সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৬

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৬
Jannatul Firdaus Mithila

রৌদ্র নিজের রুমে এসে কাউচে গা এলিয়ে বসে। ফ্লোরে পড়ে থাকা ফাইলগুলো একেক করে গুছিয়ে হাতে নেয়।ফাইলের একাংশে চোখ বোলাতেই হঠাৎ অরিনের স্নিগ্ধ মুখশ্রীটি তার কল্পনার মানসপটে ভেসে ওঠে। রৌদ্র ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলে ফাইলগুলো সরিয়ে দেয়। তার যে আর ভালো লাগছে না কাজ করতে! রৌদ্র কাউচ থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।মিনিটখানেক পর পাশ হাতিয়ে মোবাইলটি খুজে হাতে নেয় সে।ফোনের লক খুলতে গিয়েও এক মুচকি হাসির দেখা মিলে তার চেহারায়। ফোনের লকটিও যে অরিনের নামে দেয়া।যদিও নাম্বারের সাহায্যে দেয়া, যা সহজেই কেও ধরতে পারবে না।

রৌদ্র ফোন ওপেন করেই চলে যায় গোপন একটি ফোল্ডারে। সেখানেও বরাবরের মতো পাসওয়ার্ড লক দেওয়া। রৌদ্র দক্ষতার সাথে সেটিকে আনলক করতেই তার সামনে ভেসে ওঠে এক মায়াবিনীর অসংখ্য হাস্যজ্জ্বল ছবি। রৌদ্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছবিগুলোর দিকে।হাত বাড়িয়ে আজকের তোলা একটি ছবি ওপেন করে সে।যেখানে দেখা যায় অরিনের মাথায় দেয়া সেই গোলাপ ফুলের ক্রাউনটি, গাল ফুলিয়ে বুকে দুহাত গুজে বা- দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র ছবিটি অরিনের অলক্ষ্যে তুলেছে।অরিনের এমন অসংখ্য ছবি সে যখন তখন গোপনে নিজের ক্যামেরাবন্দী করেছে।কোনো কোনো ছবিতে অষ্টাদশী গাল ফুলিয়ে তো কোনটায় আবার খিলখিল হাসিতে। রোজ রাতে এই ছবিগুলোর সাথে মনের হাজারো অব্যক্ত অনুরক্তি প্রকাশ না করলে রৌদ্রের চোখে যেন ঘুম আসা দায়! আজকেও যে তার ব্যাতিক্রম নয়! রৌদ্র অরিনের ছবির দিকে মোহগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে থেকে বলতে থাকে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— কি আছে তোর মাঝে সানশাইন! তোকে কাছে পেতে এতোটা ব্যাকুল লাগে কেনো নিজেকে? কিকরে সামলাই নিজেকে বলতো! তুই সামনে আসলেই ইচ্ছে করে তোকে নিজের খুব কাছে নিয়ে আসতে, খুব কাছে। এতোটা কাছে যতোটা কাছে আসলে তোর নিশ্বাসের প্রতিটি শব্দ আমার কর্ণগোচর হবে।
রৌদ্র কিছুটা থামে।চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে সে।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আবারও ফোনটি মুখের সামনে ধরে। এবার অরিনের ছবিটিকে দেখতে দেখতে তারওপর একটা-দুটাে পরপর কয়েকটা চুমু খায় সে। প্রায় কিছুক্ষণ পর থেমে গিয়ে ফোনটিকে বুকের ওপর চেপে ধরে রৌদ্র। হাতদুটোকে মাথার নিচে রেখে আয়েশ করে শুয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে ও। মুখে স্মিত হাসি টেনে বলে,

— সানশাইনরে! দেখ তুই কাছে না থাকায় আপাতত আমার কি হাল হয়েছে। রোজ তোর বদলে নিয়ম করে তোর ছবিগুলোকে চুমু খাই আমি। হাহ! কবে যে আস্ত সানশাইনটাকে পাবো! কথা দিচ্ছি, যেদিন তোকে পাবো সেদিন থেকে একটা মুহুর্তও তোকে চুমু ছাড়া রাখবো না।
নিজের এমন উদ্ভট কথায় নিজেই একমনে হেসে যাচ্ছে রৌদ্র। আবার পরক্ষণেই ভাবছে,” আচ্ছা! সানশাইন যদি এসব কথা শুনতো বা কখনো যদি জানতে পারতো ওকে নিয়ে আমি ঠিক কেমন চিন্তা -ভাবনা করি তাহলে ওর মুখভঙ্গি কেমন হতো? নিশ্চয়ই লজ্জায় মূর্ছা যেতো! ইশশ! তার যে এখন বড্ড ইচ্ছে করছে সেই লজ্জায় মূর্ছা যাওয়া চেহারাটি স্বচক্ষে অবলোকন করতে।”
রৌদ্র এসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গলায় সুর টানে।একমনে চোখ বন্ধ করে অরিনের মায়াবী মুখো আদলটি চিন্তা করে গাইতে শুরু করে।

আমার একলা আকাশ,
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ
চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
তুমি চোঁখ মেললেই ফুল
ফুটেছে আমার ছাঁদে এসে,
ভোরের শিশির ঠোট ছুঁয়ে
যায় তোমায় ভালবেসে,,
আমার একলা আকাশ
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।

আমার ক্লান্ত মন
ঘর খুঁজেছে যখন,
আমি চাইতাম
পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর,
আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম,,
তুমি কোথায় কতদূর?
আমার বেসুরে গীটার সুর বেঁধেছে,
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।।
আমার একলা আকাশ চাঁদ
চিনেছে তোমার হাসি হেসে,,
শুধু তোমায় ভালবেসে।।।

অলস মেঘলা মন
আমার আবছা ঘরের কোণ
চেয়ে রইতো, ছুঁতে চাইতো
তুমি আসবে আর কখন?
শ্রান্ত ঘুঘুর ডাক,
ধূলো মাখা বইয়ের তাক,,
যেনো বলছে, বলে চলছে
থাক অপেক্ষাতেই থাক
আমার একলা আকাশ থমকে
গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে,,,,,

গান গাওয়া শেষ করে রৌদ্র একটি কুশনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
— ভালোবাসি সানশাইন। খুব ভালোবাসি তোকে।
অতঃপর এসব বলতে বলতেই পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।

পরদিন ভোরে🌼
অরিন নামাজ পড়ে বাগানে এসেছে হাটতে। গতকাল রাতে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে বিধায় আজ এতো সকালে উঠতে পেরেছে। অরিন কিছুক্ষন হেটে বাগানের কাঠগোলাপ গাছটির সামনে এসে দাড়ায়। কেনো যেন তার খুব ইচ্ছে করছে এই ফুল কানে গুঁজতে।তাই যেই ভাবা সেই কাজ! সেখান থেকে দুটি ফুল ছিড়ে নিজের কানে গুজে নেয় সে। হুট করেই তার মনে আফসোস জন্মে –ইশশ! কেনো মোবাইলটা সাথে আনলো না! মোবাইলটা কাছে থাকলেও তো একটা সেলফি তুলতে পারতো,দেখতে পারতো নিজেকে এই মুহূর্তে কেমন লাগছে।
অরিনের এসব চিন্তাভাবনার মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় রাফিয়া বেগম। মেয়েকে দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করেন,

— কি ব্যাপার! আমার পরিটা এত সকালে এখানে যে!
অরিন তার মায়ের কন্ঠ পেয়ে হকচকিয়ে যায়। ভাবনার সুতো ছিড়ে বেরিয়ে আসে বর্তমানে। পেছন ফিরে দেখতে পায় মা আর বড়মাকে। রাফিয়া বেগম অরিনের এমন হকচকিয়ে যাওয়াতে ভ্রুকুচকায়।তিনি কিছু বলবেন তার আগেই অরিন বলে উঠে,
— গুড মর্নিং আম্মু। গুড মর্নিং বড়মা।আসলে গতকাল রাতে তারাতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম তাই আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
জুবাইদা বেগম অরিনের কথয় মৃদু হাসলেন।এগিয়ে এসে অরিনের থুতনিতে ধরে মুখটি উঁচিয়ে বললেন,

— বাহ! আমার অরি সোনাকে তো বেশ মিষ্টি লাগছে দেখতে। তা ছবি তুলেছিস?
অরিন তার বড়মার কথায় মুখ নামিয়ে নেয়। গাল ফুলিয়ে বলে,
— আর বলোনা বড়মা।নিচে এসেছি কিন্তু ফোনটা আনিনি।তাইতো একটা ছবিও তুলতে পারলাম না।
জুবাইদা বেগম অরিনের কথায় আবারও হাসলেন। অরিনকে একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
— আহারে! থাক মা মন খারাপ করিস না। তুই ওপরে গিয়ে নাহয় ছবি তুলে নিস কেমন!
অরিনও তার বড়মার কথায় সম্মতিসূচক মাথা ঝাকায়। অন্যদিকে রাফিয়া বেগম হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠে,

— হ্যা রে,অরি! তুই পায়েল কিনেছিস?
অরিন তার মায়ের কথায় ভড়কে যায়। ভরকে যাওয়া কন্ঠে বলে,
— মানে!
রাফিয়া বেগম অরিনের কাছে আসেন।স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগলেন,
— আসলে তোর আব্বু কয়েকদিন যাবত বলছিলেন তোকে নাকি পায়েল বানিয়ে দেবেন।কিন্তু কাজের চাপে যেতে পারছিলেন না।তাইতো তোর আব্বু রোদকে বলে দিয়েছিলো তোকে নিয়ে গিয়ে তাের পছন্দমত একজোড়া পায়েল বানিয়ে আনতে। এখন বল তুই এনেছিস পায়েল?
অরিন তার মায়ের কথায় যারপরনাই অবাক হয়।অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
— আব্বু বলেছিলো পায়েল আনতে?
রাফিয়া বেগম ভ্রুকুঞ্চন করে বললেন,

— হ্যা!কেন তুই আনিসনি?
অরিন তড়িঘড়ি করে মাথা ঝাকায়।পায়ের ওপর থেকে সালোয়ারটা কিছুটা উঁচিয়ে ধরে। অতপর স্বাভাবিকভাবে বলে,
— হ্যা, এনেছিতো এই দেখো।
রাফিয়া বেগম মেয়ের পায়ের দিকে তাকালেন। ফর্সা পায়ে পায়েলগুলো বেশ মানিয়েছে।মনে মনে কয়েকবার মাশাআল্লাহ বললেন তিনি। অপরদিকে জুবাইদা বেগম অরিনের পায়ের দিকে তাকিয়ে বেশ উৎফুল্লতার সহিত বললেন,
— মাশাআল্লাহ অরি! তোর পছন্দতো দারুণ। খুব সুন্দর হয়েছে পায়েলগুলো।বেশ মানিয়েছে তোকে।
অরিন তার বড়মার কথায় মৃদু হাসলো।মনে মনে বললো,

“ভালো তো হবেই বড়মা।তোমার ছেলের পছন্দ বলে কথা! তার পছন্দ কি আর খারাপ হতে পারে! ”
জুবাইদা বেগম আর রাফিয়া বেগম আরও কিছু টুকটাক কথা বলে চলে আসে সেখান থেকে। তাদের আবার সকালের আয়োজন সারতে হবে।ইতোমধ্যেই বাড়ির কর্তারা চলে এসেছে মর্নিং ওয়াক সেড়ে। অরিনও আর বাগানে না থেকে চলে আসে বাড়ির ভিতরে। ড্রয়িং রুমে বাবা-চাচাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে চলে যায়। অরিন নিজের রুমের দিকে যাবে এরই মাঝে রৌদ্রও নিজের রুম থেকে বের হয়।দুজনেরই একমুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়।সহসা অরিন চোখ নামিয়ে নেয়।মাথা নিচু করে ঠায় দাড়িয়ে রয় রৌদ্রের সামনে। একি! তার পাদু’টো মনে হচ্ছে কেমন বরফের মতো জমে গিয়েছে এখানে।মনে হচ্ছে এখান থেকে নড়বার এতোটুকু শক্তিও তার মাঝে নেই।অরিন হাসফাস করতে করতে সেখান থেকে সরে আসবার জন্য উদ্যত হতেই পেছন থেকে এক ভারিক্কি কন্ঠস্বর কানে আসে তার,

— কানের পিঠে কি দিয়েছিস এগুলো!
আবারও থমকে দাড়ায় অরিনের পদযুগল। মাথানিচু রেখেই জবাব দেয়,
— ইয়ে, মানে ফুল।
রৌদ্র নিঃশব্দে মুচকি হাসলো। পরক্ষণেই তা মিলিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— হ্যা,ফুল তাতো আমিও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এগুলো তুই গাছ থেকে ছিড়লি কেনো?
অরিন এবার আমতা আমতা করে। এখন কি জবাব দিবে সে! সে কি বলবে,যে আমার খুব ইচ্ছে করছিলো এগুলো কানের পিঠে গুঁজতে তাই ছিঁড়েছি।নাহ রোদ ভাইয়ের মুখের ওপর এসব কিভাবে বলবে সে। এও কি তার দ্বারা সম্ভব! অরিন কোনরকমে সাফাই দেওয়ার ন্যায় বলে উঠে,

— আসলে রোদ ভাই! এমনি ছিঁড়ে ফেলেছি।ভুল হয়ে গেছে আর কোনদিন ছিড়বো না হ্যা! আপনি বললে এক্ষুনি খুলে ফেলছি।
বলেই ফুলগুলোকে খুলে ফেলতে উদ্যত হতেই রৌদ্র তার হাতটি খপ করে ধরে ফেলে। রৌদ্রের এহেন কান্ডে অরিন ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকায়।
রৌদ্র মনে মনে বেশ মজা নেয় অরিনকে দেখে।অথচ বাহির থেকে একদম স্বাভাবিক সে।অতপর ভ্রুক্ষেপহীনভাবে অরিনের গালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো হাতের আঙুলের সাহায্যে কানের পিঠে গুজে দেয়। অরিন যেন রৌদ্রের আঙুলের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই মৃদু কেঁপে ওঠে। অরিন তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলে।রৌদ্র অরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

— সুন্দর লাগছে! এভাবেই নাহয় থাকুক।
কথাটি বলেই অরিনকে ছেড়ে দিয়ে গটগট পায়ে অরিনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যায় রৌদ্র। এদিকে অরিন এখনো হতবিহ্বল হয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে জায়গাটিতে। তার হাতপা এখনো কাঁপছে! এক মৃদু ঝংকার বয়ে যাচ্ছে সারাশরীরে। অষ্টাদশীর অবচেতন মনে এখনো বারংবার বেজেই চলেছে,
“রোদ ভাই সত্যি আমার প্রশংসা করেছে! আমি কি সবটা ঠিক শুনলাম! ”
অরিন নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে অথচ এখন কি আর তা সম্ভব!

অনিক কেবলই নাস্তা সেড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ির বাহিরে পা বাড়িয়েছে ওমনি পেছন থেকে তাশরিক সাহেব তাকে ডাক দেয়।অনিকও থেমে গিয়ে পেছন ফিরে।মুখে একটি মিষ্টি হাসি টেনে বলে,
— কি হয়েছে চাচ্চু! কিছু বলবে?
তাশরিক সাহেব অনিকের নিকটে এসে দাড়ায়। সে কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
— অনিক! আমার গাড়িতে একটা প্রবলেম হয়েছে। তুই কি আমাকে ভার্সিটিতে একটু ড্রপ করে দিতে পারবি।এখন রিকশার জন্য ওয়েট করলে বেশ লেট হয়ে যাবে কেননা আজকে আবার ক্লাসে এক্সাম নিবো তাই..
অনিক তাকে কথার মাঝে থামিয়ে দেয়। অত্যন্ত বিনম্রতার সহিত বলে,
— আরে এখানে বলার কি আছে! চলো উঠে পড়ো ড্রপ করে দিচ্ছি।
তাশরিক সাহেবও অনিকের কথায় মৃদু হাসলেন।হাতের ব্যাগটি নিয়ে উঠে বসেন গাড়িতে।অনিকও আর লেট না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

প্রায় ৩০ মিনিট পর ~~~
অনিক তাশরিক সাহেবের কলেজের সামনে গাড়ি থামায়। তাশরিক সাহেবও অনিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুটা ব্যস্তভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে চলে যান ভার্সিটির ভিতরে। অনিক তার চাচ্চুর চলে যাওয়ার পর গাড়ি ঘুরাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখ পড়ে পাশের সিটে।তাশরিক সাহেব তার ব্যাগ গাড়িতেই ফেলে গিয়েছেন। অনিক ভাবে– হয়তো ব্যস্ত থাকার দরুন ভুল করে ব্যাগটা এখানেই ফেলে গিয়েছে। অনিকও আর দেরি না করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গাড়ি থেকে। অনিক ভার্সিটির ভিতরে ঢুকে সোজা ক্যাম্পাসের দিকে হাটে।উদ্দেশ্য তাশরিক সাহেবের টিচার্স রুম।এর আগে বেশ কয়েকবার এখানে এসেছে অনিক তাইতো চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয় না তার।

ক্যাম্পাসের ৩য় তলার একেবারে কর্নার সাইডের রুমটিই টিচার্স রুম।অনিক লিফটের সামনে দাড়িয়ে দেখে আপাতত সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রচুর ভিড়।তাই সে লিফটের আশায় না থেকে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে। একতলা বেয়ে দোতলায় যেই না উঠতে যাবে ওমনি কেও একজন হুড়মুড়িয়ে তার গায়ের ওপরে পড়ে। অনিক তৎক্ষনাৎ নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে এক সিড়ি নিচে নেমে গিয়ে একহাত দিয়ে সিঁড়ির হাতল চেপে ধরে অন্যহাত দিয়ে আগন্তুককে আগলে ধরে। ইতোমধ্যেই তার হাত থেকে ব্যাগটিও নিচে পড়ে যায়। প্রায় মিনিট খানেকের মধ্যে আগন্তুক সাথে সাথে ছিটকে দূরে সরে দাড়ায়।অনিকও সোজা হয়ে দাড়ায়। পড়ে যাওয়া ব্যাগটি উঠিয়ে হাত দিয়ে ঝাড় দিতে দিতে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকায়।মুহুর্তেই অনিকের চোখ আটকে যায় সামনে দাড়ানো অপূর্ব সুন্দরীর দিকে।হলুদ ফর্সা মুখের আদল, ভীতসন্ত্রস্ত চাহনি, একটু পরপর যে কিনা নিজের ওপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরছে।টকটকে লাল ঠোঁট জোড়া যেন তাকে বড্ড ঘায়েল করছে।গরমে ঘেমে যাওয়া কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা।সেই সঙ্গে লেপটে আছে অসংখ্য ছোট ছোট চুল।রমনীকে দেখে এই মুহূর্তে যেন অনিকের চোখ ফেরানো দায়! হঠাৎ তার ঘোর ভাঙে কোন এক মিষ্টি সুমধুর কন্ঠস্বরে,

” এই-যে আপনি কি কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন? ”
মেয়েটির কথায় অনিকের হুশ ফিরে এতক্ষণে।আহ! কি ছিলো এই ডাকটায়! ওর কান দুটো যেন আবারও শুনতে মরিয়া হয়ে উঠছে এই মেয়েটির কন্ঠস্বর।অনিক কোনরকমে বললো,
— হু?
মেয়েটি অনিকের কথায় আবারও ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে। হাতে হাত কচলাতে কচলাতে বলে,
— আপনি কি ব্যাথা পেয়েছেন?
অনিক আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। আহা! কি সুন্দর,মিষ্টি কন্ঠ। এত ভালো লাগছে কেন ওর ডাকটা! অনিক নিজেকে ধাতস্থ করে।মেয়েটির আরও কিছু কথা শুনতে ইচ্ছে করছে তার।তাই সে মনে মনে দুষ্ট হেসে গলা হালকা খাঁকারি দিয়ে বললো,

— হ্যা। পেয়েছিতো ব্যাথা।
মেয়েটি অনিকের এহেন কথায় খানিকটা চিন্তিত হয়ে যায়। মৃদু কন্ঠে বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,
— কোথায় লেগেছে আপনার? খুব ব্যাথা পেয়েছেন? আমি সত্যি দুঃখীত।আমি আপনাকে মোটেও ইচ্ছে করে ব্যাথা দেইনি।আসলে তখন…
বলতে গিয়েই থেমে যায় মেয়েটি।কোন এক অজানা বিষয়ে হাসফাস করতে থাকে ও।সবটা অবশ্য অনিকের চক্ষু এড়ায়নি। অনিক বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। অনিক এবার নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে,
— আচ্ছা তখন এভাবে ছুটছিলে কেনো? আমি যদি না থাকতাম তাহলে তো ইতোমধ্যেই তোমার অনেক বড় এক্সিডেন্ট হতে পারতো।আমি কি জানতে পারি এমন করার কারনটা?
মেয়েটি যেন এবার আরো নিজেকে গুটিয়ে নেয়।আমতা আমতা করে বলতে থাকে,

— না আসলে তেমন কিছু না। আমি একটু তাড়াহুড়ায় ছিলাম তো তাই আরকি।
অনিক মেয়েটির কথায় ভ্রুকুটি করে তাকায় তার দিকে। অনিকের কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না মেয়েটির কথা।কেননা মেয়েটির মুখভঙ্গি একরকম কথা বলছে অথচ সে মুখে অন্যটা বলছে।অনিক ভ্রুকুটি করেই জিজ্ঞেস করে,
— আর ইউ শিওর?
মেয়েটি পরপর মাথা ঝাকায়। তড়িঘড়ি করে অনিককে সরি বলে তাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায় সে।অনিক এখনো মেয়েটির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“মেয়েটি এমন বিহেভ করছিলো কেন?”
অনিকের এমন ভাবনার মাঝে হঠাৎই তার মনে এক অদ্ভুত প্রশ্ন জাগলো,
” আচ্ছা আমি এই মেয়েটা কে নিয়ে এতোটা কৌতুহলী হচ্ছি কেন?হঠাৎ কি হলো আমার! ”
নিজের এমন ভাবনায় নিজেই অবাক হয় অনিক।অতপর আর কিছু না ভেবে চলে যায় তাশরিক সাহেবের কাছে।

আহিয়া আর মাহিয়া কলেজ ক্যাম্পাসের করিডোরে কথা বলতে বলতে হেটে যাচ্ছে। আজকে তাদের ক্লাস নেই।স্যার লিভে আছেন।তাইতো দুবোন এটা সেটা বলে সময় কাটাচ্ছে। কথার মাঝে হুট করে আহিয়া বলে উঠে,
— মাহি চল একটু সামনের শপিং মলটায় যাই।ওটাতো রিসেন্টলি ওপেন করেছে।আজকে যেহেতু বন্ধ আছে চলনা সেখান থেকে একটু ঘুরে আসি।
আহিয়ার কথায় মাহিয়া নিজের চশমা খুলে হাতে নেয়।অনীহা কন্ঠে বলে উঠে,
— নারে আহি।আমার মোটেও ইচ্ছে করছে না যেতে।এক কাজ করনা! তুই তিন্নি কে নিয়ে ঘুরে আয় সেই জায়গায়।আমি নাহয় ততক্ষণ লাইব্রেরিতে গিয়ে একটা বই পড়ি।
মাহিয়ার কথায় চোখ-মুখ কুচকায় আহিয়া।মুখভঙ্গিতে একরাশ বিরক্ততা এনে বলে,
— ওরে বিদ্যাসাগরের বড় ছেলের ঘরের মেজো মেয়ের ঘরের ছোট ছেলের সর্বকনিষ্ঠ হবু বউ,রাখ তোর পড়া।খালি সারাদিন এই পড়া পড়া ছাড়াও অনেক কিছু আছে লাইফে ওকে! চল আমার সাথে।
বলেই হাত ধরে টানতে থাকে আহিয়া।কিন্তু মাহিয়া বরাবরই নাকচ করছে আহিয়ার কথা।তাই শেষমেষ বিরক্ত হয়ে আহিয়া বলে উঠে,

— ওকে ফাইন।তোর যা ইচ্ছে কর।আমি যাচ্ছি বায়।
মাহিয়াও তাকে বায় বলে চলে যায় লাইব্রেরিতে।মাহিয়াদের কলেজ থেকে মাত্র মিনিট দুয়েকের দূরত্বে অবস্থান লাইব্রেরিটির।মাহিয়া লাইব্রেরিতে ঢুকে নিজের নাম এন্ট্রি করে চুপচাপ চলে যায় নিজের পছন্দের বইয়ের কর্নারে। মাহিয়া কয়েকটা উপন্যাসের বই হাতিয়ে নিজের কাঙ্খিত বইটি খুজতে থাকে।কিন্তু অনেক খুজেও সে কোথাও বইটি পায়না।তাই মাহিয়া অন্য একটি বই বের করে লম্বা গোল টেবিলের এক কর্নারে বসে পড়ে। মাহিয়া বেশ মনোযোগ সহকারে বইটি পড়ছিলো এমন সময়ে কেও একজন ফিসফিস করে তাকে ডেকে উঠে,

–এই যে মিস: শুনছেন।
মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় মাহিয়া ভ্রুকুটি করে সামনে তাকায়। দেখতে পায় চশমা পড়া একটি ছেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাহিয়াও তার মতোই ফিসফিস করে বলে,
— জি বলুন!
ছেলেটি মাহিয়ার কথায় চমৎকার হাসলো।মাহিয়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই হাসির দিকে।ছেলেটি আগের ন্যায় ফিসফিস করে বলে,
— আপনি আমাকে আপনার হাতের বইটি দিতে পারবেন প্লিজ।আসলে আমি এই বইটি না পেয়ে অন্যটি পড়ছি!
মাহিয়া অবাক হয় ছেলেটির কথায়।বইটিতো শেলফেই ছিলো তাহলে ছেলেটা কেনো বললো সে খুজে পায়নি! এখন আবার তার কাছ থেকে বইটি নিতে চাচ্ছে। এটা আবার কেমন কথা!
মাহিয়া চোখমুখ শক্ত করে বললো,
— দেখুন মিস্টার, আমি যেহেতু বইটি আগে নিয়েছি তাই এটা যতক্ষণ পড়া না হচ্ছে ততক্ষণ আপনাকে দিতে পারছি না।সরি!

ছেলেটি যেন নাছোড়বান্দা! সে আবারও মাহিয়াকে অনুনয় করতে থাকে বইটির জন্য। মাহিয়া এ পর্যায়ে প্রচুর বিরক্ত হয়।সে বইটি হাতে নিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছে যায়।বইটি কার্ডে এন্ট্রি করিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে মাহিয়া।করিডর ধরে হাটতে থাকে সে।পেছন থেকে আবারও কারো ডাকের শব্দ ভেসে আসে তার কানে।মাহিয়া এবার চোয়াল শক্ত করে পেছন ফিরে তাকায়।ছেলেটি দৌড়ে মাহিয়ার সামনাসামনি এসে দাড়ায়। ছেলেটি তার কাঁধের ব্যাগটিকে হালকা টেনে বলতে থাকে,
–মিস, আই নো আ’ম ইরেটেটিং ইউ।বাট আই রিয়েলি নিড দিস বুক।
মাহিয়া এবার আর চুপ থাকতে পারলো না।সামান্য বিরক্ত হয়ে বলতে লাগলো,
— দেখুন মিস্টার! আপনার যদি বইটা এতই প্রয়োজন তাহলে আগে নিলেন না কেন? বইটাতো শেলফেই ছিলো তাই না!
ছেলেটি যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিলো।সে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললো,

— মিস, আপনি ভুল ভাবছেন। আসলে আপনি যখন শেলফের কাছে দাড়িয়ে বই খুজছিলেন তখন-ই আমি লাইব্রেরিতে ঢুকি।আর বইটি আমার নেওয়ার আগেই আপনি হাতে নিয়ে নেন যার জন্য আমি তখন চাইলেও নিতে পারিনি। আসলে এই বইটির ক্লাইমেক্সের জন্য আমি যথেষ্ট উদগ্রীব ছিলাম তাই আপনাকে এতোটা বিরক্ত করেছি।এখন আর দরকার নেই আমার, আমি নাহয় আপনার পড়ার পড়ই পড়বো।আসছি এখন।আল্লাহ হাফেজ।
বলেই ছেলেটি আর পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।এদিকে মাহিয়া এখনও সেখানটায় দাড়িয়ে। ভাবছে,– সে কি একটু বেশিই কঠোর হয়ে গেলো? এমনিতেও এই বইটি তার পছন্দের ছিলো না।সে চাইলেই তো পারতো ছেলেটিকে বইটি দিয়ে দিতে,কিন্তু সে কি করলো! নিজের সো কলড ইগোর জন্য এতোটা কঠোর বিহেভ করলো! মাহিয়ার প্রচুর গিলটি ফিল হচ্ছে। সে আর কিছু না ভেবে একপ্রকার ছুটে যায় ছেলেটিকে খুজতে। লাইব্রেরীর সরু করিডর থেকে এদিক ওদিক দেখেও ছেলেটিকে কোথাও পায়না ও।তাই সে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে।তারাহুরো করে নামতে গিয়ে যেই না হোচট খেয়ে হুরমুড়িয়ে পড়তে নিবে ওমনি একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় মাহিয়া চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। বুকটা এখনো দুরুদুরু করে কাপছে মাহিয়ার।অর্ধেক ঝুলে থাকা অবস্থায় হুট করে তার কানে আসে একটি নিরেট কন্ঠস্বর,

— মিস,আর ইউ ওকে?
মাহিয়া তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে।নিজেকে এমন ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে সাথে সাথে সোজা হয়ে দাড়ায়। সামনে তাকিয়ে দেখে সেই লাইব্রেরির ছেলেটিকে।সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে লেপ্টে যায় একরাশ ইতস্ততা।মাহিয়ার কিছু বলার পূর্বে ছেলেটি আবারও চমৎকার হেসে প্রশ্ন করলো,
— মিস, আপনি কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন?
মাহিয়া সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।কালবিলম্ব না করে ব্যাগ থেকে উপন্যাসের বইটি বের করে ছেলেটির সামনে এগিয়ে দেয়।অতঃপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলতে থাকে,
— এই নিন আপনার বই।আপনি আগে পড়ুন তারপর আমাকে দিয়েন।
ছেলেটি মাহিয়ার কথায় চোখ সরু করে তার দিকে তাকায়।শীতল কন্ঠে বলে উঠে,
— কিন্তু আমিতো এখন চাচ্ছি না।আপনার বই আপনিই রাখুন।পড়া শেষ হলে আমায় দিয়েন।
মাহিয়ার শান্ত থাকা মেজাজটা মুহুর্তেই চটে যায়।এমনিতেই গিল্টিনেসের জন্য মনটা কেমন করছে তারওপর এই লোকের এমন ভদ্রতার বানী।মাহিয়া মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৫

— দেখুন আমার এই বইটা একদমই পছন্দের না।আমি জাস্ট টাইম পাসের জন্য নিয়েছিলাম। আপনার যেহেতু প্রয়োজন তাই আপনাকে দিচ্ছি।
বলেই ছেলেটিকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছেলেটির হাতে বইটি একপ্রকার জোর করে ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে গটগট পায়ে হেঁটে চলে আসে।
অপরদিকে মাহিয়ার চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছেলেটি মুচকি হাসে। মনে মনে বলে বসে,
— ইন্টারেস্টিং তো!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here