সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৬+২৭

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৬+২৭
Jannatul Firdaus Mithila

রাত নামার সাথে পশ্চিমা বাতাসের তীব্র প্রকোপে পরিবেশ বেশ উত্তাল! সুনামগঞ্জ পেরিয়ে প্রায় অনেকক্ষন আগে গাড়ি উঠেছে মেইন রোডে। সাই সাই করে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তায় ছুটে চলছে রৌদ্রের গাড়িটি।রৌদ্র দক্ষ হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে।তার পাশে বসে ফোন ঘাঁটছে অনিক।পেছনের দু-সিটে ক্লান্ত হয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অরিন! সারাদিন কি আর কম ধকল গিয়েছে মেয়েটার ওপর দিয়ে? সে সুবাদে, ক্লান্ত হওয়াটা যে নিতান্তই যৌক্তিক বৈকি! রৌদ্র গাড়ি ড্রাইভ করার পাশাপাশি ক্ষনে ক্ষনে ফ্রন্ট মিররে চোখ রাখছে।মেয়েটার ঘুমন্ত মায়াবী মুখখানা যে তাকে বড্ড শান্তি দিচ্ছে। মনে মনে এক অজানা সুখের ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার।মেয়েটার প্রতি তার এতদিনকার অনুভূতি গুলো যে আজ পূর্নতা পেলো।

প্রায় অনেকটা পথ পাড়ি দেবার পর হুট করেই ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামে।সাথে বাতাসের তীব্র বেগ ও বিকট শব্দের বজ্রপাত! প্রথম বজ্রপাতের বিকট শব্দে একপ্রকার হকচকিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে অরিন।হকচকিয়ে উঠে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে সিটে।বুকের কাছে দুহাত চেপে ধরে রেখেছে সে।হয়তো এহেন বিকট শব্দে বুকটা কাপছে তার! ভয়ে ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে পরপর। মেয়েটা আবার বজ্রপাতের শব্দে ব্যাপক ভয় পায়!কিয়তক্ষন বা৭
দে আরেকবার বিকট শব্দে মেঘের গর্জন হয়।এবার আর টিকে থাকতে পারলোনা অরিন।মেয়েটা তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ ভাইয়া গো!”
তড়িৎ গাড়ি ব্রেক করে রৌদ্র। পেছন দিকে তাকিয়ে বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ কি হয়েছে? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও?না-কি ভয় পেয়েছিস? ”
অরিন ধীরে ধীরে মাথা ঝাকায়। থেমে থেমে বলে,
“ আমার ভয় লাগছে!”
অনিক বোনের ভীত চাহনির দিকে তাকিয়ে হুট করেই তীব্র বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।তারপর কালবিলম্বহীন বোনের পাশের সিটে এসে বসে পড়ে। এইটুকুন সময়ের ব্যাবধানেই ছেলেটার অবস্থা ভিজেনেয়ে একাকার! অনিক হাত বাড়িয়ে বোনকে সযত্নে আগলে নেয় বাহুডোরে।মেয়েটার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আওরায়,

“ সোনা বনু আমার! ভয় পায়না।ভাইয়া আছি না তোর পাশে?”
অরিনও ভাইকে পেয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। চোখদুটো তার এখনো কুঁচকে রাখা। শরীরে বইছে মৃদু কাঁপন! অনিক বেশ টের পেলো বোনের অবস্থা! সে অরিনকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে,
“ বনু জানিস? আজকে আমাদের সাথে কি হয়েছিল? ”
অরিন ভাইয়ের বুকে মাথা রেখেই মৃদু কন্ঠে বললো,
“ কি?”
রৌদ্র এতক্ষণ নিরেট দৃষ্টিতে দু’ভাইবোনের কান্ড দেখলো।পরক্ষণেই মুচকি হেসে সামনের দিকে ফিরলো।থাকুক কিছুক্ষন দু’ভাইবোন নিজেদের মতো।রৌদ্র এবার সরু দৃষ্টি ফেলে সামনের দিকে। গাড়ির কাচ গলিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পায়— ভারি বর্ষন।এরূপ পরিবেশে গাড়ি চালানোটা বড় রিস্কি বটে। রৌদ্র কিছুক্ষণ ভাবলো কিছু একটা। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল লাগায় তাশরিক সাহেবের নাম্বারে।দু’টো রিং হতেই ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হয়।

— “হেলো রোদ?”
— “চাচ্চু! তোমরা কোথায় আছো?”
তাশরিক সাহেব একবার জানালার কাচ গলিয়ে বাইরে তাকালেন।পরক্ষণেই বললেন,
—“ রোদ! আমরা তো প্রায় পৌঁছে গিয়েছি।এইতো আর ৪০ মিনিটের মতো লাগতে পারে বাড়িতে যেতে।তোরা কোথায় আছিস?”
—“ আসলে চাচ্চু,আমরা মেইন রোডেই আটকে আছি।কেননা এখানে প্রচুর ঝড় হচ্ছে! সামনের দিকে ঠিকঠাক তাকানোই যাচ্ছে না। এ অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করাটা রিস্ক হয়ে যায়।”
তাশরিক সাহেব বিচলিত হলেন। ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

—“ এই না না! এই অবস্থায় গাড়ি ড্রাইভ করার কোন দরকার নেই। তোরা একটা সেফ জায়গায় থাক।দরকার হয় আজকে রাতটা আশেপাশে কোন হোটেল থাকলে সেখানে কাটিয়ে, ভোরের দিকে নাহয় চলে আসিস।”
রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ কি যেন একটা ভেবে পরক্ষণেই বললো,
—“ কিন্তু আব্বু মানবে বিষয়টা?”
তাশরিক সাহেব অভয় দিয়ে বললেন,
—“ সেটা আমার ওপর ছেড়ে দে! আমি বড় ভাইজানকে জানাচ্ছি সবটা।তোরা আপাতত সেইফ কোন জোনে চলে যা।”
কথাবার্তা শেষ করে কল কাটে রৌদ্র। আশপাশে একবার নজর বুলিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।ধীরে ধীরে বৃষ্টির মধ্যে কিছুটা সামনে এগোতেই হাইওয়ের পাশে একটা আবাসিক হোটেলের দেখা মিলে।তা দেখে রৌদ্র মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক তবে রাতটা আর গাড়িতে কাটাতে হবে না।

তুমুল বর্ষা মাথায় নিয়েই হোটেলের ভেতরে ঢুকলো তিনজন। অনিক আর অরিনকে একটা টেবিলে বসিয়ে রৌদ্র এগিয়ে যায় রিসেপশনিস্টের কাছে। রৌদ্রকে দেখতে পেয়ে রিসেপশনিস্ট মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টানে।বিনিময়ে রৌদ্রও হাসি-হাসি মুখে তার সঙ্গে কথা বলে পাশাপাশি তিনটে রুম বুক করে আজ রাতের জন্য। কাউন্টার থেকে রুমের চাবি নিয়ে ফিরে আসে অনিক আর অরিনের কাছে।
“ অনিক! তুই ৩১২ নম্বর রুমটায় থাকবি।আর অরি থাকবি ৩১১ নম্বরটায়।তার পাশেরটাতেই আমি থাকবো।এবার চল ওপরে! ”
অনিক মাথা ঝাকায়। বোনের হাত ধরে এগিয়ে যায় লিফটের কাছে।রৌদ্র তাদের সাথে না গিয়ে অন্যদিকে হাঁটা ধরলো।কিয়তক্ষন বাদে অনিক পেছনে তাকিয়ে রৌদ্রকে না দেখে ভ্রুকুটি করে। পরক্ষণেই আশপাশ খুজে রৌদ্রকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ডাক দেয়,

“ ভাইয়া? রুমে যাবেনা?”
রৌদ্র চলতি পাদু’টো থামায়।অনিকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“ ওকে নিয়ে সাবধানে যা,আমি আসছি! আমি না আসা অবধি তুই ওর রুমে থাকিস।”
অগত্যা এহেন কথায় ভ্রুকুচকায় অরিন।এমন ভেজা শরীরে লোকটা আবার কোথায় যাচ্ছে এখন? অরিনকে এভাবে রৌদ্রের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে দেখে, অনিক হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“ ভাইয়া ফিরে আসবে।তুই চল আমার সাথে বনু।এমনিতেই প্রচুর ভিজে গেছিস তুই।”
ভাইয়ের মুখের এমন কথায় খানিকটা বিব্রত হলো অরিন। মনে মনে ভাবলো, — ইশশ্ ডাক্তার সাহেবের দিকে ওমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে, ভাইয়া মনে মনে কি ভাবলো! ধূর!

অরিন আর অনিক অরিনের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে আসলো মাত্র। রুমে ঢুকতেই অরিনের চক্ষু চড়কগাছ! এতো সুন্দর করে গোছানো রুমটা!অরিনের তো এখন ইচ্ছে করছে, ঐ শুভ্ররঙা বিছানার ওপর ইচ্ছেমতো গড়াগড়ি খেতে।অরিন ধীরে ধীরে রুমের চারিদিকে নজর বোলায়।তখনি তার চোখ আটকে যায় রুমের ওপাশে থাকা বারান্দার দিকে। অরিন ছুটে চলে আসে সেখানে।পেছন থেকে অনিক দুয়েকবার বারণও করেছে মেয়েটাকে,এই বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় যেতে কিন্তু মেয়েটা শুনলে তো!সে বুঝি আজকে নাছোরবান্দা হলো।সে অনিকের বারণ করাকে একপ্রকার উপেক্ষা করে চলে আসে খোলা বারান্দায়। সম্পূর্ণ বারান্দায় ধেয়ে আসছে বৃষ্টির পানির ছিটা। সেখানে দাড়াতেই অরিন আরেকদফা ভিজে যায়। অথচ সেদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই তার।সে চোখ বন্ধ করে অস্ফুট স্বরে বললো,

“ অসাধারণ!”
অনিক পিছু পিছু আসে।বারান্দার দরজার সামনে দাড়িয়ে বোনকে তাড়া দিয়ে বলে,
“ লক্ষ্মী বনু আমার! ভেতরে চলে আয় এবার।এরমভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর বাঁধবে সোনা। ও বনু! আয় না ভেতরে।”
ভাইয়ের এহেন অনুনয়ে গলে পানি অরিনের মনটা।সে পেছনে ফিরে মেকি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলে,
“ এমন করো কেন? একটু ভিজলে কি হয়?”
“ অন্যকারো তেমন কিছু নাহলেও তোর অনেক কিছুই হয়!” — ঘরের খুলে রাখা দরজার সামনে সটান হয়ে দাড়িয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে কথাটা বললো রৌদ্র। অনিক রৌদ্রের দিকে তাকায় একবার।পরক্ষণেই বোনকে নিজের পেছনে আড়াল করে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ বনুরে! নিজেতো বকা খাবিই,তার সাথে আমাকেও খাওয়াবি!”
রৌদ্র গটগট পায়ে এগিয়ে আসে ভেতরে। হাতে থাকা শপিং ব্যাগগুলো পাশের সোফাতে রেখে অনিকের দিকে সরু চোখে তাকায় সে।পরক্ষণেই গম্ভীর গলায় শুধায়,
“ অরি নাহয় ছোট! বোঝে কম।কিন্তু তুই তো ছোট নস অনি! তাহলে তুই কিভাবে ওকে এলাও করলি বৃষ্টিতে যেতে?”
অনিক মাথানিচু করে দাড়িয়ে রইলো। এখন ঠিক কি উত্তর দেবে সে? সে যদি রোদ ভাইকে সত্যিটা বলে দেয় — যে সে না করেছিল বনুকে কিন্তু বনু শোনেনি।তখন যদি রোদ ভাই তার বনুর ওপর রাগ দেখায়,তাহলে নিশ্চয়ই বনুটা খুব কষ্ট পাবে! এরচেয়ে বরং সব দোষ নিজের মাথায় নিয়ে চুপ থাকাটাই শ্রেয়!
এদিকে নিজের জন্য ভাইয়াকে এমন কথা শুনতে দেখে মনে মনে বেশ আহত হলো অরিন।সে ধীরে ধীরে ভাইয়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাথানিচু করে বললো,

“ আসলে, ভাইয়ার কোন দোষ নেই।সে আমায় না করা স্বত্বেও আমি জোর করে গিয়েছিলাম ভিজতে!”
দু’ভাইবোনকে এভাবে মাথানিচু করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে রৌদ্র।
“ মাথানিচু রেখে কি বোঝাতে চাচ্ছিস দু’জনে? খুব মান্য করছিস আমায়? অথচ আমি যেটা না করি সেটাই বেশি করে করিস তোরা। তাই শুধু শুধু মাথানিচু করে রাখার কোনো দরকার নেই। মাথা তোল!”
অগত্যা এমন শক্ত কথায় দু’জনেই মাথা তোলে তৎক্ষনাৎ। অরিন ঘাড়ে হাত বুলিয়ে আড়চোখে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়, — ছেলেটা তার দিকেই কেমন সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিন সঙ্গে সঙ্গে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।মনে মনে নিজেকে কষিয়ে দুটো গালি দিলো মেয়েটা।বললো,— যাহ! লোকটা বুঝে গেলো আমি তাকে লুকিয়ে দেখছি!ইশশ্ কি লজ্জা! কি লজ্জা!
অনিক সামনের দিকে তাকায়। দেখতে পায়, সোফার ওপর দুটো শপিং ব্যাগ রাখা।সে সন্দিহান গলায় বললো,

“ এগুলো কি ভাইয়া?”
রৌদ্র এবার দৃষ্টি সরায় অরিনের ওপর থেকে। অনিকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
“ এখানে কিছু কাপড় আছে তোদের জন্য! যা গিয়ে পাল্টে নে!”
অনিক বেশ অবাক হলো। শপিং ব্যাগদুটো হাতে নিয়ে বললো,
“ এগুলো কোথায় পেলে ভাইয়া?”
“ রাস্তায় পড়া পেয়েছি!” — রৌদ্রের ভাবলেশহীন জবাব। তা শুনে অরিন মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছে। আর অনিক! ছেলেটা কেমন বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বলে,
“ এতো ভালো কাপড় রাস্তায় পড়া পেয়েছো? হুহ্ বললেই হলো? কোথায় পেলে বলোনা!”
রৌদ্র হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো খানিকটা ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,

“ নিচেই একটা ছোটোখাটো ড্রেস আউটলেট আছে।আমি ভেতরে আসবার সময় দেখেছিলাম। যাইহোক, তোরা এখন ড্রেস পাল্টে নে। অনিক তুই ফ্রেশ হয়ে নিচ থেকে খাবার আনিস।অরি এখানে বসেই খাবে।”
অনিক মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। চোখ সরাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখ পড়লো — রৌদ্রের থেঁতলে যাওয়া হাতটির দিকে।সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে এগিয়ে আসে। রৌদ্রের হাতটা ধরে বলে,
“ ভাইয়া! তোমার হাতটার অবস্থা তো খুব একটা ভালো না। তুমি নিজের জন্য ঔষধ এনেছো তো?”
রৌদ্র একবার নিজের আঘাতপ্রাপ্ত হাতের দিকে তাকায়,আরেকবার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছলছল চোখের অরিনের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলে,
“ হুম এনেছি।ফ্রেশ হয়ে লাগিয়ে নিবো।”
বলেই অনিকের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে চলে যায় রৌদ্র। এদিকে তার যাওয়ার পথে একরাশ অপরাধবোধ আর অস্থিরতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো অরিন।মেয়েটা যে সবকিছুর জন্য নিজেকেই বারংবার দায়ী করছে!

রাত সাড়ে ১২টা🌸
বেশ খানিকটা সময় নিয়ে শাওয়ার শেষে মাত্রই বেরুলো রৌদ্র। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। তারওপর ডানহাতটাও এখন একটু-আধটু ব্যাথা করছে। রৌদ্র বেখেয়ালিবশত ডানহাতটা দিয়ে চুল ঝাড়তে গিয়ে পড়লো আরেক বিপত্তিতে।ব্যাথায় তৎক্ষনাৎ মুখ কুচকে আসে তার। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মুখে চ– কারন্ত শব্দ তুলে হাতটা ঝাড়া দিতে থাকে। নাহ! হাতটার যা অবস্থা, মনে হচ্ছে আজ রাতটা না খেয়েই কাটাতে হবে তার। রৌদ্র খালি গায়ে কাঁটা হাতটা নিয়ে বিছানায় বসে। হাতে ব্যাথা থাকা দরুন মাথাটাও ঠিকমতো মুছতে পারেনি ছেলেটা।সেখানে শরীর মোছা তো বড়লোকি বৈকি! রৌদ্র বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নেয়।তখনি তার দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ আসে।রৌদ্র ভাবলো — হয়তো অনিক এসেছে খাবার নিয়ে। সে ধীর কদমে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। গায়ে শার্ট না জড়িয়েই দরজাটা খুলে দেয়।পরক্ষণেই সামনে দাড়ানো ব্যাক্তিকে দেখে ভ্রু-গোটায় রৌদ্র। তার সম্মুখে খাবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে অরিন।রৌদ্র ভরাট কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ তুই? তুই কেন খাবার আনতে গেলি?”
অরিন কোনরূপ প্রতিত্তোর না করে রৌদ্রকে ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকে। রৌদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। একহাতে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে, অরিনের কাছে এসে কোমরে দু’হাত রেখে সটান হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ এতোরাতে কেন এলি আমার রুমে? ”
অরিন নির্বাক! মাথানিচু করে দাড়িয়ে আছে সে।অস্থিরতায় দু’হাত কচলে যাচ্ছে অনবরত। রৌদ্র আড়চোখে দেখলো সবটা। তারপর ফোঁস করে একটা ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে অরিনকে পাশ কাটিয়ে বসে পড়ে সোফায়। ক্লান্তি এবং মাথা ব্যাথা দুটো মিলিয়ে কুপোকাত ছেলেটা।সে মাথা এলিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে বসে রইলো সোফায়। অরিন এবার ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে। রৌদ্রের থেকে প্রায় অনেকটা দূরে দাড়িয়ে আছে সে। দৃষ্টি তার রৌদ্রের আঘাতপ্রাপ্ত হাতের দিকে। কিয়তক্ষন সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই চোখদুটো ছলছল হয়ে আসে তার। সে খানিকটা এগিয়ে এসে রৌদ্রের পাশে বসে।

নিজের এতোটা কাছে অরিনের উপস্থিতি স্পষ্ট টের পেলো রৌদ্র। তবুও সেদিকে কোনরূপ পাত্তা দিলো না সে। চোখ বন্ধ করে রইলো আগের মতো।এদিকে রৌদ্রকে এখনো আগের ন্যায় বসে থাকতে দেখে আহত হলো অরিন।ছলছল চোখজোড়া ইতোমধ্যেই জলে টইটম্বুর। যেন হালকা একটা স্পর্শ পড়লেই গড়িয়ে পড়বে তা! অরিন কাঁপা কাঁপা হাতে রৌদ্রের হাতটা ধরে। তৎক্ষনাৎ তার হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয় রৌদ্র। চোখবুঁজেই কাঠকাঠ গলায় বলে,
“ ধরতে হবে না আমায়! রুমে যা তুই।”

ব্যস!এটুকু কথাই যেন যথেষ্ট ছিলো অরিনকে কাঁদানোর জন্য। মেয়েটা আর নিজের উপচে পড়া কান্নাগুলো আটকে রাখতে পারলো না। সে তৎক্ষনাৎ জড়িয়ে ধরে রৌদ্রকে।হঠাৎ এমন হওয়ায় থমকায় রৌদ্র। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।নিজের পূর্ণ মনোযোগ টানলো মেয়েটার কথা শুনতে। রৌদ্রের বুকে মাথা রেখে অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ মাফ করে দিন আমায়! ভুল হয়ে গেছে আমার। আর কোনদিন আমি আপনার অবাধ্য হবোনা।আপনি যখন যা বলবেন তাই শুনবো।আপনার কথামতো চলবো তবুও প্লিজ আমায় এভাবে দূর দূর করবেন না। আপনার অবহেলা আমার সহ্য হয়না ডাক্তার সাহেব। ভিষণ রকমের যন্ত্রণা দেয় আমাকে।ভিষণ পোড়ায় আমার অন্তরটা।ডাক্তার সাহেব, প্লিজ এই শেষবারের মতো মাফ করে দিন আমায়। প্লিজ আর রাগ করে থাকবেন না!”
কথাগুলো শেষ হওয়া মাত্র মুচকি হেসে অরিনকে জড়িয়ে ধরে রৌদ্র। মেয়েটার এলোমেলো চুলগুলোকে খানিকটা গুছিয়ে দিয়ে মাথায় আলতো করে চুমু একে দেয় সে। বলে,
“ আর কখনো এমন ভুল হবে সানশাইন? ”

তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে না জানায় অরিন। রৌদ্রের বুক হতে মাথা উঠিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় শুধায় সে,
“ আর কোনদিন হবেনা এমন।এইতো প্রমিস!”
বলেই গলায় চিমটি কাটার ন্যায় হাত রাখে অরিন।তা দেখে রৌদ্র স্মিত হাসলো। মেয়েটার হাতদুটো গলা থেকে সরিয়ে এনে নিজের বুকের কাছে রাখলো সে।তারপর মেয়েটার পানে শান্ত অথচ নিরেট দৃষ্টি ফেলে বললো,
“ তুই যখন আমার চোখের আড়াল হয়ে যাস সানশাইন, তখন আমার এই বুকটায় প্রচন্ড ব্যাথা হয়।যখন দেখি কেও আমার পবিত্র ফুলকে অপবিত্র হাত দিয়ে ছোবার চেষ্টা করে, তখন এই বুকটায় তান্ডব শুরু হয়। ইচ্ছে হয় তাকে জালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে। তুই কেনো বুঝিস না সানশাইন? তোকে না দেখলে আমার নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়! মনে হয়,কেও বুঝি সজোরে গলা চেপে ধরেছে আমার। অথচ আমার এতো কষ্টের একটাও তুই বুঝিস না সানশাইন! খালি কিভাবে আমায় কষ্ট দেওয়া যায় সেই পায়তারাই করিস তুই!”

থামলো রৌদ্র। চোখদুটো বন্ধ করে শুষ্ক অধর জোড়া জিভ দিয়ে খানিকটা ভিজিয়ে আবারও বললো,
“ রুমে যা সানশাইন! আমি চাই না,আমার অবাধ্য মনটা আরেকবার অবাধ্য হোক।”
অরিন হাতের উল্টোপিঠে চোখদুটো মুছে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে আসে। রৌদ্রের ব্যাথায় জর্জরিত হাতটা নিজের পায়ের ওপর নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রৌদ্র চোখ খোলে। হাতটা সরাতে নিলে অরিন আরও কিছুটা চেপে ধরে সেই হাত।জোর গলায় বলে,
“ সরাবেন না হাতটা।আমি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি। ”
রৌদ্র আলতো হেসে বললো,
“ তুই জানিস কিভাবে ড্রেসিং করাতে হয়?”

এবার বুঝি অসহায়বোধ করলো অরিন।মেয়েটার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে আছে তার অসহায়ত্বের ছাপ।রৌদ্র বেশ বুঝলো তা।সে মৃদু মাথা নাড়িয়ে উঠে দাড়ায় বসা ছেড়ে। বিছানার ওপর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আবারও চলে আসে অরিনের কাছে। তারপর সেই প্যাকেটটা থেকে তুলো আর এন্টিস্যাপ্টিক বের করে অরিনের হাতে দেয়। বলে,
“ মন খারাপ করার দরকার নেই জানবাচ্চা! আমি বলে দিচ্ছি, তুই কর।”
অগত্যা এহেন কথায় মুখ থেকে আধার সরলো অরিনের। মেয়েটা বেশ খানিকটা যত্নের সাথে করতে থাকলো ড্রেসিং। আর রৌদ্র বসে বসে নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো সবটা। এইটুকুন পিচ্চি মেয়েটাও কেমন দায়িত্ব নিয়ে তার যত্ন করছে।

প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিনের ড্রেসিং করা শেষ হলো।ড্রেসিং শেষ হতেই মেয়েটার সে-কি উচ্ছ্বাস! এই প্রথমবার ড্রেসিং করলো সে,তাও আবার একজন ডাক্তারের! ভাবা যায় বিষয়টা? রৌদ্র মুচকি হেসে অরিনকে নিজের কোলে বসায়। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ ভড়কে যায় খানিকটা। চোখ বড়সড় করে তাকায় রৌদ্রের পানে। রৌদ্রের ঘোরলাগা নয়নে চোখ পড়তেই কেঁপে ওঠে মেয়েটা। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে লজ্জায় হাসফাস করতে থাকে সে। গালদুটোর চামড়ায় বুঝি লালাভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে! অরিনের এহেন লজ্জা মাখা মুখ দেখল রৌদ্র ফাঁকা ঢোক গিলে। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার গালে আলতো করে স্পর্শ করতেই লাজে মূর্ছা যায় অরিন। চিবুক তার এসে ঠেকলো গলায়। রৌদ্র এবার অস্থির হলো।

“ কেন এলি সানশাইন? এতোদিন নাহয় সম্পর্কের মধ্যকার বেড়াজালে নিজের অবাধ্য ইচ্ছেগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলাম আমি।কিন্তু আজ? আজ কিভাবে নিজের এমন অনুভুতিকে আটকাবো আমি? কিভাবে তোর থেকে দূরে রাখবো নিজেকে? যেখানে আমার অবাধ্য মনটা নিজেই জানে— আজ থেকে তোর ওপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার!”
হঠাৎ করেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে অরিনের। সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটা প্রায় ভুলেই বসেছিল সে। মেয়েটা আমতা আমতা করে বলে,
“ আপনি খাবারটা খেয়ে নিন প্লিজ!”
অরিনের এহেন কথায় আবারও মাথা এলিয়ে দেয় রৌদ্র। নাহ!মনটা বড় আনচান করছে তার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না এ মুহুর্তে! রৌদ্র ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে।কিয়তক্ষন বাদে নিজের এক আকাশসম ইচ্ছেগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে বললো,

“ সানশাইন! আমার মাথাটা মুছে দে।”
অরিন মাথা ঝাকায়। রৌদ্রের কোল থেকে নামতে নিলে বাঁধ সাধলো রৌদ্র। মেয়েটার কোমর চেপে আরেকটু কাছে নিয়ে আসে নিজের। অরিন কেঁপে ওঠে আবারও! হাতদুটো কি সাংঘাতিকভাবেই না কাপছে তার! অরিনের পাদু’টো রৌদ্রের কোমর বরাবর। রৌদ্র মৃদুস্বরে বললো,
“ কোত্থাও যেতে হবেনা সানশাইন! তোর ওড়নাটা দিয়ে মুছে দে প্লিজ!”
অরিন শুষ্ক ঢোক গিলে পরপর। আহা!এতো ঠান্ডা পরিবেশেও বুঝি খরা নেমেছে মেয়েটার গলায়!মনে হচ্ছে এ মুহুর্তে একজগ পানি না গিললেই নয়।অরিনের সাড়া না পেয়ে রৌদ্র এবার তাড়া দেখায়!
“ কই? আমি ওয়েট করছি তো!”

ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ফেলে অরিন।কাঁপা কাঁপা হাতে ধীরে ধীরে ওড়নার কোণা দিয়ে মাথাটা মুছতে শুরু করে রৌদ্রের। রৌদ্র মনে মনে বাঁকা হাসলো। মেয়েটাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখতে বললো,
“ তোর শরীর থেকে কি সুন্দর একটা ঘ্রাণ আসছে সানশাইন! ওহ, মাই! দিস ইজ পুলিং মি ইন সো মাচ!”
তৎক্ষনাৎ কর্মরত হাতদুটো থেমে যায় মেয়েটার।কানদুটো দিয়ে বুঝি লজ্জায় গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে! মেয়েটা তড়িৎ জিভে দাত কাটে। রৌদ্রের কোল থেকে খানিকটা সরতে নিলে রৌদ্র আরেকটু
চেপে ধরে তার কোমর। হাস্কি স্বরে বলে,
“উহুম! ডোন্ট মুভ জান, আই রিয়েলি লাইক দিস পোজ!”
একথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই নাকেমুখে উঠে অরিনের। কাশতে কাশতে যাচ্ছে তাই অবস্থা তার! রৌদ্র এবার হেয়ালি ছেড়ে মাথা তুলে নড়েচড়ে বসে। অরিনের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,
“ কি হয়েছে সানশাইন? পানি খাবি?”

মেয়েটাকে উত্তর দেবারও সুযোগ দিলোনা রৌদ্র। সে তড়িঘড়ি করে সামনের টি-টেবিল থেকে একগ্লাস পানি উঠিয়ে মেয়েটার মুখের সামনে ধরে। অরিনও আর সাত-পাচঁ না ভেবে গটগট করে গিলে নেয় পানিটুকু। মেয়েটার অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এ মুহুর্তে পানিটা ঠিক কি পরিমাণ দরকার ছিল তার! অরিন পানি খেয়ে গ্লাসটা রৌদ্রের হাতে দেয়।তারপর হাত বাড়িয়ে নিজের ঠোঁটগুলো মুছতে নিলে আবারও বাঁধ সাধে পাগল ছেলেটা। অরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রৌদ্রের দিকে।আর রৌদ্র? তার ঘোরলাগা দৃষ্টি আঁটকে আছে মেয়েটার সিক্ত অধরযুগলের পানে। কিয়তক্ষন বাদে নিজেদের মধ্যকার দুরত্ব আরও কিছুটা ঘুচিয়ে নেয় রৌদ্র। তা দেখে অরিন খানিকটা ভড়কে গিয়ে পেছাতে গেলে রৌদ্র তার ঘাড় চেপে ধরে আলতো হাতে। নেশালো কন্ঠে বলে,

“ এমন করিস না!”
কথাটা শেষ হবার পরপরই অরিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“ আ-মি আ-সি ডাক্তার সাহেব!”
রৌদ্র কি শুনলো সে কথা? কে জানে! ছেলেটার হাবভাবে তো তা মনে হচ্ছে না। তার নেশাক্ত আখিঁদ্বয় যে বুদ হয়ে আছে অরিনের ওষ্ঠের ভাঁজে। সে ধীরে ধীরে নিজের মুখটা এগিয়ে আনে অরিনের মুখের কাছে।মেয়েটার ওষ্ঠপুটে নজর রেখে কেমন যেন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বললো,
“ একটা চুমু খাই জান?”

তৎক্ষনাৎ এক শীতল স্রোত নেমে আসে অরিনের শীরদাড়া বেয়ে। পেটে ডানে ঝাপটায় হাজারো নামনাজানা প্রজাপতির দল।বুকের খাঁচায় লুকায়িত অঙ্গটা নৃত্য তুলতে ব্যস্ত যেন! হাত-পায়ের সাথে সাথে মাথাটাও বুঝি অবশ হয়ে আসে মেয়েটার।সে ক্ষনে ক্ষনে শুষ্ক ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করতে কিন্তু সেটা কি আর আদৌও সম্ভব এ মুহুর্তে? অরিন কিছু একটা বলার জন্য ঠোঁট নাড়তেই সেখানে আঙুল চেপে ধরে রৌদ্র। বলে,
“ হুঁশশ! আজ আর কোন কথা নয় সানশাইন!”
বলেই মেয়েটাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হেঁচকা টানে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে আসে রৌদ্র। মেয়েটার ঠোঁটের দিকে এগোবে তার আগেই অরিন কিছুটা ফাঁক পেয়ে চট করে উঠে দাড়ায় রৌদ্রের কোল থেকে। এহেন কান্ডে রৌদ্রের মেজাজ চটে যায় মুহুর্তে।তবুও মনের সুপ্ত রাগকে কন্ট্রোল করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,

“ কি হয়েছে ?”
অরিনের কাছ থেকে জবাব আসলো না কোনো। সে কাঁপা শরীরে তৎনগদ পেছনে ঘুরে। তারপর কালবিলম্ব না করে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। এদিকে তার এমন চলে যাওয়া বসা ছেড়ে উঠে দাড়ায় রৌদ্র। পড়নের কালো ট্রাউজারটার পকেটে হাত গুঁজে ভরাট কন্ঠে ডাক দেয়,
” এই যে মিস অরিন! উপস! ইট’স মাই বেড।শুনছেন সানশাইন! ”

দ্রুত কদমে হাঁটতে থাকা পাদু’টো সহসা থমকে যায় অষ্টাদশীর। হৃৎপিণ্ডটা কেমন ছলাৎ করে ওঠে লোকটার মুখের নিসৃত বানী শুনে। শরীরে বয়ে যায় এক নাম না জানা শিহরন। অষ্টাদশীর কোনরূপ পাত্তা না পেয়ে ধৈর্য হারায় রৌদ্র। ভ্রুকুটি করে এগিয়ে আসে জোরালো কদমে। মেয়েটার ঠিক পেছনে দাড়িয়ে আলতো করে তার হাতদুটোতে নিজের হাত দিয়ে স্লাইড করতে থাকে সে।অরিন সঙ্গে সঙ্গে খপ করে চেপে ধরে নিজের জামার একাংশ। চোখদুটো কুচকে ফেলেছে সেই কবেই! রৌদ্র এবার আরেকধাপ এগোলো।মেয়েটার বেধে রাখা চুলগুলো আলগোছে খুলে দিলো।ফলে কালো সিল্কি চুলগুলো ঝপঝপিয়ে নেমে পিঠ ঢেকে ফেললো মেয়েটার।রৌদ্র নিজের নাক এগিয়ে এনে প্রান ভরে মেয়েটার চুলের মনমাতানো সৌরভ টেনে নিলো। কথায় আছে, — মেয়েদের চুলে না-কি এক অদ্ভুত রকমের মিষ্টি ঘ্রাণ থাকে।কথাটা যেন আজ হাতেনাতে প্রমাণ পেলো রৌদ্র। সে মেয়েটার চুলগুলোর মাঝ বরাবর আলতো হাতে চেপে ধরে নিজের বুক বরাবর মেয়েটাকে টেনে নিয়ে আসে।তারপর অরিনের ঘাড় হতে চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে সেখানে মুখ গুঁজে দিলো রৌদ্র। অরিনের বুঝি এখন মরিমরি অবস্থা! মেয়েটা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে অনবরত। রৌদ্র অরিনের ঘাড়ে আলতো করে নাক ঘষতে থাকে।কিয়তক্ষন বাদে সেখানে একে একে চুমুতে ভরিয়ে তোলে। তারপর মেয়েটার ঘাড় বেয়ে কান অবধি উঠে আসে তার মুখ। পরক্ষণেই মৃদু কামড় বসায় অরিনের কানের পিঠে। এবার আর চুপ থাকতে পারলোনা অরিন। মেয়েটার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে,

“ উফফ! ”
রৌদ্র থামলো না। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কনুই ধরে নিজের দিকে ঘোরায়। দেখতে পায়, অষ্টাদশীর তিরতির করে কাঁপতে থাকা বন্ধ নেত্রযুগল। নাকের ওপরটা বুঝি ঘামের ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুতে আচ্ছাদিত। ঘরের সফেদ আলোর ঝলকানিতে ঘামের বিন্দুগুলো যেন এক একটা মুক্তার মতো দেখাচ্ছে। রৌদ্র থমকায়। আবারও খেই হারায় নিজের। অজান্তেই কখন যেন নিজেদের মাঝের বেশ কিছুটা দুরত্ব সদর্পনে ঘুচিয়ে ফেলেছে ছেলেটা! সেদিকে কি তার বিন্দুমাত্র খেয়াল আছে?

রৌদ্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছে নিজের প্রাণভোমরার দিকে। আর মেয়েটা! সেই যে নেত্রযুগল বন্ধ করেছে, আর তো নামই নিচ্ছে না খোলার। অরিন খেয়াল করলো তার মুখের ওপর মানুষটার গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে। অরিন ভরকায় তবুও চোখ মেলে না। মনে মনে ভাবছে, লোকটা কি তাহলে তার খুব কাছে দাড়িয়ে? অরিনের একবার ইচ্ছে হলো চোখ মেলে দেখার। কিন্তু সেই সাহস হলে তো! মানুষটা তার সামনে আসলে কি জানি তার কি হয়! এই যেমন এখন হচ্ছে! না পারছে মানুষটাকে দূরে ঠেলে দিতে, আরনা পারছে তাকে কাছে টেনে নিতে।আচ্ছা এখন তো তারা স্বামী স্ত্রী। তাহলে তবুও কেন তার মাঝে এতো দ্বিধা?
রৌদ্র এখনও ঘোরলাগা নয়নে তাকিয়ে আছে। তার বেহায়া চোখদুটো বারেবারে ঘুরেফিরে ঐ তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ের দিকেই আবদ্ধ হচ্ছে! রৌদ্র এবার হাসফাস করে। গলাটা কেমন হুট করে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে ছেলেটার। এ কি অবস্থা হচ্ছে ওর!

রৌদ্র এবার ঘটালো আরেক কান্ড! নিজের শীতল হাতটি উঠিয়ে আলতো করে অরিনের গালে রাখলো। গালে এমন শীতল স্পর্শ পেয়ে আরেকদফা কেঁপে ওঠে মেয়েটা! তৎক্ষনাৎ খামচে ধরে জামার দুপাশ। ঠিক তখনি তার কানে আসে এক অবিশ্বাস্য ঘোর লাগা কন্ঠের ফিসফিসানি আবদার!
“সানশাইন! আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে রে,প্লিজ একটু শান্তি দে আমায়।তোর ঐ সুন্দর ঠোঁটে একটা মিষ্টি চুমু খাই না প্লিজ!”
কি শুনলো অরিন! ফট করে চোখ মেলে তাকালো মেয়েটা! চোখেমুখে তার আকাশসম চমকের রেশ। কথাটা প্রথম যখন কানে এলো তখন এক মুহুর্তের জন্য অরিনের মনে হয়েছিল, —”মানুষটা এতোটা অধৈর্য্য হলো কবে থেকে? ”
না, মেয়েটার অবিশ্বাসের রেশ আর বেশিক্ষণ টিকলো না। তার আগেই কর্ণগোচর হলো ঠিক আগের ন্যায় ঘোরলাগা কন্ঠ!

“ সানশাইন! একটা চুমু খাই না প্লিজ! কথা দিচ্ছি একটাই খাবো। এবার অন্তত একটা চুমু খেতে দে!”
অরিন কি বলবে বুঝে আসছে না মেয়েটার। সে কেমন হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের পানে। খানিকক্ষণ বাদে নিজের সকল হতবিহ্বলতা একপাশে রেখে বিচলিত কন্ঠে অরিন বলে,
“ আপনি এতোটা অধৈর্য্য হলেন কবে থেকে ডাক্তার সাহেব? এটা সত্যিই আপনি তো?”
অন্যসময় হলে হয়তো রৌদ্র কিছুটা বিরক্ত হতো। কিন্তু এ মুহুর্তে তার বুঝি মজাই লাগলো কথাটা শুনতে। রৌদ্র চোখেমুখে দুষ্টভাব এনে অরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ একটু চেক করে দেখতো এটা আমিই কি-না?”

অরিন কিছু বলবে কিন্তু তার আগেই ঘটলো এক অবিশ্বাস্য কান্ড! রৌদ্র তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজ উদ্যেগে আকড়ে ধরলো মেয়েটার গোলাপি অধর জোড়া। হঠাৎ আক্রমণে ভড়কায় অরিন। পেটে কেমন গুরগুর করছে তার। শরীরে হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত কম্পন।ধরে রাখা জামার অংশগুলোও কেমন কাপছে। প্রথমবার কোন পুরুষের স্পর্শ তাও আবার এতো কাছ থেকে, এমনটা হবার নয় কি?
অরিনের এমন অবস্থা সবটাই অবলোকন করলো রৌদ্র। নিজের কাজ বহাল রেখে মেয়েটার কাঁপতে থাকা হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয় সে। অতপর হাতদুটোকে উঠিয়ে দেয় নিজের ঘাড়ের ওপর। অরিনের কি হলো! মেয়েটা কেমন জড় বস্তুর ন্যায় দাড়িয়ে আছে। হাতদুটো মনে হচ্ছে অসার হয়ে আসছে এখন।
কিছুক্ষণ বাদে রৌদ্র তার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দেয়। অরিনের মুখটা নিজের খসখসে দু’হাতের আজলায় নিয়ে নেয়।অরিনের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে অস্থির হয়ে বলতে থাকে,

“ রেসপন্স কর না সানশাইন! প্লিজ রেসপন্স কর!”
অতপর চোখের পলকে পাগল ছেলেটা আবারও মত্ত হলো নিজের কাজে। প্রায় মিনিটের ব্যাবধানে অরিনও কেমন রেসপন্স করতে শুরু করলো। তার রেসপন্স পাওয়া মাত্র রৌদ্র বুঝি খেই হারিয়ে দ্বিগুণ পাগল হলো। উম্মাদের মতো কাজ চালালো নিজের ওষ্ঠপুটের। তারওপর মেয়েটার পিঠের ওপর নিজের অবাধ্য হাতের বিচরন তো আছেই। অরিন যেন নিজেকে এক অন্য অনুভুতিতে হারিয়ে ফেলেছে ক্রমাগত। কি হচ্ছে তার সাথে। কেন মানুষটাকে আটকাতে চেয়েও পারছে না ও। কেন নিজেকে তার সংস্পর্শে পেয়ে উম্মাদ মনে হচ্ছে। কেন সেও সায় দিচ্ছে এই উম্মাদনায়! নাহ!এত্তোগুলো প্রশ্নের একটারও কোন উত্তর পেলোনা মেয়েটা! সে চোখ বন্ধ করে অনুভব করে যাচ্ছে রৌদ্রের করা প্রতিটি স্পর্শ!

প্রায় মিনিট পাঁচেক পর অরিনের নিশ্বাস আটকে আসে।হাসফাস করতে থাকে মেয়েটা। তার ওমন হাসফাস দেখে রৌদ্র তাকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে ব্যাকুলের মতো লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকে মেয়েটা। ওদিকে রৌদ্র অস্থির! সে আবারও অরিনের মুখটা হাতের আজলায় নিয়ে অস্থির হয়ে বললো,
“সানশাইন! প্লিজ আরেকবার! প্লিজ জান।”
অরিনের এবার মেজাজ খারাপ হয়। মুখ ফুটে কিছু বলবে তার আগেই রৌদ্র তার ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে ধরে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ হুশশ! এখন আর কথা নয়। চল!”

বলেই সে আবারও দখল করে নিলো অরিনের ঠোঁটযুগল। অরিন একবার চাইলো রেসপন্স করবে না কিন্তু তার মন সেটায় সায় দিলে তো! এই বদ্ধ উন্মাদের উন্মাদনায় সায় না দিয়ে উপায় আছে তার?
অধরজোড়ার কাজ বহাল রেখেই রৌদ্র এবার অরিনকে কোলে তুলে নেয়। অরিন ভড়কে গিয়ে তার পাদু’টো দিয়ে রৌদ্রের কোমড় পেচিয়ে ধরে। রৌদ্র সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসে। অতপর নিজের গভীর আশ্লেষ, অরিনের অধরে চালানো অবস্থায় তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আগের চেয়ে দ্বিগুণ আশ্লেষে নিজেকে হারিয়ে ফেলে অরিনের অধর মাঝে। তার অবাধ্য হাতের বিচরন অরিনের সম্পূর্ণ সর্বাঙ্গে। এহেন অবাধ্য হাতের বিচরণে মেয়েটা আবারও কেপে ওঠে। বুকটায় কেমন ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে!মাথাটাও কেমন ভো ভো করে ঘুরছে। অরিন নিজেকে সামলাতে না পেরে রৌদ্রের ঘাড়ে নখ দাবিয়ে দেয়। এতে বুঝি আরেকদফা খেই হারালো ছেলেটা! অধর ছেড়ে দিয়ে মুখ নিয়ে আসে অরিনের গলার ভাজে।ছোট ছোট চুমুতে কাপিয়ে তুলে মেয়েটাকে। কিয়তক্ষন বাদে সেখানে মৃদু কামড় বসায় রৌদ্র।তক্ষুনি মৃদু শীৎকার ভেসে আসে অরিনের থেকে।রৌদ্র মেয়েটার কন্ঠদেশে মুখ রেখেই বলে ওঠে,
“তুই জানিস না সানশাইন, কতটা তীব্রভাবে চাই তোকে,”

রৌদ্রের কণ্ঠ কাঁপছে। তার আঙুল অরিনের চিবুক তুলে ধরল, চোখ রাখলো মেয়েটার ঘোলাটে চোখে।
“তোর একেকটা ঘন নিঃশ্বাস আমাকে উন্মাদ করে তোলে জান!”
অরিনের কি হলো কে জানে! সে কেমন আলতো করে হাত রাখলো রৌদ্রের গালের ওপর। রৌদ্র সেই হাতটা সযত্নে চেপে ধরে ঠোঁট ছোঁয়ায়।মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগলো,
“ সানশাইন তোকে একটু গভীর ভাবে ছুয়ে দিলে তুই কি খুব রাগ করবি? বল না খুব রাগ করবি?”
অরিন নির্বাক! চোখ যেন চড়কগাছে রুপান্তরিত হয়েছে মেয়েটার!সকল ঘোর যেন এ কথাটা শোনামাত্র নিমিষেই ফুড়ুৎ! মেয়েটা আমতা আমতা করে কোনরকমে বললো,

“ ডাক্তারসাহেব!প্লিজ! ”
রৌদ্র এবার সরু দৃষ্টি ফেলে অরিনের ওপর। সন্দিহান গলায় শুধায়,
“ তুই কি রেডি না সানশাইন?”
অগত্যা এমন কথার পিঠে মৌন রইলো অরিন।চোখবুঁজে ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলে সে।রৌদ্র বুঝি নিজের উত্তর পেয়ে গেলো ইতোমধ্যে। সে কিয়তকাল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ে তারওপর থেকে। অতপর মেয়েটার হাত ধরে তাকেও উঠিয়ে বসিয়ে দেয় বিছানায়। অরিন মাথানিচু করে বসে রইলো। হয়তো লজ্জা কিংবা দ্বিধা! রৌদ্র বেশ বুঝলো মেয়েটার মনের অবস্থা! সে অরিনকে বুকে জড়িয়ে নিলো।মেয়েটাকে অভয় দিয়ে বলতে লাগলো,
“ মনে এতোটা দ্বিধা রাখতে হবে না সানশাইন! আমি সরি সোনা।নিজেকে কেমন কন্ট্রোললেস করে ফেলেছি ইতোমধ্যে! যাইহোক, আজকে কথা দিচ্ছি জান, যতদিন তুই নিজ থেকে আমাকে না চাইবি ততদিন আমি তোর এতোটা কাছাকাছি আসবোনা।”

তড়িৎ মাথা উঠায় অরিন। তার এহেন ছলছল চোখজোড়া দেখে রৌদ্র স্মিত হাসলো। বললো,
“ ধূর বোকা! আবার কাঁদছিস কেন?”
“ আপনি আমার ওপর রাগ নিয়ে এসব বলছেন তাইনা? ”
রৌদ্র এবার খানিকটা জোরেই হাসলো।মেয়েটার গালদুটো টেনে দিয়ে বললো,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৫

“ আরে নাহ! আমার এমন মিষ্টি একটা বউয়ের ওপর রাগ করে কি আর থাকা যায়?”
এহেন কথায় খানিকটা লজ্জা পেলো অরিন।সে মাথানিচু রেখে লজ্জালু হাসে।তা দেখে রৌদ্র ভরাট কন্ঠে বলে,
“ অপেক্ষা করে যদি ভালো কিছু পাওয়া যায়, তাহলে অপেক্ষাই শ্রেয় সানশাইন!”

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here