বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪২

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪২
ইশরাত জাহান

ফজরের আযান শুনতে পেয়েই শোভা শান্তভাবে উঠে বসে।ওযু করে নামাজ শেষ করল।পর্দার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঘরে ঢুকছে।দর্শন তখনও বিছানায় ঢলে পড়ে আছে।শ্বাস প্রশ্বাস ভারী,যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
শোভা সুযোগ বুঝে নিঃশব্দে পা বাড়াতেই হঠাৎ একটা শক্ত হাত তার কব্জি আঁকড়ে ধরে।শরীর কেঁপে ওঠে শোভার।ঘুরে তাকাতেই দর্শনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,আধখোলা চোখে যেন শিকারি নেকড়ের মত তাকিয়ে আছে।রাগী গম্ভীর কন্ঠে বলে,“আমাকে ফাঁকি দেবে ভেবেছিলে,ওয়াইফি?”

দর্শনের কণ্ঠ ভারী।শোভা ভয়ে জমে যায়।কাপা কাপা কণ্ঠে বলে,“আমি…আমি তো শুধু বাইরে যাচ্ছিলাম।”
দর্শন ধীরে ধীরে উঠে বসে।হাতের চাপ আরও শক্ত করে।মুখটা শোভার এত কাছে আনে যে নিঃশ্বাসে গরম স্পর্শ লাগে শোভার মুখোশ্রীতে।তার চোখে অদ্ভুত এক দহন,রাগ,অধিকার আর আসক্তির মিশেল।
রাগে হিসহিস করে বলে,“তুমি কোথাও যাবে না। আমার অনুমতি ছাড়া একটা পা-ও এগোবে না।”
ধীর কণ্ঠে কথাটুকু বলে এবার ধমকে চিৎকার করে বলে,“বুঝেছো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শোভা কেঁপে উঠলো।চোখ বেয়ে পানি।কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,“ছেড়ে দিন আমার হাত।এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?”
দর্শনের ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি ফুটল।যেন নিষ্ঠুর আনন্দ লুকিয়ে আছে সেখানে।সে শোভাকে হঠাৎ নিজের দিকে টেনে নিল।অবুঝ জেদে,পাগলাটে আকর্ষণে বলে,“তোমাকে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছে নয়,ওয়াইফি। কিন্তু তুমি যদি আমার থেকে পালাতে চাও,তখন আমি নিজেকেই সামলাতে পারি না।হয়তো অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলব তখন।”
দর্শনের কণ্ঠে এক অদ্ভুত মায়া,যেন হুমকি আর টান একইসাথে গেঁথে আছে।শোভা আর প্রতিবাদ করতে পারল না।তার চোখে শুধু সেই আগুনঝরা দৃষ্টি ভেসে উঠল।চারপাশ নিস্তব্ধ,অথচ জানালা দিয়ে আসা বাতাসে অজানা এক শিহরণ ছড়িয়ে গেল।হাতে টান লাগায় শোভা হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই দর্শনের চোখ হঠাৎ লালচে দ্যুতিতে চকচক করে উঠল।সে আর শান্ত নেই।আঁকড়ে ধরা হাতের চাপ এতটাই বাড়িয়ে দিল যে শোভার নিশ্বাস আটকে আসতে লাগল।

দর্শন তেজ দেখিয়ে বলে,“তুমি আমার কাছে মিথ্যে বলেছো।তাই না ওয়াইফি?”
দর্শনের কণ্ঠে ছিল হিংস্র মানবের সুর।শোভা আতঙ্কিত গলায় শুকনো ঢোক গিলে বলে,“আমি শুধু একটু বাইরে যাচ্ছিলাম।”
দর্শন হঠাৎ হেসে উঠল।ভয়ংকর এক হাসি।তার ঠোঁট শোভার কানে গিয়ে ছুঁয়ে গেল।কণ্ঠস্বর এত ধীরে,এত কাছে যে শোভার শরীর শিরশির করে উঠল।
ফিসফিস করে বলে,“তুমি ভাবছো আমি ঘুমাচ্ছিলাম?উহু।তোমার প্রতিটা নড়াচড়া আমি শুনেছি।তুমি নিঃশ্বাস ফেলার আগেই আমি টের পাই।”

শোভা চমকে ওঠে।গা শিউরে উঠছে নিশ্বাসের ভারে।দর্শন আচমকা শোভাকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। চোখে ছিল শিকারির নেশা।হিংস্র হয়ে শোভার গালে নিজের নাক ঘষে বলে,“তুমি যদি আবার আমার চোখ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো বিশ্বাস করো ওয়াইফি, আমি তোমাকে এমনভাবে বন্দী রাখব যে তুমি আর কোনোদিন বাইরের আলোও দেখতে পারবে না।”

শোভার শরীর কেঁপে ওঠে।কিন্তু সেই আতঙ্কের ভেতরেও তার বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি ছড়িয়ে যায়।ভয়,ঘৃণা,আবার অদ্ভুত এক টান।দর্শনের দৃষ্টি থেকে চোখ সরাতে পারছিল না সে।
দর্শন তার চিবুক আঙুল দিয়ে উঁচু করে দিল,শীতল স্বরে বলে,“তুমি একান্তই আমার।ভোরের আলো যেমন আকাশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না,তেমনি তুমিও আমায় ছাড়া কোথাও যেতে পারবে না।তুমি যতই পালাও,আমি তোমাকে খুঁজে নেব।”

শোভা বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কথা বলার শক্তি নেই তার মধ্যে।দর্শনের এই ভয়ানক রূপ দেখে কথা হারিয়ে ফেলছে যেনো।শোভা কেঁপে কেঁপে দাঁড়িয়ে আছে।দর্শনের চোখে তখন শুধু অন্তহীন পাগলামি।
হঠাৎ সে শোভার হাত আরও শক্ত করে ধরে।কুকড়ে ওঠে শোভা।শোভাকে বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে দর্শন।শোভার বুক ভেঙে কেঁপে ওঠে।
শোভার সামনে দড়ি নিয়ে মুখে হিংস্র হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এসে বলে,“বেঁধে রাখছি যেন আর পালাতে না পারো।”
শোভা কেঁপে উঠে বলে,“না…. বাঁধবেন না আমাকে।”

শুনল না দর্শন।শোভার হাত-পা বেঁধে রাখল।শোভার চোখে ভয় আর অভিমান দুইই মিশে আছে।
দর্শন জানালার লক টানল।ঘরের লাইট নিভিয়ে দিল। চারপাশে অন্ধকার নেমে এলো অথচ দর্শনের উপস্থিতি ও ভারী নিশ্বাসকে ঘরকে আরও হিম করে দিচ্ছে।শোভার মুখের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করল,“আমার থেকে পালানোর শাস্তি এটাই তোমার।মাথায় রাখবে যেটা আমার জন্য একবার ফিক্সড হয়ে যায়,সেটা চিরকালের জন্য আমারই থাকে।
শোভার চোখে অশ্রু জড়ো হয়ে চলে আসল।সে কান্না করতে করতে বিছানায় শুয়ে পড়ল।দর্শন দরজাটা জোরে লাগিয়ে ঘরের বাইরে হেঁটে চলে গেল।

অন্ধকার ঘরে শোভা ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে।মেয়েটার অন্ধকারে ভীষণ ভয় করে।দর্শন তাকে সেই শাস্তিটাই দিলো।শোভার হাত-পা বেঁধে রাখা না হলে এতক্ষণে পালিয়ে যেত।এখন তো সে পালাতেও পারবে না।মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।ডুকরে কান্না করে দেয়।কিভাবে নিজেকে উদ্ধার করবে এটাই ভাবছে।শোভার ভাবনার মাঝেই দরজায় মরমর শব্দ করে ওঠে।ভয় পায় শোভা।এই তো গেলো দর্শন।মিনিট ত্রিশের মধ্যে আবার ফিরে এলো কেন?
দর্শন ঘরে প্রবেশ করল।হাতে প্লেট।সেখানে ছিল একটা গরম রুটি আর সঙ্গে সিদ্ধ সবজি।বাইরের দেশে থাকতে দর্শন রুটি ও তেল মশলা ছাড়া সিদ্ধ সবজি খেয়েই সকালটা পার করতো।এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাবে।ধীরে ধীরে শোভার সামনে এসে প্লেট এগিয়ে দিল।

শোভা মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,“হাত না খুললে খাবো কিভাবে?”
দর্শন মৃদু হেসে তাকালো।যেনো ধরতে পারল শোভার ছল-চাতুরী।স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,“আমি তো আছি,তাই না?”
হাসি দিয়ে দর্শন বসলো শোভার পাশে।শোভা সরে গেলো।দর্শন এক টুকরো রুটি তুলে শোভার মুখের কাছে ধরল।শোভা ঠোঁট আঁকড়ে ধরে বলে,“আমি নিজের হাতে খাবো।”
“আমার হাতেই খেতে হবে তোমাকে।”
“তাহলে আমি খাবোই না।”
দর্শন কণ্ঠে হালকা ধমক মিশিয়ে বলল,“কাল থেকে কিছুই খাওনি।এখন খাও নাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে।আমি একটু পর অফিসে যাবো।”

শোভা একটা কথাও বলল না আর।চুপ করে অন্যদিকে ফিরে আছে।মনস্থির খাবেই না সে।
দর্শন এবার বিরক্ত সাথে অধৈর্য হয়ে হুমকি দেয়,“চুপচাপ খেয়ে নেও!না খেলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
শোভা কেঁপে উঠল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে হা করে।দর্শন রুটি এবং সবজি এক এক করে তার মুখে তুলে দিল।শোভা কিছুটা বিরক্ত,কিছুটা ভয়ানক উত্তেজনার মধ্যে আছে।তার শরীর কাঁপছে,কিন্তু আর কিছু বলছে না।
হঠাৎই সে ইচ্ছে করে দর্শনের আঙুলে কামড়ে দিল। দর্শন চমকে গেল কিন্তু চোখে অদ্ভুত হাসি।হিংস্রতা আর টান একসাথে ফুটে উঠল।তারপর সে আবার ধীরে ধীরে প্লেট থেকে সবজি তুলে শোভার মুখে তুলে দিল।শোভা আবারও খাবার নিয়ে কামড়ে দেয় দর্শনের আঙুলে।দর্শন নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে কামড়গুলো।যেনো কামড় খেয়ে হলেও বউকে নিজের কাছে রাখতে চায় সে।

শোভার খাওয়া শেষ হতেই দর্শন দেখলো শোভার ঠোঁটের কোণায় খাবার লেগে আছে।রুমাল দিয়ে শোভার ঠোঁট মুছে দেয়।সেখানে টুক করে চুমু দিল দর্শন।শোভা চমকে উঠলো।মিনমিন করে বলে,“এবার তো হাতটা খুলে দিন।”
দর্শন ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলে,“নো ওয়াইফি,ইউ হ্যাভ টু সাফার অল দ্যা ডে।”
শোভা মুখটা ঘুরিয়ে বলে,“জানালা তো খুলে রাখুন।”
“উহু,তোমাকে বুঝতে হবে আমার থেকে পালানোর শাস্তি কি।”
বলেই দর্শন চলে গেলো।আসবে রাতের দিকে।কারণ সে যেখানে যাচ্ছে এখান থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার রাস্তা ওটা।ওখানেই আজ মিটিং আছে তার।শোভা হতাশ হয়ে বসে রইল।
ক্ষিপ্ত নয়নে হলরুমে বসে আছে দাদাজান।দর্শনকে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছেন দীপ্ত ফরাজি।দর্শনের ধরার নাম নেই।দাদাজান অতিষ্ঠ হয়ে বলেন,“ধরবে না ধরবে না।ওই ছোকরা ধরবে না এই কল।বউকে ডাকাতি করে নিয়ে গেছে না।আসামি কি আর ধরা দেয় নিজেকে?”

দীপ্ত ফরাজি বিরক্তির সাথে বলেন, “আহা!এত চিন্তা করছো কেন?বউকেই তো নিয়ে গেছে।”
দাদাজান চোখটা বড় বড় করে বলেন,“বউকে নিয়ে যায়নি বউকে কিডন্যাপ করেছে।ডাকাতি করেছে তোমার ছেলে।যাকে রীতিমত বলে বউ ডাকাতি।ছিনতাইকারী একটা।বউ ছিনতাই করে বেড়ায়।”
পারুল বেগম দুশ্চিন্তার মাঝেও মুখে কাপড় দিয়ে হাসলেন। দিজা বলে ওঠে,“ভাইয়া বউকে নিয়ে যাবে এটা তো স্বাভাবিক।”
দাদাজান ফোস করে উঠে বলেন,“ভদ্রলোকের মত নিয়ে যেতে পারেনি?শ্বশুরবাড়িতে ডাকাতি করার কি দরকার?”
দীপ্ত ফরাজি কপাল চাপড়ে বলেন,“ছেলেটার রাগ বেশি।”
দাদাজান সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বলেন,“এখন তো দেখি রাগের সাথে পীড়িত উতলায় বেশি বেশি।”

“আব্বাজান!আশেপাশে ছেলেমেয়ে আছে তো।”
“তো!তোমার ছেলে বউকে ডাকাতি করে নিয়ে যাবে আর আমি বললেই দোষ!”
“ওরা কি শিখবে এসব শুনলে?”
“ওরা আমার একার কথাতে কিচ্ছু শিখবে না।নিজের ডাকাত ভাইকে দেখেই শিখবে সব।”
দীপ্ত ফরাজি এবার দিজার দিকে ফিরে বলেন,“তোর ভর্তি ডেট কবে?”
দিজা মেইল দেখে বলে,“পরশুদিন।”
দাদাজান তড়িৎ বলে ওঠে,“কালকে যাবো আমরা যশোর।”
দীপ্ত ফরাজি জিজ্ঞাসা করলেন,“কে কে যাবে?”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪১

দাদাজান জানান,“কেউ না গেলেও আমি যাচ্ছি।আর যাই হোক মেয়েটার একটা দায়িত্ব আছে আমাদের কাঁধে।নিজেদের ছেলের জন্য বাড়ির বউকে অবহেলা করা যায়না অন্তত।”
দীপ্ত ফরাজি শান্তির নিশ্বাস নিতে পারলেন না।ছেলে আজকে রেগে থাকলেও কালকে ঠিক ঠান্ডা হয়ে যাবে।শোভার উপর এতটাও চড়াও হবে না যতটা বাকিদের উপর হয়।এখন দাদাজান গিয়ে কি কান্ড ঘটায় এটাই ভাবছেন।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here