সে আমার হৃদয় হরণী পর্ব ৭

সে আমার হৃদয় হরণী পর্ব ৭
বুশরা আহমেদ

“আহমেদ মেনসন ” রাত ১০ .৩০ মিনিট । রেজা আহমেদ নিজের রুমে বসে অফিসের কিছু ফাইল দেখছেন। রেবা আহমেদ পাশে এসে বসলেন।
রেজা আহমেদ: বুশরা এখনো ফিরলো না কেন?
রেবা আহমেদ: ওরা তো ওখানেই থাকবে ‌।,
রেজা: মেয়েটা এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। এই তো সেইদিন আমাদের কোল আলো করে আসলো এই পৃথিবীতে।
রেবা: শুধু বড় হয় নি।রাগ জেদ সবকিছুই বেড়ে গেছে তোমার মেয়ের ‌। আর দুই দিন পর সেও চলে যাবে রাহি ও তৌফিক এর সঙ্গে।

রেজা আহমেদ: যখন সব ঠিক করেই নিয়েছে তখন বাঁধা দিয়ে কি করবো ।
বুশরা আমাদের প্রথম সন্তান , আমাদের ভালোবাসার প্রথম প্রতীক।
রেবা আহমেদ: কি করে দেখতে দেখতে যে এতো গুলো বছর চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া তোমাকে ভালোবাসা সবকিছুই অনেক সুন্দর ছিল। এখন সেই ভালোবাসার জোরেই আমি তোমার।
রেজা আহমেদ: তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি গুলো আজও আমার মনে রয়ে গেছে। সময় কতো অদ্ভুত এই তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো ।আর আজ আমারা তিন সন্তান এর বাবা মা।
বুশরাও এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। আফরিন আর আয়ান ও বড় হচ্ছে।আর আমরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু একটা জিনিস জানো তো !!
রেবা আহমেদ: কী?!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রেজা আহমেদ: আমি তোমাকে সেই আগের মতই ভালোবাসি।।
রেবা আহমেদ মুচকি হাসলো,সেও বললো আমিও তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি বুশরার আব্বু।
চলে যাওয়া যাক অতীতে ,,
সালটা ১৯৯৮ , রেজা আহমেদ BSC তে পড়ার জন্য দিনাজপুরে যান। সেখানে একটা একটা সরকারী কলেজ এ ভর্তি হন । সেখানে রেবা আহমেদ ও ভর্তি হন ।সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয় । আস্তে আস্তে সেইটা ভালোবাসায় রুপ নেই । রেজা আহমেদ রেবা আহমেদ এর জন্য চিঠি লিখতেন।সেই চিঠি আদান-প্রদান শেষ হয় । তাদের পবিত্র বন্ধন এর মাধ্যমে।২০০২ সালের ১৬ জানুয়ারি ঘরোয়া ভাবে তাদের বিয়ে হয়। ২০০১ সালে 1st class degree নিয়ে দুই জনেই বের হন।কলেজের সবাই তাদের রেজা রেবা বলে ডাকে। শুধু তাই নয় দিনাজপুর এ সবাই তাদের রেজা রেবা বলেই চিনে ।

অনেক চাকরি পেয়েছে রেজা আহমেদ।রেবা আহমেদ ও চেয়েছিলেন বাহিরে থাকতে। কিন্তু শুনেন নি রেজা। তারপর জন্ম হয় বুশরার। তখন তারা রাজশাহীতেই থাকতো । কিন্তু ধিরে ধিরে বাসায় ঝামেলা হওয়ার কারণে , আফরিন এর জন্মের বুশরাকে দিনাজপুরে তার নানির কাছে পাঠে দেওয়া হলো । তারপর বুশরার বয়স যখন ১৩ তখন রেজা আহমেদ ও হাফিজুর আহমেদ ঢাকাতে চলে আসেন সপরিবারে। শুধু গ্ৰামে থেকে যায় তার দাদি দাদু । এখন তারাও চলে এসেছে।
বর্তমান
রেজা আহমেদ ও রেবা আহমেদ এর কথার মাঝে আয়ান এসে রেবা আহমেদ কে জড়িয়ে ধরে বললো,
আয়ান: আম্মু আপু আসে নি কেন।
রেবা আহমেদ: তোমার আপু আজকে আসবে না।
আফরিন এসে বললো,

আব্বু আপু দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে আমিও যাবো । আমিও ওখানে পড়াশোনা করবো ।
রেবা আহমেদ: তোদের মাথা টাই খারাপ হয়ে গেছে । সবাই যা তোরা আর আমরা বুড়ো বুড়ি একা একা থাকি ।
আফরিন: কোথায়?তোমারা বুড়ো হওনি এখনো । তোমাকে তো এখনো সেই ২৫ বছরের যুবতী মতো লাগে ।আর আব্বু কে কি আর বলবো আব্বু যা handsome একদম ৩০ বছরের যুবক ।সবাই বলে আমার স্কুলে যে ” আফরিন তোর আম্মু আব্বু কে দেখলে বোঝায় যায় না যে তারা ৪০+ । তোমারা তো জানোই ।
রেবা আহমেদ: হ্যাঁ।জানা আছে ‌।
রেজা আহমেদ: হ্যাঁ তা ঠিক। আমাদের বয়স টা বোঝা যায় না। কিন্তু বয়স তো হয়েছে। বুশরা যাচ্ছে যাক। তুমি এখানেই থাকো ।আর রিফাত ও তো এখানেই আছে । সবাই যদি দেশের বাইরে চলে যাও তাহলে এখানে কে থাকবে।

আফরিন আর কিছু বললো না।
রেজা আহমেদ কিছু ছবি বের করলেন।এই গুলো রেবা আহমেদ ও রেজা আহমেদ কলেজ লাইফ এর ছবি।দেখো তো আফরিন তোমার আম্মু আগে একদয ঐশ্বরিয়া রাই এর মতো ছিল।
আফরিন আর বুশরা জানে তার আম্মু আগে থেকেই অনেক সুন্দরী মেধাবী ।সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।
এখনো কম না ‌।তাই তো সবাই তাকে কলেজের স্টুডেন্ট মনে করে । আফরিন আয়ান আগেকার সেই পুরনো ছবি গুলো দেখতে লাগলো।

এইদিকে বুশরা খাবার সার্ভ করছে তৌফিক আর রাহিকে । তারপর সেও বসে পরলো। খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। খাওয়ার সময় রাহি আর তৌফিক টুকটাক কথা বললেও বুশরা কোন কথা বলে নি ।রাহি বিষয় টা লক্ষ্য করলেও কিছু বললো না।
রাত থেকে বুশরার খুব জ্বর।রাহির মাথা ব্যথা। দুইজনেই অসুস্থ। সকাল সকাল হিয়াও রেডি হয়ে এসেছে। কিন্তু এসে দেখে বুশরার জ্বর এ অবস্থা অনেক খারাপ। রাহি তৌফিক কে বললো , আয়ান, আফরিন, রিফাত আর হিয়া কে নিয়ে ঘুরে আসতে । হিয়া না করলো কিন্ত বুশরার কথায় রাজি হয়ে গেল। তৌফিক রিফাত কে ফোন দিয়ে রেডি হয়ে থাকতে বললো ।
রাহি নিষেধ করে দিয়েছে যে বুশরা আর সে অসুস্থ এইটা কাউক না জানাতে ।অযথা টেনশন করবে। তারপর কালকে ফ্লাইট।

তৌফিক ও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। তৌফিক হিয়া চলে যেতেই,রাহি বুশরার পাশে বসলো তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
রাহি:কালকে রাত থেকে জ্বর এক বারো বলিস নি কেন।
বুশরা নিশ্চুপ।
কালকে রাতে যে যার রুমে শুয়ে পরার পর। রাহির মাথা ব্যথা হওয়ায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। রাহির একটুতেই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর চলে আসে। কিন্তু বুশরার তা হয় না। কিন্তু হঠাৎ মাঝরাতে বুশরার প্রচুর জ্বর আসে ।সে আর কাউকে ডাকে নি ।
রাহি: কি হলো কিছু বলছিস না কেন?ডাকিস নি কেন?

বুশরা: ছোট থেকেই জ্বর হলে কাউকে ডেকেও পাই নি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই ডাকি নি ।
রাহির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো কথা টা শুনে।রাহি বললো , ছোট আম্মু ছিল তো এই ৮ টা বছর ,তাও তুই যদি তাকে না ডাকিস তাহলে কেমন করে হবে ‌কিন্তু ভেবে দেখ তোর খারাপ সময় থেকে কিন্তু ছোট আম্মুই তোকে বের করে এনেছে ।
বুশরা ভাবলো ঠিকি তো । কিন্তু কোথাও একটা অভিমান রয়ে গেছে বুশরার তার আব্বু আম্মুর প্রতি। শৈশব এর ৫ টা বছর তো সে পায়নি তার আম্মু আব্বু কে।

রাহি আবার বললো ,, তুই শৈশব এর ৫ টা বছর ছোট আম্মু ও আব্বু কে ছাড়া কাটিয়েছিস । কিন্তু সেখানে কিন্তু অনেকেই ছিল।জানি অনেক কথা শুনতে হয়েছে । কিন্তু আমি,,আমি যে ১৬ টা বছর একা নিজেকে সামলেছি । তৌফিক কে আগলে রেখেছি।২ টা বছর আঙ্কেল আন্টি ছিল। কিন্তু তারা আমাদের একা রেখে চলে যাওয়ার পর,আমি কি করে থেকেছি।কি করছি তৌফিক কে কী করে সামলেছি , ভেবে দেখেছিস। তুই তো বছরে একবার বা দুইবার হলে তাও কাছে পাইতিস ছোট আম্মু, ছোট আব্বু কে কিন্তু আমি
কী করে ১৬ টা বছর কাটাইছি তুই ভাববি না.??
বুশরার জ্বর অনেকটাই বাড়ছে । রাহির কথায় বুশরার ভিতরটা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে।বুশরা উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল।রাহি বুশরার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো।রাহি নিচে গিয়ে ঔষধ আর বুশরার জন্য তৈরি করা সুপ নিয়ে অসলো । রাহি নিজে হাতে বানিয়েছে।রাহি বুশরার রুমে এসে দেখে এখনো একি ভাবে শুয়ে আছে।রাহি বুশরাকে উঠে বসালো। বুশরার মুখের সামনে সুপ টা ধরতেই বুশরা মুখ ঘুরিয়ে নিল।রাহি বুঝলো বুশরার অভিমান হয়েছে । রাহি বললো ,,

আমার সঙ্গে কথা বলবি না ঠিক আছে কিন্তু এই ভাবে কষ্ট কেন দিচ্ছিস । সুপটা কিন্তু আমি নিজে বানিয়েছি যদি খেতে না চাস ওকে চলে যাচ্ছি।রাহি চলে যেতে লাগলো কিন্তু বুশরা রাহির হাত ধরে থামিয়ে দিল।রাহি মুচকি হাসলো বুশরার আড়ালে।রাহি বুশরাকে খাইয়ে দিল সঙ্গে ঔষধ ও দিয়ে দিলো।বুশরার অভিমান কিছুটা হলেও কমেছে ‌। কিন্তু তাও সে রাহির সঙ্গে কথা বললো না।
রাহি চলে যাচ্ছিল তখন পিছন থেকে বুশরা বলে উঠলো,,
” আপনার মাথা ব্যথা কমেছে ?”
বুশরার এই একটা জিনিস রাহি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ,,,
বুশরার অভিমান হলে তুমি থেকে আপনি তে যাইতে ১ সেকেন্ড ও দেরি করে না ।
রাহি : কমেছিল কিন্তু আবার বেড়েছে।
বুশরা: আপনি বসেন আপনার জন্য কফি এনে দিচ্ছি।
রাহি: লাগবে না। তুই রেস্ট নে।আর কফি তখনি খাবো । যখন তুমি টা তুমিই থাকবে ।আপনি হবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে বলতেই পারিস ‌। কিন্তু সেইটা অভিমান করে না। মনে মনে বললো,, তোর মুখে আপনি ডাকটা ভালোবেসে শুনতে চাই জানপাখি।

রাহি চলে গেল।
তৌফিক হিয়া , আফরিন, রিফাত, আয়ান কে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরেছে ‌। রেস্টুরেন্টে এ এক সঙ্গে lunch করেছে । আইসক্রিম,ফুচকা সবকিছুই খেয়েছে । তৌফিক সবার সব আবদার পু্রণ করেছে । সবাইকে অনেক অনেক চকলেট, স্যানক্স কিনে দিয়েছে ।
হিয়ার মনটা আজকে খুব ভালো কিন্তু পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তৌফিক,বুশরা, রাহি কালকে আমিরিকায় চলে যাবে এইটা ভাবতেই।হিয়া তৌফিক এর দিকে তাকিয়ে আছে, তৌফিক ড্রাইভ করছে ‌। পিছনের সিটে বসা আয়ান, আফরিন, রিফাত। তৌফিক হিয়ার বাসার সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করলো হিয়া নেমে গেল। তারপর তৌফিক কে বললো, সাবধানে থাকিয়েন।
তৌফিক: হুম। তুমি ও সাবধানে থাকিও । কোন প্রবলেম হলে ফোন করো ।
হিয়া: আবার কবে আসবেন?

তৌফিক: ঠিক নাই । এখন তো বনু ও আমার সঙ্গে থাকবে ‌।তাই আর কোন পিছুটান ও রইলো না।
হিয়া : সত্যিই কোন পিছুটান নেই?
তৌফিক : না।
হিয়া মনে মনে বললো,কে বলতে পারে আপনারো পিছুটান তৈরি হলো । আমি ততোদিন অপেক্ষা করবো তৌফিক জোবায়েদ ‌।
হিয়া: ওকে । আল্লাহ হাফেজ। আর বুশরাকে বলিয়েন আমাকে ফোন করতে।
তৌফিক: ওকে । আল্লাহ হাফেজ।
বিকেলে বুশরার জ্বর অনেকটাই কমছে ।রাহি বুশরাকে নিয়ে আহমেদ মেনসন এ এসেছে সন্ধ্যায় ।
রাতে সবাই বসে গল্প করছে। মোবারক আহমেদ বললেন,,
তোমারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছো যাও কিন্তু সাবধানে থাকিও। ‌ভুলে যেও না আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করি ‌।

রাহি: কি যে বলো দাদুভাই । ভুলে যাবো কেন। তোমরাই তো আমাদের আপনজন।
তৌফিক: হ্যাঁ ভুলার কোন প্রশ্নেই আসে না।
বুশরা এতো কিছুর মাঝখানে না থেকে নিজের রুমে গিয়ে পাকিং করছে ।
রাহি বুশরার পিছু পিছু এসে দরজায় হেলান দিয়ে দেখছে ।
রাহি : এতো কিছু নেওয়ার প্রয়োজন নেই ।যেইটা যেইটা খুব প্রয়োজন সেইটাই নে ।আর ওখানে গিয়ে ড্রেস কিনে নিবি ।

সে আমার হৃদয় হরণী পর্ব ৬

বুশরা রাহিকে বললো ,, আমি নুর ভিলাই যাবো ?
রাহি: এখন রাত ১০ বাজে ।কি দরকার তোর?
বুশরা: আমি ওখান থেকে কিছু শাড়ি আর নিকলেস টা নিবো ।
রাহি: নিতে হবে না। ওখানে গিয়ে আরো নিউ কালেকশন কিনে দিবো ‌।
বুশরা: আমার জন্য এতো কিছু কেন? কে আমি আপনার।
রাহি: তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আমার কাছে কৈফিয়ত চাইবি না।
বলেই চলে গেল,,
বুশরা বিরবির করে বললো, “”আমিও দেখি কতদিন তুমি তোমার মনের কথা না বলে থাকতে পারো।”‘

সে আমার হৃদয় হরণী পর্ব ৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here