সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি শেষ পর্ব
Jannatul Firdaus Mithila
~ আ-আপনি স-সত্যি আমায় ভালোবাসেন না?
জবাবে রৌদ্র কি বলবে এখন? তার যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে এ কথাগুলো বলতে গিয়ে। রৌদ্র টের পাচ্ছে তার গলা কাপছে, সে টের পাচ্ছে তার হৃদয়ের অসহ্য রকমের যন্ত্রণাগুলো। হঠাৎ তার গাল বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়ে একফোঁটা অশ্রু। রৌদ্র সন্তপর্ণে অরিনের অলক্ষ্যে লুকিয়ে ফেলে সে অশ্রু। তারপর গলায় আগের চেয়েও দৃঢ়তা এনে বললো,
~ নাহ! বাসিনা।
অরিনের কাছে মুহুর্তেই চারপাশটা অন্ধকার মনে হলো। তার সারা শরীরে ধরে যায় অসহ্য কাঁপন। কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎই সে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ে।
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে। অরিনকে এভাবে ফ্লোরে বসে পড়তে দেখে দু-কদম এগিয়ে আসে। যে-ই না অরিনকে ধরতে যাবে তার আগেই অরিন তাকে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেয়। কাঁপা কাঁপা গলায় সাবধান করে বললো,
~ ছোঁবেন না আমায়। যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন।আর এগোবেন না।
রৌদ্রের এবার নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। বুকে তার অসহ্য রকমের যন্ত্রণা আর মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে এক অদৃশ্য অমানিশার পরিনাম।
রৌদ্র নিজেকে কোনমতে সামলে বললো
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
~ অরি পাগলামি করিসনা।ওঠ বলছি!
অরিনের কি হলো? সে একথা শোনামাত্র দৃষ্টি তাক করলো রৌদ্রের পানে।সে দৃষ্টি অবলোকন হওয়া মাত্র মুহুর্তেই রৌদ্র থমকে যায়। পিছিয়ে যায় দু-কদম। কি ছিলো সেই দৃষ্টিতে? কি এমন অদৃশ্য ক্ষমতা আছে এই দৃষ্টিতে? যার জন্য রৌদ্রের মত মানুষটাও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো!
অরিনের হরিনি আঁখিদ্বয় কান্নার ফলে হয়ে উঠেছে রক্তবর্ণ। ঠিক যেমন রুপে গোধূলির শেষ লগ্নে পুরো আকাশ রাঙিত হয় ঠিক তেমন! কাজলদীঘীর চোখগুলো অসহায়ত্বে কাজলের রেখাকে কেমন লেপ্টে দিয়েছে সারা কপোলদ্বয়ে। অরিনের তিরতির করে কাঁপা গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ওষ্ঠপুট বড্ড মোহনীয় সৌন্দর্যে রুপান্তরিত হয়েছে এ মুহুর্তে। কিন্তু এ সৌন্দর্য উপভোগ করার পরিস্থিতি কি আর এখন আছে? নেই তো!
অরিন বেশকিছুক্ষন পর দু’হাতে ভর দিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। নিরবতা ভাঙে কাঁপা গলায়।
~ যে আমার না, তার স্পর্শও আমার না।
বলেই আর একমুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে চলে যায় সিঁড়ি ভেঙে নিজ রুমের উদ্দেশ্যে।
অন্যদিকে রৌদ্র! সে-তো এখন অপলক তাকিয়ে আছে ঐ চলে যাওয়ার দিকে। অরিন চক্ষু আড়াল হতেই রৌদ্র চিলেকোঠার ঘরের দরজা ভিতর থেকে লাগিয়ে দেয়। নিজেকে একপ্রকার বন্দী করে নেয় রুমের মাঝে। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ফ্লোরে পড়ে থাকা লাল গোলাপটি (যেটি অরিন এনেছিলো রৌদ্রকে দিবে বলে) সযত্নে হাতে তুলে নেয়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ গোলাপটির দিকে। তারপর সেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কাঁদতে থাকে। রৌদ্র ভিষণ রকমের চেষ্টা করছে যাতে তার কান্নার শব্দ এই ঘর পেরিয়ে বাইরে না যায়। কেননা পুরুষ মানুষদের যে কাঁদতে নেই! তাই বলে কি পুরুষদের কষ্ট হয় না? তাদের কি মন ভাঙে না? হয়তো ভাঙে কিন্তু সে মন ভাঙার কোন আওয়াজ হয়না!
রৌদ্র নিজের শার্টের হাতায় চোখগুলো মুছে। কিন্তু পরমুহূর্তে তা আবারও ভিজে উঠে। রৌদ্র এবার ফ্লোরে বসে থাকা অবস্থায় নিজের বুকে হাত রেখে বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,
~ মাফ করে দে সানশাইন! মাফ করে দে।
এদিকে চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অরিন নিজের রুমে দরজা আটকিয়ে, দরজার সামনেই পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। বুকের ভেতরটা কেমন তীব্র ব্যাথায় জর্জরিত তার। নিশ্বাস ফেলতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে এ মুহুর্তে। অরিন দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে বলতে থাকে,
~ এত বড় ভুল কি করে করলাম আমি? কি করে কেয়ারনেস আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারিনি আমি? কেন বুঝতে পারিনি রোদ ভাই আমায় ভালোবাসেন শুধুই কাজিন হিসেবে। আমি কেন বুঝিনি আমার কোন অস্তিত্ব নেই তার মন পিঞ্জিরায়। কেন? কেন? কেন?
বলেই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। ভাগ্যিস ঘরটা সাউন্ড প্রুফ তা নাহলে কি যে হতো!
অরিন কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে।শাড়ির আচঁল খুলে পড়েছে ইতোমধ্যে।সুন্দর পরিপাটি চুলগুলোর যাচ্ছে-তাই অবস্থা। কিছুক্ষণ আগের লজ্জায় রাঙা মুখের আদলটি এখন ছেয়ে গিয়েছে ঢের বিষাদের ছায়ায়। চোখ-মুখ অতিরিক্ত কান্নার তোড়ে লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। অরিন এবার চিৎকার থামিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,
~ এত কষ্ট হচ্ছে কেন বুকটায়! উফফ! খোদা, এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমি কি এখন মরে যাবো? এই কষ্ট কি মরন কষ্ট আমার!
এমন হাজারো আহাজারি করতে করতে সেদিনের রাতটা অরিন নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। শুধু কি সে? আরেকটা মানুষও যে তারই মতো অশ্রু কে সঙ্গী করে কাটিয়েছে নির্ঘুম রাত।
পরদিন সকালবেলা 🌸
আজকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলকেই একসঙ্গে খেতে বসার জন্য বলা হয়েছিল গতকাল রাতেই। কেননা আজকে রুহি আর রেহানের বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে রেহানের পরিবার আসবে এহসান বাড়িতে। বাড়ির যেকোনো ছোট -বড় বিষয়ে একসঙ্গে বসে আলাপ করাটাও যেন এহসান বাড়ির সদস্যদের অন্যতম গুন। কবির সাহেবের আদেশ মোতাবেক সকলেই উপস্থিত হয় ডাইনিং টেবিলে। আহি-মাহি ও ঘুমু ঘুমু চোখে উপস্থিত হয়। আর বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য পুতুল! তিনি চোখ ডলতে ডলতে চেয়ার টেনে বসে বারবার ঢুলে পড়ছেন ঘুমে। তার পাশের চেয়ারে বসে রুহি তাকে আদর করছে। রুহি পুতুলের কানে ফিসফিস করে বললো,
~ পুতুল সোনা, এতো সকালে উঠতে গেলে কেন?
পুতুল চোখ ডলা অবস্থাতেই বললো,
~ উহু,সবার সাথে খাবো তাই।
রুহি তার কথায় মুচকি হাসে।পুতুলের ফোলা ফোলা গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বসে। তখনি পুতুল সকল তন্দ্রা কাটিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে,
~ এই তোমাদের মেয়েদের এক জ্বালা! কথায় কথায় আমাদের মতো কিউট পিউট ছেলেদের গাল ভিজিয়ে দাও। কি এক্টা অবস্থা! আবারও গালটা ধুতে হবে।
পুতুলের মুখে এসব শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয় রুহি। কি বললো ছেলেটা? ও তার গাল ভিজিয়ে দিয়েছে?
রুহি এবার পুতুলের গাল টেনে বললো,
~ বাহ! বেশ কথা শিখেছেন মনে হচ্ছে সাহেব! তা এতো পাকা পাকা কথা শিখলেন কবে শুনি?
পুতুল রুহির হাত থেকে নিজের গাল ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ ভাব দেখিয়ে বললো,
~ হু! পাকা কথা শিখতে হবে কেন? আমি এমনেতেও বড্ড বুদ্ধিমান। ইউ নো দ্যাট রাইট!
রুহি যারপরনাই অবাক হয়। ভাবা যায় তার হাটুর বয়সী ভাইটা কতো কথা শিখেছে!
রুহি আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করলো।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর সেখানে রৌদ্র এসে উপস্থিত হয়। সকলেই রৌদ্রকে দেখে কিছুটা অবাক হয় কেননা সবসময় পরিপাটি থাকা ছেলেটা আজকে কেমন অগোছালো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কপাল অবধি। চোখে চশমাটি আজকে অনুপস্থিত। যার ফলে লাল হয়ে থাকা চোখ গুলো মোটেও চক্ষু এড়ায় না কারো। শার্ট পড়েছে তাও ইন করা নেই। দেখলে যেকেউ বলতে পারবে ছেলেটা সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে।
বাড়ির সকলের দৃষ্টি এখন রৌদ্রের ওপরে।জুবাইদা বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলেন।ছেলের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললেন,
~ বাবা! শরীর খারাপ লাগছে তোর? চোখ-মুখের এ অবস্থা কেন?
মায়ের কথায় রৌদ্র মৌনতা ভেঙে নরম গলায় বলল,
~ নাহ, তেমন কিছু না জাস্ট একটু মাইগ্রেনের ব্যাথা হচ্ছে।
জুবাইদা বেগম ছেলের জন্য মুহুর্তেই বিচলিত হয়ে ওঠলেন। মায়ের এমন অস্থিরতা দেখেও রৌদ্র আজকে কেমন ভ্রুক্ষেপহীন। তার ব্যস্ত আঁখি যুগল একবার পুরো ডাইনিং জুড়ে বিচরণ করে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুখাবয়বকে না দেখতে পেরে আশাহত হয়। রৌদ্র কোনমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে খাওয়া শুরু করে।
এরই মাঝে কবির সাহেব হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে সকলের দৃষ্টি নিজের ওপর আনে।তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলতে থাকেন আজকের পরিকল্পনাগুলো। সকলেই বেশ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলেও রৌদ্রের যেন সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে-তো ডুবে আছে নিজের ভাবনায়।কবির সাহেব কথা বলার একফাঁকে অন্যমনস্ক
হয়ে থাকা ছেলেকে দেখলেন। কথা বলার মাঝেই তার কপালে দৃশ্যমান হয় গুটি দুয়েক ভাজ। কবির সাহেব এবার নিজের কথা থামালেন। রাশভারী গলায় ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
~ রোদ! তুমি কি কিছু শুনেছো?
বাবার ডাকে তৎক্ষনাৎ সৎবিৎ ফিরে পায় রোদ। হতবাক হয়ে বলতে থাকে,
~ হু? কিছু বললে?
ছেলের এমন বেখেয়ালি আচরণে কিছুটা বিরক্ত হন কবির সাহেব। তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে কিছু বলতেই যাবেন তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে সাব্বির সাহেব বললেন,
~ ভাইজান, আমার মনে হয় রোদের শরীরটা আজ একটু বেশিই খারাপ। দেখোনা ছেলেটার চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে আছে! তুমি বরং ওর ভাগের কাজগুলো আমাদের আর অনিককে দিয়ে দাও। আমরাই করে ফেলবো ঠিকঠাক।
কবির সাহেব আর কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। একবার আড়চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। দেখলেন, সত্যি ছেলেটার চেহারা একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে আছে। কবির সাহেব মনে মনে ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেললেন। গম্ভীর গলায় শুধালেন,
~ শরীর যখন এতটাই অসুস্থ তাহলে আজকে হসপিটালে না গেলেই পারো! রেস্ট করো বাসায়।
কবির সাহেবের কথাকে বড্ড নরম সুরে উপেক্ষা করে রৌদ্র। বললো,
~ নাহ, তার প্রয়োজন নেই।আ’ল মেনেজ।
কবির সাহেব ছেলের কথায় আবারও আড়চোখে তাকালেন। অতপর মুখভঙ্গি আগের ন্যায় করে শুরু করলেন বাকি কথাবার্তা।
~ রাফু, দেখ না ভাই, মিষ্টিটা কি ঠিক আছে?
~তোকে আর কতবার বলব জবা সবটাই ঠিক আছে। তুই এতো টেনশন করছিস কেন বলতো? আজকে রুহির বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে একেবারে বিয়ে হয়ে যাবে না।
রাফিয়া বেগমের করা কৌতুকে রান্নাঘরে উপস্থিত বাড়ির বাকি দু বউ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। জুবাইদা বেগম কৃত্রিম মুখ ফুলিয়ে বললো,
~ যাহ! তুইও না। একটা স্কোপ ছাড়িস না আমার কান টানার।
রাফিয়া বেগমসহ বাকিরা আবারও হেসে ওঠে। মাইমুনা বেগম কোনরকম হাসি থামিয়ে বললো,
~ বড়বু, বলি কি তুমি নাহয় রান্নাটা বাদ দাও। আমি আর মেজোবু মিলে সবটা সামলে নিবো।
~ আরে না না। কি বলিস! আমি চলে গেলে এতোকিছু একা হাতে সামলাবি কি করে তোরা? দরকার নেই বাপু।একসঙ্গে হাতাহাতি সবটা করে ফেলি বরং।
কথাগুলো বলে আবারও চারজন মিলে মেহমানদের জন্য খাবার প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
বিকেল ৫ টা🌸
রৌদ্র বাড়িতে এসেছে প্রায় আধঘন্টা হতে চললো অথচ একবারও অরিনটা তার সামনে পড়লো না। আচ্ছা মেয়েটা কি খুব কষ্ট পেয়েছে গতকালকের ব্যাবহারে? সময়ের সাথে সাথে অরিনকে একপলক দেখার তৃষ্ণাও কেমন বেড়ে চলছে রৌদ্রের।মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে অরিনকে না দেখলে হয়তো বুক ফেটে মরে যাবে ও। রৌদ্র নিজেকে আর সামলাতে পারে না। ধৈর্যের বাঁধ একেবারে শূন্যের কোঠায় পৌছে গেছে ছেলেটার। রৌদ্র হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসে। এদিক-ওদিক হন্য হয়ে খুজতে থাকে অরিনকে।কোথাও না পেয়ে আবারও সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যায় ছাঁদে। কিন্তু নাহ! এখানেও অরিন নেই। রৌদ্র এবার ভেবে নেয়, অরিন হয়তো তার রুমেই আছে। তাই সে ব্যস্ত পায়ে ছোটে অরিনের রুমের দিকে। অরিনের রুমের দরজার সামনে এসে রৌদ্রের বুঝি আর ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার নবে মোচড় দেয়।মুহূর্তেই লকটি খুলে গিয়ে ঘরের ভেতর উম্মুক্ত হয়। কিন্তু রৌদ্রকে অবাক করে দিয়ে ভেতরেও কোথাও অরিনের টিকিটাও নেই। রৌদ্র আশাহত হয়ে নিচে নামে। আলগোছে ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসে। মুখখানায় তার রাজ্যের আধার নেমেছে যেন। রৌদ্র কি মনে করে বুক ফুলিয়ে তার মেজো মা’র কাছে যায়। রাফিয়া বেগম রান্নাটা সেড়ে কেবলই ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে কেবল ওমনি তার সামনে সটান হয়ে দাড়ায় রৌদ্র। রাফিয়া বেগম রৌদ্রকে সামনে পেয়ে মুচকি হাসেন। গায়ে আদরের হাত বুলিয়ে বলেন,
~ বাবা! শরীরটা এখন কেমন লাগছে তোর?
রৌদ্র একথার কোনরুপ জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করে,
~ মেজোমা, অরিকে কোথাও দেখছি না যে? কোথায় ও?
অরিনের কথা শুনে রাফিয়া বেগমের মুখটা ছোট হয়ে আসে। চোখের কোনা কেমন চিকচিক করে ওঠে সাথে সাথে। রৌদ্র সবটা খেয়াল করে বললো,
~ কি হলো?
রাফিয়া বেগম হঠাৎই কেমন করে বলতে লাগলেন,
~ জানিস বাবা! মেয়েটা বুঝি আমার বড্ড হয়ে গেছেরে। এই দেখ না, কয়েকদিন আগ অবধি যে মেয়েটা নিজের পেটের কথাগুলো আমায় না বলা পর্যন্ত শান্তি পেতো না সেই মেয়েটা আজ কেমন কথা লুকাতে শিখে গেছে। লুকাতে শিখে গেছে নিজের ভেতরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানগুলো।
রাফিয়া বেগমের কথা সম্পূর্ণ বোধগম্য হয়না রৌদ্রের। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার মেজো মা’র দিকে। শুনতে পায় তার আরো কিছু কথা।
~ জানিস বাবা,আজকে সকালে কি হয়েছে?
বলেই তিনি বর্ননা করতে থাকেন সকালের ঘটনাগুলো।
~ অরি! বেলা কয়টা বাজে সে খেয়াল কি তোর আছে? এখনো খেতে আসলি না কেন হ্যা? তার ওপর সেই কখন থেকে দরজা নক করছি খোলার নাম অবধি নিচ্ছিস না। বলি কি হলো? আজকে কি দরজাটা খুলবিনা?
দরজার বাইরে দাড়িয়ে একাধারে হাঁক ছেড়ে কথাগুলো বললেন রাফিয়া বেগম।মেয়েটাকে নিয়ে তিনি আর পারেন না! সেই কখন থেকে ডাকছে অন্তত একটা রেসপন্সতো করবে তাই না? কিন্তু নাহ! মহারানী কি আর এই অধমের কথা শুনবে?
রাফিয়া বেগম এবার উদ্যত হন দুটো কড়া কথা শোনাতে কিন্তু তখনি খট শব্দ তুলে দরজা খুলে দেয় অরিন। রাফিয়া বেগম যেইনা কিছু বলতে যাবে ওমনি তার নজর পড়ে মেয়ের ফ্যাকাশে মুখের দিকে। তৎক্ষনাৎ তিনি আঁতকে ওঠেন। ব্যাকুল হয়ে মেয়ের গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,
~ অরি! কি হয়েছে মা? শরীর খারাপ করেছে?
অরিন কিছু বললো না।একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে, তার হাতটি টেনে এনে বিছানায় বসায়। তারপর কোনরূপ শব্দ না করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে অরিন।রাফিয়া বেগম মেয়ের কান্ডে অবাকের চেয়ে চিন্তিত হন বেশি। মেয়ের খোলা চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে আওরায়,
~ কি হয়েছে তোর? মা’কে বলবি না?
অরিন ধরে আসা কন্ঠে থেমে থেমে বলতে লাগলো,
~ আম্মু আমার না ভালো লাগছে না কিছু। কেন লাগছে না? — এই প্রশ্নটা করোনা প্লিজ,আমি হয়তো উওর দিতে পারবো না। আচ্ছা আম্মু আমরা কেন নিজেদের আবেগকে ঠিকমতো সামলাতে পারিনা? কেন নিজেদের মনকে সামলাতে পারিনা?
রাফিয়া বেগম নির্বাক হয়ে মেয়ের কথা শোনেন। আজ তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন, মেয়েটা যে তার আর ছোট নেই।বড্ড বড় হয়ে গিয়েছে। রাফিয়া বেগম মেয়ের মাথায় যত্নের সাথে চুমু খান।অতঃপর বলতে লাগলেন,
~ হয়তো সবটাই তোমার বয়সের ঝোক অরি। আসলে এখানে তোমাদেরও দোষ নেই কেননা এই বয়সে এরম আবেগ আসা যে একদম স্বাভাবিক কিন্তু প্রতিবার যে এই বয়সের আবেগ সঠিক হবে এমনটা কিন্তু নয়।কিছু কিছু সময় আমরা আমাদের চোখের ভালো লাগাকে নিজেদের মনের আবেগ বলে মেনে নেই। তাই এই বয়সের ঝোকে পড়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত।
অরিন মায়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। মনে মনে ভাবছে, হয়তো রোদের প্রতি তার ফিলিংসটাও নিতান্তই বয়সের ঝোঁক! অরিন এবার মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে আসা কন্ঠে বলে,
~ আম্মু আমি কিছুদিন নানাবাড়িতে যেতে চাচ্ছি।প্লিজ এবার আর না করোনা! আমি সত্যিই একটু কোথাও ঘুরতে যেতে চাচ্ছি। অন্তত এতে যদি মনটা একটুখানি ফ্রেশ হয়।
রাফিয়া বেগমের সাহসে আজ আর কুলোয় না মেয়েকে না বলতে। তিনি মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে সম্মতি দিলেন। অরিনও চোখ বুজে পড়ে রইলো মায়ের কোলে।
~ তারমানে অরি বাড়িতে নেই?
রৌদ্রের করা প্রশ্নে রাফিয়া বেগম মাথা ঝাকায়। তারপর আর কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে চলে যান তিনি।
এদিকে অরিনের চলে যাওয়া যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা রৌদ্র। সে বুঝি থমকে গিয়েছে সেখানেই। বারেবারে তার মনে হচ্ছে, এই বুঝি সে অরিনকে হারিয়ে ফেললো।
নাহ আর ভাবতে পারছেনা রৌদ্র। সে গটগট পায়ে ছুটে যায় নিজের রুমে।কোনরকম নিজের রুমে পৌঁছে দরজা লাগিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে অনবরত। সে বেশ বুঝতে পারছে অরিন তার ওপর অভিমান করে চলে গিয়েছে। রৌদ্র নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কিন্তু না, এ মুহুর্তে রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। রৌদ্র চোয়াল শক্ত করে সারা ঘরময় পায়চারি চালায়। তবুও রাগ বুঝি কমবার নাম নেই। তাই শেষমেষ উপায় না পেয়ে রৌদ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অনবরত দেয়ালে ঘুষি মারতে থাকে আর মুখ দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে,
~ এতো অভিমান তোর সানশাইন? এতটা অভিমান! কি করে এই অভিমান ভাঙাবো আমি? কি করে ফেরাবো তোকে?
বেশ কয়েকটা ঘুষি মারার পর রৌদ্র থামে। হাতটা তার একেবারে থেতলে গিয়েছে ঘুষির প্রকোপে। তবুও বান্দার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আবারও নিজের চুল খামচে ধরে বলতে থাকে,
~ ভালোবাসবি আর কষ্ট পাবিনা তা কিকরে হয় সানশাইন? আমি, আমি যে এক জলন্ত আগুনরে। আমার ভালোবাসার আগুনে নিজ থেকে দগ্ধ হতে এসেছিস তুই, তাহলে এতো সহজে তোকে ছাড়ি কি করে বলতো?
তারপর রৌদ্র নিজের চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় নিজের ফোনের কাছে। অতঃপর লক খুলে অরিনের একটি ছবি নিজের সামনে ধরে বাঁকা হেসে বললো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি পর্ব ২৬
~ এত্তো সহজে তোকে ছাড়ছি না সানশাইন! যেখানে তুই নিজে থেকে আমায় ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছিস সেখানে তোকে ছাড়ার তো প্রশ্নই আসে না! এতোদিন রৌদ্রের কেয়ার দেখেছিস কিন্তু এবার থেকে রৌদ্রের পাগলামি দেখবি। আই রিপিট আমার পাগলামি দেখবি মিসেস ইফতেখার এহসান রৌদ্র।
বলেই বাঁকা হাসলো রৌদ্র।
সত্যিই কি অরিন আবারও ফিরবে রৌদ্রের জীবনে? সত্যিই কি পূর্নতা পাবে তাদের ভালোবাসা? এহসান বাড়ির অদৃশ্য শেকল ছাড়িয়ে পারবে কি তারা নিজেদের ভালোবাসাকে জয় করতে? নাকি আবার হারিয়ে যাবে এ ভালোবাসা পরিবারের তুচ্ছ কিছু নিষেধাজ্ঞার প্রাচীরে?
জানতে হলে চোখ রাখুন #সঙ্গীন_হৃদয়ানুভুতি দ্বিতীয় খন্ডে।