প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৮
জান্নাত নুসরাত
মেঘের আড়ালে ঢেকে গিয়েছে তারারা। মেঘ ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে গোলাকার আলো ছড়ানো চাঁদটার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল গোলাকার চাঁদ। দু-একক্ষণ কাটার পর পর মেঘ গর্জন তুলে আকাশ কাঁপিয়ে বজ্রপাত করল। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এরকম অনেকক্ষণ কাটল! বৃষ্টি আসার আগ পর্যন্ত, বাতাসের আর বজ্রপাতের ঠান্ডব। আজ আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো না, শা শা বাতাসের সাথে বড় বড় ফোটা নিয়ে মাটিতে পতিত হলো বৃষ্টি। আর সেই বৃষ্টির ছিটে এসে গায়ে লাগল ইসরাতের। ইসরাত বৃষ্টি একেবারে পছন্দ না, পছন্দ না হওয়ার কারণ আছে৷ বৃষ্টির পানি গায়ে লাগলে তার দশ মিনিটের ভিতর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে হাচি আর সর্দি হয়ে যায়। তাই বৃষ্টির ফোটা গায়ে লাগতেই বারান্দা থেকে দ্রুত পায়ে রুমে ফিরে আসলো ইসরাত। বারান্দা থেকে বৃষ্টির পানি রুমে ঢুকতে না পারে তাই টেনে লাগিয়ে দিল স্লাইডিং দরজা।
নুসরাত বাড়িতে নেই, গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছে সৌরভিকে নিয়ে। নাছির সাহেব প্রথমে একা ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। কি না কি অঘটন ঘটায় ওখানে গিয়ে? এই মেয়ের উপর তিনি নখ পরিমাণ বিশ্বাস করেন না। হয়েছে তো উনার মতোই। ঘাড়ত্যাড়া! নিজে যা ভালো বুঝে তাই, অন্য সেখানে বুঝিয়ে মরে যাক ওসব সে শুনবে না। আমি যা বুঝেছি তাই ঠিক, অন্যরা যা বুঝেছে সব ভুল। তাই নাছির সাহেব ছাড়তে চাইছিলেন না, কিন্তু নাছোড়বান্দা নুসরাত ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবে মানে যাবে। একবার যখন ঠিক করেছে সে যাবে তার মানে সে যাবে ওখানে, হয়তো নিজে যাবে নয়তো ওর রুহ ওখানে যাবে। নাছির সাহেব কে মানতে না দেখে হাত-পা ধরে পুরো একটা দিন লটকে বসে রয়েছিল। তাকে যাওয়ার পারমিশন না দিলে সে, নাছির সাহেবকে বাড়ি থেকে বের হতে দিবে না, এমনকি ওয়াশরুমে ও যেতে দিবে না। শেষ পর্যন্ত নুসরাতের ঘাড়ত্যাড়ামিতে হার মেনে নাছির সাহেব পারমিশন দিলেন তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার জন্য।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ইসরাত মনে করে যাওয়াই উচিত, এই অসুস্থ পরিবেশ থেকে বের হয়ে বাহিরে কোথাও! এভাবে হসপিটালে দিন-রাত পড়ে থাকলে নুসরাত নিজে ও অসুস্থ হয়ে যেত, তাই না চাইতে ও ইসরাতের কথায় নাছির সাহেব একা ছেড়েছেন নুসরাতকে।
মেহেরুন নেছার শরীর আগের মতোই খারাপ, কোনো উন্নতি হয়নি, গত দু-দিনে আরো বেশি অবনতি হয়েছে। তারপর ও ডাক্তাররা থেমে যাচ্ছে না, তাদের না থামার জন্য মোটা অংকের একটা অংশ নাছির সাহেবকে খরচ করতে হচ্ছে।
ইসরাতের সাথে জায়িনের আর দেখা হয়নি হসপিটালের সেদিনের দেখা হওয়ার পর থেকে। হসপিটালে লাস্ট দিন জায়িনকে রেখেই বাড়ি ফিরে এসেছিল সে আর নুসরাত।
লিপি বেগম আর হেলাল সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিল হসপিটালের করিডোরে। সাথে ইরহাম ও ছিল! ইরহামই তাদের দু-জনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নতুন করে বড় বাবা আর বড় মায়ের সাথে। ইসরাত সুন্দর করে দু-জনের সাথে কুশল বিনিময় করলেও নুসরাত তা করেনি। মুখ ঘুরিয়ে রেখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার কন্ঠে শুধু হেলাল সাহেবকে সালাম জানিয়েছিল। সেটা ও আসসালামু আলাইকুম বলেনি! বলেছিল, “সামালাইকুম!
ইসরাতের সালামের জবাবে হেলাল সাহেব মিছিমিছি হেসে শুধু জিজ্ঞেস করছিলেন,” কেমন আছো মা?
ইসরাত মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছিল হেলাল সাহেবের ঠোঁটে ঝুলানো মেকি হাসি। সেই হাসি দেখেই তার মুখের হাসিটা নিভে গিয়েছিল। তারপর নিস্ক্রিয় গলায় উত্তর করেছিল,”জি ভালো।
এইটুকু কথা হয়েছিল হেলাল সাহেবের সাথে। বাবা বড় বাবার বিষয়ে কোনো কথা না তোলায় সে ও আর কিছু বলেনি বাবাকে এই বিষয়ে।
হাতের রোলেক্স সাবমেরিনার টু-টোনের সাদা পাথরের কাজ করা ঘড়িটি চোখের সামনে তুলে ধরল আরশ। দশমিনিট প্রায় শেষের দিকে এতক্ষণে হয়তোবা ভাই, বাবা, মা সকলেই তাদের লাগেজ নিয়ে নিচে উপস্থিত হয়ে গিয়েছেন। সোহেদ সাহেব আর শোহেব সাহেব শুধু আজ বাড়িতে অনুপস্থিত। একজন অফিসে আছেন, আর অন্যজন্য হসপিটালে দাদির কাছে আছেন।
আরশ লাগেজের হ্যান্ডেলে ধরে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে আসলো লাগেজ নিচে। বড় সড় লাগেজটা খুবই সতর্কতা সহিত নিচে নামিয়ে আনলো, এমনভাবে আনলো যাতে একটু জোরে টান দিলেই লাগেজ ফেটে যাবে নয়তো লাগেজ কষ্ট পাবে।
ইরহাম ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে নাক কুঁচকাল। নাক কুঁচকানো শেষে চোখ উপরে তুলতেই আরশকে তার দিকে ছোট ছোট চোখ বানিয়ে এক যোগে চেয়ে থাকতে দেখে, কুঁচকানো মুখ এক নিমিষেই হাসি হাসি করে ফেলল। বাহিরে হাসি হাসি মুখ থাকলে ও, ভিতর ভিতর বিতৃষ্ণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। ইরহাম মনে করেছিল, আরশ একজন জেন্টালম্যান, কিন্তু এই বেটা যদি দেশে না আসত, সে কখনই জানতে পারত না এই বেটা এত খারুস। যেদিন দেশে এসেছিল সেদিনই তাকে পাঁচটা চড় মেরে দিয়েছে। কেউই কি দেশে এসেই নিজের ছোট ভাইকে এভাবে থাপড়ায়? কেউ না থাপড়ালে ও এই বেটা থাপড়ায়!
সামান্য কল না ধরায় তাকে দুটো থাপ্পড় মেরেছিল, আর দ্বিতীয়বার একটা মেরেছিল, দৌড় দেওয়ানোর জন্য। এর পরের দুটো খেয়েছিল, একটা ভুল ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য, আর আরেকটা নুসরাতের হুডি আর মাস্ক পরিহিত ফটো পাঠানোর জন্য। এখানে ও কি তার দোষ? ওই পাগল মহিলাই তো তাকে দিয়ে অ্যাসতেথিক পিক তোলায়, তার কি দোষ যদি মুখ না বের করে ছবি তুলে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইরহামের হাত গালের কাছে চলে গেল, এখনো গালে ব্যথা রয়ে গিয়েছে তার। আহ, দু-দিন মুখ নাড়াতে পারেনি পাঁচটা থাপ্পড় খাওয়ার জন্য। আর সাথে মাংস ও খেতে পারেনি, সব মাংস একাই এই দুই ভাই খেয়ে নিয়েছিল। তার মাকে ও দেখেছিল কি রকম আদর আপ্পায়ন করে খাওয়াচ্ছিল যেন নিজের ছেলের বিয়ে দিবে এই পোলাদের সাথে। ইরহামের মুরগির লেগ পিসের কথা মনে হতেই মুখ গোমড়া হয়ে গেল। ঝর্ণা বেগম কি ভাবে সব মাংসের টুকরো তার দুই চাচাতো ভাইকে ঢেলে দিলেন প্লেটে আর তাকে এক পিস ও দেননি, শুধু চারটা মুরগীর হাঢ় আর একটা মাত্র বুকের অংশ দিয়েছিলেন। কত আশা নিয়ে সে বসেছিল মাংস খাবে বলে, হায় তার কপাল! তার কপালে জুটেছে মুরগির মাত্র চারটে হাঢ় আর এক টুকরো বুকের অংশ তাও তার তর্জনী আঙুলের মতো ছোট। খাবার না খেতে পেয়ে রোগা হয়ে যাওয়ার জন্য তার দুটো গার্লফ্রেন্ড ও ভেগে গিয়েছে। হায় কপাল! জীবনটা বেদনার হয়ে গেল।
নিজের চিন্তা পাশে ফেলে সামনে তাকাতেই দেখল হেলাল সাহেবের লাগেজের চেইন খোলা হচ্ছে। ইরহাম ভেবে নিল কি কি বের হবে এখান থেকে? তার চোখে ভাসল নুসরাতের হাতে থাকা মোবাইলের মতো দেখতে সাত,আটটা আই ফোন আর সাথে দশ বারোটা চকলেট বক্স। ইরহাম আরো ভাবল, বিভিন্ন ব্রান্ডের পারফিউম, মানিব্যাগ, লেপটপ, জুতো, কাপড় ইত্যাদি ইত্যাদি।
যখন চিন্তা শেষ হলো তখন হাসি হাসি মুখ নিয়ে চোখ নিচের দিকে নামায়। আর তখনই তার হাসি হাসি মুখ নিমেষে আঁধারে ঢেকে গেল। লাগেজের ভিতর তার চিন্তা ভাবনা করা কোনো জিনিসই নেই, শুধু ঔষধ আর ঔষধ। গিফট দেখার জন্য আনচান করা মনটা ফুস করে নিভে গেল। মুখটা পেচার মতো করে চারিদিকে চোখ ঘুরাল। না কেউ নেই তার দিকে তাকিয়ে! কেউ একবার তাকিয়ে দেখছে না, তার দুঃখি মুখটা। আহ… এই জীবনটা বৃথা! এইসব কে নিয়ে আসে বিদেশ থেকে। নিজের মনের প্রশ্ন মুখে ফুটে আসলো। মৃদু কন্ঠে ইরহাম জানতে চাইল,”এই সব-ই নিয়ে এসেছেন, আর কিছু আনেননি?
ইরহামের গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে হেলাল সাহেব অধর প্রসারিত করে হেসে জিজ্ঞেস বললেন,”আর কি নিয়ে আসবো? এইগুলো দিব বলেই তো সবাইকে এখানে ডেকে নিয়ে আসছি। পছন্দ হয়নি?।
হেলাল সাহেবের প্রশ্নে ভিতরে কান্নায় ফেটে পড়া ইরহাম হে হে করে হেসে ওঠল। তার কান্না ও আসছে, আবার হাসি! এরা কারা? কোথা থেকে এসেছে? ঔষধ আবার কার পছন্দ হয় ভাই? তাদের বাড়ির মানুষ কি সব অসুস্থ, যে বড় বাবা বিদেশ থেকে টেনে নিয়ে আসছেন ঔষধ! পেটের ভিতর খিল মেরে কথাগুলো আটকে রাখল। আজ তার ভাই নুসরাতটাকে বড় মিস করল এই বাড়িতে। তার ভাইটা থাকলে বলত, এসব কে নিয়ে আসে? ফ্রান্স থেকে ফিরে আসা গরীবস লোক। দুঃখি মুখ বানিয়ে কথাগুলী বহু কষ্টে চেপে গিয়ে বলে ওঠে,”জি অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এসব কে নিয়ে আসে বিদেশ থেকে টেনে?
গলার নিচে আটকে থাকা কথাটা মুখ ফুসকে বের হয়ে গেল। কথাটা বের হতে দেরি হলো, সৈয়দ বাড়ির দুই কর্তীর রাঙানো চোখ তার দিকে পড়তে দেরি হলো না। মা আর চাচির ধমকি দেওয়া চোখে তাকানো দেখে কথা পালটে নিল ইরহাম। হে হে করে হেসে বলে ওঠল,”স্লিপ অফ ঠ্যাং হয়ে গিয়েছে? আসলে আমার মনের ভিতর এই কথা ছিল, তাই মুখ ফুসকে বের হয়ে গিয়েছে।
আবার সত্যি কথা বলে দেওয়ায় ইরহাম জীব কাটে। আবার সত্যি বলে দিয়েছে সে! পরপরই আবার নিজের সত্যতা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। মা-চাচির দিকে তাকায় না, দেখা গেল একজন ঝাড়ু হাতে আর অন্যজন নিজের পায়ে জুতো হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই নিজেকে শুধরে নিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলে ওঠে ,”আই মিন আমি বলতে চাইনি এভাবে।
ইরহামের কথায় কান না দিয়ে হেলাল সাহেব ধীরে ধীরে ওষুধের বক্সগুলো বের করে রাখতে শুরু করলেন। আর ইরহাম চোখ-মুখ কুঁচকে বসে রয়, তারপর ও মনের ভিতর একটু আধটু আশার প্রদীপ জ্বলে যে, আরশ ভাই আর জায়িন ভাইয়ের লাগেজ থেকে কিছু বের হবে। সেই আশা নিয়ে হা করে লাগেজ দুটোর দিকে লোভী চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখের সামনে ভাসে নানারকম জিনিস পত্র। এবার জায়িন লাগেজের চেইন খুলে। উপরের সাটার সরাতেই ইরহামের চোখ বের হয়ে আসে অক্ষিকোটরের ভিতর থেকে। চোখ গোল গোল করে একবার জায়িন আর একবার মা-চাচিদের মুখ দেখে। এবার রুহিনী বেগম আর ঝর্ণা বেগম সমান অবাক হয়েছেন। আহান আর সুফি খাতুন গিয়েছেন নাছির মঞ্জিলে, তাই তারা এই মুহুর্তে এখানে উপস্থিত নেই।
রুহিনী বেগম লাগেজের দিকে তাকিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। একবার ঝর্ণা বেগমের দিকে, একবার লিপি বেগমের দিকে বিস্ময় নিয়ে ফিরে ফিরে বারংবার তাকালেন। জায়িনের লাগেজ থেকে বের হয়ে এসেছে ডাক্তারি বিভিন্ন প্রকার ইন্সট্রুমেন্ট, স্টেথোস্কোপ, LACRIFLUID, RinoCle’nil। পুরো লাগেজ এসব হাবি-জাবি জিনিসে ভর্তি। ইরহামের লোভী হয়ে আসা চোখ গুলো এসব দেখে আশা হারিয়ে ঝিমিয়ে গেল। ঠোঁট চেপে ধরে নিজের কান্না আটকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তার আগেই জায়িন জিজ্ঞেস করল,”এরকম অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন কেন বৌমা? আমি কি ভুল কিছু নিয়ে এসেছি? আসলে, আপনাদের কাছে তো পরার কাপড় আছে, তাই আমার কাছে মনে হলো এসব নিয়ে আসলে আপনাদের লাভ হবে। আমি স্টোরে যাওয়ার পর এইগুলো ছাড়া ভালো আর কোনো জিনিস আমার চোখে লাগেনি, তাই নিয়ে আসলাম। পছন্দ হয়নি বৌমা আর ছোট আম্মু?
রুহিনী বেগম ঠোঁট টিপে হাসি আটকালেন। যেখানে সেখানে হেসে দেওয়ার ভেমো আছে তার। কোনোরকম ঠোঁট চেপে ধরে হাসি আটকিয়ে আওড়ান,”হ্যাঁ বাবা অনেক পছন্দ হয়েছে।
ইরহাম তাদের কথার মধ্যে ফোঁড়ন কেটে জিজ্ঞেস করল,”ভাইয়া আরেকটা লাগেজ নিয়ে আসছিলে না তুমি ওইটায় কি?
জায়িন শান্ত চোখ ঘোরায় ইরহামের দিকে। কাম এন্ড কম্পোজড গলায় বলে ওঠে,”এসব আমার বাসায় পরার জিনিস।
ইরহাম আরেকটা কথা বলতে নিবে, এর মধ্যে আরশ তার লাগেজ খুলল। সেখান থেকে বের হয়ে আসলো বিভিন্ন ব্রান্ডের ঘড়ি। প্রায় নব্বই শতাংশ ঘড়ি হলো রোলেক্স সাবমেরিনের টু-টোনের সাদা পাথরের কাজ করা। ইরহাম হা করে তাকিয়ে রইল। সে একবার দেখেছিল ঘড়িগুলো এগুলোর প্রাইজ প্রায় দুইলক্ষ টাকা। ইরহামের হা করে তাকিয়ে থাকা আরশ দেখল না, সে হাস্কি গলায়, রাশভারী কন্ঠে বলল,”শপে যাওয়ার পর, এগুলো ছাড়া আমার চোখে কিছুই লাগেনি, তাই নিজের জন্য কিনে নিয়ে এসেছি এসব।
ইরহামের ঘড়ি পাওয়ার আশায় উৎফুল্ল হওয়া মন ফুস করে নিভে গেল। ঠান্ডা থাকা মেজাজ খিঁচে গেল এক মিনিটে। দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। ইরহাম তার গার্লফ্রেন্ডদের কাছে গপ্পা মেরেছিল, আমার কাজিনরা এই আনবে, সেই আনবে, আর এরা কি নিয়ে আসছে? একজন ওষুধের ঠেলা নিয়ে আসছে,আর আরেকজন নিয়ে আসছে ডাক্তারি জিনিসের ঠেলা, যে একজন বেঁচেছিল সেই বেডা নিয়ে আসছে ঘড়ি তা ও আবার নিজের জন্য সব। হাহ..!
ইরহাম ফুস করে শ্বাস ফেলল। লিপি বেগম কর্কশ কন্ঠে হেলাল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনাকে এসব কে আনতে বলেছে?
হেলাল সাহেব উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,
“আমি জায়িনের কাছে সাজেশন চেয়েছিলাম তোমার ছেলেই তো আমায় এসব আনার জন্য সাজেশন দিল। বলল এইগুলো নিয়ে আসলে রুহিনী, ইরহাম, ফুফি, আহান আর ঝর্ণার মুখ হা রয়ে যাবে।
ইরহাম ত্যাড়া চোখে তাকিয়ে মিনমিন করে আওড়াল,”এইগুলো দেখেই তো হা মুখ হা-ই রয়ে গিয়েছে। এখন তো আর আঁটছেই না।
লিপি বেগম এবার লাগেজ খুললেন। সেখান থেকে বের হয়ে আসলো বিভিন্ন প্রকার রান্নার জিনিস পত্র। কফি পাউডার, ফ্লাইপ্যান, ছোট বড় চামচ, মশলা রাখার কৌঠা, খুন্তি, ফ্রজেন ফিস, নিউট্রেলা, চকলেট সিরাপ, বোরকা, হিজাব, অর্নামেন্ট, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই জিনিসগুলো দেখে রুহিনী বেগম আর ঝর্ণা বেগমের চোখ চকচকে হয়ে উঠল। মা-চাচির চকচকে চোখ দেখে ইরহাম আবার হতাশ হলো! এই পরিবারের উপর সে পুরাই হতাশ।
হেলাল সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন,
” আরে ইরহাম তোর জন্য আমি জুতো আর চশমা নিয়ে এসেছিলাম ওইগুলো দিতেই ভুলে গেছি।
হেলাল সাহেবের কথা শুনে ঝিমিয়ে পড়া ইরহামের মন এবার কিছুটা সতেজ হলো। চকচক করতে থাকা চোখে হা করে তাকিয়ে রইল হেলাল সাহেবের যাওয়ার পথে। কিৎকাল অতিবাহিত হওয়ার পর হেলাল সাহেব হাতে এক জোড়া নাইকের জুতো আর একটা বাচ্চাদের কালো চশমা নিয়ে আসলেন। ইরহাম চশমার দিকে ধ্যান না দিয়ে হা করে নাইকের জুতোটার দিকে তাকিয়ে রয়। জুতো জোড়া হেলাল সাহেব সেন্টার টেবিলে রাখতেই চারিদিকে লাল, নীল, সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। সেকেন্ডের ভিতর ইরহামের হাসি হাসি মুখ কালো হয়ে গেল। অসহ্যকর কন্ঠে বলে উঠল,”বড় আব্বু বাচ্চাদের লাল, নীল কালার বিশিষ্ট জুতো আমার জন্য নিয়ে আসছেন কেন? আমি কি বাচ্চা?
হেলাল সাহেব ঈষৎ হাসলেন। হাসিটা সূচারুভাবে গিয়ে গায়ে লাগল ইরহামের। হেসে নিয়ে হেলাল সাহেব বলতে লাগলেন,”তুই তো আমার কাছে সেই বাচ্চা ইরহাম, যে আমার কোলে ওঠে প্রস্রাব করে দিত।
ইরহামের রাগ মেজাজে চড়ে গেল। রাগে তেঁতিয়ে ওঠা মস্তিষ্ক ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঢাকার চেষ্টা করল। সেই সময় হেলাল সাহেব আবার বললেন,”সেই তো সেইদিনের কথা, তুই আমার কোলে উঠে প্রস্রাব করে, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করে দিতি।
এর মধ্যে আগমন ঘটল সৈয়দ বাড়িতে শোহেদ সাহেবের। হেলাল সাহেব শোহেদ সাহেবকে দেখতেই প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”তুই? তুই এখন বাড়িতে, তাহলে আম্মার কাছে কে?
শোহেব সাহেব সোফায় বসতে বসতে বললেন,
“মেজ ভাই আর ফুফি গিয়েছে ওখানে।
হেলাল সাহেব আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালেন ইরহামের দিকে। কোমল কন্ঠে বললেন,”পরে দেখা, কিরকম লাগে তোকে?
ইরহাম নাক ফোলায়। কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
” বড় আব্বু, আমি বাচ্চা নই যে এসব….
কথা শেষ হওয়ার আগে গালে হালকা হাতের থাপ্পড় পড়ল। ইরহাম বিরশ মুখে তাকায় বাবার দিকে। রাগে ফোস করে উঠে বলে,”আব্বু মারলে কেন?
শোহেব সাহেব ধমকে ওঠে বলেন,
“বড় ভাই যা বলছেন, তা করো চুপচাপ।
বাপের থাপ্পড় সাথে ফ্রি এর ধমক খেয়ে ইরহামের মুখ চুপসে গেল। অস্তমিত রবির ন্যায় রক্তিম মুখ বানিয়ে লাল নীল বাতি জ্বলা জুতো জোড়া পড়ল। তারপর বাচ্চাদের কালো চশমাটা শোহেব সাহেব ইরহামকে পড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে দু-আঙুল এনে দাঁড় করালেন।
হেলাল সাহেব আবেগে আপ্লুত হয়ে যাওয়া স্বরে বললেন,”কতটা সুন্দর লাগছে তোকে? নজর না লাগুক। রুহিনী একটা নজর টিকা পড়িয়ে দাও ইরহামকে।
রুহিনী জি ভাই বলে চলে গেলেন রুমের দিকে। জায়িন অনেকক্ষণ হলো রুমে চলে গিয়েছে। আরশ বসে বসে হেলাল সাহেব আর ইরহামের নাটক দেখছিল। এতক্ষণ কোনোমতে হাসি আটকাতে পারলে ও এবার আর পারল না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে, এক হাত কপালে চেপে উল্টো দিকে তাকিয়ে হাসি আটকানোর বৃথা প্রয়াস করল।
তখনই রুহিনী হাতে একটা কাজল নিয়ে আসলেন। আর সেটা ইরহামের কপালের গোল করে এক পাশে সুন্দর করে লাগিয়ে দিলেন।
শোহেব ইরহামের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল সামনে এনে ভি আকৃতি করে সোজা দাঁড় করালেন। ইরহাম বিড়বিড় করে বলল,” একটা ফিডার এনে গলায় ঝুলিয়ে দাও, তাহলে সবকিছু পূর্ণ হয়ে যাবে।
হেলাল সাহেব ফোন বের করে বললেন,
“চিজ, ইরহাম চিজ।
ইরহাম দাঁত বের করে হাসতেই হেলাল সাহেব ঠাস করে ফটো তুলে ফেললেন।
মমো রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ঢাকা শহর হওয়ায়, চারিদিক থেকে গাড়ি চলাচল ও সাথে হর্ণের আওয়াজ আসছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত নগরী হয়তোবা ঢাকা, আর শান্ত নগরী হয়তোবা সিলেট। তার মমোর অনেক সময় বিরক্ত লাগে ঢাকা শহরটাকে, আজ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না হত, তাহলে তো সে ও বাড়িতে বসে নুসরাতের মতো। আহ..মেয়েটার কি জীবন! এইচ-এস-সি দেওয়ার পর বলল আর পড়বে না, আর পড়লই না। মেজ মামা নুসরাতের কথার তোয়াক্কা না করে, জোর করে নিয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন সাস্টে। অনার্স ফাস্ট ইয়ারে দুই ক্লাস করার পর যখন অ্যাসাইনমেন্ট প্রফেসররা ঠেলা ভরে ভরে দিল, এরপর আর সাস্টের আশে-পাশে গিয়ে ভীরল-ই না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল মমো। তখন এই যানজটে পরিবেশ বেদ করে মমোর মোবাইলে ফোন আসলো। মমো ফোনটা পকেট থেকে বের করে কল ধরতেই ইসরাতের ধমক ভেসে আসলো। মমো মনে করল ভুলে আজ নুসরাতের ভুত ইসরাতের উপর ভর করে ফেলেছে, তাই ভরকে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। ওপাশ থেকে ইসরাত আবার জিজ্ঞেস করল,”কিরে? কথা বলছিস না কেন?
মমো নিজেকে সামলে মোলায়েম কন্ঠে বলে ওঠে,
“কি হয়েছে আপু? এভাবে আজ ধমকাচ্ছো কেন? নুসরাতের ভুত কি তোমার উপর ভর করেছে?
ইসরাত সে কথার প্রতিউত্তর করল না। নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”কবে আসছিস বাড়িতে? আম্মু তোর কথা বলতে বলতে আমার কান পঁচিয়ে ফেলল। আসবি কবে তুই?
মমো চারিদিক থেকে আসা গাড়ির শব্দে একটা কথা ও পরিস্কার শুনল না। তাই তাড়াহুড়ো কন্ঠে ইসরাতকে বলল,” আপু আমি তোমাকে হোটেল গিয়ে কল ব্যাক করি। এখন একটু বাহিরে এসেছি। তুমি জিজ্ঞেস করতে আমার শরীর কেমন? আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। পরে কথা বলছি।
কথাটা শেষ করে ইসরাতকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল মমো। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল মেয়েটা।
গত আধঘন্টা যাবত আরশকে সামনে বসিয়ে রেখে হেলাল সাহেব চুপ করে বসে আছেন। আরশ ও চুপচাপ হেলাল সাহেবের সামনে বসে মোবাইলে কিছু একটা ঘাটাঘাটি করছে। দু-জনে আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে সময় অতিবাহিত করলেন। হেলাল সাহেব এবার নিজের গোড়ামির শেকল ভেঙে গলা খাঁকারি দিলেন। গলা খাঁকারি দেওয়ার শব্দেই আরশ নিজের বিচ্ছিন্ন হওয়া মস্তিষ্ক বাস্তবতা থেকে, সেটা আবার বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলো। প্যান্টের পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে রেখে নড়েচড়ে বসল। দু-হাত কোলে এনে রাখল, গম্ভীর দৃষ্টি স্থির রাখল হেলাল সাহেবের দিকে।
হেলাল সাহেব আরশের সরাসরি চোখে তাকানোতে একটু ভরকে গেলেন৷ এতক্ষণে সাজানো কথাগুলো মস্তিষ্ক থেকে এক নিমেষে দুলিসাৎ হয়ে গেল। হেলাল সাহেব আড় চোখে দেখলেন, আরশকে। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখটা শক্ত করে রেখে দিয়েছে, পরণে কালো রঙের ওভারসাইজড টিশার্ট আর পায়ের ঠাখনুর উপর ফোল্ড করে রাখা কার্গো প্যান্ট, মাথায় সাদা রঙের একটা টুপি। মসজিদে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে হয়তোবা। হেলাল সাহেব নিজের অতর্কিত চিন্তাগুলো পাশে ফেলে দিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,”তোমাকে এক সপ্তাহের জন্য আউট অফ সিলেট যেতে হবে।
আরশ শক্ত করে রাখা মুখটা আরেকটু শক্ত হয়ে গেল। দাঁতের কপাটি চেপে ধরে ধারালো কন্ঠে পরপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বাবার উদ্দেশ্যে,”কেন?
আরশকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দেখে একটু নিজের জায়গা থেকে টলে গেলেন হেলাল সাহেব। এক যোগে চেয়ে থেকে নিষ্প্রভ কন্ঠে বলেন,”আমি কেন টেন এর উত্তর দিতে পারব না। তুমি যাচ্ছ, মানে যাচ্ছ! এটাই আমার ফাস্ট এন্ড লাস্ট ডিসিশান।
আরশ নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে রইল হেলাল সাহেবের দিকে। শ্যাম বর্ণের ধারালো ক্লিন সেভ চোয়ালে হাত দিয়ে হালকা হাতে চুলকে নিল। অব্যক্ত অভিন্নতায় কাঠখোট্টা গলায় গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায়,”এটা তো বলবেন কোথায় যাব? কখন থেকে বলেই চলেছেন যাও যাও, কোথায় যাব সেটাই তো বলছেন না!
আরশের নিরেট হয়ে যাওয়া শ্যাম বর্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে হেলাল সাহেব মাথা নাড়ালেন। আনন্দিত কন্ঠে আওড়ালেন,”ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আরশের ভ্রু-যুগল কুঁচকে গেল। এক পেশে ভ্রু কুঁচকে, কপালের মাঝে হালকা ভাঁজ ফেলে ভরাট স্বরে জানতে চাইল,”ব্রাহ্মণবাড়িয়া! কেন?
হেলাল সাহেব মর্মাহত হলেন। এই ছেলে ভুলে গেছে নাকি ব্রাম্মণবাড়িয়া কার বাড়ি? পিটপিট করে আরশের দিকে তাকিয়ে আওড়ান,”তুমি ভুলে গিয়েছ কি? তোমার হবু বউ আজ দেশে আসছে। আগামীকাল তুমি ওদের ওখানে যাচ্ছো, আমি সব ব্যবস্থা করে নিয়েছি। আর ওদের ও বলে দিচ্ছি তুমি ওখানে যাচ্ছ! এক সপ্তাহ ওখানে থেকে মাহাদি আর অনিকা কে নিয়ে আসবে এই বাড়িতে। বুঝেছো আমার কথা? নাকি আবার বুঝাবো?
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৭
আরশ হ্যাঁ, না কোনো উত্তর করলো না। অনুমতির তোয়াক্কা না করে, উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল রুমের বাহিরে। মুখ দেখে বোঝা গেল না ভিতরে কি চলছে বা কি ভাবছে? উপর থেকে দেখে এইটুকু ঠাওর করা গেল, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের পুরুষালি লম্বাটে মুখটা আরো বেশি গম্ভীর হয়ে পড়েছে। বের হতে হতে যখন দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল, আলগোছে গালের পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা গর্তের সৃষ্ট হলো। যা উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখটা আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলল।