনে। অনিক আবারও একই কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— তুমি কি সত্যিই বনুকে ভালোবাসো?
রৌদ্র এবার নিজেকে সামলায়।বসা ছেড়ে সটান হয়ে দাড়ায়। ট্রাউজারের দু-পকেটে দুহাত গুজে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— হুম ভালোবাসি। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি।এতোটা ভালোবাসি যতটা ভালোবাসলে এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কাওকে ভালোবাসার প্রয়োজন অনুভব হবে না।
রৌদ্রের কন্ঠ একেবারেই শান্ত-স্বাভাবিক। চোখে নেই কোন ভয়,নেই কোন সংশয়! অনিক রৌদ্রের কথায় তৎক্ষনাৎ সোজা হয়ে দাড়ায়। অবাক কন্ঠে বলে উঠে,
— কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! তুমিতো নিজেও জানো এর পরিনতি ঠিক কতোটা ভয়ানক! তারপরও কেনো নিজের মনের মাঝে এই অনুভুতির বর্ষন ঘটাতে গেলে।তুমি কি ভুলে গেছো আজ থেকে ১৬ বছর আগে ঠিক কি ঘটেছিলো এই এহসান পরিবারে? ভুলে গেছো সেই কালরাত্রির কথা? ভুলে গেছো সেদিনকার অজস্র ক্রন্দনরত মুখগুলো? কিভাবে ভুলে গেলে ভাইয়া! কিভাবে!
অনিকের কথায় রৌদ্র তার দিকে ফিরে। চোখ থেকে চশমাটি খুলে কাউচের সামনের টেবিলের ওপর রাখে। আবারও সটান হয়ে দুহাত বুকে ভাজ করে দাড়ায়।অতঃপর অনিকের চোখে চোখ রেখে নিরেট কন্ঠে বলতে থাকে,
— তোকে কে বললো আমি সেসব স্মৃতি ভুলে গেছি? সবটা আমার মনে আছে।
রৌদ্রের কথায় অনিক এবার ভ্রুকুচকায়।মুখভঙ্গি যথেষ্ট গম্ভীর রেখে জিজ্ঞেস করে,
— মনে যদি থেকেই থাকে তাহলে কেনই বা জলন্ত আঙ্গারে পা বাড়াচ্ছো! তুমি তো বেশ ভালো করেই জানো তোমার এই অনুভুতি ঠিক কতটা ভয়ংকর পরিনতি নিয়ে আসবে।
অনিক এ-পর্যায়ে থামে। কিছু একটা ভেবে আবারও প্রশ্ন করে,
— কতদিন যাবত পছন্দ করো বনুকে?
রৌদ্র এবার ফিচেল হাসে। অনিকের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকায়। তারপর কিছুক্ষন কিছু একটা ভেবে বলে উঠে,
— আয়।
বলেই সে রুম থেকে বের হয়ে হাটা ধরে ছাদের দিকে। অনিক প্রথমে বোঝে না তার কথা।কিন্তু তবুও প্রতিত্তোরে টুঁ-শব্দ না করে চলে যায় ছাদে। অনিক ছাদে এসে দেখে রৌদ্র রেলিঙের দাড় ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। অনিক নিঃশব্দে পাশে এসে দাড়ায়।
রৌদ্র অনিকের উপস্থিতি টের পেয়ে দূর আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
— তুই জানতে চেয়েছিলিনা তোর বোনকে কতদিন যাবত ভালোবাসি? তাহলে শোন~
যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি ভালোবাসা কি! যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি নিজের অস্তিত্বকে, সেদিন থেকেই ভালোবাসি তোর বোনকে। সে আমার জীবনের প্রথম অনুভুতি। আমার মন আরন্যে ফুটে ওঠা প্রথম প্রনয়ের ফুল। আমার হৃদয়ে তোলপাড় তোলা প্রথম মায়াবিনী। যার চোখের দিকে তাকালে আমি রৌদ্র নিজেকে হারিয়ে ফেলি সেই হৃদয়হরনী তোর বোনটা।
রৌদ্র এবার থামে।চোখ তার এখনো দূর আকাশে। এপর্যায়ে মনে হচ্ছে গলাটা কেমন ধরে আসছে তার। বুকটায় কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে এখন।রৌদ্র হাত রাখে তার হৃদয়টার ওপর। ধরে আসা কন্ঠফুরে আবারও বের হয়ে আসে কিছু অপ্রকাশিত অনুরক্তি,
— অনিকরে! আমিতো ইচ্ছে করে তোর বোনটাকে ভালোবাসতে চাইনিরে! কিন্তু আমার এই অবচেতন হৃদয়টা ওর জন্যই কেবল উত্ত্যাক্ত করতো আমায়।এমন না যে আমি ওকে ভুলবার চেষ্টা করিনি।বিশ্বাস কর! বহুবার চেষ্টা করেছি ওকে ভুলে যেতে কিন্তু যতবারই এমনটা চেষ্টা করেছি ঠিক ততবারই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বুকে এক অমীমাংসিত প্রলয় ওঠে। আমি নিজেকে অনেক সংযত করতে চেয়েছি পরিবারের কথা ভেবে কিন্তু ফলাফল প্রতিবারই শূন্য। অরিনকে হারিয়ে ভুলে যাবার কথা ভাবাতো দূর স্বপ্নেও আনতে পারিনা আমি। আচ্ছা আমি কি করবো বলনা! আমিতো ওকে ছাড়া বাঁচবো নারে।মরে যাবো আমি, একেবারেই মরে যাবো!
অনিক এতক্ষণ যাবৎ নিস্তব্ধ হয়ে শুনছিলো রৌদ্রের কথাগুলো। হঠাৎ রৌদ্রের শেষের কথাগুলো শুনে তার কাঁধে হাত রেখে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠে,
— না ভাইয়া। এভাবে বলোনা। কিচ্ছু হবে না তোমার।
রৌদ্র এবার চোখ বন্ধ করে নেয়। চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক করতে। অনিক আবারও আগের ন্যায় বলে,
— ভাইয়া! আমি প্রথমে যখন বুঝতে পেরেছিলাম তুমি অরিনকে পছন্দ করো বিশ্বাস করো আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তারওপর বনুর প্রতি তোমার অবসেশন ঠিক কতোটা প্রখর তাও আমি দেখেছি। এখন তোমার কথা শুনে আমি নিসন্দেহে বলতে পারি তুমি আমার বোনুকে ঠিক কতোটা ভালোবাসো। কিন্তু ভাইয়া তুমি নাহয় ওকে ভালোবাসো কিন্তু ওতো তোমায় ভালোবাসে না!
অনিকের কথায় রৌদ্র এবার ঠোঁট কামড়ে হাসে।বিরাট আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
— যদি বলি তোর বোনুও আমায় ভালোবাসে তখন!
অনিক এবার চমকে উঠে। চোখ বড়সড় করে বলে উঠে,
— মানে! তুমি এতোটা শিওর কি করে?
রৌদ্র এবার পেছন ঘুরে। দুহাত পকেটে গুজে দাড়িয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
–আমার ধারনা যদি ভুল নাহয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো তোর বোনও আমায় ভালোবাসে। তবুও তোর বিশ্বাস নাহলে পরিক্ষা করে দেখতে পারিস।
অনিক অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
— ইম্পসিবল! ও তোমায় ভালোবাসবে মানে! আমিতো কখনো এমনটা খেয়াল করিনি ওর মাঝে।
রৌদ্র আবারও ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো,
–সেটা তোর দূর্ভাগ্য তুই খেয়াল করিসনি।
অনিক এবার চিন্তায় পড়ে যায়। ঘাড়ে হাত দিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে বললো,
— ভাইয়া! যদি তোমার কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এহসান পরিবারে আবারও যে একটা ঝড় আসতে চলেছে তা আমি কনফার্ম।
রৌদ্র এবার থমকায়।অনিকের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— আচ্ছা তোর কি মনে হচ্ছে আমি তোর বোনকে ভালো রাখতে পারবোনা বা তাকে যেকোনো সমস্যা থেকে আগলে রাখতে পারবোনা?
এরূপ কথায় অনিকের ঘাড়ে থাকা হাতটি থেমে যায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
— ইয়ে না মানে,, আমি এমনটা ভাবিনি ভাইয়া।আসলে আমি ভাবছি তুমি কিভাবে সবাইকে মেনেজ করবে! আদৌও কি আমাদের পরিবারে এটা সম্ভব?
রৌদ্র ফিচেল হাসে। ঘাড় এদিক ওদিক বাকিয়ে বলে উঠে,
— ওসব সময় আসলে দেখা যাবে। আপাতত এই বিষয়টা শুধু নিজ অবধি রাখবি।গট ইট!
অনিকও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।কিন্তু তার মনে এখনো কিছু একটা সন্দেহ থেকেই যায়।তাই সে রৌদ্রকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠে,
— ভাইয়া! তোমার কথামতো অরিনও যদি তোমায় ভালোবেসে থাকে তাহলে বিশ্বাস করো আমি অনেক খুশি হবো কেননা এখন আর আমার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তুমি তোমার ভালোবাসাকে শত প্রতিকুলেও আগলে রাখবে এবং পরিবারের বিরুদ্ধেও যাবেনা। কিন্তু যদি অরিন তোমায় ভালোবেসে না থাকে তাহলে আমি কিন্তু আমার বোনকে কোনপ্রকার জোর করতে দেবো না বলে দিলাম!
রৌদ্র ভ্রুকুটি করে তাকায়। গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
–তুই কি আমায় থ্রেট দিচ্ছিস?
অনিক জিভ কাটে।তড়িঘড়ি করে নিজেকে শুধরে নেবার ন্যায় বলে উঠে,
— আরে না ছি ছি কি বলছো এসব।আমিতো ঐ অরিনের মতামতের বিষয়ে বলছিলাম আরকি!
এপর্যায়ে র্রৌদ্র বাঁকা হাসলো। এক অবাধ আত্মবিশ্বাসের সহিত বললো,
— জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ সম্বন্ধী সাহেব!
অনিক হঠাৎই হো হো করে হেসে ওঠে। ধুম করে জড়িয়ে ধরে রৌদ্রকে।রৌদ্রের কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৫
— বাহ! তোমার মুখে এই ডাকটাতো বেশ লাগলো!
রৌদ্রও মুচকি হাসে।অনিকের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,
— হয়েছে। এবার থাম।
অনিকও আস্তে ধীরে ছেড়ে দেয় রৌদ্রকে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর তারা চলে আসে ছাঁদ থেকে।তারপর চলে যায় যার যার রুমে।