প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ২
জান্নাত নুসরাত

মেহেরুন নেছা মাছি তাড়ানোর মতো নাছির সাহেবের কথা উড়িয়ে দিলেন। ভেংচি কেটে বললেন,”আমি কানে হুনবার পারি না, তাই তো এই ইংটোন দিয়েছি। তুমারে বেশি কথা কইবার লাগবো না। এই ইংটোনে সমইস্যা হইলে তুমি কানে তালা লাগাইয়া লও।
নাছির সাহেব কথা বাড়ালেন না। প্লেট থেকে ডিম ভাজি কে ছুড়ি দিয়ে কেটে তিন পিস করলেন। এক পিস ইসরাতের প্লেটে এক পিস নুসরাতের প্লেটে দিয়ে দিলেন।
মেহেরুন নেছার মোবাইলে আবার কল আসলো। তিনি ফোন ধরে মোবাইল টেবিলের উপর পানির গ্লাসের সাথে রাখলেন ভর দিয়ে।
ওপাশ থেকে হেলাল সাহেব বললেন,

“আসসালামু আলাইকুম আম্মা!
” ওয়ালাইকুম আসসালাম!
“আম্মা ভালো আছেন?
” হু!
মেহেরুন নেছা খাবার খাওয়া রেখে বললেন,
“বাবা তুমি কিলান আছো?
” যেরকম দেখছেন!
হেলাল সাহেবের পাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলল,”পাপা, বলে দাও না!
মেহেরুন নেছা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“কি কইবা হেলাল?
হেলাল সাহেব ধমক দিলেন কাউকে। তারপর ভিডিও এর দিকে তাকিয়ে বললেন,”আম্মা, একটা কথা বলার ছিল!
“এতো হিয়েলি না কইরা আসল কথা কও আব্বা!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওপাশের ছেলেটা হয়তো বিরক্ত হলো। হেলাল সাহেবের হাত থেকে মোবাইল টেনে নিল নিজের কাছে। বড় গলায় সালাম দিল। মেহেরুন নেছা সালামের উত্তর দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,”কি হইছে আরশ?
আরশ নাম শুনতেই নুসরাতের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। ইসরাতের দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলো ইসরাত ও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইশারায় দু-বোন কিছু কথা বলে নিয়ে নিজ নিজ খাবার খেতে ব্যস্ত হলো।
আরশ গম্ভীর গলায় ফোনের ও-পাশ থেকে বলল,
“দাদি দু-দিন পর পাপা দেশে আসছে! এটা বলতে গিয়ে পাপা বার বার থেমে যাচ্ছে। আপনাদের সবাইকে না জানিয়ে আসতে চাইছিলেন তাই আমি জোর করে পাপা কে দিয়ে কল দিয়ে জানিয়ে দিলাম।
নুসরাতের কপালের ভাঁজ শীতিল হলো। হেলাল সাহেব দেশের আসার কথা শুনে নুসরাতের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল আলাদা ধরণের শির-শিরানি বাতাস। হাতের রুম ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে গেল।

নুসরাত অবাক চোখে তাকিয়ে নিজের হাত পায়ের অস্বাভাবিক কম্পন দেখলো। ততক্ষণে খাবার টেবিলে এক প্রকার হইচই লেগে গেছে। সবাই খাবার খাওয়া থামিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে।
মেহেরুন নেছার চোখ অশ্রুসিক্ত! সাদা শাড়ির কোণ দিয়ে চোখের জল মুছলেন।
” আরে দাদি কাঁদছ কেন? এই জন্য পাপা তোমাকে জানাতে চায়নি!
আরশের নিরেট গলার স্বর। মেহেরুন নেছা চোখ মুছে নিয়ে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,”তোরা আইবি?
উচ্ছাস গলা নিয়ে আরেকটা ছেলে বলে উঠলো,
“আসলে কি আমাদের বিয়ে দিবে?
মেহেরুন নেছা উচ্চ শব্দে হাসলেন। হেলাল সাহেব চোখ পাকালেন ছেলেটার দিকে।
” আইচ্ছা দিমু নে সুন্দর দেইখা একটা মাইয়ার সাথে তোর আর জায়িনের বিয়া। তোরা আসবি?
“আমি আর ভাইয়া এখনো সিউর না!
আরশের সিউর না শুনে ঝিমিয়ে পড়া নুসরাত শয়তানি হাসি দিল। উৎফুল্ল হয়ে নাস্তা করতে লাগলো।
হেলাল সাহেব বললেন,

” আম্মা নাস্তা করছো?
“অয়! তোদের ওখানে কয়টা বাজে?
” এই তো পাঁচটার আশে-পাশে! নামাজ পড়েছ তুমি!
মেহেরুন নেছা মাথা নাড়ালেন। হেলাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”বাড়ির সবাই এখানে আছে?
“দাঁড়া দেখাই!
মেহেরুন নেছা ব্যাক ক্যামেরা করতেই নুসরাত প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, পেছন পেছন ইসরাত ও উঠে দাঁড়ালো! দু-জন প্লেট নিয়ে অগ্রসর হলো কিচেনের দিকে।
মেহেরুন নেছা পিছু ডাকলেন,
” এই ছ্যাঁমড়ি! কই যাও? তোমাগো আব্বার সাথে কথা কও?
দুজনের একজন পিছন ফিরে তাকালো না। তাদের বয়েই গেছে উনার সাথে কথা বলবে। নাছির সাহেব নুসরাত কে ডাকলেন,”নুসরাত!
নেই উত্তর নেই! আরশ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে রইলো। চোখ ছোট ছোট করে নুসরাতের পরণের কাপড় সকলের আগে নোটিশ করলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলো যে-দিক দিয়ে দুই বোন গিয়েছে ওই দিকে।

সৈয়দ বাড়িতে আজ আলোড়িত হয়ে আছে এক প্রকার খুশির জুমে। বাড়ির তিন কর্তীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করছেন। একজন রুম পরিস্কার করছেন, তো অন্যজন কিচেন সামাল দিচ্ছেন, তো আরেকজন আসবাবপত্র বের করে ডায়নিং টেবিল সুন্দর করে সাজাচ্ছেন। মেহেরুন নেছা পান চিবুতে চিবুতে সবকিছুর তদারকি করছেন। বউদের দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে কী করতে হবে!
বাড়ির মহিলারা কাজ করতে থাকলে ও এই বাড়ির চার মেয়ে এঁটে আছে নিজেদের রুমে। চারজনের একজন ও নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলনা মা-চাচিদের।
বাড়ির তিন কর্তীই সবকাজ নিজেরা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকক্ষণ পর নাজমিন বেগম কিচেন থেকে ঝিমানো পায়ে বেরিয়ে এসে বসলেন ধপ করে সোফার উপর। মৃদু কন্ঠে ঝর্ণা বেগমকে ডেকে উঠলেন,”সেজ, যা তো গিয়ে দেখে আয়, মেয়েগুলো কি করছে? আর গোসল না করলে বল তাড়াতাড়ি গোসল করার জন্য। তোদের ভাই একটু আগে ফোন দিয়ে বলল লন্ডনের ফ্লাইট কিছুক্ষণ আগে ল্যান্ড করেছে।

ঝর্ণা বেগম হাত ওড়নায় মুছতে মুছতে বের হয়ে আসলেন স্টোর রুম থেকে। ডায়নিং রুমে দাঁড়িয়ে শব্দ করে শ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন উপরের তলার দিকে। রুমের বাহিরে দাঁড়াতেই কানে আসলো দু-বোনের ফিসফিস কন্ঠে কথা বলার শব্দ। সেদিকে কান না দিয়ে ঠকঠক করে শব্দ করলেন দরজার উপর। ভিতর থেকে ইসরাতের গলা ভেসে আসলো,”ভিতরে আসো!
পারমিশন আসতেই ঝটপট ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলেন ঝর্ণা বেগম। ইসরাত আর নুসরাত তার দিকে তাকিয়ে ছিল, ঝর্ণা বেগম ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখা-চোখি হলো তার সাথে দু-বোনের। ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন ঝর্ণা বেগম। ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”কী করছ দু-জন?
ইসরাত পিছনের দিকে সরে বসতে বসতে বলে,

“এই তো ছোট ফুপির বিয়ের ভিডিও দেখছি।
ঝর্ণা বেগম বিছানায় বসে ওড়নার সাহায্যে কপালের ঘাম মুছলেন। হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,”এই সময় দেখছ কেন?
নুসরাত বিছানায় শুয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে জিজ্ঞেস করল,”বিয়ের ভিডিও দেখতে হলেও কী সময় দেখে দেখতে হয়?
ঝর্ণা বেগম কপাল কুঁচকালেন। নুসরাতের দিকে কুঁচকানো কপাল নিয়ে চেয়ে আওড়ালেন,”তুমি এরকম কেন? একটা প্রশ্ন করলে ঘুরিয়ে আরেকটা প্রশ্ন ফিরিয়ে দাও!
নুসরাত মাথার নিচে দু-হাত রেখে আরাম করে শুয়ে আওড়ায়,”কারণ আমি এরকম,তাই আমি এরকম!
ইসরাত ল্যাপটপের দিকে ইশারা করে ঝর্ণা বেগমকে। ছোট তিনটি বাচ্চাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,”এই ছেলেটা কে?
“কোন ছেলে?
“ওই যে ফুপির ডান পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে।
“ওহ ও? ওতো আরশ! তোমাদের বড় বাবার ছেলে! ওকে চিনতে পারছ না?
বিরক্তি নিয়ে ইসরাত বলল,

” চিনতে পারব কীভাবে? কথা হলে তো চিনতে পারব!লাস্ট বারো বছর আগে দেখা হয়েছে কথা মেবি হয়েছে লাস্ট বারো বছর আগে। চেহারার নকশা কেমন ছিল তাইয়ি ভুলে গেছি।
নুসরাত হে হে করে হাসতে হাসতে আওড়ায়,
“ভেচকানো মার্কা, মানচিত্রের মতো চেহারা ছিল।
ঝর্ণা বেগম মৃদু হাসলেন নুসরাতের কথায়। সতর্ক করে বললেন, “মেজ আপার কানে গেলে, নুসরাত তোমার পিঠে দু-ঘা পড়বে মনে রেখ। ইয়া আল্লাহ দেখ, তোমাদের গোসল করার জন্য বলতে এসে গল্প করতে বসে গিয়েছি। যাও যাও গোসল করতে যাও! মেজ আপা পরে আমাকে বকবে।
ঝর্ণা বেগম কে পিছন থেকে ডেকে উঠল নুসরাত,
“বৌমা!
ঝর্ণা বেগম মাথা ঘুরিয়ে ধীর কন্ঠে বলেন,
” হু!

নুসরাত জিজ্ঞেস করল,
“কয়টার ফ্লাইটে আসবেন দ্যা গ্রেট সৈয়দ হেলাল সাহেব এন্ড হিজ সন’স ?
ঝর্ণা বেগম বললেন,
“ওদের লন্ডনের ফ্লাইট দশ মিনিট আগেই এসে পৌঁছেছে,মেজ ভাই কল করে বললেন।
নুসরাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখন কয়টা বাজছে বৌমা?
ঝর্ণা বেগম বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করছ কয়টা বাজে! তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
নুসরাত নাক মুখ কুঁচকে বলল,
” আহ…বলো না কয়টা বাজছে? এতো কথা বলোনা তো। তুমি তো জানোই আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করিনা।
ঝর্ণা বেগম ভেংচি কাটলেন নুসরাতকে। ঝটপট রুমের বাহিরে বের হতে হতে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন,
“১:১৫।
ঝর্ণা বেগম বের হওয়ার আগে ইসরাত আবারো পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করল,” লন্ডনের ফ্লাইটে ওরা আসবে কেন?
ঝর্ণা বেগম মাথায় হাত রেখে ঈষৎ চোখ কুঁচকে বললেন,
“আরে বোকা মেয়ে ফ্রান্স থেকে আসলে সোজা ঢাকায় আসতে হবে, ফ্রান্সের ফ্লাইট সিলেটে এখনো করা হয়নি, কিন্তু ট্রানজিট ফ্লাইটের মাধ্যমে আসা যায়। তাই ওরা ফ্রান্স থেকে দু-ঘন্টার জার্নি করে লন্ডন আসছে, এরপর সরাসরি সিলেট আসছে। বুঝেছ, এবার আমি যাই?
ইসরাত আবার বলল,

“এক মিনিট! ওরা চাইলে তো সোজা ঢাকা চলে আসতে পারত তাহলে এত পেঁচিয়ে আসার মানে কী?
ঝর্ণা বেগম নিচু স্বরে বললেন,
” ওসব তোমাদের বড় বাবার কারসাজির নিম্নমানের একটা উদাহরণ। এরপরে কী কী হয় শুধু দেখ? আর কিছুক্ষণ পর তো এখানে এসে পড়বেন, তখন দেখে নিও।
ঝর্ণা বেগম কথা শেষ করে বের হয়ে যাওয়ার পর নুসরাত ইসরাত কে ধাক্কা দিল গোসলে যাওয়ার জন্য। ইসরাত নুসরাত কে ধাক্কা দিল নুসরাতকে। একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিতে থাকল, গোসলে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর হার মেনে গোসল করতে চলে গেল ইসরাত। বিছানার মধ্যে অলস ভঙ্গিতে পড়ে রইল নুসরাত। বোঝা গেল গোসল করার কোনো তাড়া নেই তার। রুম থেকে চিৎকার করে ইসরাতের উদ্দেশ্যে বলল,”এক ঘন্টা হওয়ার আগে গোসল থেকে বের হবি না। বের হলে তোকে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখব রেলিঙের সাথে।

দো-তলা থেকে হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নুসরাত ড্রয়িং রুমে আসলো। মেহেরুন নেছাকে পান বানাতে দেখে এগিয়ে গেল তার দিকে। তারপরই কোনো আগাম বার্তা ছাড়া ধুপ করে মেহেরুন নেছার নিকট গিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে বসে গেল। মেহেরুন নেছা কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন নুসরাতের এরকম ঘষাঘষি দেখে বিরক্তি নিয়ে বললেন, “এইই তুই আমার লগে লাইগা বইছত ক্যা?
নুসরাত হাসল। মেহেরুন নেছার আরো একটু গা ঘেঁষে বসে কর্কশ কন্ঠে বলল,”আরে বুড়ি এত তেজ দেখাও কেন? যেভাবে চ্যাত করে উঠতেছ মনে হচ্ছে আমাকে একটা বিয়ে দিয়ে রাখছ, এখন আমি জামাইরে ঘরে রাইখা আইসা তোমার সাথে ঘষাঘষি করতেছি। হাহ….
মেহেরুন নেছা তেঁতানো মেজাজ নিয়ে তেরছা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,”তোরে বিয়া করব কেডা?
নুসরাত হা হা করে হাসল। দু-হাত দু-দিকে মেলে বলল,” আমাকে বিয়ে করার জন্য কী লোক কম পড়ছে? একটু বাহিরে তাকালে দেখতে পাবে আমার জন্য কত পোলা মজনু হইয়া ঘুরতাছে।
মেহেরুন নেছা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“এ্যাহ আইছে, তোর জন্য পোলা মানুষ দিবানা হইয়া ঘুরব। ওই মজনুই তোর জন্য দিবানা হইব আর কেউ হইব না। বুঝচ্ছত?
“উফফফ দাদা, এরকম করছো কেন?
” তাইলে কি রকম করুম? তোর সাথে বইলা দে আমারে!
“ভালোবেসে আদর করে কথা বলবে এরকম করবে নাহ। শুধু চিড়বিড় করে উঠো কেন? মনে হয়, তোমার উপর কেউ গুঁড়ো মরিচ ছিটিয়ে দিয়েছে।
মুখ কিছুটা বাঁকিয়ে মেহেরুন নেছা বললেন,
” ওরে আমার নবাবজাদী, ওনার সাথে আদর করে কথা বলতে হবে।
নুসরাত কিছুক্ষণ চুপ করে বসল। তারপর আরো একটু মেহেরুন নেছার দিকে এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে ডেকে উঠল, “দাদা…!
মেহেরুন নেছা নুসরাতকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে অনিহার সহিত বললেন,” কী দাদা? আমি তোর দাদি এই কথা কতবার মনে করাইয়া দেওন লাগব?
নুসরাত মেহেরুন নেছার কথায় কান না দিয়ে, বিরক্ত করার জন্য আবার ভেঙ্গিয়ে বলে ওঠল,”আচ্ছা মনে থাকবে দায়ায়ায়ায়ায়া দায়ায়ায়ায়ায়া…..

এভাবে বলে গান শুরু করল। কিৎকাল পর মুখ শক্ত করে নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেল। তারপর মেহেরুন নেছাকে জিজ্ঞেস করল, ” দাদা আজ শুনলাম তোমার নাতিরা নাকি দেশে আসছে?
মেহেরুন নেছা নুসরাতের থেকে সরে বসতে বসতে বললেন,”হুম! তো কী হইছে তোর? ঈর্ষা করছিস নাকি আমার নাতিগো?
নুসরাত ভেংচি কাটল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি কেন ঈর্ষা করব তোমার নাতিদের? আমার মনে হয় খেয়ে দেয়ে কাজ নাই। এসব ঈর্ষা করার থেকে আরো বড় বড় কাজ আমার কাছে আছে। সামান্য ঈর্ষা করে আমি, এই নুসরাত আমার টাইম ওয়েস্ট করিনা।
মেহেরুন নেছা নুসরাতের কথায় ফোড়ন কেটে বললেন,”কাজ তো নাই তোর, সারাদিন নাচানাচি করিস, কোনো কাজ কাম তো করিস না , বিয়ের পর জামাইয়ের বাড়ি গিয়া কী করবি? যখন ধাইক্কা দিয়া বাইর কইরা দিবনে তখন বুঝবা আসল মজা।
নুসরাত হাসতে হাসতে মেহেরুন নেছার গায়ে ঢলে পড়ল। হাসির তোড়ে মৃদু কন্ঠে আওড়াল,”আরে বুড়ি চিন্তা করো না! আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে, আর কাজ-কাম না করলেও জামাইয়ের বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন মেহেরুন নেছা,

” কীভাবে?
“তোমার ছোট নাতিকে বিয়ে করে নেব।
কথাটি বলে হা হা করে হাসতে লাগল নুসরাত। আবারো হাসতে হাসতে মেহেরুনের গায়ে ঢলে পড়ল।
মেহেরুন নেছা বিরক্ত হয়ে নুসরাতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন। হাত উঁচু করে বললেন, ”গা ঘেইষাঘেইষি করবি না, আরেকবার করলে খুব খারাপ হইব তোর সাথে!
মেহেরুন নেছার কথা পাত্তা দিল না নুসরাত। হেসে উড়িয়ে দিল মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে।
গোসল শেষ করে ইসরাত উপরের তলা থেকে নিচের তলায় নামছিল। মেহেরুন নেছা ইসরাতকে খেয়াল করে বললেন,”আমার সোনা নাতনিডা আসছে। ওর মতো হইতে পারিস না। সারাদিন শুধু হা হা হিহি করিস।
নুসরাত একবার বোনের দিকে তাকাল তো একবার দাদির দিকে তাকাল। দাদির মুখ খুশি খুশি। নুসরাত তার কারণ ও জানে! এত হাসি কেন মেহেরুন নেছার মুখে? মেহেরুন নেছা হাত বাড়িয়ে ইসরাতকে টেনে এনে নিজের পাশে বসালেন।
ইসরাতের দিকে ইশারা করে বললেন,

“ওর মতো কাপড় পরতে পারিস না। সারাদিন বেটা ছেলেদের মতো ঘোরাঘুরি করিস। তোরে বিচ্ছিরি দেখতে লাগে।
নুসরাত বোনের কাপড়ের দিকে তাকালো, হালকা নীল রঙ্গের থ্রি-পিস পরিধান করেছে,সাথে মেচিং ওড়না ও সেলোয়ার পরেছে। প্রসাধনীর ছোয়া নেই গোলাকৃতি সাদা মুখটায়। ইসরাতের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাহা করে হেসে উঠল। হাসার সাথে নিজের গায়ে দু-একটা থাপ্পড় মারল। কাউচে থাপ্পড় মেরে মেরে জিজ্ঞেস করল,”তোকে দেখতে আসছে নাকি? যে এতো সুন্দর হয়ে সেজেগুজে ঘুরছিস?
আঙুল তুলে ইসরাতকে ভেঙ্গিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল।
মেহেরুন নেছা হাত তোলে নুসরাতের বাহুতে আঘাত করলেন। রাগী কন্ঠে বললেন,”এই তুই আমার নাতনিডারে নিয়ে হাসছিস ক্যা? চুপ হাসি বনকর!

হাতে মার খেয়ে মুখ বন্ধ করে নিল নুসরাত। কিন্তু, হাসি থামাল না হাত দ্বারা মুখ ঢেকে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এটা তার অভ্যাস! কেউ হাসতে মানা করলে, বা সিরিয়াস মোমেন্টে তার হাসি ঠোঁটে নিচে আটকায় না, ঠুস করে বের হয়ে আসে দাঁতের ফাঁক গলে। তাই এবার ও তাই হলো মৃদু শব্দে হিহি করে হেসে ওঠল।
মেহেরুন নেছা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
“দেইখা লো বেলেহাজটার অবস্থা, মার খাইয়া ও হাসতাছে।
নুসরাত ইসরাতের দিকে হাসি থামিয়ে তাকাল কিছুক্ষণ। দু-বোন চোখাচোখি করে নিয়ে ল উপর নিচ মাথা নাড়াল। তারপর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দুই বোন হা হা করে হাসতে লাগল। মেহেরুন নেছা মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে তাকলেন ইসরাতের দিকে। মিনমিন করে বললেন,”তুই ও??

দুপুর দুইটায়। সৈয়দ বাড়িতে এক এক করে তিনটা গাড়ি প্রবেশ করল। পাকিং এড়িয়ায় গাড়ি পার্ক করার পর প্রথম গাড়ি থেকে নামলেন লুৎফা বেগম উনার দুই ছেলে মেয়ে। ছোট মেয়ে মমো চৌধুরী এবং মেজ ছেলে আশিক চৌধুরী।
২য় গাড়ি থেকে নামলেন লুৎফা বেগমের বড় মেয়ে সাজিদা চৌধুরী তার স্বামী শুভ মির্জা এবং ছেলে শুভ্র মির্জা।
তৃতীয় গাড়ি থেকে নেমে আসলেন মাহমুদা এবং উনার স্বামী সরওয়ার। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই।
সৈয়দ বাড়ির সবাই দরজার সামনে এগিয়ে গেলেন মেহমানদের এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য। বাড়ির মেজ কর্তী নাজমিন বেগম, বাড়ির সেজ কর্তী ঝর্ণা বেগম,এবং বাড়ির ছোট কর্তী রুহিনী বেগম,সাথে ইসরাত, অনিকা, আহান, আরিশা।
নাজমিন বেগম চোখ ঘুরালেন সবার দিকে কাউকে খোঁজলেন, বাড়ির মানুষের ভীরে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে হয়তো খুঁজে পেলেন না। তাই না খুঁজে পেয়ে মুখে অসন্তোষ ভাব ছেয়ে ওঠল নাজমিন বেগমের। ইসরাতের কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন,”নবাবজাদী কই?
ইসরাত মায়ের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে নম্র কন্ঠে বলল,

” রুমে।
ছোট্ট করে জবাব দিল। বাড়তি কোনো শব্দ ব্যয় করল না! বাড়তি শব্দ ব্যয় করলেই আরো একটা কথা বাড়বে আর সে এখন বাড়তি কথা বলতে চাচ্ছে না। তাই তার জবাব টুকরো মাত্র।
নাজমিন বেগম আদেশ দিলেন,
“যা ওকে ঢেকে নিয়ে আয়।
ইসরাত আবার ছোট্ট শব্দে, “আচ্ছা, বলে চলে গেল দো-তলায়।
নাজমিন বেগম অপেক্ষা করতে লাগলেন দুই মেয়ের কিন্তু দু’জনের একজনও নিচে আসলো না। নাজমিন বেগম বিড়বিড় করলেন,”ওই বোকাটা মনে হয়, নিজের সাথে বসিয়ে রেখে দিয়েছে,আসতে দিচ্ছে না! একে নিয়ে আমি কি করব?

সকল বাসায় প্রবেশের পর কুশল বিনিময় করলেন।সবাইকে ড্রয়িং রুমে বসানো হলো। বাড়ির কর্তীরা এক এক করে নাস্তা দিতে শুরু করলেন মেহমানদের । এর মধ্যে নাছির সাহেবের কল আসল আবার, নাছির সাহেব বললেন আমরা ইতিমধ্যে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছি আধঘন্টা লাগবে বাসায় পৌঁছাতে। বলে ফোন রেখে দিলেন।নাজমিন বেগম নিচ তলা থেকে তাড়া দিলেন যে যে গোসল করেনি করে নিতে। অনিকা ড্র‍য়িং রুম থেকে নিজের রুমের দিকে চলে গেল রেডি হওয়ার জন্য।
নাজমিন বেগম জাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“সেজ আমি একটু আসছি তুই আর ছোট একটু এই পাশ সামলা।
রুহিনী বেগম বললেন
“আচ্ছা মেজ আপা তুমি যাও,আমরা সামলে নিচ্ছি।

নাজমিন বেগম দো-তলার সবার প্রথমের বেড রুমে গেলেন, গিয়ে খেয়াল করলেন ইসরাত মোবাইলে ফেইসবুক স্ক্রল করছে আর নুসরাত বিছানার নিচের দিকে মাথা দিয়ে বিছানার উপর দিকে পা রেখে শুয়ে আছে। আর কাকের মতো কা কা করে গান গাইছে,”জানতো যদি নুসরাত রানী বাঁচবে কতদিন বানাইতো পাঁচতলা বিল্ডিং করিয়া রঙ্গিন।
নাজমিন বেগম ধমকের স্বরে নুসরাতের গানের মাঝখানে বলে ওঠলেন,”এই তুই এখনও গোসল করিসনি? এই যা গোসল করতে।
হাত তুলে মারার জন্য এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে নাজমিন বেগম।
” আরে মা যাচ্ছি।

বলে নুসরাত এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর শক্ত হাতে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল নাজমিন বেগমের মুখের উপর।
ইসরাতের দিকে তাকিয়ে নাজমিন বেগম বললেন,
“কাপড় চেঞ্জ কর, কাবার্ড থেকে নতুন কাপড় পরে নিবি।
ইসরাত শান্ত গলায় কিছুটা বিরুধিতা করে বলল,
“আম্মা এটা তো নতুন।
নাজমিন বেগম কঠোর স্বরে বললেন,
“চেঞ্জ করতে বলেছি মানে চেঞ্জ করবি, আমি তোমাকে আদেশ দিয়েছি জিজ্ঞেস করিনি ইসরাত।
ইসরাত হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল! সন্তুষ্ট হয়ে নাজমিন বেগম কিচেনে চলে গেলেন। নাজমিন বেগম চলে যেতেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে মাথা বের করল নুসরাত। রুমের চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখল নাজমিন বেগম আছেন কি না! ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কু কু করে শব্দ বের করল মুখ দিয়ে। নুসরাতের এইরকম অদ্ভুত শব্দ বের করা দেখে ইসরাত মাথা ঘুরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,” কি হয়েছে?
নুসরাত জিজ্ঞেস করল,

“আম্মা চলে গিয়েছে?
” হুম!
ইসরাতের বলতে দেরি হয়েছে লাফ দিয়ে বিছনার ওপর নুসরাতের আসতে দেরি হয়নি। নুসরাত কে বিছানায় উঠে বসতে দেখে ইসরাত জিজ্ঞেস করল “তুই গোসল করবি না নুসরাত?
নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“নাহ, এখন করব না।
ইসরাত জিজ্ঞেস করল আবার,
“তো কখন করবি? মেহমান তো প্রায় চলে এসেছে।
নাক ছিটকে নুসরাত আওড়ায়,
“সন্ধ্যার সময় করব। আর এরা কীসের মেহমান? এদের আমি মেহমান মনে করিনা। তুই একটু বেশি ইম্পর্ট্যান্ট’স দিয়ে দিচ্ছিস না এদের? চিল ব্রোহ, চিল এদের বেশি পাত্তা দিবি না। পাত্তা দিলেই মাথায় চরে বসবে। সো বি কেয়ারফুল।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১

ইসরাত নুসরাতের কথায় কোনোরুপ বিরুধিতা না করে বলল,”আচ্ছা।
কথা শেষ হওয়ার পর নিচে গাড়ি আসার শব্দ হলো।
দু- বোন নিজেদের দিকে তাকিয়ে এমনভাব করল যেন ওরা কোনো মেহমান না,তারপর ঠাস করে বিছানায় শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকল নুসরাত। আর ইসরাত মোবাইল স্ক্রল করতে লাগল।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here