বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২০
ইশরাত জাহান
“এই বিয়ে হবেনা।”
সবাই কর্ণপাত করতেই দরজার দিকে তাকালো।দিদার এগিয়ে এসে মাথা নত করে বলে,“আমি মানুষ চিনতে পারিনি দাদাজান।অনেক বড় ভুল করেছি জীবনে।”
পারুল বেগম ছেলেকে দেখছেন।দিদারের কষ্ট হচ্ছে খুব।অন্যদিকে দর্শন এখনও রাগে ফুঁসে আছে।দিদার আচমকা বলে,“একটা ক্যারেক্টারলেস মেয়েকে আমি ভালোবেসেছিলাম।ঘৃণা লাগছে সবকিছু।বাড়ি চলো সবাই।”
দর্শন পাশ ফিরে বলে,“কি হয়েছে?”
“মাত্র যার কল আসলো সে ফারিয়ার প্রাক্তন স্বামী।একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলো।যেই গরীব হয়েগেছে ওমনি ছেড়ে দেয় তাকে ফারিয়া।এরপর আরো কয়েকজনের সাথে রুমডেট!ছিঃ।সবকিছুর প্রমাণ দিয়েছে ও আমাকে।”
“ওরা তোকে চিনলো কিভাবে?”
“খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।ওমন বাজে মেয়ের শত্রু থাকা অস্বাভাবিক না।যাদের টাকা পয়সা নিয়ে উড়িয়েছে তারা ওর পিছনে লেগে আছে।কোনো এক জায়গা থেকে খবর পেয়ে আমাকে খুঁজে বের করে।একটু দেরি হলো ঠিক কিন্তু জানতে তো পারলাম।”
দর্শন রক্তিম চাহনি দিয়ে এগিয়ে এসে মিসেস ফারহার উদ্দেশ্যে বলে,“যেমন মা তার তেমন বে* মেয়ে।দুজনেই মানুষের মন নিয়ে খেলে টাকা নিয়ে বাস করে।টাকা পেলেই ওরা লেলিয়ে যায়।”
উপর থেকে মিসেস ফারহার বর্তমান স্বামী নামতে নামতে বলেন,“তুমি কিন্তু আমাদের ঘরে এসে অপমান করছো ছেলে।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বলে যেই দর্শনের দিকে তাকালো একটু কেঁপে উঠে বলে, “স্যার আপনি?”
দাদাজান কপাল কুঁচকে বলেন,”স্যার!”
দর্শন ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলে,“ঘরে এসে অপমান করেছি কারণ সেই কর্ম তারা করে।বাই দ্যা ওয়ে আপনিও তো এতেই শামিল।”
লোকটা কথাগুলো বুঝতে না পেরে বলে, “স্যার আপনি এগুলো কি বলছেন?”
“হোয়াট স্যার?”
“আপনি স্যামসাং এর এক নাম্বার ব্র্যান্ড অর্গানাইজ করছেন আমি তার মধ্যে যুক্ত আছি।”
দর্শন ভ্রুকুটি করে রাগ মিশিয়ে বলে,“আপনার নাম?”
“জবরুল আহমেদ।আমার তো অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল বড় কোনো কোম্পানির ওনারে থাকবো।আপনি ক্ষুদে ব্যবসায়ী হয়েও টপ ফাইভে নিজের নাম রেখেছেন। হেটস অফ ইউ।”
দর্শন দ্রুত পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে জানালো,“স্যামসাং ব্র্যান্ডের যতগুলো শোরুম আছে বা কাজ আছে সেখান থেকে মিস্টার জবরুল আহমেদকে বাতিল করে দেও।আমি এই লোককে আমার কর্মস্থলে দেখতে চাইনা।”
জবরুল আহমেদ হতাশ চাহনি দিলেও মিসেস ফারহা নরম চাহনি দিয়ে আছেন।তিনি কিছু বলতে নিলেও দর্শন তাকে মূল্যায়ন না করে চলে যায়।পিছন থেকে জবরুল আহমেদ চেঁচিয়ে বলতে থাকেন,”স্যার আমার জব থেকে এভাবে বাতিল করতে পারেন না।আমার এখনো প্রমোশন বাকি ছিল।আপনাদের থেকেই তো শর্ত দেওয়া ছিলো আমি কাজ সম্পুর্ণ করলে আমাকে উপরের পদ দেওয়া হবে।”
দর্শন কথা কানে না নিয়ে হাঁটতে থাকে।বুকপকেট থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে দিয়ে বাইরে আসতে আসতে বলে,“আই হেইট চিটার্স অ্যান্ড আই ডোন্ট এলাউ দেম ইন মাই লাইফ।”
জবরুল আহমেদকে থামালেন মিসেস ফারহা।তারপর বলেন,“সোফায় তাকাও।”
জবরুল আহেমদ অবাক হলেন দীপ্ত ফরাজিকে দেখে।তারপর মিসেস ফারহার দিকে তাকিয়ে বলেন,“ওই ছেলেটা তোমার সেই?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন মিসেস ফারহা।পিছন থেকে পারুল বেগম বলেন,“ছেলেটা আমার।”
“কিন্তু জন্ম তো আমিই দিয়েছি।”
“জন্ম দিলেই যে মা হওয়া যায়না এটা তুমি প্রমাণও করেছো।আর জন্ম না দিয়েও যে মা হওয়া যায় এটা আমি প্রমাণ করেছি।আমার ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিজ যোগ্যতায়।কিন্তু সে তার জীবনের সবথেকে খারাপ সময়টার প্রতিশোধ নিয়ে নিলো প্রকৃতির বিচারে।আজ না আমরা এখানে আসতাম না আমাদের পুরোনো ক্ষত জাগ্রত হতো আর না তোমাদের চাকরি হারিয়ে দেউলিয়া হতে হতো।”
“দেউলিয়া?”
“দর্শন কাদের সাথে ওঠাবসা করে জানো তো?কোরিয়ার টপ কোম্পানির চেয়ারম্যানদের সাথে।জাস্ট একটা কল আর প্রত্যেকটা কোম্পানি থেকে বের করে দিবে জবরুল আহমেদকে।এগুলো একদিন দুইদিন ধরে চেষ্টার ফল না জীবনের চারটে বছরের ফল।যেটা তোমার তেইশ বছরের পাপকে ধ্বংস করে দিল।”
ফারিয়া খবর পেতেই সাজ বাদ দিয়ে দ্রুত ছুটে আসে।দিদারের হাত ধরে অনুরোধ করে,“আমাকে ছেড়ে যেও না।আমার ভুল হয়েছে।আমার অতীত জানানোর দরকার ছিল কিন্তু আমি..
দিদার হাত ঝাড়া দিয়ে বলে,“ভাই ঠিকই বলে।মেয়ে জাত অবিশ্বাসের যোগ্য।তোমরা মা মেয়ে এটার বাস্তব প্রমাণ।যতদিন ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে ততদিন তাদের মূল্য থাকে।প্রতিষ্ঠিত না হলে তাকে মূল্যায়ন করতে পারতে না।ভাইয়া কথাটা বিশ্বাস করে বলেই ওর জীবন এখন পারফেক্ট আর আমি চিল করেও খেলাম ধোঁকা।কারণ আমাদের ছেলেদের গা ভাসিয়ে দিলেই চলেনা নিজেদের অনেককিছু অর্জন করে নাম কামাতে হয়।”
ফারিয়া আরো অনুরোধ করে কিন্তু কোনোটায় কাজ হয়নি।দিদার ক্ষিপ্ত হয়ে চলে আসে।পিছনে আসে পুরো পরিবার।চলে গেলো তারা অতীতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
গাড়ি চালিয়ে নিজ মনে অনেকটা দূরে এলো দর্শন।ধর্মতলার বিখ্যাত চায়ের দোকানের সামনে এসে গাড়ি থামালো।ওখানে চলে বৃদ্ধ থেকে যুবক সকলের আড্ডা।চায়ের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হয়।দর্শন গাড়ি থামিয়ে এক কোনায় বসে খোলা আকাশের দিকে তাকালো।এদিকে কয়েকজন যুবকের মুখ থেকে বাজতে থাকে গান।বেশ কয়েকটা গান শেষ করে এখন শুরু করে,
“একজনে ছবি আঁকে ও মন
আরেকজনে বসে বসে রং মাখে ও মন।
সেই ছবিখানা নষ্ট করে কোন জনা কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
মন জানো না
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা?”
গান শেষে এক যুবকের কণ্ঠে শোভা যায় বেদনা,“আমার বউয়ের চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে।যোগাড় হয়না ভাই।”
আরেকজন বলে,“আমার তো বউই নাই।টাকা যোগাড় করতে গিয়ে দেখি বউ নিজেই সুযোগ বুঝে উড়াল দিছে।”
“আজকাল সংসার টেকে নাকি?নতুন নতুন মাল ধরে সব পালায় যায়।গরিবের বউ থাকেনা।”
“অনেক ঘরে আছে বর পরকীয়া করে।আমার দুলাভাই করছিল।”
“কও কি তারপর?”
“যার সাথে পরকিয়া করছিল তার স্বামীকে খুন করে এখানে আসছিল।কেস করছিল এলাকাবাসী মিলে।মেয়েটা জেলের ভাত খায় ওই কপালপোড়া এখন আমার বোনের পা ধরে।”
“যুগ জামানা ভালো না।মেয়েরা ছলনা করে।”
এখানে যেহেতু ছেলেদের আড্ডা মেয়েদের সুনাম কেউ করবে না এটাই স্বাভাবিক।দর্শন ওদের থেকে মেয়েদের বদনাম শুনে আবারও ঘৃণা করতে শুরু করে মেয়েদের।আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকে নিয়ে ভাবছে।ঘৃণার পরিমাণ বেড়েই চলেছে মেয়েদের প্রতি।কিছুক্ষণ পর মোবাইল বেজে উঠল।কল দিয়েছে দীপ্ত ফরাজি।জানালেন,
“আমরা বাসায় এসেছি।তুমি কোথায়?”
“ধর্মতলা।”
“দিদার যাবে কি আনতে?”
“গাড়ি আছে সাথে ওকে লাগবে না।”
বলেই কল কেটে গাড়িতে উঠে বসে।গাড়ি চালানোর সময় পাশে একটি ছোট বাচ্চা এসে জানালায় টোকা দিয়ে বলে,“ভাইজান পাপড় নিবেন?”
দর্শনের উত্তর থাকে,“না।”
বাচ্চাটির আকুতি শোনা গেলো,“নেন ভাইজান।মাত্র দশ টাকা করে।বিক্রি না হইলে দাদী মারবে।”
দর্শন পাশ ফিরে বলে,“কেন মারবে কেন?”
“বিক্রি সবগুলো না হইলে আমাকে বকে।বাড়িতে টাকা না থাকলে খাবার কিনে খাইতে পারবো না।”
“তোমার বাবা মা?”
“বাবা মারা গেছে মা আরেকটা বিয়ে করছে।আমি দাদীর কাছে থাকি।কিছু নেন ভাইজান।”
দর্শন নিলো না কিন্তু পাঁচশত টাকার নোট দিয়ে বলে,“এগুলো আমার লাগবে না।আমি ভাজাপোড়া খাইনা।”
ছেলেটি হাসতে হাসতে চলে গেলো টাকা নিয়ে।পাশ থেকে দেয়ালে বসে থাকা এক বয়স্ক লোক বলে, “ভাইসাপের মনে হয় অনেক টাকা।তাই তো মাগনা দিয়ে দিলো।আমাদের হাত থেকে তো টাকা বের হতে গেলে অনেক ভাবতে হয়।”
দর্শন পাত্তা না দিয়ে জানালার গ্লাস উঁচিয়ে গাড়ি চালালো এবার।গন্তব্য বাড়ির দিকে।মাথা এখনও ঠিক নেই বরং রাগ মাথায় চেপেই আছে।বাসায় আসার পর কারো সাথে কোনো কথা না বলে চলে যায় নিজ ঘরে।দর্শনের এতক্ষণ মনেই ছিলো না শোভার কথা।শোভার পায়ের ব্যাথা অনেকটা কমেছে।মলম লাগিয়ে আবার পেইন কিলার খাওয়ার কারণে ব্যাথা নেই বললেই চলে।তাই হেঁটে যেতে চেয়েছিল নিচের দিকে কিন্তু বের হবার সময় ধাক্কা লাগে দর্শনের সাথে।দর্শন কিছু বলতে নিবে শোভা বলে,“আমার একার দোষ দিবেন না।দোষ আপনারও আছে।এক হাতে তালি বাজে না।”
আরো কিছু বলতে নিবে শোভার গাল ঠাস করে দিলো থাপ্পড়।শোভা আহাম্মক হয়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে পাল্টা আঘাত করার প্রস্তুতি নিবে দর্শন হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বাইরে বের করে দেয় শোভাকে।তারপর মুখের ওপর দরজাটা লাগিয়ে দেয়।শোভা আজ অনেক বড় অপমানবোধ করলো।চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তার।কান্না করে দিবে ভাব।কোনমতে চোখের পানি মুছে নিচে আসতেই দেখে সবাই চুপচাপ বসে আছে।শোভা হিজাব বেঁধে সবার সামনে দাঁড়ায়।দাদাজান প্রশ্ন ছুড়লেন,“পায়ের ব্যাথা কমেছে?”
“জি দাদাজান।”
“খেয়েছো রাতে কিছু?”
“হ্যাঁ আম্মা যা দিয়েছে সবই খেয়েছি।আপনারা তো আজ খেয়ে এসেছেন তাই না?”
পারুল বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বলেন,“তুই বাইরে কেন?”
“আমার এখন পা ঠিক হয়েছে।ঘুম থেকে উঠে ঠিক লাগছে এখন।”
“আচ্ছা কিছু খাবি।’’
“না,তোমরা খেয়ে আসোনি?রান্না করছো যে?”
“খেয়ে আসিনি।”
“কেন?”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ১৯
“সে অনেক কাহিনী।যাই হোক কালকে ঢাকায় রওনা দিবি।ব্যাগ গোছানো হয়েছে?”
“না।”
“গুছিয়ে নে।”
শোভা মনে মনে বলে,“মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।আমি কিভাবে গোছাবো ব্যাগ! যাই হোক এবার তাকেও শাস্তি দিতে হবে।”