সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪
Jannatul Firdaus Mithila
কয়েকদিনের উত্তপ্ত ধরণী আজ কিছুটা শান্ত হলো। পরিবেশের ভ্যাপসা গরম তার নিজস্ব তেজ ভুলে হারিয়েছে কোথাও। চারিদিকে ঠান্ডা মৃদুমন্দ বাতাস। অনেকক্ষণ গাড়ির জানালা বন্ধ থাকায় হাসফাস করতে থাকে অরিন। মেয়েটা আবার বেশিক্ষণ আবদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না। নিজের এমন অসস্তিতে বড্ড কাহিল মেয়েটা। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ রেখে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে থাকে অনবরত। পাশ থেকে রৌদ্রের সবটা অবলোকন হওয়া মাত্রই সে গাড়িটা রাস্তায় সাইড করে দাড় করায়। দ্রুত হাতে গাড়ির জানালা খুলে দেয়।তারপর অরিনের গালে আলতো হাত রেখে নমনীয় কন্ঠে বলে,
” জানবাচ্চা! কি হয়েছে তোর? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? কথা বল না সোনা!”
অরিনের মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে পেটের ভেতর থেকে সব কেমন গুলিয়ে উঠছে। অরিন বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকায়। তার ওমন ছলছল চোখজোড়া দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে রৌদ্র। ব্যস্ত হাতে নিজের সিটবেল্ট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর অরিনের পাশের ডোর খুলে তাকে বললো,
” অরি! সোনা একটু বের হ। বাতাসে দাড়ালে ভালো লাগবে তোর।”
অরিন মাথা নাড়িয়ে নাকচ করে প্রস্তাবটি। রৌদ্র বুঝলো মেয়েটার হয়তো একটু বেশিই খারাপ লাগছে। রৌদ্র আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে একটি ছোট্ট মুদির দোকান দেখতে পায়। সে অরিনদের উদ্দেশ্যে বললো,
” অরি, আমি যাবো আর আসবো। তুই একটু কষ্ট কর জানবাচ্চা!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কথাটা শেষ করে একপ্রকার দৌড়ে জায়গাটা ত্যাগ করলো রৌদ্র। প্রায় মিনিট তিনেক পর আবারও একইরকম দৌড়ে আসে সে।হাতে তার দুটি পানির বোতল, কয়েক ধরনের আচার,টক চাটনি। কিছু সোহেলিকে পাস করে বাকিগুলো নিজের হাতে রাখলো। অরিনের গালে আবারও আলতো হাত রেখে ডাক দিয়ে বলে,
” জানবাচ্চা! মুখ টা একটু খোল না প্লিজ! একটু পানি খেয়ে নে ভালো লাগবে। ”
অরিন হয়তো শুনলো এই কথাটা। পিটপিট করে চোখ মেলে হালকা হা করলো। রৌদ্রও সুযোগ বুঝে তাকে নিজ হাতে সযত্নে পানি খাইয়ে দিলো। প্রায় দু-ঢোক পানি খাওয়ার পর অরিন হেলান ছেড়ে উঠে বসে। মুখে হাত চেপে ধরে সজোরে। রৌদ্র কিছু বুঝে ওঠবার আগেই হর হর করে তার গায়ের ওপর ব*মি করে ভাসিয়ে দেয় অরিন। মেয়েটা একবার বমি করেই কাহিল। মাথাটা তার হেলে পড়ে যেতে নিলে রৌদ্র সেটিকে আলতো করে বুকে চেপে ধরে। অরিনের কপালে হালকা চাপ দিয়ে বললো,
” জানবাচ্চা! আরেকটু করবি? করলে কর! আমি আছি।”
ব্যস এটুকু কথাই হয়তো ম্যাজিকের মতো কাজ করলো অরিনের ওপর। শরীর খারাপ লাগলেও মনে বেশ খানিকটা জোর পেলো রৌদ্রের আশ্বাসে। রৌদ্র টের পেলো অরিনের ছোট্ট দেহখানা কেমন কাপছে। তাই সে অরিনকে আরেকটু কাছে টেনে নিজের বুকে চেপে ধরলো। আলতো হাতে মাথা বুলিয়ে দিলো মেয়েটার। অরিনও ঘোরে পড়ে নাক ঘষে দিলো রৌদ্রের বুকে।
মুহুর্তেই রৌদ্রের কর্মরত হাতটি থমকে যায়। বুকটায় বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দনের হার। সম্পূর্ণ শরীরের পশমগুলো কাটা দিয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। রৌদ্র ফাঁকা ঢোক গিলে। ঘাড় নিচু করে তাকিয়ে থাকে তার বুকে পড়ে থাকা সানশাইনের দিকে। রৌদ্র নিজেকে শাসায়। নিজের মনের নিষিদ্ধ অনুভুতিকে একপ্রকার উপেক্ষা করে অরিনকে বুক থেকে ছাড়াতে নেয় তখনি অরিন তাকে আরেকটু জোরে চেপে ধরে। রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। এই মেয়েটা তাকে সত্যিই জালিয়ে মারবে। সেতো বোঝে না, তার একটু স্পর্শে রৌদ্রের বুকে ঠিক কতোটা ভয়ংকর ইচ্ছে এসে হানা দেয়। যদি কোনদিন এসবের একটুও মেয়েটা ঘুনাক্ষরে টের পেতো তাহলে নিশ্চিত মেয়েটা লজ্জায় কুন্ঠা যেতে। রৌদ্র অরিনকে একপ্রকার জোর করেই বুক থেকে ছাড়ায়। সিটে হেলান দিয়ে রেখে, পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে নিজের রুমালটিকে ভিজিয়ে নেয়। তারপর সেই ভেজা রুমাল দিয়ে ধীরে ধীরে সযত্নে অরিনের মুখটা পরিষ্কার করে দেয়। পেছন থেকে সোহেলী সবটা নিরেট দৃষ্টিতে পরোখ করে যাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। মনে মনে বলছে,
” অরিপু! তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী।”
প্রায় অনেক্ক্ষণ পর অরিন কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তাকে স্বাভাবিক হতে দেখে রৌদ্র কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।। হাত বাড়িয়ে অরিনের মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর রাখে। অরিনও কেমন চুপটি করে মাথা দিয়ে রাখলো রৌদ্রের কাঁধে। রৌদ্র আবারও নরম স্বরে বললো,
” এখনও খারাপ লাগছে? ”
“উহু”
রৌদ্র আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ছেলেটার সারা শরীর থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে অথচ সেদিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিজের সবটা চিন্তা শুধুমাত্র তার প্রেয়সীকে জুড়েই রেখেছে।
রাত ১০:৩০🌸
রৌদ্রদের গাড়িটা মাত্র এহসান বাড়ির আঙিনায় ঢুকলো। গাড়ি থামা মাত্র সোহেলি চটপট করে নেমে পড়ে। এগিয়ে এসে অরিনের দিকে তাকাতেই ওপাশ থেকে রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো,
” তুমি ভেতরে যাও সোহেলী। আমি অরিকে নিয়ে আসছি”
সোহেলীও “আচ্ছা ” বলে মাথা কাত করে ভেতরে ঢুকে। সোহেলীর যাবার পর রৌদ্র অরিনের দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন কাহিল হয়ে পড়েছে। মুখটা হয়ে ওঠেছে শুকনো,ফ্যাকাশে।রৌদ্র একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে। তারপর ফোনটি হাতে নিয়ে কল লাগায় অনিকের নাম্বারে। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয় কলটি,
“হ্যালো, ভাইয়া! সোহেলি ভেতরে ঢুকলো কিন্তু তুমি আর বনু কই?”
“বাইরে বের হ অনিক!”
” আচ্ছা আসছি ”
বলেই ফোনটি খট করে কেটে দেয় ওপাশ থেকে। হয়তো মিনিট খানেক সময় পেরোলো, এরই মাঝে দ্রুত কদমে সেখানে উপস্থিত হয় অনিক। নিজের বনুকে এভাবে রৌদ্রের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে দেখে থমকায় অনিক।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রৌদ্রের দিকে তাকায় ছেলেটা। রৌদ্র তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
” বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হেটে যেতে পারবে না, তুই কোলে নে!”
বলতে দেরি কিন্তু করতে দেরি হলো না অনিকের। আলতো হাতে নিজের বোনকে কোলে তুলে নেয় ছেলেটা। তারপর হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। তার চলে যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো রৌদ্র। বিরবির করে বললো,
” আল্লাহ তোর সকল বিপদ, সকল অসুস্থতা আমায় দেক সানশাইন! তবুও তুই ভালো থাক, সুস্থ থাক”
রৌদ্র গাড়ি পার্ক করে বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই কেও একজন ছুটে এসে তার ডান হাতটি জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভ্রুকুটি করে রৌদ্র। কপালে বিরক্তির ছাপ ফেলে হাত ধরে রাখা মানুষটার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই মানুষটাকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে বললো,
” শিশির! তুই? এখানে?”
শিশির রৌদ্রের মুখে নিজের নাম শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে। রৌদ্রের বাহু ছেড়ে দিয়ে বুকের কাছে দুহাত ভাজ করে বলে ওঠে,
” ইয়েস মিস্টার ইফতেখার! আমি। আপনি তো লন্ডন থেকে ফিরে এসে আমায় ভুলেই গিয়েছেন। ভুলেই গিয়েছেন নিজের কাজিন ওরফে ভালো বন্ধুকে”
রৌদ্র প্রতিত্তোরে কেবল মৃদু হাসলো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে শিশির বললো,
” রোদ! ইয়াক… তোর শরীরে এগুলো কি? ছিঃ কি বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে। ”
বলেই নাক সিটকায় শিশির। পরমুহূর্তেই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
” রোদ! তুই না প্রচুর Neat freak (অতিরিক্ত পরিষ্কার -পরিচ্ছন্নতা প্রিয়)। তাহলে আজ এতোটা নোংরা গায়ে লাগলো কিভাবে তোর?”
রৌদ্র এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। শিশিরের সকল কথা একপ্রকার উপেক্ষা করে বললো,
” আমি ফ্রেশ হবো শিশির। তোর বাকি কথা পরে বলিস”
কথা শেষ করে গটগট পায়ে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। রুমে যাবার পথে রৌদ্র অরিনের ঘরের সামনে থামে।ভেতরে তাকাতেই দেখতে পায়, বাড়ির সকল সদস্য একপ্রকার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অরিনকে নিয়ে। রৌদ্র আর ভেতরে গেলো না। শরীরে এতো নোংরা নিয়ে কিভাবে যাবে ও? তাই সে আর দেরি না করে চলে গেলো নিজের রুমে।
প্রায় আধঘন্টা সময় নিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার শেষে বেরিয়ে আসে রৌদ্র। কোমরে টাওয়েল পেচিয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে কাবার্ডের সামনে যায়। একটি সাদা ঢিলেঢালা ট্রাউজার আর ধূসর রঙের টি-শার্ট বের করে পড়ে নেয় সে। ঠিক তখনি তার ঘরের দরজায় নক করার শব্দ হয়। রৌদ্র মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তেই বললো,
” কে?”
ওপাশ থেকে সাড়া দেওয়ার বদলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো শিশির। হাতে তার গরম ধোঁয়া ওঠা দু-মগ কফি। রৌদ্র একবার সেদিকে চাইলো। তারপর মৃদু হেসে বললো,
” কিভাবে জানলি এই মুহুর্তে এটা আমার প্রয়োজন ছিলো?”
শিশির মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো। হাত বাড়িয়ে একটি মগ রৌদ্রকে দিয়ে বললো,
” তোকে আমি আর রেহান বাদে কেইবা এতো ভালো করে চেনে বলতো!”
রৌদ্র হাস্যজ্জ্বল মুখে কফির কাপে চুমুক বসায়। চিরচেনা স্বাদ অনুভব হতেই বললো,
” এখনো দেখছি কিছুই ভুলিস নি! কফিটা একদম পারফেক্ট হয়েছে ”
শিশির স্মিত হেসে বললো,
” হুম, এতোদিনকার এক্সপেরিয়েন্স বলে কথা, পারফেক্ট তো হবেই!”
রৌদ্র কফি হাতে নিয়ে কাউচে বসে। পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বলে,
” তোর জব কেমন চলছে? এখনো কি একই সেক্টরে আছিস নাকি চেন্জ হয়েছে? ”
শিশির রৌদ্রের পাশে বসতে বসতে বললো,
” আর বলিস না! এতোদিন ধরে সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করছি অথচ তারা প্রমোশন দেবার নামই নিচ্ছে না! মাঝে মাঝে কি ইচ্ছে করে জানিস?”
” কি?”
” ইচ্ছে করে আমার ঐ যে টাকলু সিনিয়রটা আছে না? তার মাথার তবলাটা ঠাশ করে ভেঙে ফেলতে। ঐ খারুস টা নিজেতো রোবটের মতো কাজ করেই পাশ থেকে আমাকেও গাধার মতো খাটায়”
শিশিরের এমন হা-হুতাশে হো হো করে হেসে ওঠে রৌদ্র। শিশিরের মাথায় মধ্যমা আঙুল দিয়ে হালকা গাট্টা মেরে বললো,
” তোর এই কথাটা যদি তোর সিনিয়র শুনতো, তাহলে আমি ড্যাম শিওর সে তোকে আর ২য় সুযোগ দিতো না।”
শিশির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অবুঝ চোখে তাকালো রৌদ্রের দিকে। অবুঝ কন্ঠে বলে,
” মানে?”
” মানে সে তোকে আর চাকরিতেই রাখতো না।চাকরিতে না রাখলে আবার কিসের সুযোগ? ”
শিশির ঠোঁট ফুলায়।কাউচের ওপর পড়ে থাকা কুশনটি নিয়ে ইচ্ছেমতো মারতে থাকে রৌদ্রের বাহুতে। বলতে থাকে,
” ইউ স্টুপিড! তুই সবসময় এমন ফাইজলামি করিস আমার সঙ্গে! ”
রৌদ্র শিশিরকে থামায় না। সে একমনে হেসে যাচ্ছে। বেশকিছুক্ষন পর থেমে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে শিশির বললো,
” স্টিল ম্যান একটা! বলি তোর কি একটু লাগে নি রোদ? কিভাবে এমন ড্যাম কেয়ার হয়ে বসে রইলি? তোকে মারতে গিয়ে আমিই হাঁপিয়ে গেছি কিন্তু তোর তো কোন হেলদোলই দেখছি না”
রৌদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে শিশিরের দিকে তাকায়। কৌতুকের স্বরে বলে,
” মাছির আঘাতে শরীরে কি আর ব্যাথা লাগে বল?”
শিশির হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের পানে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবটা তার বোধগম্য হতেই সে খেঁকিয়ে বলে,
” কি বললি? আমি মাছি?”
” তুই জানতে চাইছিস নাকি বলছিস বলতো?”
” রোদ!”
প্রতিত্তোরে রৌদ্র কাউচে হেলান দিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তার গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। শিশির কতক্ষণ নাক ফুলিয়ে বসে রইলো। পরে রৌদ্রের মুখে এমন হাসি দেখে নিজেও ফিক করে হেসে দিলো।রৌদ্রের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,
” তোর এমন হাজারটা হাসির কারন হতে চাই আমি রোদ!”
রৌদ্রকে খাবারের জন্য ডাকতে এসেছিলেন জুবাইদা বেগম কিন্তু ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াতেই ছেলেকে এমন প্রানখুলে হাসতে দেখে থমকে দাঁড়ান তিনি। একমনে তাকিয়ে রইলেন ছেলের হাসির দিকে।তার ছেলেটা শেষ কবে এতোটা হেসেছে মনে নেই তার। রৌদ্রের পাশে শিশিরকে বসে থাকতে দেখে মনে মনে এক অন্য চিন্তা এসে হানা দেয় তার। তিনি তখনি এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। মনে মনে ঠিক করলেন খুব শিঘ্রই তিনি নিজের ইচ্ছেটি বাস্তবায়ন করবেন। জুবাইদা বেগম কিছু না বলে জায়গা ত্যাগ করলেন। মানুষটা আজ ছেলেকে এতোটা খুশি দেখে বড় সুখ সুখ অনুভব করছেন। ছেলের জন্য প্রানখুলে দোয়াও করে ফেললেন ইতোমধ্যে।
” শুনছেন! একটু ভেতরে আসবো?”
হঠাৎ মেয়েলি ডাকে থামে শিশির, রৌদ্র। দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় কুহেলীকে।রৌদ্রের হাসি হাসি মুখটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে আসে। চেহারায় নেমে আসে চিরচেনা গম্ভীর রুপ। পাশ থেকে শিশির সবটা আড়চোখে খেয়াল করলো। তারপর কুহেলিকে বললো,
” হ্যা, আসো! কিছু বলবে?”
কুহেলি ধীর কদমে এগিয়ে আসে তাদের কাছে। মাথানিচু রেখে নরম সুরে বলে,
” নিচে সবাই খেতে ডাকছে, আপনারা খাবেন না?”
” আমাদের ডাকার জন্য তোমাকে কে পাঠিয়েছে? ”
রৌদ্রের করা এহেন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় কুহেলি। আমতাআমতা করতে থাকে মেয়েটা,
” ইয়ে — মানে, আপনারা আসেন নি তাই আমিই এসেছি আরকি!”
রৌদ্র উঠে দাড়ায়। সটান হয়ে পকেটে দুহাত গুজে গম্ভীর গলায় শুধায়,
” মেহমান আছো, মেহমানদের মতো থাকো। তাছাড়া এহসান বাড়িতে যথেষ্ট মানুষ আছে। সেই হিসেবে মেহমান হয়ে কাজ করার কোন প্রশ্নই আসে না।”
কথাটা বলেই গটগট পায়ে জায়গা ত্যাগ করে রৌদ্র। এদিকে তার কথায় কুহেলি ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়ে থাকে। চোখে এসে ভিড় জমিয়েছে অশ্রুকনা।ভাবছে, লোকটা তাকে সবসময় এমন পিন্চ করে কথা বলে কেন? সে কি দেখতে খারাপ নাকি যোগ্যতায় খারাপ? একটু ভালো করে কথা বললে কি হয়? ”
শিশির এতক্ষণ চুপচাপ সবটা দেখছিলো। রৌদ্র যেতেই সেও উঠে দাড়ায়। কুহেলির কাছে এসে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
” চলো, খেতে যাওয়া যাক। ”
কুহেলিও নিজের কান্নাগুলো গিলে নিয়ে সম্মতিতে মাথা ঝাকায়। তারপর শিশিরের সাথে চলে যায় খাবার খেতে।
রৌদ্র করিডর দিয়ে হেটে যাওয়ার পথে আবারও অরিনের ঘরের সামনে থমকে দাঁড়ায়। তারপর কিছু একটা ভেবে ঢুকে পড়ে অরিনের রুমে। রুমটার আলো নেভানো। রৌদ্র আর লাইট অন করে না।সে একপা একপা করে এগিয়ে যায় খাটের পাশে। বারান্দা থেকে আসা চাদের আলোয় ঘরটা ওতোটাও অন্ধকার লাগছে না। রৌদ্র অরিনের মাথার কাছে বসে পড়ে। চাদের আলোয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরিনের স্নিগ্ধ মুখখানাতে। তারপর হাত বাড়িয়ে আলতো করে অরিনের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। অরিন একটু নড়েচড়ে ওঠে। দূর্বল চোখ জোড়া পিটপিট করে খুলে থেমে থেমে বললো,
” কে?”
রৌদ্রের হাতদুটো থেমে যায়। মনে মনে ভাবলো, কি বলবে এখন? রৌদ্র যখন নিজের ভাবনায় নিমজ্জিত তখনি তার কানে আসে অরিনের বলা কিছু কথা।
” রোদ ভাই! এটা আপনি তাই না?”
রৌদ্র হকচকায়। দ্রুত সরে আসে অরিনের মাথার কাছ হতে। দোনোমোনো করে যেই না চলে যাবে ওমনি তার পা দুটো থমকে দাঁড়ায় মনোহরিনীর অব্যক্ত কথাগুলোতে।
” রোদ ভাই! কেন প্রতিদিন স্বপ্নে এসে আবারও হারিয়ে যান আপনি? কেন ঘুমিয়ে গেলে আপনাকে কাছে পেলেও ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে ফেলি? কেন একটু ভালোবাসলেন না আমায়? কেন এতোটা দূর করলেন আমায়? কেন এতোটা কষ্ট দিলেন? কেন রোদ ভাই? কেন!”
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩
কথাগুলো বলতে বলতে আবারও গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত হয় মেয়েটা। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলার শব্দতো তাই বলছে। রৌদ্র আবারও এগিয়ে যায় অরিনের কাছে। এবার ফ্লোরে বসে অরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ। ছেলেটার চোখে রাজ্যের ভয়। মনে হচ্ছে সে বুঝি প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলবার ভয়ে কাতর। রৌদ্র চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলে। চোখ মেলে ধীরে ধীরে মুখটা এগিয়ে আনে অরিনের কাছে। তারপর আলতো করে চুমু খায় অরিনের কপালে। বিরবির করে বলতে থাকে,
” তোর যত দুঃখ, কষ্ট সব আমার হোক সানশাইন। আর আমার ভাগের যত সুখ আছে সবটা তোর নামে লিখা হোক। ”