প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১৮
জান্নাত নুসরাত
দেখতে দেখতে ১৫ দিন কেটে গেল। নুসরাত আর ইসরাতের বাসায় ফিরার নাম গন্ধ নেই। নাছির সাহেব এবার কিছুটা চিন্তিত। এতোদিন হয়ে গেল বাসায় ফিরে আসছে না কেন? নাজমিন বেগমকে যখন জিজ্ঞেস করলেন কখন ফিরে আসবে নুসরাত আর ইসরাত। নাজমিন বেগমের চোখ জলে ছলছল করে উঠলো। ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছলেন।
” দরদ এখন উতলে পরছে কেন? যখন আমার মেয়ে গুলোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে তখন এই দরদ কোথায় ছিল?
“আরে,আমি কখন তাড়িয়ে দিলাম। আর দরদ কেন উতলে পড়বে?
” তুমিই তাড়িয়ে দিয়েছ। আমার মেয়েগুলো সামান্য কথাই তো বলেছিল। ওদের কথায় কি ভুল ছিল? সব তো উচিত কথা বলেছে। আর তুমি কি করলে? সবার সামনে আমার বাচ্চা মেয়েগুলোকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বললে। সেইতো না করে দিতে! তাহলে ওরা না করায় তোমাদের জাত চলে গিয়েছে।
“আমি কখন বললাম বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য,আমি শুধু বলেছি আমার সামনে না পরার জন্য। তুমিই তো ওদের তোমার বোনের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে। আমার পারমিশন নিয়েছিলে। আর আমরা না করলে বসে নিজেদের মধ্যে কথাবলে সব ঠিকঠাক রেখে না করতাম।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” সেদিন কি বলেছিলে মনে আছে? বলেছিলে আমার মেয়ে গুলোকে একটু মেয়ে মানুষের মতো আচরণ শিখাতে। তাই আমার মেয়েদের বিষয়ে তোমার নাক গলানো আমি সহ্য করবো না। আমার মেয়ে যখন তখন আমার যা ইচ্ছা আমার মেয়েদের সাথে তা করবো। তোমার কোনো পারমিশন নেওয়ার আমি প্রয়োজন মনে করি না।
“আমি কখন বললাম এটা। আমি তো এসব বলিনি।
” তুমিই বলেছ! এখন কথা পাল্টাবে না। এই জন্যই তো আমি আপার বাসায় ওদের পাঠিয়েছি। এখন তুমি মিথ্যা বলছো। মিথ্যাবাদী লোক।
নাজমিন বেগম কথা বলতে বলতে কান্না করে দিলেন। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
রেস্টুরেন্টে সবচেয়ে ভিতরের টেবিল বুক করেছে নাহিদ। ইসরাত, নুসরাত আর মমো সেখানে বসে আছে। নাহিদ চার প্লেট বিরিয়ানি ওডার দিয়ে এসে টেবিল টেনে ইসরাতের কাছে বসে গেল। মমো আর নুসরাত নিজেদের মধ্যে ফুসুর ফুসুর করছে। ফুসুর ফুসুর শেষে দু-জন সোজা হয়ে বসল।
নুসরাত কথা বলা শুরু করলো তাদের মধ্যের নীরবতা ভেঙে।
“আরে নাঈমের বাচ্চাকে এতো করে বললাম জিমে ভর্তি হওয়ার জন্য শালা ভর্তিই হচ্ছে না। দেখবি মোটা হতে হতে কোনদিন ফেটে যাবে।
মমো বলল,
” আমার চিন্তা তো আরেকটা।
ইসরাত বলল,
“কি?
” নাঈম ভাইয়া যখন…..
কথা পুরো না করে হাসতে শুরু করল মমো। নুসরাত হালকা থাপ্পড় মেরে বলল,”হে হে করা বন্ধ করে কথা শেষ কর!
মমো কথা বলতে গেলেই মেয়েটা হেসে দেয়। নুসরাত আর ইসরাত মমোর হাসি দেখে তারা ও ফিক করে হেসে দিল। নাহিদ হ্যাবলা কান্তের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মমো হাসি থামিয়ে বলল,
” নাঈম ভাইয়ার বউ যদি রোগা হয়। আর নাঈম ভাইয়া এইরকম মোটা থেকে যায় তাহলে উনার বউয়ের কি হবে?
ইসরাত বলল,
“বুঝতে পারছি না। খুলে বল!
মমো বলল,
” নাঈম ভাইয়া যদি উনার বউয়ের উপর হাত পা তুলে দেয় তাহলে কি হবে? বেচারি তো ওখানেই মারা যাবে।
ইসরাত বলল,
“তুই আরো কিছু বলতে গিয়েছিলি? কথা ঘুরিয়েছিস!
মমো বলল,
” না না আমি কথা ঘুরাইনি।
ইসরাত জোর করলো না। একজন মানুষ যখন বলতে চাইছে না থাকে জোর করার কি দরকার? অর্ডার আসতে আরো ২০ মিনিট সময় লাগবে তাই ইসরাত মোবাইল স্ক্রল করতে শুরু করলো।
নুসরাত মমোকে জিজ্ঞেস করল,
“তখন কি বলতে গিয়েছিলি?
মমো বলল,
” কাছে আয়! এটা সিক্রেট। কানেকানে বলি।
মমো নুসরাতের কানে কানে কিছু বলতেই নুসরাতের মুখ হা হয়ে গেল। নুসরাত মাথা দু-দিকে ঝাঁকিয়ে বলল,”সত্যি তো, এটা চিন্তা করে দেখিনি!
অর্ডার আসার পর সবাই খেতে ব্যস্ত হলো। খাবার খাওয়ার মাঝখানে নুসরাতের চোখ একবার দরজার দিকে গেল। চোখ ফিরিয়ে এনে আবার তড়াক করে মেইন ডোরের দিকে নুসরাত তাকালো। রেস্টুরেন্টে আরশ আর সাথে সুন্দরী একটা মেয়ে প্রবেশ করছে।
নুসরাত আরশের সাথে সুন্দরী একটা মেয়েকে দেখে সতর্ক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালো। ইসরাত কে ফিসফিস করে ডাক দিল,”এই ইসরাত!
” কি?
নুসরাত হাত দ্বারা আস্তে কথা বলতে বুঝালো। ইসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে নুসরাতের দিকে তাকালো। নুসরাত বলল, “সামনের টেবিলে তাকা?
ইসরাত ভ্রু কুঁচকে সামনের টেবিলে তাকালো। মনে করলো নুসরাত এমনি এমনি ওভার একটিং করছে। সামনে তাকিয়ে ইসরাতের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
” আমি যা দেখছি মমো তুই কি তা দেখছিস?
মমো বলল,
“কি দেখব?
ইসরাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা মেয়েকে নিয়ে সামনের টেবিলে আরশ বসে আছে। নুসরাত মোবাইল বের করে আরশ আর মেয়েটার ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
মমো নুসরাতের কান্ড দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” এই কি করছিস?
নুসরাত কিছুটা বিরক্ত হলো মমোর কথায়। দেখতে যখন পাচ্ছে ছবি তুলছে তারপর কেন জিজ্ঞেস করে কি করছে?
“দেখতে পাচ্ছিস না ছবি তুলছি।
” সেটা তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, ছবি দিয়ে কি করবি?
“আরে এসব প্রমাণ। বুঝো না মনু, দুধু খাও!
” ছে্হ,কী সব লেঙ্গুয়েজ ইউজ করিস তুই নুসরাত?
“একদম নাক ছিটকাবি না ইসরাত। আসছে আমার শুদ্ধ মুরগী।
নুসরাত জোম করে আরো দু-তিনটে ছবি তুলল আরশের। যাতে বুঝা যায় দুজনের মুখ।
ইসরাত বলল,
” ভাইয়া এখানে কেন? সিলেটে কি রেস্টুরেন্টে অভাব পরছে। যে এতো দূরে আসলো।
নুসরাত বলল,
“আরে প্রেমিকা কে নিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছ না। অফিসের আশেপাশে গেলে তো আব্বা, আব্বু, উনার অফিসের কর্মচারীরা দেখতে পেত। তাই এতো দূরে আসছে যাতে কেউ দেখতে না পারে।
ইসরাত বলল,
” না জেনে কথা বলবি না নুসরাত।
নুসরাত বলল,
“আমি জেনেই কথা বলছি। দেখ, কি হেসে হেসে কথা বলছে? আমার সাথে যখন কথা বলে তখন মুখ দিয়ে করলা বের হয়। আর এখন কি মুচকি মুচকি হাসি? হাসি সরছে না মুখ থেকে। আহা,কি হাসি? মানুষের কত রঙ যে দেখব?
মমো বলল,
” আল্লাহর ওয়াস্তে তোর মুখ বন্ধ কর বইন।
নুসরাত বলল,
“আমি কি বেশি কথা বলি? যে, তুই আমাকে বললি মুখ বন্ধ করার কথা। তুই এভাবে বলতে পারলি মমো।
নাহিদ বলল,
” না বইন তুই একটু ও বেশি কথা বলিস না। খুশি এবার মুখ বন্ধ কর বইন আমার। কানের পোকা সবগুলো বের করে দিলি।
নুসরাত বলল,
” তাহলে তো ভালোই হয়েছে। তোর কানের ভিতর থেকে সব পোকা বের হয়ে চলে যাবে। আমাকে ধন্যবাদ বল। আমি কথা বলে তোর কানের পোকা বের করে দিয়েছি।
ইসরাত বলল,
“চুপ একদম চুপ। আর একটা কথা না। এবার আওয়াজ বের হলে কস্টেপ করে দিব মুখ। নাহলে এখানে রেখে চলে যাব।
নুসরাত বলল,
” কিন্তু,
ইসরাত ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ দেখালো। নুসরাত মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। সামান্যই তো কথা বলছে আর তো কিছু করছে না। বিল পে করে সবাই রেস্টুরেন্ট বের হয়ে গেল। মমো একটা সি এন জি ভাড়া করে জিন্দাবাজারের দিকে চলে গেল। আর নুসরাত আর ইসরাতেরা উপশহর যাওয়ার জন্য সি এন জি খুঁজতে লাগলো।
” নাহিদের সাথে নুসরাতের আর নাঈমের সাথে ইসরাতের বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হবে? দু-বোন দু ভাইয়ের বউ।
আকস্মিক কোনো কারণ ছাড়া এসব কথা লাবণ্যকে বলতে দেখে ইসরাত বিরক্ত হলো। লাবণ্যের কথা ইগনোর করতে চাইলো। কিন্তু লাবণ্য আবার বলল,” আর তোমাদের খালা তোমাদের শাশুড়ী হয়ে যাবে।
নাহিদ বিরক্ত হয়ে বলল,
“এটা আমার ছোট বোন। আমি ছোট বোনের চোখে দেখি তাই না বইনা।
” এসব কিছু হয় না। বোন ভাব আর যাই ভাব। বিয়ে হলে এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
নুসরাত তিক্ত বিরক্ত গলায় বলল,
আপু এক কাজ করেন নাঈমকে বিয়ে করে নিন।আমি আন্টিকে বলে নাঈমের সাথে আপনার একটা ব্যবস্থা করে দিব।
লাবণ্য বলল,
ও আমার বয়সে ছোট। কী সব বল তুমি?
” তো কি হয়েছে। নাঈম বয়সে বড় মেয়ে বিয়ে করা সুন্নত। নাঈম সুন্নত কাজ করে ফেলবে। ওর ও নেকি সাথে তোমার ও নেকি হবে।
“আরে কী সব বল তুমি নুসরাত? এসব হবে না!
” হবে না কেন? হান্ডেন্ট এন্ড টেন পার্সেন্ট হতে পারে।
“এটা জীবনে ও হবে না।
নাহিদ লাবণ্যের উপর বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল নিজের রুমে। ইসরাত কাপড় চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশরুমে গেল। আর নুসরাত ফেবু স্ক্রল করতে শুরু করলো। লাবণ্য তাদের বিজি হতে দেখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
নাজু বেগমের বাড়ি হঠাৎ করে নাছির সাহেব এসে হাজির। নাছির সাহেবকে হঠাৎ আসতে দেখে নাজু বেগম বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। কি খাওয়াবেন না খাওয়াবেন ওইসবি নিয়ে চিন্তিত হলেন? নাছির সাহেব বললেন তিনি কিছু খাবেন না। অনেক জরুরি কাজ রেখে এসেছেন ইসরাত আর নুসরাতকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
” এটা কীভাবে সম্ভব? ওরা আমার এখানে আরো এক সপ্তাহ থেকে তারপর যাবে। এখন তো আমি দিতে পারবো না ওদের।
” অনেকদিন তো থাকলো, পরে এসে থাকবে। এখন নিয়ে যাই। আর মাত্র দু-সপ্তাহ পর ইসরাতের সেমিস্টার। সেই তো যাওয়া লাগবে তো এখন গেলে কী হবে? আজ যাবে কাল যাবে একই কথা।
নাজু বেগম রাজি হয়ে গেলেন। তিনি আর কি বলবেন? অন্যের সন্তানের উপর তার তো আর জোর চলে না। নাজু বেগম ইসরাতকে বললেন লাগেজ গুছানোর জন্য আজকে তারা ব্যাক করবে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নাছির সাহেবেরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। লাবণ্য আবার আসার জন্য বলল! তারা নীরবে মাথা নাড়লো। যার মানে শীগ্রই আসবে বেড়াতে।
সৈয়দ বাড়িতে ফিরে আসার পর নুসরাত দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। ইসরাত গাড়ি থেকে লাগেজ টেনে নিয়ে আসার সময় জায়িনের সাথে দেখা হলো। ইসরাত জায়িনের পাশ চুপচাপ কাটাতে চাইলে জায়িনের গা জ্বালানো কথা শুনে ইসরাতের মাথা একশত আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে গরম হয়ে গেল।
“এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলে আরো দু একদিন থাকতে।
” আপনার কোনো সমস্যা! আমি তাড়াতাড়ি চলে আসায়। আমি আসায় কি আপনার খাবারে ভাগ কম পরবে নাকি আমি আপনার খাবারের প্লেট টান দিয়ে নিয়ে নিব? কি সমস্যা কি?
“আমার কেন সমস্যা হতে যাবে তুমি আসায়? আর আমার খাবারের ভাগ কেন কম পরবে? তোমাকে দেখছি কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। ইসরাত তুমি ওভার রিয়েক্ট করছো।
” কথায় তো তাই মনে হচ্ছে। আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে আপনাকে কে বলেছে? আমি বাড়িতে ফিরে আসছি তা আপনার সহ্য হচ্ছে না, আসল কথাতো এইটাই। আমার বাড়ি আমি ফিরে আসবো না!
” আমি একটা সিম্পল কথা তোমাকে বলেছি আর তুমি এটাকে তাল থেকে তিল বানিয়ে দিলে। একটা সিম্পল কথা সিম্পল ভাবে উত্তর দিলেই তো হয়। ঝগড়া করছো কেন?
“আপনি কি আমাকে এক্ষুনি ঝগড়ুটে বলে গালি দিলেন।
জায়িন নিজের চুল টেনে ধরল। কপালের উপর থেকে চুলগুলো টেনে সরালো। ও কখন ঝগড়ুটে বলে গালি দিল। এই মেয়ে তো মহা ঝগড়ুটে।
” আমি কখন তোমাকে ঝগড়ুটে বললাম।
“তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি মিথ্যা বলছি।
নিজের দিকে আঙুল তুলে ইসরাত বলল,
” আমি মিথ্যাবাদী!এতো বড় সাহস আপনাকে কে দিল? আপনি আমাকে মিথ্যাবাদী বলছেন।
“আরে তুমি এক কথার আরেক মিনিং কেন বের করছো?
” আপনি ডাবল মিনিং কথা বলবেন আর আমি তার প্রতিবাদ করবো না।
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ১৭
কী জ্বালায় পরলাম রে বাবা? কোন দুঃখে একে এই প্রশ্ন করতে গিয়েছিলাম। আল্লাহ মাফ করো। জায়িন ইসরাতের কথার উত্তর না পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ইসরাত রাগে ফুসতে লাগলো। তাকে ইগনোর এতো বড় সাহস এই জায়িইন্নার বাচ্চার। নুসরাতকে বলে একে একটা শিক্ষা দিতে হবে। শালা খবিস!