বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩৪
ইশরাত জাহান
খাবার এনে দর্শন বিছানায় তাকাতেই ফোস করে নিশ্বাস ছাড়ে।নিজের বউকে চিৎপটাং হয়ে ঘুমাতে দেখে বলে,“এই মেয়ের আর কি কি কান্ড দেখবো আল্লাহ ভালো জানে!”
বিছানার নিচে ঝুলতে থাকা শোভার মাথাটা বালিশে রেখে দুইটা মেলে রাখা হাত এক করে দিলো।শোভার ঠোঁট আঙুল দিয়ে উঁচিয়ে ফাঁকা করে তার মধ্যে চামচ দিয়ে স্যুপ খাইয়ে দিলো।ভ্রু কুঁচকে ঘুমন্ত শোভাকে বলে,“আমি কোনোদিন মেয়েদের আশেপাশে থাকার চিন্তা করিনি অথচ আজ কিনা একটা মেয়ের শরীরে হাত দিয়ে তার সেবাটাও করছি!সব তোমার দোষ।এই তোমাকে কে অসুস্থ হতে বলেছে?তোমার এসব ঝামেলা না হলে আমি এত কাঠখড় পোহাতাম না।”
ঘুমন্ত শোভা নিশ্চুপ।জেগে থাকলে নিশ্চয়ই রাগী বরের ভালোবাসার কথার অর্থ না বুঝে উল্টো অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে রাখতো।যেটা দেখলে দর্শন আরও অভিমান বাড়িয়ে দিতো।এখন চুপ আছে দেখেই আরো শুনিয়ে দিলো,“বউ বউয়ের মত থাকবে।এত গোমড়া মুখ,অভিমানে ফুলে রাখা নাক আমাকে দেখাবে না।আমার এসব বিরক্ত লাগে।”
বেচারি ঘুমের দেশে পাড়ি জমানো তাই কিছুই শুনল না।দর্শন সুযোগ বুঝে ঔষধ দিয়ে পানি দিয়েই শোভার ঠোঁট চেপে রাখলো।যেনো আবারও অঘটন না করে।ঘুমন্ত শোভার চোখের দিকে চেয়ে থেকে মুচকি হাসে দর্শন।মন চায় টুক করে কয়েকটা চুম্বন দিতে কিন্তু এখনও ব্যর্থ।শোভার পাশে চুপটি করে শুয়ে থাকে।শোভা আচমকা ঘুমের মাঝে দর্শনের বুকের উপর ঠ্যাং দিয়ে নাকটা দর্শনের গলার কাছে নেয়।দর্শন চোখ বড় করে দেখে।অতঃপর শোভার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে বলে,“শেষমেষ আমার গায়ের উপর ঠ্যাং দিয়ে দিলে!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
শোভা নিশ্বাস নিচ্ছে গরম নিশ্বাস।দর্শন শোভার চোখের নিচে একটা ছোট্ট কালো পাপড়ি দেখে।সেই পাপড়ি হাতে নিয়ে ফু দিয়ে উড়িয়ে বলে,“অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে আমাকে যেভাবে পারছ খাটিয়ে নিচ্ছো।সুযোগ আমারও আসবে।”
শোভার গরম নিশ্বাস দর্শনের গলার কাছে বারি খাচ্ছে।দর্শন উন্মাদ হয়ে উঠতে থাকে।ধীরে ধীরে শোভার দিকে ফিরে শার্টের বোতাম খুলে শোভার মাথাটা উন্মুক্ত বুকে রাখে।শোভার গরম নিশ্বাস এবার দর্শনের বুকে লাগে।দর্শন তার একটা হাত শোভার গালে বিচরণ করতে থাকে।
পরদিন সকালে শোভা নিজেকে সুস্থ বোধ করে।ঘুম থেকে উঠেও মনে হয় তার চোখমুখ পরিষ্কার।ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের ময়লা জমা বা মুখে রুক্ষ ভাব আনে এগুলো শোভার মাঝে নেই।উল্টো হামুখে তেলতেলে ভাব পায়।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে দর্শন ঘুমিয়ে আছে। শোভা নামতে প্রস্তুত নিলেই ক্ষোভ করে দর্শন তার হাত ধরে ফেলে।শোভা ফ্যালফ্যাল করে তাকালে দর্শন কপাল ভাঁজ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,“কোথায় যাচ্ছো?”
“নিচে।”
“চুপ করে ঘুমিয়ে থাকো।”
শোভা অবাক হয়ে বলে, “কাল থেকে ঘুমিয়ে আছি। আর কত ঘুমাবো?”
“যতক্ষণ না আমার ঘুম শেষ হয়।”
“সারাদিন কি ঘুমিয়ে থাকা যায়?”
“সারাদিন কি তোমাকে সেবা করে পাড়া যায়?”
শোভার মুখ চুপসে আসে।কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলে,“আমি কি বলেছি আমাকে সেবা করতে?”
দর্শন চোখ বুজেছিল।শোভার কথা শুনে আবারও চোখ মেলে রাগ দেখালো।শোভা মিনমিন করে বলে,“এমন রাগ দেখার ইচ্ছা নেই আমার।আমি গেলাম।”
শোভা নামতে নিলেই দর্শন পা দিয়ে ঠেকায়।শোভা চোখ বড়বড় করে তাকায়।মাথার নিচে দুইহাত ভাজ করে রাখে দর্শন। মাথাটা একটু উঁচিয়ে দেখতে চায় শোভা কি করে।শোভা পা ডিঙিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেই দর্শন পা উঁচিয়ে শোভার বাহু ধরে দিলো টান।শোভা অপ্রস্তুত হয়ে সোজা দর্শনের মুখের উপর ঝুঁকে গেলো।লম্বা চুলগুলোর কিছু চুল এসে ঠেকলো দর্শনের ঠোঁটের কোণে ও নাকে।দর্শন নিশ্বাসের সাথে শোভার চুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে।এদিকে শোভার ডাগর ডাগর চোখজোড়া দর্শনের মুখে বিচরণ করছে। দর্শনের
চাপদাড়ী ও মোচের মাঝে হালকা গোলাপি ঠোঁট প্রসারিত হয়ে আছে।যেটা দেখে শোভা স্তব্ধ।আচমকা দর্শনের হাত গেলো শোভার পিঠে।ঝুঁকে পড়ার কারণে চুলগুলো বেয়ে এক কোণায় আছে। আর শোভার পিঠের উপর উন্মুক্ত হয়ে আছে।সেখানেই হাত রেখেছে দর্শন।পিঠের উপর এমন ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠছে শোভা।গায়ে মোচড় দেয় তার।কাপাকাপি শুরু করেছে।দর্শন ভ্রু কুঁচকে বলে,“কাপাকাপি বন্ধ করো।”
শোভা হতভম্ভ চাহনি দেয়।কাপাকাপি বন্ধ করতে বললেই কি আর বন্ধ হয়?তার গা তো কাপছে দর্শনের অপৃত্তিকর ছোঁয়ায়।শোভা তোতলাতে শুরু করে, “আ আ আ আমার পি পি পি…
বাকিটা বলতে পারেনা।দর্শন আরও শক্ত করে ধরে রেখে বলে,“বেশি কাপাকাপি করলে আজ একটা অঘটন ঘটতে পারে।তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার স্বামী।যে তোমাকে এখনো পরিপূর্ণ ছোঁয়ায় ভরে দেয়নি।সামান্য বুকের উপর আছো তাতেই আমার বেহাল দশা,বেশি কাপাকাপি করলে আমি কন্ট্রোল হারাতে বাধ্য হবো।তোমার অসুস্থ শরীরে আমি নিজেকে আন্ডার কন্ট্রল করতে চাইনা।তোমার দুর্বল শরীরে প্রভাব ফেললে আমি নিজেই সাফার করব।”
শোভা ভাবান্তর দৃষ্টি মেলে আছে।দর্শন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,“আমার বাধ্য বউ হয়ে থাকবে।কোনো বাঁদরামি আমার সহ্য হয়না।জানোই তো রাগ বেশি আমার।তাই বলছি আমার কাছ থেকে রাগ পেতে না চাইলে আমার বাধ্য বউ হয়ে থেকো।”
শোভা উত্তর দেয়না দেখে দর্শন হালকা ঝাকুনি দিয়ে বলে,“বুঝেছো?”
শোভা আবারও কেঁপে ওঠে পিঠের উপর এমন ঝাকুনিতে।তাও গলা দিয়ে শব্দ বের করে,“হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ।”
“গুড ওয়াইফি।এখন চুপচাপ ঘুমাও।আমাকেও ঘুমাতে দেও।প্রচুর টায়ার্ড লাগছে।”
শোভা আর একটা টু শব্দ উচ্চারণ করেনা।দর্শনকে ঘুমাতে দেয় সে।এদিকে দর্শনের উপর নিজেকে রেখে অবস্থা খারাপ শোভার।
দুপুরের দিকে বাড়িতে আগমণ ঘটে ফারহার।তাকে দেখেও কেউই সন্তুষ্ট হয়নি।বরং সবার মুখ ভারী।সোফায় বসে দাদাজানের সামনে মিনতি করে বলে,“দর্শনের সাথে দেখা করতে চাই।”
দাদাজান বিদ্রুপের সাথে বলেন,“কিসের জন্য?”
“আসলে ওর জন্য আমাদের বাড়ি নিলামে উঠেছে।”
“ওর জন্য নাকি তোমার স্বামীর অপকর্মের জন্য?”
ফারহার মুখটা চুপসে গেলো।ঘর থেকে বের হলো দীপ্ত ফরাজি।প্রাক্তন বউকে দেখে সে ঘরে ফিরে গেলেন।এখানে থাকতে তার কাছে জঘন্য লাগছে।এই মহিলা পেরেছে মা জাতিকে কলঙ্কিত করতে।নাহলে মায়ের মত পবিত্র নারীকে দর্শন ঘৃণা করতে পারত না।
দাদাজান গা দুলিয়ে হেসে বলেন,“ছেলের কাছে এসেছো নিজের সম্মান বাঁচাতে!একদিন তুমিই ছেলেকে অসম্মান করেছিলে।স্বামীর কথা বাদ দিলাম।ছেলে তো তোমারই গর্ভের।তাকে কিভাবে বলেছিলে অযোগ্য সন্তান?বাচ্চা ছিলো।কতই বা যোগ্যতা অর্জন করতে পারত?আজকে দেখো।যোগ্যতা এতটা বেশি যে তুমি ওর দুয়ারে।”
ফারহার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।দাদাজান জানায়,“ও তোমার সাথে দেখা করবে না।”
ফারহা হাতজোড় করে অনুরোধ করলো,“একটু দয়া করুন।আমাদের পুরো পরিবার রাস্তায় নেমেছে।”
“যখন একটা ছেলে তার মাকে পা ধরে রাস্তায় হাউমাউ করে কান্না করেছিল তখন তো তোমার মনে সন্তানের জন্য দয়ামায়া আসেনি।একজন স্বামী এক্সিডেন্ট হয়ে পা খোয়ায়।সেই দৃশ্য দেখেও তুমি দেখোনি।এতকিছুর পরও আমাকে দয়া দেখাতে বলো কোন মুখ নিয়ে?”
শেষ কথাটা ধমকে বলেন দাদাজান।পারুল বেগম শান্ত হতে বলে।দিদার এগিয়ে এসে দাদাজানের কাপা কাপা হাতটা ধরে বলে,“তোমার হার্টের ব্যাথা বাড়বে দাদাজান।চিৎকার করো না।ওই মহিলার কোনকিছু না হলেও তোমার শরীরের ক্ষতি হবে।”
অতঃপর ফারহার দিকে ফিরে বলে,“অতীতের করা সর্বনাশের পর আপনার মুখ দেখা পাপ বলেই আমরা জানি।তাও কেন পাপের পল্লা ভারী করে দিচ্ছেন আমাদের?আপনার নিজের সন্তান আপনকে ধ্বংস করতে চায়।আমরা এখানে কেউই তাকে থামাতে পারবো না।কারণ সে এখন রাগী, জেদী হিংস্র।তার রাগ একবার মাথায় চেপে ধরলে কাউকে মানতে চায়না।আপনার কারণেই এমন।আপনার করা ঘৃণিত কাজের প্রভার ভাইয়ার ব্রেনে বাজেভাবে ফেলেছে।ওর মাইগ্রেইনের সমস্যা আছে।প্যানিক এটাক হয়।ধীরে ধীরে নিজেকে শেষ করে দিতে চায়।এই সবকিছু আপনার কারণেই।আপনি আসলে মানুষ না আপনি একজন ডাইনি।বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।ভাইয়া আপনাকে দেখলে আজ খুন করে ফেলবে।”
ফারহা কি করবে বুঝতে পারছে না।দর্শনের অনুমতি না পেলে তো বাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে।কোনমতে আটকে রেখেছে সরকারি লোকেদের।অনেক ভেবেও উপায়ন্তর না পেয়ে চলে গেলেন।ফারহা চলে যেতেই দর্শনের ঘুম ভাঙ্গে।বাইরে এসে সবার সামনে দাড়াতেই সবাই স্বাভাবিক হয়।
দাদাজান সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন দর্শনকে।সোফায় বসে দর্শন বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করে ভ্রুকুটি করে বলে, “হোয়াট?”
“বউকে কি ভালোভাবে বুঝিয়ে নিজের করতে পারো না?ধমকে কেউ বউয়ের ভালোবাসা আদায় করে?”
“যে কাজ অন্যরা করেনা ওই কাজ আমি করি।”
“তুমি কোন আম্বানির ফুত?”
“আমি ফরাজির ফুত।”
আমার দাদাজান খুক খুক করে উঠলেন।বাকিরা মুখ টিপে হাসছে।দর্শন পাত্তা না দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আজকের খবরের কাগজটা কোথায়?”
দিদার এগিয়ে দিলো।দাদাজান জিজ্ঞাসা করে,“সকালের খবর বিকালে পড়ে কেউ?”
“কেন পড়লে অসুবিধা কি?”
“দুপুরে খেয়েছো?”
“না,খাবো।”
“বউ কোথায় তোমার?”
“আসবে একটু পর।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩৩
“দেরি করে খেতে নেই।সময়মত খাওয়া দাওয়া করো।”
দর্শন তাকালো এক পলক অতঃপর আবারও খবরের কাগজে নজর রাখলো।দেখতে চায় জবরুল আহমেদ নিয়ে কোনো আপডেট এসেছে কি না।না আসলে এর হেস্তনেস্ত নিজেই করবে।