প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩
জান্নাত নুসরাত

কিছুক্ষণ আগের পরিষ্কার আকাশ এখন কালো মেঘের আধারে ঢেকে গেছে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পর মেঘের গর্জন ভেসে আসছে আকাশ থেকে। ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে রিকশা, সাইকেল। হঠাৎ হঠাৎ মাটি বহনকারী ট্রাক উচ্চ শব্দে হর্ণ বাজিয়ে তীব্র গতিতে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাওয়া রাস্তার কাদামাটি ট্রাকের চাকার গতিতে ছিটকে এসে পড়ছে সৈয়দ বাড়ি ঘিরে রাখা গেটে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে এসব লক্ষ্য করছিল ইসরাত। সে যতটুকু বুঝতে পারছে, আজ সে, বাবা, বোন আর মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে—আজীবনের জন্য।

উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেয়েলি মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। তারপর মুখে হাতের তালু চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। বড় বাবা করা অপমান বারবার চোখের সামনে ভাসতে লাগে ছোট্ট মেয়েটার।
মেয়েটা মুখে হাত চেপে রেখে কান্না থামায়। চোখে সামনে ভেসে উঠা অপ্রাথিব দৃশ্যটা মনে করে মুখ শক্ত করে নেয়। সে মনে করতে চায় না এই দৃশ্য, তবুও মনে পড়ে যায়!
চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভাসে আজ সকালে পাঠাগারে বসে মাথা চাপড়ে, আহাজারি করে বাবার কান্না। ভাইয়ের কথা মানতে বাড়ি ছেড়ে দিতে রাজি হলে ও মনে মনে ঠিক আশা নিয়ে বসে ছিলেন, ভাই আজ মানিয়ে নিবেন। কিন্তু তিনি আবার হতাশ হলেন যখন দেখলেন আজ ভাইয়ের রুম থেকে নামাজ পড়ার কোনো শব্দ আসছে না। তার এই আহাজারি দাঁড়িয়ে নিরবে দেখছিল ইসরাত। বাবার সামনে যায়নি, বাবা হয়তো তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়বেন এই অবস্থায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইসরাতের মনে হলো আবার ও গলার কাছে কিছু দলা পাঁকাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে চোখ চেপে ধরতেই হেঁচকি উঠল। তারপর এক ফোঁটা পানি আবার গড়িয়ে পড়ল শুভ্র গাল বেয়ে।
নিজের বাবাকে নিয়ে এতো চিন্তায় ছিল যে, সামনে এসে কখন জায়িন দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেনি সে। জায়িন নীরবে দাঁড়িয়ে ইসরাতের এক একটা পদক্ষেপ লক্ষ করল। সান্ত্বনা দেওয়ার তাগিদে হাত বাড়িয়ে মেয়েটার মেয়েলি মসৃণ নরম চুলগুলো স্পর্শ করল।
মাথায় মোলায়েম হাতের স্পর্শ পেয়ে ইসরাত চোখ তুলে তাকায় উপরের দিকে। জায়িন ও তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে, স্বল্প সময়ের জন্য দু-জনের চোখাচোখি হলো।

অতঃপর জায়িন নিজেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। ইসরাতের মাথার উপর তার হাত তখনো স্থির রাখা। নিজের গম্ভীরতা এক পাশে ফেলে দেশে আসার পর এই প্রথম ইসরাতকে একটা কথা বলতে নিল সে, তা ও নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে। নিজের থেকে ছয় বছরের ছোট মেয়েটাকে তুই বলে সম্বোধন করতে পারল না। কারণ,
এর আগে সে ইসরাতের সাথে কথা বলার ইচ্ছে পোষণ না করায়, ইসরাত ও কোনো রকম কথা বলেনি। খাবার টেবিলে, বা সিঁড়ি দিয়ে উপরে-নিচে নামার সময় শুধু চোখাচোখি হয়েছিল তাদের। কোনো বাক্য আলাপ,বা বিনিময় হয়নি। তাই এবার সান্ত্বনা বাণী দিতে আসা চৌদ্দ বছর বয়েসী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, ম্যাচিউর জায়িন কোনো সম্বোধন খুঁজে পেল না। ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু গলায় নম্রতার সহিত বলল,”আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বু আবার আপনাদের এ-বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।

ইসরাত কথাটা শোনার সাথে সাথেই চোখ তুলে উপরে তাকাল। বিস্ময়ে নিয়ে চেয়ে রইল গোল গোল চোখে। ইসরাতকে বিস্ময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে জায়িন আবার বলে,”আপনি কান্না করবেন না, আপনাকে কান্না করতে দেখলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
জায়িনের ভীষণ খারাপ লাগা কথাটি শুনে ইসরাত এবার পেট এক হাত দিয়ে চেপে ধরে হেসে উঠল। ইসরাত কে খিলখিল করে হাসতে দেখে জায়িন লজ্জা পায়। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে নিজের লজ্জা সংবরণ করার চেষ্টা করল ছেলেটা। হলো না! কিশোরের শুভ্র গাল নিমেষেই লাল হয়ে গেল। ইসরাত অবাক চোখে তাকিয়ে নিজের গালে দু-হাত চেপে ধরে বলতে লাগল,”এই আপনি লজ্জা পাচ্ছেন? হায় আল্লাহ, আপনার গাল লাল হয়ে গেছে। আরে আরে, মেয়েদের মতো করছেন কেন আপনি?

ইসরাতকে মজা নিতে দেখে জায়িন দ্রুত পায়ে পিছন ঘুরল, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনো তার কানে আসছে মেয়েলি হাসির শব্দ। জায়িন বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছু ঘুরল ইসরাতকে দেখার জন্য। আর তখনি ধুক ধুক শব্দ তোলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসতে থাকা মেয়েটির কাছে আটকাল কিশোরের হৃদয়। কিশোর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ধ্যান-জ্ঞান খুঁইয়ে মৃদু গলায় বিড়বিড় করে আওড়ায়, ❝আপনার হাসি মারাত্মক সুন্দর ইসরাত! আপনার এই রিনঝিনে হাসির শব্দ যে-কারোর বিনাশ ডেকে আনতে সক্ষম।❞

সেইদিনই তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। এরপর ওই বাড়িতে কি হয়েছে কেউই বলতে পারেনা তারা। সেই বিষয়ে সকলেই অজ্ঞ! বাড়ি থেকে বের হয়ে তারা উঠেছিল একটা তিন রুমের ছোট্ট বাসায়। সেই বাসায় প্রবেশ করার সাথে সাথে নাছির সাহেব স্পষ্ট বলে দিলেন বিয়েটাকে ভুলে যেতে। ওইটা একটা পুতুল খেলার মতো খেলা ছিল। সেইদিনের পর কেউই বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা তুলেনি নাছির সাহেবের সামনে।

ধীরে ধীরে সময় গড়াল, একদিন, এক সপ্তাহ, একমাস, এক বছর এরকম করে বারো বছর গড়াল। এই বারো বছরে কেউই বিয়ে বিষয়ক প্রশ্ন তুলেনি নাছির সাহেবের সামনে। একই সুতোয় বাঁধা ছেলে-মেয়ে গুলো ও বড় হতে লাগল। যোজন-যোজন দূরত্ব তৈরি হলো তাদের মধ্যে। সময়ের বিবর্তনে ছাপ পড়ল তাদের মস্তিষ্কে। কয়েক বছর আগে নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাদের কাছে। এক প্রকার ভুলতে বসল নিজেদের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা। আর তখনই ছোট্ট মেয়েটার হাতে লাগল গোলাপি রঙের একটি ডায়েরি। মেয়েটার দাদার ডায়েরি! যে ডায়েরিটা সবসময় বাবা লুকিয়ে রাখত তার আর ইসরাতের কাছ থেকে,সেই ডায়েরির প্রতি এক অজানা কৌতূহল জাগল মেয়েটার।

বাবার অগোচরে একদিন সেই ডায়েরি পড়তে শুরু করল মেয়েটা। আর ডায়েরি পড়ে সেখান থেকে উদ্মাঘাটন হলো বড় একটা রহস্যের। আর সেই রহস্যের উদ্মঘাটনের ফলে, ছোট মেয়েটা যে এই বারো বছরে বড় হয়েছে সে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল নিজ জায়গায়। সে ভাবতে ও পারেনি এই ডায়েরির ভিতর এতো বড় রহস্য চাপা দেওয়া রয়েছে। নিজের ভাবনার থেকে বড় কিছু বের হয়ে আসতে দেখে মেয়েটা কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। যেখান থেকে মেয়েটা জানতে পারল কিছু ধুলো পড়ে যাওয়া অনেক বছর আগের ঘটনা। যা তার মস্তিষ্ক থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। যার উপর পড়েছিল মোটা এক ধুলোর আস্তরণ। আর সেই আস্তরণ এভাবে আজ সরে যেতেই, সে নিজ জায়গা থেকে নড়তে ভুলে গেল।

এতো বছর ধরে মনের ভিতর জমা হওয়া এক একটা প্রশ্নের উত্তর সেকেন্ডের ভিতর পরিস্কার হয়ে গেল তার কাছে। এই জন্য তারা দাদার সাথে তাদের বাড়ি থাকে না? এই জন্য বাবার ব্যবসা আলাদা? বড় বাবার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই! নিজের ভিতরে জমা হওয়া হাজারো কেন এর উত্তর ধীরে ধীরে পরিস্কার হয়ে গেল। আর এই জন্য তার বিটকেল বাপ এতোদিন ধরে তাকে এই ডায়েরির আশে-পাশে আসতে দেয়নি। নিজের ভাইয়ের কূ-কীর্তি সে জেনে যাবে বলে? যুবতী হয়ে যাওয়া মেয়েটার মনে আরেকটা প্রশ্ন জাগল ইসরাত এই সম্পর্কে কি জানে? নাকি সব ভুলে গিয়েছে? সবকিছু এখন তাকেই বের করতে হবে। নিজ মনে বিড়বিড় করে আওড়াল,”লেগে যা মেয়ে লেগে যা, নতুন আরেকটা ক্যাস! মনে হচ্ছে
এবারের ক্যাসটা দারুণ ইন্টারেস্টিং হতে যাচ্ছে। ক্যাস সলব করার আগে নাছির সাহেবকে একটু বাজিয়ে নেওয়াই যায়, দেখি আর কি কি লুকিয়েছেন আমার গুণোধর আব্বাজান আমার কাছ থেকে?

ইসরাত কান বাড়াল ছেলেটা কি বলছে শোনার আশায়। দূর হতে দেখল ছেলেট মুখ নাড়াচ্ছে, আর কিছু বিড়বিড় করছে। ইসরাত এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে ছেলেটার কাছে, হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে ছেলেটাকে, নেই! কোনো অস্তিত্ব নেই!ইসরাতের চোখের সামনে থেকে ছেলেটার শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রতঙ্গ কালো ছাই হয়ে হাওয়ায় উড়ে যায়। বাচ্চা মেয়েটি সামনে হেঁটে গেল ছাই গুলো ছোঁয়ার আশায়, তখনি কানে আসলো পিছন থেকে কারোর কান্না! অতঃপর আরেকটা বাচ্চা কন্ঠ ভেসে আসলো,”ইসরাত আব্বা তোমাকে ডাকছে, তাড়াতাড়ি আসো!

পরপর ধুপ করে শব্দ হতেই ইসরাত আবার সামনে ফিরল। দেখল,সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে একটা ছয় বছরের বাচ্চা। বাচ্চাটি কান্না করছে না, কপাল চেপে ধরে বসে আছে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে, কপাল থেকে হাত সরাতেই ইসরাতের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো রক্ত! ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েটি রক্তের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। রক্ত, সিঁড়ি, বাচ্চা, দূর থেকে দৌড়ে আসা নাজমিন বেগম, চিৎকারের শব্দ, ধীরে ধীরে সব অন্ধকারে হারিয়ে গেল। শুধু ভেসে আসলো তীক্ষ্ণ, কানভেদ করে দেওয়ার মতো কান্নার শব্দ।
এক লাফে ঘুম থেকে উঠে বসল ইসরাত। শরীর ঘেমে গিয়েছে তার! যখন বুঝল আবার সেই স্বপ্ন দেখেছে তখন দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বিছানার কাছে রাখা টেবিলের উপর থেকে পানির জগ নিয়ে পানি ঢালল গ্লাসে। জগ তার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিয়ে, গ্লাসে নেওয়া পানি এক ঢোকে খেয়ে ফেলল।
পানি পান করে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল পা নামিয়ে মেঝেতে। বুকে এখনো ধুকপুক করছে তার। এই স্বপ্নকে ইসরাত ভয় করে, যখনই এই স্বপ্ন সে দেখে তখনি শরীর অস্বাভাবিক ভাবে ঘেমে যায়। হাত পায়ে কাঁপুনি উঠে।

চোখ বন্ধ করে বুকের বাঁ-পাশে হাত দিয়ে চেপে ধরে শ্বাস ফেলল মেয়েটা। এতক্ষণে খেয়াল করল কারেন্ট নেই!
মুখের মধ্যে জমা হওয়া সেদ জল গুলো কব্জিতে ভালো করে মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। রুমের ভিতর আঁশাটে আঁশাটে গন্ধ হচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জানালার কাছে। থাই গ্লাস হওয়ার ধরুণ লক খুলেই এক পাশে ধাক্কা দিতেই শুরশুর করে খুলে গেল পুরো জানালা। জানালা খুলে যেতেই, খোলা জানালার ভিতর দমকা হওয়া এসে প্রবেশ করল। সামান্য প্রাকৃতিক এই বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল ইসরাতের।

থাই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ। যতক্ষণ পর্যন্ত না, শরীরের অস্বাভাবিক কাঁপুনি আর ধুকপুক না কমে।
ইসরাতের রুমের জানালা রাস্তামুখী হওয়ায় জানালার কাছে দাঁড়ালে সোজা রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। নির্মিশেষ দৃষ্টিতে ইসরাত চেয়ে রইল রাস্তার দিকে। হঠাৎ হঠাৎ চলাচল করা বড় বড় গাড়ির দিকে চোখ বুলাল, তারপর চোখ ফিরিয়ে এনে রাখল গোলাকার চাঁদে। আজ পূর্ণ চন্দ্রিমা। চাঁদের আলোয় পথ-ঘাট সবকিছু পরিস্কার হয়ে আছে। তখনো বাহির থেকে বয়ে আসছে দমকা হাওয়া! টুপটাপ শব্দ তুলেই বৃষ্টি শুরু হতেই ইসরাত নিজের হুশে ফিরে আসলো। জানালার গ্লাস লাগাল না, সাদা রঙের সিল্কের পর্দা টেনে দিল জানালার সামনে। বাতাসের সাথে উড়ে আসা মেঘের ছটা এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল কালো রঙের খাঁজকাটা টাইলস। ইসরাত ভিজতে দিল টাইলস, আজ সারারাত তার পার হবে এইভাবে নির্ঘুম। এই স্বপ্নের কারণে বছরের দুইশত দিন এর বেশি রাত তাকে নির্ঘুম কাটাতে হয়, আর আজ ও তাই হবে।

ইসরাত বিছানায় শোয়ার আগে একবার মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে ঘুমানো নুসরাতের দিকে তাকাল। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটা এক পাশে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে আবুল-তাবুল বকছে আর গালি দিচ্ছে ইরহামকে।
শব্দ করে লম্বা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়ল ইসরাত। চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে চেয়েই সারারাত কাটাল মেয়েটা। আগামীকাল সকালে দেখা যাবে, চোখের নিচে পড়েছে তার গাঢ় মোটা কালো আস্তরণ।
একেবারে ফজরের আযানের পর দু-চোখ বুজল সে। ঘুম পাখি এসে ধরা দিল নির্ঘুম রাত্রিযাপন করা মেয়েটার চোখে।

প্যারিসের ৭ তম অ্যারোন্ডিসমেন্ট উচ্চ বিত্ত একটি শহর। যেখানে বড় বড় দালান এবং ঐতিহাসিক ভার্সিটি গুলো গড়ে উঠেছে। বিখ্যাত ভার্সিটি গুলোর মধ্যে একটা হলো দ্য আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস।
দ্য আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিসে আজ ছাত্র ছাত্রীর সমাগমে মো মো করছে। ভার্সিটিতে আজ সকল বিভাগের স্টুডেন্ট উপস্থিত থাকার কারণে হাঁটতে গিয়ে বার বার ধাক্কা লাগছে একে অপরের সাথে। ধাক্কা লাগাতে কেউ কারোর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না, বা স্যরি ও বলছে না, সবাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পা বাড়াচ্ছে নিজ নিজ ভবনের উদ্দেশ্যে।

যারা এ-বছর পি-এইচ-ডি করছে তারা আজ তাদের গবেষণাপত্র নিয়ে ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়েছে। ফারহান ও তাদের একজন। চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট সুঠাম দেহের পঁচিশ বছর বয়সী পুরুষটি নিজের ঘুম ফেলে আজ হাজির হয়েছে ভার্সিটিতে। পরনে তার আকাশি রঙের শার্ট আর কালো ফর্মাল প্যান্ট। ক্যাম্পাসে হাঁটতে গিয়ে অনেকের বাহুর সাথে বাহুর ধাক্কা লাগল,সেদিকে সে ভ্রুক্ষেপ করল না। নিস্পৃহ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল নিজের ভবনের দিকে। সচারাচর হাঁটতে গেলে এসব ধাক্কা লাগে তাই এটা এতো আমলে নেওয়ার বিষয় না।
নিজ ভবনে পৌঁছানোর পর সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে উঠতে লাগল ছেলেটি। উস্কখুস্ক চুলগুলো হাত দিয়ে ভালো করে পিছনের দিকে ব্যাক ব্রাশ করে এগিয়ে যেতে লাগল নিজের গন্তব্যের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হাতে থাকা কালো ডায়ালের, ভিতরের সাদা পাথরের কাজ করা রোলেক্স সাবমেরিনার টু-টোনের ঘড়িটি চোখের সামনে তুলে ধরল আরশ। সময়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে পায়ের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল নিজ ক্লাস রুমের দিকে।

ক্লাসের ভিতর পা রাখার আগেই কানে ভেসে আসলো পিছন থেকে মাহাদির গলার স্বর। উচ্চস্বরে বার বার ডাকছে আরশ বলে। আরশ পিছু ফিরল না, মাহাদির ডাকের ও কোনো জবাব দিল না, কিছু সেকেন্ডের জন্য নিজ জায়গায় সোজা স্থির দাঁড়িয়ে থেকে, কালো বোট জুতো পরা পা বাড়িয়ে ক্লাস রুমে প্রবেশ করল। পরপর এদিক-সেদিক কোনোদিকে চোখ না বুলিয়ে নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গিয়ে বসে গেল মাঝের এক সিটে।
মাহাদি তখনো তাকে ডেকে চলেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল আরশের সিটের সামনে। হাঁটুতে দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে শ্বাস নিতে লাগল। আরশ নড়চড়হীন! নিস্প্রভ পুরুষালি চোখে তাকিয়ে থেকে সবকিছু লক্ষ করল।
মাহাদি জিরিয়ে নিয়ে ঝুঁকা থেকে উঠে দাঁড়াল। আরশের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে হিসহিস করে শুধায়,”তুই এমন কেন?

আরশ নির্লিপ্ত! তার মধ্যে নেই কোনো উদ্বেগ। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। নিজের নিস্পৃহ দৃষ্টি হাতের স্টেইনলেস স্টিলের বেল্টের ঘড়ির উপর ফিরিয়ে নিয়ে আসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করল আরো পাঁচ সেকেন্ড অতিবাহিত হওয়ার। পাঁচ সেকেন্ডে অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে বলে,”কারণ আমি এমন।
মাহাদি হতাশ হয়ে পড়ল। চোখ উল্টে শব্দ করে বসে গেল আরশের কাছ ঘেঁষে। দু-হাত আরশের গলার সামনে নিয়ে এসে গলা চেপে ধরার মতো করে বলে,
“তোকে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয় শালা!
আরশ কথা বলে না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর, চট করে মাহাদির দিকে ফিরে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,”তোর একটা বোন আছে তাই না?

মাহাদি অবাক হয় আরশের বোন বিষয়ক প্রশ্নে। ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়ায় হ্যাঁ ভঙ্গিতে। যার মানে তার বোন আছে। মাহাফি অনিহা নিয়ে বলে ওঠে,” এমন অভিনয় করছিস মনে হচ্ছে জানিসই না?
আরশ দু-হাত ঘাড়ের পিছনে নিয়ে মটমট করে শব্দ করে। কাঁধ এদিক-সেদিক ঘোরায়। মাথা কাত করে বলে,”শালা বলবি না আমায়! তোর বোনের সাথে বিয়ে দিবি? দিলে বল? তাহলে শালা বলা গ্রান্টেড।
মাহাদি আরশের গলা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে। কপাল কুঁচকে নিচু কন্ঠে স্পষ্ট বাংলায় ভাষায় বলে,”তোর মতো লম্পটের সাথে আমার বোনের বিয়ে আমি দিব না। তুই বউ থাকতে আরেক বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিস। শালা সাইকো..! তোর বাপ আমার বাপরে কি জাদু করছে যে, তোর মতো এক বিয়াইত্তা পোলার লগে আমার নিষ্পাপ বোনটারে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে আমার বাপ। আমি বলে দিচ্ছি তোর সাথে আমি আমার বোনকে বিয়ে দিব না।

আরশ চোখ উল্টায়। গলা নিচু করে মাহাদির কথার উত্তর দেয়,”ডিভোর্স হয়ে গেছে! আর গলা ছাড় ঘামের গন্ধ আসছে। ছে্হ কি দূ-গন্ধ?
মাহাদি ছেড়ে দিল না। আরো কিছুক্ষণ আরশকে চেপে ধরে রাখল নিজের হাতের নিচে।
যখন সময় আসলো প্রফেসর আসার তখন গিয়ে আরপশঅকে ছেড়ে দিল। ব্যথিত নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,” সত্যি ডিভোর্স হয়ে গেছে?
আরশ বিরক্ত হয় মাহাদির প্রশ্নে। কপালে ভাঁজ ফেলে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। সামনের দাঁত ভেঙ্গিয়ে বের করে বিচ্ছিরি হেসে বলে,”না আমি মজা করছি! হা হা

মাহাদি আরশের মুখ চেপে ধরে হাতের তালু দিয়ে। মাথা দূরে সরিয়ে রেখে বলল,”না, আর হাসতে হবে না, আপনার এই উপরের পাটির দাঁতগুলো ভিতরে ঢোকান। ভয়ংকর লাগছে আপনাকে।
আরশ বিরক্তির শ্বাস ফেলে মাথা এলিয়ে দেয় সামনের দিকে। হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে প্রফেসর আসার দু-মিনিট এখনো বাকি। আরাম করে শুয়ে পড়তেই কানে ভেসে আসে মোটা গলায় ফরাসি ভাষায় কর্কশ স্বরে কেউ বলছে,”এটা কি আপনার ঘুমানোর জায়গা চৈয়াড আরচ।
আরশ নাক কুঁচকে ফেলল। তার এতো সুন্দর বংশ পদবির এই লোক মাইরি বাপ করে দিল। ইচ্ছে করল লোকটার চুল চেপে ধরে মুখের সামনের অংশ নিয়ে দেয়ালে দুটো বারি দিতে। তারপর বলতে,”এটা চৈয়াড না গাধা, এটা সৈয়দ হবে!

গালি গুলো গলার নিচে সংবরণ করে উঠে দাঁড়াল আরশ। আরশকে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে দাঁড়াতে দেখে প্রফেসর রাগান্বিত হলেন। কর্কশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”রাতে ঘুমাওনি?
আরশ কিছু বলার আগেই তার মুখের কথা কেড়ে নিল মাহাদি। দাঁত বের করে হেসে গলার স্বর বাড়িয়ে প্রফেসরের কথার উত্তর দেয় সে,”স্যার নতুন নতুন ডিভোর্স হয়েছে বেচারার তাই রাতে ভাবির চিন্তায় ঘুমাতে পারে না।
প্রফেসর এক ভ্রু বাঁকিয়ে মাহাদির দিকে তাকান। আরশের জন্য যতটুকু ব্যথিত হলেন তার থেকে দ্বিগুণ রাগ প্রকাশ করে তিনি বলেন,”এই মাআডি কান উঠে দাঁড়াও।
প্রফেসরের বলা আদেশের সহিত কথাটা কানে যেতেই মাহাদি কাচুমাচু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। আবার বিরক্ত হয় নিজের নামের এই অপমান দেখে। রাগী কন্ঠে বীরপণা দেখিয়ে স্যারের উদ্দেশ্যে মাহাদি ফরাসি ভাষায় বলে,”স্যার মাআডি না বলে আগডুম-বাগডুম-ঘোড়ারডুম বলে দিলেই তো পারেন।

কথা শুনে পুরো রুম হাসির দমকে কেঁপে উঠল। প্রফেসর রাগী চোখে মাহাদির দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন। হাত দিয়ে বসার মতো ইশারা করলেন। পারলে তিনি চোখ দিয়ে জ্বলসে দিতেন মাহাদিকে,শুধু পারছেন না বলে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আরশের দিকে তাকান। ব্যথিত নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,”আপনাদের ডিভোর্স হওয়ার কারণ বলতে পারবেন? আপনি যদি কিছু মনে না করেন!

আরশ নির্লিপ্ত। চোখ-মুখ তার স্বাভাবিক। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কালো মনি বিশিষ্ট বড় বড় পাপড়ি গুলো একবার আশে-পাশে ঘোরায়। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে উত্তর জানার অপেক্ষায়। আরশ নিজের কপাল কিছুটা কুঞ্চিত করে বলল,”তেমন কিছু না, বউকে অতিরিক্ত আদর দেওয়ার কারণে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
প্রফেসর বিশ্বাস করে নিলেন আরশের কথা। আরশ তখনো সিরিয়াস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার স্টাইল দেখলে যে-কেউ ধরে নিবে এই ছেলে একটা মিথ্যা কথা বলতে পারে না। মিথ্যা কথা কি এই ছেলে জানে না! কিন্তু মাত্র সবার সামনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলা এক একটা কথা মিথ্যা তা মাহাদি জানে।
প্রফেসর আগ্রহ পেলেন আরশের কথায়। দুঃখি চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” আপনি কি আর কাউকে ভালোবাসতে পারবেন?

আরশ দু-হাত বুকে আড়াআড়ি বাঁধে। ঠোঁট টিপে একটু হাসে। ফির আবার বলে,”অবশ্যই পারব না কেন? আমার মনে এখনো অনেক ভালোবাসা আছে, যে চাইবে তাকে দিতে পারি।
“এমন কেউ কি আছে, যাকে আপনি ভালোবাসা দিতে চান?
আরশ এবার একটু দু-টানায় পড়ল। সত্যি তো এমন কেউ কি আছে? কিছুক্ষণ নীরব সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,” না নেই।
প্রফেসর আর প্রশ্ন করেন না। সবার কাছ থেকে থিসিস গুলো জমা নিয়ে চলে যান নিজ কক্ষের উদ্দেশ্যে।
প্রফেসর চলে যেতেই আরশ ব্যাগ কাঁধের উপর তুলে নেয়। মাহাদির সাথে পা মিলিয়ে ক্যাম্পাসে আসতেই এক ঝাঁক মেয়েদের দল এসে তাদের ঘিরে ধরে।

শুভ্র বর্ণের মেয়েটি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আরশকে জিজ্ঞেস করে,”আজ বারো বছর পূর্ণ হয়েছে তাই না?
আরশ মেকি হাসে। মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যাঁ। মাহাদি অবাক চোখে তাকায় ফ্লোরা নামক মেয়েটার দিকে। এ জানল কীভাবে এতো ডিপ কাহিনী! হা করে একবার তাকায় ফ্লোরার দিকে একবার তাকায় আরশের দিকে।
ফ্লোরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরশের দিকে। আরশ তাকায় না তার দিকে, সে দূরে দাঁড়ানো একটা ছেলের হাতের গিটার লক্ষ করে সে-দিকে তাকিয়ে থাকে। ফ্লোরা নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করে,”আরচ বারো বছর পার হয়ে গেছে, সেই মেয়েকে তুমি কী এখনো ভুলোনি?
আরশ নিজের দৃষ্টি তখনো পাইন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গিটার বাজানো ছেলেটার দিকে স্থির রাখে। ওদিকে তাকিয়ে উত্তর করে,”নিজের শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমকে কেউ কি ভুলে যেতে পারে!
আরশ আর বাক্য বিনিময় করে না। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় পাইন গাছের নিচে। ছেলেটার সাথে ফরাসি ভাষায় কিছু আলাপ সেরে নিয়ে হাতে তুলে নেয় গিটার। পাইন গাছের সামনে রাখা ছোটো কাঠের বেঞ্চে বসে এক-পাশে রাখে নিজের কাঁধের ব্যাগ।

গিটার নিয়ে না আসায় নিজের প্রতি আজ সে কিছুটা বিরক্ত৷ এই নিরিবিলি মধ্যহ্নে পাইন গাছের নিচে বসে তার ইচ্ছে করছে বিরহের গান গাইতে। কারণ টা সে জানে না! ইচ্ছে করছে তাই গাইবে! কার জন্য গাইবে সেটা ও জানে না সে। কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে বারবার গানটা ভেসে আসছে। বারংবার কানের মধ্যে ভেসে উঠছে গানের লাইনগুলো। আরশ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না গিটারের তারে আঙুল চালায়। গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নেয়। গম্ভীর গলায় চোখ বন্ধ করে গেয়ে ওঠে,
তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম,
কি দোষ দিবি তাতে,
বন্ধু তোকে খুঁজে বেড়াই
সকাল-দুপুর-রাতে।

মাহাদি আরশের এই গানের মর্মাথ জানে। কার উদ্দেশ্য গাওয়া সে সেটা ও জানে। কিন্তু সামনে বসা ছেলেটা শুধু দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যাচ্ছে নিজের ভিতরের কথাগুলো। আসলেই কী শুধু দায়িত্ব নাকি এই বারো বছরে না দেখে, না জেনে মনের ভিতর লালল করা মেয়েটা দায়িত্বের থেকে বের হয়ে আরো বেশি কিছু জুরে নিয়েছে আরশের, আরশ কী তা জানে? উঁহু সে এসবের কিছুই জানে না! নিজের ভিতরের হওয়া দোলাচালের কোনো কিছু টের পাচ্ছে না সে, কিন্তু মেয়েটা শত মাইল দূরে থেকেও ধীরে ধীরে নিজের দখল, অধিপত্য দ্বারা গ্রাস করে নিচ্ছে আরশকে।
মাহাদির এসকল অতর্কিত চিন্তার ব্যাঘাত ঘটল আরশের গম্ভীর কন্ঠে দ্বিতীয়বারের ন্যায় গাওয়া গানের প্রতিটা শব্দ।
প্রেমের নামে কিনলাম আমি ,
নিঠুর অভিশাপ ,
তোর আমার প্রেমে ছিলো রে
বন্ধু ,ছিলো পুরোটাই পাপ ।

সিটি হসপিটালের বাহিরে উচ্চ শব্দ তুলে একটা এম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। এম্বুলেন্সের পিছনের দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন একজন ভদ্র মহিলা। কোলে তার তিন বছরের শিশু। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কখন থেকে কেঁদে চলেছেন তিনি। বাচ্চাটাকে হাত লাগাতে দিচ্ছেন না কাউকে। তিনি ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে তার বাচ্চা স্পর্শ করতে দিবেন না। গাড়ি থামতেই ভদ্র মহিলা একপ্রকার ঝড়ের গতিতে দৌড়ে বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটালের ভিতর ঢুকলেন। ভদ্র মহিলার দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকে এম্বুলেন্সের সামনের দরজা খুলে বের হয়ে আসলো উঁচু-লম্বা, মোটা চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট এক সাতাশ বছরের যুবক। মুখে বিদেশি বিদেশি ছাপ। ঠোঁট গুলো লাল বর্ণের হয়ে আছে শীতের কারণে। সাথে তার পুরুষালি গালগুলো ও।
এম্বুলেন্স থেকে বের হয়ে বিরক্তি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় লম্বা চওড়া পুরুষটি। নিজের ভিতরের বিরক্তি নিজের ভিতর অনেক কষ্টে হজম করে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ডিউটি পালন করতে ভদ্র মহিলার দিকে এগিয়ে যায়।

ভদ্র মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাচ্চা কে স্পর্শ করার আগেই বাচ্চাকে সরিয়ে নেন ভদ্রমহিলা। রাগী চোখে তাকিয়ে হিসহিস করতে করতে আঙুল তুলে সাবধান করে দেওয়ার ভঙ্গিতে যুবকটাকে বলেন,
“দূরে,আমার বাচ্চাকে তুমি স্পর্শ করছ কেন?
যুবক বিরক্ত হয়। নাক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। বাচ্চাকে স্পর্শ করার তাগিদে এক পা আগাতেই মহিলা বলেন,
“আরে এই এম্বুলেন্স ড্রাইভার কে সরান, আমার বাচ্চার বুকের হাড্ডি ভেঙেছে আর উনি বারবার স্পর্শ করতে চাচ্ছেন। উনি কি আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চান? ডাক্তার কে ডাকুন! ডাক্তার..ডাক্তার.. এই ড্রাইভার কে এখান থেকে সরান!
একজন নার্স এগিয়ে আসে সামনে। মহিলার কাছে দাঁড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলেন,”ম্যাম আপনি ভুল বুঝছেন।
মহিলাটি ঝাঁঝাল গলায় বলে,

” কি ভুল বুঝছি?
নার্স মহিলাটি বিনম্র গলায় বলল,
“স্যার কার্ডিওলজিস্ট। বর্তমানে উনি ছাড়া ডিউটি তে আর কোনো স্যার নেই! সবাই ব্রেক নিচ্ছেন।
ভদ্র মহিলা অবাক হোন। চোখ গোল গোল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করেন,”তাহলে উনি কেন এম্বুলেন্স নিয়ে গেলেন? ড্রাইভার কোথায়?
নার্স মিষ্টি হাসে। স্যারের প্রশংসা করার একটা চান্স সে মিস দেয় না। এবার ও দিল না! গাল এলিয়ে হেসে বলে,”আমাদের সকল এম্বুলেন্সের ড্রাইভার আজ অনেক দূরে দূরে রোগী পিক করতে চলে গিয়েছে কিন্তু একজন ছিলেন যিনি দুপুরের খাবার খেতে ক্যান্টিনে ছিলেন। আর আপনার ফোন করে আহাজারি শুনে স্যার মনে করেছিলেন ভয়ংকর কোনো কিছু হয়েছে তাই নিজের লাঞ্চ রেখে আপনাদের পিক-আপ করতে চলে গেছেন।
ভদ্র মহিলা লজ্জা পেলেন। লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন,” আমি বুঝতে পারিনি আপনি ডাক্তার।
জায়িন বিরক্তি চেপে রেখে গম্ভীর মুখটা হাসি হাসি করার চেষ্টা করে। মেকি হাসি খুব কষ্ট করে ঠোঁটের আগায় ঝুলিয়ে বলে,”ইট’স ওকে আমি কিছু মনে করিনি। মিসেস আপনি বাচ্চাকে নিয়ে এদিকে আসুন।

দু-তলা বিশিষ্ট সৈয়দ বাড়ির পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আরেকটি ডু-প্লেক্স বাড়ি। যার গেইটে বড় বড় অক্ষরে লিখা নাছির মঞ্জিল।
সৈয়দ বাড়ির দালান পুরোনো হয়ে যাওয়ার ধরুণ সেখানে পড়েছে শ্যাওলার গাঢ় আস্তরণ।
সৈয়দ বাড়ির বাহিরে যতটা রঙচটা নাছির মঞ্জিল যেন তার তুলনায় দ্বিগুণ চাকচিক্যে ঘেরা। শোহেব সাহেব নিজের হাতের অ্যান্ড্রোয়িড ফোন দিয়ে ভিডিও কলে দেখাচ্ছেন বাড়ির আশ-পাশ হেলাল সাহেবকে। ক্যামেরা ধীরে ধীরে ঘুরাতেই ক্যামেরার লেন্সে ভেসে উঠল বাচ্চাদের সাথে ক্রিকেট খেলছে একটা মেয়ে। হেলাল সাহেব সামনের টেবিল থেকে দৌড়ে চিকন লেন্সের চশমা তুলে নেন। চোখের মধ্যে চশমা এঁটে চোখ ঝাপটেই তাকাতেই ভেসে উঠল মেয়েলি লম্বাটে মুখ। মুখ দেখে কিছুটা চেনে চেনা মনে হলো মেয়েটাকে উনার কাছে। কিন্তু আন্দাজ করতে পারলেন না কে মেয়েটা! তাই শোহেব সাহেবকে আদেশ দিয়ে বললেন,”ক্যামেরা সামনের দিকে স্থির রেখে সোজা হেঁটে যা।
ভাইয়ের থেকে পাওয়া আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। হেলাল সাহেব তখন চিনতে পারেননি মেয়েটাকে। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছেন মোবাইলের দিকে। চেনার চেষ্টা চালাচ্ছেন! অনেকক্ষণ চেষ্টার পর যখন চিনতে পারলেন তখন জিজ্ঞেস করলেন,”মেয়েটা কে? মুখটা কেমন চেনা-জানা লাগছে।
শোহেব সাহেব উৎসাহ নিয়ে ক্যামেরায় তাকান। হাসি হাসি মুখ করে বলে ওঠেন,”জি ছোট ভাইয়ের মেয়ে!
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মোবাইলের উপর এসে পড়ল ক্রিকেট বল। শোহেব শক্ত করে মোবাইল ধরে রাখেননি, তাই হাত ফসকে মোবাইল মাটিতে উল্টে পড়ে গেল।
নুসরাত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আদেশ দিয়ে বলল,

” যাও বাচ্চা বল নিয়ে আসো।
বাচ্চাগুলো মুখ কুঁচকায়। নাক ফুলিয়ে বলে,
“তোমার চাচা তুমি যাও! আমরা গেলে আমাদের কে বকবে। তোমাকে বকবে না!
নুসরাত বিরক্তির শ্বাস ফেলল। বাচ্চাগুলোকে তিরস্কার করে বলল,”এহ, একটা ও আমার মতো সাহসী হতে পারল না। সবগুলো এক একটা বোকারহদ্দ।
নুসরাত বাচ্চাগুলোকে তিরস্কার করা শেষে হেলেদুলে এগিয়ে গেল শোহেব সাহেবের দিকে। শোহেব সাহেব তখনো ঝুঁকে ফোন হাতে নিচ্ছেন। নুসরাত দু-হাত উপরে তুলে দূর থেকে বলে,”এই তোমার না, পায়ে ব্যথা তাহলে ঝুঁকছ কেন? দাঁড়াও, আমি নুসরাত দ্যা গ্রেট গার্ল এখন চলে এসেছি তোমার সাহায্য করতে, আমি তোমার ফোন তুলে দিচ্ছি, তোমার ফোন মাটি থেকে তুলে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখাবো ডায়মন্ড অক্ষরে। টেনশন মাত লো চাচ্চু!
নুসরাত নিজে নিজের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসলো। উল্টো হয়ে পড়ে থাকা ফোনটা ঝুঁকে রাস্তার পাশ থেকে তুলে দিতে দিতে মৃদু কন্ঠে গালি দিল মোবাইলকে,” বালের মোবাইল, সামান্য বলের আঘাতে পড়ে যায়। এসব হেডার মোবাইল দে কেডা?

নুসরাত মোবাইল ঘুরিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না অপাশে কে! সে মোবাইলকে নিজ ইচ্ছে মতো দু-তিনটে গালি দিয়ে বোকা হেসে মোবাইল এগিয়ে দিল শোহেব সাহেবের দিকে। তার এই বোকা হাসির মানে হলো, শোহেব সাহেব তার এতো বড় বড় সুন্দর গালি গুলো শুনেতে পাননি তাই। হেসে মোবাইল শোহেব সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিতেই কানে ভেসে আসলো গম্ভীর গলার কারোর ধমকের স্বরে বলা কথা,”কে ওখানে? শোহেব কে ও?
নুসরাতের কপাল কুঁচকে গেল। ব্যাটা মানুষের গলার আওয়াজ শুনে চোখ ঘুরায় চারিদিকে। কাউকে খুঁজে না পেয়ে শোহেব সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়। একপেশে ভ্রু করে জিজ্ঞেস করে কে কথা বলছে?
নুসরাতের ইশারা বুঝে নেন শোহেব সাহেব। মোবাইল নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দিলেন যাতে সে নিজে দেখে কে কথা বলছে। নুসরাত মোবাইল হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে শোহেবের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে আওড়ায়,”এই বুইড়া বেডা আবার কে? ঠিক চিনতে পারছি না।

হেলাল সাহেব আঁতকে উঠলেন। তাকে বুড়ো বলে নাছিরের মেয়ে। কত বড় সাহস! যার বাপ তার ভয়ে কাঁপে সেই বাপের মেয়ে তাকে বুইড়া বেডা বলে সম্বোধন করে। তিনি চোখ বড় বড় করে ক্যামেরার মধ্যে তর্জনী আঙুল তুলে শাসিয়ে বললেন,”কাকে তুই বুইড়া বেডা বলছিস? চিনিস আমাকে?
নুসরাত অবাক হওয়ার ভান করে। গালে এক হাতের তালু রেখে অধর বাঁকিয়ে হেসে বলে,”ওমা আপনাকেই তো বললাম বুইড়া বেডা। আর আপনাকে চিনার কি দরকার। আমি তো চিনি, আপনি হলেন এক কর্কশ, খ্যাকখ্যাক করতে থাকা বুইড়া বেডা। এবার আমাকে চিনে নিন আপনি, আমি হলাম সৈয়দ নাছির উদ্দিনের ছোট মেয়ে সৈয়দা নুসরাত নাছির। আপনি আমাকে ভালোবেসে ব্যাটাছেলে ডাকতে পারেন, আমি মাইন্ড করব না। আর আপনাকে চিনার কোনো শখ, ইচ্ছা, আকাঙ্কা আমার নেই। আপনার সাথে যদি আমার কোনোদিন দেখা হয়, তাহলে আপনাকে আমি চিনিয়ে দিব আমি কে?

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২

নুসরাত আবার ক্যানাইন দাঁত বের করে হাসে। হাত উপরে তুলে নাচিয়ে নাচিয়ে মুখ বাঁকিয়ে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলে,”টাটা আঙ্কেল, আজ বিদায় নেই, অন্য একদিন এক জায়গায় বসে বিস্তারিত আলোচনা করব। এবং আলোচনার শিরোনাম হবে, আমি কে? আপনি কে? কে কাকে বেশি চিনে? তুই কি আমাকে চিনিস নাকি আমি তোকে চিনি! হে হে হে.. বাবায় আঙ্কেলল…

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here