সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫
Jannatul Firdaus Mithila

সকাল সকাল এহসান বাড়িতে বেশ তোড়জোড় চলছে। রাফিয়া বেগম আর জুবাইদা বেগম মিলে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। হালকা -পাতলা কিছু না খেয়ে গেলে কি আর ওতো দূরের পথ অতিক্রম করা সম্ভব? রাইসা বেগম পুতুলের পেছন পেছন ঘুরছে।ছেলেটা কেমন জেদ ধরেছে খাবেনা বলে। বেশকিছুক্ষন ছেলের পিছনে দৌড়ে একপ্রকার হাঁপিয়ে ওঠেছেন তিনি। হাঁপাতে হাঁপাতে ছেলেকে বললেন,
” পুতুল, একটু খেয়ে নে বাবা। না খেয়ে গেলে শরীর খারাপ করবে তো!”
কে শোনে কার কথা! পুতুল এখনো মাথা নাড়িয়ে নাকচ করে যাচ্ছে মায়ের কথা। তখনি সিড়ি বেয়ে নিচে নামে রুহি। পুতুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

” কি ব্যাপার হ্যান্ডসাম! এভাবে দৌড়াদৌড়ি করছো কেন?”
” দেখো না রুহিপু! এত্তো সকাল সকাল কারো কি খিদে পায় বলো? আম্মু সেই কখন থেকে আমার পিছু পড়ে আছে। তুমি প্লিজ আম্মুকে একটু বোঝাও না।”
পুতুলের এমন বিচার দেওয়ার ধরন দেখে ফিক করে হেসে দেয় রুহি। পুতুলের গাল টেনে দিয়ে বলে,
” ওরে বাবুটা! মা তো ঠিকই বলেছে। তুমি যদি এখন না খাও, তাহলে তো গাড়িতে উঠলে তোমার খুদা লাগবে। তখন কোথায় খাবার পাবে শুনি?”
রুহির দেয়া যুক্তিতে ভাবুক হলো পুতুল। থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে ভাব নিয়ে বললো,
” উমম, বিষয়ট তো মন্দ বলোনি রুহিপু! ঠিকই তো গাড়িতে খুদা পেলে খাবার পাবো কই? নাহ, নিজের সাথে তো আর এতবড় রিস্ক নেওয়া যায় না।”
কথাটা শেষ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আম্মু দাও দাও খাবার দাও। খেয়ে নি”
রুহি পুতুলের ওমন পাকা কথায় মুচকি হাসে। পুতুলের মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দেয় হাত বুলিয়ে। নিজের সদ্য হেয়ারস্টাইলের এমন বারোটা বাজতে দেখে আর্তনাদ করে উঠে পুতুল।
” রুহিপু!! কি করলে এটা? মাত্রই কতোগুলো জেল লাগিয়ে স্টাইলটা করেছিলাম। ”
রাইসা বেগম ছেলের এমন অবস্থায় মিটমিট করে হাসতে থাকেন। ছেলেটা তার বড্ড সৌন্দর্য প্রিয়। ঘুম থেকে উঠেই, সেই কতক্ষণ লাগিয়ে রেডি হয়েছে, বিগড়ে গেলে তো এমন করবেই!

” কই তোমাদের হলো? আজকে কি আর বেরোতে পারবো?”
স্বামীর কথায় ব্যস্ত হাতজোড়া আরও কিছুটা তাড়াহুড়ো করতে লাগলো রাফিয়া বেগমের। কাপড়ের ব্যাগটা ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে নিয়ে বিছানার ওপর রাখলেন। আবারও ঘুড়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধপত্র নিজের আরেকটা ব্যাগে ভরে নিলেন। দরজার সামনে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থেকে সবটাই অবলোকন করছেন সাব্বির সাহেব। স্ত্রীর এমন তাড়াহুড়ো দেখে এগিয়ে আসলেন তিনি। স্ত্রীর হাতটা ধরে তাকে বিছানায় বসালেন। রাফিয়া বেগম স্বামীর এহেন কান্ডে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন — কি হলো?
সাব্বির সাহেব কোন প্রতিত্তোর না করে বেড সাইডের টেবিলের ওপর রাখা পানির জগ থেকে একগ্লাস পানি এনে এগিয়ে ধরলেন স্ত্রীর মুখের সামনে। তারপর ইশারায় বললেন — পানিটা খেয়ে নিতে।
রাফিয়া বেগমও চুপটি করে পানিটা খেয়ে নিলেন। খাওয়া শেষে গ্লাসটা রেখে দিলেন টেবিলের ওপর। সাব্বির সাহেব এবার স্ত্রীর ঘর্মাক্ত কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলেন। তারপর স্ত্রীর গালে হাত রেখে নমনীয় কন্ঠে বললেন,

” ওতো তাড়াহুড়ো করতে হবে না রাফু! তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের অযত্ন করলে কি আর হবে? ”
রাফিয়া বেগম মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে! গালের ওপর রাখা স্বামীর হাতটা চেপে ধরে বললেন,
” কিচ্ছু হবে না! তুমি ওতো টেনশন করো না তো! এখন তুমি নাহয় নিচে যাও।আমার কাজ প্রায় হয়ে এলো বলে! আমি আরেকবার সবটা দেখে নিয়েই নিচে নামছি”
সাব্বির সাহেব মাথা ঝাকালেন। বিছানা ছেড়ে উঠে চলে গেলেন নিচে যাবার উদ্দেশ্যে। পেছন থেকে রাফিয়া বেগম তাকিয়ে রইলেন স্বামীর যাওয়ার পানে।ভাবতে লাগলেন,দিন যত বাড়ছে, মানুষটার যত্নও ঠিক ততোটাই বাড়ছে।

” এই শোন তোমরা! এক গাড়িতে আমি, জবা, রাফিয়া,সাব্বির যাবো।২য় গাড়িতে তায়েফ,মাইমুনা,তাশরিক, রাইসা যাবে। আরেকটা চালাবে অনিক, তার সাথে যাবে অরিন, রুহি,আহি,মাহি আর পুতুল। বাকি যারা আছে তারা রৌদ্রের সঙ্গে তার গাড়িতে করে যাবে।ওকে?”
কবির সাহেবের দেওয়া লম্বা লিস্টে সবাই সম্মতি জানায়। লিস্ট অনুযায়ী সকলে গিয়ে বসে পড়ে নিজ জায়গায়। অনিক ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো এতক্ষণ। যেই না শেষের কথাটা কানে এসেছে ওমনি ছেলেটা সোজা হয়ে বসে। তার রোদ ভাই -তো কুহেলিকে সহ্যই করতে পারে না, সে কি আর কুহেলিকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে যেতে রাজি হবে? আর তাছাড়া ঐদিন অরিনকে নিয়ে সে যা পাগলামিটাই না করলো! আজকে না জানি কি থেকে কি করে।এসব ভেবেই অনিক বেচারার কপালে দু-তিনটে চিন্তার ভাজ পড়ে। ঠিক তখনি তার সামনে এসে দাড়ায় একজোড়া পা। অনিক মাথানিচু রেখেই বেশ বুঝতে পারে সামনে দাড়ানো মানুষটা কে! সে ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে। সামনে দাড়ানো রৌদ্রের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়েই একটি হ্যাবলাকান্ত হাসি দেয়। রৌদ্র সে হাসির দিকে পাত্তা না দিয়ে অনিকের কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় শুধায়,

” বাইরে চল কথা আছে! ”
অনিক শুষ্ক ঢোক গিলে। এ-ই -রে! যা ভেবেছিলাে তাই হচ্ছে। সে ঠিক জানতো রোদ ভাই তাকে দিয়েই নিজের কাজ হাসিল করাবে। অনিক কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বললো,
” ইয়ে মানে, রোদ ভাই! আরেকটু পর তো বের হতেই হবে তাইনা? বলছিলাম যে এখন নাহয় এখানেই থাকি।”
অনিকের কথায় রৌদ্র বাঁকা হাসে। সোফায় অনিকের পাশে গা ঘেষে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,
” শুনলাম কে না-কি ছোট চাচ্চুর ভার্সিটিতে ইদানীং বেশ আসা যাওয়া করছে! আমি কিন্তু তেমন কিছু দেখিনি জাস্ট একটু বললাম আরকি!”
ফট করে ঘুরে তাকায় অনিক। চোখেমুখে তার এক আকাশসম অবাকের রেশ। ছেলেটা অবাক কন্ঠে বললো,
” তুমি কি করে জানলে?”
বাঁকা হাসলো রৌদ্র। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমাটা হাতে নিয়ে ভাব দেখিয়ে বললো,
” তুই যেই কলেজের নতুন ছাত্র, আমি বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই সেখানকার প্রফেসর হয়ে বসে আছি”
উঁহু উঁহু করে কেশে ওঠে অনিক। নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে বললো,
” ভাইয়া প্লিজ কাওকে বলো না! ”
রৌদ্র কিছুক্ষণ ভাবুক হলো। তারপর আবারও বললো,

” হুম, বলা না- বলা সেটা পরের বিষয়। আপাতত আগে বাইরে আয়।”
কথাটা শেষ করে একবার আশেপাশে তাকালো রৌদ্র। তারপর আরেকটু ফিসফিস করে অনিকের কানে কানে বললো,
” আমার বউকে যতক্ষণ নিজের করে পাচ্ছি না ততক্ষণ আমি অন্যকারো বউকে এ বাড়িতে আসতে দিবো না সম্বন্ধীমশাই!”
বলেই আর একমুহূর্ত দেরি না করে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো রৌদ্র। অথচ পেছনে পড়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকা বেচারা অনিক! ছেলেটা মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠলো,
” রোদ ভাই তুমি এতোটা সেলফিশ হতে পারলে?”
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে নিজের ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে আসে অনিক। তার আবার এখন রোদ ভাইয়ের হুকুম শুনতে হবে। তারপর সে মোতাবেক কার্যসম্পাদন করতে হবে।
অনিক এগিয়ে যায় রৌদ্রের কাছে। রৌদ্র কিছু বলবে তার আগেই সে হুড়োমুড়িয়ে বলতে থাকে,

” ভাইয়া! বড়আব্বু সবটা এরেন্জ করে দিয়েছে। এখানে আমার কিছুই করার নেই। আজকে আমি হেল্পলেস!”
রৌদ্র কিছুক্ষণ মৌন রইলো। তারপর দৃঢ় গলায় বললো,
” তোকে কিছু করতেও হবে না। তুই জাস্ট নিজের সিট পাল্টাবি।”
” মানে?”
” মানে হচ্ছে, তুই আমার গাড়ি ড্রাইভ করবি আর আমি তোরটা। গট ইট?”
অনিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিয়ৎকাল। নিজেকে কোনমতে সামলে বললো,
” এতবুদ্ধি কই রাখো রোদ ভাই? ”
রৌদ্র ভ্রু কুচকায়। বলে,
” সেটা তোর না জানলেও চলবে। ”

আহি,মাহি কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসে। মেয়ে দুটো একসঙ্গে হওয়া মানেই রাজ্যের কথা!
কিছুক্ষণ পর রুহিও এসে বসে পড়ে গাড়িতে। মেয়েটার দৃষ্টি মোবাইল হতে সরছেই না। হয়তো রেহানের সাথেই চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত তিনি। অনিক বাইরে থেকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। পেছন থেকে বাড়ির দুটো গাড়ি অলরেডি লোড হয়ে গেছে। এখন শুধু তারটা আর রোদ ভাইয়েটাই বাকি। অনিকের অদূরেই অন্য গাড়িটায় একহাতে ভর ছেড়ে দাড়িয়ে আছে রৌদ্র। দৃষ্টি তার মোবাইলে নিবদ্ধ। ঠিক তখনি বাড়ির সদর দরজা থেকে এগিয়ে আসে অরিন। রৌদ্র একবার আড়চোখে তাকিয়ে ফট করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তার ওপর। অরিনটাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে। কালো রঙের লং কুর্তা, গ্রে রঙের জিন্সে মেয়েটাকে বড় মোহনীয় লাগছে। রৌদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। তখনি তার কানে আসে অনিকের গলা খাঁকারির শব্দ। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরায় সে। অনিকের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, ছেলেটা কেমন মিটমিটিয়ে হাসছে। রৌদ্র মেকি চোখ রাঙায়। কিন্তু এতে লাভের লাভ কিছু হলোই না! অনিকটা ভয় পাওয়া তো দূর একটু ঘাবড়ালো অবধি না! রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। মাথা নাড়িয়ে ভাবে,

” এই মেয়েটার জন্য বারেবারে ধরা খাই আমি!”
অরিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” ভাইয়া, আমি কোথায় বসবো?”
অনিক বোনের হাত ধরে তাকে সামনের সিটে বসায়। তারপর বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” এখানে বসবি। আর কোন সমস্যা হলে আমায় বলবি কেমন?”
” তোমায় বলব মানে? তুমি এ গাড়িতে যাচ্ছো না?”
অনিক জবাবে চুপ করে রইলো। প্রসঙ্গ এড়াতে বললো,
” ওসব কথা ছাড়! আমি একটু সামনে গিয়ে দেখে আসি সবাই ঠিকঠাক বসেছে কি না!”
বলেই সে কোনরকম পালালো সেখান থেকে। অরিনও আর তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ না করে বসে রইলো নিজের সিটে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর কুহেলি আর সোহেলী বের হয় বাসা থেকে। অনিক একবার তাকালো তাদের দিকে।কুহেলির দিকে নজর পড়তেই তার ভ্রুজোড়া কুঁচকে আসে। মেয়েটা আজকেও জমকালো সাজে সজ্জিত। অনিক একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। বিরবির করে বলে,
” ক্ষ্যাত একটা!”

রৌদ্র ফোন দেখছিলো তখনি শিশিরের কন্ঠ তার কানে আসে।
” রোদ! বাইরে দাড়িয়ে আছিস যে? সবাই তো চলে এসেছে, এবার নাহয় গাড়ি স্টার্ট কর।”
শিশিরের কথায় ঘাড় বাকিয়ে গাড়ির দিকে তাকালো রৌদ্র। তারপর হাতের ফোনটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে হেটে গেলো অনিকের গাড়ির দিকে। ওপাশ থেকে শিশির এখনো দাড়িয়ে দেখছে রৌদ্রের কান্ড।
রৌদ্রকে দেখতে পেয়ে অনিক জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যায় রৌদ্রের গাড়ির দিকে। অনিককে গাড়িতে বসতে দেখে শিশির বললো,
” তুমি এখানে? এই গাড়ি তুমি ড্রাইভ করবে?”
অনিক প্রতিত্তোরে কেবল “হু” বললো।শিশির কিছুটা দাত কিড়মিড় করলো।হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে। অন্যদিকে কুহেলি আজকেও আশাহত! মেয়েটা এই পর্যন্ত একবারও রৌদ্রের কাছাকাছি যেতে পারলো না। যতবার চেষ্টা করেছে নিজ থেকে কাছাকাছি ঘেঁষবার ততবারই রৌদ্র তাকে দূরদূর করেছে। কুহেলি মন খারাপ করে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। মুখ ফুলিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে পড়ে রইলো নির্বিকার ভঙ্গিতে।

রৌদ্রকে গাড়িতে বসতে দেখে ভড়কায় অরিন। চোখদুটো বড়সড় করে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে। ঠিক তখনি পেছন থেকে রুহি বলে ওঠে,
” ভাইয়া! এই গাড়ি তুমি ড্রাইভ করবে? ”
রৌদ্র ভাবলেশহীন হয়ে উত্তর দেয়,
” হুম।”
রুহি আর কিছু বললো না। আবারও ব্যস্ত হলো ফোনে। রৌদ্র গাড়িতে বসেই পকেট থেকে একটি ট্যাবলেট বের করে। গাড়ির সামনের ড্রয়ারে রাখা পানির বোতল আর ট্যাবলেটটি এগিয়ে ধরে অরিনের দিকে। অরিন সেগুলো দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।
রৌদ্র বললো,
” বমি না আসার ট্যাবলেট।খেয়ে নে।”
অরিন মাথা নাড়িয়ে নিয়ে নেয় ট্যাবলেটটি। ঔষধটা গিলে নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলো ।রৌদ্রও সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

প্রায় দু’ঘন্টা জার্নির পর গাড়িটি একটা ছোটখাটো দোকানের সামনে দাড় করায় রৌদ্র। তাদের বাড়ির বাকি গাড়িগুলো বেশ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। রৌদ্র গাড়ি থেকে নেমে দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় পাঁচ মিনিট পর ফিরে আসে গাড়ির কাছে। হাতে তার বেশকিছু আইসক্রিম, চকলেট, চাটনি আর পানি। রৌদ্র কয়েকটা নিজের কাছে রেখে বাকিগুলো পেছনে রুহিদের দিয়ে দেয়। রুহিতো ভাইকে বিশাল এক ধন্যবাদ জানিয়ে সবগুলো হাতে নিয়ে নেয়। রৌদ্র নিজের হাতের স্ন্যাকস গুলো অরিনকে দেয়। অরিন এতগুলো স্ন্যাকস দেখে মুচকি হাসলো।তারপর সেখান থেকে একটা আচার নিয়ে খেতে শুরু করলো। সত্যি তার এ মুহুর্তে আচারটা বেশ দরকার ছিলো! কিন্তু রোদ ভাই এটা কিভাবে বুঝলো? হয়তো গতকাল অসুস্থ হয়ে যাওয়াতেই এমনটা মনে হয়েছে তার। অরিন খেতে খেতে একটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে। কিছু কিছু আবেগ মানুষের জন্য বড্ড ভয়ানক হয়।এই যেমন রোদ ভাইয়ের জন্য তার মনে অনুভব হওয়া আবেগটিও বড্ড বেশি ভয়ানক!

বিকেল চারটে🌸
সাই সাই করে এহসান বাড়ির গাড়িগুলো গ্রামের পাকা রাস্তা দিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকছে।আশপাশ থেকে মানুষজন কৌতুহলের দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে। পরপর সবগুলো গাড়ি পুরনো এহসান ভিটার বড় কেচি গেটের সামনে দাড়াতেই একজন বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এসে কেচি গেটটি খুলে দেন।মুহুর্তেই খেচখেচ আওয়াজ তুলে কেচি গেটটি সরে গিয়ে দ্বার উম্মুক্ত হয়। একে একে সবগুলো গাড়ি ঢুকে পড়ে এহসান ভিটার বড় আধপাকা উঠোনে। প্রথম গাড়ি থেকে নেমে আসেন কবির সাহেব। তিনি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন ঘোলাটে চোখে। তার শৈশব, কৈশোর সবটাই কেটেছে এ বাড়ির আঙিনায়। কতশত স্মৃতি জুড়িয়ে আছে এ বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে। কবির সাহেব আড়ালে চোখ মুছলেন। এগিয়ে গেলেন সামনে দাড়ানো বৃদ্ধের কাছে। বৃদ্ধর পড়নে আটপৌরে পোশাক। পড়নের ময়লাটে লুঙ্গিটি পায়ের টাখনুর অনেকটা ওপরে। গায়ে জড়ানো একটি সাদা সেন্ডো গেঞ্জি। কাঁধের একপাশে ঝুলিয়ে রাখা একটি মলিন গামছা। বৃদ্ধ কবির সাহেবকে দেখে গামছায় চোখ মুছলেন। করুন গলায় বললেন,
” আমগো কথা এতদিন পরে মনে পড়লো তোমার? নিজেগো বাড়িত কেও এমন না আইয়া থাহে? ”
কবির সাহেব বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরলেন। এ পর্যায়ে তার কন্ঠস্বর মোটা হয়ে আসে,

“মনে কষ্ট রাখবেন না আবুল চাচা! আমিও যে কম কষ্টে এ বাড়ি ত্যাগ করিনি।”
বৃদ্ধ হতবাক হলেন।ধরে আসা গলায় বললেন,
” তুমি তারে এহনো মাফ করো নাই?”
কবির সাহেবের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো।দৃঢ় চোয়াল খানিকটা শক্ত করে বললো,
” এ জীবনে তা আর সম্ভব নয় চাচা!”
বৃদ্ধ আহত চোখে তাকিয়ে রইলো কবির সাহেবের দিকে। আর কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তার ডাক পড়ে বাড়ির ভেতর থেকে। হয়তো গিন্নি তার ডাকছে! বৃদ্ধ চুপ করে সরে গেলেন সেখান থেকে। যাওয়ার আগে হাতে করে কিছু মালপত্রও নিয়ে গেলেন ভেতরে।

রৌদ্রসহ বাকিরা বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে। অরিন গাড়ি থেকে নেমে একমনে তাকিয়ে রইলো বাড়িটার দিকে। দোতলা পাকা বাড়িটি অসম্ভব সুন্দর কারুকাজে সজ্জিত। দোতলার জানালা, দরজা এমনকি দোতলার রেলিঙটাও কাঠের তৈরি। অরিন বেশ অবাক হয় সবটা দেখে।শেষ কবে সে গ্রামের বাড়িতে এসেছে মনে নেই তার। অরিন যখন নিজের ভাবনায় মশগুল তখনি তার সামনে এসে উপস্থিত হয় একজন আগন্তুক। ছেলেটি চমৎকার হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় অরিনের দিকে। বলতে থাকে,

” হেলো! আমি তামিম। আর আপনি? ”
অরিন কিছুটা হকচকায়। দোনোমোনো করে যেই না হাত বাড়াতে যাবে তার আগেই কেও একজন আগন্তুকের বাড়িয়ে রাখা হাতটা চেপে ধরে। বলতে থাকে,
” ওর নাম অরিন।আর আমি রৌদ্র! আর কিছু জানার আছে? ”
তামিম সহসা মাথা নাড়িয়ে না জানায়। হাতটা ছোটাতে চেয়েও পারছে না সে। রৌদ্র তার হাতটা এমনভাবে ধরেছে যে ছাড়ার নামই নিচ্ছে না।
এদিকে অরিন কিছুক্ষণ দুজনের দিকে তাকিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। ও চলে যেতেই রৌদ্র তামিমের হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারপর কটমট করে বলে ওঠে,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৪

” ওর থেকে যত দূরে থাকবে, ততই তোমার জন্য মঙ্গল! ”
বলেই রৌদ্র সেখান থেকে চলে যায়।এদিকে তামিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রৌদ্রের যাওয়ার দিকে। তারপর হুট করে বাঁকা হেসে বিরবির করে,
” জনাব! যে জিনিস যত নিষিদ্ধ, সে জিনিসের প্রতি ঠিক ততটাই আকর্ষন থাকে!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here