সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৫

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৫
জাওয়াদ জামী

” উফ্ কি যে আনন্দ লাগছে। আনান ভাইয়া আর সিক্তাপুর বিয়ে হবে। আমি সিক্তাপুর বড় জা হব। সিক্তাপু আমাকে ‘ ভাবী ‘ বলে ডাকবে। কথাটা মনে হলেই বুকের ভেতর হাজারো পাখির কলকাকলি শুনতে পাচ্ছি। তোমার ভালো লাগছে না , ভাইয়া? ” দৃষ্টি আনন্দে লাফালাফি শুরু করেছে।
নিহান দৃষ্টিকে লাফাতে দেখে হাসলো। এই মেয়েটা পারেও বটে।

” এত লাফালাফি না করে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। ভাই কিন্তু অনেক আগেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে। শপিং মলে গিয়ে যদি আমাদের না দেখে তবে তার জন্য দায় কিন্তু আমি নেবো না। ”
” আর দুই মিনিট। হয়ে গেছে আমার। সুযোগ পেলেই ভয় দেখায়। বদ লোক একটা। ” মুখ ঝামটা দিল দৃষ্টি।
” হ্যাঁ, আমি বদ লোক , আর তুই সাধু নারী। বেশি কথা না বলে চল। আর এক সেকেন্ডও দেরি করলে আমি তোকে রেখেই চলে যাব। ” নিহান রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
নিহানের হুমকিতে কাজ হলো। দৃষ্টি সাজুগুজু বাদ দিয়ে সুড়সুড় করে নিহানের পেছনে হাঁটতে শুরু করল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” সময়ের অনেক আগেই এসেছিস তোরা । আরও একঘন্টা পর আসলেও কিন্তু সমস্যা হতো না। আরেকটু সাজুগুজু করতে পারতিস। ” তাহমিদ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল।
” ভাই আর কখনো এই মেয়েকে নিয়ে আমাকে কোথাও যেতে বলবে না। একঘন্টা ধরে সাজুগুজু করেছে। তবুও নাকি তার সাজ হয়নি। আরও আধাঘণ্টা সময় নাকি ওকে দিতে হতো। পুরো রাস্তা আমার কানের মাথা খেতে খেতে এসেছে। ” নিহান একটু রেগেই বলল।
নিহানকে রাগতে দেখে দৃষ্টি ওর দিকে চোখ গরম করে তাকাল। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল , আজকে বাসায় চল, তোমার খবর আছে।

” সিক্তাপু কোথায় , ভাইয়া? ” আশেপাশে সিক্তাকে না দেখে জিজ্ঞেস করল দৃষ্টি।
” মলে এসে ওর এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার সঙ্গেই বোধহয় কোথাও গেছে। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। ”
” আনান ভাইয়া কি সিক্তাপুর সঙ্গেই আছে? ”
” হুম। শোন দৃষ্টি , প্রথমেই তোর জন্য কেনাকাটা করবি। তবে সেটা এক ঘন্টার মধ্যেই। একঘন্টার মধ্যে যা যা প্রয়োজন কিনে নিবি। তোর কেনাকাটা শেষ হলে সিক্তর জন্য কেনাকাটা করব। বুঝেছিস? ” তাহমিদ সোজাসাপটা বলে দিল।

” কারও দুলাভাই যেন এমন রসকষহীন না হয়। একঘন্টার মধ্যে কি কেনা যায় তুমিই বল ? আমার আপুর মত বউ পেয়ে বেঁচে গেছো তুমি। নয়তো তুমি বুঝতে মেয়েদের সাজুগুজুর জিনিসপত্র কিনতেই পুরো দিন লাগে। ” দৃষ্টিও কম যায় না। সে-ও প্রত্যুত্তর করল তাহমিদের কথায়।
” হ্যাঁ, তোর মেক-আপ আইটেম কিনতেই পুরো দিন লাগাই আর কি। আগামীকাল নতুন ফ্ল্যাটে ফার্নিচার যাবে। সেখানেই সবাইকে থাকতে হবে। তারপর সন্ধ্যায় বিয়ে। শপিং যা করার আজকেই করে নিবি। কালকে কোন সময় পাচ্ছিস না শপিংয়ের জন্য। কালকে ফ্ল্যাট গোছাবি বুঝেছিস? ”
” আপু আসবে না, ভাইয়া? আনান ভাইয়ার বিয়েতে আপু থাকবে না এটা হয় বলো? আপুর জন্য কেনাকাটা করব না আমরা? ”

” সে আমার বউয়ের জন্য যা যা লাগে আমি কিনব। তুই নিজেরটা ভাব। কথা না বলে শপিং স্টার্ট করে দে। ”
” আমি নিজেরটা যেমন ভাববো, আপুরটাও তেমন ভাববো। যেহেতু আজকে শপিং তোমার টাকায় করব, সেহেতু তোমাকে রাস্তায় না নামিয়ে ছাড়ব না। ”
” চেষ্টা করে দেখ, আমাকে রাস্তায় নামাতে পারিস কি না। সিক্ত এসে গেছে। তোরা তিনজন কি কি কেনার কিনে ফেল। সিক্তর কাছে ক্রেডিট কার্ড, টাকা সবই আছে। প্রথমে তোদের দু’জনের যা যা লাগে কিনবি। এরপর সুপ্তিপু, দ্যুতিপু আর ভাগ্নে-ভাগ্নীদের জন্যও কিনবি। আমি নিহানকে নিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছি। আমরা শিহাবের জন্য কিনব। ”
সিক্তা, আনান ওদের সামনে এসে দাঁড়াতেই দৃষ্টি চোখমুখ কুঁচকে তাহমিদকে বলল ,
” ভাইয়া , তোমার বোন কিন্তু আমাকে সালাম দেয়নি। সম্পর্কে আমি এর বড় জা। বড় জা’কে সালাম না দিয়ে সে কিন্তু অন্যায় করেছে। ”

” সেই হিসেবে আমিও তোর ভাসুর হই। তোরও উচিত উঠতে-বসতে আমাকে সালাম করা। কিন্তু তুই কয়বার আমাকে সালাম করিস? ”
” আমি কি আর সাধে বলি , যে তুমি একটা খচ্চর? কার সঙ্গে কি মেলাও তুমি! তুমি আমার দুলাভাই এটাই সবথেকে পরিচয়। এর বাহিরে তোমার অন্য কোন পরিচয় নেই আমার কাছে। আনান ভাইয়া , তোমার বউয়ের ভাইকে বল আমাকে যেন এক্সট্রা খাতিরযত্ন করে। নয়তো আমি বরের ভাবী কিন্তু চটে গেলে তার বোনের লাইফ হেল করে দেব। ”
দৃষ্টির কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সিক্তা। এই মেয়েটার কথা শুনলে এত হাসি পায় ওর। তবে সিক্তার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ও দেখল পৃথু হাসতে হাসতে আসছে ওদের দিকে।আপনাআপনিই সিক্তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেল।

” হেই তাহমিদ , হোয়াট আ সারপ্রাইজ ! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম বলো? সেই যে আমার বিয়ের আগে আমার সঙ্গে দেখা করলে, তারপর আর তোমার দেখাই নেই। কেমন আছো, ইয়ার? তুমি সেদিন আমার কতবড় উপকার করেছিলে সেটা আমি এখন বুঝতে পারি। ” একনাগাড়ে কথাগুলো বলল পৃথু।
নিহান, আনান, দৃষ্টি, সিক্তা সকলেই শুনলো পৃথুর কথা। ওরা কেউই বুঝলো না পৃথু কিসের উপকারের কথা বলছে।
” আমি বিন্দাস আছি। তোমার কি অবস্থা বলো? বিয়ে করেছো তো নাকি রায়ানকে? কোথায় আছো এখন? ”
” করেছি মানে। তোমার সঙ্গে কথা বলার পরই দু’জন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছি। এরপর দু’জন চলে গিয়েছিলাম মালদ্বীপ। সেখান থেকে শ্রীলংঙ্কা এর থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া। এই কয়েকটা মাস আমরা শুধু ইনজয়ই করছি। থ্যাংকস ইয়ার , তুমি না থাকলে আমি রায়ানকে পেতাম না । রায়ান আমাকে সত্যিই ভালোবাসে । আমি তো ভেবেছিলাম , রায়ানও আমার মত টাইম পাস করছে। কিন্তু না , আমি ভুল ছিলাম। ”
পৃথুর কথা শুনে ওরা সবাই বুঝলো তাহমদিকে পৃথু খুব ভালোভাবেই চেনে। এবং দু’জনের মধ্যে কোন বিষয়ে যোগসাজশও আছে। সকলের মনে প্রশ্নেরা উঁকিঝুঁকি মারছে। তাদের সকলের মনের কথা বুঝতে পেরে আনান প্রশ্ন করল পৃথুকে,

” হেই পৃথুপু , চিনেছো আমাকে ? আমি আনান। যা কাণ্ড করেছিলে সেদিন। আমার আম্মুকে কবরে প্রায় পাঠিয়েই দিয়েছিলে। এবার বলো , ভাইকে মানে তোমার ইয়ারকে চিনলে কিভাবে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে , দু’জনের মধ্যে ভালোই চেনা-জানা আছে। ভাই তোমার কি উপকার করেছিল বল তো? ”

” আনান , তোমাকে দেখামাত্রই চিনেছি। এমনকি তোমাদের সবাইকেই চিনেছি । শুধুমাত্র একজনকে ছাড়া। তাহমিদের সঙ্গে কথা শেষ করে , তোমাদের সঙ্গে কথা বলতাম। আন্টি বোধহয় আমার ওপর রাগ করেছে? সে আমাকে ভালোবাসতো এটা জানতাম। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। নিহানকে বিয়ে করতে চাইনি প্রথমদিকে। কিন্তু পরে নিজের মনকে স্থির করে নিয়েছিলাম । কষ্ট হলেও নিহানকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের তিনদিন আগে তাহমিদ আমাকে বললো , রায়ান আমাকে সত্যিই ভালোবাসে। রায়ানের সঙ্গেই আমার থাকা উচিত। ব্লা ব্লা। তখন আমিও ভেবে দেখলাম , রায়ান ইন্ড্রাট্রিয়ালিস্টের ছেলে। জীবনে কোনদিন অর্থের অভাব হবে না , প্রতিমাসেই চাইলে বিদেশে ট্যুর দিতে পারব , এককথায় রাজরানী হয়ে থাকব। লাইফ সেটেল হয়ে যাবে। সবকিছু ভেবেই রায়ানকে বিয়ে করে নিলাম। এখন দেখ , সত্যিই আমি সুখে আছি। ”

পৃথুর কথা শুনে নিহানসহ সকলেই অবাক হয়ে তাকালো তাহমিদের দিকে। সকলেই চোখেই প্রশ্ন। এদিকে তাহমিদ সরাসরি তাকালো নিহানের দিকে। ইশারায় দু’জনের মধ্যে কথা হলো। যা বোঝার বুঝে নিল নিহান। কৃতজ্ঞতায় ওর ঠোঁটে হাসি ফুটল। ভাই ওর জন্য এতকিছু করেছে সেটা এতদিনও বুঝতে না পারার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল।
” ভাইয়া , এসব কি শুনছি ! তুমিই ইচ্ছে করে নিহান ভাইয়ার বিয়ে আটকেছিলে সেদিন ? ” দৃষ্টি বোকার মত জিজ্ঞেস করল।
দৃষ্টির দিকে এক নজর তাকিয়ে তাহমিদকে জিজ্ঞেস করল পৃথু,
” এই মেয়েটা কে , ইয়ার? ”

” ও দৃষ্টি । নিহানের ওয়াইফ। সেদিন তোমার পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে বাড়িতে সবাই চিন্তায় পরে গেছিলো। তখন বড়রা সিদ্ধান্ত নেয় দৃষ্টির সঙ্গেই নিহানের বিয়ে হবে। ওরা সম্পর্কে কাজিন। ”
আনান অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে । ভাই কেমন অবলীলায় বলে দিল , বড়রা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ! অথচ ভাই নিজে দৃষ্টির কথা বলেছিল সেদিন। আনানের খটকা লাগছে। কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে না।
পৃথু চলে যেতেই নিহান ছাড়া সবাই চেপে ধরল তাহমিদকে। কেন সে পৃথুকে রায়ানের কথা বলেছিল, সেটা জানতে চায় ওরা। বাধ্য হয়ে তাহমিদকে মুখ খুলতেই হলো।
” গাধার দল , তোরা দেখলি না পৃথু কোন ধরনের মেয়ে? তোদের কি মনে হয় , ও নিহানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত? কিংবা ফুপুর কথা মেনে চলত? আর তাছাড়া রায়ান ওর একমাত্র বয়ফ্রেন্ড ছিলো না। আমি সব জেনেশুনে নিহানকে বিপদে ফেলতে পারতাম? ”
তাহমিদের কথায় যুক্তি আছে তাই কেউ-ই কিছু বললো না। চুপচাপ শপিং করতে গেল।

আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত শপিং করে পরদিন দৃষ্টি আর নিহান নতুন ফ্ল্যাটে গেলো । নিহান, আনান দুই ভাই এখন থেকে একসঙ্গেই থাকবে। নিহানের বাসায় তেমন একটা ফার্নিচার ছিলো না। তাই নিয়াজ মাহমুদ নতুন ফ্ল্যাটের ফার্নিচার কেনার দ্বায়িত্ব তাহমিদকে দিয়েছেন। তাহমিদ চিন্তা করছে এই সুযোগে সে-ও কয়েকটা ফার্নিচার নতুন ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেবে। ও মা এবং বড়মাকে সে কথা বলেছে। বড় ভাই হিসেবে ও নিহান, আনানকে গিফ্ট দিতেই পারে।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৪

পরদিন বিকেল পর্যন্ত বাসা গুছিয়ে দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে রইল। তখনই বাসায় আসলো নিয়াজ ও রাখী। তাদের সঙ্গে দৃষ্টির ফুপা-ফুপু এবং নিয়াজের চাচাতো ভাইবোনেরাও আছে। সবাইকে একসঙ্গে দেখে দৃষ্টির মনটা খুশিতে নেচে উঠল।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here