তাজমহল পর্ব ৪৯+৫০

তাজমহল পর্ব ৪৯+৫০
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী

তাজদারকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পর শাইনাকে নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। বারান্দায় একটা বালতিতে আনিসের ওই শার্টটা পানিতে চুবিয়ে রাখা ছিল। সম্ভবত সেটা আনিসই রেখেছিল।
ওটার দিকে শাইনা কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলো। শার্ট হতে ধীরেধীরে রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। মনে হচ্ছে এক বালতি রক্ত বালতিতে ভরে রেখে দিয়েছে কেউ।
শাহিদা বেগম সেটা দ্রুত সরিয়ে ফেললো সেখান থেকে। সাবরিনা শাইনাকে ভেতরে নিয়ে গেল। বোরকা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তুমি হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ। আমি গিয়ে রান্না বসাই।”
শাইনা বিছানায় বসে রইলো। ফোনটা নিজের অজান্তেই হাতে নিয়ে তাজদারের মেসেঞ্জারে পাঠানো ভিডিওটা দেখলো সে। পুরোটা দেখতে পারলো না অবশ্য। তার আগেই চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
সে ঝাপসা চোখে তাজদারের প্রোফাইল পিকচারে ক্লিক করলো। সেই সাদা কালো ছবিটা এখনো দেয়া আছে। পেছনে কালো ব্যাকগ্রাউন্ড, নিচে একটা ভায়োলিন অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে, গায়ে সাদা শার্ট। পিঠ কুঁজো করে বসে একহাত উরুতে রেখে আরেক হাতে থুতনি চেপে ধরে চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। এই ছবিটা দেখলে যে কেউ বলবে এই লোকটার শিরায় শিরায় অহংকার আর দম্ভ। অথচ আজ তার সব অহংকার, দম্ভ লুটিয়ে পড়েছে হাসপাতালের বেডে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যে মানুষ নিজের যুক্তি দিয়ে দশজনকে কোণঠাসা করতে জানে, তর্কে হারতে শেখেনি সেই মানুষটা আজ জীবনের সামনে নিরুপায় আত্মসমর্পণ করেছে। কত সহজেই জীবন পাশা উল্টে দেয়, কত দ্রুতই মানুষকে পরাজিত করে ফেলে!
ঢাকায় আনিস আর শাওন গিয়েছে ওই বাড়ির সদস্যদের সাথে। ওরা তাজদারের ব্যাপারে ঘনঘন আপডেট জানাচ্ছে আশরাফ আর সাবরিনাকে।
সবাই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় এসে থেমেছে যে মন কেমন কু গাইছে সবার। ভালো কিছু চিন্তা করার মতো খবর এখনো কানে আসেনি।
পাড়াপড়শিরা দলে দলে আসছে খবর শোনার জন্য। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনে একেকজন একেক কথা বলছে।

ঢাকার হাসপাতালের সাদা দেয়াল আর ফ্লোরের উপর ঝলমলে আলোয় শুধু নিস্তব্ধতা। আইসিইউর কাঁচের ভেতরে শুয়ে আছে তাজদার।চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, শরীরে নানা রঙের তারের মতো জিনিস। মেশিনের বীপ ধ্বনি শোনা যায় কান পাতলেই। চট্টগ্রামে রাতভর হওয়া অপারেশনের ধকল তার শরীরে এখনো স্পষ্ট। এখন শরীরটা ক্লান্ত যোদ্ধার মতো শুয়ে আছে।
বাইরে পরিবারের মানুষজন বসে আছে উদ্বিগ্ন চেহারায়। আনিস তৌসিফ বারবার খবর যাচাই করছে, ডাক্তারদের পেছনে ঘুরছে। রওশনআরা এক কোণে বসে চুপচাপ কাঁদছে, কান্না থামাতে পারছে না। রায়হান বারবার তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার নিজের গলাও কেঁপে উঠছে কথার ফাঁকে।
প্রতি ঘণ্টায় ডাক্তার এসে পরীক্ষা করছেন। রিপোর্ট বেরোচ্ছে, ভেতরে ওষুধ চলছে, মেশিনের শব্দ কানে বাজছে বীপ… বীপ শব্দে

ডাক্তাররা বলেছেন পরবর্তী ৭২ ঘণ্টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখনো তিনি সংকটমুক্ত নন।
এদিকে ঢাকার আকাশে বিকেলের আলো ঢলছে। হাসপাতালের জানালার ফাঁক দিয়ে সেই আলো ভেতরে এসে তাজদারের নিস্তেজ শরীরে পড়ছে। রওশনআরা ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে শান্ত থাকতে পারছেন না। শাইনা তিতলিকে ফোন করে বলেছে পৌঁছে একবার ফোন করতে। তিতলির মনেই নেই সেইসব। সে মায়ের সাথে সাথে আছে। তাসনুভাও তৌসিফ আর শাওনের সাথে ছোটাছুটি করছে। দুপুরেই তার কয়েকটা বন্ধু বান্ধব এসেছে খাবার দাবার নিয়ে। কিছু খাওয়া হয়েছে। কিছু এখনো টিফিন ক্যারিয়ারে পড়ে আছে।

ঢাকার গুলশান-২ এলাকার রোড ৭১-এ তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর ফ্ল্যাট। হাসপাতালের বাইরে টানটান উদ্বেগে রাত কাটানো সহজ হচ্ছিল না, তাই সবাইকে ওখানে পাঠিয়ে দিল রায়হান।
ফ্ল্যাটে পৌঁছে কারো মুখে কোনো কথা নেই। তিতলি জানালার কাছে বসে থাকল। সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলেই বুকটা ধক করে উঠছে। তাসনুভা খালি পায়চারি করছে এদিক-ওদিক, মাঝে মাঝেই ফোনে হাসপাতালের আপডেট নিচ্ছে।
তন্মধ্যে শাইনা ফোন করলো। সে একটু তাজদার সিদ্দিকীকে দেখতে চাইছে। কিন্তু তিতলি বললো তারা বাসায়। শাইনার মন খারাপ হলো। ভাইয়াদের ফোনে কল যাচ্ছেই না। সম্ভবত তাদের ফোনে চার্জ নেই।
তৌসিফ আর শাওন বাসায় এল রাত বারোটার দিকে। তাসনুভা রান্না বান্না করে রেখেছে তিতলিকে সাথে নিয়ে। রান্না খারাপ হয়নি। কিন্তু আনিস ঝাল কম খায়। তার জন্য রান্নায় বেশি তেল মরিচ ব্যবহার করতে পারেন না শাহিদা বেগম।

হাসপাতালে রাতের ভাত নিয়ে গিয়েছে তৌসিফ। শাওন বাসায় ঘুমিয়ে পড়েছে। সে এত ধকল আর নিতে পারছেনা।
আনিসের ঝাল খেতে কষ্ট হওয়ায় রায়হান ফোন করে তাসনুভাকে একদফা বকে নিয়েছে। এতবড় মেয়ে এখনো ভালো করে রান্নাটা শিখলো না। তাসনুভা বকুনি খেয়ে রাগে ফুঁসছে। তিতলিকে বলল, আমার হাতের রান্না খেতে পেরেছে সেটা আনিসুজ্জামান সিদ্দিকীর সৌভাগ্য। ঝাল খেতে পারেনা। ঢঙ! ভাইবোন সবকটা যত ঢঙ করতে জানে। জঘন্য!
তিতলি ঘুম ঘুম চোখে বলল,”এখানে আবার শাইনাকে ডাকছো কেন?”
তাসনুভা তাকে ধমকে বলল,”জাস্ট শাটআপ! কাল সব রান্নায় আরও বেশি করে মরিচ দেব। বকা যা খাওয়ার খেয়ে নিয়েছি। দরকার পড়লে আরও খাব কিন্তু আনিসুজ্জামানের ঢঙ গুছিয়ে দেব। ন্যাকা! ঝাল খেতে পারেনা।
রাতে শাইনা গোসল নেওয়ায় গায়ে হালকা জ্বর এসেছে। শীতে সে কাঁপছিল দাদীমা এসে জড়িয়ে ধরতেই শান্ত হয়ে এল। দাদীমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

“ব্যাটা এত সহজে তোকে ছাড়বে না। আবার আসবে দেখিস। জাপটে জড়িয়ে ধরবে তখন আমার সোহাগীরে। ”
শাইনা ফোঁপানি আটকে রেখে জানতে চাইল,”তোমার সাথে দাদাভাইয়ের স্বভাব চরিত্র কতটুকু মিল ছিল?”
“একটুও না। ওই বুড়ো তো মরার আগের দিনও আমার সাথে ঝগড়া করেছে জোর করে ঔষধ খাইয়েছিলাম বলে। সে কি গালি! আমি অন্যসময় হাসতাম। ওইদিন গালি শুনেও হেসেছি। মধুর মতো লেগেছিল গালিটুকু। কারণ আমি তো জানতাম ওই লোকটা আমার কাছে আর বেশিদিন নেই। তখন চাইলে এই গালিটুকুও শুনতে পারব না।”
শাইনা কন্ঠরুদ্ধ! ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চাইল,
“তোমাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?”
“মাগো মা, সে কি মহব্বত ছিল আমাদের মধ্যে। জামাইয়ের সাথে ঝগড়া তো হবেই। তাই বলে মহব্বত কোনোদিন কমেনি।”

“তোমার এখন কষ্ট হয় না? মনে পড়েনা দাদাভাইকে?”
“পড়ে, কিন্তু মানুষ চলে গেলে আর ফিরে তো আসেনা। কতবার মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে কেঁদেছি। দুনিয়ায় এত এত মানুষ। ওই মানুষটা কোথাও নেই। তোর দাদা তো বুড়ো হয়ে মরেনাই। আমি মজা করেই বুড়ো ডাকতাম। পঞ্চান্ন বছর বয়সে মারা গেছে। শক্তসমর্থ ছিল তখনো। হুট করে রোগ দেখা দিল। তারপর আর বেশিদিন সময় নেয়নি। কথা বলতে বলতে মরে গেছে।”
শাইনা নীরব হয়ে গেল। দাদীমা বললেন,”ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?”
শাইনার বুক ভার হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে একটা পাথর উঠে বসেছে বুকের উপর।
দাদীমা তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ছোটবেলার মতো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”তোর বুড়ো এত সহজে তোকে ছাড়বে না। ডাক্তারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফিরে আসবে। আরও কত মারামারি, ফাটাফাটি বাকি। একবছরও তো যায়নি এখনো। সংসার কি এত সহজ রে?”

ফজরের নামাজের মোনাজাত শেষ করে শাইনা ধীরে ধীরে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো।
ভোরের কাক ডাকছে, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে। বাইরে শীতল হাওয়ার স্পর্শ তার গালে এসে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর সূর্যের আলো ধীরে ধীরে প্রকৃতিকে জাগিয়ে তুললো।
শাইনা ফোনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তিতলির ফোন না পেয়ে নিজেই ফোন দিল। তিতলি রিসিভ করলো না। বোধহয় এখনো ঘুম ভাঙেনি। কাল রাতে ওদের উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে।
বেলা গড়ালো। প্রায় দেড়টার দিকে তিতলি ফোন করল। ভিডিও কলে হঠাৎ তাজদার সিদ্দিকীর চেহারা দেখা গেল। কল রিসিভ হতেই তাজদার সিদ্দিকীকে দেখামাত্রই শাইনার শরীরটা সামান্য কেঁপে উঠল। তাজদার সিদ্দিকীর নির্জীব মুখমণ্ডল, নিঃশব্দে ওভাবে শুয়ে থাকা শাইনা মানতে পারছে না।

আজ সত্যিটা স্বীকার করতে বাধা নেই ছোটবেলায় তাজদার সিদ্দিকী যখন তাদের সঙ্গে এমন বাজে আচরণ করতো তখন সে মনে মনে তাকে অভিশাপ দিয়েছিল। অথচ আজ সেই একই মানুষটার জন্য সে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে কেঁদেছে, চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে প্রার্থনা করছে। শাপমোচন না হয়ে যাবে কোথায়? তার অভিশাপে উপরওয়ালা সেদিন তাজদার সিদ্দিকীর উপর রুষ্ট হয়েছেন কি হননি শাইনা জানেনা। কিন্তু আজ তার প্রার্থনায় তিনি অবশ্যই খুশি হবেন।
ফোনের ওপাশে তাসনুভার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
“ওকে ওখানে বসে বসে ঢঙ করতে বারণ করো।”
আনিসের কণ্ঠস্বরও শোনা গেল হঠাৎ।
“তোমার কথা শুনলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে।”

তাসনুভা রাগে ফোঁসফোঁস করে বলল,”এই যে আপনাকেই খুঁজছি। আপনার জন্য ভাইয়া আমাকে কাল…
তৌসিফ এসে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,”তোর জন্য মেঝ ভাইই ঠিক আছে। তোর মতো বেয়াদবকে ওই শায়েস্তা করতে পারে।”
“আচ্ছা? সেবাশুশ্রূষা করছি বকুনি খাওয়ার জন্য? শোনো আমার ভাই আমাকে বকুনি দিক আর যাই দিক তাতে এই বাইরের লোকেদের কি?”
তৌসিফ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আনিস বলল,
“তুমি একটা কাজ করো। বাসায় চলে যাও। নইলে আমি একটা কাজ করতে পারি। তোমাকে এখানে এডমিট করিয়ে দিই। তোমার চিকিৎসা প্রয়োজন।”
তিতলি ফোনটা নিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। শাইনার চোখমুখ দেখে তার কষ্ট হলো। বলল,
“ভাইয়াকে দেখেছ?”

শাইনা দেখেছে তবুও বললো,”ভালো করে দেখিনি।”
তিতলি আবারও ব্যাক ক্যামেরা অন করলো। শাইনার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল দাদীমা। বাইরে নিয়ে গিয়ে তাজদারের দাদীমাকে ডাকলো। শাহিদা বেগমকে ডাকলো,
“দেখো দেখো লন্ডনওয়ালাকে দেখো। এভাবে চুপচাপ শুয়ে থাকলে মানায় ব্যাটাকে? আহা আহা দুইদিনের মধ্যেই কেমন চুপসে গেছে!”
আনোয়ারা বেগম নাতিকে দেখে চুপ হয়ে গেছেন। তার ভাইটার উপর কত ঝড় যাচ্ছে। নইলে সে তো চুপ করে শুয়ে থাকার মতো ছেলে নয়। সবাই একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাজদার সিদ্দিকীকে দেখছে। একেকজন একেক মন্তব্য করছে।

শাইনা সবার পেছনে দাঁড়িয়ে ফাঁকফোকর দিয়ে তাজদার সিদ্দিকীকে দেখলো। তার কৌতূহলী মন প্রশ্ন করলো, ওই চোখদুটো যখন খুলবে তখন কি একটিবার শাইনা মমতাজকে দেখতে চাইবে?
আনোয়ারা বেগম শাইনাকে নিয়ে যেতে চাইলো। শাহিদা বেগম বললেন, ওই ঘরে গেলে ওর আরও কষ্ট হবে বড়ো মা। জামাই আসুক। একসাথে যাবে।
আনোয়ারা বেগম তাই আর কিছু বলেননি। কথাটা মিথ্যে নয়।
যদিও পরে ওই বাড়ির সব মানুষই একে একে ঢাকায় চলে গিয়েছে। কিন্তু শাইনাকে নিয়ে যাওয়ার কথা কেউ বলেনি।

শাহিদা বেগম আশ্চর্য হয়ে গেছেন। ওই বাড়িতে যেতে দেয়নি বলে গোটা পরিবার ঢাকায় চলে যাওয়ার সময় বউটাকে নিয়ে যাবে না? একবার বলবে অন্তত। তার মেয়েটাকে তো পরই করে রাখলো।
এটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। পরে জানা গেল রওশনআরা, তাজউদ্দীন সিদ্দিকী চাননি শাইনা সেখানে যাক। কারণ শাইনার খাওয়া দাওয়ায় এত অনীহা বেড়ে গেছে যে তাকে তিনবেলা এত যত্ন করে, তোষামোদি করে খাওয়ানোর মানুষ ওখানে নেই।
তারউপর তাদের ছেলে প্রাণেপণে লড়ছে হাসপাতালের বেডে।
কথাগুলো শুনে শাহিদা বেগম, আফসার সাহেব খুব খেপে গিয়েছিলেন। পরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে চুপ হয়ে গিয়েছেন। তাদের একটা বললে, বুঝে বসে অন্যটা।
আনিস অবশ্য বললো, ওরা না চাইলে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। ও তাজের সেবা করতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরে ওকেই সবাই কথা শোনাবে। আরও অশান্তি বাড়বে। তারচেয়ে ভালো ওদের ছেলেকে ওরা সুস্থ করুক। আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে থাকুক।
শাহিদা বেগম তখন বললেন,”এ কেমন কথা আনিস? জামাইয়ের এমন দিনে বউকেই তো পাশে লাগে। ওরা মেয়েটাকে নিয়ে গেল না এ তো ভারী অন্যায় হলো।”

কয়েকটা মাস পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
শীত চলে এসেছে প্রায়। এবারের শুরুর দিকে শীত এতটা প্রখর। মাঝামাঝিতে কি হবে ভেবেই কূল পাচ্ছে না সবাই।
দাদীমা মাজেদা বেগম পুকুর থেকে গোসল করে এসে উঠোনে এসে মোড়া নিয়ে বসলেন। পুকুরের পানি অতিরিক্ত ঠান্ডা। ঠকঠক করে কাঁপছেন তিনি।
কাঁপতে কাঁপতে মেঝ ছেলে আর ছোট ছেলের বউদের বকছেন। তাদের মুরগীগুলোর নখ কেন কেটে দেয় না? বকবক করছেন এই বলে,
“দেখো তো কান্ড! মাটিতে কুঁড়ে ফেলছে যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে।”
একটা চিকনমতো লাঠি নিয়ে বসেছেন তিনি। মুরগী দেখলেই সেটা নেড়ে তাড়াচ্ছেন। এই উঠোন তিনি দিনের মধ্যে চার পাঁচবার ঝাড়ু দেন। শাহিদা বেগম বারণ করলেও শোনেন না। পিঠ কুঁজো হয়ে যাচ্ছে তবুও বাড়তি কাজ করার স্বভাব যায় না।

সাবরিন একটা বালতি এনে উঠোনে থামলো। আজ তার শ্বাশুড়ি ধোয়ামোছা করেছে। ছাদ ভর্তি হয়ে গেছে কাপড়ে। উঠোনেই শুকোতো দিতে হবে।
দিনটা শুক্রবার। শাওন, আনিস, আশরাফ সবাই জুমার নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুক্রবারে বাড়িভর্তি লোকজন থাকে। চাকুরীজীবি মানুষজন বাড়িতে থাকে। তাই সবাই মিলে পুকুরে গোসল করে। তারা তিন ভাই গোসল করে এসে রশিতে ভেজা কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। শাইনাকে ডেকে আতর খুঁজছে, কেউ টুপি খুঁজছে, কেউ লোশন আর ভেসলিন খুঁজছে, কেউ চিরুনি খুঁজছে।
শাহিদা বেগম তা শুনে ছেলেদের বকছেন।

“বিয়ে দিয়ে ফেলেছিস তারপরও ওকে খাটাচ্ছিস বাপছেলেরা মিলে।”
সাবরিনা হাসছে শ্বাশুড়ির কথা শুনে। সে কাপড় শুকোতে না দিয়ে চলে এসেছে। ফ্রিজ থেকে পায়েস বের করেছে। জুমার নামাজে যাওয়ার আগে সবাই হালকা মিষ্টি খায়।
শাইনা সবার জিনিস খুঁজে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। গায়ে একটা সাদা সেলোয়ার-কামিজ। চুল থেকে তোয়ালে খুলতে খুলতে দাদীমাকে ডাকলো,
“কোথায় তুমি? তেল রোদে রেখেছি। গলে গেছে। এখন মাখবে নাকি পরে?”
দাদীমা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকে ডাকলেন,”মাথায় কাপড় দিয়ে এদিকে আয় তো। তোর মা সুঁই কিনতে চেয়েছে। এই ব্যাটা সুঁই এনেছে।”

শাইনা কাঁধ থেকে ওড়নাটা নিয়ে মাথায় তুললো। কয়েক পা হেঁটে সামনে যেতেই দেখলো একটা ফেরিওয়ালা।
দাদীমা তাকে ডাকলেন। শাইনা নিজেকে ঢেকেঢুকে গেল দাদীমার পেছনে। দাদীমা সুঁই-সুতোগুলো নিয়ে শাইনাকে দেখালো। শাইনা সুঁই সুতো দেখা শেষে বলল,
“কত টাকা?”
“চুল দেন আপা।”
“চুল নেই। কত টাকা বলেন।”
দাদীমা হেসে উঠে ফেরিওয়ালাকে বলল,”লন্ডনওয়ালার বউ। টাকা বেশি করে চেয়ে নাও।”
শাইনা চোখ গরম করে তাকালো। দাদীমা হাসছেন। শাইনা দাদীমাকে হাসতে দেখে ফেরিওয়ালাকে বলল,
“এই বুড়ির পাকা চুল আছে অনেক। ওগুলো হবে?”
দাদীমার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর সেই ঠোঁটে আবারও হাসি ফুটলো যখন দেখলো সিদ্দিক বাড়ির মূল রাস্তা ধরে একটা কালো মতো কার এসে থামলো উঠোনে এসে। পরপর আরো দুটো গাড়ি এসে থামলো তার পেছনে।

তাজমহল পর্ব ৪৮

শাহিদা বেগম পেছন থেকে হায়হায় করে উঠলেন,
“তুই এই অবস্থায় ওখানে কেন গিয়েছিস শানু? তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসছে আজ।”

অর্ধসমাপ্ত
২য় খন্ড খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here