প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৬
সাইয়্যারা খান
তৌসিফ আজ বাইরে যাবে। ফিরবে আগামী কাল। কাজের জন্য প্রায়ই তার শহরের বাইরে অথবা দেশের বাইরে যেতে হয়। বিয়ের তার তিনদিন কেটেছে মাত্র। বউ নিয়ে ঘুরাঘুরি করার সময় অথচ তৌসিফের বন্দরে জাহাজ এসেছে একটা, পুরো নতুন। এটাকে বছর দুইয়ের জন্য একটা কম্পানি সাইন করতে চাইছে। সেই কাজের বিষয়েই তৌসিফ যাচ্ছে চট্টগ্রাম। সরাসরি না দেখে কাজ করাটা সে পছন্দ করে না। তয়েফা শুনেই চরম এক ধমক দিয়েছে। তার কথা যাবে যাও কিন্তু বউ নিয়ে যাও। তৌসিফ জানে, বুঝে আপা কেন বলছে কিন্তু নিয়েই বা লাভ কোথায়? তৌসিফ সারাদিন থাকবে এদিক ওদিক। বউ থাকবে কই?
সেই হোটলে? তাহলে এতদূর টেনে নিয়ে লাভটা কোথায়? তায়েফার সাথে কথা বলেই তৌসিফ এসেছে নিজের ফ্ল্যাটে। পৌষ গুনগুন করে গান গাইছে আর রান্না করছে। না, গুনগুন বললে তো ভুল হবে। তৌসিফ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ওর গান। অদ্ভুত এক মেয়ে এই পৌষরাত। এই ভালো তো এই মন্দ। তৌসিফ যাওয়ার আগেই বিশাল এক ঝগড়া সমাধান করে গিয়েছে। মিনুর সাথে আবার লেগেছে ওর। পৌষ জোরে দুটো ধমক দিয়ে মিনুর থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে কারণ সরূপ বলেছে মিনু নাকি তাকে হুমকি দিয়েছে তার ওর বোন আসবে। তখন নাকি পৌষকে দেখে নিবে। সেই যে পৌষ ক্ষেপেছে রাগ পড়েছে বহু পরে। তৌসিফ সেই রাগ ভাঙিয়েই না তায়েফাকে দেখতে গেলো। ঐ দিকে নাকি তাহিয়াকে তিশা জানিয়েছে মেঝ ভাইয়ের বাড়ী আর যাবে না। ভাই পর হয়ে গিয়েছে। তৌসিফ শুনেও তেমন কিছু বলে নি। তিশা না আসার মেয়ে না। ছোট বলে যা খুশি তা করবে তা তো মানা যায় না।
তৌসিফ সোফায় বসেই ডাকলো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পৌষরাত?”
পৌষ হাতে খুন্তি নিয়েই এগিয়ে এসেছে। ঘর্মাক্ত মুখটা দেখেই তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এই গরমে তুমি রান্না ঘরে এত কি করছো?”
“পেরেম করছি। পেরেম।”
ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে হেসে পৌষ উত্তরটা দিলো। তৌসিফ মনে মনে অবাক হলো। এই মেয়ে একটা বাদর। তৌসিফ বেশ শান্ত ভাবেই বললো,
“সেটা করতে রান্নাঘরে যেতে হয়? আমি তো এখানে। প্রেম করলে কাছে এসো।”
তৌসিফ হয়তো ভেবেছিলো পৌষ লজ্জা-টজ্জা পাবে কিন্তু হায়, তৌসিফ কি জানে তার বউ লজ্জার ধার ধারে না। বসা অবস্থায়ই জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কিছু লাগবে? লাগলে বলো। আমি তো শহরের বাইরে যাচ্ছি।”
পৌষের মুখের ভঙ্গি বদলায় নি। ওভাবেই বললো,
“ভালো মতো ফিরে আসবেন তবে আমার কিছু লাগবে।”
চোখেই জিজ্ঞেস করে তৌসিফ কি লাগবে। পৌষ একই ভাবে বললো,
“আমার ক্লাস চলছে। তিনদিন যাওয়া হচ্ছে না। আমাদের নাম্বার কাটা যায়। পড়াশোনা করতে যদি নিষেধ করলে সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ঝুলিয়ে রাখাটা খুবই বিরক্তিকর।”
তৌসিফ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। কথাগুলো শুনে আরেকটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। গা এলিয়ে দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই পৌষ দৌড়ে চলে গেলো। তৌসিফ বুঝলো কিছু রান্না করছে ও। এমনটাই অবশ্য চাইছিলো সে। কেউ একজন ঘুরে বেড়াবে ঘরের আনাচে-কানাচেতে। বাস্তবতা কল্পনা থেকে সামান্য ভিন্ন তবে সুন্দর। সম্মুখে থাকা এই পৌষরাতটাতো আরো বেশি সুন্দর। পৌষ ফিরে এসেছে। হাতে বাটি আর চামচ। তৌসিফ বুঝে নি ওর জন্যই যে এনেছে। এগিয়ে দিলো পৌষ তা তৌসিফের দিকে। তৌসিফ তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ফিরনি তৌসিফ খায় না বহু বছর। ছোট বেলায় মা বিশেষ বিশেষ দিনে রান্না করতো। বড় হতে হতে জীবনটা এমন ভাবে মোড় ঘুরালো যে এমন ক্ষুদ্র খাবারে থাকা আনন্দ গুলো মিলিয়ে গেলো দূর কোথাও। পৌষ তাড়া দিলো,
“খাচ্ছেন না কেন?”
“আমি ডায়েটে আছি…”
“ধুর মিয়া। ডায়েট করবেন কেন? আপনাকে কি দেখতে আসবে? নাকি আপনার জামাই আছে যাকে জিরো ফিগার দেখাতে হবে? খান তো।”
চামচ ডুবিয়ে দিলো ফিরনিতে পৌষ। তৌসিফ ওর কথায় পরে খেতেই ভুলে গেলো। পৌষ খায়িয়ে দেওয়ার মতো মেয়ে না। তৌসিফ এক চামচ মুখে দিয়েই বুঝলো চমৎকার স্বাদ। বাকিটা ও ওমনিতেই খেতো কিন্তু পৌষের কথায় কথার খেই হারিয়েছে সে। খেতে খেতেই বললো,
“আমার আম্মু এভাবে রাঁধে বুঝলে পৌষরাত। বুয়াকে গত বছর রান্না করতে বলেছিলাম, এত দুধ দিয়েছে। খুব পাতলা ছিলো।”
“দুধ তো বেশিই দিতে হয় কিন্তু শুকাতে হয়। শুকালেই ঘন হয়।”
“তুমি পিঠা বানাতে পারো?”
“পুলি পিঠা বাদে সব বানাতে পারি।”
“ওটা কেন পারো না?”
“কারণ ওটা আমার প্রিয়।”
তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। পৌষ হাসলো। এই পুলি পিঠা কবে খেয়েছিলো ও জানে না। কিন্তু কেন জানি ওটা ওর খুব প্রিয়। পাশের বাসার চাচি একবার দিয়ে গেলো ছয়টা। পৌষকেই দিয়েছে কিন্তু পৌষ নিজে খেয়েছে একটা বাকিগুলো ভাই-বোনদের দিয়েছে। বাসায় শীত আসলেই পিঠা বানালে পৌষই হাতে হাতে করে বেশি কিন্তু ঐ পিঠা গুলো খেতে পারে না। পিঠা ততটা পছন্দই না ওর। দুই একটা যা মজা লাগে তা বাসায় বানায়ই না। বিশেষ করে পুলি পিঠাটা। একবার তো পৌষ বললোও যাতে পুলি বানায় কিন্তু বড় চাচি সরাসরি না করে দিলো। কে করবে এত ঝামেলা। পৌষ তার পরও কয়েকবার বলেছে। কেউ বানিয়ে দেয় নি। এগুলো অনেক আগের কথা। তখন ইনি, মিনিও হয় নি। তৌসিফের ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো,
“খুব মজা হয়েছে হানি।”
পৌষ তাকালো। মুখটা বিমর্ষ দেখাচ্ছে। তৌসিফের হাত থেকে বাটিটা নিয়ে চলে গিয়ে ফিরে এলো পানি নিয়ে। গ্লাস পাশে রেখে তৌসিফ ওকে বসালো নিজের পাশে। পৌষ মাথাটা নিচু করে রেখেছে। বসেছে একটু দূরত্ব রেখে। তৌসিফ ওকে খেয়াল করে দেখলো। জিজ্ঞেস করলো,
“মন খারাপ?”
পৌষ হেসে ফেললো। ও এটাই করে। এসআ কারণেই কেউ ওর অবস্থা টের পায় না। মন খারাপেও হাসে, কষ্টেও হাসে। তৌসিফ আমলে নিলো না। বললো,
“হেমন্ত ফোন দিয়েছিলো গতকাল। দেখা করতে আসবে।”
“না করে দিন।”
“তোমার প্রিয় ভাই সে।”
“হ্যাঁ। আমার ছয় ভাই-বোনই আমার খুব প্রিয়। আদরের।”
“ওদের জন্য মন খারাপ?”
“জানি না। আমার মন খারাপ না।”
“দেখে মনে হচ্ছে।”
“চোখের ভুল।”
“আমার খুব বিচক্ষণ চোখ পৌষরাত।”
“খুব ভালো। সেই চোখ রাজদরবারে পেশ করা হোক।”
বলেই ফিক করে হাসলো পৌষ। তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। বললো,
“আমি কাজটা সেরে ফিরে আসি এরপর থেকে ক্লাস শুরু করো আর হ্যাঁ, ও বাড়ী তোমাকে আপাতত যেতে দিচ্ছি না তবে ওদের নিয়ে আসব।”
“তার প্রয়োজন নেই। ওদের আনা লাগবে না। মায়া কেটে যাক, আপনাআপনি ভুলে যাবে।”
“তুমি ভুলে যাবে?”
“সেটাতে কারো যায়-আসে না। পৌষের অত সময় নেই কাউকে মনে রাখার।”
তৌসিফকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পৌষ বললো,
“আপাকে ডেকে আনুন। বলুন ফিরনি রেঁধেছি।”
“বেশি রেঁধেছো?”
“ততটাও না।”
“বেঁচে গেলে আমার জন্য দিয়ে দিও। রাস্তায় খাব।”
পৌষ মাথা নেড়ে চলে গেলো। নিজে না খেয়ে সেটুকু তৌসিফের জন্য তুলে রাখলো। পেটের মধ্যে এক ঝাঁক সুখ প্রজাপতি উড়ছে। এদিক ওদিক ডানা মেলে যাচ্ছে। তৌসিফ বলেছে ফিরে এসেই দেখা করাবে। পৌষ এখনই ভাবছে ওদের জন্য কি কি রাঁধবে। একটু আবদারও ধরবে যাতে ওদের থাকতে দেয়। ইশ, পৌষের খুশিতে কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কবে যাবে আর কবেই বা আসবে তৌসিফ তালুকদার?
নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৌসিফ নিজে তৈরী হচ্ছে। পৌষ ওকে দেখতে মনোযোগ দিয়ে। প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ পৌষ অবশ্য দেখেই যাচ্ছে। একটা মানুষ তাও কি না পুরুষ মানুষ, সে এতটা রংঢং করে তা জানা ছিলো না পৌষের। যেখানে পৌষ সাবান দিয়ে মুখ এক ডলা দিলেই ঝকঝক করে সেখানে তৌসিফ নানান জিনিস মাখছে, ডলছে, ঘষছে আবার টেনে তুলছে। পৌষ অধৈর্য হয়েও ধৈর্য ধরে দেখছে। মনে মনে ছোট্ট খাটো গালিও দিয়েছে ‘শালা’ বলে।
পা দুটো দুলাতে দুলাতে পৌষ গান গাইছে,
“নয়নের-ই ভান দিয়ে গো
যৌবনের দোল দিয়ে গো
নয়নের-ই ভান দিয়ে গো
যৌবনের দোল দিয়ে গো
নুপুরেরও তালে তালে তোমায় আমি বেঁধেছি
জানি গো, জানি ওগো তোমারে যে বেঁধেছি
আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি
সবার চোখে রং লাগিয়ে
সবার মনে ঢেউ জাগিয়ে
সবার চোখে রং লাগিয়ে
সবার মনে ঢেউ জাগিয়ে
নতুন দেশের পথে আমি আজকে আবার চলেছি
জানি গো, জানি সবার মনকে নিয়ে চলেছি।”
তৌসিফ অবাক চোখে তাকালো। পৌষ দাঁত বের করে হেসে বললো,
“আমি আপনার জামাই হলে উষ্টা দিয়ে আমার সংসার থেকে বের করে দিতাম। আপনার কপাল কিন্তু খুব ভালো কারণ আমি আপনার বউ, জামাই না।”
বোকা বনে গেলো তৌসিফ। পৌষ আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“তারাতাড়ি করুন। কোমড় ব্যথা হয়ে গেলো।”
“একটু হাটাহাটি করো।”
“ধ্যাত।”
তৌসিফ চুল শ্যাট করে এগিয়ে এলো। পৌষের মাথায় হাত দিয়ে নরম স্বরে বললো,
“সাবধানে থাকবে। ফোন দিলে ধরবে। সময় মতো খাবে। বাড়ীর বাইরে যাবে না। মনে থাকবে?”
পৌষ মাথা নেড়ে বলে,
“সাবধানে যাবেন।”
“আচ্ছা।”
দু’জন বেরিয়ে এসে তায়েফাকে দেখলো। পৌষ দুই লাফে ওর কাছে গিয়ে বললো,
“এত দেড়ী কেন আপা?”
“একটু চাচির কাছে গিয়েছিলাম সোনা। তুসু, সাবধানে যাবি। আমাকে ফোন দিবি।”
“দেব আপা।”
পৌষ বুয়া দিয়ে আলাদা একটা ব্যাগ পাঠাতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,
“এটা কেন?”
পৌষ গমগমে গলায় জানায়,
“এটায় খাবার আছে। বাইরের খাবার আজ খেতে হবে না।”
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ২৫
কপালে তিনটা ভাজ অথচ লুকায়িত এক হাসি তৌসিফের ঠোঁটে। বিদায় নিয়ে ও চলে গেলেও বারান্দা দিয়ে পৌষ দেখলো। ঘাট পেড়িয়ে মূল সড়কের পুরোটা সময় দেখলো পৌষ। মিলটার দিকে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। এটা তুহিনের নিজস্ব। ওর কথা মনে পরতেই আবার পলকের কথা মনে পরলো। পৌষ পা নাচাতে নাচাতে ভেতরে ঢুকলো। মনটা খুব খুশি। তৌসিফ নেই। পৌষ স্বাধীন। এখন সারাক্ষণ এদিক ওদিক গেলেও সমস্যা নেই। তৌসিফ বলেছে বাড়ীর বাইরে না যেতে কিন্তু ফ্ল্যাটের বাইরে যেতে তো আর নিষেধ করে নি।