সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৮
Jannatul Firdaus Mithila
“ আরে শাহানুর! কেমন আছিস তুই? চট্টগ্রাম থেকে ফিরলি কবে?”
সম্মুখে দাড়ানো কবির সাহেবের কথায় মৃদু হেসে জবাব দেয় শাহানুর,
“ জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই! আপনি কেমন আছেন? ”
“ হ্যা বেশ ভালো।তা তুই গিয়েছিলি বাড়িতে? দেখা করেছিস সবার সাথে? ”
কবির সাহেবের শেষ কথাটি কর্নপাত হওয়া মাত্রই মুখটা পানশে হয়ে আসে শাহানুরের।কোনমতে মুখে মেকি হাসি টেনে মাথানিচু করে বললো,
“ জি-না ভাইজান! যাইনি এখনো।”
কবির সাহেব আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন শাহানুরের মুখের দিকে।অতপর রৌদ্রের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে এলেন খানিকটা। ব্যাথিত কন্ঠে বললেন,
“ তুইও কি কাকীমার কথা শুনে রাগ-অভিমান করে আছিস ভাই? আপন হয়েও পরের মতো দূর দূর করবি? ”
শাহানুর তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে।কবির সাহেবের ছলছল হয়ে আসা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে বলতে লাগলো,
“না না ভাইজান! এমন কোন বিষয় না! তুমি শুধু শুধু এসব ভেবে মন খারাপ করো না।আচ্ছা চলো আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি। ”
কথাটা শেষ করে শাহানুর কবির সাহেবের অন্যহাতটা ধরে চলে আসে রাস্তার ওপাশে থাকা খায়রুল এহসানের ভিটেতে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আব্দুল মান্নান সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছেন নিজ কেদারায়। চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে তার। গালভর্তি পাক-ধরা লম্বা দাড়িগুলোয় মেহেদী দিয়ে লাল করে রাখা।মাথার ওপরের চুলগুলো ছেঁটে ছোট করে রাখা। পড়নে একটা ধবধবে সাদা লুঙ্গি আর ঢোলা ফতুয়া। মানুষটা যখন নিজের ভাবনায় বিভোর তখনি সেখানে আগমন ঘটে আরিফ এহসানের।বাবাকে এমন অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে আরিফ সাহেব বললো,
“ আব্বা! এমনে বইসা আছেন কেন? কি ভাবেন এতো?”
হঠাৎ ডাকে একপ্রকার হকচকিয়ে ওঠেন বৃদ্ধ মান্নান সাহেব। চকিত দৃষ্টি ফেলেন ছেলের ওপর। বলতে লাগলেন,
“ নাহ! তেমন কিছু না।আসলে ঐ কবির গো লইয়া এট্টু ভাবতাছিলাম আরকি!”
কবিরদের কথা শুনতেই বুঝি ঠান্ডা মেজাজটা মুহুর্তেই চটে যায় আরিফের। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে খানিকটা ভাজ ফেলে কর্কশ গলায় বলে,
“ হে-গোরে নিয়া আফনে এত কিয়ের চিন্তা করেন? আফনে বুড়া মানুষ আফনে করবেন আল্লাহ আল্লাহ! কিয়ের যার না তার লাইগা চিন্তা কইরা নিজের শরীর নষ্ট করেন।”
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে আহত হলেন মান্নান সাহেব। আহত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ওরা কি কোনো যা-তা? ওরা হইছে গিয়া আমাগো আপন।আমার আপন ভাইয়ের পোলাপান। আর তগো আপন চাচাতো ভাই-বইন।তারপরও হেগো লইয়া এসব কওয়াডা কি ঠিক হইলো আরিফ? ”
“ হ হ! আমরা কিছু কইলেই বেঠিক! আর যতো ঠিক তুমি আর তোমার মরা ভাই আর তার পোলাপানেরা।”
স্বামীর কথার প্রতিত্তোরে যথাসম্ভব খেঁকিয়ে ওঠে কথাটা বলে থামলেন খুশবু বেগম। হাতে পানির জগটা নিয়ে এসে সেটা শব্দ করে টেবিলের ওপর রাখলেন তিনি।পরপরই স্বামীর দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন,
“ আর কতোকাল গুনগান গাইবা তোমার ভাই আর তার পোলাপানের? হেরা যে আমগো এতো ক্ষতি করলো, তারপরেও কেন তোমার শিক্ষা হয়না? কেন বুঝো না ঐডিনে একেকটা কালসাপ। কারন, কালসাপের ঔরস্যে কালসাপই তৈয়ার হয়!”
মান্নান সাহেব এবার মাথা নাড়িয়ে নাকচ করলেন স্ত্রীর কথা।তাকে শুধরে দিয়ে বললেন,
“ তুমি আবারও ভুল কইতাছো আরিফের মা! খায়রুলের এনে কোনরকমের দোষ আছিলো না।ঐডা তো আমার…”
কথাটা সম্পূর্ণ হতে না দিয়ে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন খুশবু বেগম। রাগান্বিত হয়ে বলতে লাগলেন,
“ মিথ্যা কথা কইবা না আরিফের বাপ! আমি কিন্তু কিচ্ছু ভুলিনাই।আমি ভুলিনাই তোমার ভাইয়ের বেঈমানী। ভুলিনাই ঐদিনের কথা।আমি বড় ভাইয়ের বউ হইয়াও তোমার ছোট ভাইয়ের পাদুইটা ধরা বাকি রাখছিলাম শুধু। কতো অনুনয় কইরা কইলাম তোমার ভাইয়েরে,যাতে তোমারে পুলিশের হাত থেইকা ছাড়ায় আনে।কিন্তু তোমার ভাই কি করলো? খায়রুল আমার থেইকা মুখ ফিরায় নিলো।তার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও তোমারে জেল থেইক্কা ছাড়াইলো না। তুমি হইতো ভুইলা গেছো সব আরিফের বাপ! কিন্তু আমি ভুলিনাই। কোনদিন ভুলমুও না।মনে রাইখো।”
খুশবু বেগম থামলেন। চোখদুটোর কোটর ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে নোনাজল। রক্তবর্ণ আঁখি দ্বয়ে ঘৃণা আর অসংখ্য অভিযোগ। যেন তা চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছে — মাফ করবেন না তিনি।আরিফ মায়ের ছলছল চোখজোড়া দেখে এগিয়ে আসে। মা’কে একহাতে আগলে নিয়ে বলে,
“ কাইন্দো না মা! যার যার পাপের শাস্তি হে পাইবো। তুমি শুধু আল্লাহরে কও।”
খুশবু বেগম শুনলেন কি ছেলের কথা? হয়তো! তিনি ছেলের হাতটা কাঁধ হতে সরিয়ে গটগট পায়ে ঘরের দিকে চলে গেলেন। আরিফ সেদিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু। ছেলেটার আবার মায়ের চোখের অশ্রু একেবারেই সহ্য হয়না।তাইতো মায়ের মতো সেও ঐ বাড়ির কাওকে দেখতে পারেনা। আরিফ আর কিছু না বলে শক্ত মুখে জায়গা ত্যাগ করে। পেছন থেকে হয়তো মান্নান সাহেবের দুয়েকটা ডাক কানে এসেছে তার কিন্তু আরিফ সেদিকে পাত্তা দেয়নি তেমন।
বৃদ্ধ মান্নান সাহেব ছেলের গমনের দিকে তাকিয়ে রইলেন ঘোলাটে চোখে। ঠোঁটটা কেমন কাপছে বুড়ো মানুষটার।হয়তো অসংখ্য কথা জমে আছে সেই কাঁপতে থাকা ঠোঁটের আগায় কিন্তু শোনার মতো মানুষ না থাকায় হয়তো ব্যক্ত করতে পারছেন না তিনি।তখনি মাথায় বেশ বড়সড় ঘোমটা টেনে সেখানে উপস্থিত হয় পারভিন। আরিফের স্ত্রী। পারভিন শ্বশুরের মনের অবস্থা হয়তো কিছুটা আচ করলো।কেননা বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই সে খেয়াল করেছে, মাঝেমধ্যেই এই একটা বিষয়ে বেশ তর্কাতর্কি লেগে যায় এ বাড়িতে।যদিও পারভীন এই বিষয়ে আধো আধো জানে।কেননা সে-তো আর বাড়ির বউ হয়ে কাওকে তেমন জিজ্ঞেস করতে পারেনা।তারওপর তার শ্বাশুড়ির যেই ত্যাড়া ত্যাড়া কথা।পাছে না আবার দোষ ধরে বসে তার।
পারভীন আড়চোখে একবার শ্বশুরের মলিন হয়ে আসা মুখটার দিকে তাকালো।মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ আব্বা! কি হইছে? মন খারাপ কইরা আছেন যে?”
মান্নান সাহেব একবার চোখ তুলে তাকালেন পুত্রবধূর দিকে।পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তাক করলেন উঠোনের মাঝে।মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ জানো বউ? ঐদিন যদি আমার ছোট ভাই আমারে জেল থেইকা ছাড়ায় আনতো তাইলে আমি হয়তো ঐদিনি মইরা যাইতাম।হয়তো তোমার শ্বাশুড়ি বহুত আগেই আমারে হারায়া বিধবা হইতো।”
কথাটা পুরোপুরি বোধগম্য হলোনা পারভীনের।সে ছোট চোখজোড়া আরও কিছুটা ছোট করে সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ আব্বা! আফনের কথাডা তো বুঝলাম না! ”
এমন একটা পরিস্থিতিতেও আহত হাসলেন মান্নান সাহেব। যেই হাসিটা স্পষ্ট চক্ষুগোচর হলো পারভীনের।সে কেমন উৎসুক হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ আগের বলা কথাটার ব্যাখা শুনতে! মান্নান সাহেব পিঠ হেলিয়ে বসলেন কেদারায়। চোখদুটো আলতো করে বুজে নিয়ে ধরে আসা গলায় বলতে লাগলেন,
“ এলাকার মেম্বরের পোলা আছিলো বিল্লাল।সবাই ওরে বিল্লু কইয়াই চিনতো।পোলাডা বাপের পাওয়ার নিয়া চাঁদাবাজি করতো।একদিন আমি এইডার বিরোধ করি।কিন্তু এক কথায় দুইকথায় বিল্লু’সহ ওর সাঙ্গুপাঙ্গুর লগে আমার হাতাহাতি হয়।হাতাহাতির একপর্যায়ে ওগো দলেরই এক পোলার হাত দিয়া বিল্লুর মাথায় আঘাত লাগে। অবস্থা বেগতিক দেইখা সবাই বিল্লুরে হাসপাতাল নিয়া যায়।আমিও আর তেমন পাত্তা না দিয়া বাইত আয়া পড়ি কিন্তু বিকালের দিকে বাইত পুলিশ আহে আমারে ধইরা নিতে।
আমি কারণ জিগাইলে কইলো, আমি নাকি বিল্লুর মাথা ফাডাইছি।আমি অনেকবার তাগোরে সত্যি কথা কাইছি কিন্তু তারা শুনে নাই।আমারে ধইরা নিয়া যায়। তহন তোমার চাচা শ্বশুর মানে আমার ছোট ভাই খায়রুল আছিলো এলাকার চেয়ারম্যান। ওর শহুরে একটা কাম থাকোনে ওয় ঐদিন বাইত আছিলো না।পরে আমারে যহন জেলে নেওয়া হয় তহন আমি জানবার পারি, আমি যদি জেল থেইকা বাইর হই তাইলে সাথে সাথে বিল্লু আমারে মাইরা লাইবো।কারণ তহন আমার ভাই এলাকায় নাই।
তোমার শ্বাশুড়ি অবশ্য বাজারের টেলিফোন দিয়া খায়রুলেরে সব কইছে কিন্তু খায়রুল হুট কইরা আইতে পারেনাই। তাছাড়া খায়রুলের কানেও কথাডা পৌঁছায় গেছিলো যে ওয় না থাকলে আমারে মাইরা ফেলবো। এল্লেগাই খায়রুল আমার জামিন করায় নাই তৎনগদ।খায়রুল দুইদিন পর আহে বাইত।কিন্ত এর আগেই আমার বড় সম্বন্ধি আমারে জামিনে ছাড়ায় আনে। হের পর থেইকাই তোমার শ্বাশুড়ি ওরে আর ওর পরিবারেরে দেখতে পারেনা। আমি বহুবার ওরে সত্যিডা কইছি কিন্তু ওয় আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। বারবার অপবাদ দিছে— আমি না-কি আমার ভাইয়ের দোষ ঢাকোনের লাইগা মিছা কথা কই।”
থামলেন মান্নান সাহেব। বুক চিড়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে মানুষটার।চোখদুটো দিয়ে কখন যে অবহেলায় কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়েছে তার হয়তো খবর নেই মানুষটার।পাশে দাড়ানো পারভীনও বুঝি থ হয়ে গেছেন।অবশেষে এতদিনে বুঝলেন তার শ্বাশুড়ির রাগের আসল কারণ।
“ রাফু! আম্মা ঔষধ খেয়েছে?”
রান্নাঘরে দক্ষ হাতে খুন্তি নাড়তে ব্যস্ত রাফিয়া বেগম। তক্ষুনি পেছন থেকে ভেসে আসা স্বামীর কন্ঠ কানে আসতেই হাতের কাজ থেকে খানিকটা বিরতি নিয়ে পেছনে ফিরেন তিনি। স্বামীর কথার প্রতিত্তোরে জিভে দাত কেটে বললেন,
“ এইরে! একেবারে ভুলে গিয়েছি। আমি এক্ষুনি দিয়ে আসছি।”
“ না আর যেতে হবে না। আমি দিয়ে আসছি ঔষধ। ”
হাতভর্তি বাসন-কাসন নিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে করতে কথাটা বললেন জুবাইদা বেগম। সাব্বির সাহেব তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এলেন ভাবিকে সাহায্য করতে। হাত বাড়িয়ে কিছু বাসন নিজের হাতে তুলে নিলেন তিনি। তারপর বললেন,
“ এতো ভারি কাজগুলো তুমি করছো কেন বউমনি? তুমি একটু আরাম করে বসো নাহয়।তা বলি কি, আম্মা এখন কি করে বউমনি?”
জুবাইদা বেগম হাত থেকে অবশিষ্ট বাসনগুলো নামিয়ে রাখলেন। কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিয়ে বললেন,
“ আম্মা রোদ আর অনির সাথে আড্ডায় বসেছে।কি জানি কি বিষয় নিয়ে খিলখিল করে হাসছে তিনজন। যা মাতা মেতেছে না! বলার বাইরে! ”
রাফিয়া বেগম এহেন কথায় মৃদু হাসলেন।জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢেলে এগিয়ে দেয় জুবাইদা বেগমের দিকে। জুবাইদা বেগমও মুচকি হেসে নিয়ে নিলেন পানিটা। পুরো গ্লাসের পানিটা একদমে শেষ করে থামলেন তিনি।পাশ থেকে তখন সাব্বির সাহেব বলে ওঠেন,
“ আচ্ছা আমি নাহয় আম্মাকে দেখে আসি।তোমাদের কিছু লাগলে আমাকে বলো কেমন?”
রাফিয়া বেগম মাথা কাত করলেন।সাব্বির সাহেবও প্রস্থান ঘটায় সেখান থেকে। তিনি যেতেই রাফিয়া বেগম বললেন,
“ বাচ্চাটার এখন কি অবস্থা রে জবা? নড়ছে কেমন?”
জুবাইদা বেগম মিহি হেসে আলতো করে ফুলো পেটটায় হাত বুলালেন। বললেন,
“ আর বলিস না! বাচ্চাটা যা দুষ্ট হচ্ছে না! পেটের ভেতর থাকতেই যা শুরু করেছে না জানি বের হলে কি করে! এই দেখ দেখ এখনো কেমন লাথি দিচ্ছে। উঃ”
রাফিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে কান এগিয়ে ধরলেন জুবাইদা বেগমের পেটের কাছে।ভেতর থেকে ছোট্ট জানটার নড়াচড়ার মাত্রা টের পেয়ে উল্লাসীত কন্ঠে বললেন,
“ দেখ জবা! সোনা বাচ্চাটার বুঝি বেরিয়ে আসতে আর তর সইছে না।হয়তো সেও চাচ্ছে তার বড় ফুপ্পির বিয়েটা উপভোগ করতে।”
জুবাইদা বেগম নিঃশব্দে হাসলেন।বলতে লাগলেন,
“ ভালোয় ভালোয় সবটা হয়ে গেলেই হয়রে রাফু।”
“ আরে হাতটা ছাড়ো! কেও দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।বড় ভাইজান এখন বাড়িতেই আছে। তাছাড়া বাড়ি ভর্তি মানুষ। দয়া করে হাতটা ছাড়ো!”
আমরিনের একের পর এক অনুনয়ের পরও তার হাতটা ছাড়লো না শাহানুর।মেয়েটাকে একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে এসে দরজাটা লাগিয়ে দেয় ভেতর দিয়ে। পরক্ষণেই আমরিনের হাতটা চেপে ধরে বলতে লাগলো,
“ কেন করছো বিয়েটা? তুমি তো আমায় ভালোবাসো তাই না? তবুও আমায় ভালোবেসে অন্য একজনকে কিভাবে বিয়ে করছো তুমি আমরিন?”
আমরিন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। তা দেখে শাহানুর অধৈর্য্য হলো।ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ চুপ করে থেকো না আমরিন! আমার কষ্ট হচ্ছে তুমি কি বুঝছো না সেটা?”
আমরিন এবার মুখ তুলে চাইলো। ভিজে ওঠা চোখদুটো তাক করলো শাহানুরের পানে।বললো,
“ বড় ভাইজান হুট করে বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছে। আমি কিছু জানতামও না এ বিষয়ে।যখন আমি জানতে পারি,বিষয়টা ততক্ষণে অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। আমি এখন কি করবো বলো?”
শাহানুর বুঝলো ব্যাপারটা।মেয়েটার গালে আলতো হাত রেখে তার ভিজে ওঠা চোখদুটো মুছে দিলো সযত্নে। নমনীয় কন্ঠে বললো,
“ কেঁদো না আমরিন! যা করার আমি করবো।তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।কি বলো,থাকবে তো?”
আমরিন হয়তো সম্পূর্ণ বিষয়টা ওতো ভালোভাবে বুঝে ওঠেনি।মেয়েটার চোখেমুখে একরাশ জিজ্ঞাসা। শুধু মাথা নাড়িয়ে কোনরকমে সায় জানায় শাহানুরের কথায়।
পরদিন সকালবেলা 🌸
“ ও বড় বউমা! বলি এদিকে একটু আসো তো! আমার বাতের ব্যামোর মলমটা কই রেখেছো গো? খুঁজে পাচ্ছি না যে!”
একের পর এক হাঁক ছোঁড়ায় বেশ ক্লান্ত বৃদ্ধা ফজিলাতুন্নেছা বেগম। কপালে দু-তিনেক ভাজ ফেলে বিরবির করছেন তিনি,
“ এত্তোগুলান ডাক দিলাম! একটাও কি কানে গেলোনা কারো! বুড়া হইছি দেইখা এহন দামও পাইনা!”
“ বউঠান আসমু?”
আমেনা বেগমের ডাকে সেদিকে ফিরলেন বৃদ্ধা।তাকে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে বললেন তিনি,
“ কিরে আবুলের বউ! তোরে কয়বার কইরা কইলাম তুই আমার লগে লগে থাহিস।কিন্তু তা না কইরা তুই খালি বিলে বিলে হাঠস! ”
পৌঢ়ার কথায় মুচকি হাসলেন আমেনা বেগম। তড়িঘড়ি করে এসে পৌঢ়ার বাতের মলমটা এপাশ ওপাশ থেকে খুঁজে আনলেন তিনি।তারপর পৌঢ়ার পায়ের কাছে বসে, পা মালিশ করতে লাগলেন তিনি।
“ আমরিন কই ছোট বউ?”
শ্বাশুড়ির কথায় বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায় রাফিয়া বেগম। বললেন,
“ আম্মা! ওতো নিজের রুমেই আছে বোধহয়। ”
সাথে সাথে মাথা নাড়ালেন পৌঢ়া।
“ না, ওয় ঘরে নাই।আবুলের বউরে দিয়া ছাঁদেও খুজ্জি কিন্তু পাইনাই।কই গেছে মাইয়াডা? ”
রাফিয়া বেগম চিন্তিত হলেন এহেন কথায়। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলবেন তার আগেই পেছন থেকে জুবাইদা বেগম বলে ওঠেন,
“ আম্মা! আমার মনে হয় আমরিন পাশের বাড়িতে গিয়েছে। এক্ষুনি এসে যাবে।আপনি ওতো চিন্তা করবেন না। ”
“ চিন্তা কি সাধে হয় বড় বউমা! মাইয়াডার আইজ বিয়া অথচ এখনও কেমন ধেইধেই করে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুইরা বেড়ায়।লোকে দেখলে কি কইবো হেই খেয়াল আছে? ”
শ্বাশুড়ির কথার পিঠে আর কি বলবেন, খুঁজে পেলেন না দু-বউ। চুপ করে দাড়িয়ে রইলেন তারা।ঠিক তখনি বাড়ির উঠোন জুড়ে চেচামেচির শুরু হয়।জুবাইদা বেগম, রাফিয়া বেগম একে-অপরের দিকে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ছুটে আসেন বাড়ির উঠোনে।
“ কোথায় ছিলি তুই? সেই সকাল থেকে তোকে পুরো বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি অথচ তোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ”
সাব্বির সাহেবের এহেন কথার প্রতিত্তোরে মৌন রইলো আমরিন।মাথানিচু করে দাড়িয়ে আছে সে।তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে কবির সাহেবের শান্ত অথচ গম্ভীর গলা!
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ১৭
“ বোরকা পড়ে কোথায় গিয়েছিলি তুই? আর শাহানুর তুই ওর হাত ধরে আছিস কেন?”
শাহানুর একটা শুকনো ফাঁকা ঢোক গিললো। মাথা খানিকটা উঁচু করে আমরিনের হাতটা আরেকটু শক্ত করে হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।বললো,
“ আমি ওকে বিয়ে করেছি কবির ভাই।আমি ওকে ভালোবাসি!”