বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৫
ইশরাত জাহান
পরদিন সকালে শামীম কল দিয়ে জানালো তারা সাতটায় এসে বাসায় পৌঁছেছে।তাই যেনো দুপুরের ভাত এসে খায়।দাদাজান সোফায় বসে আছেন।শোভা ব্যাগে নিজের জন্য দুটো জামা নিলো।কালকেই তার জন্য ব্যাগ কেনা হয়।শোভাকে দেখে দাদাজান বলেন,“কালকে সকাল সকল চলে এসো কেমন?তোমার ছোট ভাইটার জন্য মেয়ে দেখতে যাবো।”
দর্শন কপাল কুঁচকে বলে,“আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম।”
শোভা এসে দিজা ও পারুল বেগমকে জড়িয়ে বলে,“আমি আসছি।ভালো থেকো তোমরা।”
দুজনেই বিদায় দিলো।দাদাজানের উদ্দেশে বলে,“আসি দাদাজান, আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
তিনদিন পর নিজের বাড়িতে এলো শোভা তাও যেনো কতগুলো মাস কতগুলো বছর পর এলো।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল শামীম ও মৌলি।এদের বাপ আর মেয়েকে শত বলেও মিতু ঘরে আনতে পারেনি।এই বিশ্রী গরমে কেন যে থাকতে হবে ওখানে বুঝতে পারছে না।জোরে গলায় বলে,“নিজের কালা শরীর নাহয় রোদে কালা বানাও।মেয়েটারে কেন কালা বানাও?পরে তো মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে পাবা না।”
শোভা গাড়ি থেকে নেমে মিতুর কন্ঠ শুনে হেসে দেয়।দরজার কাছে এসে শামীমকে সালাম দিল,“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া”
শামীম উত্তর দেয়,“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
তারপর আবার দর্শনকে সালাম দিল শামীম।দর্শন সালামের উত্তর দেয়।মৌলি এসে ঝাপিয়ে পড়ে শোভার কোলে।শোভার দিকে চেয়ে বলে,“তুমি নাকি ততুল বালি গেতো?”
শোভা একগাল হাসি দিয়ে ভিতরে ঢুকে কালো নিকাব উঠালো মুখ থেকে।গরম লাগছে বেশ।চৌকিতে বসতে নিবে মৌলি আবারও বলে,“বতবে না খুব গলম।পাতু গলম হয়ে যায়।”
মিতু এসে মৌলির পিঠে চাপড় মেরে বলে, “স আর র উচ্চারণ করতে পারিস।তাহলে ঠিকভাবে কথা বলিস না কেন?নতুন ফুফা তোকে তোতলা বলবে।”
মৌলির পিঠে হাত বুলিয়ে শোভা বলে,“বাচ্চা মানুষ সময় লাগবে তো।”
শামীম বড় দরজা খুলে দিলো।দর্শন গাড়ি ঢুকিয়ে নিতেই শামীম আবার লাগিয়ে দিল।মিতু গায়ের ওড়না আগেই ঠিকভাবে রেখেছে।মৌলি এতবড় গাড়ি দেখে বলে,“তুমি এত বলো গালিতে তিলে!”
মিতু কপাল চাপড়িয়ে চলে যায় নাস্তাগুলো নিয়ে আসার জন্যে।সব রেডি আছে শুধু সামনে প্রবেশ করা লাগবে।শোভা হেসে দেয় মিতুর হাহাকার দেখে।এটা নিত্যদিনের কাজ ওদের।মৌলির কান টিপে ধরে সঠিকভাবে কথা বলা শিখিয়ে দেয় মিতু।শোভা আর শামীমের জন্য পারেনা বেশি।এরা শাসন করতেই দেয়না।দিনদিন শামীমের প্রধান কাজ হয়েছে বাড়িতে এসেই মৌলির কাছে নালিশ শোনা।অবশ্য এতে লাভের লাভ কোনোটাই মৌলির হয়নি।বরং মিতুর চোখ গরমে শামীমের দম ফুরিয়ে যায়।দর্শন গাড়ি একপাশে করে ওদের সামনে আসে।শামীম চলে গেলো মিতুর কাজে সাহায্য করতে।শোভা সামনে এগোতে থাকে নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য।নিজ ঘরে ঢুকেই শোভার গায়ে গরম উত্তাপ অনুভব হলো।
টিনের ঘরের চালে দুপুরের রোদে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।ঘরের ভেতরটা অন্ধকার কিন্তু গরমে যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দর্শন একটু বিরক্ত হলো।তার মুখ গম্ভীর।শোভা দরজাটা খুলেই বলল,“ভেতরে আসবেন তো?না বাইরে দাঁড়িয়ে রোদে গলে যাবেন?”
দর্শন চোখ কুঁচকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে পা রাখল।শোভা একটা কাঠের টুল টেনে দিয়ে বলল,“এইটাতেই বসেন।আরাম নাই তাই বলে দাঁড়িয়ে থাকবেন না যেন।”
দর্শনের ভুরু কুঁচকে গেল।
“তোমার কথায় তীক্ষ্ণতা কমানো যায় না?”
শোভা হালকা হাসল,“আপনার সহ্যশক্তি বাড়ানো যায় না?”
দর্শন মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল।বাইরে ছোট একটা গাছের ডালে দোয়েল বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ।তারপর বলল,“তোমার এখানে কষ্ট হয় না?”
শোভা একটু চমকে তাকাল।প্রথমবার দর্শনের কণ্ঠে যেন একটুও অহংকার নেই।শান্ত এবং ক্লান্ত একটা স্বর।সে ধীরে বলল,“এই কষ্টই তো আমার অভ্যাস।আর অভ্যাসে কষ্ট কেমন হয় জানেন?”
দর্শন কিছু বলল না।ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল।পুরনো পর্দা একটা ছোট খাট,পড়ার টেবিল,কোণায় থালা বাসনের তাক, উপরে বিশ্রী শব্দ করে ঘুরতে থাকা ফ্যান।টিনের ঘরের গায়ে বাতাসে মাঝে মাঝে শব্দ হয়।দর্শন কিছু ভেবে বলে,“তুমি এই ঘরটায় থাকো কেন?আন্টি যে ঘরে ছিল ওই ঘর তো ফাঁকা।”
“মা মারা যাওয়ার পর ওই ঘরটা যে আমার ঘর ছিল এটা ভাবনায় আসেনি।এই ঘরে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ পাই।যদিও এটা আমার ভ্রম কিন্তু মনের শান্তি।শান্তি মেটাতেই মায়ের আগের ঘরটা আমি দখল করেছি।”
শোভার কন্ঠ নরম চোখটা স্থির বাইরের দিকে।জানালার পর্দাগুলো পুরোপুরি মেলে দিতেই আলোর দেখা।বাতাস আসতে পারল না কারণ এদিকটা দখিনা বাতাস আজও আসেনা।বাইরে অন্যদিকে বাতাস আসে এটা বোঝ যায় শুধু।শোভা ম্লান হাসলো।আনমনেই বলে,“আমাদের প্রথম দেখা না না প্রথম কথা হয়েছিল এই ঘরটিতে।ভীতু আমিটা তখন এই ঘরে থেকে পড়াশোনা করতাম।আমার ঘরটা নিয়েছিল আম্মু।শুধুমাত্র ঘরের দখিনা বাতাস বইতো না বলে।আর দেখুন আমাদের ভাগ্য!আমাদের উছিলা দিয়ে মিলিয়ে দিলো।”
দর্শন চেয়ে রইলো শোভার শুকনো ভাবলেশহীন মুখের দিকে।মেয়েটা অনেক সাহসী হয়েছে।আগের মত ভয় পায়না।দর্শন বলে ওঠে,“বোরকা খুলবে না নাকি এই গরমেও তোমার শীত লাগছে?”
শোভা মাথা নাড়িয়ে বলে,“হুমমম খুলবো।”
বলেই ব্যাগ থেকে ওড়না নিয়ে বোরকা খুলে মাথায় ওড়না নিলো।শামীম ও মিতু নাশতা নিয়ে এলো।শোভার ঘরের বিছানায় আলাদা কাপড় বিছিয়ে নাশতাগুলো সাজিয়ে রাখলো শামীম।মিতু বলে,“গরম অনেক পড়েছে তাই চা বানাইনি।ভাইজান কি চা নিবেন?”
দর্শন নাশতার দিকে চোখ রাখলো।শরবতের গ্লাস দেখা যাচ্ছে আবার দুইটি জগ আনা। একটাতে শরবত আরেকটাতে পানি।হরেক রকমের নাশতার ব্যবস্থা করা।দর্শন সবকিছু দেখে নিজের মাঝে জামাই জামাই ভাব অনুভব করে।গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,“এতকিছুর প্রয়োজন নেই।আমি এমনিতেও এগুলো খাবো না।”
শোভা মুখ ভেংচালো দেখে ফেলে দর্শন।ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইল সে।এগিয়ে এসে শোভা একটি গ্লাস নিয়ে শরবত ঢকঢক করে গিলে মৌলিকে ডেকে বলে,“পিপি তুমি খাবে?”
মৌলি হলো আস্ত এক ছুঁচো।সে তো খাবারের অফার পেয়েই দিলো দৌড়।শোভার পাশ থেকে আঙুর নিয়ে গোপগোপ করে গালে পুড়ে নিলো।শামীম ভেবলার মত চেয়ে আছে।বোন জামাইয়ের সামনে সম্মান গেলো।মিতু কপালে হাত দিয়ে ইশারা করে কিন্তু কেউ দেখে না।কালো মিষ্টি নিয়ে মুখে ভরলো মৌলি।ওমনি মিতু পাশ থেকে ঘুতা দিলো শামীমকে,“মেয়েকে কোলে করে নিয়ে আসো নাহলে সব শেষ করে দিবে।”
শামীম ছুটে মৌলিকে কোলে নিয়ে বলে,“এগুলো তোমার ফুফার।”
“সমস্যা নেই বাচ্চা মানুষ ও খাক।”
শামীম মৌলিকে নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসলো দর্শনের কাছে।মিষ্টির বাটি এগিয়ে নিয়ে এসে বলে,“একটু মুখে দিন ভাইজান।ভালো লাগবে আমাদের।”
শামীমের হাস্যোজ্বল মুখ দেখে দর্শন নিলো।শোভা দেখে মুচকি একটা হাসি দিল।এই হাসি দেখে দর্শনের মুখের মিষ্টি গেলা আর হলো না।মুখেই পুরে রেখে শোভার হাসি দেখছে।মেয়েটার হাসিটা খুব সুন্দর।দর্শনের নজর ফেরানো দায়।ক্ষণিকের জন্য মনে হলো সে হিরে পেয়েছে।যার মাঝে আছে মনোমুগ্ধকর।
দর্শনের হুশ ফিরল শামীমের কথায়।শামীম বলে,“দুপুরের খাবার এখন দিবো কি?”
“না,একটু পর।নামাজ পড়ে আসি।”
শামীম খুশি হয়ে বলে,“চলেন তাইলে দুজনে একসাথে যাই।”
দর্শন উঠে দাড়ালো।শোভার দিকে একটু তাকাতেই শোভা ব্যাগ থেকে টুপি বের করে দিলো।দর্শন মাথায় দিতেই শামীম খুশিমুখে নিজের ঘরে গিয়ে টুপি নিয়ে বাইরে আসে।দেখে দর্শন ওযু করতে গেছে।শামীম মনে মনে বলে,“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ।”
দর্শন বের হতেই বলে,“চলেন তাইলে আমার ওযু আছে।”
দুজনে বের হলে মিতু বড় দরজাটা ভিতর দিয়ে ছিটকিনি দিয়ে দেয়।ভিতরে এসে বলে,“তুমি তাইলে নামাজ পড়ে নেও।আমিও নামাজ পড়ে আসি।”
শোভা রাজি হয়ে ওযু করে নামাজ পড়তে বসবে,ছোট্ট মৌলি সেও মাথায় এলোমেলো করে ওড়না দিয়ে ওর জন্য কেনা ছোট জায়নামাজ নিয়ে এলো।শোভা দেখে মিষ্টি একটা বাচ্চা মেয়ে নামাজের জন্য মাথায় ওড়না দিয়েছে কিন্তু ওড়নাটা খুলে যাচ্ছে।শোভা সুন্দরকরে ওড়না পরিয়ে দিলো।দুজনে পাশাপাশি জায়নামাজ বিছিয়ে একসাথে নামাজ পড়তে থাকে।শোভা যখন হাত উচু করে মৌলিও তাই করে।শোভা হাত বুকে নিলে মৌলিও নেয়।শোভা হাঁটুতে হাত দিয়ে রুকু দিতে নিলে মৌলি ঠিক তাই করে।এক কথায় শোভা যখন যা করে মৌলি হুবহু তাই করতে চায়।কিন্তু বেচারি শোভার সাথে তাল মিলিয়ে কোনো সুরা পড়তে পারেনা।কারণ সে তো শুধু আলিফ বা তা ছা এগুলো আর ঘুমানোর আগে দোয়া শিখেছে।আমাদের মৌলি নামাজে এখন ভুলভাল পড়ে।এই যেমন সে সুরা পারেনা কিন্তু পড়ছে মায়ের থেকে শিখে রাখা কবিতা,
“আতা গাতে তোতা পাকি
দালিম গাতে মৌ
এত ডাকি তবু কতা
কও না কেন বউ?’’
ছোট বাচ্চা মৌলি একদিন শোভার কাছে বলেছিলো,“আমি এত বলো বলো তুলা পালি না।”
শোভা স্বাভাবিকভাবে বলেছিলো,“শিখতে হবে মা।তুমি এখন যেগুলো শিখেছো ওগুলোই পড়বে শুধু।আস্তে আস্তে আমি,আম্মু-আব্বু শিখিয়ে দিব।তুমি কোনো চিন্তা করো না।তোমার গুনাহ হবেনা বরং আল্লাহ খুশি হবে।”
শোভার থেকে এমন সাহসিকতা পেয়ে সরল মনে মৌলি এখন কবিতা বলে দেয়।তবে এই কবিতা একদিন মিতু শুনে কপাল চাপড়ে বলে, “তোরে আমি বলছি নামাজে কবিতা পড়তে?”
মৌলি চোখ পিটপিট করে বলে,“পিপি বলতে।”
শোভা অবাক হয়ে বলে,“আমি বুঝিয়েছি আলিফ বা তা এসবের কথা যেগুলো শিখেছে।ও বুঝলো পড়তে হবে কবিতা?”
“এর বাপ কে এটা দেখা লাগবে না!এরা বাপ মেয়ে দুটোই এক।বুঝাই এক বোঝে আরেক।আমার হয়েছে যত্ত জ্বালা।”
শোভা মুখ টিপে হাসে আর মিতু কাজ করতে থাকে।মৌলি গিয়ে ওর মায়ের গালে টুক করে চুমু দেয়।মিতুর রাগ সব উধাও হয় সাথে সাথে।
আজকেও নামাজ শেষ করে শোভা জিজ্ঞাসা করে,“কি কি সুরাহ পড়েছো?”
“একতাও না।”
“তাহলে?”
“আজকে পলেতি তিবু বনে তিবু মুহাম্মদ এলো লে দুনিয়ায়।”
শোভা নিজের কপালে হাত রাখলো।মৌলি প্রশ্ন ছুড়লো,“আজকেও ভুল পলেতি ?”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৪
শোভা মাথাটা উপর নিচ করতেই মৌলি কান্না করে দিবে এমন মুখ করে বলে,“আম্মু মালবে আজকেও।”
শোভা বুকে জড়িয়ে বলে,“না না মারবে না।আমার মৌলি সোনা তো চেষ্টা করে।”
মৌলি মিষ্টি একটা হাসি দেয়।বড় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসে।শোভা অতীত বুকে মৃদু হেসে বাইরে এসে দরজা খুলে দেয়।দর্শন আর শামীম এসেছে ভিতরে।শোভা আবারও ছিটকিনি দেয়।দর্শন ভিতরে ঢুকে মৌলিকে দেখে খুশি হয়।মেয়েটার ফর্সা মুখটায় কি সুন্দরকরে ওড়না দিয়ে রেখেছে।দেখতে পুরো পুতুলের মত লাগছে।দর্শন এভাবে তাকিয়ে আছে দেখে মৌলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।অচেনা কাউকে দেখলে মৌলি এমনটাই করে।চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়ায় কিন্তু খাবার দেখলে লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিক মুখে পুড়ে নেয়।