সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩
Jannatul Firdaus Mithila
~ হুশ! কাঁদেনা জানবাচ্চা! এইতো আমি। আমি থাকতে তোর কিসের ভয় শুনি?
অরিন কি শুনলো সবটা? হয়তো শুনলো! এই যে কেমন চুপটি করে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে রৌদ্রের বুকে।ভাব এমন, এই মুহুর্তে এর চেয়ে বেশি সুরক্ষিত জায়গা হয়তো পৃথিবীতে আর একটিও নেই!
রৌদ্র কিছুক্ষণ একহাতে অরিনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দেয়। অন্যহাত এখনও অরিনকে বুকের মাঝে সযত্নে চেপে রেখেছে। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হবার পর কারেন্ট চলে আসে। আলো চলে আসায় অরিন নিজের সৎবিৎ ফিরে পায়।পরক্ষণেই নিজেকে রৌদ্রের বুকে লুকিয়ে থাকতে দেখে থমকায় মেয়েটা। শুষ্ক ঢোক গিলে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে দুহাতে সজোরে ধাক্কা দেয় রৌদ্রের বুকে। হঠাৎ আক্রমনে রৌদ্র পেছন দিকে হেলে পড়ে।তারপর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অরিনের দিকে।
অরিন রৌদ্রকে কিছু না বলে মেঝে ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে। অতপর এক মুহূর্ত কালবিলম্ব না করে ছুটে পালায় রৌদ্রের দৃষ্টির সীমানা হতে।
অরিনের এমন ছুটে পালানোতে রৌদ্র হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সম্পূর্ণ বিষয়টা বোধগম্য হবার পর আনমনে হেসে ওঠে। বুঝতে পারে, মেয়েটা তাহলে লজ্জা আর অস্বস্তিতে এরম করে ছুটে পালালো। রৌদ্র গা ঝাড়তে ঝাড়তে মেঝে ছেড়ে উঠে দাড়ায়। নিজের হাত ঘড়িটাকে ঠিক করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
~ আজকে নাহয় এটুকুতেই লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেলি সানশাইন কিন্তু কথা দিচ্ছি একদিন তোকে লজ্জা পাওয়ার সুযোগ টুকুও দেবো না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” এই মেয়ে, এই, বলি তুই কেমন আহাম্মকরে! আরেকটু পরেই ছেলেটা বাড়ি ফিরে যাবে আর তুই এখানে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস? বলি এ জনমে কি তোর আর আক্কেল জ্ঞান হবে না?”
মায়ের কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বের করে দেয় কুহেলি। মাথার নিচের বালিশটা কানের ওপর চেপে ধরে আবারও ঘুমানোর সুযোগ খোঁজে ও। মেয়েটা আবার বড্ড ঘুম কাতুরে। একবার ঘুমালে খুব সহজে উঠতে চায়না। রাহেলা বেগম মেয়ের কান্ডে আরেকদফা খেঁকিয়ে উঠেন। মেয়ের পিঠে হালকা হাতে চাপড় মেরে বললেন,
~ এই মেয়ে তুই উঠবি? নাকি তোর ওপর পানি ছুড়ে ফেলবো?
~ যা ইচ্ছে করো। এবার সরো তো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমের ঘোরে কথাগুলো বলে থামলো কুহেলি। সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারও নাক ডাকার শব্দ আসে তার থেকে। রাহেলা বেগম এবার মেজাজ হারালেন। সামনের টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পানির জগের পুরোটা পানি ছুরি ফেললেন মেয়ের মুখের ওপর। হঠাৎ এমন পানির বহরে ঘুম ছেড়ে হকচকিয়ে ওঠে কুহেলি। চোখ বন্ধ রেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
~ আম্মা! আম্মা! ছাদ লিক করছে। বৃষ্টির পানি পড়তাছে। আম্মা মিস্ত্রি ডাকো।
মেয়ের কথায় রাহেলা বেগমের চটে যাওয়া মেজাজ আরো কিছুটা প্রখর হলো। তিনি গলায় ঝাঁঝ এনে বললেন,
~ এ-ই মেয়ে, কোন ছাঁদ লিক করেনি। আমি পানি ছুড়ে মারছি।
মুহুর্তেই কুহেলির সকল তন্দ্রা ফুস করে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। গলায় স্পষ্ট অবাকের রেশ টেনে বললো,
~ আম্মা! তুমি পানি মারছো? কিন্ত কেন!
রাহেলা বেগম মেয়ের দিকে এগিয়ে এলেন।ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে নজর বুলালেন একবার। তারপর মেয়েকে ধীমী স্বরে বললেন,
~ তোকে কি সবকিছু শিখিয়ে দিতে হবে কুহেলি? রৌদ্র কিছুক্ষণ পরেই এখান থেকে চলে যাবে। তোর উচিত ওকে এখন যথেষ্ট সময় দেওয়া যাতে করে ওর মন তোর দিকে ফিরে। কিন্তু তুই কি করছিস? এখানে এমন কুম্ভের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিস! বলি রৌদ্রকে মুগ্ধ করার চেষ্টা কর।তবেই না তুই ও বাড়ির বউ হতে পারবি।
মায়ের কথায় কুহেলি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবলো, মা তো তার ঠিকই বলেছে। কুহেলি বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। নিজেকে একবার পরোখ করে বললো,
~ মা আমার সারা শরীর তো ভিজে গেছে। আমি নাহয় আগে একটু চেঞ্জ করে আসি?
~ হুম যা। আর এই নে এই শাড়িটা ধর।এটা পড়ে বাইরে যাবি এখন!
পাশ থেকে একটা নতুন ভাজ খোলা লাল রঙের শাড়ি বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে কথাগুলো বললেন রাহেলা বেগম। কুহেলি শাড়িটা হাতে নেয়। এটাতো ওর মায়ের শাড়ি। গতমাসেই তো কিনে আনলো। কুহেলি শাড়িটা গায়ের ওপর জড়িয়ে খুশিমনে বললো,
~ আম্মা দেখো তো কেমন লাগবে এটাতে আমায়?
~ তা পরে বলা যাবে, আগে তুই গিয়ে শাড়িটা পড়ে নে।
~ আচ্ছা আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
কথা শেষ করে কুহেলি চলে যায় চেঞ্জ করতে। ওদিকে রাহেলা বেগম প্রহর গুনতে থাকে মেয়ের জন্য।
~ ভাইয়া! কোথায় ছিলে তুমি? আমরা আরো তোমাকে সেই কখন থেকে খুজে যাচ্ছি।
অনিকের প্রশ্নে স্পষ্ট উদ্বিগ্নতা। রৌদ্র একবার অনিকের পাশে বসা আসিফের দিকে তাকায়। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে অনিকের দিকে তাক করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
~ কারেন্ট চলে গিয়েছিল তাই একটু ড্রয়িং রুমে গিয়েছিলাম। আচ্ছা ওসব কথা বাদ দে। বৃষ্টি তো থেমে গেছে তাহলে আর দেরি করে কি লাভ? চল রওনা দিয়ে ফেলি।
~ এখনি চলে যাবি? আজকের রাতটা নাহয় থেকে যা।
আসিফের কথায় রৌদ্র, অনিক দুজনেই সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দেয়। রৌদ্র একপা এগিয়ে এসে আসিফের কাছাকাছি দাড়ায়। ঠান্ডা গলায় শুধায়,
~ ভাইয়া, রুহির বিয়েতে আর মাত্র আটদিন বাকি। এমনেতেই বিয়ে বাড়ির প্রচুর কাজ থাকে। তাছাড়া আগামীকালকেই সবাই গ্রামের বাড়িতে যাবো।তাই আজ আর না গেলেই নয়!
রৌদ্রের দেয়া যুক্তিতে হার মানে আসিফ। মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললো,
~ আচ্ছা ঠিক আছে। তোদের আর আটকাবো না। চল বসার ঘরে যাই।
তারপর তিনজনই হাঁটা ধরে একসঙ্গে। আসিফের রুম বরাবর কুহেলি আর সোহেলীর রুম। কুহেলি এতক্ষণ আসিফের ঘরের দিকে নজর রেখে করিডরে পায়তারা করছিলো কিন্তু যেই না তিনজনকে একসঙ্গে বেরোতে দেখেছে ওমনি সে হুট করে এসে তাদের পথ আটকিয়ে দাড়ায়।
শ্যামবরন গায়ে লাল টুকটুক শাড়ি। দু-হাতে দুমুঠ কাচের চুড়ি। চোখে মোটা করে কাজল লেপ্টানো। ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙা লিপস্টিক। অসময়ে এমন জমকালো সাজ দেখে রৌদ্র বাদে বাকি দু’জন বেশ চমকায়। রৌদ্র একেবারেই নির্বিকার কেননা সে একবারের জন্যও কুহেলির দিকে খেয়াল করাতো দূর ফিরেও তাকায়নি। সে একমনে ফোন ঘেটে যাচ্ছে।
কুহেলি লজ্জালু ভঙ্গিতে দাড়িয়ে । বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে রৌদ্রের দিকে কিন্তু মহাশয় তো একবার তাকাচ্ছেও না। এসব দেখে কুহেলির মনঃক্ষুণ্ন হয়। সে আর কিছু ভাববে তার আগেই কানে আসে আসিফের কৌতুক মাখা কন্ঠ,
~ কিরে? তুই ওমন সঙ সেজেছিস কোন দুঃখে?
আসিফের কথায় ফুঁসে ওঠে কুহেলি। রাগে গজগজ করে বলে,
~ একদম উল্টো পাল্টা কথা বলবে না ভাইয়া। আমি কোনরূপ সঙ সাজিনি। শুধু হালকা একটু সেজেছি মাত্র!
~ হ্যা ঠিক আছে তা বুঝলাম। তুই সঙ সাজ নাহয় বাঁদর সাজ তাতে তো আমার কিচ্ছু আসে যায় না কিন্তু তুই এভাবে আমাদের পথ আঁটকে দাড়ালি কেন?দেখি সাইড দে!
আসিফের ত্যাড়া কথায় মেজাজ খারাপ হয় কুহেলির। এই মুহুর্তে সামনে অনিক আর রৌদ্র না থাকলে ইচ্ছে মতো দুয়েকটা কটু কথা শুনিয়ে দিতো ও, কিন্তু এখন এদের সামনে রাগ দেখালে চলবে না ওর। এদের সামনে যথেষ্ট ভদ্র হয়ে থাকতে হবে । তাই কুহেলি মুখে মেকি হাসি টেনে বললো,
~ না আসলে, বলছিলাম যে! উনারা কি আজকেই চলে যাবে?
অনিক এবার মুখ খুলে। শান্ত গলায় বলে,
~ হ্যা কুহেলি। আমরা আজই চলে যাবো।
~ এমা! এখনি চলে গেলে কিভাবে হবে?
কুহেলির এমন কথায় তিনজনই ভ্রুগোটায়।
~ কিহ? বুঝলাম না কি বলতে চাইছিস তুই?
আসিফের প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় কুহেলি। বুঝতে পারলো ভুল সময়ে ভুল কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তার। কুহেলি আমতা আমতা করতে থাকে,
~ ইয়ে মানে বলছিলাম যে, আজকেই চলে গেলে রাস্তায় যদি আবারও বৃষ্টি হয় তখন? তাই ভাবলাম আপনাদের সমস্যা হবে তাই….
কুহেলির কথা শেষ হবার আগেই রৌদ্র ভরাট কন্ঠে বলতে লাগলো,
~ ও নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।আর তাছাড়া আমরা তো আর পায়ে হেটে বাড়ি যাবো না।গাড়ি আছে সাথে, বৃষ্টি পড়লেই বা কি?
তৎক্ষনাৎ কুহেলি চুপসে যায়। বলার মতো আর কিছু না পেয়ে খানিকটা মুখ ফুলিয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়।
” আচ্ছা ভাই! আজ তাহলে আসি।আর তোমরা সবাই কিন্তু সময় থাকতে চলে এসো কেমন? ”
কবির সাহেবের কথায় শফিক সাহেব মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
~ হ্যা ভাই সাহেব অবশ্যই চলে আসবো। আমাদের রুহি মা’র বিয়ে বলে কথা না এসে কি উপায় আছে বলুন?
এ কথায় বসার ঘরে উপস্থিত সকলেই একসঙ্গে হেসে ওঠেন। সকলে মিলে যে-ই না বাড়ির বাইরে পা রাখবে ওমনি রাহেলা বেগম বাধ সাধলেন। তার এমন কান্ডে আনোয়ারা বেগম ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে থাকেন। না জানি এ মহিলা আবার কোন ফন্দি এঁটেছে। তার এমন ভাবনার সত্যতা নিশ্চিত করতে তিনি এগিয়ে আসলেন কথা শোনার জন্য।
রাহেলা বেগম কেমন দোনোমোনো করছিলো দেখে সাব্বির সাহেব নমনীয় গলায় বললেন,
~ ভাবি? কিছু বলবেন?
কিছুটা ভরসা পেয়ে রাহেলা বেগম মুখ খুললেন,
~ জি, মানে বলছিলাম কি, কুহেলি আর সোহেলিটা এখনই আপনাদের সাথে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছে। বলছে, তারা নাকি তাদের রুহিপুর সাথে আরো কিছুটা সময় কাটাতে চায়।
~ ওমা! বেশ তো। ওদের আসতে বলুন।একসাথেই তাহলে নিয়ে যাই ওদের আপনারা নাহয় পরে আসলেন।
কবির সাহেবের কথায় রাহেলা বেগম বিজয়ী হাসলেও আনোয়ারা বেগম বড্ড চিন্তিত হলেন। তিনি ঠিক আচ পাচ্ছেন কেন রাহেলা তার দু মেয়েকেই ও বাড়িতে পাঠাতে চাইছে। তিনি কোনমতে বাঁধ সাধলেন।
~ আরে না না, ওরা আমগো লগেই যাইবো নি। আপনেরা এহন খামোখা কষ্ট কইরেন না।
সাব্বির সাহেব এগিয়ে এলেন।শাশুড়ীর হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
~ কিসের কষ্ট আম্মা? সোহেলী, কুহেলি তো আমাদের মেয়ের মতোই। বরং ওরা আসলে বাড়ির সকলে বেশ খুশি হবে।
জামাইয়ের কথায় বাইরে থেকে হাসলেও ভেতরে ভেতরে চিন্তারা খুড়ে খাচ্ছে আনোয়ারা বেগমকে। ও বাড়ির লোকগুলো তো আর জানেনা কুহেলি কেন যাচ্ছে সেখানে।
অন্যদিকে সবার এমন কথায় যথেষ্ট বিরক্ত রৌদ্র। সে শুরু থেকেই বুঝতে পারছে কুহেলির ইনটেনশন। তাইতো একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে করতে নিজের গাড়ির দিকে হাটা ধরলো সে।
~ সাচ আ মেলোড্রামা!
আর কারো কান অবধি কথাটা না পৌঁছালেও অনিকের কানে তা বেশ ঢুকেছে। তাইতো ছেলেটা কেমন মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে একমনে।
সকলের বের হবার জোগাড়। রাহেলা বেগম কুহেলিকে এটা সেটা বুঝিয়ে যাচ্ছেন সে কখন থেকে। মেয়েটা কেমন মাথা নাড়িয়ে সায় দিচ্ছে বারংবার। কবির সাহেব আর সাব্বির সাহেব উঠে বসলেন নিজেদের গাড়িতে। এই গাড়ি ড্রাইভ করার দায়িত্ব পড়েছে অনিকের ওপর। কেননা তাদের সাথে আসা ড্রাইভার কোন এক সমস্যার কারনে অনেক আগেই চলে গিয়েছে। বাকি রইলো আরো চারজন। রৌদ্র তার গাড়িতে বসে ফোন ঘাঁটছে। ওদিকে তার গাড়ি সম্পূর্ণ খালি। রাহেলা বেগম এগিয়ে এসে দু মেয়েকেই তড়িঘড়ি করে রৌদ্রের গাড়িতে উঠতে বললেন।কুহেলি একবার রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে আবারও মায়ের কাছে যায়।হয়তো কোনরূপ শলাপরামর্শ দরকার তার।এদিকে রয়ে যায় সোহেলী। রৌদ্র সেদিকে একবার আড়চোখে তাকালো। তারপর ফোনে কাওকে মেসেজ পাঠায়,
” আমার গাড়িতে আমার বউ ছাড়া আমি অন্য কাওকে নিবো না। তুই এদেরকে নিজের গাড়িতে ওঠা।আর আমার গাড়িতে আমার বউকে পাঠা”
ওপাশে অনিকের ফোনে টুং করে মেসেজের শব্দ হলো।
সে ফোন বের করে সামনে ধরে মেসেজ খানা দেখলো।মুহুর্তেই ছেলেটার নাকেমুখে কাশি ওঠে যাচ্ছে -তাই অবস্থা! পেছন থেকে সাব্বির সাহেব একটি পানির বোতল এগিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
~ কি হলো হঠাৎ তোমার? পানি খেয়ে নাও।
অনিক মাথা ঝাকায়। হাত বাড়িয়ে পানির বোতল নিয়ে গটগট করে গিলতে থাকে। দৃষ্টি তার এখনো মোবাইল স্ক্রিনে। ভাবা যায়, রোদ ভাই এখনি তার বনুকে কেমন বউ বউ ডাকছে। অনিক মুচকি হাসে। ঠিক তখনি তার পাশের সিটে বসে পড়ে অরিন। বোনকে এখন নিজের পাশে বসতে দেখে খুশি হওয়ার বদলে চিন্তিত হলো ছেলেটা। ব্যস্ত হাতে ফোনে টাইপ করলো,
~ ভাইয়া বনুতো আমার সাথে বসে পড়ছে। এখন ওকে কিভাবে উঠতে বলি বলো? প্লিজ একটু কন্সিডার করো!
মেসেজ সেন্ট হবার পর হয়তো দুমিনিট অতিক্রম হলো।তারপরেই আবারও টুং করে শব্দ হলো তার ফোনে। এবারের মেসেজটা ছিলো আরেকটু তীক্ষ্ণ।
” রাখ তোর কন্সিডারেশন, আমার বউকে তুই কেন নিয়ে যাবি? ওরে আমার কাছে পাঠা। আর ঐ আপদকে তুই নিজের গাড়িতে তোল। ”
অনিক পড়লো বিপদে। কিভাবে সবটা সামলাবে ছেলেটা? সে দোনোমোনো করে আবারও লিখলো,
” ভাইয়া ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড! এই গাড়িতে একসঙ্গে পাঁচজনের জায়গা হবে না। সো ইউ নিড টু টেক ওয়ান উইথ ইউ।”
ওপাশ থেকে মেসেজ সিন হবার পর খানিকক্ষণ বাদে আবারও রৌদ্রের মেসেজ এলো।
” ওকে। সোহেলিকে আমার গাড়িতেই রাখবো বাট ঐ আপদকে আমি নিয়ে যেতে পারবো না।তুই আমার বউকে বল তার বর তার জন্য ওয়েট করছে। আর পাঠিয়ে দে আমার কাছে। ”
অনিক এটা দেখে কপাল চাপড়ালো। পাশ থেকে ভাইয়ের ওমন কান্ডে অবাক হলো অরিন। অবাক কন্ঠে বললো,
~ ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? কপাল চাপড়াচ্ছো যে! মাথা ব্যাথা করছে নাকি?
অনিক মাথা নাড়িয়ে না জানায়। মনে মনে কথায় সাজায় ছেলেটা, কিভাবে তার বনুকে রাজি করাবে সে। ওদিক থেকে আবারও মেসেজ এলো,
” আমার বউ যদি আমার সাথে না যায় তাহলে আমি কিন্তু একাই চলে যাবো। এদের কাওকেই আমি নিবো না। সো আমার বউ আমাকে দে। আ’ম ওয়েটিং! ”
অনিক মনে মনে ইচ্ছে মতো কথা শোনায় রৌদ্রকে। হু, আসছে তার বউ ওয়ালা! ভাব এমন বউ বুঝি পৃথিবীতে একমাত্র তারই আছে। এই ওয়েট! ও নিজেও কি পাগল হয়ে গেলো? কিসব ভাবছে ও।তার বনুকি এখনি রোদ ভাইয়ের বউ হয়েছে নাকি। রোদ ভাইতো বিয়ের আগেই তার বনুকে বউ ডাকছে। এখনি এ হাল হলে বাকিদিন কি হবে কে জানে!
অনিক খামখেয়ালি ছাড়লো। অরিনকে বেরিয়ে আসতে বলে নিজেও বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।তাদের এভাবে বের হতে দেখে পেছন থেকে কবির সাহেব বললেন,
~ আবার কোথায় যাচ্ছো তোমরা? বাড়ি কি যাবে না নাকি?
~ জি বড় আব্বু। এইতো আসছি!
কথা শেষ করে কিছুটা দূরে গিয়ে বনুকে বললো,
~ বনু তুই প্লিজ ঐ গাড়িটায় আসবি! আসলে কুহেলিকে আমি নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।
অরিন ভাইয়ের দিকে চোখ ছোট করে তাকায়। সন্দেহের গলায় বললো,
~ কি ব্যাপার ভাইয়া? কাহিনি কি?
অনিক মেকি লজ্জালু ভান করে। হাত বাড়িয়ে মাথা চুলকে বললো,
~ ইয়ে ঐ আরকি!
মুখে এ কথা বললেও বেচারা মনে মনে বলেই বসলো,
” আল্লাহ আমার এতোটাও খারাপ দিন দেয়নি যে এমন মেয়েকে দেখে ফিল আসবে”
অরিন খিলখিল করে হেসে ওঠে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
~ হুম হুম বুঝলাম। যাও নিয়ে যাও তোমার ওনাকে। আমি অন্যটায় আসছি।
বলেই হাটা ধরে অরিন।অন্যদিকে অনিক তার পেছন থেকে বিড়বিড়িয়ে বললো,
~ রোদ ভাই! আমার ইজ্জত টা আর রাখলে না তুমি!
অরিন রৌদ্রের গাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাড়ায়। পাদু’টো বুঝি আটকে আছে মাটিতে। তখনকার ঘটনাটা কেমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে তার। অরিন কোনরকমে এগিয়ে যায় বেক সিটের সামনে। তখনি সোহেলি তাকে বলে বসে,
~ আপাই! তুমি ফ্রুন্ট সিটে বসো।কেননা আমার একটু বমি-টমির সমস্যা আছে।
অরিন পড়লো এবার গেঁড়াকলে। অস্থিরতায় আঙুলে ওড়না পেঁচাচ্ছে বারবার। কি করবে না করবে এসব ভাবার মাঝেই কানে আসে রৌদ্রের ভরাট কন্ঠ,
~ লেট হচ্ছে! তাড়াতাড়ি আয়।
অরিন ঠোঁট কামড়ে ধরে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বসে পড়ে ফ্রন্ট সিটে। সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসে রৌদ্র। লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি রেখে চোখে চোখে কথা বললো পেছনের মানুষটার সাথে। ভাগ্যিস মেয়েটা বুঝে গিয়ে বুদ্ধিটা খাটালো।
রৌদ্র দৃষ্টি সরায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মনে মনে বললো,
~ তুই আমার থেকে যতোটা দূরে যেতে চাইবি, আমি তোকে তারচেয়ে দ্বিগুণ কাছে টেনে আনবো সানশাইন!
রৌদ্রের গাড়ি চলে যেতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে কুহেলি। যাহ! লোকটা তাকে না নিয়েই চলে গেলো? এবার কি হবে। মন খারাপ হয়ে যায় কুহেলির।উপায়ন্তর না পেয়ে এগিয়ে যায় অনিকদের গাড়ির কাছে। অতপর তাকে সাথে নিয়েই শুরু হয় তাদের যাত্রা।
” কুহেলির মা! তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করো নাই।আর কেও বুঝুক বা না বুঝুক আমি কিন্তু ঠিকই বুঝছি তুমি কিল্লেগা কুহেলিরে ওগো লগে পাঠাইছো। এমন ছ্যাচড়ামিডা না করলেই হইতো না?”
শাশুড়ীর কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান রাহেলা বেগম।চোর ধরা পড়ার ন্যায় কাচুমাচু করতে থাকেন তিনি। আমতাআমতা করে বললেন,
~ কি বলেন আপনে! কিসের কথা বলতাছেন আমিতো কিছুই বুঝতাছি না।
~ হুুুউউ.. ন্যাকা সাজতে হইবো না। তুমি কি বুঝো আর না বুঝো এইডা আমি খুব ভালা জানি। শুধু এইটুক মনে রাইখো, মা হইয়া মাইয়াডার জিবন নষ্ট কইরো না।
শাশুড়ীর কথায় মুখ ভেঙচি কাটেন রাহেলা বেগম। বিড়বিড়িয়ে বলেন,
~ বুইড়া মাইনষের কথা,, ছাতার মাথা!
বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটাও বেশ শুনলেন আনোয়ারা বেগম। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তেমন কোনো রিয়েক্ট না করে মৃদু হাসলেন।তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,
~ বুইড়া মাইনষের কথা বাসি হইলেও ফলে বউ! মনে রাইখো, যে ঘরের মা’রা বেশি বুঝে ঐ ঘরের মাইয়াগো কপালে দুক্কু থাহে।বহুত দুক্ক!
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২
বলেই তিনি চলে গেলেন সেখান থেকে। অথচ পেছনে হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে রইলো রাহেলা বেগম। শাশুড়ীর শেষ কথাটায় তার বুকটায় কেমন কামড় দিয়ে ওঠলো! সত্যি কি তিনি বেশি বুঝছেন? তাহলে কি তার জন্য তার মেয়েও দুঃখ…. না না। এমনটা হবে না। রাহেলা বেগম সেখানেই ধপ করে বসে পড়লেন। মনটা কেমন কু ডাকছে তার। শতো হলেও মা তো! মা হয়ে কি আর সন্তানের অমঙ্গল চাওয়া সম্ভব?