বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৯

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৯
ইশরাত জাহান

বিকালের দিকে প্যাকেটিংয়ের কাজ করছে শোভা ও দিজা।দিদার তো আনন্দে লুঙ্গি ছাড়া লুঙ্গি ড্যান্স দিচ্ছে। মানে কোর্ট প্যান্ট পরে আয়নার সামনে নাচতে শুরু করেছে। দাদাজান লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে এসে ছোট নাতির নাচ দেখে মৃদু হাসলেন।ঘরের মধ্যে ঢুকে বললেন,“কিছুদিন পর থেকে অনুমতি নিয়ে আসবো বলে আজকে বিনা অনুমতিতে এলাম।”
দিদার হেসে বলে,“সমস্যা নেই দাদাজান।”

“বিয়ের পর ঠিক সমস্যা হবে দেখে নিও।আমারও হয়েছিল।”
“তুমিও না।”
“লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই পুরুষ মানুষ সাহস থাকতে হয়।’’
দিদার মৃদু হাসলো।দাদাজান বলেন,“তোমাকে একটা কথা বলি।”
“বলো?”
“ভালোবাসার পূর্ণতা ঘটিয়ে দেওয়ার পর যেনো পরিবারের সাথে বিচ্ছেদের রূপ ধারণ করতে না দেখি।আজকাল ভালোবাসা বিয়ের আগেই সুন্দর।বিয়ের পর ওই ভালোবাসা পূর্ণতায় আসলে যেনো পারিবারিক বিচ্ছেদ তৈরি করে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দিদার কিছুটা হিমশিম খাওয়ার মত চাহনি দিলো।দাদাজান আশ্বস্ত করে দিদারের হাত ধরে বলেন,“সংসারের প্রথম যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওটা স্বামী স্ত্রীর তারপর সন্তান জন্ম দিয়েই হয় মা বাবার।হজরত আদম (আ) এর সাথে কিন্তু হজরত হাওয়া (আ) জীবনসঙ্গিনী হয়ে আসেন আগে তারপর টুকটুক করে বাবা মা ভাই বোন বাড়তে থাকে।আমি দাদাজান আছি আর কয়দিন!আল্লাহর ডাকে সাড়া দিলে তোমাদের জীবন নিজেদের মত হয়ে যাবে।তবুও আছি যে কয়দিন আছি তো।আমি চাই একতা বজায় রাখতে।আজকালকার মেয়ে ঘরোয়া কাজ কম পারে।এতে আমাদের সমস্যা নেই কিন্তু একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এতে আমাদের একটু শাসন করতেই হয়।তুমি দিজা দাদুমণিকে দেখেছো।বুঝেছো তো আমরা বাড়ির মেয়ে বউ আলাদা চোখে দেখিনা।দিজাও কিন্তু সকালবেলা উঠে রুটি বানাতে যায় প্রায় প্রায় থালাবাসন ধোয় আবার ঘর ঝারুও দেয়।এগুলো করতেই হবে ব্যাপারটা এমন না কিন্তু নিজের ঘর নিজের জীবন যেন গুছিয়ে চলতে পারে।আমি চাই আমার ছোট নাতবউ যেন আমার দাদুভাইকে অনেক ভালো রাখে।তোমার মুখে হাসি দেখার জন্যই আমি আজ পরিবারের সাথে লড়াই করেছি।তুমিও এই মর্যাদা রেখো।আমার ছেলে আর বউমা দুজনকে ভুলে যেও না।তারা তোমার বাবা মা।তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে প্রথম অবদান রাখেন।”

দিদারের চোখে পানি।দাদাজানের বুকে মাথা গুঁজে বলে,“পৃথিবীতে বেস্ট দাদা বলে কেউ যদি থাকে তবে সে আমার দাদাজান দিলদার ফরাজি।”
দর্শন দরজার কাছে এসে সব শুনে ঘুরে চলে গেলো।দাদাজান সবাইকে আশকারা দেন এটা ঠিক কিন্তু ভালো শিক্ষাটাও দেন।বয়স তার এমনি এমনি হয়নি। রেলিং ধরে নিচের দিকে চোখ রেখে দেখলো শোভা দুইহাত দুদিকে করে ঘাড় কাত করছে। ঘাড়ের ব্যাথা দূর করার চেষ্টা চালাচ্ছে।এতক্ষণ ধরে বসে প্যাকিং করাটা আসলেই কষ্টের। এতে ঝুঁকে কাজ করা হয়।দর্শন দেখে চুপচাপ ঘরে চলে গেলো।শোভা আসতেই চুপচাপ বিছানায় বসে।শোভা এক পলক দেখে নিজের মত গোসলে গেলো।বাইরে আসতেই দর্শন বলে,“ওখানে পেইন কিলার আছে,খাও।”
শোভা অবাক চাহনি দিলো,“আমাকে বললেন?”

“নাহ একটা ইডিয়টকে।”
“আমি ইডিয়ট?”
“হুমমম।”
“রাগী গন্ডার।”
“তোমার উপকার করাটাই আমার উচিত হয়নি।”
“আপনি উপকার করতে জানেন?পারেন তো শুধু ঠাস ঠাস করে গালের উপর বসিয়ে দিতে।”
দর্শন কথাটি শুনে উঠে দাড়ালো।শোভার কাছে হাতা গুটিয়ে এগিয়ে আসতে নেয়।শোভা ভয় পেলো।এখন আবার মারবে নাকি!শোভাও ক্যারাটি স্ট্যাইলে দাঁড়ালো যদিও সে পারেনা ঘোড়ার ডিমও।তবুও সাহস সঞ্চয় করে বৃথা চেষ্টা করবে।ক্যারাটি ভাব নিয়ে বলে,“দেখুন মিস্টার এগোবেন না।আপনি একটা থাপ্পর দিলে আমি আপনাকে ডাবল উষ্টা দিয়ে উগান্ডায় পাঠিয়ে দিবো।”

দর্শন বুকের উপর থেকে বোতাম খুলতে খুলতে বলে,“ওয়াও আমার তাহলে ফ্রিতে উগান্ডায় ঘোড়া যাবে।ফ্রিতে টুরিষ্ট সার্ভিস সিস্টেম দেখছি আমার ঘরেই আছে।”
শোভা বোকা হয়ে গেলো।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।দর্শন বুকের বোতামগুলো খুলল কেন বুঝলো না।এই লোক তো কাছে আসার লোক না।শোভা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে নিবে দর্শন তার সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করবে না।কিন্তু কি যে করবে এটাই জানে না বেচারি।দর্শন হাত উঁচিয়ে যেই এগোলো শোভা চোখ বন্ধ করে পা উচু করতে নেয় কিন্তু দর্শন পা দিয়ে দিলো হাঁটুর উপর লাথি।শোভা কুকড়ে বসে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনের ছোট্ট কাঠের টুলে।দর্শন ধমকে বলে,“ইডিয়ট এটা দেখাতে এসেছিলাম।”
শোভা চেয়ে দেখলো দর্শনের হাতের ক্ষত যেটা কাটা চামচ দিয়ে শোভা দিয়েছিল।তারপর দেখলো গলার ওই কামড়ের দাগ।দেখিয়ে বলে,“আমি থাপ্পড় দেই আর তুমি কি দেও আমাকে?”

“পাল্টা আঘাত কিন্তু আজকে আপনি আমার পা ভেঙ্গে দিলেন।”
“কোথায় লেগেছে?”
“হাঁটুতে।”
“মলম লাগাও।”
“এনে দিন আমি হাঁটতে পারব না।”
“আই অ্যাম নট ইউর সার্ভেন্ট।”
বলেই দর্শন চলে গেলো বাইরে।শোভা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলো।মলম নিয়ে নিজের হাঁটুতে লাগালো।দিজা বোরকা পরে এসেছে।শোভাকে দেখে বলে,“কি হলো তোমার?”

“পায়ে লেগেছে।”
“পড়ে গিয়েছিলে?”
“ওই আর কি।”
“দাদাজান তাড়াহুড়ো করছেন তো।”
“আমি যাব না।তোমরা যাও।”
“আমরা সবাই যাবো তুমি যাবেনা এটা হয় নাকি?”
“হবে না কেন?আমি কি বাচ্চা যে সামান্য বিষয় নিয়ে মন খারাপ করবো?”
“থাকতে পারবে তো?”
“হ্যাঁ পারব।”
“আচ্ছা তাহলে থাকো আমি নিচে যাই।”
শোভা মাথা উপর নিচ করে।দিজা চলে যায়।নিচে গিয়ে পারুল বেগমকে বলে,“ভাবীর পায়ে ব্যথা।হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।যাবেনা বলল।”

পারুল বেগম ছুটে গেলেন দেখতে।দাদাজান রাগ দেখিয়ে দর্শনের দিকে ফিরে বলেন,“অপদার্থ একটা!বউয়ের পায়ে চট লেগেছে উনি আছে ওনার মত।”
“কি করা উচিৎ আমার?”
“পা টিপে দেওয়া।বউয়ের পা টিপে দেওয়া মহৎ গুণ।”
“তুমি দেওনা গিয়ে।”
“বউ আমার হলে কোনো অপদার্থের অপেক্ষায় থাকতাম না।”
কিছুক্ষন পর পারুল বেগম এসে প্লেটে করে খাবার নিয়ে আবার উপরে গেলেন।খাবার দিয়ে এসে বলেন,“বাড়ির বাইরে তালা মেরে দিয়ে গেলেই হবে।শোভার সবকিছু দিয়ে এসেছি।অসুবিধা নেই কোনো।”
আজকে বাসায় এসেছেন সুফিয়া বেগম।দর্শনের ফুফু তিনি।আড়ালে মুখ ভেংচি কেটে জোরে জোরেই বলেন,

“দেবরের বিয়ের দায়িত্ব না নেওয়ার ধান্দা জানে এই মেয়ে।কৌশলে কাজে ফাঁকি দেয়।”
পারুল বেগম একবার দর্শনের দিকে তাকিয়ে তারপর চোখ ফিরিয়ে বলেন,“আমার বউমাকে দেখেছো তুমি?”
“দেখা লাগে আজকালকার মেয়ে?ওদের মধ্যে ঘাবলা থাকে অনেক।”
“মেয়ে তো তোমারও আছে।”
“আমার পারিবারিক শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।সবাই কি তাই পারবে?”
দর্শন উঠে দাঁড়ালো।মুখে কোনো জবাব না দিয়ে দিজার উদ্দেশে বলে,“মেয়েটা সারাদিন যে প্যাকিং করলো ওগুলো কি গাড়িতে রেখেছিস?”
“হ্যাঁ ভাইয়া।”
“তাহলে চল।”
দর্শন বেরিয়ে গেলো কিন্তু সুফিয়া বেগম কিছুই বুঝলেন না।অবাকের সাথে বলেন,“কার কথা বলল দর্শন?”
“আমাদের বড় বউমা।বাড়ি থেকে এসেই দুপুরের রান্না করে সেই যে বসেছে সব সাজাতে একটু আগেই উঠলো।অনেক গুণী ও কাজের।”
লেগে গেলো সুফিয়া বেগমের গালে বিনা আঘাতে একটা থাপ্পড়।মুখটা বন্ধ করে চলে গেলেন গাড়ির কাছে।গাড়িতে উঠতেই দিজার উদ্দেশে বলেন,“নতুন ভাবী দেখতে যাবি।একটা ভালো জামা পরলি না কেন?এসব খেত সেজেছিস কেন?”

“এগুলো ইসলামিক মানসিকতা ফুফু।”
“আগে তো দেখিনি এমন মানসিকতা।”
“বড় ভাবী শিখিয়েছে তাই আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছি।”
দর্শন গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত।দিজার কথা শুনে মুচকি হাসলো।সবাইকে ফারিয়ার বাড়ির সামনে এনে দর্শন বলে,“আমি তাহলে বাসায় যাই।”
গাড়ি দুইটা।একটায় আত্মীয়তা করতে আনা ফল ও মিষ্টির ঝুড়ি আরেকটায় পরিবারের সকলে।দর্শন ওদেরকে রাখতেই এসেছে।কিন্তু দাদাজান বলেন,“বড় ভাই যখন এসেছো আত্মীয় স্বজন দেখেই যাও।তোমার দায়িত্ব আছে একটা।”
দর্শনের মনের মধ্যে আছে শোভাকে দেখতে যাওয়া।মেয়েটার পায়ে আঘাত করে এখন তাকে দেখার জন্য মন বারবার ছুটছে সেদিকে।পারুল বেগম যখন দর্শনের কাছে দাবি করলেন দর্শন আর বাড়ির দিকে গেলো না।আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেল।

ফারিয়াদের বাড়িটি বেশ সুন্দর করেই সাজানো।দর্শনদের থেকে কোনো অংশে কম নয়।ফারিয়ার বড় চাচা এসে সবাইকে বসালেন।ফারিয়ার বাবা চট্টগ্রাম থেকে আসছে আজকে।তাই তিনি ঘরে আছেন।ফ্রেশ হয়ে বের হবেন।ফারিয়ার মা নাশতা গোছাচ্ছেন।দর্শন ও পরিবারের সবাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পরিবেশ।ভালোই লাগছে সবকিছু।এর মধ্যেই দিদারের মোবাইল বেজে উঠলো।রং নাম্বার দেখে ভ্রুকুটি করে রিসিভ করে মোবাইল কানে নেয়।কিছু একটা শুনে সবার উদ্দেশ্যে বলে,“আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।”
সবাই অবাক হলো।তারপরও স্বাভাবিক বিষয় ভেবে গল্প করতে থাকে।ফারিয়ার চাচা হাসিমুখে বলেন,“ওই যে মেয়ের মা আর চাচী আসছে।”

সবাই চোখ তুলে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।দর্শন উঠে দাড়ালো সাথে সাথে। এতগুলো বছর পর এই মুখের সম্মুখীন হবে ভাবতেই পারেনি।ঘৃণা বাড়ছে গা গুলিয়ে আসে দর্শনের।ফারিয়ার মা এগিয়ে এসে অন্যদের দেখার আগে দর্শনকে দেখতে পান।কারণ ও দাড়িয়ে আছে।এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলেন,“দাঁড়িয়ে কেন বাবা? বসো।”

ওনার হাতে শরবতের ট্রে।যেটা নিয়েই দাঁড়িয়েছে দর্শনের সামনে।দর্শন রেগে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ট্রে নিচে ফেলে দিয়ে বলে,“আপনার মুখে বাবা ডাক শুনতে ঘৃণা লাগে আমার।আপনি একজন কালনাগীনীর থেকেও খারাপ।বিষাক্ত কীট আপনার মধ্যে বসবাস করে।”
উনি অবাক হয়ে দর্শনকে দেখছেন কিন্তু যেই সোফায় চোখ গেলো তারও চোখ কপালে।সুফিয়া বেগম প্রশ্ন করেন,“ফারিয়া কি তোমার মেয়ে,ফারহা?”
“হ্যাঁ।”

পারুল বেগম মুখে হাত দিয়ে তাকালেন দীপ্ত ফরাজির দিকে।যার জন্য পাত্রী দেখতে আসা তার মেয়ে কিনা সতীনের মেয়ে!নিজ স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রীর বর্তমান সংসারে যে মেয়ে হয়েছে তার সাথে প্রেম করছে তাদের ছেলে।লজ্জা লাগছে এবার।গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।মিসেস ফারহা নিজেও অবাক।তিনি জানতেন ফারিয়া দিদার নামের এক হ্যান্ডসাম ছেলেকে ভালোবাসে।আসলেই দিদার হ্যান্ডসাম ও স্মার্ট।দিদার ব্যাবসা করে ওর বাবা প্যারালাইজড এগুলো জেনে আপত্তি করেনি।দিদার কি পাশ কি করে এটুকুই শুনেছে।বাবা মায়ের সাথে দেখা করবে তাদের থেকেই আলাপ করে সব জানাশোনা এগোবে এই নিয়ত রেখে আলাদা প্রশ্ন করা হয়নি।এখন তিনি নিজেই অবাক।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৮

এদিকে দাদাজান ভাবছেন দুই ভাই নিয়ে।দর্শন কোনমতেই বিয়ে হতে দিবে না আর দিদার কি মানবে এটা?মানলেও তাকে তো আঘাত দেওয়া হয়।এমনিতেও এই সম্পর্ক কিভাবে আগায়? এমন সম্পর্ক কোনোদিন সুখ বয়ে আনবে না।অতীতের সম্মুখীন হয়ে কখনও বর্তমান উজ্জ্বল হয়না।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here