প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৫
জান্নাত নুসরাত
হেলাল সাহেব নুসরাতের সাথে ঝগড়া করা শেষ করে এসে সেই ড্রয়িং রুমে বসেছেন এখনো পর্যন্ত সেখান থেকে নড়েননি। সুফি খাতুন দু-একবার এসে কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আশানুরূপ যুতসই কোনো উত্তর পাননি বলে বর্তমানে হেলাল সাহেবের আশেপাশে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। হেলাল সাহেবের শুভ্র মুখ গম্ভীর বটে৷ ওই ছোটো মাছের মতো দেখতে মেয়েটা তার ছেলের মতো সুঠাম দেহি পুরুষকে কীভাবে গাধা বলতে পারে! আরশের নখের যোগ্য কী ওই মেয়ে! উঁহু তার ছেলের সাথে ওই মেয়ের তুলনায় দেওয়াই তো ভুল।।
হেলাল সাহেব নিজের অতর্কিত চিন্তার ভেতর মনে পড়ল আজ পুরোদিন প্রায় কেটে গেলেও আরশের দেখা সে পায়নি। কপালে ভাঁজের মোটা আস্তরণ পড়ল। চিন্তিত চোখ আশেপাশে ঘুরালেন, অতি আদরের ছেলেকে দেখার আশায়। অতি প্রিয় মুখটা না দেখতে পেয়ে বিরক্তি ফুটে উঠে শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায়। তার বিরক্তি আরো বাড়িয়ে দিয়ে জায়িন গম্ভীর কন্ঠে সালাম দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। জায়িনের তৎপর গতিতে যাওয়া দেখে হেলাল সাহেবের চশমার আড়ালে থাকা চোখগুলো ছোটো ছোটো হয়ে গেল। ছেলের কাছ থেকে সালাম ছাড়া কোনো প্রকার হায়, হ্যালো, না পেয়ে একটু অসন্তোষ হলেন। চেহারায় তা স্পষ্ট ভেসে উঠল। পুরুষালি কু্ঁচকে যাওয়া চামড়া আরোকটু কুঁচকে গেল।৷ নাক উপরে তুলে হেলাল সাহেব ভেংচি কাটলেন জায়িনকে পেছন থেকে। জোর গলায় স্ত্রীকে ডেকে ওঠলেন,”লিপি ও লিপি!
লিপি বেগম মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“জি, আসছি।
স্ত্রী-র নিকট থেকে উত্তর পেলেও সেটা নিজের পছন্দসই না হওয়ায় রেগে গেলেন হেলাল সাহেব। এই মুহূর্তে তার দ্বারা অপেক্ষা করা সম্ভব না তাই আবারো চিৎকার করে গর্জে ওঠার মতো লিপি বলে ডেকে উঠলেন। লিপি বেগম তড়িঘড়ি করে বের হয়ে আসলেন কিচেন থেকে। ওড়নার কোণে হাত মুছলেন। কপালের ঘাম ওড়না দিয়ে ঘষে মুছে নিলেন। স্বামীর দিকে চোখ পাঁকিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” কী হয়েছে আপনার? চিৎকার করে এলাকা শোনাচ্ছেন কেন?
হেলাল সাহেব খিঁচে যাওয়া মেজাজে বললেন,
“বেশ করেছি চিৎকার করেছি। তোমাকে এই নিয়ে সাতবার ডাকলাম কোনো হা না উত্তর করলে না কেন?
লিপি বেগম শুধরে দিয়ে স্বামীকে বললেন,
” সাতবার নয় দু-বার ডেকেছ।
হেলাল সাহেব তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন করলেন না। তর্জন গর্জন করে কঠিন আওয়াজে স্ত্রীর নিকট জানতে চাইলেন,”আরশ কোথায়?
লিপি বেগম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলেন। সত্যিতো আজ সারাদিনে একবারো আরশের দেখা পাননি লিপি বেগম। মৃদু কন্ঠে অনিশ্চয়তা নিয়ে জানালেন,”হয়তো এখানে আশেপাশে আছে।
হেলাল সাহেব স্ত্রীকে কিছুক্ষণ রাগী চোখে লক্ষ করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”হয়তো কী? ছেলের খোঁজ রাখো না কেমন মা তুমি?
লিপি বেগম নিজেও রেগে গেলেন। পাল্টা প্রশ্নের বান ছুঁড়ে মারলেন,”আপনি কেন জানেন না আরশ কোথায়? আপনি কেমন বাবা?
দু-জন দু-জনের দিকে কিৎকাল তাকিয়ে থেকে নীরব চোখে শুধু যুদ্ধ চালালেন। লিপি বেগম হেলাল সাহেবকে ড্রয়িং রুমে একা ফেলে রেখে কিচেনে যেতে যেতে মুখ মুচড়ে ভেংচি কেটে গেলেন। হেলাল সাহেব বিড়বিড়িয়ে আওড়ালেন,”মহিলার অবস্থা দেখো! স্বামীকে মুখ মুচড়ে কীভাবে যাচ্ছে? বেয়াদব!।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ। নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবেছে ধরণী। বৃষ্টির হঠাৎ আগমণে একটু বিভ্রান্ত বটে মাহাদি। একটু আগেই সে হসপিটাল থেকে ফিরে এসেছে সৈয়দ বাড়িতে। ডাক্তার নিশ্চিত করেছেন যে আরশ এখন বিপদের বাহিরে। কিন্তু হসপিটাল থেকে আসার পথে যা দেখল তা দেখে সে নিজে বিপদের ভেতরে ঢুকে গেছে। এই বাড়ির সব মানুষ কী এরকম অদ্ভুত, মাহাদির মনে প্রশ্ন জাগল! একজন কাদা শুয়ে গড়াগড়ি খায় তো অন্যজন্য দিন দুপুরে ঝগড়া করে।
ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে যখন নামছিল তখন এসব চিন্তা করছিল সে। হঠাৎ গলা খাঁকারি দেওয়ার শব্দে তার ধ্যান ফিরে আসে গভীর চিন্তা থেকে। চোখ তুলে সামনে তাকায়, চোখাচোখি হয় হেলাল সাহেবের সাথে। মৃদু শব্দে সালাম করে। সালামের জবাব হেলাল সাহেব ফিরিয়ে দেন। হাত তুলে ইশারা করেন তার দিকে আসার জন্য। মাহাদির কপালে ভাঁজ ফেলে এগিয়ে যায় হেলাল সাহেবের দিকে। চিন্তার উদ্ভব ঘটে আকস্মিক হেলাল সাহেব তাকে কেন ডাকছেন! নিজের গম্ভীর মুখখানা আরো একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখে মুখে বিরক্তি এঁটে যায় নিমেষে। একটা কাজে যাবে, তার মধ্যেও বাঁধা! ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে হেলাল সাহেবের সামনের সোফায় বসে। প্রশ্নাতীত গলায় জিজ্ঞেস করে,”কোনো প্রয়োজন আঙ্কেল?
হেলাল সাহেব নিজের সরু চোখ দিয়ে উপর থেকে নিচে মাহাদিকে অবলোকন করেন। বোঝার চেষ্টা করেন কোনো ঘাপলা আছে কী -না এই ছেলের মধ্যে! বন্ধুর ছেলে হলেই কী পার পেয়ে যাবে, তার সন্দেহের হাত থেকে? উঁহু একদম না! এই হেলাল কারোর সাথে না ইনসাফি করে না।
মাহাদির ভেতর কোনো ঘাপলা না পেয়ে নড়েচড়ে বসে আবারো চিন্তা করতে লাগলেন। সকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা প্রায় আরশের দেখা নেই কেন? আজ একেবারের জন্য আরশকে দেখননি তিনি। লিপি বেগমকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো কথার উত্তর দিতে পারেন না। তাই স্ত্রী-র উপর সমরুপে বিরক্ত হেলাল সাহেব। মাহাদির দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণতার সহিত জানতে চাইলেন,”তুমি এখানে, তাহলে আরশ কোথায়?
মাহাদির গম্ভীর মুখ আরো একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে আরশের কথা জিজ্ঞেস করায়। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। ভেতরে ভেতরে মিথ্যা বলার জন্য সব কথা গুছিয়ে নেয়৷ মুখে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে নিয়ে এসে, পুরুষালি পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে জানায়,”জি, আরশ আমাদের এক বন্ধুর সাথে আছে।
হেলাল সাহেব পরমুহূর্তে প্রশ্ন করেন,
“তাহলে তুমি এখানে কেন?
মাহাদি ঠোঁট কামড়ে ধরে অপ্রস্তুত হাসে। বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষালি চোখজোড়া আশেপাশে ঘুরিয়ে বলে ওঠে,” জি বাসা থেকে স্ন্যাকস নিতে এসেছি।
হেলাল সাহেব তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে মাহাদির দু-হাত পরিদর্শন করেন। তারপর ভ্রযুগল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করেন,”কোথায় স্ন্যাকস? তোমার হাত তো খালি!
মাহাদি থতমত খেয়ে যায়। ইতস্তত কন্ঠে বলে ওঠে,”জি!
হেলাল সাহেব মাহাদিকে শুধরে দিয়ে বলে ওঠেন,
“জি নয়, আমি জিজ্ঞেস করেছি হাত খালি কেন? স্ন্যাকস নিতে তো এসেছ?
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে আবারো চোখ সরু করে মাহাদির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন হেলাল সাহেব। হেলাল সাহেবের জেরার মুখে পড়ে মাহাদি বোকার মতো হেসে পরিবেশ স্বাভাবিক করতে চায়৷ ফিকে হয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,” তাই তো, তাই তো!
মনে মনে মিথ্যা কাহিনি সাজায়। আসল কথা বললে এই বাড়ি আর ওই বাড়িতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে এটা মাহাদি নিশ্চিত। তাই বিশ্বযুদ্ধ আটকাতে নিজের মুখ আটকে নেয়। ধীর মনোবল নিয়ে মিথ্যা কথা বলে,”আরশ গ্রোসারি শপে!
হেলাল সাহেব শুধালেন,
“গ্রোসারি শপে ওর কী কাজ?
মাহাদি ঝটপট ওঠে দাঁড়ায়। হেলাল সাহেবকে আরেকটা প্রশ্নের সুযোগ না দেওয়ার জন্য উল্টো পায়ে মেইন দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” আসলে আঙ্কেল আরশ ও কার্ড নেয়নি আর আমিও আবার আমাদের ওই বন্ধু ও কার্ড আনেনি। কিন্তু জিনিস না কিনে কিছু খাবার গ্রোসারি শপে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই খেয়ে নিয়েছিলাম। এখন আরশ আর আমাদের ওই বন্ধুকে ওখানে আটকে রেখেছে আর আমাকে এখানে কার্ড নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।
মাহাদি তাড়াতাড়ি করে এই বিপদের সামনে থেকে পালাতে যাবে হেলাল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কখন আসবে তোমরা এটা তো বলে যাও?
মাহাদি দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,” সপ্তাহ দশদিন পর ফিরে আসবো আমরা। আমরা আমাদের ওই ফ্রেন্ডের বাসায় কয়েকদিন থাকব। কিছু প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করবে আরশ ওখানে।
মাহাদি জান গলার কাছে নিয়ে পালিয়ে গেল। নাক কুঁচকে সৈয়দ বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে ভৎসনা জানায় হেলাল সাহেবকে। একটা মানুষ এত প্রশ্ন করতে পারে কীভাবে! বিরক্তিকর!
নুসরাত সন্ধ্যা বেলা পড়ে পড়ে ঘুম দিচ্ছিল। কিন্তু ভয়ংকর রকম এক বাস্তব স্বপ্ন দেখে তার বন্ধ হওয়া চোখগুলো তড়িৎ গতিতে খুলে গেল। চোখ খোলার পর সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা মনে করতে হলো। আরশকে হয়তো দেখেছে স্বপ্নে। কিন্তু কী বলছিল আরশ! কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু একটা তো বলছিল সে! কী সেটা? নুসরাত মনে করতে পারল না। যে স্বপ্ন গুলো বাস্তবিক হয় সেই স্বপ্নগুলো মনে রাখা একটু কষ্টকর হয়। নুসরাত হাল ছেড়ে দিল না, চাপ দিতে থাকল নিজের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে যাতে আরশের বলা কথাটা তার মনে পড়ে যায়।
হঠাৎ আজ সন্ধ্যাবেলায় ঘুমানোর জন্য নুসরাতের শরীরটায় একটু অলসতা গেড়ে বসেছে। তাই বিছানায় আবারো হাত-পা ছুঁড়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমের ভাব এখনো না কাটায় চোখ বন্ধ করে নিতেই স্বপ্নে দেখা কিছু মনে পড়ল। আরশের বলা কথাগুলো সাইরেনের মতো কানের কাছে শব্দ হলো।। চোখ খিঁচে নিতেই আবারো আরশের বলিষ্ঠ হাতজোড়া নিজের গলার কাছে ভাসল। নিজের উপর বিরক্ত হলো এত বাস্তবিক একটা স্বপ্ন দেখে সে কী করে ভুলে গেল। নিজে নিজের চুলগুলো খাঁমচে ধরে বিছানার প্রান্তে ঝুলে রইল। স্বপ্নকে স্বপ্নভেবে ভুলে যেতে চাইল কিন্তু বারবার সেটা মাথায় চড়ে বসল। অধিক চেষ্টার পরেও নিজের মনের ভিতর থেকে স্বপ্নের রেশ কাটাতে পারল না।
বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে এসির রিমোট হাতে নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। শরীর ঘেমে গেছে সেটা ঢের ভালো অনুভব করতে পারছে। নিজে অভারসাইজড হ্যালো কিট্টির টি-শার্ট টেনে পেটের উপর তুলে ফেলল। এর মধ্যে ইসরাত এসে রুমে প্রবেশ করল। ভ্র কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে তোর? শরীর এমন ঘেমে আছে কেন?
নুসরাত মৃদু কন্ঠে ইসরাতকে বলল,
“বাস্তবিক স্বপ্ন দেখেছি।
ইসরাত এগিয়ে এসে বিছানায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে,”কী স্বপ্নে দেখেছিস?
নুসরাত এক পেশে ভ্রু বাঁকিয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে জানায়,
“একজনকে দেখেছি, মুখ দেখিনি কিন্তু অনুভব করেছি।
ইসরাত শান্ত কথায় এবার কিছুটা বিরক্তির খুঁজে পাওয়া যায়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,”সেটাই তো জানতে চেয়েছি, কাকে অনুভব করেছিস?
নুসরাত ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়,”আরশ ভাইকে।
ইসরাত কথা বলতে যায় নুসরাত কেটে দেয়। মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,”অন্য বিষয়ে কথা বলি।
ইসরাত আর ঘাটায় না। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ডাক্তার কী বলেছে?
“কোমরে হাঢ়ে ফ্রেকচার হয়েছে কী-না এক্স-রে করে দেখে নিতে, এখন শুধু ব্যথানাশক ওষধ দিয়েছে।
ইসরাত শুধায়,
“তাহলে কী আগামীকাল তুই যাবি হসপিটালে আবার?
নুসরাত উদাসীন কন্ঠে জানায়,
” না দু-তিনদিন পর যাবো। এর মধ্যে কমে গেলে তো আর যাব না।
নুসরাত সে কথা শেষ করে উদগ্রীব কন্ঠে ইসরাতকে বলে ওঠে,”জানিস আজ কী হয়েছে?
নুসরাতের কথায় ইসরাত নড়েচড়ে বসে। চোখে মুখে কৌতূহল নিয়ে নুসরাতের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নুসরাত ওঠে দাঁড়িয়ে নিজের কার্বাড খুলে আন্মুল ডার্ক চকলেট বের করতে করতে বলে,”বালের নেতার সাথে দেখা হয়েছে হসপিটালের করিডোরে।
“বালের নেতা মানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওই নেতা?
নুসরাত মাথা নাড়ায় উপর নিচ। বিরক্তিতে পূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,”হু! এত বিরক্তিকর মানুষ কীভাবে হতে পারে। যেখানে দেখে সেখানে এসে গায়ে পড়ে কথা বলতে চলে আসে। তুই নেতা মানুষ তুই হবি মুডি, না তুই হলি মহিলাদের সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব। এটা কী যায় ভবিষ্যৎ নেতার সাথে?
ইসরাত নুসরাতের কথায় সুর মিলিয়ে বলে,
” না।
“এক্সেক্টলি। আমি এইটা বলতে চাই ওই বেটা মাথা মোটাকে।
নাহিয়ানের কথা বলতে বলতে নুসরাত মুখের ভাবভঙ্গি বারবার পরিবর্তন করল। ইসরাত ঠোঁট চেপে হেসে ওঠল আকস্মিক। ঠাট্টার স্বরে নুসরাতকে অপ্রস্তুত করার জন্য বলে ওঠে,”Maybe he has fallen in love with you.
ইসরাতের কথায় নুসরাত সামান্য কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বড় বড় করে নিল। পরমুহূর্তে দু-বোন দু-জনের দিকে তাকিয়ে থেকে রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠল। নুসরাত নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে ওঠল,”ভাই মানুষ আমার মধ্যে কী দেখে প্রেমে পড়বে, তুই বল?
ইসরাত হাত বাড়িয়ে নুসরাতের খোপা বাঁধা অগোছালো চুলগুলো আরো বেশি অগোছালো করে দিল। মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে আওড়াল,”এই মায়াবী চেহারা দেখে।
নুসরাত হেসে উড়িয়ে দিল ইসরাতের কথা। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে দু-হাত দু-পাশে নাড়াল। রুমের পরিবেশ আরো কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আর তখনই জায়িনের পুরুষালি হাস্কি গলার আওয়াজ দো-তলার ইসরাতের কানে স্পষ্ট ভেসে আসলো। নুসরাত ইসরাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে মিচকে শয়তানের মতো হাসল। ওড়না ছাড়া দৌড় দেয় সিঁড়ির দিকে জায়িন কেন এসেছে তা জানার জন্য কিন্তু পরমুহূর্তে ইসরাতকে অবাক করে দিয়ে আবারো ফিরে আসে উল্টো পায়ে হন্তদন্ত হয়ে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিজের ওড়না খুঁজে। কাঙ্ক্ষিত জিনিস চোখের সামনে কোথাও খুঁজে না পেয়ে এলোমেলো কন্ঠে গালি দিয়ে ওঠে,”হেডা! প্রয়োজনের সময় কোনো সাউয়া হাতের কাছে পাই না।
ইসরাতের গায়ে ওড়না দেখার পরপর নুসরাতের শিকারী দৃষ্টি সেদিকে চলে যায়। মেয়েটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড়ের গতিতে এসে, উড়ন্ত গতিতে ইসরাতের গায়ের ওপর থেকে জরজেট ওড়না টেনে নিয়ে আবারো দৌড় দেয় নুসরাত। কাঠের দরজার সাথে পায়ের আঙুল লেগে আঘাত লাগে। একবার নিজের দৌড়ের গতি থামিয়ে পা চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে, তারপরে ইসরাতের দৃষ্টি সীমার বাহিরে উড়ে চলে যায়।
ড্রয়িং রুমে নাছির সাহেব বসে আছেন। নুসরাত তাড়াহুড়ো করে গিয়ে সোফায় বসতে বসতে জায়িনের উদ্দেশ্যে সালাম ঠুকে,”সালাম ভাইয়া!
জায়িন নিজেও গম্ভীর কন্ঠে নুসরাতের সালামের উত্তর দেয়,”ওয়ালাইকুম!
নুসরাত নাছির সাহেবের পাশে বসে সেন্টার টেবিলে রাখা আঙুরের উপর হামলে পড়ে। পিরিচ থেকে এক মুঠো আঙুর তুলে মুখে একসাথে ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কী মনে করে এখানে ভা..ই…য়া?
জায়িন নুসরাতের দিকে তাকিয়ে হাসে। আলগোছে পকেট থেকে ব্ল্যাক কার্ড বের করে ইশারা করে সেদিকে। সেটা দেখতেই নুসরাতের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আপনা-আপনি। ঠোঁট চোখা করে তীক্ষ্ণ চোখ বুলায় আমেরিকান এক্সপ্রেসো এর দিকে। আর কোনো প্রশ্ন করে না সে। জায়িন এবার সূক্ষ্ম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”মনে হচ্ছে উড়ে এসেছ?
নুসরাত কাচের পিরিচে প্রেস্টির টুকরো তুলে নিতে যাবে, জায়িন মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,”প্রয়োজন নেই এটার!
নুসরাত ভ্রু কুঁচকে তাকায়।৷ নিজের প্রেস্টির দিকে ইশারা করে দাঁত কেলিয়ে হেসে উত্তর দেয়,”আপনাকে লজ্জা দেওয়া উচিত নয়, তারপর ও বলব ভাইয়া, এটা আপনাকে দিচ্ছেটা কে? এটা আমি নিজের জন্য নিয়েছি। যদি খেতে চান তাহলে নিজে কষ্ট করে প্লেটে তুলে নেন।
জায়িন নুসরাতের সূক্ষ্ম অবমাননা আলগোছে ঢোক গিলে, নেয়। নাছির সাহেবের দিকে তাকাতেই নাছির সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন,”তুমি শুধু রেজিস্ট্রি করতে চাও?
জায়িন হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। নাছির সাহেব পকেট থেকে চশমা বের করে কপালে ভাঁজ ফেলে ফু দিয়ে গ্লাস পরিস্কার করে নেন। নুসরাত নিজেও প্যান্টের পকেট থেকে নিজের চশমা বের করে ফু দিয়ে পরে নেয়। বাপ মেয়ে ভ্রুযুগল কুঁচকে এক সাথে জায়িনের দিকে উপর নিচ তাকান। নাছির সাহেব গম্ভীর কন্ঠে আবারো বললেন,”দেখো, আমি একজন বাবা। আমার মেয়েকে যদি কেউ বলে, ছেলে একা এসে হাত চাইতেই আমি আমার মেয়ের হাত দিয়ে দিয়েছি তার হাতে, সমাজের কোনো মূল্যায়ন করলাম না। তখন আমি কী উত্তর দিব? আমার মেয়ের দিকে আঙুল উঠবে বিদেশি ছেলেকে জাদু করে বিয়ে করেছে….
জায়িন স্যরি বলে প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিল নাছির সাহেবের কথা কাটার জন্য। নিজের রাশভারী গলায় বলে ওঠে,”যেখানে আমাদের বিয়ে আগে হয়ে গিয়েছে সেখানে মানুষ কী বলল আমি তার পরোয়া করিনা।
নুসরাত চুপচাপ এক পা সোফার উপর তুলে বসে রইল। দো-তলার বারান্দায় ততক্ষণে ইসরাত ও এসে দাঁড়িয়েছে। রেলিঙে হাত চেপে উঁকি দিল জায়িনকে পরিস্কার দেখার আশায়। তখনই আবারো নাছির সাহেব বললেন,”সেটা তুমি বললে হবে না বাবা, সমাজ বলতে তো কিছু আছে। তোমাদের বিয়েটা সমাজের কাছে এখনো স্বীকৃতি পায়নি। আমাদের ফ্যামেলির ভেতর কী হয়েছে এখনো আমাদের কাছের অনেক আত্মীয় জানে না। আর সেখানে…যাইহোক! তুমি বললে আমি সমাজের পরোয়া করিনা, কিন্তু আমাদের পরোয়া করতে হবে। আমি এই সমাজে বসবাস করি, আর এই সমাজ আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলুক সেটা আমি একদম চাইনা। আমার মেয়ে ফেলনা নয়, যে মানুষ তার দিকে আঙুল তুলবে। আমি এখনো বেঁচে আছি জায়িন। আর আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েদের উপর আঙুল তোলার সাহস আমি কাউকে দিব না।
জায়িন এবার গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইল,
“আপনি এখন কী চাচ্ছেন আমার কাছে মেজ আব্বু?
নাছির সাহেব পানি পান করলেন। এক নিঃশ্বাসে কথা বলায় হাপিয়ে ওঠেছেন তিনি। শব্দ করে শ্বাস ফেলে অনুভূতিহীন কন্ঠে জানালেন,”নাথিং অনেক বেশি কিছু না। সমাজের চোখে তোমাদের বিয়েটা বৈধ করতে চাইছি। তুমি বড় ভাইকে, বড় ভাবিকে এখানে নিয়ে আসো,একটা সাধারণ এরেঞ্জ ম্যারেজ যেভাবে হয় সেভাবে তোমরা সবাই এসে ইসরাতকে দেখবে তারপর তার হাত আমার কাছে চাইবে। আমি তোমাকে পরিদর্শন করব এবং এটা নিশ্চিত করব যে আমার মেয়ের উপযোগী জীবন সঙ্গিনী তুমি। তারপর তোমাদের আবারো প্রথম থেকে বিয়ে হবে। কারণ মেয়েদের বিয়ের বিষয়ে অনেক শখ থাকে। আমি মনে করি আমার মায়ের ও আছে। তাই তার এই শখ আমি অপূর্ণ রেখে বিয়ে দিতে চাই না। বুঝেছ আমি কী বলেছি!
জায়িন নির্দ্বিধায় উত্তর দিল,
“জি। আর কিছু মেজ আব্বু?
নাছির সাহেব দু-পাশে মাথা নাড়ালেন। জায়িন ওঠে দাঁড়াল। সালাম জানিয়ে দরজার দিকে বের হয়ে যাবে নিজের দিকে কারোর প্রবল দৃষ্টি অনুভব হলো। ঘাড় কাত করে তড়াক করে পেছনে তাকাতেই চুপচাপ মলিন মুখে দো-তলায় দাঁড়িয়ে থাকা ইসরাতের সাথে চোখাচোখি হলো। জায়িন আজ ইসরাতের পানে চেয়ে হাসল না। গম্ভীর মুখ করে স্থির দৃষ্টি কিছুক্ষণ তাক করে রাখল শুভ্র মেয়েলি মুখে। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত পায়ে নাছির মঞ্জিল পরিত্যাগ করল।
সৈয়দ বাড়ির ড্রয়িং রুমে মাথায় হাত রেখে এখনো বসে আছেন হেলাল সাহেব। চোখে মুখে কিছুটা উদ্বিগ্নভাব ফুটে আছে। কপালে হাত চেপে রেখে যখন কিছু চিন্তা করছিলেন তখন নাকে এসে লাগল পুরুষালি আতরের ঘ্রাণ। লেবুপাতার সুগন্ধিতে পুরো ড্রয়িং রুম মো মো করে ওঠল। নিজের নিকট গন্ধটা তীব্র করে পেতেই হেলাল সাহেব কপাল থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে জায়িনের দিকে তাকালেন। সোজা হয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন,” কী হয়েছে? ও বাড়ি থেকে এসেই পান্ডার মতো মুখ ফুলিয়ে বসে আছো কেন? তোমাকে ভয়ংকর লাগছে!
হেলাল সাহেবের কথায় জায়িন রিয়েক্ট করল না। জায়িনকে নড়তে না দেখে বিভ্রান্ত হলেন সামান্য হেলাল সাহেব। ঠোঁট থেকে রসিকতা সরিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন,”কী হয়েছে? গুরুতর কোনো সমস্যা?
“জি সমস্যা তো বটে। আমার চিন্তাটা তো আপনাকে নিয়ে।
জায়িন নিরেট কন্ঠে কথাটা শেষ করে। জায়িনের কন্ঠে কোনো শ্লেষ খুঁজে পেলেন না হেলাল সাহেব। তাই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”আমাকে নিয়ে? কীরকম চিন্তা?
জায়ন নিজের গলা নিচু করে নিল। ফিসফিস করে হেলাল সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,”আব্বু আমার সত্যি আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। মানুষ আপনাকে রাস্তায় দেখলে ছি্হ বলবে।
হেলাল সাহেব আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কেন?
” প্রশ্ন এটা না সেটা বলুন ইসরাতের খোঁজ খবর নেওয়া শেষ?
“না এখনো শুরু করিনি, কিন্তু মানু….
হেলাল সাহেব কথাটা কেটে দিল জায়িন। ফিসফিস করে সতর্ক আওয়াজে বলে,” তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসরাতের সম্বন্ধ নিয়ে যান নাহলে মানুষ আপনাকে ছি্হ বলবে।
“সেটা তো বলবে, কেন ছি্হ বলবে?
জায়িন দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর গলায় বলল,
“সবাই জেনে গেছে ইসরাতের সাথে আমার বিবাহের কথা।
” তাতে কী?
“আরে আব্বু আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না! মানুষ খারাপ বলবে না, আপনার ছেলের বউ নিজের বাপের বাসায় এখনো থাকে। আর তার খরচ ও তার বাবা বহন করে।
জায়িনের কথার সাথে মানুষের ছি্হ দিবে কেন তা যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেলেন না। জায়িন বলল,” আব্বু এখনো সময় আছে, মেজ আব্বু কিছু কথা মানুষের কাছে ছড়ানোর আগেই তুমি গিয়ে ধুমধাম করে ইসরাতকে তুলে নিয়ে আসো। এতে তোমার সম্মান আরো বেড়ে যাবে। বুঝছেন? সেই তো রেজিস্ট্রি করে নিয়ে আসব, তাহলে এর আগে ধুমধাম করে তুলে নিলে কেমন হয়? আপনার জয়ধ্বনি মানুষের মুখ মুখে থাকবে।
হেলাল সাহেব গভীর চিন্তায় চলে যেতেই জায়িন ঠোঁট কামড়ে হেসে দিল। সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। দন্ত কপাটির মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। হেলাল সাহেব উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,”তাহলে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসরাতের বিষয় খোঁজ নিতে হবে। জায়িন আমরা এক কাজ করি আগামী বুধবারে বিয়ের জন্য হাত চাইতে চলে যাই? কী বলো তুমি?
জায়িন হ্যাঁ ভঙ্গিতে উপর নিচ মাথা নাড়াল।।হেলাল সাহেব গম্ভীর চিন্তা লিপ্ত হলেন। চিন্তা শেষে চোখ তুলে জায়িনের উদ্দেশ্যে বললেন,”আমাকে একটা ওয়াদা করতে হবে!
জায়িন শুধাল,
“কী বিষয়ে?
হেলাল সাহেব নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
” আমার কথার মধ্যে তুমি কোনো কথা বলতে পারবে না। ওয়াদা করো!
জায়িন পুরুষালি ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে শক্ত কন্ঠে আওড়ায়,”ওয়াদা।
পরেরদিন সকাবেলা।
মিষ্টি রোদের আজ দেখা মিলেছে। সূর্যের দেখা মিললে তার তেজ তেমন প্রকট না। চারিদিকে বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে গাছের ঢালে শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলো মড়মড়ে শব্দে ঝড়ে পড়ছে নিচে৷ ইসরাত আজ ভার্সিটিতে যাবে। তাই নুসরাত তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য সাথে বেরিয়েছে। ইসরাতের ভার্সিটিতে কী একটা প্রোগ্রাম আজকে। তাই ইসরাতের সেখানে উপস্থিত থাকা জরুরি। বাড়ি থেকে বের হতেই হসপিটালের সে দু-জন লোক নুসরাতের চোখে পড়ল। ফিসফিস করে ইসরাতের উদ্দেশ্যে বলল,”ওই দেখ কার্টুনগুলাকে, গতকাল থেকে দেখছি আমার পিছু নিয়েছে।
ইসরাত আড় চোখে লক্ষ করল তাদের। নুসরাতের কথানুযায়ী সত্যি দু-জনকে দেখতে কার্টুনের মতো দেখাচ্ছে। তারা ঐ দু-জনকে পাত্তা না দিয়ে সামনে পা বাড়াল। তারা যত সামনে আগাল দু-জন তাদের পেছন পেছন আসলো। ইসরাত সি-এন-জি ওঠে চলে যাওয়ার পর দু-জন নুসরাতকে চুপিসারে লক্ষ করতে লাগল। নুসরাত পকেটে হাত রেখে দূর দূরান্তে চোখ সরু করে তাকাল। এটা দু-জন নোটিশ করল। গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে বলে দু-জনের নিকট মনে হলো। হেলাল সাহেবকে তথ্যটা জানানোর জন্য কল দিল, দু-রিং হতেই কল রিসিভ করলেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই দু-জন পরামর্শ করে নিল কে বলবে। বাঁ-পাশের লোকটা বলল,”এশমাম তুই বল।
এশমাম নামক লোকটা অপরপাশের লোকটাকে বলল,”না তুই বল এহসান।
দু-জনের কথা কাটাকাটির মধ্যে হেলাল সাহেব ধমক দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,”কী গুরুত্বপূর্ণ খবর আমাকে জানাও! এহসান তুমি বলো।
এহসান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আমাদের যার উপর নজর রাখার জন্য বলেছিলেন তিনি এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরে কোথাও চেয়ে আছেন।
ফোনের অপরপাশে হেলাল সাহেব দাঁতে দাঁত চাপলেন। কিড়মিড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” এই তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ খবর?
দু-জন একসাথে বলে ওঠল,
“জি হ্যাঁ!
” ফোন রাখো গাধারা, আর ওর ওপর নজর রাখো।
দু-জন সামনে তাকিয়ে দেখল নুসরাত নেই। একসাথে চিৎকার করে ওঠে বলে,”ম্যাম কোথায় গেল?
হেলাল সাহেব রুঢ় গলায় হিসহিসিয়ে বলেন,
“ওকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করো নাহলে…
হেলাল সাহেবের কথা কেটে দিয়ে তারা বলে ওঠল,
“এই তো ম্যামকে পেয়ে গেছি স্যার!
হেলাল সাহেব সস্থির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হেলাল সাহেব ফোন কাটতে যাবেন এশমাম ফোন টেনে নিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,”স্যার ম্যাম তার থেকে দু-তিন বছরের ছোট একটা ছেলেকে ব্যাট দিয়ে পেটাচ্ছেন।
হেলাল সাহেবের ছোট ছোট চশমার পেছনে ঢাকা চোখগুলো বৃহৎকার ধারণ করল। তিনি মেয়েটাকে কতটা ভদ্র সভ্য তার মতো মনে করেছিলেন আর এখন দেখেন কী! শক্ত কন্ঠে আদেশ দিলেন,”নজর রাখো! আর কী কি ঘটে সব আমাকে ইনফরমেশন দাও।
দু-জন এক সাথে বলে ওঠে,
” ইয়েস স্যার।
ইসরাতের ভার্সিটিতে আজ একটা বিশেষ প্রোগ্রাম রাখা হয়েছে। সেখানে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসবেন। এই প্রোগ্রামের মূল কারণ হলো, যারা টাকার অভাবে পড়তে পারছে না বা দরিদ্রতার কারণে বিবাহ সম্পন্ন হচ্ছে না তাদের জন্য একটা ফান্ড খোলা। নাছির সাহেব, শোহেব সাহেব আর সোহেদ সাহেবকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নাছির সাহেব কিছু ব্যাস্ততার কারণে প্রথমেই তিনি না করে দিয়েছেন। তাই আজ শুধু শোহেব সাহেব না হয় সোহেদ সাহেব আসবেন। ইসরাতকে ভলেন্টিয়ারের দায়িত্বে রাখা হয়েছে।
প্রিন্সিপাল রুমে মিটিং শেষে যখন ক্যাম্পাসে বিশেষ অতিথিদের নিয়ে আসা হলো ইসরাতের ক্লাসমেটরা সিনিয়র হিসেবে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিল। ইসরাত তখনো লক্ষ করেনি স্টেজে আসা মানুষগুলোকে। অতিরিক্ত মানুষের জন্য পুরো স্টেজ এড়িয়া গরম হয়ে ওঠেছে। মানুষের সংস্পর্শে দ্বিগুণ ঘেমে যাচ্ছিল। ইসরাত তাদেরই একজন। ঘামের গন্ধে বমির উদ্রেক হলো। তাই ভাবল ঠান্ডা পানি পান করলে হয়তো বমির উদ্রেক কমবে। ব্যাগ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে পান করতে যাবে অস্বাভাবিক ভাবে হাত কেঁপে ওঠল। ইসরাত ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের এই অধপতন লক্ষ করল৷ সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে আনতেই নিজের দিকে কারোর তীব্র দৃষ্টি অনুভব করল।
মেয়েলি নাজুক শরীর খানা তখনই টানটান শক্ত হয়ে আসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বোতলের ছিপি খুলে পানি খেতে নিবে তাড়াহুড়োয় আর হাত কাঁপায় নাকে-মুখে পানি ঢুকে বিষম ওঠে গেল। মুখ চেপে ধরে কুহ কুহ করে কেশে ওঠতেই পিঠে কারোর শক্ত হাতের স্পর্শ পেল। ইসরাত তড়াক করে দূরে সরে যাবে তার আগেই মেয়েলি কব্জি চেপে ধরল জায়িন। চোখ বড় বড় করে উদ্বীগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কাম ডাউন ইসরাত,এটা আমি। আগে এটা বলুন, আপনি ঠিক আছেন?
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৪
ইসরাত নিজের মুখে হাত চেপে ধরল। গলায় এখনো কিছু একটা করছে। জায়িনকে দেখে অবাক হলো তবুও অবাকতা ঢেকে রেখে, মৃদু কন্ঠে জানাল,”আমি ঠিক আছি।
জায়িন কন্ঠ খাদে নামিয়ে, যতোটা সম্ভব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,”আর ইউ সিউর? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো!
ইসরাত চোখ তুলে তাকাতেই নাক চিড়ে লেবু পাতার ঘ্রাণ প্রবেশ করল। ঢোক গিলে, শ্বাস ফেলল। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ঝুলিয়ে বলল,”আমি ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।