সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৬

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৬
Jannatul Firdaus Mithila

~ অনিক তুই সত্যি বলছিস? ইকরাই ঐ মেয়ে?
অনিক মাথা ঝাকাতে গিয়েও থেমে যায়। চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে,
~ এই ইকরাটা আবার কে?
অনিকের কথা শুনে তাশরিক সাহেব হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এই মুহুর্তে তার ঠিক কেমন এক্সপ্রেশন দেওয়া উচিত তাই হয়তো ভাবছেন। ভাবা যায়, ছেলেটা যাকে পছন্দ করলো তার নাম অবধি জানে না! তাশরিক সাহেব কৌতুকের গলায় বললেন,

~ অনিক ধন্য তুই বাপ! যাকে পছন্দ করলি তার নামটাই জানিস না?
অনিকের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার হলো। বুঝতে পারলো ইকরা কে। তাই অনিক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
~ আসলে আগে কখনো কথা হয়নি তো তাই..
~ থাক হয়েছে আর বলতে হবে না। আমি এখন যাই তাহলে।শত হলেও হবু বউমা কি যেন বলবে বললো, না শুনলে কি আর হয়?
এ পর্যায়ে অনিক কিছুটা লজ্জা পেলো। মুচকি হেসে মাথা চুলকে চাচার দিকে তাকালো। তাশরিক সাহেব অনিকের লজ্জালু মুখাভঙ্গী দেখে ঠোঁট চেপে হাসলেন। ছেলেটা এত লাজুক! তিনি আর কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে গেলেন ক্যাম্পাসে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে অনিক এখনো ক্যান্টিনের চেয়ারটায় ঠায় বসে। চোখ খোলা রেখেই কল্প জগতে প্রবেশ করলো সে। কল্পনা করতে থাকে ইকরার স্নিগ্ধ মুখখানা।জোড়া ভ্রু, ভাসা ভাসা আঁখি দ্বয় যেগুলো দেখলে মনে হবে এক অতল গহীন সমুদ্র। ফর্সা মুখশ্রীটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি তিল। এই তিলগুলোর জন্যই হয়তো তাকে এতটা নজরকাড়া লাগে।আহা, কি মাসুম সেই চেহারা! অনিক আবারও মুগ্ধ হয় ইকরাকে কল্পনা করে। কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে মনে মনে আওরালো সে,
~ প্রিয় তিলপরি। একবার যেহেতু মনের মনিকোঠায় বসিয়েছি, তাহলে জেনে রাখুন জীবনের শেষ নিশ্বাস অবধি এ মনের মনিকোঠায় আপনি বন্দী।
কথাগুলো ভেবে আপনমনেই হেসে ওঠে অনিক। বেচারা,সে কি আর জানে তার অপ্রতিরোধ্য বাসনার পরিনাম কি! জানলে হয়তো এতোটাও ব্যাকুল হতোনা। আবার হয়তো হতো! কেননা ভালোবাসা কি আর কোন বাধা মানে?

~ইকরা?
পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ কর্নগোচর হওয়া মাত্র তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে ইকরা। একটি খালি ক্লাসরুমে এসে অপেক্ষা করছিলো সে। করিডর দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় তাকে এখানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাশরিক সাহেব ক্লাসরুমের দরজায় দাড়িয়ে ডাক দেয়। ইকরা নিজেকে স্বাভাবিক করে। তাকে স্বাভাবিক হতে দেখে তাশরিক সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন। মাঝে প্রায় অনেকটা দুরত্ব রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
~ তখন কি যেন বলবে বলেছিলে?
ইকরা মাথা ঝাকায়।পেটে বলার মতো হাজারটা কথা থাকলেও মুখে এই মুহুর্তে একটাও আসছে না। ইকরা এবার নিজের ওপর খানিকটা বিরক্ত হয়। কি জানি হঠাৎ তার কি হলো! যেই কথাগুলো এখানে বলতে এসেছিলো সেগুলো আদৌও বলতে পারবে তো!
ইকরার মৌনতা দেখে তাশরিক সাহেব ভ্রু গোটায়। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে গম্ভীর গলায় শুধায়,

~ ইকরা! কিছু কি বলবে?
ইকরা আবারও মাথা ঝাকায়। দৃষ্টি এবার ফ্লোর থেকে তুলে তাশরিক সাহেবের দিকে তাক করে। ইকরার টলমল চোখের দিকে তাকিয়ে তাশরিক সাহেব কিছুটা ভড়কে যান। ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলেন,
~ইকরা আর ইউ ওকে?

ইকরার কানে আদৌতে কথাটি পৌঁছুলো কি? সে-তো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাশরিক সাহেবের দিকে।এতোগুলা দিন এই মানুষটাকে শুধু শিক্ষক হিসেবেই দেখে এসেছে কিন্তু আজ যে সেই দৃষ্টিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন! আজকে যে ইকরার খুব করে ইচ্ছে করছে এই মানুষটাকে মামা ডাকতে। একটু আদর পেতে। এতোগুলাে বছর কেবল মাত্র নিজের পরিবার বাদে অন্যকোন আত্মীয় স্বজনের ছোয়া অবধি পায়নি সে। মনটা তো একটু-আধটু আদর পেতে চাইবেই তাইনা! ইকরা নিজ থেকে এবার খানিকটা এগিয়ে আসে। তার দৃষ্টি এখনো তাশরিক সাহেবের দিকে। প্রায় অনেকটা কাছাকাছি এসে ইকরা আচমকা তাশরিক সাহেবের ডান হাতটি আঁকড়ে ধরে উঁচু করে সেটিকে নিজের কপালে ঠেকায়। তারপর মৃদুস্বরে হুহু করে কেঁদে ওঠে। আকস্মিক ঘটনায় তাশরিক সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। তিনি এখনো বুঝতে পারছেন না এসব হচ্ছে টা কি? মেয়েটাই বা কেন এমন উদ্ভট আচরণ করছে! তিনি হাতটি ছাড়াবার চেষ্টা করতেই ইকরা সেটিকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। অতঃপর কান্না জড়ানো গলায় থেমে থেমে বলতে তাকে,

~ হাতটা সরিও না মামা।আরেকটু তোমার স্পর্শ পেতে দাও। আমার যে তোমাদের বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে মামা।বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে!
বলেই আবারও কাঁদতে থাকে মেয়েটা। এদিকে ইকরার মুখে বারবার মামা ডাক শুনে হতবাক হয়ে যায় তাশরিক সাহেব। তার গলা ফুঁড়ে হঠাৎ বের হয়ে আসে কিছু প্রশ্ন,
~ মামা? কার মামা! ইকরা তুমি ঠিক আছো? বারবার আমায় মামা বলছো কেন?
ইকরা কি এ মুহুর্তে কোন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার স্থিতিতে আছে? নাহ নেই তো! কি করে থাকবে মেয়েটা! অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু মুহুর্তে করা প্রশ্নের জবাব সবাই কি আর দিতে পারে?
ইকরার কান্না দেখে তাশরিক সাহেব কেমন বিচলিত হলেন।তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না এই মেয়েটার এমন কান্না দেখে তার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে। তিনি আর সহ্য করতে না পেরে জোর করে নিজের হাতটি ছাড়িয়ে নেন। ব্যাকুল হয়ে বললেন,

~ইকরা আই থিংক ইউ আর নট ওকে। তোমার বাসার নাম্বার দাও আমি কাওকে কল দিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে বলছি।তুমি আজকে বাসায় গিয়ে রেস্ট করো,কেমন?
ইকরা কোন প্রতিত্তোর না করে চুপটি করে তাকিয়ে রইলো তার মামার দিকে। চোখ দুটি দিয়ে যেন রাজ্যের বর্ষন ঝড়ছে। সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে ঠোঁট ঠোঁট চেপে।
তাশরিক সাহেব আর কালবিলম্ব না করে ফটাফট নিজের পকেট হাতরিয়ে ফোন বের করেন।দ্রুতহাতে ডায়েল লিস্টে ঢুকে বলতে লাগলেন,
~ফোন নাম্বারটা বলো ইকরা!
ইকরার এবার কি হলো? সে এক কথাতেই ফটফট করে নাম্বারটি বলে দিলো।তাশরিক সাহেব এটা দেখে অবাক হলেন বৈকি! তবুও তার সকল অবাকের রেশ কাটিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। অতপর ফোনে রিং ঢুকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে ইকরার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

~ গার্ডিয়ানের নাম কি তোমার?
ইকরা চোখ তুলে তাকায় মামার দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বলে,
~ মিসেস আমরিন এহসান। ডটার অফ খায়রুল এহসান।
সঙ্গে সঙ্গে থমকে যায় তাশরিক সাহেব। সারা শরীর বেয়ে বয়ে যায় এক মৃদু বিদ্যুৎের ঝলকানি।হাত দুটোয় আচমকা কাপন ধরে। তিনি তিরতির করে কাপা চোখের পাতা তুলে সামনে তাকান।ঠিক তখনি ওপাশ থেকে কলটি রিসিভ হয়।কেও একজন বেশ নম্র স্বরে সালাম দিয়ে কথা শুরু করে,
~ আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
তাশরিক সাহেবের গলা বুঝি ধরে আসছে। হঠাৎ করে গাল বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা নোনা জল। তিনি কাপা কাঁপা গলায় বললেন,
~ আপা!
ব্যস, ডাকটি শোনা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে ওপাশে থাকা ব্যাক্তিটির ব্যস্ত হাত থেকে রান্নার খুন্তিটি এক ঝনঝন শব্দ তুলে পড়ে যায় ফ্লোরে । নিজেকে ভুল প্রমাণিত করতে আরেকবার জিজ্ঞেস করেন,

~কে?
তাশরিক সাহেব বোনের কন্ঠ পেয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। বুকটায় চলছে এক ভয়ংকর তোলপাড়। ২০ টা বছর! হ্যা ঠিক ২০ টা বছর পর এই গলা শুনতে পাচ্ছেন তিনি। তাশরিক সাহেব চোখ খুলে নিজের শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছলেন।ধরে আসা গলায় আবারও বললেন,
~ তোমার তুশুকে ভুলে গেলে আপা!
আমরিন বেগমের বুকটা কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। গলায় এসে ভিড় জমায় অজস্র অশ্রুধারা। নিজেকে কোনমতে সামলে বললেন,

~ তাশরিক?
তাশরিক সাহেব কান্না চোখেও মৃদু হেসে ওঠলেন।
~ হ্যা, তোমার তুশু।
এবার বুঝি আমরিন বেগমের অশ্রুধারা আর বাধ মানলো না। ছুটে বেরিয়ে আসলো সন্তপর্ণে। হু হু করে কাঁদতে লাগলেন তিনি। থেমে থেমে বলতে লাগলেন,
~ ভাই আমার, আমার তুশু।কেমন আছিস তুই ভাই? বাড়ির সবাই…
বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। মনে পড়ে গেলো সেই ২০ বছর আগের নিষেধাজ্ঞা। তাই নিজেকে আবারও ইস্পাতের ন্যায় কঠিন করে বললেন,
~ আর কল দিস না তুশু! ভাইজান জানলে কষ্ট পাবে।
বলেই তিনি তাশরিক সাহেবকে আর কিছু বলতে না দিয়ে খট করে ফোনটি কেটে দিলপন।অতপর ফোনটি হাত থেকে ফেলে দিয়ে ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়েন।তারপর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে আবারও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন পাগলের মতো।
অন্যদিকে তাশরিক সাহেব বোনের অসহায়ত্বে আবারও ভেঙে পড়েন। ভাবতে থাকেন — আদৌও কি এই অভিশাপ তাদের পরিবার থেকে কাটবে? আবারও কি জোড়া লাগবে কিছু ভাঙা সম্পর্ক!

রাত ১২ টা🌸
ক্লান্ত দেহ, আসাড় হয়ে আসা পাদু’টোয় কোনরকম ভর দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে রৌদ্র। ইদানীং হসপিটালে বেশ চাপ যাচ্ছে তারওপর দিয়ে। আর চাপ থাকবে নাই বা কেন, রৌদ্র যে এখন বেশ সুখ্যাতি সম্পন্ন একজন ডাক্তার।তাছাড়া আজকে আবার একজনের সাথে দেখা করে আসতে আসতে কখন যে এতোটা লেট হয়ে গেলো টের-ই পায়নি সে। বাড়িতে ঢুকে কোনরকম দেহটাকে টেনে টেনে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। করিডর দিয়ে হেটে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার আগে একবার অরিনের ঘরের দিকে তাকায়,দেখতে পায় দরজাটি আটকানো।হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। রোজ রোজ থোড়াই না তার জন্য অপেক্ষা করবে মেয়েটা! সে কি আর এখনো বউ হয়েছে তার। বউ হলে নাহয় অপেক্ষা না করে থাকলে ব্যাপক রাগ করবে। এখন আর রাগ করে কি-ই বা হবে?

রৌদ্র আপন মনে এসব ভেবে ভেবে নিজের রুমে আসে। রুমে ঢুকে প্রথমেই হাতে থাকা এপ্রন আর স্ট্যাথোস্কোপটি ছুড়ে ফেলে বিছানায়। তারপর দুহাত দিয়ে একে একে বাটন খুলতে থাকে শার্টের। শার্টের বাটন সবগুলো খোলা শেষে আলমিরা থেকে টাওয়েল নিয়ে চলে যায় শাওয়ার নিতে।
প্রায় বেশকিছুক্ষনের শাওয়ার শেষে একহাতে চুলগুলো মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে রৌদ্র। কদম ফেলে এগিয়ে আসে ড্রেসিং টেবিলের কাছে। ঠিক তখনি তার নজরে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা একটি গোলাপ আর তার নিচের একটি সাদা কাগজের দিকে।রৌদ্র ভ্রুকুটি করে তাকায় সেগুলোর দিকে। তারপর হাত বাড়িয়ে গোলাপটি একহাতে নিয়ে অন্যহাতে কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করে,

~ ডাক্তারসাহেব! আপনার সঙ্গে আমার ভিষণ জরুরি আলাপ আছে। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আপনার জন্য কিন্তু মহাশয়ের আসার নামগন্ধও নেই! সে যাকগে, আপনি যখনি বাড়িতে আসেন প্লিজ একবার একটু ছাদের চিলেকোঠার ঘরে আসবেন। জানি হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু তবুও জাস্ট একটুর জন্য আসুন নাহয়!
ইতি
(কারো জন্য অপেক্ষারত অষ্টাদশী)
রৌদ্র চিরকুটটা পড়ে দু-কদম পিছিয়ে যায়। পেছাতে পেছাতে হঠাৎ করে খাটের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেখানেই বসে পড়ে। একবার চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালায়। এ মুহুর্তে রৌদ্রের যে শুধু রাগ হচ্ছে তা না,তার যে ভয়ও হচ্ছে।কাওকে হারিয়ে ফেলার ভিষণ রকমের ভয়। রৌদ্র চিরকুটটা হাতে রেখেই দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে। বিড়বিড়িয়ে বলে,

~ আল্লাহ! কি করবো আমি এখন! আমি নিশ্চিত অরি এ মুহুর্তে কি চাইছে কিন্তু আমি কিভাবে এখন কিভাবে এগুলো সামাল দিবো।কিভাবে?
কথাগুলো শেষ করে কোনরকম ধীর গতিতে এগিয়ে যায় ছাদের দিকে। সে প্রতিটি কদম এগোচ্ছে আর তার বুকের ভেতর হার্টবিটটা ঠিক ততবার ফাস্ট হচ্ছে।
প্রায় কিয়ৎক্ষন বাদে রৌদ্র এসে দাঁড়ায় চিলেকোঠার ঘরের সামনে। আশ্চর্য! ঘরটি থেকে কেমন একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। রৌদ্র আবারও চিন্তায় পড়ে যায়। নিজেকে কোনমতে সামলে দরজায় হালকা চাপ দেয়।মুহুর্তেই দরজাটি খুলে গিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি উম্মুক্ত হয় চোখের সামনে। রৌদ্র মিহি স্বরে নিরবতা ভাঙে,
~ অরি! আর ইউ দেয়ার?

ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না। রৌদ্র এবার অধৈর্য হয়। ভ্রুকুঞ্চন করে ঘরে ঢুকে অন্ধকারে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে যায়। সুইচ টিপতেই মুহুর্তেই ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়। রৌদ্র এবার গলায় ঝাঝ এনে যেই না কিছু বলতে যাবে ওমনি সামনের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই সে বাকহারা হয়ে যায়। মুহুর্তের মধ্যে পাল্টে যায় দৃষ্টিভঙ্গি, বুকে উঠে এক মারাত্মক ঢেউ! রৌদ্র ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে অনবরত। উদ্দেশ্য নিজেকে কোনমতে সামলানো কিন্তু সামনে থাকা রমনীর ঝলসানো রুপের মোহে আদৌও কি তা সম্ভব হচ্ছে এই ডাক্তারের পক্ষে! রৌদ্র বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে। ওর এখন বড্ড তৃষ্ণার্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। কি করবে এখন ও! রৌদ্র একবার চোখদুটো বন্ধ করে আবারও মেলে তাকায়। মোহগ্রস্ত নয়নে আপাদমস্তক দেখতে থাকে সামনে দাড়ানো অষ্টাদশীর পানে।যে কিনা এ মুহুর্তে কালো একটি জামদানী শাড়িতে নিজেকে অপরুপ সাজে সজ্জিত করেছে।

কালো জামদানীতে অরিনকে এখন আগের চাইতেও বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে রৌদ্রের কাছে।আচ্ছা এই রুপ এতোদিন কোথায় ছিলো মেয়েটার? সাজেনি কেন এভাবে কোনদিন? কেন আজকেই তাকে এভাবে পাগল করতে উঠেপড়ে লেগেছে মেয়েটা! মেয়েটা কি জানে এ মুহুর্তে রৌদ্রের কি ভয়ংকর বাসনা জাগছে মনে? জানলে হয়তো মেয়েটা লজ্জায় কুকরে যেতো ক্ষনিকেই।

অরিন আজকে নিজেকে অপ্সরাদের সাজে সাজানোর বেশ উদ্যেগ নিয়েছে। এই যে পড়নে তার কালো জামদানী শাড়ি,মুখে হালকা প্রসাধনীর ছাপ,ঠোঁটে আকা গোলাপি প্রলেপ। কোমড় অবধি খোলা চুল, ফ্যানের বাতাসে আবার কিছু অবাধ্য চুল মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে। অরিন সেগুলোকে বারবার কানের পিঠে গুজে যাচ্ছে কিন্তু অবাধ্য গুলো এতোটাই অবাধ্য যে বারেবারে তারা বাঁধনহারা হতে চাইছে। অরিন এবার বেশ বিরক্ত!
সে চুলগুলোকে আর না সরিয়ে সেভাবেই রেখে দেয়।থাকুক বেয়াদবগুলো এভাবেই।
এতক্ষন অরিনের হাত নাড়ানোতে তার হাতে সজ্জিত থাকা কালো কাচের চুড়িগুলো বারংবার টুংটাং শব্দ তুলেছে।চুড়ির শব্দ গুলো অরিনের কানে স্বাভাবিক ঠেকলেও সামনে থাকা মানুষটার বুকে যে-তা তোলপাড় তুলছে সে খবর কি আর অরিন রাখছে? নাহ রাখলো না তো!

রৌদ্র বুঝি কিছুক্ষণ আগের করা রাগ, ভয় সবটাই কেমন ভুলে বসেছে।হয়তো আবারও তার অবচেতন মন হারিয়েছে তার সানশাইনের মোহে।হয়তো আবারও ভুলে বসেছে নিজের অদৃশ্য শিকলকে! রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে আসে অরিনের কাছে। নিজেদের মাঝে সামান্য দুরত্ব রেখে সটান হয়ে দাড়ায় সে। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে নিজের হৃদয়হরনীর দিকে।
আর অরিন? সে-তো এখনো মাথানিচু করে দাড়িয়ে আছে প্রিয় মানুষটার সামনে। ভাব এমন, কেও বুঝি তাকে আদেশ দিয়েছে — এই মুহুর্তে ঘাড় সোজা করলে গর্দান নেওয়া হবে তার!
অরিন বহুকষ্টে মনে মনে সাহস সঞ্চার করে দৃষ্টি ওপরে তুলে। আজকে যে ভয় অথবা লজ্জা পেলে চলবে না তার! ভালোবাসার কথা যে স্বীকার করতেই হবে।

অরিন দৃষ্টি ওপরে তুলতেই দুজনের দৃষ্টির মিলন ঘটে। অপলক তাকিয়ে থাকে দু’জন দু’জনার দিকে। কি আশ্চর্য! দু’জনার কারো মুখেই কোন রা-শব্দ নেই কিন্তু চোখে চোখে যেন রাজ্যের কথা হচ্ছে দু’জনের মধ্যে! অরিন সেদিকে অপলক তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে। তারপর নিজেকে সাহসী করে বলতে শুরু করে,
~ ডাক্তারসাহেব!
রৌদ্রের কি হলো কে জানে? সে মোহগ্রস্ত হয়ে জবাব দেয়,
~ জ্বি!
অরিন বিজয়ী হাসে। তারপর আবারও বলতে থাকে,

~ পৃথিবীতে আমরা খুব কম সময়ের জন্যই আসি ডাক্তার সাহেব। কিন্তু এই কম সময়ের জন্য এসেও আমরা প্রেমে পড়ি,ভালোও বাসি। আবার সেই ভালোবাসা কিন্তু যেই-সেই ভালোবাসা না! সেই ভালোবাসা হচ্ছে এক ভিন্ন হৃদয়ানুভুতি।এক তীব্র হৃদয়ানুভুতি — যেখানে ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। তাকে সবসময় চোখে হারাতে ইচ্ছে হয়। তার সঙ্গে কদমে কদম মিলিয়ে হাটতে ইচ্ছে হয় বহুদূর অবধি। হয়তো সেই অনুভুতিকেই বলা হয় সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি!
এতটুকু বলে অরিন থামে।চোখ দুটো তার টলমল করছে কেমন! সে আবারও লম্বা শ্বাস টেনে বলতে শুরু করে,

~ ডাক্তার সাহেব! জানেন কি? আমি না বৃষ্টিকে ভিষণ পছন্দ করি।যদি কেও আমায় কোনদিন জিজ্ঞেস করে– আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জিনিস কি? তাহলে আমি নির্দ্বিধায় বলবো — বৃষ্টি! কিন্তু এই আমিই আবার বলবো আপনাকে আমি বৃষ্টির মতো পছন্দ করি না।
এ পর্যায়ে রৌদ্রের বুকটা কেঁপে ওঠে। সে কি অরিনের জীবনে ওতোটাও পছন্দের হতে পারেনি?
অরিন এবার যেন বিশ্বজয়ের সাহস সঞ্চার করে আরও কিছুটা এগিয়ে আসলো। নিজ থেকে হাত বাড়িয়ে রৌদ্রের গাল ছুয়ে দিলো।অতঃপর নিরেট দৃষ্টি ফেলে বললো,
~ উহুম! আপনাকে আমি মোটেও বৃষ্টির মতো পছন্দ করি না। বরং তারচেয়েও বেশি করি। যদি জিজ্ঞেস করেন কতটা তাহলে বলবো, বৃষ্টিতো আমায় একবার ছুয়ে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু আপনি? আপনি হচ্ছেন আমার নিশ্বাসের মতো! যতদিন এই নিশ্বাস রবে ততদিন এই দেহে প্রান থাকবে ঠিক তেমনি যতদিন রৌদ্র থাকবে ততদিন অরিনের অস্তিত্বও থাকবে।

ডাক্তার সাহেব! আমি আপনাকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি। হয়তো এতোটা যতটা ভালোবাসলে একটা জীবন স্বাছন্দ্যে পার করে দেওয়া যাবে।
অরিনের ব্যাক্ত করা নিজের অনুরক্তিগুলো একেকটা বুঝি তীরের ফলার মতো রৌদ্রের বুকে এসে বিঁধছে।তার খুব করে ইচ্ছে করছে অরিনকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিতে।কিন্তু সে যে এ মুহুর্তে একেবারেই বাধা।
রৌদ্র নিজেকে শক্ত করে।নিজের গালের ওপর থেকে অরিনের হাতটি সরিয়ে দৃঢ় চোয়াল আরও কিছুটা দৃঢ় করে।অরিন রৌদ্রের হঠাৎ পরিবর্তনে ভড়কে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের দিকে।রৌদ্র অরিনের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে রাশভারী গলায় বললো,

~ অরিন! তুই ছোট থেকেই আমাদের বাড়ির সকলের আদরের। তাই আমরা সবাই তোকে একটু বেশি কেয়ার করি,প্রায়োরিটি দেই। তাই বলে সেই এক্সট্রা কেয়ার করাকে তুই ভালোবাসা বলে মেনে নিবি? এতটুকুও সেন্স অফ হিউমার নেই তোর মধ্যে? কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা কেয়ার এখনো বুঝতে শিখিসনি তুই?
রৌদ্রের বলা প্রতিটি কথায় যেন অষ্টাদশীর বুক ভেঙে খানখান হয়ে ওঠে। কান্নারা এসে ভিড় জমায় চোখের কোনে। অরিন বহুকষ্টে শুকনো ঢোক গিলে কান্না হজম করবার চেষ্টা চালায় কিন্তু নাহ! এ ব্যাপারে যে সে বড্ড কাঁচা। অরিন কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৫

~ আ-আপনি স-সত্যি আমায় ভালোবাসেন না?
তক্ষুনি তার কর্ণগোচর হয় এক দৃঢ় কন্ঠ!
~ না!

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি শেষ পর্ব 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here