বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৭

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৭
ইশরাত জাহান

বাজার করে দিদার বাড়িতে এসে দিজার উদ্দেশে বলে,“ভাইয়া বলেছে গেস্টরুম পরিষ্কার করে দিতে।হেল্পিং হ্যান্ড কাল থেকে আসবে।”
দিজা বাজারের ব্যাগ ধরে বিরক্তির সাথে বলে,“তুই গিয়ে পরিষ্কার কর।আমি এখন রান্নাঘরে ব্যাস্ত।আমার ঘরটাও তো এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ।ওটাও পরিষ্কার করতে হবে।তোর থাকার জন্য ঘর তুই পরিস্কার কর।”
দিদার রাগ দেখিয়ে বলে,“বেয়াদব!বড় ভাইকে হুকুম করতে লজ্জা করে না?”
“না,করে না লজ্জা।সর তো সামনে থেকে।কাজের মধ্যে বাম হাত ঢোকাতে আসে।”
“থাপড়ে মুখ বেকিয়ে দিবো,বেয়াদব মেয়ে একটা।”
“কত বড় সাহস!আমাকে থাপড়াবি আর আমি চুপ থাকবো?

“কি করবি শুনি?”
“উস্টা মারবো একদম।”
“মুখ সামলে কথা বল দিজা।”
“তুই চুপ থাক।আমাকে তেজ দেখাতে আসে।”
দিদার এবার দাদাজানকে ডেকে বলে,“তোমার নাতনি কিন্তু আমার কাছে মাইর খাবে,দাদাজান।”
দিজাও বলে ওঠে,“এই আপোদটাকে আনতে গেলে কেন দাদাজান?এখন আমার এক কাজের মধ্যে আরেক কাজ করতে বলে।নিজের নেই গুণ আবার করে হুকুম!”
দিদার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলে,“তোমার নাতনির কিন্তু চোপা বেরিয়েছে।বড় ছোট মানে না।এটাকে কিন্তু এক আছাড় মেরে ওপারে পাঠিয়ে দিব।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“হ্যাঁ, আর আমার বাবা মা চেয়ে চেয়ে দেখবে?তোকে জেলের ভাত খাওয়াবে।”
“ওটা আমারও বাবা মা।এক সন্তান গেলে বাকিদের উপর দয়া মায়া করে কাছেই রেখে দিবে।”
দিজা হা হয়ে গেলো।শোভা ভিতর থেকে শুনে মুখে হাত দিয়ে দেখছে।ও কখনও শামীমের সাথে ঝগড়া করেনি।এমনকি শামীম ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি।একেক ভাইবোনদের একেক ভাবে ভালোবাসা থাকে।শোভা এগুলোর সাথে পরিচিত।দাদাজান এসে দেখেছেন তার নাতি নাতনি দুজনে চুল টানাটানি শুরু করেছে।কপাল চাপড়ে বলেন,“এভাবে চললে দুপুরে না খেয়ে থাকতে হবে।দাদুভাই যাও ঘরটা তুমি পরিষ্কার করবে। দাদুমণি তো রান্না করবে।”
দিদার বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,“এসে ধরেই তো একেকটা কাজের উপর আছি।”
“আমরা বুঝি হাত পা গুটিয়ে বসে আছি?”

বলেই ফুলঝাড়ু আর বেলচা ধরিয়ে দিলো দিদারের হাতে।দিদার বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে চলে যাচ্ছে।সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবার পিছনে ফিরে ধমকে বলে,“বালতিতে পানি কি তোর বাপ দিয়ে যাবে?”
দিজা রান্নাঘরে যেতে নিয়েও থেমে পিছন ফিরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে,“না,তোর বাপের মেয়ে দিবে।”
“বেয়াদব!”
“তোর বাপের মেয়ে তাই এমন।”
বলেই দিজা চলে গেলো ভিতরে।বালতিতে পানি নিয়ে দিয়ে আসলো।শোভা মশলা বেটে রাখে। দিজা আসতেই শোভা বলে,“বড় ভাইয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে হয়না।”
দিজা শান্ত হয়ে বলে,“সব বড় ভাই আর ওই বড় ভাই এক না।”
একটু নীরবতা পালন করে দিজা ও শোভা কাজ করতে থাকে।হঠাৎ বলে ওঠে,“আচ্ছা ভাবী তোমার কি হয়েছে?”
“কোথায়?”

“ভাইয়া বলছিল তোমার শরীর ভালো নেই।”
“ওহ,আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে।”
“আচ্ছা…এই ব্যাপার!দাদাজান এই ব্যাপারটা উল্টো করে মিষ্টি আনালো।”
শোভা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, “মানে?”
“কিছু না,তোমাকে এতকিছু করতে হবে না।আমি রান্না করছি।”
“আমি পারবো।”
“আরে রাখো তো।তুমি সুস্থ হলে সংসারের হাল ধরে রেখো।আমি আছি যতদিন একটু সাহায্য করি।”
“যতদিন আছো মানে?”
“বা রে!আমি কি চিরকাল এই সংসারে পড়ে থাকবো?ভাই ভাবীর সংসারে ননদ বেশিদিন মানায় না।”
“কোথায় যাবে তুমি?”

দাদাজান বারান্দায় বসা আছেন।তিনি জানান,“ননদের বিয়ে দিতে হবে তো।সেই ব্যবস্থা করা লাগবে না?”
শোভা বুঝে চুপ করে থাকে। দিজা বিয়ের কথা শুনতেই ধক করে ওঠে।খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে চোখের সামনে তুহিনকে ভাসিয়ে আনে।তুহিনের সাথে কল্পনার জগতে পারি দেয়।এটা অনেক আগে থেকেই।তুহিনকে একটা দিন দেখেছিল নিজেদের বাড়িতে।তাও কি না আড়ালে।দেখেই ভালো লাগা।এরপর দর্শনের আইডিতে।দুই বন্ধুর এত এত ঘুরতে যাওয়া ছবি আর নিজেদের একই ব্যক্তিত্ব দেখেছে দিজা।তুহিনের মাঝেও দর্শনের হাবভাব আছে কিছুটা।দুজনেই প্রায় শান্ত।তুহিনকে এভাবেই দেখে দেখে মেয়েটা তুহিনের সাথে কল্পনার জগতে পারি দেয়।এই যেমন এখন রান্নার মাঝেও কল্পনা করছে, সে রান্না করছে আর তুহিন এসে তাকে দেখছে।মুগ্ধ নয়নে দেখছে দিজাকে।ভাবতেই লাজুক হাসিতে ভরে গেলো দিজার চোখমুখ।

শোভা চেয়ে চেয়ে দেখছে দিজাকে।ভাবছে,“মেয়েটা এমন করছে কেন?জ্বিনে ধরলো নাকি?ভাই থাকে গম্ভীর মুখে চুপ হয়ে বোন দেখি আবার মিটিমিটি হাসে।এ কোন জ্বিনে ধরা পরিবারে হাজির হলাম!”
দিজা একেকটা মশলা নিয়ে তেলের মধ্যে দিয়ে মুচকি হেসে পানি দিয়ে কষিয়ে নিচ্ছে।শোভা চেয়ে আছে দিজার এই হাসির দিকে।উপর থেকে দিদার উচ্চস্বরে বলে,“ওই বুচকি,পানি পাল্টে দিয়ে যা।”
শোভা শুনতে পেলেও দিজা কিছুই শুনতে পায়নি। সে তো আশেপাশে তুহিনকে কল্পনা করে রান্না করছে। দিজার ধারণা এই রান্না তুহিন খাবে।তাই আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে রান্না করা।
এদিকে শোভা বলে,“ছোট ভাই পানি চাচ্ছে। বালতির পানি ময়লা হয়ে আছে।পাল্টে দিতে বলছে।তুমি যাও আমি রান্না করি।”

কে শোনে কার কথা!দিজার কানে কোনো কথা যাচ্ছে না।ও তুহিনকে কল্পনা করে রান্না করে যাচ্ছে।শোভা এবার দিজাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।আলতো ধাক্কা দিলেও দিজার সাড়া নেই।বিড়বিড় করে বলে,“দিনে দুপুরে এই ভাই বোনদের উপর জ্বীনে ভর করে কেন?”
দিদার ঘাম ভেজা শরীরে বালতি হাতে নিচে এসে দাদাজানের কাছে নালিশ করে,“তোমার নাতনি কিন্তু আমার একটা কথাও শোনে না দাদাজান।”
দাদাজান চুরি করে মিষ্টি খাচ্ছিলেন।তার হঠাৎ করে দিদারের কন্ঠ পেয়ে হিচকি আসলো।হাত থেকে মিষ্টি পড়ে গেলো।দিদার কপাল কুঁচকে বলে, “চোর একটা।”
দাদাজান রাগ দেখিয়ে বলেন,“মুখ সামলে।”

“ভাইয়াকে বলে দিবো,তুমি চুরি করে মিষ্টি খাচ্ছো।”
“ভয় পাই নাকি ওইটাকে আমি?”
“তাহলে ওর সামনে মিষ্টি খেয়ে দেখাও।”
“চ্যালেঞ্জ করছো তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা দেখাবো তাহলে।শুধু আমার একটা কথা মানতে হবে।”
“কি কথা?”
“দোকান থেকে সুগার ফ্রী মিষ্টি কিনে নিয়ে এসো।তোমাকে দেখিয়ে দিবো ওই হতচ্ছাড়ার সামনে মিষ্টি খেতে আমি ভয় পাই না।”

দিদার মুখটা বেকিয়ে চলে গেলো।রান্নাঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,“ভাবী আছেন নাকি ভিতরে?”
শোভা মাথায় হিজাব দিয়ে বলে,“জি ছোট ভাই।”
“আপনার ননদকে ডেকে দিন।”
“ডাকছি কিন্তু কিছুই শুনতে পায়না।”
“তাহলে আপনি একটু সরে যান আমি ওর কান পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করছি।”

শোভা হিজাবের মুখে বেঁধে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো।দিদারকে আসতে বললে দিদার ময়লা শরীরে ভিতর ঢুকে সোজা গেলো দিজার পাশে। দিজার কান ধরে দিলো এক টান।বেচারি শখের পুরুষের সাথে কল্পনায় থাকাটা বেশিদূর এগোতে পারল না।দিদারের কান মোলা খেয়ে নাকমুখ কুচকে তাকালো।দিদার ধমকে বলে,“কতক্ষন ধরে বলছি বালতির পানি পাল্টে দে।এই ময়লা শরীরে নিচে আসতে ইচ্ছা করে?”
দিজা বিরক্ত হয়ে এবার দিদারের চুল টেনে ধরে বলে, “ছাড় আমার কান।”
“আমার কথা শুনিস না কেন?”
“তুই কে রে?তোর কথা শুনতে হবে কেন?”
“বড় ভাই আমি তোর।”

“সর তো।রান্না করছি দেখতে পারছিস না?নিজের ব্যাবস্থা নিজে কর।”
শোভা দুই ভাইবোনের এই চুল আর কান ধরে টানাটানি দেখে চোখ বড় বড় করে দেখছে।শামীম আজ অব্দি কোনোদিন তাকে একটা মাইর অব্দি দেয়নি।এমনকি শামীমের একটা কথাও অমান্য করেনি শোভা।এখানে সব উল্টো। দিজা আর দিদার মারামারি করতে থাকে এদিকে নিচে পড়ে থাকা বালতি নিয়ে শোভা পানি ভরতে থাকে।দাদাজান এসে তার নাতি নাতনিকে থামিয়ে দিলেন।

দর্শনের সাথে দেখা করতে এসেছে তুহিন।অনেকদিন পর বন্ধুকে পেয়ে খুশি হয় দর্শন।তুহিনকে দেখে একটু সন্দেহ জাগলো দর্শনের মনে।ছেলেটার চোখটা কেমন কালো হয়ে এসেছে।মিসেস তাসনুভা তুহিনের মায়ের থেকে শুনেছে তুহিনের মনটা ইদানিং ভালো নেই।দর্শন জিজ্ঞাসা করে,“ইদানিং আমাকে ইগনোর করছিস কেন?নতুন বন্ধু পেলি নাকি?”
তুহিন ম্লান হেঁসে বলে,“যার জন্য জীবনের বাকি বন্ধুদের এড়িয়ে গেলাম তাকে বদলে নেওয়া কি সহজ?”
“তাহলে কল দিলে ধরিস না কেন আবার আন্টি জানালো তুই মন খারাপ করে থাকিস।”
“এমনিতেই কাজের ব্যস্ততা।”
“উহু,আমার কাছে অজুহাত দিবি না তুহিন।আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।কাজের ব্যস্ততা আমাদের থাকলে আমরা এটাতে বেশি আনন্দিত থাকি।তাই আমাকে এই জিনিস দিয়ে তোর মন খারাপের কারণটা এড়িয়ে যাবি না।”
“আরে!অন্তত তোর কাছে এসে মনটা ভালো তো করতে পারি?”

“হ্যাঁ,সে পারিস।কিন্তু তোর মন খারাপের কারণটা আমার জানা প্রয়োজন।নাহলে এই খারাপ লাগাটা তুই সারাজীবন পুষে রাখবি।যেটা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে আমি ঠিক করতে না পারলে শান্তি পাব না।”
“ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে।আমি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছি।কিছুদিন গেলেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।”
দর্শন ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসা করে,“Are you sure?”
“হ্যাঁ,আচ্ছা শোন।কালকে তো ভাবী আর প্রে.. না মানে তোর বোনের ভর্তি।সাথে আমার এক কাজিনেরও।তো আমি ভাবীর জন্য ব্যবস্থা করেছি।ভাবীর শুধু পরীক্ষা দিলেই হবে।বাকি যে যে ইনফরমেশন ওগুলো আমার কাজিনের থেকে নিয়ে তোকে দিয়ে দিব।তুই ভাবীকে সেভাবে গাইড করবি।”

দর্শন অবাক চাহনি দিয়ে দেখছে তুহিনকে।তুহিন মৃদু হেঁসে বলে,“কি ভাবছিস?”
দর্শন কিছুই বলে না।তুহিন আবারও বলে,“আরে ইয়ার!আমি তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।তোর সম্পর্কে এ টু জেড জানা আমার।যে ছেলে নিজের জিনিসে অন্যকে ভাগ দিতে জানে না সে তার বউকে রেগুলার ভার্সিটিতে পাঠাবে এটা মানতে কষ্ট হয় দোস্ত।তাই তোর জীবনের ইম্পর্ট্যান্ট ব্যক্তিকে আমি তোর কাছেই সেফটি করে রাখার ছোট্ট চেষ্টা করে দিলাম।”
দর্শন এবার হেঁসে দিলো।উঠে দাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তুহিনকে।এই একমাত্র ছেলে যে দর্শনের মন যুগিয়ে চলে।দর্শনের কিছু বলাও লাগে না তার আগে দর্শনের চাওয়া পূরণ করে দেয়।দর্শন ভীষণ আনন্দের সাথে বলে,“তোর মত বন্ধুকে পেয়ে আমি জীবনের অর্ধেক দুঃখ ভুলেই গেছি।একমাত্র তুই আছিস যে আমাকে বোঝে।আমাদের বন্ধুত্বে কোনো নজর না আসুক।”

তুহিন একটাবার দিজাকে কল্পনা করে।চোখটা জ্বলজ্বল করছে তবুও নিজেকে শক্ত করে জানায়,“কখনও কোনো কারণে আমাদের বন্ধুত্বে কারো নজর আসতে দিবো না।এমনকি কারো জন্য এই বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না।”
দর্শন এবার তুহিনকে ছেড়ে বলে,“চল,আজকে আমরা দুজনে গাড়িতে করে অনেক দূর যাই।”
“দূরে?”
“হ্যাঁ,দুই বন্ধুর এখনো ঠিকমত আড্ডা দেবার সময় পেলাম না।”
“তাহলে চল,দোস্ত।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৬

দুই বন্ধু হাই ফাইভ দিয়ে চলে গেলো।একসাথে গাড়িতে ওঠে দুজনেই গা থেকে ব্লেজার খুলে হাস্যোজ্বল মুখে বাইকে করে ঘুরছে।গাড়ি চলছে আর রাস্তার দুইপাশ দিয়ে সারিবদ্ধ গাছগুলো পাড় হচ্ছে।দর্শনের মত তুহিনও ভালো গান গাইতে পারে।গিটার ছাড়াই তুহিন গান শুরু করে।দর্শন ইনজয় করে আর গাড়ি চালায়।দুইজনের মন এখন ফুরফুরে।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here